Categories
কবিতা

রঞ্জন মৈত্রের কবিতা

সাইকেল-১

জানি সেই ছাদ কলমে আসবে না
মাঝে আর শব্দটি সরিয়ে দিয়েছি
ছাদ ছন্দ ছত্রাকার না হোক

Categories
গদ্য

কুণাল বিশ্বাস

 

“রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, ধর্ম, সাহিত্য ও শিল্পের উন্নতি অর্থনৈতিক উন্নতির উপর নির্ভর করে। তবে সমাজের সার্বিক উন্নতির ক্ষেত্রে অর্থনীতি কোনো একক ভূমিকা নিতে পারে না।”

—সারকেনবার্গকে লেখা এঙ্গেলসের চিঠি (জানুয়ারি ২৫, ১৮৯৪)

Categories
সাক্ষাৎকার

মধুময় পালের সাক্ষাৎকার

এক দেশভিখারির মাটি অন্বেষণ

[লেখক মধুময় পালের সঙ্গে আলাপচারিতায় শতদল মিত্র]

আর ‘মরিচঝাঁপি’?

আগেই বলেছি বাম দলগুলো উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি করেছে, কিন্তু তাদের সমস্যার সমাধানে কতটা আন্তরিক ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ আছে। বাংলার মাটির বিপরীত ভূমি দণ্ডকারণ্য, সেখানে উদ্বাস্তুদের যেতে দিল। অথচ আন্দামানে যেতে দিল না। ওখানে বাঙালিদের আর একটা রাজ্য পেতাম। বামপার্টিরা পার্টি লাইনের বাইরে গিয়ে বাস্তবকে স্বীকার করতে পারল না। সবকিছু চেপে দেওয়া হতে লাগল। সাবিত্রী রায়ের ‘স্বরলিপি’ চেপে দেওয়া হল। গোপাল হালদার মন্বন্তর নিয়ে লিখলেন, কিন্তু দেশভাগ নিয়ে লিখলেন না। মরিচঝাঁপির রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেও চেপে দেওয়া হল। এখন দণ্ডকারণ্যের ওই রুক্ষ পাথুরে বাংলার বিপরীত ভূমি থেকে তারা তাদের পরিচিত জল-পলির দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিল। এটাই ছিল তাদের একমাত্র অপরাধ। ১৯৭৮— নতুন ক্ষমতায় আসা একটা বাম সরকারের এমন বর্বরতা মানা যায় না! দণ্ডকারণ্য থেকে ওরা এসেছিল বাম সরকারের ভরসাতেই। নেতাজিভক্ত, তাই মরিচঝাঁপির নাম দিয়েছিল— নেতাজিনগর। আমি উদ্বুদ্ধ হই এ-ইতিহাস খুঁড়ে বার করতে, বাঙালি হিসাবে এ আমার দায়ই ছিল। সে-সময় তো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বা সোস্যাল মিডিয়া ছিল না। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে নথি যোগাড় করতে হয়েছিল। দণ্ডকারণ্যের মালকানগিরির নির্মল কান্তি ঢালি বা রাধিকা রঞ্জন বিশ্বাসের ‘নিজের কথায় মরিচঝাঁপি’ থেকে প্রচুর তথ্য পাই। এ-প্রসঙ্গে নাম করতে চাই বিখ্যাত সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ও স্টেটসম্যান কাগজের ফোটোগ্রাফার সুব্রত পত্রনবিশের।

নানা ধরনের সম্পাদনামূলক কাজ করতে গিয়ে আপনার নিজের মৌলিক লেখালেখি কি কিছুটা হলেও খর্ব হল না?

