Categories
প্রবন্ধ

সুজিৎ দে’র প্রবন্ধ

মুর্শিদাবাদের বোলান গান: সাধারণ পরিচয়

চৈত্র মাস শেষের দিকে। বছর শেষ হবে। সারা বছর ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষগুলির মনে কীসের এত ফুর্তি! ও শিবের গাজন আসছে। শরতের চারদিন যেমন বাঙালির ঘরের মেয়ে ঘরে ফেরে; চৈত্রের শেষ চারদিন তেমনি বুড়ো শিবের। এই শিবের গাজন আর তাকে কেন্দ্র করে ‘বোলান’ গান পল্লিমায়ের চিরদুঃখী সন্তানগুলিকে মাতিয়ে রাখে এ-সময়।

এমন চিত্র ছিল আগের বছর পর্যন্ত। আর এ-বছর করোনার মৃত্যু ভয়ে কুঁকড়ে আছে তারা। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে জীবন আর জীবিকার তাগিদে আজ তারা অসহায়। একটা একটা করে উৎসবকে ছেড়েছে তারা। মনমরা হয়ে ভাতে মরার দিন যেন সামনে এগিয়ে আসছে। থেমে যাওয়া উৎসবের স্মৃতিচারণায় এই প্রবন্ধের আয়োজন।

বোলান= বোল + আন। যার অর্থ কথা বলা, প্রতিবচন, উত্তর। বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্য যুগের অনেক ক্ষেত্রে ‘বোলান’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়—

“বোলান বুলিতে গেল ময়না বসতি” (রূপরাম চক্রবর্তী/ধর্মমঙ্গল) [১]

“ঘরে গেল্যা না দিয়া বুলান” (কবিকঙ্কণ) [২]

“ডাকিলে বোলান ন দেও” (মনসামঙ্গল/বিজয়গুপ্ত) [৩]

রূপরামের ধর্মমঙ্গলে ‘বোলান’ হল মানসিক ব্রত। কবিকঙ্কণ ও বিজয়গুপ্তের রচনায় ‘বোলান’-এর অর্থ উত্তর-প্রত্যুত্তর বা কথা বলা। নাথপন্থী শৈব যোগী, পশ্চিম ভারতের নিরঞ্জন নাথপন্থী প্রমুখ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বোলান’-এর প্রচার দেখা যায়। ডঃ সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে উত্তর রাঢ়ের মনোহরশাহি পরগণা থেকে একটি ‘বোলান’ গানের নমুনা তুলে এনেছেন—

“যতগুলি বললাম বোলান গো
আরও বলতে পারি
ওস্তাদের নাম অকিঞ্চন
তেঁতুল তলায় বাড়ি
যার বাড়িতে জমি
তোমরা এবার বোলান বল
আমরা এবার বসি।।” [৪]

বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে-বোলান গান প্রচলিত আছে তা মূলত শিবের গাজনকে কেন্দ্র করেই। তবে কখনো কখনো অন্য কোনো অনুষ্ঠান বা মেলায় বোলানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। চৈত্রের শেষ চারদিন যে-শিবের গাজন হয় তার কিছুদিন আগে থেকেই বোলান দলগুলির মধ্যে সাজ সাজ রব ওঠে। তারা তিন-চার দিন ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে বোলান গান করে বেড়ায়। এ হল পালা বোলান। আর এক প্রকার বোলান আছে তাকে বলে ‘সাধলে বোলান’; বা ‘সাজলে বোলান’। শিবের গাজনের বা ধর্মরাজের ভক্তরাই এ-বোলান করে। অন্যদের এ-বোলান করার অধিকার নেই। শিবের গাজন ছাড়াও ‘সর্বমঙ্গলা’ বা ‘শেতলা’ পুজোর সময়ও বোলানের আয়োজন করা হয় অনেক সময়।

সাজলে বোলান ও পালা বোলান উভয়ই প্রচলিত আছে এখন। শিবের ভক্তরা করে সাজলে বোলান। তা মূলত পূজা পদ্ধতির অঙ্গ। আর পালা বোলানে একদিকে যেমন থাকে পালাবন্দী নাটক অন্য দিকে সংগীতের বহুল প্রয়োগ। আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে নারীবেশী পুরুষের চটুল নৃত্য। বন্দনা গান, পালা অভিনয় আর রং পাঁচালির মধ্য দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করে থাকে কুশীলবরা। গানগুলি অবশ্যই লোকসংগীতের ধারাটিকে বজায় রেখে চলেছে।

বোলান গানকে বলতে হয় আনুষ্ঠিক বা পূজাকেন্দ্রিক লোকসংগীত। পালার প্রয়োজনে গানগুলি লোকসমাজের দ্বারাই রচিত হয়। কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা এ-গান রচিত হয় না। দলের বিভিন্ন সদস্যদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক প্রসূত এই গান। গানগুলির প্রচার ও প্রসার ঘটে লোকমুখে। তাই পাঠভেদ লক্ষ করা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। সুরে থাকে আঞ্চলিকতার ছোঁয়া। প্রেম, আনন্দ, অভিমান বা চরম দুঃখ প্রকাশে এর প্রয়াগ। ‘ভিখারি ঈশ্বর’ নামক একটি সামাজিক পালায় দাদা ঈশ্বর তার ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে গান গাইছেন—

“আজকে আমার ভায়ের বিয়ে খুশীর সীমা নায়
আয়রে তোরা সবাই মিলে আয়রে ছুটে আয়
আনন্দেতে সবাই যখন শাঁক বাজাবে
পালকি এসে ভায়কে আমার নিয়ে যাবে।” [৫]

এর ভাষা নিতান্ত সহজ সরল। আর সুরে আঞ্চলিকতা থাকলেও বাংলা বা হিন্দি সিনেমার গান কিংবা প্রচলিত জনপ্রিয় কোনো গানের সুরকে অনুসরণের চেষ্টা করা হয় লোক আকর্ষণের জন্যই। পদ বা পদসমষ্টির পুনরাবৃত্তি অবশ্যই থাকে গানে। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বর্ধমানের কিছু অঞ্চলের লোকসমাজই এ লোকসংগীতের জন্মদাতা ও পৃষ্ঠপোষক।

সামাজিক নানা বিষয়, মনগড়া নানা কাল্পনিক কাহিনির পাশাপাশি পৌরাণিক কাহিনির দেখা মেলে বোলান পালায়। অবশ্যই লোকমুখে প্রচলিত পুরাণ। তাই কোনো গ্রন্থের সাথে এর সত্যতা যাচাই করা অর্বাচীনের কাজ হবে। শিল্প শাসনের বাধা মানে না বোলান। তাই লোকরুচি ও চাহিদা অনুযায়ী এর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। নৃত্য এর একটি জরুরি অঙ্গ। সূক্ষ্ম ভাবের প্রকাশ করতে গিয়ে সুনিপুণ অভিনয় সেখানে হয় না। জোড়ালো ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সংলাপ ও গান পরিবেশিত হয়। পূজা মণ্ডপের মাঝে একটু জায়গা করে নিয়ে, চারিদিকে দর্শকের উপস্থিতিতে কুশীলবরা অভিনয় করে চলে।

একইসঙ্গে গান ও অভিনয়ের প্রাধান্যে বোলান লোকসংগীত ও লোকনাট্যের বিমিশ্র রূপ হয়ে উঠেছে। গানের মধ্য দিয়েই বোলানের সূচনা, গানের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি। মূল পালার মাঝেও সংগীতের ব্যবহার একটু বেশিই। বোলানের প্রাচীন রূপে সংগীত ছিল প্রধান। সংলাপ ছিল সংগীতের মেলবন্ধনকারী। বর্তমানে সংলাপের প্রাধান্য এলেও সংগীত তার নিজের জায়গাটি ছেড়ে দেয়নি। গীতিপ্রধান এই বোলানকে গীতিনাট্যও বলা যায়—

“বোলান গান গীতি প্রধান রচনা। সেই জন্য ইহাদের গীতিনাট্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে”। [৬]

ধর্মঠাকুর ও শিবের গাজনকে কেন্দ্র করে মূল সন্ন্যাসী গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে যে-তর্জা, ছড়া বলে তার নাম বোলান। শিবের গাজনের ভক্তরা তাদের পূজার অঙ্গ হিসেবে লোকের বাড়ি বাড়ি কিংবা তাদের ইষ্ট দেবতার সামনে যে-গান বা ছড়া পরিবেশন করে তাই সাজলে বোলান। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেছেন সাজলে বোলানই হল বোলানের আদি রূপ। সাজলে বোলানের একটি নমুনা—

“আরে সাজলে
ধুল ধুল সাজলে ধুল ধুল ধুল
পড়েছে মায়ের পাতা উদম করে চুল।
আরে সাজলে
শ্মশানে গিয়েছিলাম মশানে গিয়েছিলাম
সঙ্গে গিয়েছিল কে ?
কার্তিক গণেশ দুই ভাই সঙ্গে সেজেছে।
আরে সাজলে কাল বাঞ্ছা খেয়েছিল টুকই ভরা মুড়ি
আজ বাছার মুণ্ডু যায় ধুলায় গড়াগড়ি।।
আরে সাজলে
তুই তো মেরা ভাই সাজলে তুই তো মেরা ভাই
তোর সাথে গেলে সাজলে শিব দর্শন পাই।
আরে সাজলে
ভাল বাজালি ঢেকো ভেয়ে
তোর মা আমার মামি…” [৭]

সাজলে বোলান কেবলমাত্র গাজনের ভক্তরাই গাইতে পারে। অন্যদের অধিকার নেই। সাজলে বোলানের রূপটি বেশি পরিবর্তন হয়নি। দেবতাদের উদ্দেশে প্রণাম জানাতে এবং গ্রামবাসীর মঙ্গল কামনায় আজও এ-ধরনের গান গাওয়া হয়।

শেষ পাতা

Categories
সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

[২০০৮ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ‘দি নিউ ইয়র্কার ফেস্টিভ্যাল’-এ হারুকি মুরাকামির সঙ্গে কথপোকথন থেকে এই সাক্ষাৎকার সংকলিত। ‘দি নিউ ইয়র্কার’-এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেবোরা স্টেইনম্যান।]

মুরাকামি: আমি যখন দশ বছর আগে শেষবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম এবং এই দশ বছরে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। যেমন, এই দশ বছরে আমি দশ বছর বড়ো হয়েছি। এটা খুব গুরুতপূর্ণ বিষয়, অন্তত আমার কাছে। দিনের পর দিন আমি বয়স্ক হয়ে উঠছি আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেকে কৈশোরের দিনগুলো থেকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। আজকাল আমি ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করছি। আপনি জানেন যে, ভদ্রলোক এবং ঔপন্যাসিক একইসঙ্গে হওয়া সহজ নয়। একজন রাজনীতিবিদের একইসঙ্গে ওবামা এবং ট্রাম্প হবার চেষ্টা করার মতো। তবে আমার কাছে ভদ্রলোক ঔপন্যাসিকের সংজ্ঞা আছে। প্রথমত, তিনি যে আয়কর দিয়েছেন সেই বিষয়ে কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর প্রাক্তন বান্ধবী বা প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে লেখেন না। এবং তৃতীয়ত, তিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ সম্পর্কে ভাবেন না। সুতরাং, দেবোরা, দয়া করে আমাকে এই তিনটি জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। আমি সমস্যায় পড়ে যাব।

দেবোরা: আপনি আমার প্রশ্নভাণ্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। আসলে আমি আপনার অতি সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘কিলিং কমেন্ডোটোর’ দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। বইটি এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে এক পুরোনো চিত্রশিল্পীর বাড়িতে থাকা শুরু করে। সে যখন সেই বাড়িতে গিয়ে থাকা শুরু করল তখন অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এর মধ্যে একটা হল কিছুটা কূপের মতো দেখতে একটি গর্তের দেখা পাওয়া। আমি ভাবছি আপনি কীভাবে উপন্যাসের এই ভিত্তিটি নির্মাণ করলেন?

মুরাকামি: আপনি জানেন যে এটি একটি বড়ো বই এবং এটা লিখতে আমার দেড় বছর বা তার বেশি সময় লেগেছিল। তবে এটি শুরু হয়েছিল একটি বা দু-টি অনুচ্ছেদ দিয়ে। আমি সেই অনুচ্ছেদগুলো লিখে আমার ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম এবং একসময় ভুলেও গিয়েছিলাম। তারপর, সম্ভবত তিন বা ছয় মাস পরে আমার ধারণা হয় যে, আমি ওই অনুচ্ছেদ্গুলো দিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে পারি। তারপর আমি লিখতে শুরু করি। আমার কোনো পরিকল্পনা বা প্লটও ছিল না। তারপর গল্পটি আমাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেল। যদি আপনার কোনো পরিকল্পনা থাকে, আপনি শুরু করার সময়ে যদি পরিণতি জানেন, উপন্যাস লিখে কোনো আনন্দ নেই। আপনি হয়তো জানেন, কোনো চিত্রশিল্পী চিত্রকর্ম শুরু করার আগে রূপরেখা এঁকে নেয়, তবে আমি তা করি না। আমার কাছে আছে একটি সাদা ক্যানভাস এবং একটি ব্রাশ। তাই দিয়ে আমি ছবি আঁকি।

দেবোরা: উপন্যাসটিতে একটি চরিত্র বা ধারণা আছে, যা মোজার্টের অপেরা ‘ডন জিওভান্নি’ থেকে গড়ে উঠেছে। এই ধারণা বা চরিত্রটি বইয়ের কেন্দ্রে থাকার কারণ কী?

মুরাকামি: সাধারণত আমি আমার বইগুলি শিরোনাম দিয়ে শুরু করি। এই ক্ষেত্রে ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’ শিরোনাম আর প্রথম অনুচ্ছেদটা নিয়ে আমি ভাবলাম যে এগুলি দিয়ে আমি কী ধরনের গল্প লিখতে পারি! জাপানে ‘কমেন্ডেটোর’ বলে কোনো কিছু নেই। তবে আমি এই শিরোনামটির অদ্ভুতুরে মেজাজটি অনুভব করে মনে মনে পুলকিত হয়েছি।

দেবোরা: আপনার কাছে ‘ডন জিওভান্নি’ অপেরা কি গুরুত্বপূর্ণ?

মুরাকামি: চরিত্র আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সাধারণত মডেল ব্যবহার করি না। আমার কেরিয়ারে একবার মাত্র একটি চরিত্রের জন্য মডেল ব্যবহার করেছি। লোকটি খারাপ ছিল এবং তাকে আমি বেশি পছন্দ করতাম না। ওই লোকটি সম্পর্কে আমি লিখতে চেয়েছিলাম। তবে মাত্র একবার। আমার বইগুলির অন্য সমস্ত চরিত্র আমি শূন্য থেকে তৈরি করেছি। আমি কোনো চরিত্র তৈরি করার পরে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নড়াচড়া করতে থাকে এবং আমাকে তারপর তার চারপাশে ঘোরাফেরা করে তার সাথে কথা বলে যেতে হয়। একজন লেখক হিসেবে যখন আমি লিখি একইসঙ্গে আমার মনে হয় আমি কোনো আকর্ষণীয় বইও পড়ছি। এইভাবে আমি লেখাটি উপভোগ করি।

দেবোরা: আপনি উল্লেখ করেছেন যে, বইটির মূল চরিত্র অপেরার পাশাপাশি অন্যান্য সংগীতও শোনে। প্রায়শই আপনার চরিত্রগুলি দেখি কোনো নির্দিষ্ট ব্যান্ড ও জোনারের সঙ্গীত শুনে থাকে। এগুলি কি আপনাকে লিখতে সাহায্য করে?

মুরাকামি: আমি লেখার সময় গান শুনি। সুতরাং সংগীত খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার লেখায় আসে। কী ধরনের সংগীত এটা নিয়ে আমি বেশি ভাবি না, তবে সংগীত আমার কাছে একধরনের খাদ্য। সংগীত আমাকে লেখার শক্তি যোগায়। তাই আমি প্রায়শই সংগীত সম্পর্কে লিখি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার পছন্দের সংগীত সম্পর্কেই লিখি। আমার স্বাস্থ্যের পক্ষেও এটা মঙ্গলজনক।

দেবোরা: সংগীত কি আপনাকে সুস্থ রাখে?

মুরাকামি: হ্যাঁ, খুব। সংগীত এবং বিড়াল। তারা আমকে প্রচুর সাহায্য করেছে।

দেবোরা: আপনার কাছে কতগুলি বিড়াল আছে?

মুরাকামি: একটাও না। আমি প্রতিদিন সকালে আমার বাড়ির চারপাশে ঘুরতে গেলে তিন-চারটি বিড়াল দেখতে পাই, এরা আমার বন্ধু। আমি তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি এবং তাদেরকে অভিবাদন জানাই। তারা আমার কাছে আসে। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোভাবেই চিনি।

দেবোরা: যখন ‘নিউইয়র্কার’ ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’-এর একটি অংশ প্রকাশ করেছে, আমি তখন আপনাকে আপনার কাজের অবাস্তব উপাদানগুলি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, “আমি যখন উপন্যাস লিখি, বাস্তবতা আর অবাস্তবতা একসাথে মিশে যায়। এটা আমার পরিকল্পনা মাফিক নয় এবং লেখার সাথে সাথে আমি এটি অনুসরণ করি। তবে আমি যতই বাস্তবতাকে বাস্তবসম্মতভাবে লেখার চেষ্টা করি ততই অবাস্তব পৃথিবীর উদয় হয়। আমার কাছে উপন্যাস পার্টির মতো। যে-কেউ যোগ দিতে চাইলে দিতে পারেন। এবং যখনই তাঁরা চলে যেতে চাইবেন, যেতে পারেন”। সুতরাং আপনি কীভাবে এই পার্টিতে অতিথি এবং অন্যান্য বিষয়গুলোকে নিয়ে আসেন, অথবা আপনি যখন লিখছেন সেখানে কীভাবে এরা বাধাহীনভাবে আসতে পারে?

