লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সিন্ধু সোমের গদ্য

স্লিপ প্যারালাইসিস

পাড়ার বাসন্তী ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসেন পশ্চিম সীমান্তে…অনেকক্ষণ ধরে একটা পিউ কাঁহা ডেকে যায়…আজকাল এই ডাক বড়ো নিরলস লাগে… বড়ো বেশি ক্লান্তিহীন… যেখানে পুকুর ছিল তার গাঢ় বুকের দাগ নিয়ে সেইখানে বিবসনা মাটির রোম… তাতে ছাগল বেঁধে রাখে কেউ… প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কতদিন বেরোতে পারি না… তালগাছে হাওয়া দিলে সে-হাওয়ার শান কাটা বোধ মাথার থেকেও অনেক পিছনে বাস করে… হয়তো চোখের থেকেও পিছনে আজকাল মনে হয় চোখ মাথা ছড়িয়ে ছড়িয়ে থাকে… অবস্থান করে… এমনটা মনে হলে আমার ঘুম আসে খুব… বিছানায় শুয়ে খেয়াল হয়, আরে! আমার না মাথা বাজছিল! কে পায় কাকে! বিছানার প্রতি বুননের বীজে শিব শক্তির ওম… সে-ওম মৈথুন ছাড়িয়ে মাংস চেখে দেখতে বুকের ভিতর বেজে যেতে থাকে… ঝা ঝম ঝা ঝম… দূর থেকে কাকের ডাক শুনি… মাথাটা চেপ্টে গিয়ে এই বুঝি মিশে গেল বালিশের সাথে… আকাশটা বিভূতি মাখে… আমি বিভূতি মাখি… মুখপোড়া নদী দুটো বিভূতি মাখে…

আমাদের বাড়ির পিছনে টিনে ছাওয়া নীচু ঘর… ও-জায়গাটা আমাদের কিনে নেওয়ার কথা ছিল… কথাটুকুই… তারপরে মাজিদের ছোটো ভাই নিল… তেওয়ারি জেঠুর জায়গার ওপর মাজির বেটা ঘর রেখেছে ভাড়াটিয়া বসাইছে… ভাড়ার ঘরে এক কাঠ মিস্ত্রী… টিয়ার ঘরে একপাল ছাগল… সে-ছাগলের মালিক তার দুই মেয়ে বউকে নিয়ে পাকা ঘরে থাকে… ঝোপ মাখা কালি মাখি মাটিগাঁথা ইঁটের পাঁজরায় কাঠ ঠোকার শব্দ আসে ঠুক ঠুক… সেই শব্দ ঘষা ঘষা জোৎস্না গড়িয়ে এসে দুইয়ে মাখামাখি একে মাখামাখি খানিক দূরে রেললাইনের শায়িত লম্বা নিস্তব্ধতার ডানায় নিপাট একটা অবয়ব গড়ে উঠলে আমার না চলা দৃষ্টি তাকে ছাড়িয়ে আরও পিছনের দিকে যেতে থাকে। আগের গল্প বরাবর বেড়ার ভিতরে সাধকের দাড়ি গোঁফে মাখা…ওপারের দিকে যা থাকে তা একটি অনুমানের অবয়ব… ছোট্ট কালো মেয়ে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করছে শুধু… নিজে বাঁধছে না… বরং আমাকে ঠেলে দিচ্ছে… সাধনাকে ঠেলে দিচ্ছে…সেই হারামজাদা পৌঢ়কে ঠেলে দিচ্ছে তার হাঁ করা লাল জিভের পিছনে… আরও পিছনে…যেখানে মহাবিশ্বের খেয়াল আসে… যেখানে লাভক্র্যাফ্ট একটি সাইকেলে চড়ে দ্রুত বেগে আমাকে পাশ কাটিয়ে যান…

সেইখানে দাঁড়িয়ে একটি নিতান্তই কালো বরণ ছেলেকে কব্জি ডুবিয়ে নিঃশব্দ খেতে খেতে রোগা আরও রোগা হয়ে মিলিয়ে যেতে দেখলে…আমার ব্রহ্মাণ্ডবোধ পূর্ণ হয়… ইমিলাবার আগে আমায় সে দেখিয়ে গিয়েছিল… তার হাড়ের রং কালো… তার জিভের রং ফ্যাকাশে… তার চোখের রং জ্বলন্ত সাদা…

