লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুবীর সরকারের গদ্য: হাটগঞ্জকোরাস (চতুর্থ পর্ব)

হাটগঞ্জকোরাস (চতুর্থ পর্ব)

৮।

উত্তরবাংলা। এক বর্ণময় ভূখন্ড। আমি উত্তরবাংলাকে দুইভাগে বিভক্ত করি। তিস্তাবঙ্গ আর গৌড়বঙ্গ। আমি তিস্তাবঙ্গের মানুষ। আমি তোরসাদেশের মানুষ। গানভরা নাচভরা উৎসবঘেরা হাটগঞ্জঘেরা সবুজে ভরা এক বহুমাত্রিক জনপদ। এখানকার লোকগান মিথ কিংবদন্তি ইতিকথা সোনার বরণ সব ভূমিলগ্ন মানুষের বর্ণময় যাপন উঠে এসেছে এখানকার লোকগানের কথায় ও সুরে। উত্তরের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকসংগীত হল ভাওয়াইয়া গান। উত্তরবাংলার প্রাণবন্ত লোকসংগীত ভাওয়াইয়া। উত্তরবাংলার শ্রেষ্ঠতম লোকসংগীত ভাওয়াইয়া। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতের জায়মানতায় যুগ যুগ ধরে লোকপরম্পরায় নির্মিত হয়েছে ভাওয়াইয়া। উত্তরবাংলার আদি বাসিন্দা ভূমিপুত্র রাজবংশী জনগোষ্ঠী লালন পালন করেছে কৌম সংস্কৃতির পরিচয়বাহী এই গান। জীবনযাপনের দিনযাপনের সমগ্রটুকুই ধরা পড়েছে এই গানে। হাতি মহিষ গাড়িয়াল গোরুর রাখাল পূজাচার উৎসবাদি বিরহব্যথা নারীজীবনকথা বারমাস্যা— সবই ধরা পড়ে ভাওয়াইয়ায়। সুরেন বসুনিয়া প্রথম ভাওয়াইয়ার রেকর্ড করেন। ক্রমে আব্বাসউদ্দিন নায়েব আলি টেপু কেদার চক্রবর্তী প্যারিমোহন দাস কেশব বর্মণ প্রতিমা বড়ুয়া প্রমুখের দক্ষতায় ভাওয়াইয়া আজ সার্বজনীনতা অর্জন করেছে। পৌঁছে গেছে বিশ্বের দরবারে।

আমি যেহেতু তোর্ষাদেশের মানুষ তাই আমার আলোচনায় ভাওয়াইয়ার কথাকেই ঘিরে আবর্তিত হবে।

ভাওয়াইয়া গানের ইতিহাস হাজার বছরের। এই জনপদের মানুষের প্রতিদিনের জীবন ও যাপনের, মনের ভাব ও পালাপার্বণ, উৎস প্রকৃতির অনুষঙ্গগুলিকে কেন্দ্র করে কত কত গান মানুষের গিদালের মুখে মুখে রচিত হয়েছে। পরে সেগুলিকে লিখিতভাবে আমরা পেয়েছি। পরম্পরাগতভাবেই এই গানগুলি গীত হয়ে এসেছে। পরে নুতন গীতিকারেরা নতুন নতুন গান লিখেছেন। এখনও লিখছেন।

৯।

ভাওয়াইয়ার সুরের ভেতর বড়ো মায়া। বুকের ভেতর বুঝি নদীর কাছাড় ভাঙার হিড়িক হিড়িক শব্দ। আর ঢোল দোতরা বাঁশির মতন সব অনবদ্য বাদ্যযন্ত্র। একটা জীবনের উৎসবের ভেতর চলে যেতে হয় এই ভাওয়াইয়া শুনতে শুনতে। উতরের লোকগানের কথায় কী অদ্ভূত এক জীবনদর্শন উঠে আসে। যেমন—

‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে
কুনদিন আসিবেন বন্ধু
কয়া যাও কয়া যাও রে
বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর নায়া তেমন রে’

প্রেমিকের জন্য একবুক ভালোবাসা। বটগাছের ছায়ায় যে শান্তি বন্ধু তো তেমনই এক শুশ্রুষার নাম।

আবার একটি গানে দেখি—

‘আরে বাউকুমটা বাতাস যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে
সেই মতন মোর গাড়ির চাকা পন্থে পন্থে ঘোরে
ও কি গাড়িয়াল মুই
চলং রাজোপন্থে’

ফাঁকা মাঠের উপর, বিস্তীর্ণ পাথারের উপর যখন ঘূর্ণিবাতাস আসে তখন সেই ঘুর্ণিতে সব ঘুরতে থাকে, তেমনি গাড়িয়াল তার গোরুর গাড়ি নিয়ে পথে পথে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন; সেই ছবিই এই গানে।.

