লেখক নয় , লেখাই মূলধন

হাসান রোবায়েতের কবিতা

দুপুরের বন্ধন

কখনো এমন হয়, পাতাঝরা আইলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের মনে পড়ে—দক্ষিণের বাতাস চলে গেছে কতদিন আগে, কতদিন আগে পৃথিবীর বেহুলা নারী নিয়ে গেছে দূর রূপকথা, ভাসানের অবছিন্ন আলোয় থেমে গেছে রজনীল হাওয়া—

ছোটো ছোটো বাতাস বইছে, একদল মানুষ জীবনের দিকে চলে যাচ্ছে— তাদের বউ-ছেলে-মেয়ে, গৃহপরিবার ক্লান্ত দুপুরের বন্ধনে ঘুমিয়ে পড়ছে রাস্তার শেষে—ঠান্ডা ছায়ায়, পিপুলের ঘনায়মান বনে তারা প্রশ্ন করে একে অন্যকে—

‘জীবন নশ্বর কেন—?’

দূরের শিমুলখেতে কামলারা নিচু হয়ে মাটি ভাঙছে, গোরুগুলো পাল ধরে ফিরে যাচ্ছে বক্রগাঙের জলায়, কেউ কেউ গান গাইছে গামছার ছেঁড়া মমতায়—

সামনে ধরমপুর— একটা বিষণ্নমান ছোট পাখির কণ্ঠে কেমন উতলে উঠছে জীবন—

ধানপূরবীর ছায়া

ধানপূরবীর ছায়ায় মাঝে মধ্যে আলো আসে, পশ্চিম আড়ার শেষে যে ঘর সেখানে হারিকেনের স্তব্ধ আলোয় দুইজন মানুষ পৃথিবীর সন্ধ্যালীন ধুলায় বসে ভাবছে—

কেমন হবে মানুষের শেষ লণ্ঠনের আলো—?

নিমগাছে অপরাহ্ণ হেলে পড়ছে, কোথাও একলা ঘরে মরে যাচ্ছে যে মানুষ তার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঘন কড়ুইয়ের ছায়া কেঁপে উঠছে ধীরে— বিষণ্ন ফুলের গন্ধ বাকশূন্য হয়ে থেমে আছে হ্রদের পাশে—

মন্দালোকিত রাত

ভাঙা জানালায় পৃথিবীশেষের যেই পথ, সেদিকে তাকিয়ে আছে একটা মানুষ— হাড়িচাচা পাখিরা পীতরাজের ডালে বসে অপেক্ষা করছিল সন্ধ্যার— বিষণ্ন কঞ্চির ঝাড়, নিচে ক্লান্ত মৃতদের ছায়া, অনেক দূরের থেকে ভেসে আসছে মরমিয়া গান—

সে তাকে জিজ্ঞাসা করে— ‘মৃত্যু কি নদীর ওপারে যে বাড়ি তার আঙিনায় পড়ে থাকা শিমুল ফুলের মতো?

নীরবে বাতাস বইছে, ধানের চারাগুলো দূরের টিলার সঙ্গে কথা বলতে ঢেউ দিচ্ছে পাতারে, কতগুলো কামলা চলে যাচ্ছে মন্দালোকিত রাতের দিকে। ভাঙা জানালার লোকটা একা নম্র শূন্যতায় দাঁড়িয়ে আছে—

রাত নামছে—

চিরঘ্রাণ

চিকন রাস্তা— কোনো এক অনন্তের থেকে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে কোথাও, চারপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত, তন্দ্রাতুর সবুজের শব্দহীন এই প্রান্তরে মাঝে মধ্যে জেগে আছে দুয়েকটা ইটের ভাঁটা, আইলে বুনো গুল্মের অশান্ত মর্মর—

কাছেই ঠান্ডা এক আমবাগানের ছায়া, বহুকাল আর্দ্র গন্ধের নিচে পাতাগুলো পড়ে আছে বিমলিন, যেন গৃহস্থবাড়ির কেউ অপরাহ্ণকালে কতদিন ঝাড়ু দেয়নি, পত্রপল্লবের চিরঘ্রাণ ভেসে আছে। এদিকে কেউই আসে না, ঝোড়া ইটের পুরানা আবরণ খসে পড়ছে মাটিতে—

‘যুদ্ধ কী?’

ভাঙা জানালায় দাঁড়ানো লোকটা তাকিয়ে থেকে শুনতে পায়, শিশুরা খেলতে খেলতে প্রশ্ন করছে একে অন্যকে; বাঁশঝাড় পেরোলেই দিঘি, তারপর ছোটো ঘর, বনভূমিফেরত দুইজন মানুষ, দুপুরের ডালভাত মিলেমিশে অপেক্ষা করছে রাতের, যখন চাঁদ গৃধিনীর নখর থেকে মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে দিঘির পানিতে—

মধ্যদুপুর

মধ্য দুপুরের প্রতিবেশ, ছোটো ছোটো হাওয়ায় কেঁপে উঠছে শ্রান্ত কড়ুইয়ের পাতা, নদীর নিস্তব্ধতা চিরে একা পানিকাউর উড়ে যাচ্ছে ছায়াময় বাঁশঝোপের দিকে— সেখানে, ধীরেনের ছোটো মেয়েটা খুটিমালসা সাজিয়ে রান্না করছে নুড়ি-পাথরের ভাত, ইটের বিচুর্ণ মসলায় শান্ত তরিতরকারি— ধরমপুরের এই অবসন্ন বাঁশঝোপের দুপুরে, বাবার চিতার থেকে কিছু দূরে একা মেয়েটার মনে হয়, বাবাকে ডাক দিয়ে খেতে দিই ভাঁটের পাতার থালে, কলার পাতার ঝোল তুলে দিই পাতে—

জমির বিরোধ নিয়ে যে লোকটা চলে গেল তামাম বসন্ত পার হয়ে সুবর্ণাভ নিয়রের হাওয়ায় তাকে আর ডাকা যায়নি মধ্যদুপুরের বিপুল মায়ায়—

বাঁশঝোপের পাতা ঝরছে, অদূরে বকরির বাচ্চারা সুষুপ্তির অশ্রুত ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে জমির ঢালে, ভাঙা জানালায় দাঁড়ানো লোকটা পীতরাজবনের ফাঁকে দেখতে পাচ্ছে সূর্যরশ্মিতে চকমক করে উঠছে বনবিতান, মেয়েটা বাবার জন্য রাখা ভাঁটপাতার শূন্যতায় মনে মনে চিৎকার করছে—

মানুষ চলে যায় কেন?

মধ্যদুপুরে ছায়াশ্রান্ত আঙিনার কোনে বাতাস বয়ে যাচ্ছে অ্যাকাশিয়াবনের উপর দিয়ে ধু ধু খেতের নিস্তব্ধতায়—

নির্জনতা

বিস্তীর্ণ মাঠ— কোথাও ধানখেত তার ঘুমের সুষুপ্তি নিয়ে জেগে আছে বিমলিন, কোথাও ধানহীন অস্পষ্ট প্রান্তর যেন সীতার দুঃখের পরে তন্দ্রাতুর আলোছায়াময় এক জীবন বহন করছে নীরবতা— কাগনা ফুলের মতো মেঘলা আকাশ, একটা গাছ একলা দাঁড়িয়ে যে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে তাকে স্পর্শ করছে জীবনের নৈঃসঙ্গ্য— কাজ থেকে ফিরে কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে ধুতে লোকটা দেখে নিচ্ছে এইসব পৃথিবীপাড়ের মায়া—তার পরিবার, গৃহছেলেমেয়ে কোথায় যে চলে গেছে, কোন আঘাটায় নেমে গেছে রূপম্লান অরণ্যতীরের হাওয়ায়—! গামছায়, তাদের ঘ্রাণ পড়ে আছে—

সন্ধ্যার হাটশেষে বাড়ি ফিরছে কেউ, আড়াজঙলার ধারে পাখিদের করবী-সুরের রেণু উড়ে যাচ্ছে মাগরিবের আজানের দিকে, কতগুলো ট্রাক ঘর্ঘর আওয়াজ তুলে চলে যাচ্ছে আতুর নক্ষত্রের সাথে, অর্জুন গাছের নিচে মর্মর করছে নিস্তব্ধতা— লোকটা ভাবতে থাকে

নির্জনতার রঙ কী হতে পারে—?

এখানে সন্ধ্যার মেঘ পারুল ফুলের মতো, মেঘের ঘ্রাণ অপার্থিব চন্দনের বন—

সন্ধ্যা

ধরমপুরের এইসব ছোটো ছোটো গড় ঠিক কবে পৃথিবীর পূর্ণচাঁদে নক্ষত্রপুঞ্জের রাত্রিতে উঠে এসেছিল— কেউই জানে না। অ্যাকাশিয়ার দীর্ঘবন সেই কবে থেকে মৃত্তিকাখণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে বাতাস বয়ে দিচ্ছে বহুদূর চালতাগাঙের দিকে— এমন নিস্তব্ধ মৌনতায় একজন মানুষ বসে আছে গড়ের চূড়ায়, যে আর কারো নয় লালমাটির ভিঁউ থেকে আসা কোনো দর্শনার্থীর— একা, তামাম বিষণ্নতার হাওয়া উড়ে যাচ্ছে তাকে ঘিরে—নিচে ঈদগাঁ মাঠের পুরানা কবরের ধারে কে যেন পাতা শুড়ছে, চারপাশে অপরাহ্ণের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা, সারি সারি তালগাছের ফাঁকে, গোরু ছেড়ে দিয়ে, মানুষেরা তন্দ্রায় টুপছে, শূন্য মাঠ, নৈঃশব্দ্যের অধিক বাঙ্ময়তায় সব কিছুই কেমন ঘুমিয়ে পড়ছে শান্ত নদীর পাশে—

লোকটার সব দখল করেছে একজন মুসলমান মাতবর— বাড়িঘর, অল্প জমিজিরাত—দেবতাকে দিতে পারে একটুকু ধান, তাও আর অবশিষ্ট নাই—

আজ এই সঙ্ঘ-বিমুখ রৌদ্রপ্রান্তরের টিলায় কে আর এগিয়ে আসবে মগ্নপ্রায় সিঁড়ি ধরে এই করুণ একলার হাওয়ায়, কে তাকে বোঝাবে দিব্যমূর্তি ধরে শুধু বসে থাকেন ক্ষমতা— আর কেউ নয়, না ধর্ম না বিশ্বাস—

দিকে দিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে— পাতাশুড়ানিও ফিরে গেছে চালতাগাঙ পার হয়ে তার নিজের ছায়ায়, তুঁতের পাতার উপর আলোহীন ঘুমিয়ে পড়ছে মৌমাছিসকল, শূন্য মাঠের কোলে নেমে আসছে ঢালু রাত— এমন অশ্রুপাতের সন্ধ্যায় সে ভাবছে—

ক্ষমতা কী—?

সন্ধ্যা অস্ত যাচ্ছে—

Facebook Comments

পছন্দের বই