মুরাকামি: পাঠকেরা প্রায়শই আমাকে বলে থাকেন যে আমার কাজগুলিতে এমন একটা অবাস্তব জগৎ রয়েছে, যে-জগতে নায়ক অনায়াসেই যায় এবং আসল পৃথিবীতে ফিরেও আসে। তবে আমি সবসময় অবাস্তব বিশ্ব আর বাস্তববাদী বিশ্বের মধ্যে সীমারেখা দেখতে পাই না। সুতরাং, অনেক ক্ষেত্রে তারা মিশে গেছে। আমি মনে করি জাপানে এই অন্য বিশ্ব আমাদের বাস্তব জীবনের কাছাকাছি। এবং আমরা যদি সেই অন্য পৃথিবীতে যেতে চাই সেটা আমাদের পক্ষে অতটা কঠিন হয় না। আমার মনে হয় পশ্চিমা বিশ্বে এটা করা অত সহজ নয়, সেখানে অন্য বিশ্বে যেতে হলে আপনাকে কিছু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে জাপানে আপনি যেতে চাইলে সহজেই যেতে পারেন। সুতরাং, আমার গল্পগুলিতে, আপনি যদি কোনো কূপের নীচে যান, দেখতে পাবেন সেখানে একটা অন্য বিশ্ব আছে। এবং আপনি সেখানে দুই বিশ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাবেন না।

দেবোরা: অন্য দিকটা সাধারণত অন্ধকারের জায়গা, তাই তো?

মুরাকামি: না-ও হতে পারে। আমার মনে হয় এটা আগ্রহের ব্যাপার। আপনি যদি কোনো দরজার সন্ধান পান এবং সেটা যদি খুলতে সক্ষম হন তবে আপনি সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন। এটি কেবল আগ্রহ থেকেই হতে পারে। ভিতরে কী? সেখানে কী আছে? এই প্রশ্ন করা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন ভোর চারটের দিকে উঠে আমার ডেস্কে গিয়ে লেখা শুরু করি। বাস্তব বিশ্বে এটা ঘটে। আমি আসল কফি পান করি। কিন্তু একবার লেখা শুরু করলে আমি অন্য কোথাও চলে যাই। আমি দরজাটা খুলি, সেখানে যাই এবং সেখানে কী ঘটে দেখতে পাই। আমি জানি না বা জানতে চেষ্টা করি না, এটা বাস্তব না অবাস্তব। যতই আমি লেখার মধ্যে গভীরভাবে ডুবে যাই ততই সেখানে ওদ্ভুত কিছু দেখতে পাই। আমি স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেখতে পাই বলে মনে হয়। সেখানে যদি কোনো অন্ধকারও থাকে তবে সেই অন্ধকারের কিছু বার্তা থাকে অবশ্যই। আমি সেই বার্তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আমি সেই বিশ্বকে ঘুরে দেখি, তার বর্ণনা করি, শেষে আমি ফিরে আসি। এই ফিরে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ফিরে আসতে না পারেন তবে ভয়ের ব্যাপার। তবে যেহেতু আমি পেশাদার, আমি ফিরে আসতে পারি।

দেবোরা: এবং আপনি ওই জিনিসগুলি সঙ্গে নিয়ে আসেন?

মুরাকামি: না। এটা ভীতিজনক হবে। আমি যেখানেই সব ছেড়ে দেই। আমি যখন লিখি না, আমি খুব সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের রুটিনটাকে আমি মেনে চলি। আমি খুব সকালে উঠি এবং বেসবল খেলা না থাকলে রাত ন-টার দিকে শুতে যাই। সঙ্গে থাকে আমার দৌড় এবং সাঁতার কাটা। আমি একজন সাধারণ মানুষ, সুতরাং রাস্তায় যখন আমি হেঁটে চলি তখন যদি কেউ বলে, “মিস্টার মুরাকামি, আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগল”, আমি বিব্রত বোধ করি। আমি এমন কিছু না। তাহলে কেন সে আমার সাথে দেখা হওয়ায় খুশি হল? তবে আমি যখন লেখার মধ্যে থাকি তখন অবশ্যই আমি একজন বিশেষ, অন্তত অদ্ভুত মানুষ।

দেবোরা: চল্লিশ বছর আগে, বেসবল খেলার মাঠে আপনি কীভাবে লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন, গল্পটি বহুবার বলেছিলেন। হঠাৎ আপনি ভেবেছিলেন, “আমি একটা উপন্যাস লিখতে পারি”। যদিও এর আগে আপনি লেখার চেষ্টাও করেননি। এবং আপনি আপনার স্মৃতি কথা, “হোয়াট আই টক আবউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং”-এ বলেন, “মনে হয়েছিল আকাশ থেকে কোনো কিছু নেমে এসেছিল এবং সেটা আমি হাতে পেয়েছি”। আমরা ধরে নিতে পারি ওই জিনিসটি ছিল আপনার লেখার ক্ষমতা। সেটা কোথা থেকে এসেছিল বলে আপনার মনে হয়? আর আপনি এত সাধারণ হলে কেন এটা আপনার কাছে এসেছিল?

মুরাকামি: সেটা একধরনের বোধোদয় ছিল বলে মনে হয়। আমি বেসবল পছন্দ করি এবং আমি প্রায়শই বলপার্কে যাই। ১৯৭৮ সালে ঊনত্রিশ বছর বয়সে আমি টোকিয়োর বেসবল পার্কে আমার প্রিয় দল ‘ইয়াকাল্ট স্যালোজ’ (Yakult Swallows)-এর খেলা দেখার জন্য গিয়েছিলাম। সেই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটায় ছিল খেলার উদ্বোধন। আমি খেলাটি দেখছিলাম এবং প্রথম খেলোয়াড় একটি ডাবল মারল এবং সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম যে, আমি লিখতে পারি। তখন প্রচুর বিয়ার পান করেছিলাম বলে কিনা জানি না। তবে তখন আমার মনে হয়েছিল যেন আমার মধ্যে একধরনের বোধের উদয় হয়েছে। এর আগে আমি কিছু লিখিনি। আমি একটি জ্যাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে সান্ডুইচ আর ককটেল তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। আমি খুব ভালো সান্ডুইচ তৈরি করি। তবে সেই খেলার পরে আমি একটা ষ্টেশনারি দোকানে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলাম এবং শুরু করলাম লেখা। তারপর আমি লেখক হয়ে যাই।

দেবোরা: সেটা চল্লিশ বছর আগে। সেই সময় লেখা আপনাকে কীভাবে বদলে দিল?