লেখক হিসাবে তেমন স্বীকৃতি পাইনি সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে— এটা সত্য। কিন্তু তার জন্য কোনো আফসোস নেই। মৌলিক লেখার চেয়ে সম্পাদনার কাজটা বাঙালির দায় হিসাবে নিয়েছি বলেই।

‘আখ্যান পঞ্চাশ’ গত বইমেলায় প্রকাশিত হল। তার আগে ‘আরণ্য রজনী’, ‘কহনবেলা-১, ২’। উপন্যাস ‘আলিঙ্গন দাও, রানি’, ‘রূপকাঠের নৌকা’। আপনার ভাষার চলন অনন্য। কবিতার মতো চিত্রকল্পময়, আবার ছবির মতো ছায়াতপের মায়া— স্পেসের খেলা, কখনো নাটকের বয়নই যেন! এ ভাষা এতই আপনার নিজস্ব যে, সেখানে আমি অন্য কারো প্রভাব খুঁজে পাইনি। যদি পেয়ে থাকি তা রূপকথার কথনভঙ্গি! এ-ভাষানির্মাণ কিছুটা সহজাত যদিও হয়, বেশিরভাগটাই তো সচেতন প্রয়াস। এ বিষয়ে…

যখন ভাবলাম নিজের লেখা লিখব, তখন তো মোটামুটি আমার ধারণায় ছিল কী লিখব। কিন্তু প্রশ্ন— কীভাবে লিখব? আমি আমার নিজস্ব ভাষা নির্মাণে সচেষ্ট হলাম। আমাকে প্রভাবিত করে বঙ্কিম, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, দেবেশ রায়, মতি নন্দী। আর ওয়ালীউল্লাহ। না, রবীন্দ্রনাথের গদ্য, এমন কী কমলকুমার বা অমিয়ভূষণও নয়। আমি বিশ্বাস করি ভাষা দিয়ে ব্যক্তিত্বকে চেনা যায়। যতদিন না নিজের ভাষা তৈরি করতে পেরেছি ততদিন লিখিনি। ঠিকই বলেছ আমার গদ্যে ছবি-কবিতা-নাটকের প্রভাব আছে। একসময় প্রচুর ছবির প্রদর্শনী দেখেছি, নাটক দেখেছি, কবিতা তো আজও পড়ি। আর গীতবিতান। এ-সব দিয়ে পটো যেমন মূর্তি গড়ে পরতে পরতে— সেরকম মায়ায় আমি আমার ভাষাকে গড়ে তুলি। আসলে যে-ভাষার সঙ্গে আমি ঘর করব, তাকে তো আদর দিতেই হবে, ভালোবাসা দিতে হবে। সে যে আমার প্রেমিকা, ঘরণি— তাকে তো সুন্দর করে সাজাবই।

অনেকেই কিন্তু আপনার লেখাকে ‘জাদুবাস্তবতা’ বলে দেগে দেয়। অবশ্য এই দেগে দেওয়াটা আমাদের বহুকালের বদ অভ্যাস… সেই আধুনিক সাহিত্যের শুরুর যুগ থেকে আমাদের সাহিত্যকে ৫০ কি ১০০ বছরের তামাদি বিদেশি কোনো তত্ত্বে দাগিয়ে না দিলে আমাদের পিচুটিচোখো সমালোচকদের ভাত হজম হয় না যেন!

ঠিকই বলেছ, বিদেশি তকমা না জুটলে আমাদের সাহিত্য যেন কল্কে পায় না। জাদু বাস্তবতা! আমার গদ্যে জাদুবাস্তবতা নেই, যা আছে তা হল ভয়ংকর বাস্তবতা। একজন দেশভিখারি নিজের মাটি খুঁজছে— এখানে জাদু কোথায়, এ তো ঘোর বাস্তবতা। ডি. জে.-র আওয়াজের কম্পনে মায়ের পেটের বাচ্চা বেরিয়ে আসতে চাইল— এটা জাদু নয়, নগ্ন বাস্তব। আর প্রত্যেক দেশের রূপকথাই তো জাদুবাস্তবতা, যা আসলে বাস্তবতাই। আমাদের রূপকথা, পুরাণ, মঙ্গলকাব্য— জাদু ও বাস্তবতার সোনার খনি। আমাদের রূপকথায় ছোট্ট টুনটুনি রাজাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, রাজাকে দুয়ো দিয়ে জানাচ্ছে— রাজা খায় ব্যাঙ ভাজা! রাষ্ট্রশক্তিকে এনকাউন্টার করছে। ভাবা যায়! চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতুর আনা স্বর্ণগোধিকা রূপ পালটে হয়ে যায় অসামান্য সুন্দরী নারী। ওই মঙ্গলকাব্যেই সমুদ্রমাঝে এক নারী হাতি গিলে খায়, ওগরায়। একে যদি জাদুবাস্তবতা বলো সে তো আমাদের ঐতিহ্যে! তবে একটা কথা বলতে চাই— সচেতনভাবে সবসময় চেষ্টা করেছি গল্পের মধ্যে থেকেও তথাকথিত গল্পের ধাঁচের বাইরে থাকতে। কতটা পেরেছি পাঠকই বলবেন।

তাছাড়া আমার মনে হয় প্রত্যেক দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি তার মাটির বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে জন্ম নেয়। সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা নিজের ভাষা-সংস্কৃতিকে হারিয়ে, তাকে খুঁজছে— তার বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের বাস্তবতা মিলবে কীভাবে?

ল্যাটিন আমেরিকার জীবনযাত্রা অন্য ধরনের। উদ্দাম। আমরা ১৮০ কিলোমিটার বেগের ঝড় সামলাতে একযুগ সময় নিই, তাও পারি না। আর ওরা ২৫০-৩০০ কিলোমিটার বেগের সাইক্লোন, রুক্ষ-উগ্র প্রকৃতিকে নিয়ে ঘর করে। ওদের ভোজ্য-পেয় আলাদা। ওদের উত্সব-যৌনতা ঝড়ের মতনই উদ্দাম। ওদের সঙ্গে যুদ্ধহীন-ভেতোবাঙালির তুলনা চলে? সুতরাং ওদের সাহিত্যের যে-‘জাদুবাস্তবতা’, তা আমাদের সাহিত্যে ব্যর্থ অনুকরণই মাত্র।

ভাষার জাদুর বাইরে গিয়ে আমি বলতে চাই যে, আপনার প্রতিটি লেখাই আদ্যন্ত রাজনৈতিক। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করছে, রাষ্ট্রকে টার্গেট করেছে। আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, শরত্‍চন্দ্র থেকে শুরু করে আজকের নবারুণ ভট্টাচার্য, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুময় পাল… একটা রাজনৈতিক সাহিত্যের সমান্তরাল ধারা প্রবাহিত। কিন্তু বর্তমান সাহিত্যে রাজনীতি, মানে প্রত্যক্ষ রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে আপনার মনে হয় না?

দেখো, আমি যৌবনে, ছাত্রজীবনে নকশাল রাজনীতি করেছি। আমাদের রাজনীতি ছিল একটা আদর্শের, যা বর্তমানের কামিয়ে নেওয়া দলীয় রাজনীতি থেকে আলাদা। আগেই বলেছি আমাদের রাজনীতির সঙ্গে বরং স্বদেশি আন্দোলনের মিল, স্বদেশি আন্দোলনেরও তো একটাই চাওয়া ছিল দেশের পরাধীনতার মুক্তি। এই আদর্শবাদী রাজনীতি থেকেই আমার যাবতীয় লেখালেখি, মানুষের জন্য লেখা। সুতরাং আমার লেখা পরিকল্পিতভাবেই রাষ্ট্রবিরোধী। রাঘব, নবারুণ রাষ্ট্রকে সরাসরি টার্গেট করেছে, সাধ্যমতো আমিও— সেটাই তো প্রকৃত লেখকের ধর্ম। আর বর্তমানের বাজারি সিরিয়ালধর্মী লেখা? যেখানে শ্রমিক-কৃষকের জীবন যন্ত্রণা, তার লড়াই নেই, মানুষের সমস্যা নেই— সেখানে রাজনীতি আশা না করাই ভালো। ওগুলো তো ইতরামি লেখা, ফাত্‍রামিও বলতে পার— বালখিল্য প্রেম, যেন বাচ্চাদের নুনু-নুনু খেলা। এই লেখকরা এন্টারটেনারও নয়। সমরেশ বসু এন্টারটেনার ছিলেন, তার জীবন অভিজ্ঞতা ছিল, তাই বিটি রোডের ধারের মতো উপন্যাসও লিখতে পেরেছিলেন। ‘শোলে’ সিনেমার মতো এন্টারটেইনিং সিনেমা করতে গেলে দক্ষতা লাগে। এইসব বাজারি লেখকদের সে-দক্ষতা কোথায়? সব তো প্রতিষ্ঠানের পোষ্য। পুরস্কার নয়, টাকাই কাম্য— স্কিম করে সেটিং সাহিত্য। এর জন্য দায়ী সংবাদপত্রের কর্পোরেট কালচার। আমাদের সাহিত্য সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রিত। যতদিন কর্পোরেট ছিল না, তখন সতীনাথ ছাপা হয়েছে। এখন যা ছাপা হয়, তা খায় না মাথায় দেয়— কেউ জানে না। এরা শুধু সাহিত্যকে ধ্বংস করছে না, পাঠকও নষ্ট করছে। অধিক ফলনের কারণে মাটির প্রজননের মতো মেধার প্রজননও কমতে লাগল। ওই যে বলেছি— ভারতীয় বাঙালিরা নিজের ভাষাকে ভালোবাসে না, তারা নিজেকেই ভালোবাসে না। কিন্তু ওপার বাংলায় পাঠক আছে, তাই সাহিত্য পত্রিকা আছে, কেন-না তারা নিজের জাতিসত্তাকে ভালোবাসে।

তবে একেবারে জীবনবিমুখ, রাজনীতিবিমুখ লেখাই শুধু হচ্ছে তা নয়, জীবনের, তার রাজনীতির লেখাও হচ্ছে— তুমিই তো তার উদাহরণ।

এখন কী লিখছেন? বড়ো লেখা…

পেশার চাপে উপন্যাস তেমন লিখতে পারিনি। এই লকডাউন সময়ে লিখলাম। প্রায় ২৫০ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস— ‘একদেশ ভাইরাস’। শুরুটা এরকম— ‘চারুবালা দেখল আগুনের গোলার মতো একটা মাছ আকাশে উঠল, শরীর ত্যাগ করে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল’।

বাঃ! চমত্কার! সেই মধুময় জাদু! আবারও কিন্তু জাদু কথাটা এসেই গেল— ভাষার জাদু!

হ্যাঁ, ভাষা নিয়ে খেলি আমি। তবে বর্ণনাটা ঘোর বাস্তবের— আসলে জলা ছিল, তা বর্তমানে উবে গিয়ে বহুতল… তা, মাছটা যাবে কোথায়? এখানে জাদু নেই কোনো, আছে ভয়ংকর এক বাস্তবতা।

অপেক্ষায় থাকলাম এ-লেখার। সাবধানে থাকুন, ভালো থাকুন। আর আরও আরও লেখা দিয়ে পাঠক আমাদের মননকে সমৃদ্ধ করুন— এই কামনা করি।

তুমিও ভালো থেকো।

প্রথম পাতা

Categories
সাক্ষাৎকার

মধুময় পালের সাক্ষাৎকার

এক দেশভিখারির মাটি অন্বেষণ

[লেখক মধুময় পালের সঙ্গে আলাপচারিতায় শতদল মিত্র]

Categories
গল্প

অরিন্দম রায়ের গল্প

হতে পারত একটি ভূত
কিংবা একটা বাঞ্চোৎ-এর কাহিনি

“বল মাগি…”

চমক ভাঙল। ভূতটা যেন স্বপ্ন-জগতে ছিল এতক্ষণ।

ভূতেও স্মৃতি হাতড়ায়? এটা ভেবে এ অবস্থাতেও বাচ্চু যেন কিয়দ পরিমাণ হেসে ফেলল। স্মৃতি বড়ও নিঠুর। বোকাও। সময় অসময় না বুঝে নাক গলায়। বাচ্চু তারপর ভাবতে থাকল…

ভূতটা দ্যাখে, নীলুকে দেওয়ালে ঠেসিয়ে দেওয়া হয়েছে যেমন-তেমন করে। কিছুটা কাত হয়ে সব নিগ্রহ সহ্য করছে নীলু। তাকে অর্ধ-বিবস্ত্র করা হয়েছে। ওর রক্তশূন্য স্তন মর্দন করছে দু-জন দু-পাশে দাঁড়িয়ে। আর হোঁৎকাটা বন্দুকের নল এগিয়ে দিচ্ছে সায়ার দিকে। নীলুর চোখে জল। বাচ্চু স্পষ্ট দেখে ভূতটা কিছুই করতে পারে না। নিঃশব্দে অশ্রাব্য খিস্তি দেয় কেবল। বালের সমাজ শালা ভূতে ভয় পায়। ভূত নিয়ে ভয়ঙ্কর সিনেমা বানায়। ঘণ্টা! ভূত শালা কেবল দেখতে পারে। করতে পারে না কিছুই। করতে পারলে তো সমাজটাই শালা বদলে যেত। নীলুর উপর অত্যাচার বাড়ে। বাচ্চুর ভূত খুঁজে পায় না কী করবে!

