Categories
গদ্য

রণজিৎ অধিকারীর গদ্য

বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ

কিন্তু হারমোনিয়ামটা গেল কোথায়! মালপত্র নামানোর সময় দেখা গেল বাকি সবই আছে— ডুগি তবলা, খোল, বাঁশির লম্বা ব্যাগ, তার সানাই, আমাদের পোশাক-আশাকের ব্যাগ… শুধু হারমোনিয়াম নেই।

এদিকে গানের আসরের সময় হয়ে এল, এখন উপায়!

গ্রামের নাম মনে নেই, ঝাড়গ্রাম থেকে শিলদা যাওয়ার পথে, শিলদার একটু আগের একটা বাস স্টপে নেমে ডান দিকে জঙ্গল পেরিয়ে কয়েক মাইল ঢুকে এসেছি আমরা। সন্ধ্যের আগে আগে আমাদের মালপত্র আনার জন্য এখান থেকে গোরুর গাড়ি পাঠানো হয়েছিল। সবকিছু গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা ঝাড়া হাত পা পেছনে হেঁটে হেঁটে আসছি। বাবা দলের অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। আমি একটু আগে আগে। দু-দিকে শালের জঙ্গল ঘন হয়ে এসেছে, আধো জ্যোৎস্নায় সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছে বছর পনেরোর চোখ। নুড়িভরা উঁচু নীচু পথে চলতে হোঁচট খেতে হয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর চোখ সয়ে গেলে অসুবিধা হয় না। কথা বলতে বলতে আমরা কখনো গাড়ির চেয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ি, আবার কাছাকাছি হই… বয়স্করা এত কথা বলে কেন?

ওরা দেখে কম, বলে বেশি।

গ্রাম থেকে যে-লোকটি আমাদের আনতে এসেছিলেন, তিনি শোনাচ্ছেন, কেমন ধর্মপ্রাণ তাঁর গ্রাম, কবে কোন কীর্তনীয়া এসে পরপর পনেরো দিন আসর করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শ্রোতারা কেমন মুগ্ধ হয়ে রাত জেগে গান শোনে… দেখবেন আসন ছেড়ে কেউ উঠে যায় না… আপনার গান হবে বলে সকাল থেকে মাইকে প্রচার চলছে। টুকরো টুকরো এমন সব কথাই মনে আছে। অন্তত ২৬-২৭ বছর আগের কথা।

কিন্তু এখন উপায়? বাবার খুব সখের চেঞ্জার হারমোনিয়াম। চেঞ্জার হারমোনিয়ামে কীর্তন গাইতে তখন আর কোনো কীর্তনীয়াকে আমি দেখিনি।

সাধারণত কীর্তনে সিঙ্গল বা ডাবল হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হত। শুধু জুড়ি বা জুড়ি হায়ার রিডের প্রচলন ছিল।

অবশ্য হারমোনিয়াম নিয়ে বাবাকে খুব চিন্তা করতে দেখলাম না। বলল— গ্রামে কোনো হারমোনিয়াম নেই? এনে দিন, তাতেই গান হবে।

পাওয়া গেল কেষ্টযাত্রার দলের একটা সিঙ্গল হারমোনিয়াম।

সারা গ্রাম ভেঙে লোক এসেছিল সেদিন পালাকীর্তন শুনতে। বাবা অনেকবার বলেছে আমাকে যে— সেদিন না কি আমি চমৎকার খোল বাজিয়েছিলাম। অবশ্য ওই বয়সে যা-ই বাজাই শ্রোতারা প্রশংসা করত। পরপর তিন দিন সেখানে আসর হল, তারপর আবার চললাম ফুলকুসমার পথে। কিন্তু সেদিনের সে-হারমোনিয়াম রহস্যের উন্মোচন আজও হয়নি।

এই মধ্যবয়স থেকে যখনই নিজের লম্বিত জীবনের দিকে তাকাই— অবাক হই। কেমন ছিল সেই বাল্যকালের চোখে দেখা জগৎ? আজকে যা দেখি, যেভাবে চারপাশের জগৎ আমার সামনে প্রতিভাত হয়— তা এতটাই আলাদা যে, বুঝি সেইসব দিনের সঙ্গে একটা বড়োসড়ো ফারাক ঘটে গেছে কীভাবে যেন! আমি, আমার দেখা দৃশ্য আর উপলব্ধির। সেদিনের ‘আমি’ থেকে আজকের ‘আমি’ পর্যন্ত যদি একটা রেখা টানা যায় আর সেদিনের ‘আমি’-র থেকে সেইসব দিনের উপলব্ধ জগৎ পর্যন্ত আরেকটা রেখা আঁকি— দুটো রেখা মিলে একটা কোণ তৈরি করে না কি? যত দিন যায় বাল্যে দেখা জগতের সঙ্গে এই আমি-র দূরত্ব বাড়তেই থাকে, যেন একটা ক্রমপ্রসারমান কাল্পনিক অতিভুজ… হায়, কখনোই যা যুক্ত হবে না, কোনো রেখা দ্বারাই!

কত কিছুই যে বদলে যায়! ধারণাগুলো পালটায়… মনোভঙ্গি, বিশ্বাসের ধরন…।

তবু সেইসব দিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে, হারায় না। আমার… আমাদের মতো সাধারণের তুচ্ছের জীবনেও তারা কত ঝলমলে। কোনটা লাল, কে-বা গাঢ় নীল, মুখ করুণ করে থাকা দিন, বাঁকাচোরা, বেদনার, তুমুল সুখের কিংবা হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করা ভালো লাগার দিন…। এক বালক শালবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একা, বনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভয় পায়, ছোটে… হয়তো এটুকুই মনে পড়ছে এত দূর থেকে, তার আগের পরের আর কিছুই মনে নেই, অন্ধকার।

তবু সেই ছবিটির কী অসীম মূল্য আমার কাছে!

বাবার এক অল্পবয়সী শিষ্য, তার কথা মনে পড়ছে। তখন সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো, পড়া ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতে থাকে না, টো টো করে ঘুরে বেড়ায় তাই বাবা তাকে সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু আমার তাকে ভালো লাগেনা একটুও, একেবারেই সহ্য করতে পারি না।

সে বাবার আজ্ঞা পালন করে, আমাকে খুশি করার চেষ্টায় থাকে। বাবার কথামতো তার সঙ্গেই ঘুরতে বেরোতে হয়, একা কোথাও যাওয়ার সুখ নেই আর। বিরক্ত হয়ে থাকি তার ওপর। হারমোনিয়ামটা আমি তুলতে পারি না, সে অনায়াসে সেটা তুলে আসরের মাঝখানে রেখে আসে। আমি অল্পবয়সের ঈর্ষায় পুড়তে থাকি। মনে অশান্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াই, খাই, বাজাই।

বাবা অবসরে তাকে তবলা শেখাতে বসে, তার খ্যাংরা কাঠি আঙুলে কোনো বোল ফোটে না দেখে আমার আনন্দ হয়। আড়ালে হাসি। কী বিচিত্র মানুষের মনের রূপ!

মেট্যালা থেকে লাল রাস্তা ঢুকে গেছে গভীর জঙ্গলের ভেতর, আমরা ওই পথেই সেদিন হুমগড়ের কাছাকাছি একটা গ্রামে যাচ্ছি। বড়ো শালগাছগুলো কেটে নেওয়ায় কোথাও কোথাও বেশ ফাঁকা। হয়তো কাছাকাছি কোনো গ্রাম আছে, কিন্তু দেখা যায় না, ছেলেদের চিৎকার ভেসে আসে, মহিষ চরে বেড়াচ্ছে। বিকেল শেষ হয়ে আসছে, তখন এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছই, রাস্তাটা নেমে গেছে, ঝোরামতো, জল পেরিয়ে যেতে হবে।

বাকিরা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে পেরোনোর প্রস্তুতি নেয়।

কিন্তু আমি? বাবা বলল— মনু, তুমি ভাইকে ধরে পার করে দাও। বলা হল ধরতে কিন্তু সে তখন আচমকাই আমাকে ঘাড়ে তুলে নিল, ওই শরীরে কী শক্তি তার!

কিন্তু আমি কেন পারলাম না একাই জল পেরোতে?

এই সুযোগে ও আমাকে কব্জা করতে চায়? কিন্তু কয়েক মিনিট ওর কাঁধে চেপে জল পেরোতে পেরোতেই ওকে ভালোবেসে ফেললাম। বাল্যকালের চোখের জল কী বিশুদ্ধ! তারপর থেকে সে যে কী আপন হয়ে উঠল আমার! যেখানে যাই, সে সঙ্গে যায়, যে-কোনো সমস্যা থেকে সেই উদ্ধার করে। যোগাযোগ ছিল অনেক দিন।

পরে একসময় খবর পাই বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দিকে না কি মাওবাদীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দেয়। তারপর কিছুদিন তার খোঁজ কেউই পায় না। বেশ কিছুদিন পর জঙ্গলের ভেতর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। কেন কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল? কে তার উত্তর দেবে?

তার কথা যখনই মনে পড়ে— বাল্যকাল থেকে আজকের এই আমি পর্যন্ত টানা যে-কাল্পনিক রেখা তা আরও টানটান হয়ে ওঠে, ব্যথায় টনটন করে ওঠে।

না, তার জন্য নয়, এই কান্না এক বিশুদ্ধ উপলব্ধির।


ঘটনাটি ঘটেছিল কোথায়— ছাতনা না কি বিষ্ণুপুরে?

ও-সব দিকে তখন রামায়ণ গান বা পালাগান শুনতে লোক হত দেখবার মতো। মাঝে মাঝে আমার ভয়-ভয়ই করত, বুক দুরুদুরু…। পারব তো এতজনের সামনে বাজাতে? অবশ্য গান শুরুর কিছুক্ষণ পরেই বেশ হাত জমে যেত, তখন এত এত দৃষ্টির সামনে বাজাতে ভালোই লাগত।

কিন্তু সেদিন গান শুরুর অল্প কিছু পরেই বিপত্তি ঘটল।

এমন আর কখনো ঘটেনি।

একজন সমীহ করবার মতো বনেদি চেহারার প্রৌঢ় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে বললেন— এভাবে আপনি পালাগান করতে পারেন না।

বাবা থামিয়ে দিলেন গান, ভালো করে বুঝতে চাইল তাঁর বক্তব্য।

যা বুঝলাম, বাবা গানের মধ্যে যে-রাগরাগিণীর আরোপ করছে, তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। কৃষ্ণবিষয়ক গান বিশুদ্ধ সুরে গাওয়া উচিত ইত্যাদি।

বাবা কীর্তন শিখবার আগে কিছুকাল মার্গ সংগীতের চর্চা করেছে। শুনেছি, বাবার ঠাকুরদার আমল থেকে আমাদের বাড়িতে ধ্রুপদী সংগীতের চর্চা, তার প্রভাব পড়েছিল বাবার মধ্যে। আমি লক্ষ করতাম, একেকদিন বাবা একটু বেশিই রাগ-রাগিণীর ব্যবহার করত। আর সেদিন আমাকে খোল রেখে বেশি তবলা বাজাতে হত।

তবে সেদিনের মতো আর কখনো ঘটেনি। বাবা তৎক্ষনাৎ আসর ত্যাগ করল, একটা গুঞ্জন শুরু হল শ্রোতাদের মধ্যে। অনেকে সেই মানুষটির ওপর বিরক্ত হলেন। কর্তৃপক্ষ এসে বারবার অনুরোধ করলেও বাবা কারো কথাই শুনলেন না।


একটি মতে বাঁকুড়ার ছাতনা শহরে যে-বাশুলী মন্দির আছে, সেখানেই চণ্ডীদাস সাধনা করতেন। সেই মন্দিরের পিছনে একটি লাগোয়া ঘর, আমরা একবার ওই ঘরটিতে টানা পনেরো দিন থেকেছি। মন্দিরের সামনে আটচালা তারপর মাঠ, মাঠ ঘেঁষে পিচ রাস্তা চলে গেছে, রাস্তার ওপারে একটি ছোটো পুকুর। কথিত যে, ওই পুকুরেই রামী রজকিনী কাপড় কাচতে আসত। আমরা দিনের পর দিন ওই পুকুরে স্নান করেছি। কিন্তু সবসময়ই মনে হত, গল্পে শোনা পুকুর কেন এত ছোটো হয়! কল্পনা আমার বাধা পেত।

অবশ্য আমার এই বালকোচিত কল্পনার সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্যের কীই-বা সম্পর্ক!

এখানে আসর বসত সন্ধ্যের মুখে মুখে এবং গান শেষ হত রাত দশটার মধ্যেই।

প্রচুর নানা বয়সের মহিলা গান শুনতে আসত।

তারা কখনোই বাজনার মান বিচার করত না।

একটি অল্পবয়সী ছেলে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে কখনো শ্রীখোল কখনো তবলা বাজাচ্ছে— এটাকে তারা বিস্ময়মিশ্রিত মুগ্ধতা দিয়ে দেখত।

পুরুষ শ্রোতারা এই ব্যাপারটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। বরং তাদের মধ্যে অনেকেই থাকত কীর্তনের প্রকৃত সমঝদার।

তো তখন সাধিকা রাধার চরণ পাবে বলে কৃষ্ণের চূড়া বামে হেলছে…

চূড়া বামে-এ-এ হে-এ-লে-এ বামে হেলে-এ।

কৃষ্ণের চরণ পাবে বলে।

বামে হেলে চূড়া-আ-আ বা-আ-মে-এ হেলে-এ।

কৃষ্ণের চর-অ-অ-ণ পা-আ-বে-এ বলে…

আর গলার মালা তখন?