মুরাকামি: আমি অনেক বদলে গিয়েছিলাম। লেখা শুরু করার সময় আমি লিখতে জানতাম না। আমি খুব অদ্ভুত উপায়ে লিখেছিলাম। তবে পাঠক এটা পছন্দ করেছিল। এখন আমি আমার প্রথম বই ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’-এর জন্য তেমন একটা যত্ন নিই না। তখন আমি লেখা প্রকাশের উপযুক্ত ছিলাম না। বহুবছর আগে টোকিয়োর ট্রেনে বসে আমি একটি বই পড়ছিলাম এবং খুব সুন্দর একটি মেয়ে আমার কাছে এসে বলল, “আপনি মিস্টার মুরাকামি?” “হ্যাঁ, আমি মিস্টার মুরাকামি”। “আমি আপনার বইয়ের বড়ো ফ্যান”। “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ”। “আমি আপনার সমস্ত বই পড়েছি এবং আমি সেগুলো খুব ভালোবাসি”। আমি ধন্যবাদ জানাই। তারপর সে বলেছিল, “আমি আপনার প্রথম বইটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। ওটাই আমার কাছে সেরা”। “ওহ্‌, তুমি তাই মনে করো?” সে বলল, “আপনার লেখা এখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে”। এইভাবে আমি সমালোচনায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে আমার লেখা আগের থেকে খারাপ হয়ে যাচ্ছে তা মনে করি না। আমি মনে করি সময়ের সাথে সাথে আরও ভালো হচ্ছে আমার লেখা। চল্লিশ বছর ধরে আমি আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছি এবং আমার বিশ্বাস যে, আমি সফল। ট্রেনের সেই মেয়েটি আমাকে জিন কুইল নামে এক জ্যাজ সংগীতকারের কথা মনে করায়। তিনি স্যাক্সোফোন বাজাতেন। উনিশ-শ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বিখ্যাত ছিলেন। সেই সময় যে-কোনো স্যাক্সোফোন বাদকের মতো তিনিও চার্লি পার্কার দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন। একরাতে তিনি নিউ ইয়র্কের একটি জ্যাজ ক্লাবে বাজাচ্ছিলেন এবং যখন তিনি ব্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে নামলেন তখন এক যুবক এসে বলল, “আরে, আপনি তো চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন বললেন, “কী?” “আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন তখন তাঁর অলটো সাক্সোফোন যন্ত্রটি তার কাছে তুলে বললেন, “এই যে, আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজিয়ে দেখান!” আমি মনে করি, এই গল্পটির তিনটি বিষয় আছে— এক, কারো সমালোচনা করা সহজ। দুই, মৌলিক কিছু তৈরি করা খুব কঠিন। তিন, কিন্তু কারো এটি করা দরকার। আমি চল্লিশ বছর ধরে করে আসছি। এটা আমার কাজ। আমি মনে করি, আমি এমন একজন লোক যে অন্যদের মতো কিছু কাজ করে চলেছে, যেমন নোংরা পরিষ্কার করা বা কর সংগ্রহ করা। সুতরাং, কেউ যদি আমার প্রতি কঠোর হয় তবে আমি আমার যন্ত্রটি তাকে ধরিয়ে বলব, “এই যে, আপনি এটা বাজিয়ে দেখান!”

দ্বিতীয় পাতা

Categories
গল্প

পাপড়ি রহমানের গল্প

জলময়ূরীর সংসার

জামগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দুই পা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল ঝুলমুলি। তার চোখের সামনে বাঘিয়ার বিলের থইথই জলরাশি। হাওয়া বেগে বইলে সমস্ত বিল যেন মুহূর্তে দুলে ওঠে। তারপর তারা ঢেউ হয়। ইয়া বড়ো বড়ো মস্তপানা ঢেউ। ঢেউ হয়, আর ছুটে যায় দূরে, বহুদূর। একেবারে দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে। এ-মতো দৃশ্য শুধুমাত্র বাদলার কালেই দেখা যায়। উইন্যার মরশুমে কাদাপ্যাকলার রাজত্ব। তখন বিলের রুগ্ন চেহারা। কিছু জলজ উদ্ভিদ বেঁচে থাকার আশায় আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। কিছু শাদা ঘাস তখন মাথাডগা বের করে ভালো করে দুনিয়া দেখতে চায়। এই ঘাসেরা বাদলার কালে জলের তলায় ডুবে থেকে নিজেদের সবুজ বরণ খুইয়ে বসে আছে। এতক্ষণে দুনিয়াদারি দেখতে দেখতে ফের তারা সবুজ হয়ে উঠবে। ফের তারা তরতরিয়ে বিস্তার করে চলবে নিজেদের বংশ। বাঘিয়ার বিলের এমন রকমসকম ঝুলমুলি কোমরে কালোতাগা বাঁধা অবস্থা থেকেই দেখে এসেছে। রোগবালাই দূরে রাখার জন্য মা একটা কালোতাগা ঝুলমুলির কোমরে বেধে দিত। তাগার সঙ্গে একটা ছোট্ট ঘুঙ্ঘুট। উঠানময় দৌড়ে বেড়ানোর সময় ওই ঘুঙ্ঘুট টুংটুং করে বেজে যেত। আর মা আম্বিয়া খাতুন কাজ ফেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত ঝুলমুলির উদোম গতর— মেয়েটার গায়ের রং মাজা হবে। গরিবের সংসারে কালো মেয়ের বড়ো অনাদর। কালো মেয়ে পরের ঘরে বিদায় করা বড়ো ঝক্কির। টিভি, মোটরসাইকেল দিতে চাইলেও কালো মেয়ের বাজারদর চড়া হয় না। সেরকম পাত্রও জোটে না। যদিও-বা জোটে তাও ম্যালাই দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হয় তারা! টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেলের সঙ্গে মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে বসে। ঝুলমুলির মা মেয়ের উদ্দাম চলা দেখেও তাই খুশি হতে পারত না। মনে শঙ্কা বাসা বাধত— কাইল্যা মাইয়াডারে পার করুম কেমতে?

কিন্তু ঝুলমুলির মায়ের নানান আশঙ্কা সত্ত্বেও ঝুলমুলি বড়ো হতে থাকে। তার দেহে লাবণ্য এসে হামলে পড়ে আর ঝুলমুলি সেয়ানা হয়ে ওঠে। আম্বিয়া খাতুনের মেয়ের এই ঝলমলে ছিরিছাঁদ দেখে মনে মনে আঁতকে ওঠে—

মরারশুকির গতরে য্যান বাইস্যা মাসের নয়া পানির মাছেগো খলবলানি। এত উজাইও না গো মা-জননী! বেশি উজাইলে বোয়াল মাছের প্যাডের ভিতর চইল্যা যাইবা, নইলে শইল মাছ তুমারে গিল্যা খাইব। তহন আর বারাইতে পারবা না। মাছের প্যাডের ভিতরের মাছ কবে আর তার নিজের পরান ফিরত পাইছে?।

না, আম্বিয়া খাতুন এমন ভাবে, কিন্তু তার ভাবনা সে মনের লাটাইয়ে পেঁচিয়ে রাখে। এই লাটাইয়ের সুতার সন্ধান সে কিছুতেই দেবে না ঝুলমুলিকে। দিলে মেয়েটা আর নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে পারবে না। তার বাড়বাড়ন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। মেয়েটা অন্তত নিজের মতো করে বেড়ে উঠুক। জমিনে শুয়ে থাকা মিষ্টিকুমড়ার ডগা যেমন আপন গতিতেই বাড়ে, লকলকিয়ে তরতরিয়ে বাড়ে— ঝুলমুলি না হয় তেমনিভাবেই বেড়ে উঠুক। আম্বিয়া খাতুন এমন ভাবে, কিন্তু ছলিমুদ্দি এমন ভাবে না, বা ভাবতে পারে না। এর আগে দুই মেয়ে মঞ্জুলি আর ফুলকলি যখন সেয়ানা হয়েছিল, তখনও সে এমন ভাবে নাই। বা ভাবতে পারে নাই। দুই মেয়ের বিয়ে দিতে হালের চারটা বলদ ছলিমুদ্দিকে বিক্রি করতে হয়েছিল। গোয়াল ঘরের দিকে তাকালে আজও তার দুই নয়ন জলে ভরে যায়। গোরু বিক্রির টাকায় একটা হাতঘড়ি আর টেলিভিশন দেয়া গিয়েছিল। বাকি টাকায় ছেলেপক্ষকে শাদাভাতে গোরুর মাংসের সুরুয়া ঢেলে কোনোরকমে খাওয়ানো গেছে। এ নিয়ে মঞ্জুলি আর ফুলকলির শ্বশুরবাড়ি কম কথা শোনায় নাই!

‘মুরগার রুস্টের কতা কি আবার কইয়া বইল্যা নিতে অয় নাহি? বেবাক বিয়াতেই তো এইগুলা আকছার খাওন দেয়।’

ছলিমুদ্দি রা করতে গিয়েও যেন গিলে ফেলেছে। কষ্টেমষ্টে নিজেকে সামলেছে। মাইয়ার বাপ অইলে নীচা অইয়া থাকতে অয়! নীচা মাইনষেগো এত রাওউও করলে চলে নাহি?

নীচা মাইনষেগো মাতাডা আরও নীচা কইরা রাহন নাগে। মাতাডা মাটির লগে মিসমার কইরা রাহন নাগে। ছলিমুদ্দি তাই নীচা কইরাই রাখে নিজের মাথাডা। নীচাই রাখতে চায়। কিন্তু তাও কি মঞ্জুলি আর ফুলকলির সুখ মেলে? মেলে না! ছলিমুদ্দি তো কম চেষ্টা চালায় নাই। কথা সত্য, মুরগার রোস্ট সে খাওয়াতে পারে নাই। জনা পঞ্চাশেক লোক খাওয়ার পরেই মাংসের হাড়িতে টান পরে যায়। কিন্তু কী-ই-বা করবে ছলিমুদ্দি?

