লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সরোজ দরবারের গল্প

বিক্রি


টিনভাঙা, লোহাভাঙা, কাচভাঙা… সুরটা ক্রমশ কাছাকাছি আসতেই সজাগ হয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। এবার একটা এসপার নয় ওসপার। এই বহুতলটির নীচের তলায় একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। মেন গেট ছেড়ে এসে সামনে খানিকটা শান বাঁধানো জায়গা। তারপর পাঁচিল শুরু। এ বাড়িতে সিকিউরিটি নেই, তবে গেটে রোদ্দুর আছে। খোলা জায়গাটায় প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে রোদটুকু আয়েশ করে পোহান বৃদ্ধ। এই এখন যেমন সেখানেই বসে আছেন।

ব্যাপারির আওয়াজ কাছাকাছি আসতেই হাঁক দিলেন, এই ভাই এদিকে শোনো তো দিকি?
—ভাঙাচোরা কিছু আছে নাকি দাদু?
বৃদ্ধ একটু হাসেন। তারপর বলেন, না হে, এই চশমাটা দিয়ে দেব ভাবছি। নেবে?
বৃদ্ধ নিজের চোখের দিকে আঙুল দেখান। ব্যাপারি যারপরনাই অবাক হয়। বলে, সে কী! তাহলে দেখবেন কী করে!
বৃদ্ধ বলেন, সুন্দর তো আর কিছু দেখি না আজকাল। খামোখা রেখে কী লাভ?
ব্যাপারির যেন একটু মায়া হয়। বোঝে, এই বড়ো বড়ো ফ্ল্যাটগুলিতে সবথেকে নিঃসঙ্গ আর অসহায় হল এই বয়স্করাই। কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে সে বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
—তা দাদু, কী কী দেখেছেন এই চশমায়?
   —সে কী আর বলে শেষ করা যায়!
—তাও বলুন দু-একটা। শুনি।
  —তোমার হাতে কাজ নেই নাকি? এখন বসে বসে গপ্পো শুনবে!
—কাজ আছে। কিন্তু এই আপনাদের মুখের কথাগুলো শোনাও তো কাজ, বলুন?
—বেড়ে কথা বলো তো হে!
—ওই আর কী! ভাঙা জিনিস কিনে আর কথা বেচেই তো খেতে হয়।
—একান্তই তাহলে শুনবে!
—এই শুনব বলে বসলুম।
ঝোলাটা পাশে রেখে, সে সিমেন্টের উপর বসে পড়ে। বৃদ্ধ বলেন,
—বেশ তবে শোনো। তখন আমার অল্প বয়স। সদ্য বানিয়েছি চশমাখানা। একদিন কী দেখলাম জানো, গান্ধীকে হঠাৎ মেরে ফেলা হল।
—বাপরে! সে তো বিশাল ব্যাপার। আপনি তখন সেখানে ছিলেন নাকি দাদু?
—আরে শোনোই না। নাও থাকতে পারি। তবে, ধরে নাও ছিলাম। নইলে গল্পটা জমবে না।
—বেশ ধরছি, বলুন।
—সে তো গোটা দেশে একেবারে হই হই কাণ্ড। বুকের রক্ত চলাচল যেন আটকে যায় শুনে। গান্ধীকেও যে কেউ মারতে পারে, কেউ ভেবেই উঠতে পারেনি। পরে নাথুরাম বলেছিলেন, আমি এমন একজনকে মারছি যার অপরাধ কোনও বিচারব্যবস্থা ধরতে পারে না। ফলে সাজাও দিতে পারে না। তাই তিনি নিজেই সে দায়িত্ব পালন করলেন। গান্ধী না সরলে নাকি গান্ধীতন্ত্র থেকে দেশের শুদ্ধিকরণ সম্ভব নয়। আমি আজও ভাবি জানো, গান্ধী তো না হয় মরে বেঁচে গেলেন, দেশ কি শুদ্ধ হল?
—তাই-ই আবার হয় নাকি!
—কী করে বুঝলে!
—বুঝি দাদু। সবই বুঝি। ভোট দিই কি না, না বুঝলে চলবে কেন?
