লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুজিৎ দে’র প্রবন্ধ

মুর্শিদাবাদের বোলান গান: সাধারণ পরিচয়

চৈত্র মাস শেষের দিকে। বছর শেষ হবে। সারা বছর ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষগুলির মনে কীসের এত ফুর্তি! ও শিবের গাজন আসছে। শরতের চারদিন যেমন বাঙালির ঘরের মেয়ে ঘরে ফেরে; চৈত্রের শেষ চারদিন তেমনি বুড়ো শিবের। এই শিবের গাজন আর তাকে কেন্দ্র করে ‘বোলান’ গান পল্লিমায়ের চিরদুঃখী সন্তানগুলিকে মাতিয়ে রাখে এ-সময়।

এমন চিত্র ছিল আগের বছর পর্যন্ত। আর এ-বছর করোনার মৃত্যু ভয়ে কুঁকড়ে আছে তারা। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে জীবন আর জীবিকার তাগিদে আজ তারা অসহায়। একটা একটা করে উৎসবকে ছেড়েছে তারা। মনমরা হয়ে ভাতে মরার দিন যেন সামনে এগিয়ে আসছে। থেমে যাওয়া উৎসবের স্মৃতিচারণায় এই প্রবন্ধের আয়োজন।

বোলান= বোল + আন। যার অর্থ কথা বলা, প্রতিবচন, উত্তর। বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্য যুগের অনেক ক্ষেত্রে ‘বোলান’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়—

“বোলান বুলিতে গেল ময়না বসতি” (রূপরাম চক্রবর্তী/ধর্মমঙ্গল) [১]

“ঘরে গেল্যা না দিয়া বুলান” (কবিকঙ্কণ) [২]

“ডাকিলে বোলান ন দেও” (মনসামঙ্গল/বিজয়গুপ্ত) [৩]

রূপরামের ধর্মমঙ্গলে ‘বোলান’ হল মানসিক ব্রত। কবিকঙ্কণ ও বিজয়গুপ্তের রচনায় ‘বোলান’-এর অর্থ উত্তর-প্রত্যুত্তর বা কথা বলা। নাথপন্থী শৈব যোগী, পশ্চিম ভারতের নিরঞ্জন নাথপন্থী প্রমুখ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বোলান’-এর প্রচার দেখা যায়। ডঃ সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে উত্তর রাঢ়ের মনোহরশাহি পরগণা থেকে একটি ‘বোলান’ গানের নমুনা তুলে এনেছেন—

“যতগুলি বললাম বোলান গো
আরও বলতে পারি
ওস্তাদের নাম অকিঞ্চন
তেঁতুল তলায় বাড়ি
যার বাড়িতে জমি
তোমরা এবার বোলান বল
আমরা এবার বসি।।” [৪]

বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে-বোলান গান প্রচলিত আছে তা মূলত শিবের গাজনকে কেন্দ্র করেই। তবে কখনো কখনো অন্য কোনো অনুষ্ঠান বা মেলায় বোলানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। চৈত্রের শেষ চারদিন যে-শিবের গাজন হয় তার কিছুদিন আগে থেকেই বোলান দলগুলির মধ্যে সাজ সাজ রব ওঠে। তারা তিন-চার দিন ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে বোলান গান করে বেড়ায়। এ হল পালা বোলান। আর এক প্রকার বোলান আছে তাকে বলে ‘সাধলে বোলান’; বা ‘সাজলে বোলান’। শিবের গাজনের বা ধর্মরাজের ভক্তরাই এ-বোলান করে। অন্যদের এ-বোলান করার অধিকার নেই। শিবের গাজন ছাড়াও ‘সর্বমঙ্গলা’ বা ‘শেতলা’ পুজোর সময়ও বোলানের আয়োজন করা হয় অনেক সময়।

সাজলে বোলান ও পালা বোলান উভয়ই প্রচলিত আছে এখন। শিবের ভক্তরা করে সাজলে বোলান। তা মূলত পূজা পদ্ধতির অঙ্গ। আর পালা বোলানে একদিকে যেমন থাকে পালাবন্দী নাটক অন্য দিকে সংগীতের বহুল প্রয়োগ। আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে নারীবেশী পুরুষের চটুল নৃত্য। বন্দনা গান, পালা অভিনয় আর রং পাঁচালির মধ্য দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করে থাকে কুশীলবরা। গানগুলি অবশ্যই লোকসংগীতের ধারাটিকে বজায় রেখে চলেছে।

বোলান গানকে বলতে হয় আনুষ্ঠিক বা পূজাকেন্দ্রিক লোকসংগীত। পালার প্রয়োজনে গানগুলি লোকসমাজের দ্বারাই রচিত হয়। কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা এ-গান রচিত হয় না। দলের বিভিন্ন সদস্যদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক প্রসূত এই গান। গানগুলির প্রচার ও প্রসার ঘটে লোকমুখে। তাই পাঠভেদ লক্ষ করা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। সুরে থাকে আঞ্চলিকতার ছোঁয়া। প্রেম, আনন্দ, অভিমান বা চরম দুঃখ প্রকাশে এর প্রয়াগ। ‘ভিখারি ঈশ্বর’ নামক একটি সামাজিক পালায় দাদা ঈশ্বর তার ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে গান গাইছেন—