ভালো কোম্পানির টেলিভিশনের দাম তো তার একটা বলদ বিক্রির দামের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কাল্লা, ধলা, লাল্লি আর সফেদাকে বিক্রি করতে গিয়ে ছলিমুদ্দির বুক ফেটে গিয়েছে। ছলিমুদ্দির ঘরদোর এতদিনে শূন্য-ময়দান। সহায়-সম্পত্তির খুদকুঁড়োও কোথাও পড়ে নাই। দিনমান হা হা করে ছলিমুদ্দির দুয়ার-আঙিনা। বাঁশঝাড়ে হাওয়া জোরে বইলে মনে হয়, কে যেন কেঁদে চলেছে! কে যেন গুনগুনিয়ে অথচ গোপনে কেঁদেই চলে। ছলিমুদ্দির মন মিথ্যে বলে না বা হয়তো তার কানও ভুল শো্নে না। কাল্লা, ধলা, লাল্লি, সফেদার হাম্বা হাম্বা রবের সাথে মঞ্জুলি আর ফুলকলিও গলা মিলিয়ে কাঁদে। ছলিমুদ্দির কানে তেমনভাবেই পৌঁছায়। ছলিমুদ্দি ইদানীং মানুষ আর জন্তুর বিভেদ করতে পারে না। সে কীভাবেই-বা বিভেদ করবে? ছলিমুদ্দির কাছে তো মানুষ আর জন্তুর মূল্য প্রায় সমান কাতারে। আর তার ঘরদোরও শূন্য ময়দান। কাল্লা, ধলা, লাল্লি, সফেদার সাথে সাথে মঞ্জুলি আর ফুলকলিও তার চোখের আড়ালে চলে গেছে! এটা ভেবেও ছলিমুদ্দি্রমন বড়ো বেচান হয়।

‘যাগো এত্তদিন বুকে ধইরা আগলাইয়াছি, হেরা দেহি বেবাকেই আমারে ফালায়া থুইয়া গেলগা! আমার কুনদিহে লাভ কিডা অইল? আমার আপনার আর থাকল কী? লাল্লির চক্ষু দুইটা দিয়া ক্যামতে যে পানি পড়বার নাগছিল! বুবা জানোয়ার, কিছু কইয়া যাইতে পারে নাই। মাইয়া দুইটার চক্ষু দিয়া পানি পড়বার নাগছিল, হেরাও তো আমারে ভালা কি মন্দ কি কুনু কতাই কইয়া গেল না!’

এ-সব ভেবে ভেবে কোনো কোনো রাতে ছলিমুদ্দি একেবারে বেঘোর কেঁদে ওঠে। তখন হয়তো আম্বিয়া খাতুনের ঘুম ভেঙে যায়। ছলিমুদ্দি তখন জোর করে কান্নার ফুঁপানি বন্ধ করতে চায়, কিন্তু দম ফুরিয়ে যাবার মতো করে নতুন কান্না তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। আম্বিয়া খাতুন পরম মমতায় সোয়ামির পিঠে হাত রাখে। ধীরে ধীরে আঙুল বুলিয়ে বলে—

‘কীয়ের নাইগ্যা আফনে কাইন্দা মইরুন কন তো? হারাদিন তো ভালাই থাহুন। রাইত অইলেই কি জন্মের দুস্ক আফনেরে সজাগ কইরা তুলে? কীয়ের দুস্কে আফনে কাইন্দুন এমুন কইরা?’

ছলিমুদ্দি তখন বউয়ের এতসব প্রশ্নের জবাব দেবার অবস্থায় থাকে না। এত দুঃখ গলায় চেপে রেখে কোন মানুষই-বা কথা বলতে পারে? ছলিমুদ্দি আম্বিয়া খাতুনের উপর মনে মনে বিরক্ত হয়—

‘কীয়ের সোমসার যে আমি করি? হেয় তো বেবাকই জানে আর বুঝে, তাও কী না আমারে জিগায়? ঘুইরা ফিরা পত্যি আমার দুস্ক তালাশ করে! এই যে আমাগোরে বাড়িঘর, উঠান সব কেমতে ধূ ধূ ময়দান অইয়া গেল হের তালাশি তার মনে নাইক্কা। কিমুন বেহুশি মাইয়ানুক! যে কুনুদিন অন্তরের ভাও বুঝে না হের লগে জনমভর সোমাসার কেমতে করে মাইনষে?’

ছলিমুদ্দির অবিশ্রাম অথচ লুকানো কান্নার খোঁজখবর না করেই আম্বিয়া খাতুন ফের ঘুমে মরে যায়। নাকি দুম করে ঘুম এসে তাকে মেরে ফেলে? খানিক আগেই যে টসটসিয়ে কথা বলল, ভালোমন্দের খবরবার্তা জানতে চাইল, তার এমন আঁতকা ঘুমিয়ে পড়া দেখে ছলিমুদ্দির কান্না ফুরিয়ে যায়। ছলিমুদ্দি অনুভব করে, তার সকল কান্না কেমন ধুন্দুমার মিলিয়ে গেছে! তখন হয়তো পূবের আকাশে সামান্য শাদা শাদা আলো ফুটে উঠছে। ওই শাদাটে আলোর নীচে উঠানের জোয়ান শিউলি গাছটা বেশুমার ফুলেদের পাপড়ি মেলে দিয়েছে। ততক্ষণে আম্বিয়া খাতুনের খোঁয়াড়ের বড়ো রাতাটাও জেগে উঠেছে! জেগে উঠে ঘাড়ের কালো-সোনালি-খয়েরি রঙা পালক ফুলিয়ে সূর্যোদয়ের প্রথম বাগ দিচ্ছে।

এইবার আষাঢ় নামার সঙ্গে সঙ্গেই বাঘিয়ার বিলে জল একেবারে উপচে উঠতে লাগল। ঝুলমুলি বিলের এরকম বাড়-বাড়ন্ত রূপ ম্যালাদিন চক্ষে দেখে নাই। ঝুলমুলি দেখেছে, লিলুয়া বাতাসে বিলের ছোটো ছোটো ঢেউদের জেগে উঠতে। তারপর তারা মৃদুমন্দ গতিতে, আয়েশ করে ক্রমশ সরে গেছে তীরের দিকে। অথবা ঢেউদের বুকের ভেতর, ঢেউদের শরীরের ভিতর দুলে দুলে মিশে যেতে। কিন্তু এইবার বাদলার জল ঝরে পড়ামাত্রই বিলের চেহারা গেল আমূল পালটে! স্বচ্ছ জলের স্তম্ভ ভেঙেচুরে চক্ষে একেবারে ধান্দা লাগিয়ে দিল। বাঘিয়ার বিলে রুই-কাতলা আর মৃগেলের পাখনা-লেজের ঝাপটানিতে রুপালি ঝিলিক উঠল ঘনঘন। শিঙ্গি-মাগুর আর পুঁটির ঘাঁইয়ে বুরবুরি উঠতে লাগল পার ঘেঁষে। ফি বছর শাদা শাদা এন্তার শাপলার মাঝে কিছু বেগুনি পানার ফুল অনাহূতের মতো তাকিয়ে থাকে। এবার কি না একেবারে অন্য দৃশ্য! পদ্মফুলের বড়ো বড়ো পাতা ছাতার মতো ভেসে রইল বিলের চারধারে। আর ফুটল অগণন ফুল। শাদা শাপলার ফুটে থাকাকে ম্লান করে পদ্মের গোলাপি আভা ঢেকে দিল স্বচ্ছ জলের বিস্তীর্ণ চাদর। ঝুলমুলির চক্ষে বিস্ময় আর ধরে না! আচানক এতকিছু দেখে শুনে তার মাথাটাও যেন আর আগের মতো কাজ করে না!

‘ই-ই-রে! এইডা কুন জমানা আইল? এতকাল দেখতাছি এই বিলের ছুরত! আইজ কুন কারণে হে্র ছুরত বদলায়া যায় রে? কত মাছের ঝাইকের খলবলানি আর ল্যাজ নাড়ানি দেইখ্যাই না সিয়ান অইলাম, অহন কিনা দেখি মাছগুলান ফাল দিয়া টানে উইঠা আইবার চায়! জাল ফেলাইলেই অহন খালুই ভইরা নেওন যাইব মনে লয়! বঁড়শিতে আদার দিলেই টপাটপ মাছ উইডা আইব!’