দেওয়ালে ঠেস দেওয়া বাচ্চু বোঝে ভূতের ফোকালাইজার কেটে যাচ্ছে এবার। নীলুর এভাবে যন্ত্রণা পাওয়া, নিগ্রহ, ও কল্পনা করতে পারছে না আর। অথচ, ও নিশ্চিত জানে এমনই হবে, এমনই হয়। তাই আবার ফিরে যায় বাকিটা দেখতে। অদমনীয় কৌতূহলে…

নীলুর বাঁ ভ্রুতে সিগারেট গুঁজে দিল কে একজন। বোবা নীলু যন্ত্রণায় কাতরায় কেবল। বেঁকে যাওয়া ঠোঁট রক্তাভ। বাচ্চু তার শেষ স্মৃতিচিহ্ন এঁকেছে কিছু আগে। এমন সময় পাশের ঘর থেকে কে আঁতকে উঠে হাঁক পাড়ল— “স্যার! এখানে একটা মেয়ের বডি…”

— নাহ! নীলুকে মরতেই হবে। নইলে বাচ্চুর মরেও মুক্তি নেই। বাচ্চু স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। নীলুকে রেখে যাওয়া চলবে না কিছুতেই। কিন্তু গুলি তো দুটো। তবে তো মেয়েকে থাকতে হয়… বাচ্চু প্রাজ্ঞ এক ঋষির ন্যায় ধ্যানস্থ হয় মনের তপোবনে… নতুন করে সাজায় মরণ-ঘুঁটি…

ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বাচ্চু পড়ে মেঝেয় চিৎ হয়ে। থকথকে ঘিলু ছিটকে আছে। রক্ত-ঘিলুর উপর ভারী বুটের ছাপ পড়ছে। এ-ঘর থেকে ও-ঘর হেঁটে ফিরছে কতকগুলো পা। একটা হোঁৎকা মতন বিশ্রী লোক। মুখে সিগারেট। বাচ্চুর দিকে ঘৃণিত চোখে একবার দেখে নিয়ে সম্মুখের ঘরে এগিয়ে এল। এসে বসল চেয়ার নিয়ে। বলল—

“কোনো ভয় নেই মামণি। এই, এর মুখের কাপড়টা খুলে দে…”

ঘণ্টা দেড়েক পর বন্ধনমুক্ত হয়। মেয়েটা ভেঙে পড়ে কান্নায়। ও জানে না বাচ্চু মরে পড়ে আছে পাশের ডাইনিং-এ।

“আমার বাবা কোথায়? মা?”

“তোমার বাবা একটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা ছিল। বুঝলে মা? তুমি জানতে না তোমার বাবা কী করত? মালটা খোচর ছিল। কত লোকসান…”

“না, না। বাবা এমন ছিল না”

“চোওপ! ন্যাকামো না। বল তোর বাবার কোথায় সিক্রেট রুম? কী কী এভিডেন্স পেয়েচে দেখতে হবে”

“জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। আমি তো হোস্টেলে থাকতাম। দু-দিন হল বাড়ি এসেছি”

“ধ্যুৎ! কেন যে শালা সহজে কেউ কিছু বলে না! ভালো লাগে না বাল! এই, একটু নাড়াচাড়া কর…”

বাচ্চুর ভূত বোবা হয়ে দেখে যাচ্ছে সব। কান্নার ভাব আসছে। কিন্তু অশ্রু না।

একজন পিস্তল ঠেকায় মেয়ের কপালে।

হোঁৎকাটা আঁতকে উঠে বলে— “এই! এ শালা, কেরে! একটা কচি ডাবকা মেয়ের মাথায় পিস্তল ধরা হচ্চে? বালটা জানো না প্যান্টের নীচে কামান আছে?”

‘‘হাঃ হাঃ হাঃ হা…”

মেয়ে চিৎকার করতে গেল… আর তখনই এক থাপ্পড়। ভয়ে কুঁকড়ে গেল ও। হোঁৎকাটা মেয়ের গালে, গলায়, পিঠে, ঠোঁটে, বুকে হাত ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে গেল। আবার। আবার।

“বলো মা, বলো… কামরা দেখিয়ে দিলেই হল। ল্যাটা চুকে যায়”

“বিশ্বাস করুন আমি কিচ্ছু জানি না’ কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়ে।”

“এই, এ মালটাকে মেঝেতে ফ্যাল।”

বাবা বাচ্চু, ভূতের চোখ দিয়ে মেপে নিতে চায় আগামী ঘটনা-প্রবাহ…

পিস্তলের নল তাক করা। না থাকলেও ক্ষতি ছিল না। তবু রাখে। একটা প্যান্টির পাশে সাময়িক ও ধারাবাহিকভাবে জমা হচ্ছে কতকগুলো জাঙিয়া। ভূতের তো চোখের পাতা থাকে না। তাই নিষ্পলক তাকিয়ে ও। ওঁরাওদের পাহাড় দেবতার মতো নিশ্চল। মেয়ের কোমরের নীচ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভূতের মনে পড়ল প্রথম কয়েকবার ঋতুস্রাবের সময় মেয়েকে কিছুতেই চুপ করাতে পারেনি ও। সারাক্ষণ কেঁদেছিল। ভয়ে। আর তিনমাস পর, ও আঠারোর হতে পারত…

“লোকসান পুষিয়ে নে ভালো করে তোরা”— মেঝেতে হাঁটু দিয়ে কোলা ব্যাঙের মতো বসল হোঁৎকাটা। হোঁৎকাটার কাঁধের উপর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভূতটা দেখল ওই বিপুল মেদের পাহাড় থেঁথলে দিয়েছে কচি শরীরটা। মেয়ের ক্ষতবিক্ষত বুকের দিকে ভূতটা চেয়ে রইল পাথর চোখের নিষ্পলক ঈশ্বরের মতো…

দেওয়ালে ঠেস দেওয়া বাস্তবের বাচ্চু ভাবে ছেলেবেলায় শালা ফালতু ভয় পেত ভূতকে। প্রকৃতপক্ষে ভূত বড়ো অসহায়। একটা গাছ, একটা ধৃতরাষ্ট্র যেন। কিন্তু চক্ষুষ্মান। বাচ্চু বুঝল ওর পক্ষে আর দেখা সম্ভব নয়। ফোকালাইজার কেটে যাচ্ছে। কিন্তু তখন তার আর কিছু করার নেই। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে ও। তাই বাচ্চু দেখব না দেখব না স্থির করেও দেখতেই থাকল…

ইতিমধ্যে আরও এক হায়না ছোপ ছোপ রক্তে, পায়ের ছাপ এঁকে এগিয়ে এল অর্ধমৃত উলঙ্গ শরীরটার দিকে। মাত্র সতেরোটা বসন্ত… তার মধ্যে কতটুকুই-বা উপভোগ করেছে মেয়েটা! এমন সময়— ‘স্যার! বাচ্চু যে-দরজার মুখে পড়েছিল তার দরজা ভেঙে দেখলাম বোধহয় ওর বউয়ের লাশ…”

— নাহ! কিছুতেই মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ও যদি প্রকৃত পিতা হয় তবে মেয়েকে ওই নরক যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে মারতেই হবে তাকে। কোনো দ্বিধা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল রিভালভারেতো মাত্র দুটো গুলি। বউ, মেয়েকে মারার পর তবে ও নিজে ধরা পড়বে… আর একবার যদি ধরা পড়ে…