দেখতে দেখতে ভুলেই গিয়েছিলাম আমারও মাথাব্যথা ছিল…

মরা মাছিদের বৃষ্টি হচ্ছে… পাড়ায় কাদের ঘরে বাপ আর মেয়ের প্রচণ্ড চিৎকার উত্তরোত্তর বেড়েই চলে… বাপের গলার সামনে মেয়ের সরু খড়ের স্পন্দন নেহাৎ কীসের জোরে ধোপে টিকে যায় পৃথিবীর কোনো শক্তিমানের ইতিহাস তা জানাতে পারে নাই… পারবেও না বোধ করি… সূর্য ডোবার পরে যেটুকু থাকে তা বোধ… এই বোধ আমার কানকোর পাশে ঘাই দিতে থাকলে আমি বুঝি আমার মাথা ব্যথা ছিল… এখন যা আছে তাকে বরং রেশ বলা চলে… ব্যথার বৈশিষ্ট্য হল যে, সে মাথা আশ্রয় করে থাকে…চোখ কান দিয়ে যা কিছু ঢুকে পড়ুক ব্যথার ব্যাপ্তি এই করোটির বাইরে হয় না… কিন্তু রেশের ব্যাপারটা অন্য… বিকেলের চাপা গরমের একটা ধূসর প্রতিচ্ছবি যেমন সমস্ত দৃশ্যমানে ফুটে ওঠে… পাড়ায় শাঁখের আওয়াজ, উনুনের কটুমিঠে গন্ধ, গোরুছাগলের দল বেঁধে ফেরা, তেলেভাজার দোকানের সামনে মানুষের সার সার ভিড়… অথচ কোথাও সমস্ত কিছু যে আটকে গিয়েছে, আর কিছুক্ষণ পরে এ-সমস্ত দলা পাকিয়ে ঝিঁঝি মেশা খাঁ খাঁ শূন্যতা, পোড়ো বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে একটা শিয়াল… তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করার মতোও ন্যূনতম আলো তখন যে থাকবে না, সন্ধ্যের মলিনতা তার ছাপ বয়ে ফেরে… সে-ছাপের দিকে পিছন ফিরে ছাতের মাদুরে ভ্যাটাকায় শুলে আকাশ তার গতর নিয়ে আমার মুখের ওপর নেমে আসে… পাছায় ঘাড়ে পুরানো মাদুরের পিঁপড়ে কামড়াতে থাকে… কতদিন এভাবে শুই না… দুটো মেঘ হাতে গোনা যায় না… তবু আরামের আতিশয্যে গুনে ফেলি… ঘোষেদের বাড়িতে ঢুকেই হাত পা ছাড়া উঠান… তার ওপারের গোয়ালঘর থেকে নাদার গন্ধ আমার বহুদিনের জমাট বেঁধে ওঠা দীর্ঘশ্বাসগুলোর গাল টিপে দিয়ে যায়… গোরু ডাকে… পাশের বাড়ির চিলেকোঠায় পীযূষদা ইলেকট্রিকের কাজ করে… খানিকটা টুং খানিকটা টাং কোথাও-বা ঠাক… পীযূষদার হোটেলটা সবকিছুর সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে… এ-সমস্ত হয়তো খুলবে… তবু সব খুলবে কি? কত চোখের পাতা এ-সময় বিশ্রাম চেয়েছিল চলমানের কাছে তার তালিকা এই চেতনাকে… এই সজ্ঞান নির্জ্ঞানের ভিড়ে ক্রমাগত পালিয়ে ফেরা না-অবয়বকে কে দেবে?

সাধনার পথ বড়ো দুরূহ… এক-একটা সময় বোধ হয় এই তো… করোটির ভিতর মরণের রেশ মাখিয়ে দিচ্ছি চারিদিকে… বাইরে উত্তুঙ্গু শ্মশান… নেড়ানেড়ির দল পর্যন্ত জুটে গিয়েছে…বেশ আছি… চিতার ওপর মড়ার হাড় মুখে করে এবার শুধু দারোগাকে ভয় দেখানোর পালা…৷  অবধূত মলিন হাসেন… আমার ঘরের পাশে একটি কাঠের মিস্ত্রীর ঘর… বসে এখনও বুঝে উঠতেই পারল না চিতায় এতগুলো কাঠ তুলে কী লাভ!…