১০।

মানুষের জীবন সীমাবদ্ধ। একদিন ফুরিয়ে যাবে এই জীবন। সেই ভাবনাকে নিজস্ব এক দর্শনে জারিত হতে দেখি একটি গানে—

‘ধান কাটে ধানুয়া ভাইয়া রে
ও জীবন ছাড়িয়া কাতে ওরে নাড়া
সেই মতন মানসির দেহা
পবন গেইলে মরা জীবন রে
ভাই বল ভাতিজা বল রে
ও জীবন আগে করিবে ধনের ভাগ
পাছে দেহার গতি জীবন রে’

দর্শনের সাথে এখানে মিশে যায় প্রবল সমাজবাস্তবতা। আগে মৃতজনের বিষয়সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা হবে, তারপর তার শেষকৃত্য।

প্রেম আবহমানের। জীবনের মায়ায় মায়ায় প্রেমিকেরা বন্দনাগানের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকেন। প্রেমিক কখনও মইষাল, কখনও গাড়িয়াল, কখনও বা মাহুত বন্ধু। কী এক আর্তি ছড়িয়ে বেজে ওঠে এই গান—

‘ও মোর গনেশ হাতির মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তির শিকারে’

কিংবা—

‘আজি না যাইয়ো না যাইয়ো মইষাল
আমাকে ছাড়িয়া রে
ওরে অংপুরতে না যান তোমরা
অংপুরিয়া চেংড়িগিলা জানে ধুলাপড়া’

লোকগানের কথায় কী এক জীবনের ছবি ধরা পড়ে। আসলে জীবন থেকেই তো উঠে আসে নির্মিত বিনির্মিত হয় সবকিছু।

আমাদের গ্রামীন জীবনে এক যৌথতা জড়িয়ে থাকে। নানা পালাপার্বনে মুখরিত। সেইসবও উঠে আসে গানে গানে—

‘দে দে কালা মোকে বাঁশিকোনা দে
হামার বাড়িত সাইটোল পূজা
ঢাকের বায়না দে’

হুদুম দেউ। উত্তরের বৃষ্টির দেবতা। তাকে কেন্দ্র করে রয়েছে লোকাচার ও গান—

‘হুদুম দেউ হুদুম দেউ এক ছিলকা পানি দেও
আয়রে হাড়িয়া ম্যাঘ আয় পর্বত ধায়া
তোক ম্যাঘক বান্ধি থুইম ক্যাশের আগাল দিয়া’

হাড়িয়া ম্যাঘ মানে কালো মেঘে ভরে ওঠা আকাশ। ভারী বর্ষনের আগের আকাশের রং। আর নারী বলছেন, সে তার চুলের ডগায় কালো মেঘকে বেঁধে ফেলবে। কী অসামান্য উপমা। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না থেকেও লোকজীবনের বিশাল গ্রন্থাগার থেকে শিক্ষিত হয়ে গ্রামীণ মানুষেরা কী আশ্চর্য সব লোকগান লিখে গেছেন!

পরকীয়া প্রেমের কথাও উঠে আসে আমাদের লোকগানের কথায়—

‘দাদা আমার নাইরে বাড়ি
মশারী ক্যানে ঢোলে
আসুক দাদা কয়া দিম
পরায় বসত করে’
আবার,

খাগড়াবাড়ি গার্লসের ছাত্রীরা টিফিনের সময় মাঠে দাঁড়িয়ে যখন গেয়ে ওঠে—

‘আমতলী নদীতে/ঝামপলী খেলাইতে
আজি খসিয়া বা পড়িল/বালির শিষের
সেন্দুর রে…’

যে বাসে চড়ে আমি চাকরি করতে যাই সেই গাড়ির খালাসী যখন সাবলীল গেয়ে ওঠে—

‘ও কি ও মোর কাঁটল খুটার ওরে দোতরা/তুই
করিলু মোকে জনমের/বাউদিয়া রে’

নদীতে মাছ ধরতে ধরতে এখনো জালুয়ারা ভাওয়াইয়া গায়, বিকেলের মজলিসে আজও মেয়ে-বউদের কন্ঠে খোঁপা বাঁধবার গান—

‘তারপরে বান্ধিলুং খোপা/নাম দিনু তার উনি
তার উপুরা বসত করে/দেড় কুড়ি বাজারী’

রান্নাঘরের কাজ করতে করতে, উঠোনের ধান ঝাড়তে ঝাড়তে অনায়াস ভাওয়াইয়া গেয়ে ওঠে এখনো প্রান্তিক জনমানুষেরা।

কত কত রকমের গান। সেই সব গানের কথায় আমরা খুঁজে পাই জীবনের রনবেরঙের চিরকালীন সব ছবি। আদি ও অন্তহীন এক জীবনের না ফুরোতে চাওয়া গল্পগুলিই।

Facebook Comments

পছন্দের বই