ঝুলমুলির আন্দাজ একেবারে মিথ্যে নয়। ছলিমুদ্দি এর মাঝে জাল ফেলে খালুই দুই মাছ নিয়ে গেছে। মাদারজানির মানুষজন ঝাপ্পুরঝুপ্পুর করে মাছ ধরার কায়দা-কানুন আবিষ্কার করে চলেছে।

ঝুলমুলির চক্ষু ভরা বিস্ময়ের মাঝে মাদারজানির জোয়ান ছেলে-ছোকরারাও জাল ফেলে। বঁড়শিতে আদার দিয়ে টপাটপ মাছ টানে তুলে আনে। ওই দলে জমির চেয়ারম্যানের পুত্র ইস্কান্দারকেও দেখা যায়, সে-ও জলে নেমে খুইয়া জালে কইয়ের ঝাঁক তুলে আনে। মাছগুলার লাফালাফির ফাঁকে খুব সন্তর্পনে একটা পদ্মফুলও উপড়ে আনে সে। ওই পদ্মফুল শোভা পেতে দেখা যায় ঝুলমুলির লম্বা বিনুনির আগায়।

ইস্কান্দারের তুলে আনা পদ্মফুল কোন ফাঁকে-বা কেন ঝুলমুলি বিনুনির শোভা বাড়ায় তা কেউ খেয়াল করে না। এমনকী আম্বিয়া খাতুন ও ছলিমুদ্দির চোখেও তা পড়ে না। ঝুলমুলির কালো মুখে কোথা থেকে যেন হলদেটে আলোর ছটা এসে পড়ে! ঝুলমুলির সইয়েরা বহুদিন বাদে তাকে ‘ফুলটোক্কা’ খেলতে দেখে। এক সইয়ের চোখ দুই হাতের আঙুলে ভালো করে চেপে ধরে ঝু্লমুলি ডাক ছাড়ে—

টাপটুপানি লোহারকাঠি
বৃন্দাবনে টিয়াপাখি
ছুটলোরে ছুট!
কচুর পাতা হলদি
ছুঁইয়া আয় জলদি
কোন ঘরে চোর গেছে ‘সাবধান!’

বলেই জোরে ডাক দেয়—
‘আয়রে আমার কদমফুল!’

শেষ পাতা

Categories
গল্প

লোকগল্প

আরও কিছু আছে বাকি

গল্প কথক: পার্থ হাজরা
সংগ্রহ ও লেখা: সুব্রত ঘোষ

কোন এক গ্রামে এক শখের সাধক বাস করতেন। সামান্য মন্ত্র বিদ্যার চর্চা করতেন তিনি। সাধক এবং সংসারী মানুষটির তাই জীবন নিয়ে কৌতূহল কম ছিল না। চাষাবাদ করে কোনো মতে দিন চালিয়েই খুশি থাকতে পারতেন না। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। আর নিজের মন্ত্র প্রয়োগ করে দেখতেন পশু পাখি গাছপালা এমনকী মানুষের উপর। এই কারণেই তাকে এড়িয়ে চলত গ্রামের লোক। এমনি একদিন বেড়াতে বেড়াতে তার চোখে পড়ল একটা মড়ার মাথার খুলি কাত হয়ে আলের ধারে পড়ে আছে। খুলি দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। হায়, জীবনের এই তো পরিণতি হবে একদিন। এই ভেবে বিমর্ষ হয়েই ভাবলেন এই খুলি এখানে এল কী করে! কাছে পিঠে শ্মশান নেই। চোত-গাজন শেষ হয়েছে মাস চার হল। পচা ভাদ্র শুরু হবে এবার। ধরম পুজোও মিটে গেছে। গাজনের দলের কেউ যদি ভুল করে ফেলে গিয়েও থাকে খোঁজ খোঁজ রব উঠবে। তবে কি শেয়াল কুকুরে টেনে নিয়ে এল? না, কাঁচা খুলি নয়। শুকনো খুলি। একটা কাঠি দিয়ে খুলিটা নাড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে হল তার। কাঠি দিয়ে নেড়ে সোজা করতেই খুলিটার মুখোমুখি হতে হল তাকে। মানুষের মাথার খুলি। কিন্তু খুলির কপালের লেখন যেন তিনি পড়তে পারলেন। মন্ত্রবলে একটু চেষ্টা করেই পড়তে পারলেন লেখাটা— লেখা আছে— ‘আরও কিছু আছে বাকি’। এর পরেও বাকি থাকে কিছু জীবনে? মৃত্যুই জীবনের শেষ পরিণতি। তারপর আর কী? কর্মফলের কারণে আবার ফিরে আসা নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে। কিন্তু সেই আত্মা তো নশ্বর শরীর ছেড়ে গিয়েছে। জড় দেহ মিশে যাবে পঞ্চভূতে। এই খুলির তবে এমন কোন পরিণতি বাকি আছে? একটা সিদ্ধান্ত নিতে মানুষটি বিচলিত হলেন। কিন্তু নিজের কৌতূহলের কাছে হার মানলেন শেষ পর্যন্ত। এই খুলির শেষ পরিণতি না দেখে তিনি ছাড়বেন না। চারপাশে তাকিয়ে দেখে হেঁট হয়ে কুড়িয়ে নিলেন খুলিটা। খুব দ্রুত বেঁধে ফেললেন গামছায়। ঝুলিয়ে নিলেন পিঠে। তারপর হাঁটা দিলেন বাড়ির দিকে। বাড়ি না গিয়ে তিনি গিয়ে ঢুকলেন গোয়াল ঘরে। খুলিটাকে তুলে রাখলেন গোয়াল ঘরের মাচার ওপর, সবার চোখের আড়ালে।

কেউ খেয়াল না করলেও তার স্ত্রী খেয়াল করল স্বামীর চরিত্রে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আরও যেন সংসার বিমুখ হয়ে গেছে মানুষটা। জোর করে কাছে টানলেও কাছে আসতে চায় না। একদিন ভোর রাতে স্বামীকে গোয়াল ঘরের দিকে যেতে সন্দেহ হল তার। একদিন গোয়াল ঘর থেকে ঘেমে নেয়ে বের হতে দেখল স্বামীকে, ফলে সন্দেহ আরও বাড়ল। একদিন দেখল স্বামী গোয়াল ঘরের মাচার উপর বসে আছে, সে যেতেই হুড়মুড়িয়ে নেমে এল। যে এক আড়া মঁইটা দেওয়াল লেপতে নিয়ে এসেছিল সে গোয়াল ঘর থেকে, দেখল ভর দুপুরে তার স্বামী সেই মঁই নিয়ে গোয়াল ঘরে ঢুকল, আবার কিছুক্ষণ পরে মঁই কাঁধে ফিরে এল বাড়িতে। সন্দেহ তখন মানুষ ছেড়ে গোয়াল ঘরের মাচার দিকে ধাবিত হল। একদিন স্বামী মাঠের দিকে যেতেই স্ত্রী ছুটে গেল গোয়ালে। মাচায় উঠে একটু খুঁজতেই সে দেখতে পেল খুলিটাকে। এই খুলির টানে মানুষ যুবতী স্ত্রী ছেড়ে ভোর রাতে গোয়াল ঘরের মাচায় ছুটে আসে!! সন্দেহ একটা হত। আজ তীব্র হল। এ নিশ্চয়ই তার স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকার খুলি। তন্ত্র মন্ত্রের নামে এইসব হচ্ছে দু-জনে। মরেও শান্তি দিচ্ছে না, এখনও তার আর তার স্বামীর মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে!! এর একটা হেস্তনেস্ত না হলেই নয়। খুলিটাকে বাড়িতে এনে শিলে ফেলে নোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে ভেঙে মশলার মতো বেটে ধুলো বানিয়ে ফেলল সে। তাতেও তার রাগ কমল না। সেই ধুলো ঝেটিয়ে ফেলে দিয়ে এল পাঁদাড়ে। যাক, এবার গিয়ে প্রেমিকার মুখোমুখি বসুক মাঝরাত্তিরে গোয়াল ঘরের মাচার ওপর।

সাধক মানুষটি এই ভেবেই চিন্তিত ছিলেন যে একটা মড়ার খুলির এমন কী পরিণতি বাকি থাকতে পারে। বিদ্যা তার গুরুমুখী নয়। মেলার মাঠে কেনা দশ বিশ টাকার বশীকরণ সংক্রান্ত পুঁথি পাঠেই সীমাবদ্ধ তার তন্ত্র মন্ত্রের জগৎ। এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল তার মনে মনে। মড়ার খুলির কপালের লেখন পড়তে পেরে তার আস্থা জন্মেছিল নিজের উপর। কিন্তু গোয়াল ঘরের মাচায় রোজ ওঠেন আর হতাশ হন এই দেখে যে খুলির কোনো পরিবর্তন হয়নি। দিন কয়েক যেতে না যেতেই আবার দেখতে ইচ্ছে করে। ছুটে যান। মাস খানেক কেটেও গেছে। আজ মাঠ থেকে ফিরে মাচায় উঠে চমকে উঠলেন তিনি। খুলি গেল কোথায়? সন্দেহের তির ছুটল স্ত্রীর দিকে। ছুটে এলেন বাড়িতে। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন— “মাচায় একটা খুলি রাখা ছিল। তুমি জান সেটা কোথায়?” স্ত্রী তাকে ভর্ৎসনা করে খুলির পরিণতির কথা বলে জানাল— “যাও কেন, গিয়ে বসো মাচার ওপর। যেটুকু ওর সাধ বাকি ছিল আজ মিটিয়ে দিয়েছি। আর তুমি যদি ফের ঐ মাচামুখ হয়েছ তবে তোমাকেও আস্ত রাখব না।”

