লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সম্পর্ক মণ্ডলের কবিতা

বিশ্বসংসার

অভিমানের তালা খুলতে গিয়ে
হাত ব্যথা করে। ব্যথার চাবি খুঁজতে গিয়ে
দেখা যায়
সে চাবি মহাশূন্যের অনেক নীচে পড়ে

সাঁঝসকাল। দিবানিশি। ঘুলঘুলি দিয়ে দুঃখের
কিরণ এসে পড়ে গায়ে।

অভিশপ্ত ঘরের ভেতরে দু’জন
দু’জনকে ক্ষতবিক্ষত করি।
মহাজাগতিক চিৎকার করে সারাবাড়ি
তোলপাড় করে তুলি।

তারপর দুজনের মুখের সামনে অন্ধকার গড়িয়ে নামলে
দুজনেই শব্দহীন উড়তে উড়তে

নিজেদের ডানা দিয়ে
একে অন্যের ক্ষত থেকে
রস মুছে দি

ইহকাল

জন্ম হে
এই আবাল্যভূমি থেকে আমাকে নিস্তার দাও।
চোরের হাতে শৈশব লুটের দেশে, দিনরাত্রি,
সাপের মুখে শুয়ে ইঁদুরের মতো ভয়ে থাকি।
বিগতশোক। ঋতুস্পর্শ। আলগোছে মৃত্যুমালা পরে
ভৈরবীর ঘরে বাস করি

জন্ম হে
শুধু নির্বিকল্প এই সমাধি জীবনে
সুপ্ততাপ নিয়ে গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা আমাদের

কুলীন কৃষকবৃত্তি নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা

আর ডিমের ভেতরে হলুদ স্বপ্নের মতো

ভমরী হে
এই জন্মদোষ শুকনো পাতার মতো আগুনের
মরমীদেশে উড়ে যায়

কৃষ্ণ

ঋজু গাল। লম্বা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
তিনদিন স্নান না করা শরীর নিয়ে
সে চলেছে
দূরে মাঠের পথে

সঙ্গী বলতে একটি প্রভুভক্ত ভেড়ার পাল।
কয়েকটি বন্ধু রাখাল

আলপথে যেতে যেতে তারা থামলো
যেখানে বৃদ্ধ বটগাছ
তার ডানা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে
সেখানে রাখালদের পাঠ বসবে আজ
বেলা করে

‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরবে বলে..’

স্বভাব

প্রিয়পাত্র কেউ হয় না গুরু

সবাই শুধু বাহানার ইতিহাস লেখে
চুপিচুপি

রাত্রিচর উঠে আসে। দিনের শ্রম গড়িয়ে নামে।
এই হল
আমাদের বেঁচে থাকা

শব্দহীন। হা ঘরে। যাযাবর মন নিয়ে
কেবলই পালিয়ে যাওয়া

দূরে

আরও দূরে

আপন অন্তরে

পাখিরা

মেঘের ফাঁকে বিভা আছে। মেঘের ঘন ফাঁকে আছে
মাদকরসের কুয়ো।

পাখিরা রোজ মেঘের ভেতরে গিয়ে সে বিভাতে
আচ্ছাদিত হয়। তারপর মাতাল বাতাসের সাথে
ডানা মেলে উড়ে যায় গহিন রসের তলে।

মানুষের বিভা জুড়ে সারাদিন মেঘ করে থাকে। মানুষ সুউচ্চ
মেঘের দিকে চেয়ে হতাশ হয় বারবার

