Categories
পরিক্রমণ

পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রমণ

সান্দাকফুর পথে কয়েকদিন

আমি মনে মনে এভারেস্টকে ডাকি মাউন্ট রাধানাথ বলে। আর ছেলেমেয়েদের ক্লাস নিতে গেলেও সেই মহান বাঙালির গল্প বলি। রাধানাথ শিকদার।

যাইহোক, সান্দাকফু টপ-এ একরকম অলৌকিক প্রাপ্তির পর আমাদের ছবি তোলার আদিখ্যেতা শুরু হল। সামনে আমি পিছনে রেঞ্জ। সামনে দল, ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝকঝকে রেঞ্জ। ব্রাশ করতে করতে এভারেস্ট, ম্যাগি খেতে খেতে এভারেস্ট, জল ভরতে ভরতে, ব্যাগ গুছোতে গুছোতে, ক্রিম মাখতে মাখতে, কোকা ৩০ গালে ফেলতে ফেলতে, লাঠিটা কোথায় ফেললাম খুঁজতে খুঁজতে মনে প্রাণে জড়িয়ে নিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা আর সাগরমাতাকে।

এবার নামব।

পাইনের বন। মাঝখান দিয়ে পথ। টুকুস টুকুস করে নামছি। নামছি আর দেখছি। যত না নামি দাঁড়াই বেশি। কথা বলি, গান গাই, ছবি তুলি। তুলে তুলে কুল পাই না। সবটুকুই পকেট ভরে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। এই চমৎকার রোদ বরফে পড়ে আছে, আর বরফেরা পড়ে আছে হলুদ ঘাসে, জমে আছে পাইনের পাতার ফাঁকে, পুরোনো পুড়ে যাওয়া গাছের কোটোরে, ডাঁই করে ফেলে রাখা সরু মুখ কাচের বোতলগুলোর ওপর কিংবা দূরের সবুজ টিনওয়ালা ট্রেকার্স হাটের চালে, এই সবকিছুই বড্ড ভালো লাগায়। ভালোবেসে আমরা এর ওর মুখে তাকাই। হাসি। দাঁড়াও দাঁড়াও বলে ছবি তুলে নি, যাতে ব্যস্ত শহরে ফিরে গিয়ে অনায়াসে তাকে বলতে পারি এখন আরও অনেকদিন তোমায় সহ্য করে চলার রসদ নিয়ে ফিরেছি।

পথ নেমে যায়, আমরাও নামি, পথ বাঁক নেয়, আমরাও নি, পথ লাফায়, আমরাও কেউ পাশ হয়ে, কেউ কাত হয়ে, কেউ বসে, কেউ তাল মিলিয়ে লাফিয়ে নামি। নামতে গিয়ে পড়ি ধুপ করে, পা কখনো ভুস করে এগিয়ে যায় আমার আগেই, কখনো এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়াতেই পাশ থেকে কারো শক্ত ভরসা দেওয়া হাত এগিয়ে এসে পলকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেকটা পথ। Nothing comes from nothing/nothing ever would somewhere in my youth, or childhood/I must have done something good’.

গুরদুমের রাস্তায় সম্মোহন আছে। সবুজের। সবুজ মানে নীলচে, কালচে, বাদামি, খোড়ো, ধূসর, কচি, লালচে সবরকম সবুজ। পাইন শেষ হল তো বাঁশ। আর পাখিরালয় যেন। সারা রাস্তা পাখির ডাক। একটা খোলা চত্বর এল। সেটা পেরোতেই এক মানুষ চলার মতো পথ পেতে দিল রিম্বিক পাহাড়। সবজে কালো জাফরি কাটা চলনপথ ধরে আমরা এবার সবাই আগুপিছু হাঁটি। কখনো একা বা দু-তিনজন। একটু হাঁপিয়ে নি মাঝে মাঝে। কুহেলি দি কখন এগিয়ে গিয়েছে দেখাই যাচ্ছে না। টিপু আজ পাখিকে কিছুতেই থামতে দেবে না ঠিক করেছে বোধহয়, প্রায় ঘোড়দৌড় করিয়ে ছাড়ছে। আর পাখিও ওঠার দিনের অসুবিধেটা নামায় পুষিয়ে নিচ্ছে। পাশ কাটিয়ে এরাও ভ্যানিস। রূপাবৌদি ভুল করে একখানা উলিকট গায়ে দিয়ে এসে গরমে কষ্ট পাচ্ছেন। আর রাস্তার পাশের বরফ তুলে মাখতে মাখতে চলেছেন। মোমদির পা একবার ফস্কেছে বলে নিজেই স্পিড কমিয়ে সাবধানে চলছে। মিস্টু ঘন জঙ্গলের পাশে গরগর আওয়াজ পেয়ে দলের মধ্যে হাঁটছে। নাহলে পায়ে চাকা লাগিয়ে চলছিল।

আমি আর কুঁড়ি নামছি। ওকে পেয়ে আমার বয়েস ওর বয়সে নেমে এসছে এখন আমি আর নামছি না। স্লিপ খাচ্ছি ইচ্ছে করে। ঢাল দেখলেই হাল্কা করে বসে ভাসিয়ে দিচ্ছি গা। লিডার দাদা ইচ্ছেমতো কখনো এগিয়ে কখনো পিছিয়ে দলের তদারকি করছেন। আর চলছে গান। দাদার পছন্দের গান ইউথ কয়্যার, সলীল চৌধুরী, আই পি টি এ…