গল্প সংগ্রহের স্থান: গ্রাম মোহনপুর, থানা নানুর, জেলা: বীরভূম, ২০১৮

Categories
কবিতা

অনিন্দ্য রায়ের কবিতা

হাসির সমার্থশব্দ

হাসির সমার্থশব্দ, তুমি তো ব্রুনেট

দেহাতি ডান্সবার, এখানে আয়না নিয়ে প্রবেশ নিষেধ
যদি নিজেকে খোলার ব্রীড়া নিজেই দেখতে

ওই ছুরি, শীতল খেলনা
ওই টারকোয়েজ রুমাল
          পরস্পরকে টুকরো করছে
               অবদমনের বশে যেভাবে ইন্দ্রিয় কাটা হয়
আর হ্যাজাকের পাশে চুপ করে বসেছে টিকটিকি
পোকারা বিপন্ন হচ্ছে
          পুরুষের চোখের মতো ছোটোছোটো পোকা

সমস্ত পোশাক খুলে শুধু হাসিটুকু পরে রয়েছ, তুমি দ্যু
আর দীর্ঘ কালোচুল যতখানি প্রহেলিকাপ্রিয়

বিরহ বুড়ির বাড়ি

বিরহ বুড়ির বাড়ি, স্বামী ও সতীন থাকে ওপাশের ঘরে
প্রেম কি ওখানে!
আজ কেউ আগুন ধরাবে?
কেউ বলবে, “ভালোবাসা বয়সের পোষা”?
সহসা শেকল খুলে বাইরে এনেছে, নগ্ন
               এবং মাংসাশী
বুক্কনের শেষে যে নৈঃশব্দ্য আসে
সেখানে রক্তের ছোপ উটকো তরুলতায় ছেটানো রয়েছে

Categories
গদ্য

উৎপলকুমার বসু

 

কোথায় যেন পড়েছিল— বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। বহু অর্থহীন প্রবচনের মতো এরও আছে যুক্তিহীন অবিস্মরণীয়তা। এভাবে আমরা চমৎকার উপায়ে সমাজকে চিরদিনের মতো,  ছকে ফেলে, ভাগ করে দিতে পারি— জেলেরা জলে সুন্দর, ধোপারা সাইকেলের পিছনে বা শত্রুরা কারাগারে সুন্দর, নাগরিকতা ধর্মতলায়। হেন সৌন্দর্যবোধ ব্যতিক্রমকে অগ্রাহ্য করে। সঠিক ব্যতিক্রম-চিন্তা মাথায় না থাকার ফলে আকাশ থেকে খসে পড়া বহু আকর্ষণীয় ঘুড়ি আমরা শেষ পর্যন্ত ধরতে পারিনি। শুধু গতিবিক্রম এর জন্য দায়ী নয়, এর পিছনে ছিল ভুল জ্যামিতি জ্ঞান, ভুল উচ্চতা নির্ণয় এবং গ্রামের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছেলেটি, যে একইসঙ্গে ছিল বায়ুবিজ্ঞানী ও হঠকারী, মসজিদ হইতে পতনের ফলে যে ভবিতব্যতার দেখা পেয়েছিল— তাহলে তার সম্বন্ধে বলতে হয়, সে ছিল ছাদের সুন্দর। মুঙ্গেরের ভূমিকম্প অবশ্য মুঙ্গেরে সুন্দর বলা চলে না।

অনুরূপ, ব্যতিক্রমী একটি তালিকা যদি তৈরি করি তবে দেখা যাবে কত-না ভুল ধারণা আমরা বাস্তুসাপের মতো পুষে আসছি যেমন, আমরা ভাবি শিশুদের জন্য, কিশোরদের উপকারার্থে একটি বিশেষ ধরনের সাহিত্য আছে বুঝি, যার নাম শিশুসাহিত্য। অতীতে যে রামায়ণ মহাভারত বুড়ো-বুড়িরা শুনত, তাই বালকের বা বালিকার পক্ষে ছিল পর্যাপ্ত। যে-নিসর্গের সঙ্গে চিরদিন প্রাপ্ত বয়স্করা যুদ্ধ ও মৈত্রী ঘোষণা করেছিল— ওরা তারই রণক্ষেত্রে অকুতোভয়ে ঘোরাফেরা করেছে। তার আলাদা জগৎ তৈরি করার প্রয়োজন হয়নি— কারণ, আলাদা জগৎ বলে কিছু নেই। যেমন, নেই বিশেষ সাহিত্য— শিশুসাহিত্য বা মহিলা সাহিত্য বা রেল কর্মচারীদের জন্য সাহিত্য।

শিশু সাহিত্য আসলে এক মরালিটি বোধ থেকে জাত শিল্প প্রচেষ্টা। এবং ভিক্টোরিয়ান আমলে এর বহুল প্রচার ঘটে। পাপবোধ বুঝি পাপের চেয়েও দুর্বল। তাই ভিক্টোরিয়ান দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গেই ‘শিশুসাহিত্য’ নামে এক সুনীতি প্রচার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। লিউইস ক্যারল গোপনে কিশোরীদের ফটোগ্রাফ তুলতেন সদ্য আবিষ্কৃত একটি বিস্ময়কর যন্ত্রের সাহায্যে যার নাম ক্যামেরা। তাঁর ডায়েরি এবং সমসায়িকদের চিঠিপত্র থেকে জানা গেল এই অকৃতদার, স্বল্পবাক্ অধ্যাপকের ঘরে ‘লজেন্স টফি’-র লোভে বালিকাদের আনাগোনা ছিল। অপর দিকে তাঁরই রচিত শিশুসাহিত্যে— যা মনোমোহন কাব্যের মতো উদার, জটিলতাময় ও উন্মুখর— সেই ভিক্টোরিয়ান যুগেরই নীতিসঞ্চান দেখতে পাই। ব্রহ্মা সুকুমার রায় সে-ধারার প্রচলন ঘটালেন আমাদের সাহিত্যে।

আজ মনে পড়ে, প্রবাসী বা ভারতবর্ষে একদা যে-কাহিনিগুলি ছাপা হত তা ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু, অর্ধনগ্না মহিলাদের ছবিগুলির কথা ভুলিনি। আমাদের যে সেনসুরালিটি তৈরি হয়েছিল— তাতে উভয়েরই অকৃপণ হস্তক্ষেপ ছিল। বুঝি-বা মনে হয়েছিল দূর আজমিড় পাহাড়ের মতো কোনো এক রহস্যময় উপত্যকায় ওই স্বপ্নময়ীদের সন্ধ্যাজল থেকে উঠে আসা।

শিশুসাহিত্যের আশ্চর্য ও অফুরন্ত প্রকাশ ঘটেছিল ওই ভিক্টোরিয়ান আমলে। অধুনালুপ্ত ‘বয়েজ ওন বুক’ জাতীয় কিশোর পত্রিকার এক্ষেত্রে উল্লেখ প্রয়োজন। আধুনিক কমিক‍্স— এর আদি রূপ এবং সামাজিকতা দেখা যায় এই সংগ্রহগুলিতে। সেকালের অরণ্যদেব ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, অসমসাহসী এবং প্রায়শ আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযানরত। তিনি বশংদ আফ্রিকানদের ত্রাণকর্তা— কিন্তু বিদ্রোহীদের যম। এই ঔপনিবেশিক আদর্শ পুরুষের আরেকটি রূপ দেখতে পাই পরবর্তীকালে টার্জান চরিত্রে এবং ফিল্মজগতে মূক পশুদের সাহায্যে সে, শ্বেতাঙ্গদের উপকারার্থে, কত-না অসম্ভব সম্ভব করেছে। সে-ও কিন্তু বর্ণবৈষম্যবাদী। চীন-বিরোধী ‘ফু-মান্-চু’ গল্পগুলিতে ছিল ওই জাতির বিরুদ্ধে অবজ্ঞা, ঘৃণা ও অপপ্রচার। গোয়েন্দা শার্লক হোমসের হাতে ধরা-পড়া দুষ্কৃতকারীরা তো প্রায়ই স্বীকার করত যে, তাদের অভিনব কর্মপদ্ধতির নৃশংসতা আসলে ভারতীয় নেটিভদের কাছে শেখা। সাহেব-বালকদের যে-ঔপনিবেশিকতা শিক্ষা দেওয়া হত— তার প্রথম পাঠ ছিল তথাকথিত অ্যাডভেঞ্চারে।

অপরের কাছ থেকে গ্রহণ করায় আমরা, বাঙালিরা, বড়োই অপরিনামদর্শী। তাই বাংলা সাহিত্যে চালু হল ওই কাহিনিগুলির জাতিবর্ণ নির্বিশেষ অনুকরণ।