আপনি দোলে মালা আপনি দোলে

গলার গুণ কি মালার গুণ…

দোলে মালা সে যে

ধীর লয় থেকে পরের গানেই আমার হাত দ্রুত লয়ে বোল তুলত খোলে।

প্রাণ খুলে বাজিয়েছিলাম কি সেদিন? গানের আসর ভাঙতেই প্রৌঢ়া ক-জন মা মাসির মতো আদল তাদের— এসে আমাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নেয়। আর বল লোফালুফির মতো এ-কোল ও-কোল হতে হতে কখন তুলনায় অল্পবয়সীদের কোলে পৌঁছে গেছি। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু এমন একটা অনুভূতি যা আগে কখনো হয়নি, অজস্র নারীর চুম্বন আর তাদের শরীরের ঘনিষ্ঠ স্পর্শ আমাকে এক নতুন সুখানুভূতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল— অনেক পরে যখন স্পষ্ট যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, যৌবনের দিনগুলিতে তা যেন একটা আর্তিই বয়ে এনেছে আমার কাছে কিন্তু সেদিনকার সেই দমবন্ধ হয়ে আসা সুখানুভূতি আমাকে নতুন অপূর্ব একটা জগতের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি— সেদিনের সেই সমবেত আদরের কথা যখনই মনে পড়ে, আবিষ্ট হয়ে পড়ি। ভাবি যে, আমার এই ছোট্ট সংগীতজীবনের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার হয়তো পেয়েছিলাম সেদিনই।

শেষ পাতা

Categories
গদ্য

তমাল রায়ের গদ্য

কে জন্মায় হে বিপ্লব?

‘লুকিং আউটসাইড ইজ ড্রিমিং, লুকিং ইনসাইড ইজ এওকেনিং’

দাদুর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, ছ-বছরের মেয়েটি। সম্পর্ক হয়তো একটা কিছু আছে। এও সত্য সব সম্পর্কের নাম হয় না। পথ যেমন হয় উঁচু বা নীচু। সব পথেরই শেষ থাকে। অথবা থাকে না। এও হাইপোথিসিস! সে তুমি গল্পই লেখো বা ছবি আঁকো বা মুভি নির্মাণের সময় কিছু স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মাস্ট। কিন্তু চূড়ান্ত নয়! ধরো দাদুর নাম ইগো আর শিশুকন্যা কনসাসনেস। বাকিটা সময় বলবে। মানে কাহিনিতে রং ঢং লাগাবে সময়। ধরা যাক দাদুর স্ত্রী বিগত হয়েছেন প্রায় বছর ত্রিশ। তার নাম ছিল আনকনসাস। তার সন্তানদের কেউ ছিল লিবিডো, কেউ ইডিপাস বা ইলেক্ট্রা। সময় নামক গণৎকার এদের বড়ো করায় বাঁধা হননি। কেবল যার গর্ভ থেকেই কনসাসনেসের বাপ কাকার জন্ম, সেই আনকনসাসকে তুলে নিয়েছিলেন ঈশ্বর। ঈশ্বরও এক আপেক্ষিকতা। যে থাকলে আমাদের মত খেঁদা, প্যাঁচা বা টেঁপা, টেঁপিদের সুবিধে। যা বলার প্রয়োজন তা হল, যে-কোনো জার্নিই হল একটা ইনডেফিনাইট মেকিং! যাতে বাতাসের মিহিগুঁড়োর মতো অজান্তেই লেগে থাকে সাররিয়েল বা সুপার রিয়েল। দূরে একটা পাহাড়। ধরা যাক তারও উত্তরে জনপদ। পাহাড় টাহার যদি এনসার হয় খামখেয়ালির, তাহলে বলা যাক, এনারা উত্তরেই জেনারালি অভিষিক্ত। যেমন ধ্রুব তারা। যদিও ধ্রুব এক ফলস্‌হুড। এখানে বলা বাহুল্য মিসোজিনি আছে। মিথোজীবিতাও আছে। ধরা যাক পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম, গ্রামের নাম ইচ্ছেবাড়ি অথবা নকশালবাড়ি। আর ইগো নামক প্রৌঢ় কনসাসকে নিয়ে হেঁটে চলেছেন স্মৃতিসৌধ প্রদর্শনে। নাত্নি কনসাসনেস। আপাতত আঙুল তুলে দেখাচ্ছে একটি নদী। জল বয়ে যেত কখনো। এখন খটখটে শুকনো। দাদু অবশ্য আকাশ ভরা সূর্য তারার নীচে দাঁড়িয়ে সে-সব কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ, সন্ধ্যে নামছে, পাখিরা ঘরে ফিরছে। আর কুয়াশা জড়ো হয়েছে অনেক। শীত আসার আগে যেমন হয়। ধানক্ষেতে মৃত্যুর নোটিস বা বিপ্লব! কেবল কুয়াশায় হারিয়ে গেল কনসাসনেস। স্বজন হারানোর দুঃখে শোকে ইগো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তোমার মহাবিশ্বে প্রভু হারায় না-কো কিছু। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে চলেছেন: ‘কালেক্টিভ কনসাসনেসের কথা। আর কনসাসনেস শুকনো নদী পেরিয়ে ইগোকে খুঁজতে গিয়ে হাতে পেয়েছে চিরকুট। লেখা লুকিং আউট সাইড ইজ ড্রিমিং, লুকিং ইনসাইড ইজ এওকেনিং। শেষ আলোটুকু সম্বল করে, কনসাসনেস এপারে, আসতে চেষ্টা করছে। পেরে উঠছে না। বয়সোচিত কারণেই সে নিরুদ্বিগ্ন। ইগোকে এলোপাথাড়ি দৌড়াতে দেখে, সে হাসছে। ভাবছে এও এক খেলাই। সমাজ সভ্যতা বা বিপ্লবের ইতিহাসে যেমন হয় আরকী!

ফ্রেদরিকোর তেমন ভরসা ছিল না বর্ষায়। গ্রীষ্ম আরামদায়ক হলে সে বসে থাকত সমুদ্রতীরে। একা বসে থাকার সময় আলো আঁধারিতে চোখে পড়ত, একটা উজ্জ্বল আলোর অবিরাম ঘুরে যাওয়া। মার কাছেই শোনা, বাবা না কি অমনটাই ছিলেন, শুনে সরে যাওয়া আলোর সিঁড়ি বেয়ে সে পৌঁছতে চেয়েছিল টাওয়ারে। সেখান থেকে সমুদ্রকে চেনা যায়। দূরত্ব যেভাবে চেনায় সময়কে। একটানা সোঁ সোঁ সুরের মাঝে অক্ষরের পর অক্ষর গাঁথলে জন্ম নেয় ব্যালাড। যুদ্ধ তেমন বৃহৎ হয়ে ওঠে না কখনোই। কিন্তু লড়াইটা থেকে যায়। ফলে টবে লঙ্কা গাছ, তার পাশে নয়নতারা, তারও পাশে ক্রিসানথিমাম। চিঠি আর আসত না। পাগলের মতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে ফ্রেদরিকো সময়ের কাঁটা কে উলটো করে দিতে চাইত। সে চাইত হাতদুটো হোক আরও লম্বা, প্রেম বা বিরহে দীর্ঘ হাতই একমাত্র অবলম্বন অথবা আলিঙ্গন। তারপর ফট ফট কিছু শব্দ। আর ঘুম ছড়িয়ে গেল শহরে। বৃষ্টির ছাঁট লাগতে যখন হুঁশ ফিরল টবে ফুটেছে মৃতদেহ। সমুদ্র থেকে টবের দূরত্ব মাত্র কয়েক মিটার। বাকিটা ক্যামেরায় দেখানো হয়নি। কেবল বিশাল তারাভরতি কসমিক এম্ফিথিয়েটারে তখন কেবল সমুদ্র গর্জন। ক্যাওসের জন্ম হচ্ছে ফ্রেদরিকো ফুলের পাশেই…

যে বা যারা ভীতু, সর্বদা দর্শনকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করে, এছাড়া উপায়ই বা কী!

: কাম্যু।
: হুঁ
: সত্য বড়ো প্রকট, আলোর মতোই। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মিথ্যে বরং দূর নক্ষত্রের মতো, যা আশপাশের অনেক কিছুই চেনায়।
: কে?
: বলো দেখি।
: বুঝি না।
: কে, সার্‌ত্র? সিমন দি বোভোয়া?
: কাম্যু।
: সত্যি বলে কি সত্যি কিছু আছে?
: জানি না।
: কেন?
: আর মিথ্যে?
: এত জেনে কী হয়?
: কিছুই হয় না হয়তো। তবু তো মানুষ জানে।
: ইয়ং ইটালি কে গঠন করেন?
: জানি না।
: মাৎসিনি।
: ইউ এন ও কবে প্রতিষ্ঠা হয়?
: জানি না।
: ১৯২০, ১০ জানুয়ারি।
: আচ্ছা!
: পৃথিবীর স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ কোনটি?
: জানি না।
: ১৮৯৬। ব্রিটেন আর জাঞ্জিবার। ৩৮ মিনিট। ব্রিটেন জিতেছিল।
: আচ্ছা!
: আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটান কে?
: জানি না!
: আব্রাহাম লিঙ্কন।
: বুঝলাম। জাতি সংঘ বলে কি আদৌ কিছু আছে? না কি বড়োলোক দেশের দালালি করাই জাতি সংঘ!
: হুঁ
: কী হুঁ?
: যুদ্ধ কি শেষ হয় আদতে?
: কী জানি!
: ক্রীতদাস প্রথার অবসান হয়েছে? ইজ ইট?
: তোমার কী মনে হয়?
: এপ্রিল ১৪, ১৮৬৫। গুড ফ্রাইডের প্রেয়ারে তাকে কেন খুন হতে হল?
: বেশ!
: আর জানো, যুদ্ধ টুদ্ধ কখনোই শেষ হয় না। চলতেই থাকে।
: আর মৃত্যু?
: কী?
: কিস্যু না, যেদিন প্রেম থাকবে না। আত্মমর্যাদাবোধ থাকবে না, সেটাই মৃত্যু! সে তুমি যতই বেঁচে থাকো। আপাতত ছায়ার সাথে ছায়ার যুদ্ধ ল্যান্ডস্কেপে। কেবল বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। কেউ হয়তো কাঁদছে। কেউ কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগোপনে।

ভিজে ক্যানভাসে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট চড়াই। ধোঁয়া উঠছে। জীবন না মৃত্যুর কে জানে!


চলন্ত জানলার রডে আপাতত বসে একটি পাখি। ট্রেনের গতি খুব মন্থর! উপায়ও নেই। লাইনের দু-ধার জুড়েই অসংখ্য মানুষ অভিনন্দন জানাচ্ছে… ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে… পাখি খানিক ঘাবড়ে কামরার মধ্যে ঢুকে ওড়াউড়ি করল। ধাক্কা খেল, সার দিয়ে রাখা বন্দুকে। তারপর কী করে যেন উড়ে গেল বাইরে! যাবার আগে পিচিৎ করে খানিকটা পায়খানাও করে দিয়ে গেল। ভেতরে গান চলছে, চেনা সুর, মনে পড়ছে না কিছুতেই… কেউ খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে, কেউ-বা সদ্য কেনা জামা বা ট্রাউজার্স। মাইকিং হচ্ছে। ফুল ছুঁড়ছে লোকজন, কী উন্মাদনা। ওরা বিশ্বাস করে, এ-দেশ তাদের মাতৃভূমি, আর মাতৃভূমির বীর সন্তানরা এই ট্রেনে করে এগিয়ে চলেছে… প্রশস্তিমূলক কথা আর গানের মাঝেই পোয়াতি মেয়েটা কী কুক্ষণে কেঁদে উঠল এরই মাঝে, কে জানে! হঠাৎ ভাবগম্ভীর পরিবেশ! সকলের চোখেই জল। কুমারী মেয়েটা তার ইউ এস জি রিপোর্টের প্যাকেটটা ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো যার হাতে তুলে দিল তার বাম বগলের তলায় ধরা ক্রাচ! ট্রেন চলছে। আবার স্লো বিটে প্যাট্রিওটিক সং বাজছে। ট্রেন এগোচ্ছে, সামনে কিছু দূরেই তো ওয়ার ফ্রন্ট…

Categories
গদ্য

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর গদ্য

অতিমারির উৎসব ও এক ছদ্মকবি

মানুষের মন বিবর্তনশীল। ঠিক তেমনই তার সৃজনশীলতাও। মনের অনুভূতি ও সৃজনশীলতার প্রক্ষেপণ অভিন্ন। ঠিক তেমনই অভিন্ন মনের অবসাদ ও সৃষ্টির অবক্ষয়। মানবজীবন স্বল্পায়ু। তবু এই স্বল্পায়ু সম্বল করেই মানুষ বলতে পারে দার্শনিক রেনে ডেকার্টের মতো ‘আমি ভাবি, তাই আমার অস্তিত্বও আছে’। আবার কখনো-বা সে বলে ওঠে ‘এ মায়া প্রপঞ্চময়’। মানুষের আয়ুকাল সীমিত হলেও তার ভাবনার পরিধি ও কল্পনার ব্যাপ্তি মহাকাশের মতোই অনন্তপ্রসারী। মনোজগৎ ও বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্প, শিল্প ও সাহিত্যর মধ্যে কোনো অন্তরায় সভ্যতার জন্মলগ্নে ছিল না। এই সীমানা প্রতীষ্ঠা আধুনিক সভ্যতার অপচেষ্টা। প্রতিটি মানুষের মনের কোণে একজন কবি লুকিয়ে থাকেই। তিনি প্রবল হিসেবি গহনাকারই হোন, বা দোর্দণ্ডপ্রতাপ একনায়ক। সারাজীবন এক পঙ্‌ক্তি কবিতা না লিখলেও মানুষমাত্রই কবি। শুধু সেই কবিত্বকে পরিস্থিতি প্রবৃত্তি ঋণীঋতির আবর্তে কেউ কেউ চিরকালের জন্য কণ্ঠরোধ করে দেন। কবিতা যে শুধু লিখতেই হবে এমন কথা কে বলল? আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির সূত্র কি পৃথিবীর সুন্দরতম কবিতার একটি নয়? বা মোৎজার্টের যন্ত্রালেখ্য! কবিমন ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব অসম্ভব। তিনি যখন মা, তখনও তিনি কবি। আবার যখন শিশু, তখনও। তবু সেই কবি হওয়া কি সহজ? চারিপাশের অতিমারি। তার ভ্রূকুটি আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা কতটা নিস্পৃহ থাকতে পারবে সেই কবিসত্তাটি? কবি অরুণ মিত্র তাঁর ‘কবিতা, আমি ও আমরা’ প্রবন্ধ শুরু করছেন এইভাবে, ‘আমি মাঝেমধ্যে কবিতা লিখি। যে-সময়ে লিখি না, মাঝেসাঝে ভাবি কেন কবিতা লিখি। নিশ্চিন্ত হতে পারি এমন উত্তর কখনো পাই না। আধুনিক কবিতার কোনো লেখক কি পান? জনসমষ্টির সঙ্গে কবিতার যখন আর যোগ নেই তখন এক মোক্ষলাভ ছাড়া বস্তুত আর কোনো লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘এই ভয়াবহ সময় কে জানে, সেই ‘মোক্ষলাভ’-এর আশাতেই কি না, কয়েকটি লিখে ফেলা পঙ্‌ক্তি নিয়ে সাজিয়ে নিচ্ছি এই লেখাটি।’

তখন অতিমারির খবর সবে আসতে শুরু করেছে। ইউরোপে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। উড়ে উড়ে ভেসে আসছে ভয়ের শব্দ। কোথাও লটারি করে ঠিক হচ্ছে ভেন্টিলেটর কে পাবে, কোথাও গণকবরের ওপর তৈরি হচ্ছে রাস্তা। সেইরকম এক সময়ে হাসপাতালে রাতে ডিউটির সময় একচিলতে সুযোগ পেয়ে লিখেছিলাম এই কবিতাটি।

দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে

দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে যে-শব্দগুলি
আজ আমার কথোপকথন শুধু তাদেরই সাথে
আমি প্রশ্ন করি ওদের
ফাল্গুন ঝড়ের কথা
দখিনাবাতাসের কথা
জানতে চাই কবে আসবে তুষারপাত
উত্তর ফিরিয়ে দেয় রংচটা গোলাপি দেয়াল
আমি সেই উত্তর শুনতে পাই স্পষ্ট
কিন্তু তাদের অর্থ বুঝতে পারি না কিছুতেই

কবিতার সঙ্গে স্যানিটাইজার দিয়ে ভাবলাম অনেকগুলো ছোটো ছোটো স্কুলপড়ুয়া শিশুর ছবি আঁকব। কিন্তু কী হল কে জানে। ছবি শেষ হলে দেখলাম, প্রতিটি পড়ুয়ার চোখেমুখে ভয়। এটা তো আমি সচেতনভাবে চাইনি! তাহলে কি অবচেতনে আমারও মনের মধ্যে অনিশ্চয়তার ভয় ঢুকে বসেছে? যেমন লিখতে চাইনি ‘রংচটা গোলাপি দেয়াল’। আমি লিখতে চাইনি। তাহলে কে লেখাল! আমি কি তবে হ্যালুসিনেট করছি? অতিবায়বীয় অতিমারির জিনপরি ভর করছে আমার ভিতর!

এর কিছুদিন পর ঘটে গেল একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমরা যাঁরা মাঝেমধ্যে শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য যাই, তাঁরা জানি, সেখানকার সেবায় ব্রতি নার্সরা অধিকাংশই হয় মণিপুরী, নয় কেরলবাসী। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই সেবিকারা অসম্ভব পরিশ্রমী ও মেধাবী হন। চব্বিশ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর অনায়াসে আবার আরও এক চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করতে পারেন। ভাষাগত যে-কাঠিন্যটুকু থাকে তা অতিক্রম করতে তাঁরা হয়ে ওঠেন অতিরিক্ত স্নেহশীলা। সংক্রামক ব্যাধিতে ভুগতে থাকা রোগিকে পরম যত্নে হাতে করে খাইয়ে দিতেও দেখেছি আমি। বিনিময়ে আমরা যারা ‘বুদ্ধিজীবী’ জাতি বলে মনে করি নিজেদের, কী দিয়েছি ওদের? সম্মান? স্বীকৃতি? অধিকার? সুরক্ষা? না। এর কোনোটাই হয়তো পারিনি দিতে। শপিংমলে ওদের দেখে আড়ালে ‘চিঙ্কি’ বলেছি, রিসেপশনে ওদের কথা বলার ধরন নকল করে টোনটিটকিরি কেটেছি। সেদিন তেমনই বেশ কিছু সিস্টারদিদিমণি অভিমান করে ফিরে গেলেন তাদের নিজের রাজ্যে। মন ভালো ছিল না আমার। একদিকে অতিমারির মনখারাপের লকডাউন। অন্য দিকে শহরের কোল খালি করে চলে যাওয়া এই সেবিকারা। সেদিন হঠাৎ লিখলাম।

পরবাস

ওরা চলে গেল শূন্য দেউল রেখে
দেউলের বুকে সময়হরণ চাকা
ওরা ছেড়ে গেল একবুক অভিমানে
যুদ্ধক্ষেত্রে রইল চাদর ঢাকা।

ওরা ছেড়ে গেল একবুক অভিমানে
আমাদের ব্রত বুদ্ধিজীবীর মতো
ময়না আর তদন্ত খুঁটে খাওয়া
দেউলের চাকা নিয়তি শরণাগত।

ময়না আর তদন্ত খুঁটে খাওয়া
আমাদের যত পথ্য শোধনাগার
ওদেরকে কেউ পিছুডাক দিল না তো
ওরা চলে গেল স্তব্ধ করল হাওয়া।

ওদেরকে কেউ পিছুডাক দিল না তো
এতোদিন শুধু পিছে ডাক দিয়ে গেছি
যাতায়াত পথে অপমান ভরে দিয়ে
ওদের দু-চোখ করেছি অশ্রুজাত।

যাতায়াত পথে অপমান ভরে দিয়ে
আমরা ওদের পরবাসে ঠেলে দিলেম
আমরা আবার নেমে আসি সমতলে
ওরা চলে যায় স্বপ্ন বোনার দেশে।

হাসপাতাল তো দেউলই আমার কাছে। মনে হল এই হঠাৎ চলে যাওয়া অনেকটা তৃতীয় পানিপথ যুদ্ধে ভরতপুরের জাঠ রাজা সুরজমলের মারাঠাদের একলা ফেলে চলে যাবার মতো। এরপর কী করে যুদ্ধে লড়ব আমরা!

ক্রমশ মৃত্যুর সরণি বয়ে আসছিল আমার দেশের দিকেও। প্রথমে কিছু বিখ্যাত মানুষ। তারপর পাশের রাজ্য। তারপর পাশের পাড়া। তারপর একদিন নিজের আত্মীয়স্বজন। মৃত্যু তখন ঘরে ঘরে। সে এক মৃত্যুনদীর স্রোত যেন। সেই বিষাদঘন আবেশে বয়ে এল নতুন মহামারি আইন। মৃত্যুর পর মৃতদেহ তার নিকটজন দেখতে পারবেন মাত্র তিরিশ সেকেন্ড। তারপর পলিথিন মুড়ে তাকে ফেলে দেওয়া হবে লাশঘরে। সেখানে মৃতদেহর স্তূপ। সেখান থেকে গণদাহর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। এই যন্ত্রণা অসহনীয়। মনোবিজ্ঞান বলে মৃত্যুর পর মৃতদেহ ঘিরে আপনজনদের আর্তি অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক। সেই আর্তিতে যাঁরা স্বজনহারা হলেন তাঁরা অবচেতনে স্বীকার করে নেন বাস্তব। মনোবিদ এলিজাবেথ কুবলার রোজ এই ঘূর্ণিপাকের কথা বলেছেন। ত্রিশ সেকেন্ডে তা কতটা সম্ভব? তেমনই একটি ঘটনা ঘটে গেল। আমার শিক্ষকের শাশুড়িমা মা গেলেন অতিমারির সংক্রমণে। তার মৃতদেহ কাচের দেওয়ালের ওপার থেকে দেখার অনুমতি মিলল মাত্র ত্রিশমিনিট। কিন্তু তাঁরাই বা দেখবেন কী করে? তাঁরা নিজেরাও তো তখন ঘরবন্দি। তাঁদের দেহেও সংক্রমণ। সেদিন রাতে লিখলাম এই কবিতাটি।

চরণিক

তোমার জন্য সবুজ রেখে গেলাম
যাচ্ছি রেখে কৃষ্ণচূড়ার পাতা
আমার এ-পথ নদ হবে না জেনো
আমি হলাম শেষ না হওয়া খাতা

তোমার জন্য ফুলেল উঠোন রাখি
আমায় তুমি মুড়ছ পলিথিনে
আমার জন্য অন্তমিলের পদ
সাজিয়ে রেখো অন্য টুকিটাকি।

তুমি যাবে সদর সড়ক দিয়ে
তোমার জন্য খুলছি ব্যারিকেড
এতটুকুই আমার কণ্ঠনালি
আর কটা ধাপ বলব আশা নিয়ে।

তোমার জন্য সবুজ রেখে গেলাম
আমার চলা দখিন দুয়ার দিয়ে
ভোগ লেগেছে জগন্নাথের বাসায়
আমার কথা ফুরিয়ে গেল ঘিয়ে।

কবিতাটি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর বেশ কিছু মানুষ প্রশংসা করলেন, কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া জানালেন। কিন্তু লক্ষ করলাম, আমার মন সেইসব স্পর্শ করছে না। নিস্পৃহ লাগছে সবকিছু। তবে কি এভাবেই শেষ হবে মানবসভ্যতা!

ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমরা। মহাকাশে চলতে থাকা যানের মতোই। আলাদা হয়ে গেল সম্পর্কর মডিউলগুলো। হাতে রসায়ন ঘষি, মুখে আবরণ পরি। এই আবরণের একটি সুবিধা। মনের অন্তরের দোলাচলকে আর কষ্ট করে লুকিয়ে রাখতে হয় না। কবিতা আসে না আর। কবিতা ফুরিয়ে আসে। ক্রমশ ক্লান্ত হই। ক্রমশ নিজেকে মনে হয় পরাভূত। তবু জাহাঙ্গীরের দরবারে একটি পাখির ছবি আমাকে জাগিয়ে রাখে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বিচ্ছিন্নতা তার মায়াজাল বিস্তার করেছে। ঘরে ঘরে অবিশ্বাস। ভাইয়ে ভাইয়ে পাড়ায় পাড়ায় অবিশ্বাস। এত বিষ নিয়ে কবি লিখতে পারেন। আমি লিখব কী করে? আমি তো ছদ্মকবি। যাত্রাপালার বিদুষকের মতো আমার বেশভূষা পাগড়ি জহরত, সবটুকুই যে ‘ছদ্ম’। ভাবতে ভাবতে লিখে ফেলি আমার শেষ কবিতা।

মস্যাধার

আমার আঙুলে আর লেখনিশক্তি নেই
তুমি সেই অন্ধকার আগলে রেখেছ কবি
আমি ভগ্ন রাজ উঠোনের একপাশে
ভগ্নচোয়াল ঘিরে জীর্ণ মলিন রাজবেশ।

আমার গোলাপবাগে বেদখল কলতান অসহ্য মনে হয় না আর।
ওদের বেড়ে উঠতে দেখি আমি আঙুলের কোনায় নিভৃতে
ওরা তুলে নেয় রং
আমারই মস্যাধার থাকে
আমার লেখনি নেই
অবিশ্বাস বাস করে সেই শূন্য ঘরটুকু জুড়ে।

লিখে ফেলি। কিন্তু মানবসভ্যতার ওপর বিশ্বাস হারাই না। মনে মনে ভাবি, আমরা কাটিয়ে উঠবই। সেদিন আবার লিখব। কারণ, যতই ছদ্মবেশ হোক, বিদূষকের চলনবলন আমার রক্তে, অনুভূতিতে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবি। আমি আবার লিখব। নতুন সূর্যের দিনে লিখব। কারণ, লেখা ছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা নেই। কোনো মানুষেরই হয়তো থাকে না।

Categories
গদ্য

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা

শুধুমাত্র গোটা জীবনভর একটা অলীক পথের রেখা আমি লুকিয়ে রেখেছি দুপুরের বুকের ভিতর। যেন সে নিজেই এসে বলে: দগ্ধ শালিকের ডানায় এই মুখ আমি প্রথম দেখেছি! অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি হব বলে কত ঝড়জল পেরিয়ে এসেছি— দেখেছি পাহাড় দেখে জটিল হয়েছি। আজও আমার সাদা পাতার কাঙালপনা, কবে সে নিজেই ফুটে উঠবে। তখন মনে পড়বে না প্রবীণ কবির ছলনা। একটি ভাঙা সাঁকো জুড়ে যাবে চারপাশে। মনে পড়বে প্রথম রোদ্দুরের স্মৃতি। মনে পড়বে বিষণ্ণ গোধূলির পিছনে লুকিয়ে আছে হলুদ বাথরুম; চারপাশে বেহিসেবি জঙ্গল। আর আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে দু-টি শরীর গভীর উত্তাপে। সেই প্রথম চোখ ফেলা হলুদ স্তনের ভাস্কর্যে। বিকেলের অভিশাপ তার মুখ বিষণ্ণ বড়দির মতো। শুধু কিছু করার ছিল না। যখন নিজের দু-হাত স্বপ্নের হত‍্যাদৃশ‍্য লেখে। আমি টের পাই ফাঁকা বাড়ির গর্ভে সন্তান এসেছে।

কথায় কথায় এসে পড়ে ছোটোবেলার গান। অনুরোধের আসর। বিবিধ ভারতী। অনিবার্য শ্রাবন্তী মজুমদার গাইছেন— ‘মাথার ঘন চুল যখন, মরুভূমি হয়ে যায়, ওয়েসিস নিয়ে আসে মরূদ্যান মেঘের ছায়ায় ছায়ায়’। একটি বিজ্ঞাপন জুড়ে এমন অপ্রত্যাশিত সুরের আশ্চর্য বিষাদে ভরে ওঠে দুপুর। আর মাঝে মাঝে ভাবি আরেকটু বড়ো হলে একদিন ওয়েসিস কিনে আনব ঝক্‌ঝকে স্টেশনারি দোকান থেকে। গুপ্তচরের মতো ঘুরে বেড়াব অলৌকিক নীল দোতলা বাড়ির জানলার ছায়ায়। অপ্রত্যাশিত চোখের আলো চোখের বাহিরে এসে পৌঁছবে একদিন। তারপর একদিন এই বাড়ি বিক্রি করে তারা উঠে যাবে সোদপুর স্টেশনের কাছে। বিকেলের পুকুরের গরম জলের ঘনশ্বাসে সেইসব উপকথা একদিন ফেলে এসেছি আমি।


মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানের শেষে শ্রোতারা মুগ্ধ। শুধু এক বৃদ্ধা পথ রোধ করে দাঁড়ালেন তাঁর। অনেক দূর থেকে এসেছেন তিনি। হাতের ঠোঙায় প্রিয় শিল্পীর জন‍্য বাড়ির তৈরি নাড়ু। হেমন্তর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, বাবা কত গান গাইলে কিন্তু আমার প্রিয় গান তো গাইলে না? চোখে জল নিয়ে আবার মঞ্চে উঠলেন হেমন্ত। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে গাইলেন— ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই’। আরেকবার ফাংশন শেষ করে গাড়িতে উঠছেন হেমন্ত। হঠাৎই খালি গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটি ছোটো ছেলে। বলে অসুস্থ বাবার কথা। মৃত‍্যুশয‍্যায় একবার তিনি চোখের দেখা দেখতে চান প্রিয় শিল্পীকে। হেমন্ত বিষণ্ণ ছেলেটিকে গাড়িতে তুলে নেন। তারপর হাজির হন ছোটো এক গলির জীর্ণ কুটিরে। মৃত‍্যুশয‍্যায় শুয়ে এক অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি হন শিল্পী ও শ্রোতা। পরে হেমন্ত বলেছিলেন কী এমন আছে আমার যার জন্য মানুষের এমন ভালোবাসা আমি পেতে পারি! এখনও পৃথিবীতে আছে জীবনের বিষণ্ণ সন্ধ্যায় একপশলা অপ্রত্যাশিত। না বলে আসে। না বলেই চলে যায়। মানুষ যখন টের পায় তখন হেমন্তের পৃথিবী জীবনানন্দের ডায়েরিতে লুকিয়ে পড়েছে।


সমৃদ্ধ বনান্তরে সকল শস‍্য আলো দেয়। উৎপাদন রহস‍্যের কাছাকাছি। জমির সীমানা মেপে নেয় একদা প্রাচীন মালিক। তবু কি ঝড়েজলে পাওয়া গেল তাকে? হাইরোডের পাশে গচ্ছিত ঋতুরহস‍্য। এই সমৃদ্ধি দেখছে বাঁকা চোখে শেষ কুশীলব। যখন বাতাসে বিধবা নাভির আকুলতা। বহুদিন পর ছায়ার নদী ভেঙে এগিয়ে এসেছে বনভোজন। নিজেকে তার মনে হয় নাবিক। চারদিকে জলের ভিতরে আলপথ বেয়ে যথার্থ ভ্রমণ। এবং এইসব অতিশয়োক্তি গিলে নিজের বয়স সুস্পষ্ট হয়।

এবার গরম ভাতের উপর সামান্য মাংসের ছোঁয়া পেলে আমি লিখে দেব সন্দেহজনক এই পিছনের বাড়ি। রোগা ছেলে উদাসীন জ‍্যামিতি আঁকে মাঠের দুপুরে। তারপর চৌমাথার মোড়ে ভিড় বাসে ঝুলতে ঝুলতে দু-একটি মানুষ চোখের সামনে দেখে ফেলে মৃত ধান, রক্তে মেশানো এক জন্তুর ছায়া। উৎপাদিত শহরের চারপাশে, এই ঝড়ে জলে যা কিছু আচ্ছাদিত তারা বাদলের সংসারে ভেসে ওঠে। তখন হাইরোডের দু-পাশে অকালমৃত ঝরে পড়ছে গান।

ক্রমশ ভোরের দিকে দেখে ফেলি। সায়া ও সেমিজ ফেলে অর্ধনগ্ন দেহ মিশে যায় মাটির শরীরে। শুধু গৃহস্থটুকু পড়ে রইল। একটি সোনার কলস ভরে সিন্দুকে রাখা হল চরিত্রের আমিষাশী নখ। এখন দু-টি সন্তানের দায়িত্ব, চাষবাস, প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারি— এক হাতে সব দিয়ে, বলুন দেখি সে কোথায় পালাল? যাত্রাপালার এই কথাগুলি ভোররাতে লণ্ঠনের পিছু পিছু চলে এসেছে আমার ঘরে। চায়ের জল চাপিয়ে তন্ন তন্ন খুঁজে চলেছে অসুখের বৃত্তান্ত।


তারপর একদিন ভোরে এসে পৌঁছল নবীন দম্পতি। নির্জন পাহাড়ের কোলে মধুচন্দ্রিমা। যে-বাংলোয় উঠেছে তারা সেখানে পর্যটক নেই। শুধু এক প্রবীণ দম্পতিকে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। সকালের রোদ্দুরের ঋণ শোধ করে দেয় গোধূলির আলো। তরুণ স্বামী স্ত্রীকে সাবধান করে দেয়— যেন তাদের নতুন জীবনে ওই প্রবীণ দম্পতি আলাপ জমাতে না আসে। তবুও আলাপ হয়। একদিন সন্ধ্যায় প্রবীণ দম্পতির ঘরে চায়ের নিমন্ত্রণ আসে। নবীন দম্পতি সন্ধ্যায় পৌঁছে যথারীতি অপ্রস্তুত। বৃদ্ধা অসুস্থ। আর তাঁর মাথার পাশে বসে সেবা করে চলেছেন প্রবীণ স্বামী। সারাজীবন নিঃসন্তান, বহুবার অসুস্থ স্ত্রীকে সেবা করে আসছেন তিনি। একসময় ঘরে ফিরে আসে নবীন দম্পতি। তরুণ স্বামী টের পায় অবরুদ্ধ কান্নার স্বর। এক অপ্রত্যাশিত রূঢ় জীবনের ধাক্কায় বিশ্বাস টলে যায় তরুণীর। আজ তার যৌবন আছে। শরীরের লাস‍্য আছে। আজ ভালোবাসার কথা বলা অনেক সহজ। একদিন জীবনের পড়ন্ত বেলায় এই ভালোবাসা এমন অবিশ্বাস্য সুখের সন্ধান দেবে কি? না কি অর্থহীন নীরবতায় চরাচর জুড়ে নেমে আসবে অবলুপ্ত শরীরের শোক?

এমন করেই আবার একদিন গল্পের চরিত্রের মুখোমুখি হয় একজন সুদূর ‘আমি’ উদাসীন সংসারে। আমি মানুষটির সংসারে অথবা সমাজে সক্রিয় কোনো ভূমিকা নেই। আসলে তার কোনো ব‍্যক্তিত্ব নেই। নিজের স্ত্রী পর্যন্ত সংসারে তার কথার কোনো মূল্য দেয় না। গোটা জীবন জুড়ে শেষপর্যন্ত তিনি যেন এক অতিরিক্ত— উচ্ছিষ্ট। তবুও একদিন সকালে তিনি ফিরে পেলেন মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা এক নিজস্ব স্বর। বাজারে মাছওলাকে ধমকালেন। প্রতিবেশী এক কর্ণেলকে ব‍্যঙ্গের উপযুক্ত জবাব দিলেন। তারপর এসে দাঁড়ালেন বাড়ির দরজার সামনে। কলিংবেল টিপলেন। ভিতর থেকে তার স্ত্রী চিৎকার করে উঠল— কে? তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুধু বললেন— ‘আমি’। এই স্বর সত‍্যিই কি চেনে তার স্ত্রী অথবা সমাজ। তবু সে আছে। গোপন অমোঘ এক শুশ্রূষার মতো এই একরত্তি জীবনে।