—বুঝে ভোট দাও? বলছ? ঠিক বলছ তো?
—বুঝি। না বুঝে কেউ ভোট দেয় না। যে বলে বোঝে না, সেও বুঝেশুনেই না-বোঝে। বুঝলেন!আপনি বরং আপনার গল্পটাই বলুন।
—গল্প আর কী! কেন গান্ধীকে হত্যা করেছিল, সে কথা জানিয়ে কোর্টে নাথুরাম বহু কথা বলেছিলেন। সে এমন সব কথা যে, এক বিচারক পর্যন্ত পরে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, মানুষের রায় নিলে সেদিন তাঁর বিচার করাই সম্ভব হতো না।
—মানে, এখনকার গানের শো-এ ভোট দেওয়ার মতো ব্যবস্থা থাকলে বেঁচে যেত বলছেন?
—হ্যাঁ, তাই-ই তো বলেছিলেন বিচারক।  সেও কতদিন আগের কথা। কিন্তু আপদ কী জানো, এই হতচ্ছাড়া চশমাটা পরলে দেখি, রোজ নাথুরাম এক একটা লোকের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর রোজ গান্ধীহত্যা হয়।
—কই, হয় না তো!
—হয় হয়। আমি রোজ দেখতে পাচ্ছি, যা কিছু কুৎসিত, উগ্র তাই-ই রোজ বিক্রি হচ্ছে। একবার এ-হাতে, একবার ও-হাতে।
—কিন্তু দাদু, ওই যে বললেন, বিচার ছুঁতে পারে না এমন অপরাধী…
—তারা তো এখনও আছে। গান্ধীর বেলায় যে দোষ ধরেছিলেন নাথুরাম, সেরকম লোক দিব্যি আছে। বিচার তাদেরও ধরতে পারে না। দিব্যি বুক ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
—তা বটে!
—অথচ কি জানো শুধু ওই কুৎসিৎ উগ্রতাটা রোজ ফিরে ফিরে আসছে। সকলেই গান্ধীহত্যা ফিরি করছে। নিজেদের স্বার্থে। তাই রোজ খুন হতে হচ্ছে গান্ধীকে। তা বাপু, রোজ খুনখারাপি দেখতে কার ভালো লাগে বলো দিকি!
   —তাও বটে! এ তো তাহলে খতরনাক চশমা দাদু!
—সে আর বলতে!
—তা, রক্তারক্তি ছাড়া আর বুঝি কিছু দেখেন না?
—দেখি তো। একদিন কী দেখলাম জানো, ভ্যান গখের সূর্যমুখী কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে গেল।
—সূর্যমুখীর দাম এত! সে কী! নিশ্চয়ই দুর্লভ জাতের! কিন্তু তাতে দোষের কী হল দাদু?
—কিছুই না। আমি শুনেছিলাম, লোকটা গোটা জীবনে মাত্র একটা ছবি বিক্রি করেছিল।  তাও মৃত্যুর মাস সাতেক আগে। তারপর তো সারাজীবন ধরে টাকার টানাটানি আর টানাটানি।  তবু কিচ্ছু বেচেনি। একবার ভাইকে চিঠি লিখে বলেছিল, ছবির মধ্যে তিনি মাটির গন্ধ রেখে দিচ্ছেন, প্যারিসের সমৃদ্ধির ভিতর যা মিলবে না। সেই গন্ধও তো তাহলে বিক্রি হল শেষ পর্যন্ত। প্রাইস আর ভ্যালু– দুটোরই মানে এক করে দিল এই হতভাগা চশমা।
—অঅ… তা এরকম বিদঘুটে কিছুই দেখে চলেছেন চশমা পরে?
—তাই তো দেখছি।
—কই আর কিছু বলেন দিকি!
—আচ্ছা, জীবনানন্দ দাশ নামে একজন লোক ট্রামে চাপা পড়েছিল, জানো তুমি?
—কোন পাড়ায় বলুন তো! কই সেরম তো শুনিনি কিছু!
—সে লোকটাও সারাজীবন সব বুকে করে আগলে বসেছিল। ট্রাঙ্কে ভরে। একদিন দেখলাম, স্টেজে নীল আলোয় জীবনানন্দও বিক্রি হচ্ছে। লোকে টিকিট কেটে কেটে দেখতে যাচ্ছে আবার…
—কিছুই বুঝছি না দাদু। শুধু এটুকু বুঝলাম, আপনার চশমাখানা কিন্তু মোটেও ভালো নয়। একটা ভালো জিনিস দেখায় না গো…
—বললামই তো, সুন্দর কিছুই আর দেখতে পাই না।
—তা না দেখেও তো বেঁচে ছিলেন এতদিন। অসুবিধা হচ্ছিল কী?
—আসলে বেঁচে যে ছিলাম না, সেটাই কথা। তুমি সাম্ভাজি ভগতের নাম শুনেছ?
—ভগৎ সিংয়ের নাম শুনেছি। ১৪ ফেব্রুয়ারি, প্রেমের দিন যাঁর ফাঁসি হয়েছিল। আমাদের সেটা মনে রাখা উচিত…
—আরে ধুর, ওটা নির্জলা মিথ্যে কথা। ওসবে কান দাও কেন? শোনো যা বলছিলাম, এই সাম্ভাজি ভগতের একটা অনুষ্ঠান দেখছিলাম সেদিন।  সেখানে উনি বলছিলেন, আমরা তো মরেই গেছি। মরেই আছি। শুধু শেষকৃত্যটুকু যা হয়নি। এবার ব্যাপারটা ভাবো, মরা লোক মরা লোকের সঙ্গে কথা বলছে, মরার সঙ্গে মরার সঙ্গম হচ্ছে। মরা লোক মরা লোকেরই জন্ম দিচ্ছে। আস্ত একটা মরা সভ্যতা কেমন বেঁচে থাকার ভাণ করে চলেছে। বুঝতে পারছ?
—তেমন করে পারছি না। শুধু এটুকু বুঝছি, পুরো ভূতুড়ে কেস তো দাদু। এসব দেখেন বুঝি চশমা পরে?
—হ্যাঁ, ওই জন্যই তো আর ভালো লাগছে না। মানে পারছি না। তুমি বরং চোখে দিয়ে দেখো দিকি একবার। যদি নতুন কিছু দেখতে পাও।
বৃদ্ধ খুলে দিতে ব্যাপারি চশমাখানা হাতে নিয়ে সত্যিই চোখে দিল। একবার বৃদ্ধের দিকে আর একবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ও দাদু, এ হল কী! এই একহাত দূরে আপনি, আপনাকেই তো আর দেখা যাচ্ছে না।  একেবারে এইটুকুন হয়ে গিয়েছেন যে। ফুটকির মতো। আর ওই জো রাস্তা, দিব্যি তো লম্বা, নাকের ডগায় উঠে এসেছে একেবারে, যেন নামলেই গড়িয়ে যাব, বেশ সুন্দরই তো দেখাচ্ছে…
      সুন্দর! বার দুই কথাখানা নাড়াচাড়া করে বৃদ্ধ বললেন, তাহলে তুমিই ওটা নাওগে যাও।
ব্যাপারি নেবে কি নেবে না জানাতে কিছু একটা উত্তর দেবে বলে চশমাখানা খুলতে গেল, আর ঠিক তখনই, ঠক করে সেটি গিয়ে পড়ল শান বাঁধানো চাতালে। কাচগুলো ভেঙে খানখান।
—যাহ্‌ দাদু, ভেঙে গেল যে।
—তা তো যাবেই।
—ইসস আমার জন্যে…
—জানতাম ভাঙবেই। না ভাঙলে, তুমি নেবেই বা কী করে! তোমার তো ভাঙা ছাড়া, গোটা নেওয়ার জো নেই। যত ভাঙা তত তোমার লাভ!
—আমি নিলে কিন্তু আপনাকে পয়সা দিয়ে দেব…
—সে না হয় দিলে। কিন্তু চশমাটা চোখে দিয়ে আর তো কেউ ওসব দেখবেও না। সব অন্ধকার হয়ে গেল…
      ব্যাপারি আর কথা বাড়াল না। ভাঙা চশমাখানা তুলে নিয়ে ঝোলায় পুরে ফেলল। বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বলল, রোদ চলে যাচ্ছে আজকাল। বড্ড তাড়াতাড়ি।
       ব্যাপারি এবার আর সে কথায় কানই দিল না। বুড়োর আড্ডায় দিন কাটালে তার চলে কী করে! সে এগিয়ে যায়। বৃদ্ধ শুনতে পায়, সেই একই সুর, একই কায়দায় সে যেন বলে চলেছে, টিনভাঙা, লোহাভাঙা… দেশভাঙা!

Facebook Comments

পছন্দের বই