আজ এগুলি ফেলে দেওয়ার সময় এসেছে। শিশুসাহিত্য বা কিশোর সাহিত্য রচনার জন্য আর আমাদের বুড়ো-খোকা সাজার প্রয়োজন নেই। বড়োদের সাহিত্যে যে-আধুনিকতা, যে-সমসমায়িকতা প্রকাশ পেয়েছে তারই জ্যোতির্বিকাশ ঘটুক আজ যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের চোখের উপর। তাদের যেন আমরা খোলাখুলি বলতে পারি বাঘ দেখে ভয় পেয়ো না— তাকে সহজেই পুরোনো অস্ত্রে মারা যায়। কিন্তু সমাজের যারা অহরহ ক্ষতি করে চলেছে, যারা ভণ্ড, যারা শোষণবাদী, তাদের মারার জন্য নব নব হাতিয়ার তোমরা কল্পনাপ্রবণতার সাহায্যে তৈরি করে নাও।

ঋণ:
মহাযুদ্ধের ঘোড়া। প্রথম সংকলন, মে-জুন ১৯৭৮। সম্পা. দীপান্বিতা রায়।
(দাহপত্রের ফাইল থেকে)

Categories
কবিতা

গৌরাঙ্গ মণ্ডলের কবিতা

সমঝোতা

একঘাটে যতদিন স্নান করা যায়
তার চেয়ে দীর্ঘ না সময়

নিঙড়ে নেওয়ার জন্য হাত কি
জলের আজ্ঞা শোনে?

উদ্বাস্তু শ্যাওলায় আমাদের সূর্যোদয়
পিছলে যাওয়ার আগে শক্ত করে বাঁধো আলিঙ্গন

রাজা নই, চন্দ্র নই, কর্তৃকারকের দায়
এখনও পারি না

খুচরো মাংসের দিকে জিভডগা সাপের ফকিরি

ঘর বড়ো, ধড় বড়ো, হাঁড়ি, শূন্য, কাঁধ…
বয়স বেশির মেয়ে, পারাপার দেবে বলে
তুমিও তো নিয়ে চলো
কায়াভীতিতলে

বাংলা ভাষার থেকে সরে যাও
ব্যাকরণ বড়ো বেশি নিষ্ঠুর প্রেরণা

পদটির অনিচ্ছা জেনেও
ব্যাস বাক্য
ভেঙে ভেঙে রাখছ

এই বিচ্ছেদের দায় নাও। যত পারো দুঃখ করো। শোনো, কসাই হইয়ো না

আমার যা পছন্দের, তার
বাইরে তোমাকে খুঁজি
যা অপছন্দের, তার ভেতরেও…

বিস্তৃত সিঁথির মাঝে
বালকেচ্ছা তীব্র হয়ে ওঠে

সমস্ত রৌদ্রকে আজ স্তনের মাদুলি করে নাও
বৃক্ষহীন এ জীবনে বিদ্ধ হোক অপ্রস্তুত ছায়া

সময়

চিহ্ন দেখে নির্ধারণ
বিশ্বাস রাখিনি এই প্রাচীন প্রথায়

কাদা কি পায়ের কেউ!
সে কেন, সে কেন
নির্মাণে ভুলেছে বৃষ্টিকে

দৃশ্যেও গোপন থাকে, রঙের আড়ালও
ছুরির লাগে না কোনো সাজঘর, ব্যাধি

যা বলার, বলে নাও দ্রুত
তুমি তো চন্দন না যে, ক্ষয়ে গিয়ে ছড়াবে সুখ্যাতি

Categories
কবিতা

তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

খিদে

হরিণ লাফাক, তুমি সাপের গর্ভের কথা বলো। আমাদের মাঠে বসে গুণিন ছিলিম টানে ভোরে। ফের কিছু লোক এসে কোকুনের ছাল রেখে যাবে। নদীতে যে মড়া এসে কাল রাতে ঠেকেছে শ্মশানে, তার কোনো নাভি নেই, শুধু কিছু কুচো মাছ খুঁটে খুঁটে শ্যাওলা খেয়ে যায়। গুণিন জমিয়ে বসে, সাপের রভস ব্যাখ্যা করে। কীভাবে নক্ষত্র থাকে শঙ্খ হলে কৃষ্ণা প্রতিপদে… কীভাবে সাপের শুক্র উচাটনে স্থির হয়ে যায়… ফের ঘুম, ফের কিছু উপোসের বাটি নড়ে ওঠে। হরিণ শিথিল হয়ে মুচড়ে গেছে ছোটার আগেই।

একা বুড়ো গুণিনের ঘরের উনুনে ছাই ছুঁড়ে
মড়ার কণ্ঠার হাড় মাছ ভেবে ছিঁড়েছে সারস।

চাষ

মধ্যযামে রমণ। প্রতিবার ক্লান্ত স্ত্রী আরও যেন কুহক, আগামী।
প্রবেশ সংযম ধরে বীভৎস ঝাঁকিয়ে দিল,
যেন নিচে বিছানা নেই, মাধ্যাকর্ষণ নেই।

গতি তো ধ্রুবক নয়; ধীরে ধীরে নিভে যায় আয়ু।

যত চেনা ঘামগন্ধ, সিঁদুরগন্ধ, গৃহগন্ধ—
হাড় তত আগন্তুক শামুক।

সারাদিন বীজ পেটে ভাত রাঁধছে দানে পাওয়া গাছ।

অন্দরে মানতের জ্যান্ত, গাঢ় সুতো

ন’মাস

সুজাতা হয়ে ভাসে।

Categories
কবিতা

নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছায়ামানুষের খেলনাগাড়ি

১৬

আলো-না আলোয় বোনা পাতার পোশাক তারে মেলা

ফাঁকে ফাঁকে বাজনা থেমে আছে

নেভানো ঘরের জানলা উগরে দিচ্ছে দ্রাক্ষারস, ময়ূরের কেকা

পাড় ভাঙছে মাটির পেয়ালা

বারান্দা হারিয়ে যাচ্ছে দুপুরের নীরব মুঠোয়

জলরঙে আঁকা শূন্য থেকে

যা কখনও লাল নয় তবু তার লালের গভীরে
অস্থির প্যাডেল ঠেলে নেমে যাচ্ছে কাঙাল সেলাই

১৭

নিজেকে পিছন থেকে ধাওয়া করে ব্রহ্মবীজে ফিরেছে কুসুম

ভিতরে তারের বাজনা, বাজনার ভিতরে ডালপালা

ঘুঘু ডাকছে পাতার আড়ালে

দেউটির পিরান থেকে খসে পড়ছে গুলঞ্চ, টগর

কব্জি থেকে কাটা বালিঘড়ির জখমচিহ্ন শুষে
হাওয়া উঠছে ঘুরে ঘুরে ঘুরে

টলমলে গর্ভের ঘুম ভেঙে
গোলকের মুঠো খুলে ভেসে যাচ্ছে মাটির শাবক

Categories
কবিতা

প্রীতম বসাকের কবিতা

স্থিত হও। মধুর যে আলোক—চক্ষু মুদিয়া তাহার সংহিতা বুঝিয়া লও। প্রবীণ বাক্যের পার্শ্বে আমাদিগের সারল্য রাখিয়া দিয়াছি। ওলো কৃষাণীর দেহের কাঁচা লাবণি ভাসিয়া যায় স্রোতে! অধর ফাটিয়া জীবমণ্ডল প্রস্ফুটিত হইতে থাকে। একটি মানুষের দিনলিপির ভেতর ঢুকিয়া পড়ে ভিন্ন মানুষ। দুঃখের সনাতন কাঁপিয়া ওঠে। তুমি ধারণ করিও উহার সজল বায়ু। মেঘ নামাইয়ো আশার ছলনে। দুদণ্ড দাঁড়াইয়ো হে পথিন৷ নিকটে ঘুমাইয়া আছে আমাদিগের দীন সফলতা !

অতঃপর তাহারা পাখির উচ্চতায় আসিয়া বসিল। দেখিল কুঞ্জবনে ছড়াইয়া আছে কাহার নোলক। একটি অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীর অংশ ভাবিল কেহ। কেহ কেহ নদীর নিকট রাখিল দুঃখের তরজমা। একটি সহজ রচিত হইতে হইতে সহসা বাঁক লইয়া মানুষের পাড়ায় আসিয়া পড়িল। দেখিল ফুলের প্রতি সন্দেহ! শুশ্রূষা কেন্দ্রের নিকটে পথ হারাইয়াছে একাধিক ছোটোগল্প। একটি শিশুর দাঁতে আমি দেখিলাম চাঁদের টুকরো লাগিয়া আছে। তাহাকে একটি সরলরেখা উপহার দিতে গিয়া আমার হাসি হাসিগুলোর অপমৃত্যু হইল।