যা পোড়ার তা মানুষ তো মরার আগেই পুড়ে গেছে…


হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে বুঝি বাইরেটায় কোনো বোধ আর অবশিষ্ট নাই… এ এক আজব রাতের স্বরলিপি… পরির ডানা হাওয়ায় পাক খায়… তাকে কেমন অস্পষ্ট স্বচ্ছতার দিকে চলে যেতে দেখি… এইরকম করে বাপিদার ভাইপোটাও হারিয়ে গিয়েছিল… ঘোষেদের দুই ভাইয়ের মধ্যে শরিকি বিবাদ বাঁধলে বড়ো ভাই দা হাতে জায়গা ধরে থাকে… ছোটো ভাইয়ের মেয়ে বউ বেরোয় হেঁসো নিয়ে… তখনও এতটা রাত হয় নাই বোধহয়… উতোল চিৎকারের মাঝে চার বছরের ভাইপো এসে পড়ায় থমকে গিয়ে ঝগড়াটা এত জোরে ফুঁসতে থাকে তার আওয়াজ পেয়েছিল ওপাড়ার ধলো বুড়ির মা… বাপিদার ভাইপো তার চিনচিনে গলা তুলে চিল্লায়, শালারা বাইঞ্চোতেরা, মুখ মারা ছাড়া তুদের গুষ্ঠির কাম নাই কুনো? তারপরে ঘোষেদের অবাক করে দিয়ে সে সাত জোড়া চোখের সামনে গুঁড়া গুঁড়া ছড়িয়ে যেঞে উড়ে যেন কাঠচেরাই গুঁড়া… পড়ে যাওয়া বড়ো আমগাছের গুঁড়ি যেবার কাইটে লিয়ে গেলেক আদুরি মেঝেন অনেকটা তার পারা… পিছনের ঘরকে বাসব মদে টোর হয়ে আইসিছিল… সে লাকি শুনেই নাই কিছু… তা শুনে নাই তো শুনে নাই… তাতে হাওয়ার কী?

ভাবি সেই গুঁড়া বুঝি উড়ে এসে নাড়া দিতে চায় ব্যালকনির দরজার পাল্লায়… কিন্তু খোলা থাকার দরুন তাকে পর্দায় ধাক্কা দিয়েই কাম সারতে হয়… ওইখানে কোনো আলো নাই… অথচ অন্ধকারের রকম ফেরে জিনিসগুলো ফুটে ওঠে বেশ স্পষ্ট… অনেক দিনের চেনা যেন… ঘরটাকে আমার বলেই মনে হয়… কিন্তু পর্দার নড়তে থাকাটা ধীরে ধীরে বেড়েই উঠতে থাকলে আমি ঘরের দিকে চোখ ফিরাতে পারি না… আমার নাকের নীচে কোনো সাড় এতক্ষণ বোধ করি নাই… একটা ভয়ার্ত দীর্ঘশ্বাসের পরেও কিছু বোধ করতে পারলাম না… মন বলছে ঠোঁটটা একবার ভিজিয়ে নিতে পারলে হত…অথচ ঠোঁট কিছুই বলছে না…

দরজার ওপারে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে? মনে‌ হল একটা ছায়া সরে গেল… ছায়ারা মাটিতে ঘোরে না… বইয়ের তাকটার পিছন দিকে নজর বড়ো গাঢ়… অন্ধকার চলে না… আঁটোসাঁটো দেয়াল তাই কী ঢেকে রেখেছে স্পষ্ট দেখি না… কিন্তু ছুঁড়ে দেওয়া দৃষ্টি ফিরে এলে বুঝি তা আর এক নাই… সেখানে কিছু একটার ছাপ অথবা শূন্যতা রয়ে গেছে… মাথায় কাঁটা দেয়… কিন্তু আমি চুল রেখেছি বছর খানেক হল… সে-চুল দাঁড়ায় না… দাঁড়ানোর ভান করে মাত্র… ভুরুর ওপর দিয়ে একটা শ্যামাপোকা অতি ধীরে চোখের দিকে এগিয়ে আসে টের পাই… চোখ বন্ধ হয় না… শুধু নজর এদিক ওদিক ঘোরে…পালাতে চায়… ছায়াটা আবার সরল… আমার চিৎকার পায়… শরীরের ভিতর থেকে উঠে আসে যে-আওয়াজ তার গভীরতা বেশি… ছাগলের মালিকের ঘর থেকে তার বছর ছয়েকের বাচ্চাটা অন্ধকারে এক-একবার এরকম চিৎকার করে ওঠে… সে-চিৎকার কলিজা পাকিয়ে পাকিয়ে বেছে বেছে তোলে মাংসখেকো পোকা… আহা তাতে বড় আরাম… আমি যদি সেইভাবে চেঁচাতে পারতাম… কিন্তু গলা স্থির… সেই থমকে যাওয়া মাথার মধ্যে এক অপর গলার জন্ম দেয় যেন… সেই গলা তারস্বরে চেঁচায়— হ্রুউউউউউ হ্রুউউউউউঘঘঘঘঘ্… বোঁ বোঁ করে এক জাতীয় শব্দ ওঠে… তবে সেটা এত ভোঁতা তাকে রণন বলা চলে মাত্র… বইদেয়ালের পাশের জানলা ঘিরেছে বই মাকড়সার জাল… তার ফাঁক দিয়ে মেঘে ঢাকা এক হলদেটে আভার আভাস আসে… তাতে আলো নাই… রাতজাগা একচক্ষু কোনো আদিমতার আর্তনাদ রয়েছে… সেই প্রেক্ষাপট খানিক আগে পেরিয়ে গিয়েছে না-অবয়বটা… এখন শুধু মাথার দিক বাকি…