আলো-অন্ধকারময় একটা ঘর। উলঙ্গ বাচ্চু হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। তার পুরুষাঙ্গ রক্তাক্ত, কিছু চামড়া, মাথার চুল, দু-হাত আর পায়ের ছ-টা নখ ঘরের মেঝেয় ছড়ানো… ডেঁয়ো পিঁপড়ে লাইন দিয়েছে… বাচ্চু এ-সব দেখে আর শিউরে ওঠে। দেখে আর শিউরে ওঠে। কিন্তু দেখে… জ্বর অনুভব করে গায়ে। কিন্তু কী করবে ও? সিদ্ধান্ত নিতে পারে না! কাকে বাঁচাতে পারবে না? স্ত্রী? কন্যা? নাকি, নিজে? সব ওলোট-পালোট হয়ে যায় আবার। দেওয়াল ঘেঁষে বসে বাচ্চু। চূড়ান্ত অসহায় হয়ে কাঁদতে থাকে। দেওয়াল, যা প্রতিবন্ধকতার রূপক হিসাবে বহুল ব্যবহৃত হয় সাহিত্যে, তার গায়ে কিল মারে, মাথা ঠোঁকে… যেন এখুনি ত্রাতা হয়ে আসবে নরসিংহ… বালের ফিল্মে এমন হয় দেখেছিল কখনো। তাই কিল, চড়, থাপড় মারতেই থাকে দেওয়ালে… আর কাঁদতে থাকে… কাকে আরাম-মৃত্যু দেওয়া যায়… কিন্তু তা বলে নিজের বউকে খুন করবে? নিজের মেয়েটাকে… যাকে দেবশিশুর মতো বড় করেছে… অথচ মারা দরকার… কাকে মেরে বাঁচানো যায়… বাচ্চু চোখের জল না মুছে এবার আরও স্থির, ফোকাসড্‌ আর শান্ত হয়। সচেতনতার ঠুলি পরে পুনরায় সাজাতে চেষ্টা করে দৃশ্যপট। এবং পুনঃ তপস্বী হয়… কার কার মৃত্যু প্রয়োজন… ওদিকে বিড়াল পায়ে লোকগুলো উঠে এসেছে হয়তো বারান্দায়— বাচ্চু ভাবে। সময় নেই। দ্রুত ভেবে নিতে হবে বাচ্চুকে… সিদ্ধান্তে পৌঁছুতেই হবে। দুটো গুলি আর তিনটে মানুষ। বদ্ধ গুমোট ঘরে বাচ্চু ভাবতে থাকে…

[মার্জনা করবেন। কে খবর দিল? কারা, কেন বাচ্চুকে চায়ছে?— জানি না। বাচ্চু একটা চুতিয়া হয়তো। গণতান্ত্রিক সমাজের ক্ষতি করছিল। কাঁধে লোগো লাগানো হোঁৎকাটা রক্ষক হতে পারে। আবার হোঁৎকাটা বড়ো ব্যবসাদার হতে পারে, রাজনৈতিক নেতাও হতে পারেন বৈকি। কিংবা… যে কেউই হতে পারে। আপনি খামোখা ও-সব ভাববেন না। বরং ভেবে নিতে পারেন, আপনিই হোঁৎকাটা। শরীর একটু স্থূল হল? তা হোক। মজা নিন। আর ভেবে নিন— বাচ্চু অন্য ধর্মের, অন্য পার্টির, অন্য বর্গের, অন্য বর্ণের বা টিভি, চায়ের দোকানে তক্ক করা, প্রশ্ন তোলা অন্য মতাদর্শের বা ট্রেনের সিটে কমপ্রোমাইজড না করা একটা পিওর বাঞ্চোৎ।]

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

অরিন্দম রায়ের গল্প

হতে পারত একটি ভূত
কিংবা একটা বাঞ্চোৎ-এর কাহিনি

শ্রমজীবী সূর্যটা প্রাত্যহিক দহনে বড়ো অবসন্ন এখন। এক পরিযায়ী শ্রমিকের মতো সে এলিয়ে পড়ছে ক্রমশ পৃথিবীর পশ্চিম কোলে। এদিকে গা ঘেঁষা-ঘেষি করে উঠে যাওয়া

Categories
কবিতা

তনুজের কবিতা

নাইটশিফট

পূর্ণিমার রাত বলতে
পুন্নিমা দাসের কথা বলছ?

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দ্বিতীয় পর্ব

শ্রয়েডিংগারের বিড়াল অথবা লালনের গান

যুগপৎ একটি মূর্ত জিনিসকে বিমূর্ত করে ও একটি বিমূর্ত জিনিসকে মূর্ত করে, দু-টিকে একবিন্দুতে মিশিয়ে দেবার পর