আমার বেশ একলা হাঁটা পছন্দ। একসময় বেশ এগিয়ে নেমে গেছি। চারপাশে শুধু সবুজ জঙ্গল। কে না জানে এই ঘন বনে লেপার্ড ক্যাট থাকে। সে-কথা একটু আগেই আমাদের পোর্টার শুনিয়েছে গম্ভীরভাবে। আর সহেলিদি তো একখানা থাবার ছবিও তুলেছে।

এ উতরাই আমাদের চিরকাল মনে থাকবে। সারাদিন ধরে নামছি। ঘুরে ঘুরে নেমেই চলছি। না কমে জঙ্গল, না কমে বাঁক। আর পা ফেলা!? সে কী ধাপ রে বাবা! জল যেতে পারে এমন পথে যদি বিভিন্ন আকারের মানুষকে যেতে বলা হয়। বসে নামলে আটকে যাব এমন সরু, আর দাঁড়িয়ে নামলে ভু…স।

জঙ্গল একটু ফাঁকা হয়ে একবার একটা উৎরাই-এ এসে আমরা জামা কাপড় হাল্কা করে স্যাকে ঢোকাই। এই জায়গাটায় অনেক পোড়া গাছের গুঁড়ি পথের ধারে ভাস্কর্যের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শোনা যায় ১৯২৫-এর দাবানলের চিহ্ন এগুলো।

গুরদুম হয়ে তিম্বুরে

এতক্ষণ ছিল শুধু পাখির ডাক, পাতা ঝরার শব্দ, আর পায়ে চলার আওয়াজ। বিকেল গড়িয়ে আসে প্রায়, গুরদুমের ছোট্ট ছোট্ট বাড়িগুলো দেখা যায়। বাড়ি মানে মানুষ, মানে তেষ্টা, জল, আশ্রয়। কিন্তু যতই নামছি পাকে পাকে ততই কি বাড়িগুলোও নামছে না কী! হাল্কা হয়ে আসছে রিম্বিক ফরেস্ট বিট-এর ঘন বন, ঝরঝর করে শব্দ প্রথম শোনা গেল, তখনও শ্রীখোলা কত নীচে। বাড়িঘর দেখার পর ক্লান্তি বাড়ছে। আর চলতে পারছি না। জলের আওয়াজ কানে নিয়ে নামতে নামতে প্রায় সন্ধ্যে।

পাগুলো ভারী হয়ে আসে। পথ পৌঁছে দেয় গুরদুমের প্রথম হোটেলে। সেখানে একটু জিরিয়ে আবার নামা।

এবার সন্ধ্যের অন্ধকারে জঙ্গলের পথ বেয়ে টর্চের আলোয় জলের শব্দভেদী পথ হাঁটা। মাথার ওপরে আকাশে তাকালে বিস্ময়! এখন অমাবস্যা, তাই অজস্র হীরের কুচি নানান ঘনত্বে জ্বলছে, ঝলসাচ্ছে, অন্তরাত্মা আলোয় ভরে দিচ্ছে। মিল্কি ওয়ে স্পস্ট। আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না, আর দেখতেও চাইছি না। মনে হয় এই অনন্ত পথ চলা আমার সারাজীবনের সঞ্চয়। কখন তারই মধ্যে এগিয়ে এসে করণ মাথায় হেড টর্চ পরিয়ে দেয়, আগের পৌঁছোন দলের ছেলেরা পাঠিয়ে দিয়েছে পিছনের মানুষদের সুবিধের জন্যে। ঝরনার জলের আওয়াজ বাড়তে বাড়তে একসময় ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের মস্তিষ্ককে ঘিরে ফেলে। আমরা ব্রিজের কাছে নেমে এসেছি। পার হয়ে মটরশুঁটির ক্ষেত, টোমাটো, বাঁধাকপির ক্ষেতের পাশে সরু পথ ধরে এসে পৌঁছোই তিম্বুরে। আজ রাতের আস্তানা।

তারা ভরা আকাশের নীচে দাঁড়াই। শরীরের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় হীরেয় মোড়া মায়াবী অমানিশার আকাশ।

টুকরো প্রসঙ্গ কিছু

তারা: একজন আদ্যন্ত শহুরে মানুষকে যদি এক অমানিশার শীতল রাতে এক আকাশ তারা দিয়ে দেওয়া হয়! সে কী করে।

হেড টর্চটা বন্ধ করে অন্ধকার জঙ্গুলে পাকদণ্ডীর খাদ ঘেঁষে চুপ করে দাঁড়ায় একটু। এখানে তাকে কেউ চেঁচিয়ে সাবধান করার নেই। কারণ, যারা হাঁটছে তারা আগে পিছে, অন্ধকারে নিজেদের সামাল দিতে ক্লান্ত।

মাথা তুলে আকাশ দেখে চোখ ভরে। আর বাড়ি ফিরে শিশিরকুমার দাস-এর তারায় তারায় বইটা আবার বের করে পড়ার কথা ভাবে।

একজন মানুষকে খুব মনে হয়, মিহির সেনগুপ্ত। মাস্টারমশাই, যাঁকে অনেক বড়ো হয়ে জেনেছে। জিনি আজন্ম একটার পর একটা স্কুল আর ছাত্র তৈরি করে গেছেন। পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে, ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের দৃঢ় আর মজবুত মেরুদণ্ড বানিয়েছেন, পুরুলিয়ায় নিয়ে গিয়ে তারা চিনিয়েছেন। ফিরে গিয়ে তাঁকে বলতে হবে এই তারা দেখা।

একটা করে গান মনে আসে কিন্তু গাই না। কারণ, এ-সময় সে-স্তব্ধতাকেই আপ্রাণ শুষে নিতে চাইছে।
“তোমারই নাম সকল তারার মাঝে।” কে এই তুমি!

“আজি যত তারা তব আকাশে”… ‘তব’ মানে কার আকাশ!

“তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে…” কী অদ্ভুত কথা, কোন পাহাড়ে বসে কবি এমন করে ভেবেছিলেন।
“I wandered off by myself,
In the mystical moist night— air, and from time to time,
looked up in perfect silence at the stars”

শ্রীখোলা আমাদের মোহমুগ্ধ করে রাখে সারারাত তার জলতরঙ্গ শুনিয়ে। মনে হয় তার টানেই তারারা নেমেছে এত কাছে। এখানে দুটো পাহাড় বন্ধু হয়েছে। জুড়বে জুড়বে করেও অল্প স্পেশ রেখে পাশাপাশি আছে। এক নদী জল যাওয়ার জায়গা রেখে দেয়। কী ভালো হিসেব। তাই ওরা আকাশকে এত নিবিড় করে পায় রোজ।

প্রথম পাতা

Categories
পরিক্রমণ

পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রমণ

সান্দাকফুর পথে কয়েকদিন 

তিব্বতি রঙিন পতাকার ছায়া পড়েছে তার কালো জলে। উত্তর দিকে আবছা সান্দাকফু, পশ্চিমের আকাশ ফের সেই আবিষ্ট করে ফেলা লাল। হাওয়ার দাপট বাড়ে। আমাদের মনখারাপ, কেন গুষ্টিশুদ্ধু দেখলাম না আমরা।

টিপু বলে, চলো দিদি কয়েকটা সেল্ফি হয়ে যাক।

পান্ডিম লজ।

এই যে পাহাড়ে হাঁটা, এই যে ট্রেকার্স হাটকে এক-দু-দিনের ঘরবাড়ি বানিয়ে নেওয়া, রান্নাঘরে বসে আড্ডা, চা ডিমভাজার আবদার, কখনো দুধ দিয়ে কফি বানিয়ে দেবার অনুরোধ… এইসব দু-দিনের আলাপ হাসি কথায় কী পাওয়া যায়? হয়তো কিছুই না। বাঙালির অভ্যেস, যখন সে ভাষা হারায় তখন মনে পড়ে অবধারিত রবীন্দ্রনাথ। ছড়ার ছবির কবি আমায় উত্তর দেন “পথিক যে জন পথে পথেই পায় সে পৃথিবীকে
মুক্ত সে চৌদিকে
চলার ক্ষুধায় চলতে সে চায় দিনের পরে দিনে
অচেনাকেই চিনে”…

এতক্ষণ ছিল চলার ক্ষুধা। কালাপোখরির পান্ডিম লজে এসেই পেটের খিদে চাগাড় দিল। চা বিস্কিট পেয়ে শান্তি। এখানে রান্নাঘর আর থাকার ঘর দুটো বাড়ি মুখোমুখি। যেতে আসতে ঠোকাঠুকি লাগছে। আরেকটা গ্রুপের সঙ্গে। তাদের বেশিরভাগ অবাঙালি আর কয়েকজন ফরেনার। এক বাটি কালার্ড র‍্যাকেট পাপড় ভাজা নিয়ে একটি অল্পবয়সী মেয়ে বসে ছিল। এ-সব এখানে পাওয়া যায় জানতাম না। আমাদের যা দিচ্ছেন তাই খাচ্ছি।

বাবুদা এসে আমাদের গম্ভীরভাবে বোঝাচ্ছিলেন ফরেনাররা কত ডিসিপ্লিন্ড জানো! টি টাইম ছ-টা তো ছ-টা।এসে টেবলে বসে আছে। আবার চিনি মিশিয়েছে বলে রিজেক্ট করল। ডিনার টাইম ৭টা বলে উঠে গেল। সে বিলক্ষণ বুঝলাম। আমাদের রান্নাঘরে চায়ের জমায়েত বন্ধ করে দিতে হল ওদের টেবল গোছানোর জন্যে। আর ওদের খাওয়ার পর আমাদের জন্যে খাবার বানাতে একটু দেরি হল বলে আমরা পকোড়া ভেজে আনতে বললাম। প্রথমে দু- প্লেট, তারপর ইন্টু কতগুলো প্লেট হল সে লিডার দাদাই জানেন। আহা ঘরখানা বেশ আর চকচকে ডাবল লেপ। মরিচ দেওয়া চা আর পকোড়া নিয়ে জোর গপ্পে মেতেছি, ওমনি ওয়ার্ন করে গেল, পাশের ওঁরা ঘুমোবেন!! early to bed and early to rise… আমরা সেই মতো ভদ্র তখুনি। এই লজে খাবার পরিবেশনে বুফে সিস্টেম। ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, সয়া বড়ার কারি, ডিমভাজা, পাপড়। যারা পিতলের থালা পেলাম তাদের বেশ রাজকীয় ভাব এল।

কালাপোখরি পিছনে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। বারবার পিছন ফিরে দেখি আর অবাক হই কী সুন্দর পাহাড়ের ঢেউ পেরিয়ে পেরিয়ে আসছি আমরা। বয়স হাল্কা হয়ে যেন প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে। অনেক দূরে সামনে সান্দাকফুর আভাস। আজকের দিনটা ইদানীংকালের বহুল প্রচলিত Valentine’s Day, আমরা আমাদের সেই ভীষণ ‘প্রিয়’-র দিকে চলেছি সবাই। এই দলে সবাই হিমালয় পাগল। কেউ পাকা পাহাড়ু কেউ আমার মতো আনাড়ি প্রেমিক। সবাই মিলে হাঁটছি মহানন্দে।

বিকেভঞ্জনের শুরুতেই রাস্তায় বরফ! কনকনে হাওয়া। আর মেঘ। এত কালো যে, পথ হারিয়ে যায় বুঝি! একে-অন্যকে চোখে চোখে রাখি, হারিয়ে গেলে নাম ধরে ডাকি। উঁচুতে আরও উঁচুতে উঠতে উঠতে দেখি নীচে ঝকঝকে রোদ্দুর। ক্যামেরা বাগিয়ে তাক করতেই ম্যাজিকের মতও দৃশ্যবদল।

পাহাড় আমাদের নিয়ে লুকোচুরি খেলে এইরকম। পাইনের বন এগিয়ে আসে আমাদের অভ্যর্থনা করে। হলুদ রাস্তা কালো ঘন বন আমাদের ঘোর লাগিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে একটা আশ্চর্য আওয়াজ আমাদের ঘিরে ধরে, যেন সমুদ্র গর্জন। হাওয়ায় হাওয়ায় পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তোলে। কে জানত হাওয়ায় এমনি ঢেউ ওঠে! কালচে নীল জঙ্গল দেখে মনে হয় কেন কবি শক্তি লিখছিলেন স্বর্গের রং ঠিক এমনই।

একটা উঁচু পাহাড়। তার মাথায় ছোট্ট একটা সাদা বাক্স মতো রয়েছে যেন। ওইটাই সান্দাকফু টপ। ওইখানে উঠব। শুনে দমটা গলা অবধি এসে থেমে গেল। এক ঢোঁক জল খেয়ে লাঠি ঠুকে এগোই। কমবয়সী ছেলেগুলোর হাতে লাঠিসোঁটা নেই। বেশ হাঁটে সব ক-টা। মেঘ ঠেলে ঠেলে হাঁটা এখন আমাদেরও দিব্বি অভ্যেস হয়ে এসেছে। পাথর পাথর পথে মাঝে মাঝে লাল দিয়ে তির চিহ্ন আঁকা। ওই দেখে চলো। সামনেটা মেঘে ঢাকা তো কী!

ক্রমশ সব মেঘ পড়ে রইল নীচে। আমরা বুঝতে পারছি আর বেশি দূর নেই।

শুকিয়ে যাওয়া গলা হলেই-বা কী, গাইতে গাইতে হাঁটছি
“আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি
দেখা যায় তোমাদের বাড়ি…”

মাঝখানে ইন্ডিগো ব্লু দু-পাশে ধপধপে সাদা মেঘ উড়ছে, সেই নীলের বুকে আঁকা পিরামিড পিরামিড মাথাওয়ালা একটা বাড়ি নজরে এল অনেক উঁচুতে প্রথম। হৈ হৈ করে উঠলাম। বিভোর হয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হলাম!! এসে গেছি তবে!

একটা উঁচু পাহাড় সামনে। পাথুরে পথটা আমাদের উঠিয়ে আনল একটা সাইনবোর্ডের কাছে তাতে লেখা:
Singalila National Park
Leave nothing but footprints
and take nothing but…

বাকিটা আবছা। কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে এগোই। তার পাশে watch tower. তার বাঁ-দিকে বেসিন মতো জায়গায় বেশ অনেক ঘরবাড়ি, মানে ট্রেকার্স হাট, হোটেল এইসব। প্রচণ্ড মেঘলা আর হু হু হাওয়ায় কেঁপে-কুপে আমরা সবুজ চালওয়ালা বাড়িটার মধ্যে গুটগুট করে ঢুকে পড়লাম। হাওয়া আর ঠান্ডা একনিমেষে গায়েব। সামনেই সবচেয়ে উঁচু স্পট। কিন্তু আবহাওয়া বিশেষ সুবিধের নয়।

বাইরের আকাশ আষাঢ়ে মেঘলা। মন খুব দোটানায়। দেখতে কী পাব কিছু!?

রান্নাঘর থেকে খবর এল জলদি খেয়ে নিন। ডাইনিং-এ গিয়ে বসি। কাচের জানলা সব ঘরে। তাই খুব ভালো লাগছিল। ১১০০০ ফিটেরও কিছু বেশি ওপরে এসে এই কনকনে শীতে টেবল সাজিয়ে দিচ্ছেন গরম ভাত, ডাল, সবজি, পাপড়, শশা, পেঁয়াজ, টমেটো, আর নবরত্ন আচারে। সঙ্গে হাল্কা গরম জল। স্বর্গীয় অনুভূতি। মনে মনে কুর্নিস জানাই সেই হোস্ট আর হোস্টেসকে। যাঁরা এরপর আমাদের জন্যে সাজিয়ে রেখেছেন, পর্দা টানা কাচের জানলায় ভরা ঘর, নরম খাট আর লেপ।

গিয়ে বসি আর অজান্তে অপেক্ষা করি এক স্বর্গীয় মুহূর্তের।

“কী দেখেছ, কী দেখেছ, বলো
চুপ চুপ! দু-চোখ জুড়োল”

আজকের এই ১৪ই ফেব্রুয়ারির বিকেল আর ১৫-র ভোর থেকে সারাদিন এর কথা বলতে বললেই চুপ করে যেতে হয়। কিছুতেই বলে বোঝানো যাবে না যে, বিকেলের শেষে কীরকম করে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুষারকণারা ঝরে ঝরে পড়ছিল, রূপকথার গল্পের মতো সারাটা এলাকা ধপধপে সাদায় সাদা হয়ে যাচ্ছিল, সেই তুষারমালার দেশের পথঘাট পাইনের বন চুপচাপ শান্ত হয়ে কোনো রাজকন্যার প্রতীক্ষা করেছিল সারারাত। সারা সন্ধ্যে তুষার ঝরা শেষ হলে দু-একটা তারা আলো জ্বেলে বেরিয়ে এসে কাকে পথ দেখিয়েছিল…

সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি ছেলেরা হৈ হৈ করে গুঁড়ো বরফ কণা মেখে নিচ্ছিল সারা গায়ে, জানলার কাচ ঝাপসা করে বরফ কণারা নীচের কাঠে জমা হচ্ছিল খই ফোটার মতো। কেউ কেউ ছবি তুলে নিচ্ছিল, আমার হঠাৎ মনে পড়েছিল একটা গান
“কাশ্মীরেও নয়, শিলং-এও নয়
আন্দামান কি, রাঁচিতেও নয়
আরও যে সুন্দর…
রয়েছে কাছে এইখানে এই প্রাণে এই মনে আরো নির্ভর।”

কাঠের ঘরে ফাঁক দিয়ে বরফ এসে জমছিল মেঝেয় জানলায়।

আমরা বিভিন্ন জানলায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, আর ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম প্রায়। ঘরে কাংড়ি রাখা বারণ গত দু-বছর ধরে সিংগালীলা ন্যাশনাল পার্কে, অতঃপর চায়ের অর্ডার হল। ব্র‍্যান্ডির নিদান দিলেন কেউ। টয়লেটের পিচ্ছিল মেঝেয় যাতে কেউ অসাবধানে পড়ে না যায় সে-ব্যাপারে কেউ এসে সজাগ করে গেলেন। রান্নাঘর থেকে ডাক এল সাড়ে সাতটায় ডিনার সেরে ফেলার জন্য। সবাই মিলে ঠিক হল খিচুড়ি। সবজি দিয়ে খিচুড়ি আর স্যালাডের পাশাপাশি রান্নাঘর থেকে পাপড় ভাজার ঝুড়ি কোচড়ে বেরিয়ে এল ছোট্ট খুকি, তার কান মাথা কিচ্ছু ঢাকা নেই।

কালো আকাশে ফুটে ওঠা তারা অলিখিত ঘোষণা করে দিল আগামীকাল আকাশ পরিষ্কার থাকার সম্ভাবনা।

ঘুমোতে গেলাম নামেই, প্রবল ঠান্ডায় হাড় কাঁপুনিতে এপাশ ওপাশ করেই রাত। একটা ফেদার কোট খুব দরকার ছিল।

ভোরের আলো ফোটার আগেই ম্যাজিকের মতো সবাই নিজে নিজে উঠে পড়ে আর কেউ কারোর সঙ্গে একটিও কথা না বলে নিশি পাওয়ার মতোই কোনোমতে টুপিটা ঠিক করে পরে নিয়েই বেরিয়ে যেতে থাকে। একটা একটা করে ছায়া সেই আধো-অন্ধকারে দরজা দিয়ে বেরিয়ে মিশে যায় রাত কাটা আলো আঁধারিতে। কে কোন জন বুঝতে না পেরে আমি একজনের পিছু নি। সঙ্গে শুধু সেলফোন। ক্যামেরা নিতে ভুল হয়ে যায়। চলতে চলতে সে-মানুষ হারিয়ে যায়, একলা আবছায়াতে ফটফুটে বরফে পা রেখে খুব মনকেমন করতে থাকে, কারণ বুঝি না। জোর পা চালাই উঁচু জায়গাটার পথ ধরে। পিছু ধরি একদল টগবগে তরুণ দলের। ওরা কি ক্ষিপ্রতায় প্রচণ্ড খাড়াই বেয়ে উঠে যাচ্ছে। বুঝতে পেরে যাই ওদের বয়সটার জন্যে আমার মনকেমন করছে। এত বেশি সতর্ক হয়ে পড়লাম কবে! কেউ একজন আমার হাত ধরে নেয়, কয়েক পা উঠেও পড়ি, ওরা প্রায় দৌড়ে উঠছে, অন্যজন বলে আন্টি আপনি খালি হাতে পারবেন না। ঠিক বলে। আমি থামি। আমার জনেরা সব কই। নেমে আসি। ফাঁকা একটা জায়গা খুজে দাঁড়াই। উত্তর দিকে আবছায়ায় বুদ্ধদেব স্পষ্ট শয়ান। সম্মোহিত হই। ডান হাতে শুরু হয়ে গেছে রঙের খেলা, ক্রিমসান, স্কারলেট, ভারমিলিয়ন, এম্বার, বার্ণ্ট এম্বার, অরেঞ্জের স্তর কাটিয়ে প্রথম আলো পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘায়। মোহ, মগ্নতা আচ্ছন্নভাব কাটিয়ে দৌড় দিলাম পিছনের নির্মীয়মাণ হোটেলের দিকে। ছাদে আবছা কিছু মানুষ নজর হয়, কোত্থেকে চলে আসে শুভ। শক্ত করে হাত ধরে নিয়ে বকে, খুব পিছল, বরফ গলবে, আমার সঙ্গে আসুন দিদি। দু-জনে দৌড়ে প্রায় পাঁচ তলায়। একেবারে কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি। হিমেল হাওয়ার দাপট সামলে বড়ো বড়ো চোখে দেখি উত্তর-পশ্চিমে মাকালু লোৎসে এভারেস্ট স্পষ্ট হয়ে উঠল ক্রমশ।

সারাটা দিন মহান হিমালয় এভাবে জড়িয়ে থাকবে পাকে পাকে তা বোঝা যাবে না যদি না গুরদুমের রাস্তায় পা রাখতাম। বাঁকের পর বাঁক, কে যেন বলল বিরাশিটা! সে তো অগুন্তি পাকদণ্ডী, কিন্তু ফিরে ফিরে সামনে ভেসে উঠছেন রুপোলি মুকুটে সাজানো কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট মাকালু, লোৎসে।

শেষ পাতা

Categories
পরিক্রমণ

পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রমণ

সান্দাকফুর পথে কয়েকদিন

মেঘমার হাওয়ার ঝাপট বাঁচাতে পাথরের দেওয়াল খুঁজি। ঠেশ দি। পকেট থেকে বের করে খাই চিক্কি, আমসত্ব, লজেন্স (কলকাতা থেকে আনা। হাঁটলে বেশি খেয়ে বেরোলে বিপদ। সঙ্গে শুকনো খাবার রাখা দরকার। আর জল।

প্রায় চারটে বাজালাম পৌঁছোতে। দূর থেকে দেখে চেনা যায় শিখর লজের বাড়ি, গোলাপি চাল। আমরা তার পাশের পাশে উঠলাম। এক রাতের ঠিকানা। কুকুরগুলো ভরা বিকেলে অচেনা আমাদের দেখে বেশ ডাকল। আমরা সোফা সাজানো বসার ঘর পেয়ে বসেছি, বাকি দল এলে কাগজ দেখালে ঘর দেবে, ওমা! একজন এসে রাগ রাগ মুখে বকে গেলেন, জুতো খুলে যেন বসি সোফায়। ঠান্ডার দেশে চট করে এরকম জুতো খুলে বসার চাপ থাকে না জানি কিন্তু…

ভেবে-চিন্তে আমরা নেমে গেলাম রান্নাঘরে, কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে নীচে। গরম জল এগিয়ে দিলেন যেতে না যেতেই একজন টিপটপ লেডি। আমরা প্রাণ পেলাম। সারা রান্নাঘর জুড়ে তখন কাঠের জ্বালের ধোঁয়া। মেল ট্রেনের গতিতে রান্না হয়ে চলেছে গরম ভাত, ডাল, আলুকপির তরকারি আলুভাজা, পাপড়।

অপেক্ষা করতে করতে জানতে চাই কী কাঠে রান্না হচ্ছে!?

উত্তর এল: ভূর্জপত্র।

বেটুলা ইউটিলিস, আগের দিনে এ দিয়েই বানানো হত লেখার পাতা। অন্য ওষধি গুণের কথা না হয় বাদই থাক।

থাক দিয়ে ডাঁই করা রান্নাঘরের বাইরে। গাছ দেখতে চাইলে বললেন গুরদুমের রাস্তায় পাওয়া যাবে। এই গাছও একদিন হারিয়ে যাবে।

টুমলিং এর রাত

আজ অনেকটা হেঁটে এসে যে যার পফসেবায় মন দিলাম, আর খুশি খুশি গল্পে মেতে গেলাম। কার কখন কী অসুবিধে হচ্ছে, তা যেন আমাদের দলপতি দু-জনের দায়। শুনলাম সেই দাদার ঝুলিতে মাত্র ৩৭টা অভিযানের গল্প আছে। তাঁর আগামী ইচ্ছে জেনে চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল!! মাউন্ট এলব্রুজটা যাওয়ার ইচ্ছে। আল্পস্‌ ইত্যাদি, মাঃ কিলিমাঞ্জারো সারা হয়ে গেছে। তখুনি মনে মনে ভাবলাম, আগামীকাল ওনার কাছাকাছি হাঁটব আর গল্প শুনব। এদিকে শীতে কাঁপুনি ধরেছে জোর। এমন সময় এক দলপতি দাদার প্রবেশ। কী সব ঠিকঠাক তো! বলতে না বলতেই নজর গেল আমাদের মেয়েদলের একজনের দিকে, সবে লেপ গায়ে বিছানায় ঠেশান থেকে শয়নে তার স্থান পরিবর্তন হয়েছিল। দাদা অসম্ভব সিরিয়াস গলায় ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ টাইপের বকেঝকে তাকে সটান বসিয়ে দিলেন। অল্প অল্প গরম জলের দাওয়াই দিয়ে নিজেই আনতে চললেন। আমরা অবাক।

পরে জানলাম হেঁটে এসে শুয়ে পড়লে altitude sickness-এর শিকার হতে হবে। তাই এই কড়া দাওয়াই। সে বেচারী সত্যিই খুব কষ্ট পাচ্ছিল, মাথা ধরা এ-সবে। তাও উঠে বসে, রুটি খায়। পরদিন বিলকুল সুস্থ।

রাতে অসম্ভব নরম রুটি আর সবজি (আলু) যেন অমৃত।

আজ১৩ ফেব্রুয়ারি।

টুমলিং থেকে কালাপোখরির দিকে।

ভোর না হতেই আকাশ লাল দেখতে সবাই ছুটলাম ঘর ছেড়ে। ভিউ পয়েন্টে গেলে পিক দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব সকাল ফুটে উঠল। রান্নাঘরে তখন ডিম ময়দা বেকিং দিয়ে বানানো মিষ্টি মিষ্টি রুটি ভাজার গন্ধ আসছে। কাঠের জ্বালে চোখ জ্বালা করে তবু সবাই নামি গরম জল চা আর নাস্তার টানে। হাসি মুখে বড়ো কাঠের টেবলের চারপাশে গোল হয়ে বসি।

কেউ কোনো তাড়া দেন না। সুস্থিরভাবে সবাই সব গুছিয়ে বেরোই। সামনে ঢেউ-এর মতো পাহাড় সারির পিছনে দেখা যাচ্ছে কালাপোখরি টপ। সবুজ সবুজ পাহাড়ের মাথায় একটা সিনক্লাইনাল স্ট্রাকচার। তারও পিছনে খাঁজকাটা সান্দাকফু আবছা।

সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান গিয়েছে টুমলিং-এর পাশ দিয়েই। একটা চেকপোস্ট রয়েছে শুরুতে। পথেই পড়বে নেপালে ভারত সীমায় জৌবাড়ি।


আজকের পথে পাহাড়গুলো কালো ঝোপে ঢাকা। ওই কালো ঝোপগুলো সম্ভবত র‍্যাস্পবেরি, স্থানীয় ভাষায় বলে আসিলু, ছোট্ট লাল ফল হয়, খায় মানুষ।

আর ছিল রডডেন্ড্রন (গুরাস) প্রতিটায় মাথায় পাতায় কুঁড়ি। এবার আরও উঁচুতে উঠছি বলে গাছগুলো বৃক্ষ থেকে গুল্ম হয়ে যাচ্ছে, মানে আকারে ছোটো, পাতারা একটু সরু এরকম।

কালাপোখরির দিকে।

হাঁটছি তো হাঁটছি। চড়াই আর উতরাই তবে খুব খাড়াই নয়। হাঁপিয়ে গেলেও সামলে নেওয়া যায়। জলের বোতল খালি হয়ে যায়, কালাপোখরি তো দূর অস্ত, আমাদের নাকি গৈরিবাস-এ নামতে হবে আগে, তারপর ওইইইইইইই যে বলে লিডার একটা উঁচু পাহাড় দেখান।

যা দেখান তাতে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আর অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হতে লাগল। দূরে এক সবুজে ছাওয়া পাহাড়ের গা বেয়ে চকচকে সরীসৃপের মতো এক পথ উঠেছে অন্তত ৭০ ডিগ্রি এঙ্গেলে। ওটাই আমাদের পথ। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখি তখনও কে জানত ওই পথেই দেখা মিলবে রেড পান্ডা, জায়ান্ট স্কুইরেল, বরফ হয়ে যাওয়া ঝরনা আর… পাখির!!!!

চলতে চলতে স্বাতিদি বলে ওঠে, জানিস পিয়ালি এ পথ আর ফুরোবে না, ওই গৈরিবাস বলে আসলে কিসসু নেই, আমরা শুধু হেঁটেই চলছি। হাসাহাসি করি আর লাঠি ঠুকে ঠুকে চলি। একসময় অনেক নীচে দেখা যায় গৈরিবাস। দুপুর তখন একটা। নামতে থাকি।

আজ দলের দুই দিদির যেন ডানা লেগেছিল গায়ে, সবার আগে এগিয়ে যে কোথায় গেছে, দেখাই পাইনি আর সবচেয়ে ছোটও টিপু তো পথ হারিয়ে নেপালে চলে যেতে গিয়ে মানে মানে ফেরত এসছে, তাও সে দাবি করেছে রেড পান্ডা দেখেছে, সবাই ওকে বলেছে ওটা নিশ্চয়ই বড়ো লাল মুরগি-টুরগি হবে।

এ-সব শোনা গেল গৈরিবাসে নেমে মোমো খেতে খেতে…

গৈরিবাসের পর…

এবার সেই সবুজ পাহাড় সামনে। বেলা দেড়টায় হাঁটা শুরু করি। ওই যে পিচের রাস্তা খাড়াই উঠে গেছে। একদল এগিয়ে গেছেন ততক্ষণে। একদল খুব দক্ষ যাঁরা, তাঁরা রয়ে গেলেন পিছনে। পেটে গরম ভেজ মোমো।

চড়াই এমন যে হাজার প্রশ্ন আসে মনে। কী করে কাটল পাহাড়, এত খাড়াইতে কেমন করে প্লাস্টার করে রাস্তা। জনমানব নেই কোত্থাও, শুধু সবুজ বাঁশের ঘন জঙ্গল দু-ধারে। আর রডোডেন্ড্রন, পাতায় পাতায় কুঁড়ি সাজানো। পাকদণ্ডীতে হৃদয় মুঠোয় চলে আসতে চায়। সারা রাস্তা জুড়ে শুধু পাখির ডাক। অনেকটা উঠে আসি আর এক ধাপের ওপর পথটা দু-দিকে চলে গেছে। কাকে জিজ্ঞেস করি। লাঠির আওয়াজ প্রতিধ্বনি শোনায় শুধু। বসি। ওমা! ঠিক কোত্থেকে হাজির হয় করণ, আমাদের পোর্টার, পথ বলে দেয় আর বলে সোজা যাবেন, নো শর্টকাট। এদিকে নেপাল যাওয়ার কিছু চোরাগোপ্তা পথ আছে। কাঁয়াকাট্টা থেকে ডান দিকে ঘুরবেন, বলে দেয়। বলে কোনো দিক দিয়ে আবার গায়েব।