“আজকে আমার ভায়ের বিয়ে খুশীর সীমা নায়
আয়রে তোরা সবাই মিলে আয়রে ছুটে আয়
আনন্দেতে সবাই যখন শাঁক বাজাবে
পালকি এসে ভায়কে আমার নিয়ে যাবে।” [৫]

এর ভাষা নিতান্ত সহজ সরল। আর সুরে আঞ্চলিকতা থাকলেও বাংলা বা হিন্দি সিনেমার গান কিংবা প্রচলিত জনপ্রিয় কোনো গানের সুরকে অনুসরণের চেষ্টা করা হয় লোক আকর্ষণের জন্যই। পদ বা পদসমষ্টির পুনরাবৃত্তি অবশ্যই থাকে গানে। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বর্ধমানের কিছু অঞ্চলের লোকসমাজই এ লোকসংগীতের জন্মদাতা ও পৃষ্ঠপোষক।

সামাজিক নানা বিষয়, মনগড়া নানা কাল্পনিক কাহিনির পাশাপাশি পৌরাণিক কাহিনির দেখা মেলে বোলান পালায়। অবশ্যই লোকমুখে প্রচলিত পুরাণ। তাই কোনো গ্রন্থের সাথে এর সত্যতা যাচাই করা অর্বাচীনের কাজ হবে। শিল্প শাসনের বাধা মানে না বোলান। তাই লোকরুচি ও চাহিদা অনুযায়ী এর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। নৃত্য এর একটি জরুরি অঙ্গ। সূক্ষ্ম ভাবের প্রকাশ করতে গিয়ে সুনিপুণ অভিনয় সেখানে হয় না। জোড়ালো ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সংলাপ ও গান পরিবেশিত হয়। পূজা মণ্ডপের মাঝে একটু জায়গা করে নিয়ে, চারিদিকে দর্শকের উপস্থিতিতে কুশীলবরা অভিনয় করে চলে।

একইসঙ্গে গান ও অভিনয়ের প্রাধান্যে বোলান লোকসংগীত ও লোকনাট্যের বিমিশ্র রূপ হয়ে উঠেছে। গানের মধ্য দিয়েই বোলানের সূচনা, গানের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি। মূল পালার মাঝেও সংগীতের ব্যবহার একটু বেশিই। বোলানের প্রাচীন রূপে সংগীত ছিল প্রধান। সংলাপ ছিল সংগীতের মেলবন্ধনকারী। বর্তমানে সংলাপের প্রাধান্য এলেও সংগীত তার নিজের জায়গাটি ছেড়ে দেয়নি। গীতিপ্রধান এই বোলানকে গীতিনাট্যও বলা যায়—

“বোলান গান গীতি প্রধান রচনা। সেই জন্য ইহাদের গীতিনাট্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে”। [৬]

ধর্মঠাকুর ও শিবের গাজনকে কেন্দ্র করে মূল সন্ন্যাসী গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে যে-তর্জা, ছড়া বলে তার নাম বোলান। শিবের গাজনের ভক্তরা তাদের পূজার অঙ্গ হিসেবে লোকের বাড়ি বাড়ি কিংবা তাদের ইষ্ট দেবতার সামনে যে-গান বা ছড়া পরিবেশন করে তাই সাজলে বোলান। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেছেন সাজলে বোলানই হল বোলানের আদি রূপ। সাজলে বোলানের একটি নমুনা—

“আরে সাজলে
ধুল ধুল সাজলে ধুল ধুল ধুল
পড়েছে মায়ের পাতা উদম করে চুল।
আরে সাজলে
শ্মশানে গিয়েছিলাম মশানে গিয়েছিলাম
সঙ্গে গিয়েছিল কে ?
কার্তিক গণেশ দুই ভাই সঙ্গে সেজেছে।
আরে সাজলে কাল বাঞ্ছা খেয়েছিল টুকই ভরা মুড়ি
আজ বাছার মুণ্ডু যায় ধুলায় গড়াগড়ি।।
আরে সাজলে
তুই তো মেরা ভাই সাজলে তুই তো মেরা ভাই
তোর সাথে গেলে সাজলে শিব দর্শন পাই।
আরে সাজলে
ভাল বাজালি ঢেকো ভেয়ে
তোর মা আমার মামি…” [৭]

সাজলে বোলান কেবলমাত্র গাজনের ভক্তরাই গাইতে পারে। অন্যদের অধিকার নেই। সাজলে বোলানের রূপটি বেশি পরিবর্তন হয়নি। দেবতাদের উদ্দেশে প্রণাম জানাতে এবং গ্রামবাসীর মঙ্গল কামনায় আজও এ-ধরনের গান গাওয়া হয়।

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই