লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুমনা রহমান চৌধূরীর প্রবন্ধ

মিঞা কবিতা: স্ফুলিঙ্গ যখন মশাল

কবিতা যেভাবে মশালে পরিণত হল:

‘মিঞা’ কবিতা নির্মাণের প্রথম ধাপ ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। ‘আবাহন’ পত্রিকায় প্রকাশিত মৌলানা বন্দে আলি মিঞার অসমীয়া ভাষায় লিখিত ‘এক চরুয়ার শপথ’ কবিতা দিয়ে এই ধারার যাত্রা শুরু। বন্দে আলি মিঞা লিখেছিলেন—

“কোনে বোলে বঙ্গদেশ মোৰ জন্মভূমি
লভি যাৰ তিক্ত নির্যাতন
আহিছিলোঁ ঘৰ এৰি হই দেশান্তৰী
পিতৃ আৰু কতজন…
অহমিয়া আপোন আমাৰ
নহওঁ চৰুয়া মই নহওঁ পমুৱা
আমিও যে হলো অহমিয়া,
অহমৰ জল-বায়ু অহমৰ ভাষা
সকলোৰে সমান ভগীয়া…”

বাংলা:

(“কে বলে বঙ্গদেশ আমার জন্মভূমি
যার তিক্ত নির্যাতনে
এসেছিলাম ঘর ছেড়ে হয়ে দেশান্তরী
পিতা এবং কয়েকজন…
অসমীয়া আপন আমাদের
নই চরুয়া আমি নই পমুয়া
আমরাও যে অসমীয়া,
অসমের জল-বায়ু অসমের ভাষা
সকলের সমান ভাগী…”)

উপরের লাইনগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়, কবি বন্দে আলি মিঞা চরুয়া, পমুয়া বা পূর্ববঙ্গীয় পরিচয় সরিয়ে একজন অসমীয়া হিসাবে বৃহত্তর অসমীয়া সমাজ-সংস্কৃতি-জনগোষ্ঠীর সাথে এক হতে চাইছেন। বন্দে আলি মিঞার এই চাওয়া সমস্ত মিঞা ভাষাভাষী মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আবার ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে যখন ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা নেলীতে হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে খবীর আহমেদ ‘বিনীত নিবেদন এই যে’ নামক একটি কবিতায় লিখেন—

“বিনীত নিবেদন এই যে
মই এজন পমুয়া, এজন লাঞ্চিত মিঞা
যিয়েই নহওক কিয় মোৰ নাম
ইসমাইল শেখ, ৰমজান আলি কিংবা মজিদ মিঞা
জ্ঞাতব্য বিষয় মই অহমৰই অহমীয়া।”

বাংলা:

(“বিনীত নিবেদন এই যে
আমি একজন পমুয়া, একজন লাঞ্চিত মিঞা
যাই হোক না কেন আমার নাম
ইসমাইল শেখ, রমজান আলি কিংবা মজিদ মিঞা
জ্ঞাতব্য বিষয় আমি অসমেরই অসমীয়া”)

খুব সম্ভবত এই কবিতাটিই আজকের মিঞা কবিতার জন্মদাতা। ভ্রূণ অবস্থা থেকে তার ব্যাপ্তি শুরু হয় ২০১৬ নাগাদ অসমের সরকার বদলের হাত ধরে। ২০১৬ সালে দীর্ঘদিনের কংগ্রেস সরকারের পতন এবং বিজেপির অসম দখল। সেই সময় থেকেই ভয়াবহভাবে শুরু হল এন আর সি, বিদেশি, খিলিঞ্জিয়া, বাংলাদেশি, ডি-ভোটার, ১৯৭১-১৯৫১ বিতর্ক, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের জুমলা, সিটিজেনশিপ বিলের পক্ষে সাম্প্রদায়িক প্রচার। এই সমস্ত কিছু নতুন করে আবারও বিপন্নতার আবর্তে ঠেলে দেয় এই জনজাতিকে। মূলত এই সময়েই চরম রাগ আর হতাশা থেকে ড. হাফিজ আহমেদ ফেসবুকের পাতায় লিখলেন ‘লিখি লোয়া, মই এজন মিঞা’। এই কবিতার হাত ধরেই একটা আন্দোলন জন্ম নিল আসামের বুকে। ব্রহ্মপুত্র এলাকার মুসলমান তরুণ প্রজন্ম, যাদের পূর্বপুরুষ কোন এক সময়ে বাঙালি ছিলেন, এই নবীন কবিরা ফেসবুকে একের পর এক মিঞা কবিতা লিখতে শুরু করেন। অসমীয়া, ময়মনসিংহি, কামতাপুরি-সহ নানা স্থানীয় ভাষা-উপভাষা মিলে সৃষ্টি মিঞা দোয়ানের লিপি অসমীয়া বর্ণমালা। সেই দোয়ানেই ফেসবুকের পাতায় মিঞা কবিরা লিখে চললেন তাঁদের দীর্ঘ দিনের যন্ত্রণার ইতিহাস। কবি রেজওয়ান হুসেন সেই যন্ত্রণার বিষে নীল হয়েই লিখেন ‘আমাগো বিপ্লব’ কবিতায়—

“আমাদের তোমরা গালি দেও
হাতের নাগালে পেলে লাথিও মার
নীরবে কিন্তু আমরা তোমাদের
অট্টালিকা, রাস্তা, দালান বানাতে থাকব
তোমাদের অস্থির, ঘামে ভেজা, চর্বিযুক্ত
শরীরটাকে আমরা কিন্তু রিকশায় টানতে থাকব…”

অথবা চান মিঞা লিখেন “আইজকা আমি আমার নাম জানি না” কবিতায়—

“আবার ডিটেনশন ক্যাম্পে বসে মনে পড়লো
হায়রে, এই বিল্ডিংটা তো আমিই বানিয়েছিলাম
এখন আমার কিছু নাই
মাত্র আছে একজোড়া পুরানো লুঙ্গি, আধপাকা দাড়ি
আর দাদার নাম থাকা ছেষষ্টি’র ভোটার
লিস্টের এফিডেফিট কপি।”

ইতিহাসের শুরু থেকেই এই জনগোষ্ঠী বারবার অবজ্ঞা, উৎপীড়ন, অপমান, হেনস্থার শিকার হয়ে গেছেন। তাই এরা যখন এদের কথা বলতে শুরু করলেন, যুগ যুগ ধরে জমিয়ে রাখা সেই যন্ত্রণার ধরাভাষ্যই প্রতিফলিত হল তাদের কবিতায়। যে-‘মিঞা’ ডাক ব্যবহৃত হত তাদের অপমান, হেনস্থা করার জন্যে, সে-ডাককেই অহংকারের সাথে মাথায় তুলে নিয়ে তারা তাদের কবিতার ঘরানার নাম দিলেন ‘মিঞা কবিতা’। ‘ইটমগুর’ (চর-চাপরির ভাষায় চাষের ‘হাল’) নামক ফেসবুক পেইজে একের পর এক ‘মিঞা কবিতা’ লিখে গেলেন বিভিন্ন কবিরা। অচিরেই তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে দেশ এবং বিদেশেও তা ছড়িয়ে পড়লো। ইংরেজি-সহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হল কবিতাগুলো। আন্তর্জাতিক স্তরে মিঞা কবিতা, তার পটভূমি, চর অঞ্চলের মানুষের হালহকিকত ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু হল। এক নতুন ঘরানার কবিতা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

এনআরসি-র যাতাকলে পিষ্ট এক অসহায় বাবার দলা পাকানো অভিমানের বিস্ফোরণ ঘটে ড. হাফিজ আহমেদের কবিতায়—

“লিখো
লিখে রাখো
আমি একজন মিঞা
এনআরসি-র ক্রমিক নং ২০০৫৪৩
দুই সন্তানের বাবা আমি
সামনের গ্রীষ্মে জন্ম নেবে আরও একজন
তাকেও তুমি ঘৃণা করবে কি
যেভাবে ঘৃণা কর আমায়?”

এন আর সি-র অত্যাচারে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী এক প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়ার বিবরণ কবি চান মিঞা দিয়েছেন—

“আবাৰ ডিটেনশন ক্যাম্পে বইসা মনে পৰলো
হাৰে, এই বিল্ডিংডা তো আমিই বানাইছিলাম
এহন আমাৰ কিছু নাই
মাত্র আছে একযোৱা পুৰান লুংগী, আধপাকা দাড়ি
আর দাদাৰ নাম থাকা ছয়ষট্টীৰ ভোটাৰ লিস্টৰ
এফিডেভিট কপি।”

বাংলা অনুবাদ:

(“আবার ডিটেনশন ক্যাম্পে বসে মনে পড়লো
হায় রে, এই বিল্ডিংটা তো আমিই বানিয়েছিলাম
এখন আমার কিছুই নেই
মাত্র আছে একজোড়া পুরানো লঙ্গি, আধপাকা দাড়ি
আর দাদার নাম থাকা ছেষট্টি’র ভোটার লিস্টের
এফিডেভিট কপি।”)

বৃহত্তর অসমীয়া জনজাতির কাছে নিজের প্রাপ্যটুকু পেতে, অসমীয়া মায়ের সৎমা সুলভ আচরনে তীব্র অভিমানে রেহানা সুলতানা লিখছেন—

“হাজাৰ লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য কৰিও মই চিঞৰি
চিঞৰি কও—
আই! মই তোমাকেই ভাল পাঁও।”

বাংলা:

(“হাজার লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করেও আমি চিৎকার
করে বলি—
মা! আমি তোমাকেই ভালোবাসি।”)

১৯৮৩ সালের ইতিহাসের বর্বরতম নেলী গণহত্যা, এক রাতে সম্পূর্ণ মুসলমান গ্রামটি শ্মশানে পরিণত হয়েছিল, একটা বাচ্চাকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। সেই মর্মান্তিক ক্ষোভ, স্বজন হারানোর ব্যথা থেকেই কবি কাজী নীল লিখেছেন—

“যে-দেশে ৮৩তে মানুষ মেরে শালার বেটারা জল্লাদের
মতো উল্লাস নৃত্য নাচে,
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।”

মিঞা গালি শুনতে শুনতে শেষে রুখে দাঁড়ানো চর অঞ্চলের যুবকদের বিদ্রোহী সত্তার জানান দিয়েছেন কবি আব্দুর রহিম—

“আমাৰে আর মিঞা বিলা
গাইল দিয়েন্না
মিঞা বিলা পরিচয় দিতে
এহন আৰ আমাৰ
সৰম কৰে না
ভাল যুদি নাই পাইন
ছলনা আৰ কইৰেন্না
কাঁটাতাৰেৰ দাগ বিছৰায়েন্না
তিৰাশি, চোৰানবৈ, বাৰ, চোদ্দৰ
কথা ভুইলা যায়েন্না
অই আগুনেৰ পোৰা দাগৰে
কাঁটাতাৰেৰ দাগ কৈয়েন্না—”

বাংলা:

(“আমাকে আর মিঞা বলে
গালি দেবেননা
মিঞা বলে পরিচয় দিতে
এখন আর আমার
লজ্জা করে না
ভালো যদি না ই বাসেন
ছলনা আর করবেন না
কাঁটাতারের দাগ খুঁজবেন না
তিরাশি, চুরানব্বই, বারো, চৌদ্দ’র
কথা ভুলে যাবেন না
ওই আগুনে পোড়া দাগকে
কাঁটাতারের দাগ বলবেন না—”)

এন আর সি আতঙ্ক তাড়া করা এক সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রের কাছে শেষ আবেদনের বয়ান কবি আব্দুর রহিম দিয়েছেন—

“আমাকে এত ভয়, শঙ্কার মধ্যে
জীবিত রাখার চেয়ে
আমাকে গুলি করে মেরে ফেলা হোক।
মহাশয়, গুলি করে মেরে ফেলা হোক।”

উগ্র ভাষিক নেতাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শেষ স্পর্ধিত উচ্চারণ করেছেন রেহানা সুলতানা—

“নাই নাই, শুনক
মিঞাই আপোনাক কাহানিও গোলাম কৰিব বিচৰা নাই
কিন্তু আপোনাৰ গোলামিও আৰু মিঞাই না খাটে সেৱে,
মিঞাৰ পোয়ালীৱে আজি আপোনাক সঁকিয়াই দিছে
আপুনি যুদ্ধ কৰিব অস্ত্রৰে
মিঞাই যুদ্ধ কৰিব কলমেৰে
কাৰন শুনামতে
অস্ত্রৰ ধাৰতকৈ কলমৰ ধাৰ বেশি চোকা
বেশি শক্তিশালী।
‘জয় আই অহম’।”

বাংলা:

(“না না, শুনুন
মিঞারা আপনাকে কখনো গোলাম করবে বলে ভাবে নি
কিন্তু আপনার গোলামিও আর মিঞারা করবে না
মিঞার মেয়ে আজ আপনাকে সাবধান করছে
আপনি যুদ্ধ করবেন অস্ত্র দিয়ে
মিঞারা যুদ্ধ করবে কলম দিয়ে
কারণ শোনামতে
অস্ত্রের ধার থেকে কলমের ধার বেশি তীক্ষ্ণ
বেশি শক্তিশালী।
‘জয় আই অহম’।”)

তীব্র রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক দমন-পীড়নের মাঝেও মিঞা কবিরা দু-চোখে প্রত্যয় আর ক্রোধ নিয়ে জানান দিচ্ছেন—

“মোৰ দুচকুত জমা হৈ আছে
যুগ যুগান্তৰৰ বঞ্চনাৰ বাৰুদ
আঁতৰি যোয়া
নতুৱা
অচিৰেই পৰিণত হ’বা মূল্যহীন ছাইত!”

বাংলা:

(“আমার দু-চোখে জমা হয়ে আছে
যুগ যুগান্তরের বঞ্চনার বারুদ
সাবধান হোও
নয়তো
শীঘ্রই পরিণত হবে মূল্যহীন ছাইয়ে!”)

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই