লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

চয়ন দাশ

চল্লিশ মেঝে

 ১
বেদকে পাশের রুমে ঘুমোতে দেখে এ-ঘরে এলাম। এ-ঘর আমার আর বেদের নতুন। ঘরটা আমার নতুন হাবির, কিংশুকের। পাঁচতলার উপর। সকালের দিকটা ভালো লাগে, সামনেই একটা বস্তি আছে। সিমেন্টের রাস্তা, খোপ করে টাইম কল। বস্তির মাথাগুলো কমলা আর লাল ত্রিপল মোড়ানো। মাটির কাছাকাছি মানুষের যাবতীয় আয়োজন-প্রয়োজন ছেড়ে আমরা উপরে উপরে এড়িয়ে যাচ্ছি, কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছি। দুপুরের দিকে ব্যালকোনির গ্রিলে কাক আসে, শালিখ, পায়রা— এতখানি উঠে এসে ক্যামন যেন হাঁপায় মনে হয়। আমায় দ্যাখে, একা ঘরে আমি একা। কিংশুক অফিসে, বেদও স্কুল-কোচিং- এন্ট্রান্সের প্রিপ্যারেসন নিয়ে ব্যস্ত। বাকি থাকল, আমার পরিচয়? আমি আমার নিজের একটা নাম দিয়েছি, ‘ফালতু’।

ডিভোর্সি মহিলা, চল্লিশ হতে চলল অথচ নিজস্ব একটা জীবনের পথ খুঁজে পেলাম না, চেষ্টা করিনি এমন তো নয়, জীবনের চেষ্টার ব্যর্থতার খেসারত অন্যরকম হয়। সময় পেরোয়। স্রেফ সময় পেরোয়। আশপাশের গাছগুলোর ছায়া কমে, বাবা মরে যায় মা মরে যায়, মরে যেতে পারে ভাবতেই পারিনি কোনোদিন, আজও পারি না।

ফাঁকা ঘর, ধু ধু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। খুব সাজি। ভ্রূ আঁকি। লিপগ্লস লাগাই। আস্তে আস্তে পেটের সামনের কাপড় খুলে ফেলি, তুলে দিই। নাভির নীচে স্ট্রেচমার্কগুলো হাত বুলাই। তলপেট যোনি খুব অস্পষ্ট। কেউ কোথাও নেই। আমার নাভি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপরাহ্ণকে দেখতে পাচ্ছি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আবার দেখতে পাচ্ছি কোনো একজন মেয়ের নরম হাত— পেট আর বুক নিয়ে আমার দিকে আসছে। বলছে যেন, ‘কোনোদিন এমন নরম হতে পারবে? হতে পারলে থাকো আমার সাথে…, নয়তো যা বলেছি সেটা করো’। অপরাহ্ণ আমায় থ্রিসামে ইনভল্ভ হতে বলেছিল। অপরাহ্ণর বয়স বাড়ছে, ওর শরীর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, ওর মনের ভেতরকার লিঙ্গ জেগে উঠছে, অপরাহ্ণ মনের মুখটা ওর যমজ ভাইয়ের মতো। আমায় যেন আয়নার ভেতর থেকে ডাকতে থাকে… হাত দাও, হাত বাড়াও।

অপরাহ্ণের সাথে সব সম্পর্কই মিটে গেছিল। আমার পক্ষে যতদূর যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, গেছিলাম, হাঁপ লাগলে ছেড়ে দিলাম। হল না। বেদ আমাদের ডাইভোর্সের কারণ জানে না। বেদকে জানাবও না কোনোদিন। বেদ ওর পাপাকে খুব ভালোবাসত। ওর সাথে কিংশুকের আলাপ হয়েছে, কিংশুকও চেষ্টা করছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হতে, পাপার জায়গাটা পাপারই থাকুক।


বেদ ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম কিংশুকের রুমে, কেন-না কিংশুক আমায় নিঃশব্দে ডেকেছে। আমি জানি ও কেন ডেকেছে। আমার জন্মদিন, ফার্স্ট উইশ করবে। বিছানা থেকে ওঠার আগের মুহূর্তেও একবার অপরাহ্ণকে মনে পড়ল, ভুলতে পারিনি, যতই সে পাপ কিংবা অন্যায় করুক আমার সাথে।

কিংশুককে আমি এভাবে কোনোদিন পাইনি। আশাও করিনি এতটা কাছ থেকে ওকে দ্যাখার। ওর ধীরে ধীরে এক-একটা গিফ্ট আমায় অবশ করে দিচ্ছে। আমার দু-হাত দু’দিকে ছিটকে পড়ে আছে, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। ওর নাক ঠোঁট চোখ আমার নাভির নীচে নামতে থাকলেই মাথা ঝনঝন করতে লাগল। মনে হতে লাগল— আমি পুনরায় একা হয়ে গেছি। বাথরুমের লাল মেঝেতে উলঙ্গ হয়ে বসে আছি, মৈথুন করছি, শিরশির আওয়াজ বেরিয়ে যাচ্ছে মুখে, দরজার ঠিক ওপারে ভাই কান পেতেছে, তবু সামলাতে পারছি না নিজেকে। একসময় দেখছি বাথরুমের বন্ধ ঘরের ভেতর চুপিচুপি কারা এসে দাঁড়িয়েছে। উলঙ্গ পুরুষ, কামার্ত সবজন। অপরাহ্ণ-অপরাহ্ণের সাথে একটা বেঁটে লোক, বস্তির ভ্যানওয়ালাটা, মাছওয়ালির বরটা, কনুই গোঁতানো বাস কন্ডাকটর, বায়োলজির স্যার… সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে। সবার লিঙ্গের মাথায় লার্ভার চাক ভেঙে টাটকা মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। বুঝতে পারছি— কিংশুক আমার হাঁটু দুটো মুড়ে দিচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে— বেদ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আমার নিঃশ্বাস শুনে ফেলছে— বেদ যেন সেই বাথরুমের ভেতর ঢোকার জন্য বাথরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে।


কিংশুককে ঠেলে সরিয়ে আমি এ-ঘরে এসেছি। বেদ ঘুমাচ্ছে। ওর চোখের পাতার নীচে মণিগুলো অস্থির। হয়তো স্বপ্নে ও কোনো ইশকুলবাড়ির ভেতর আটকে গেছে, ওর একাকিত্বের সুযোগ নিতে এগিয়ে আসছে একটা রঙিন উট, ওকে ভালোবাসছে, আদর করতে করতে শূন্যের দিকে গড়িয়ে দিচ্ছে। ও আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে খাদের ভেতর থেকে, আমি হাত বাড়াচ্ছি, হাতড়াচ্ছি… কেউ নেই আমার জন্য। চাই সমস্ত পুরুষ, মানুষ থেকে গাছ হয়ে আমার কাছে আসুক। আমার তলপেটে আঙুল দিক ঠোঁট ছোঁয়াক অ্যান্ড্রোপজ একজন। আঁকড়ে ধরুক

Facebook Comments

পছন্দের বই