জঙ্গুলে পথে মাঝে একটা মাইলস্টোন, সাদা। কতটা এলাম কে জানে।

এক সময় কাঁয়াকাট্টা এসে গেল। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সাড়ে তিনটে বাজে প্রায়। বিকেল গড়ায়। তিনজন নেপালি ছেলেমেয়ে গল্প করছিল, একটা দোকান বাড়ির সামনে। চা হবে? জানতে চাই। পনেরো টাকা। খেয়ে আবার হাঁটা। এমন সময় টিপু হাজির। ওপরে পৌঁছে আগের দলকে বসিয়ে আবার নেমেছে চলতি একটা বনদপ্তরের গাড়িতে।

বাকি পথটুকু আমাদের হাঁটা শুরু হল। কেউ নেই শুধু আমরাই।

রাস্তাটা পাথরে বাঁধানো। কটর-মটর করে আমাদের লাঠির আওয়াজ। আর কিছু নেই। পাখিগুলো নিশ্চিন্তে ডাকে, তাই থামতে হয়… দেখলাম কী!? ফায়ারটেল মাইযরনিস, কিংবা কালিজ ফেজ্যান্ট!! বিকেলে হয়েছে বলে ওদের এত ওড়াউড়ি। কেউ একটু আওয়াজ নকলের চেষ্টা করে। টিপু বকবকানি করে আমাদের পথ চলার এনার্জি জোগানোর চেষ্টা করতে করতে কখনো শান্ত হয়ে যায়। একটা ঢেউ-এর মতো বাঁক পেরিয়েছি, হঠাৎ ওর উত্তেজিত গলা! রেড পান্ডা! রেড পান্ডা!!

সত্যিই তাই, মুহূর্তে ভ্যানিশ। পিছনের দল আরও ভালও দেখেছে, একটা স্থানীয় বাচ্চা মেয়ে তাকে তাড়া করায় ঝটপট বাঁশের জঙ্গলে পালায়। ছবি নেই কিন্তু মনে আঁকা রয়ে গেল ওই অপূর্ব সুন্দর লাল ভালুক।

এরপর থেকে টিপু বারবার আমাদের মনে করিয়েছে আমরা যেন ওর পক্ষে সাক্ষ্য দি। আর এর বদলে ওকে mango bite খাওয়াতে হল বেশ ক-বার।

স্বপ্নের মতো আমার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে হারিয়ে গেল রেড পান্ডা, ভালো করে বুঝে উঠতে না উঠতেই… তাই আমার বেশ মন খারাপ হল। তখন আমায় মিমো জানায় ভূগোল দিদিমণির জন্যে আরও আশ্চর্য জিনিস আছে সামনে!

সত্যিই দেখলাম বরফ হয়ে যাওয়া ঝরনার পথ। আনন্দে আটখানা আমি ওই বরফে পা দেবই, টিপু এবার বড়ো দাদা হয়ে হুকুম দিল বেকায়দায় পড়বে, তার চেয়ে চলো, এগোই… সামনে আরও কঅঅত কী!

বিকেল পড়ে আসে, কালাপোখরি মেঘে ঢেকে যায়, দূর থেকে দেখা যায় না। টিপু তাড়া লাগায়। পশ্চিমের লাল হয়ে ওঠা আকাশ আর পুবের মেঘলা হাওয়া কনকন করে ফুঁড়ে দেয় অ্যাল্পাইনের উইঞ্চিটার। হাতের আঙুল লালচে ব্যথা ব্যথা।

বাতাসে চেকপোস্টের কাছে আসতেই শুনলাম আর বেশি বাকি নেই, প্রাণে নতুন বল এল। টিপুর অনন্ত এনার্জি আমাদের মশগুল করে রাখে। ছবি তুলতে দাঁড়াই ওই সীমান্ত প্রহরীদের নিয়ে। আমি যখন ভাবছি কালাপোখরি আর কত দূর! ওরা হয়তও ভাবছেন নিজের নিজের ঘর, সঙ্গী বা সন্তানের কথা। হাসি বিনিময় হয়। আবার চলি। এই এতক্ষণ পর মানুষ পেলাম। এর আগে পেয়েছি পাখি ভালুক আর জায়েন্ট স্কুইরেল।

একটা বাঁক ঘুরতেই কালাপোখরি।

তৃতীয় পাতা

Categories
পরিক্রমণ

পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রমণ

সান্দাকফুর পথে কয়েকদিন

সান্দাকফু মানে হল ‘Height of the poisonous plant’ বা বিষাক্ত গুল্মের দেশ। সম্ভবত সেই গাছ হল একোনাইট যা থেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ হয়, সেটা অনেকেরই জানা।

Categories
কবিতা

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের কবিতা

আষাঢ়লিপি

এক
পায়ের শব্দগুলো ঘুমে নেই, জাগরণে নেই, থেমেছে অনেককাল
বধিরতা অভ্যেস করে কান সরু আর তীক্ষ্ণতা অর্জন করেছে যত

Categories
কবিতা

শুভাশিস মণ্ডলের কবিতা

এইবার, একটু লাফিয়ে

এইবার, একটু লাফিয়ে, সে নামল, স্বয়ং, ললাটে ।
আর ঠিক সে-মুহূর্তেই
সোনার বাটিতে ছিটকে লাগল কিছু