লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুবীর সরকারের গদ্য: হাটগঞ্জকোরাস (দ্বিতীয় পর্ব)

হাটগঞ্জকোরাস (দ্বিতীয় পর্ব)

৩।

‘আইতোত দেখং সোনার বালা

দিনত দেখং মুখত গোটা

তো সেই মধ্যরাতের গানের আসরে, লোকনাটকের আসরে যে সুন্দরী তার নাচ, তার কোমরের ভাঁজে এক হিল্লোল এনে পুরো গানবাড়িকেই আবিষ্ট করে দিয়েছিল; সেই ভরা সভায় তুমুল লোকপালাকে মুখরিত কোন নদীর পাড়ের কাশিয়ার ফুলের শোভায় শোভায় আচ্ছাদিত করে পুরো গানের আসরটাকেই উৎসব মুখরিত করে দিতে পেরেছিল সেই সুন্দরী চানবালা বর্মনকে সকালের নুতন রোদের আলোয় আলোয় হেঁটে যেতে দেখে গঞ্জের মানুষজন কিঞ্চিত বিষ্মিত হয়েই ওঠে বুঝি বা! কী কাণ্ড! রাতের সেই রুপসী নাচুনির সকল রূপ তো একেবারেই উধাও! চানবালার মুখভরতি পুরোনো ব্রণের অগভীর সব দাগ। গাত্রবর্ণ বেশ কালো। উচু দাঁত। হায় রে, রাতজীবনের সোনার ময়না এখন কোন আন্ধারে বুঝি উড়াল দেয়! এমনই হয়, এরকম হতে থাকে জনমভর চানবালার চার কুড়ি ছুঁই ছুঁই জীবনে। কী এক তাড়িত দুঃখের মতন জীবন তার। সেই ছোট থেকেই ঠাকুরদাদার ‘কুষান পালার’ দলে ঘুরে ঘুরে চানবালার নাচের জীবন, গানের জীবনের শুরু। রাতের পর রাত গানের আসরে আসরে, কত কত ধূলিমাখা মানুষের ভিতর তার জীবন পেরিয়ে আসা। সারাদিন অন্দরে কন্দরে ঘোরা, ঠাকুরদাদার সঙ্গে হাট টাট ঘুরে বেড়ানো। আর রাত হলেই গানের আসরে আসরে, গানবাড়ির আদিমধ্যঅন্ত জুড়ে এক অন্য জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়া। চানবালা বড়ো হয় এভাবেই। ঠাকুরদাদা চলে যান। ইতিমধ্যে চানবালা বর্মন নামিক্কার নাচুনিতে রুপান্তরিত হয়েছে দশ বিশ চল্লিশ গাঁগঞ্জে। চানবালার দল মানেই অপরূপ সব পালার আসর। মানুষের আবেগ মিশে থাকে সেই সব পালায় পালায়। আসর ভেঙে যায় শেষ রাত্রে। কিন্তু গানবাড়ি ফেরত মানুষের কন্ঠে আর স্মৃতিতে জেগে থাকে গান—

‘বেলা ডুবিলে হইবে রে আতি

সঙ্গে নাই মোর সঙ্গের সাথী

ছাড়িয়া দে মোর শাড়ির আঞ্চল

যায় বেলা

সেই রাতের আসরে আসরে ঘুরে ঘুরে দুলে দুলে অদ্ভুত সব নাচগুলি গানগুলি চোখের মণিতে ভেসে ওঠা বিদ্যুৎরেখায় চানবালা তার মস্ত জীবনকেই জাগিয়ে রাখতে চায়। উত্তরের গঞ্জে গঞ্জে নাচগানের দুনিয়ায় সে তার স্বপ্নগুলিকে নুতনতর করে নিতে থাকে। রাতের জীবনের রহস্যে সে কেবল ডুবে মরে। এটাই তো তার নিয়তি। এই ভেসে যাওয়াটাই হয়তো সত্য।

চানবালার মনে পড়ে খুব মুকুন্দের কথা। মুকুন্দচরণ বাউদিয়া।কি আশ্চর্য দোতোরা বাজাতো। চানবালার গান আর নাচের ফাঁকে দুলে দুলে মুকুন্দের দোতোরা গানবাড়ির আবহই একেবারে বদলে দিত। মুকুন্দ দোতরা বাজাতে বাজাতে ঘাড়ে হলদিয়া গামছা ঝুলিয়ে যখন গাইতো—

‘গদাধরের পাড়ে পাড়ে রে

ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি

কি মায়া নাগাইলেন মাহুত রে

ও তোর গালায় রসের কাঠি

কি মায়া নাগাইলেন মাহুত রে

আহা! উদ্দাম হয়ে উঠত পুরো সভা। মেয়েরা চোখ মুছতো আবেগে। চেংড়ার দল দু’চার পাক নেচেই উঠতো। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে চাপা পড়ে যেত দূরাগত রাতশেয়ালের ডাক। মুকুন্দর চোখে চোখ রেখে কেমন ভেসেই যেত বুঝি চানবালা! মুকুন্দর সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল চানবালার জীবন। কিন্তু মুকুন্দের বিবাহের প্রস্তাবে সায় দেয়নি সে। কেননা, বাঁধন তো তার জন্য নয়। সে কেবল নিজেকে বেধে রেখেছে লোকগানের সঙ্গে। নাচের সঙ্গে। হাজার হাজার প্রান্তবাসী জনমানুষের ধুলো ও ঘামের সঙ্গে। রাতের গানবাড়ির মাদকতার টানে রাতের রহস্যে লীন করে দেওয়া এক জীবনযাপনের সঙ্গে নিজেকে। মনের দুঃখে মুকুন্দ চলে গেল দল ছেড়ে দেবীর হাটের মহেশ গীদালের দলে সে এখন দোতোরা বাজায়। আর মুকুন্দের কথা মনে হলেই একা একাই গুনগুন করে চানবালা—

‘ওরে দুঃখ কপালের লেখা

মৃত্যু লেখা পায়রে

আহারে দারুণ বিধি

খণ্ডন না যায়

মরি আই আই রে

এভাবেই রাতের পর রাত গান নিয়ে নাচ নিয়ে গান-নাচ নিয়ে চানবালার বাঁচা। বেঁচে থাকা। রাতের জীবনের দিকে প্লাবনের মতন ছড়াতে থাকা মনোশিক্ষার গীত—

‘আরে মানব দেহা ভাই মাটির ভান্ড

পড়িলে হবে খন্ড রে খন্ড

ভাঙ্গিলে দেহা আর জোড়া নেবে না

বহতা নদীর মতন এক জীবন নিয়ে রাতের গানবাড়িতে গানের পর গান নাচের পর নাচে কেমন এক মুখরিত নদীদেশের চঞ্চলতা নিয়ে চানবালা কখন কিভাবে যেন বা রাতজীবনের একেবারে অন্দরেই নিজেকে তীব্র প্রবিষ্ট করে দেয়। যা থেকে সে আর কোন পরিত্রাণ চায় না। রাতের রহস্যের টানেলে সে নিজেকে প্রবেশ করালেও, চুড়ান্ত এক ‘কুষান পালার’ পরিসমাপ্তিতে আমরা কিন্তু চানবালাকে অসহায় দাঁড়িয়েই দেখি। মধ্যরাতের ঘনঘোরের ভেতর তখন বাজতে থাকে চিরকালীন সব গান—

‘যেদিন মাহুত জঙ্গল যায়

নারীর মন মোর কান্দিয়া রয় রে

হস্তীর কন্যা হস্তীর কন্যা বামনের নারী

মাথায় নিয়ে তাম কলসি ও

সখি হস্তে সোনার ঝারি

ও মোর হায় হস্তীর কইন্যা রে

গান ও নাচের, পালা ও আসরের এই একবজ্ঞা জীবনেই বেশ কেটে যায় চানবালার জীবন। দিনের আলোর কোনো রহস্য নেই তার কাছে। সে কেবল রাত্রির রহস্যের দিকে সওয়ারীহীন ঘোড়াদের মতন ছুটে যেতে থাকে, ছুটে যেতে চায় আরও আরও রাত্রি ও রাত্রিকালীন সব চিরায়ত গানবাড়ির দিকেই।

৪।

হাট আবহমানের। হাট চিরন্তন। হাটের কোলাহল থেকে সরে এসে হেরম্ব নেমে যাচ্ছে মাঠঘাটের ভিতর। দোলাজমি অতিক্রম করছে সে। অতিক্রমণের নির্দিষ্ট কোন মাপকাঠি না থাকলেও দ্রুতগামী হবার সমূহতর সম্ভাবনা হেরম্বকে তাড়িত করে। একা হতে হতে একসময় সে একাকীত্ব সংশয় ঝড়জল ও ঘামের নোলকঝোলানো মদিরতায় মেদুর সত্যকথনের পাশে গলা ঝাড়ে। ফাঁকা ফাঁকা পাথারবাড়ির পথ ভাঙতে ভাঙতে কাশিয়াঝোপ ভাবনাবন আল আলি গলিপথ সরাতে সরাতে একসময় জাতীয় সড়কের মসৃণ ঝকঝকে পিচপথে উঠে পড়ে। এইভাবে ঘটনার কালপরিসীমা দ্রুততায় অতিক্রম করতে করতে হেরম্ব হাওয়ার বিরুদ্ধে নিজস্ব এক শোকসংগীত রচনা করতে চায়। যদিও জলাভূমির আবেষ্টনী তাকে আটকে রাখতে চায়। অথচ অবিচল নির্বীকার হেরম্ব জলাভূমির পাশে পাশে, একদা মহিষেরা গা ডুবিয়ে থাকতো যেখানে আশ্চর্যতায় হেঁটে যেতে থাকে। হাটপর্ব অতিক্রান্ত না হলেও আগামীর কোন আসন্ন ঝড়জলক্লান্ত হাটের অভিমুখেই হয়তো অনির্দিষ্ট এই যাত্রাপথ। পথ পথের মতো, পথের টানেই এগিয়ে যাওয়া। সাবলীল হতে পারাটা অসম্ভব তবু হেরম্ব মাদকতাময় হেঁটে যেতেই থাকে। হেঁটে যাবার ভঙ্গীতে আদ্যন্ত এক জীবন ধরা থাকে, তবু নদীতীরবর্তী অঞ্চলগাঁথায় সুরতাললয়হীন ব্যপ্ততায় কবেকার সব হাটবন্দরের প্রচ্ছায়া এসে জড়ো হয়। জমাট বাঁধে, যদিও নদীমাতৃকায় পলিমাটিপীড়িত এক সমাহার এসে যাবতীয় অন্ত্যজ উপকরণের ঢেউভাঙা আবিলতা এসে আবহমানতা লিখে রেখে যায় আর নকশাচাদরের অনবদ্যতা এড়িয়ে দিনের পিঠে দিন যায়, অতিক্রান্ত হয়। যদিও কাদামাটিলেপা জীবনের গভীরে স্পর্শযোগ্য বিভ্রম এসে যুক্ত হতে থাকে আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব এড়িয়ে পুনর্বার আকাশমাটিজলের তীব্র সহাবস্থান নিয়ে সংহত হতে থাকে কতরকমের সব হাট।

প্রথম পর্ব:

সুবীর সরকারের গদ্য

Facebook Comments

পছন্দের বই