মাথার ভিতরে অজস্র হাত… মাথার ভিতরে অজস্র পা… অথচ সে-সব কোনো কাজে আসে না… ভাবি বিবেকানন্দ এতদূর আসেন নাই কখনো… কালকে বাউরি পাড়ার দুলি বাউরি হাইটেনশান লাইন ছিঁড়ে ঝলসে গিয়েছে…রাতকাবারি ভিড় ঠেলে শরীরটা যখন বার করা হল, তার গায়ের কালো চামড়ার কুঁচকে যাওয়া আমি মন দিয়ে দেখেছিলাম… সে-কালো সজীব। ভরাট কালো নয়… সে-কালো বড়ো বেশি ফাঁপা… গুটিয়ে এতটুকু হয়ে আসা সেই কালো পাপড়ির ভিতরে মাংস থেকে উঠে আসার যন্ত্রণা রয়েছে… রোমকূপ নাই… দগদগে মাংস চুলের নীচে, মুখে… মাড়ি আর ঠোঁটে মাখামাখি হওয়া মুখশ্রী… লাল জিভ এঁকে দেওয়ার ফাঁকটুকু পর্যন্ত নাই… পোড়া মাংসের গন্ধে আমার জিভে জল এসে গিয়েছিল… তারপর থেকেই এই মাথা ব্যথা… রেশ পেরিয়ে ব্যথাটা আবার চাগাড় দিচ্ছে…আমার গোটা দেহের দিকে তাকিয়ে দেখি… হলদেটে জোৎস্না এবার একটু একটু করে ঘরের ভিতরে আসছে… সেই রাবারে মোছা আলোয় বুক থেকে যতদূর নজর পড়ে ততদূর মৃত একটা লাশ পড়ে থাকতে দেখি… বুকের ওঠানামা পর্যন্ত টের পাচ্ছি না…আমি আবার চিৎকার করে উঠতে চাই… এবার মুখ দিয়ে কারো পদশব্দ বেরিয়ে এসে মিলিয়ে যায় আমার ঘাড়ের কাছে…সেই মুহূর্তে… আমার শেষবারের মতো ছুঁড়ে দেওয়া নজর চারদিক থেকে মাথার ভিতরে ফিরে এলে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি আমার মাথার পিছনে পুরো খোলা জানলাটা জুড়ে দুলির পোড়া লাশটা বসে রয়েছে… চোখ বোঝা যায় না… তবে তার নজর আমার শরীরের ওপর স্থির… অনেকটা যেন আমারই নজর বলে ভুল হয়… মুখের গাঢ় অন্ধকারে মাখামাখি সেই মাড়ি ও ঠোঁটের ফাঁকে জোৎস্না জমে হলদেটে তীক্ষ্ণ দাঁত গড়ে দিয়েছে… সেই হাঁ করা শূন্য থেকে গড়িয়ে আসা গোলা গোলা সাদাকালো তরলে থোক থোক লাল পিঁপড়ে জমে থাকে যেন এখনই তা নড়ে উঠবে… কথা বলবে… মুছে দেওয়া জিভের এই প্রত্যাবর্তন আমাকে আরও নিস্তব্ধতার দিকে ঠেলে দেয়… আমার মুখের প্রতিটা নিঃশ্বাস তার পায়ের শব্দ হয়ে সেই কালো পা জোড়ায় জমে ওঠে স্তব হয়ে… আমি আর আর্তনাদ করি না…এ সময় আমার মনে পড়ে আমার পিছনের বাড়িতে এক কাঠমিস্ত্রি ও কয়েকটা ছাগল পাশাপাশি থাকে…

সে সাধনা বোঝে… আর চিতার অপ্রয়োজনীয়তা তাকে একটু একটু করে কুরে কুরে খায়… আহা! যদি শ্মাশানের মাগনা কাঠে একটা খাট তৈরি করা যেত…

Facebook Comments

পছন্দের বই