পাখিরা সেই হতাশাকে জানে। পাখিরা মানুষের বিভা থেকে
তাই

বারবার ফিরে যায়
মাদকাসক্ত মেঘের জানলায়

প্রাগৈতিহাসিকদের ছেলেবেলা

যৌনকামনা নেই। বনজ গন্ধ নেই।
শুধু বুকের গোপন চৌহাদ্দিতে হাহাকার লেগে
থাকে তার

দুঃখও আছে, তবে তার গহিন গহ্বরে লুকিয়ে আছে
অকালে তারা হয়ে যাওয়া মায়ের মুখ

দুপুরে। একা। পুকুরপাড়ে বসে
ভ্রমণের মতো ঘুরে ঘুরে
মধুপানের ছলে

ভ্রমে
বিশাল এক
পৃথিবীর ভেতরে ঘুরে বেড়ায় সে

কিশোরবেলার বনে বনে

হে জীবন

ঘুম নেই। এই কুয়াশামাখা জীবন
যেন অন্ধকূপ থেকে ডেকে নিয়ে

চলে যাচ্ছে
সুদূরে

কষ্টভোগ। গতযৌবন। শোকপ্রকাশ।
এইসব ফেলে আসা স্মৃতিপট
ক্লান্ত এখন

অন্ধকারময়ী দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে আমায়
গত জীবনের দিকে

দূরে
অবকাশে
সাঁঝবাতির মতো কয়েকটি তারা জ্বলে উঠলো
মৃতপ্রায় বন্ধুত্বের মতো

খিদে

খিদে একটি যৌনবোধ
প্রতিদিন তার প্রাচীন আবেগে
কেঁপে ওঠে দেহ

কাঁপতে কাঁপতে খুনি মাথা
এসে বসে মনের চাতালে

এই সময় কেউ প্রিয়জন হয়ে
উনুন ধরায় রোজ

বিপন্ন সময়ে এসে তার অন্নজলের প্রয়াস
মনে হয়
এই বুঝি—

আসবে খিদের উপশম

পুরানো মলমের মতো তার জ্বলন্ত উনানে
উপশম রান্না হতে থাকে
আর খুনি মাথা খিদের সমস্ত ব্যর্থতা নিয়ে
দা হাতে পায়চারি করে
মনের চাতালে

গ্রাম্য দেহাতির প্রতিদিন

হাসনুহানার বাহারি সুবাসে সন্ধে এই গা ধুয়ে এল। তার পায়ের নীচে আজ জমি নেই। ভাবছে পরকরুণাতে যেটুকু বিশ্রাম আছে, সব তার খাটিয়ার উপর রাখা হবে। সাথে অল্প চালভাজা মুড়ি, গুড়ের বাতাস। এই নমস্য সংসারে তার ফিরে যাওয়াও মানা, শুধু আঁচল জড়িয়ে প্রণামের ভঙ্গিতে দেখে নিয়েছে সে বাড়ির চৌহাদ্দিতে একা শিকারি প্যাঁচা ওত পেতে আছে। এ’সব চিন্তায় তার মাথা ঝিমঝিম করে, চিন্তার জলরাশি দু’কূল ছাপিয়ে রাখে।

নুন আছে, পান্তা নেই— এমন আকালের দিনে কোথায় তার পিরিতির জন!

শ্রমিকবৃত্তির লোভে সেই কোন পূর্ণিমাতে
খড়ের চালের গায়ে চাঁদ ঝুলিয়ে রেখে
সে নাগর দেশ ছেড়েছে।

বৃক্ষযাপন

ক্রমশ বৃক্ষের চেয়ে ভারী হয়ে উঠেছি যেন
ক্রমশ শ্মশ্রুজালের আলোয়
ঢেকে যাচ্ছে
আমার সমস্ত ছড়ানো ডালপালা

এ এক পিপাসিত সুখ

যেন আমি কোনো আশমানি পাখি হয়ে
উড়তে উড়তে
হঠাৎ এসে

থেমে গ্যাছি নিষ্ঠাবান আর একটি
বিষাদ বৃক্ষের কাছে

আর বাঁশরিতে সুর তুলছি
হাজার পিপাসাঘন গীতিশতদলের

যেন বসন্ত থেকে আর এক বসন্তের দিকে
আমি সহবৃক্ষের সাথে
আমার বেদনার বাকলগুলি ভাগ করে
নিচ্ছি
মাথা নত করে

Facebook Comments

পছন্দের বই