তাঁর জীবনের সেরা পুরস্কার কী? এই প্রশ্নের উত্তরে বনফুল শুনিয়েছিলেন এক আশ্চর্য গল্প। ভাগলপুর থেকে জরুরি কাজে কলকাতা যাবেন বনফুল। কুলি নিয়ে যখন স্টেশনে পৌঁছলেন প্ল‍্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বনফুল হতাশ হয়ে বসে পড়লেন একটি বেঞ্চে। এদিকে কলকাতায় না-গেলেই নয়। ট্রেন আবার পরের দিন। হঠাৎ শুরু হল হইচই। যে-ট্রেন প্ল‍্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই ট্রেন আবার ব‍্যাক করে প্ল‍্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। নেমে এলেন ড্রাইভার। বনফুলের সামনে এসে বললেন, আমি আপনাকে ডাক্তার হিসেবে চিনি তবে আপনার সমস্ত লেখা আমি পড়েছি। আপনাকে ছুটতে দেখেই বুঝেছি আপনি কলকাতা যাবেন বলে আসছেন। তাই আমি গাড়ি ব‍্যাক করে নিয়ে এলাম। চলুন স‍্যার। একজন লেখকের জীবনে এর চেয়ে অপ্রত্যাশিত পুরস্কার আর কী হতে পারে? ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এই অবিশ্বাস্য ঘটনার হয়তো আর পুনরাবৃত্তি হবে না। একজন দক্ষ ড্রাইভারের দেখা মিলবে হয়তো, কিন্তু তিনি একজন পাঠক হিসেবে লেখককে এই স্বীকৃতি দেবেন কি?

সেবার আমেরিকার বঙ্গসম্মেলনে গিয়েছেন পঞ্চাশের একজন জনপ্রিয় কবি। এইসব অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিরা চান শিকড়ের গন্ধ। কিন্তু সাহিত্যের চেয়ে গান নাচেই থাকে প্রধান আকর্ষণ। একসময় এল কবিতাপাঠের পালা। দর্শকমণ্ডলী সুযোগ বুঝে মেতে উঠলেন গল্পে। কবিতা শোনার আগ্রহ নেই। সেই কবি যখন কবিতা পড়ছেন তখন রীতিমতো হইচই চলছে। সুযোগ বুঝে কবিও মাঝখান থেকে অনেকগুলি লাইন বাদ দিয়ে কোনোরকমে কবিতাপাঠ শেষ করলেন। ফেরার সময় প্রেক্ষাগৃহের বাইরে কথা বলছেন কবি। একজন যুবক বললেন আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আপনার কবিতা শুনছিলাম। কিন্তু আপনি মাঝখানে অনকগুলি লাইন বাদ দিলেন কেন? এই অবিশ্বাস্য পাঠকের জন‍্য কবির সেদিন মনে হয়েছিল তাঁর কবিতা লেখা সার্থক। এইভাবেই কাগজের নৌকো সব আলোবাতাসের জলে প্রাণ পায়।

আসুন শুনে নিই সেই অন্ধ মানুষটির কথা। রোজ অনেকটা পথ পেরিয়ে, অনেক কষ্ট করে তিনি মন্দিরে যান। প্রতিদিন একজন যুবক তাঁকে হাত ধরে রাস্তা পার করে পৌঁছে দেয় মন্দিরে। রোজ একই কাজ করতে করতে শেষপর্যন্ত কৌতূহলবশত যুবকটি সেই অন্ধ মানুষটিকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আপনি তো ঠাকুরকে দেখতে পান না, তাহলে রোজ রোজ এত কষ্ট করেন কেন? অন্ধ মানুষটি গাঢ় স্বরে বলেন, আমি আসি তার কারণ আমি ঠাকুরকে দেখতে না পেলেও, ঠাকুর তো আমাকে দেখতে পান! এই বিশ্বাসের পাশে কোনো অবিশ্বাস নেই, অন্তরের চোখদু-টি যেন সদাজাগ্রত! তিনি জীবন দিয়ে সত‍্য করে তোলেন ‘অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে’।


এসো এই অপরিমিত শস‍্যের গায়ে হাত বোলাও। যতক্ষণ রূপকথা দণ্ডিত মানুষের আয়ুরেখা আঁকে। সূর্যাস্তে উড়ছে সব ধুলোমাখা স্মৃতি। মৃত মেয়ের কথা মনে পড়ছে যখন ওর মতো বিড়বিড় করে জুড়ে দাও অহেতুক অপাপবিদ্ধ খেলা। দণ্ডিত সবুজের দেশে কুসুমের রং। গর্ডকেশর। সেই দিনের রাজার গল্পটা বলো। যার শরীর জুড়ে পলাতক মানুষের চোখ। প্রহরীর মৃত‍্যুদণ্ড। তারপর মনে পড়ুক ঘুমের ভিতর কীভাবে বদলে গেছে পথ। সেই পথে ধীবরের জাল খেলা করে। মনে মনে একটি প্রকাণ্ড বাঘ সাক্ষী রইল তোমার রূপের। আর এক পেপে গাছের মলিন স্তনভার। বুকজোড়া দুধের পিপাসা। তারপর নীরবতা জলের সমান।

এখন সবুজ তিথি। বংশানুক্রমিক ওই ব‍্যক্তিগত অভিমান— পাঁচিলের দুষ্প্রাপ্য বই।

মৃত মেয়ের ছবির চেয়ে সুদর্শন পাখিসমাচার। গণআদালতে ছুটির মহড়া। একচিলতে রোদ্দুরের গায়ে এই মৃত বনপথ।

স্রোতের বিরুদ্ধে এই স্পর্শের হাত। লিখে রাখি। মৃতদেহ নিয়ে ম‍্যাটাডোর ছুটে য়ায় অন্ধকারে। বহুদিন খোঁজ নেই। একটা বারো বছরের না মিশে যাচ্ছে কুয়াশার ভিতর। যা কিছু দৃশ‍্যাতীত সেই দিকে দু-চোখের বাধা। এবার প্রহর মেপে ধানের উপর বসে আছে ক্লান্ত চড়াই। রূপকথা অসম্ভব দামি। নদীর জল ফিরিয়ে দিচ্ছে ঠোঁটের চুমুক।

এইসব দিনরাত মানুষের কথার পিছু পিছু উঠে বসেছে বিছানায়। বারো বছর পেরিয়ে একজন অচেনা পুরুষ দেখে ঘুমন্ত শিশুর মুখ, ছেঁড়া কাঁথা সর্বস্ব আমার। এখনও সাঁতার। ঝোলায় রয়েছে ভ্রমণ— লাল নীল টিকিটের আশ্চর্য ধুকপুক। ভেঙে পড়ার আগে এই সমর্পণ। কচুরিপানার মতো মিথ্যে লেগে আছে।

ও যদি এসেই পড়ে, ভাঙা ডানার ছায়ায় পেতে রাখে নিবিড় যৌনতা আমি তবে এলোমেলো জ্বরের বিকার। সন্তানের বুকে একশো আট রকম মিথ‍্যে বুনে ফুল ফোটাই মধ‍্যরাতে। সে এসে দেখুক একটা শরীর জুড়ে নিশিদিন মোমবাতি জ্বলে। একটা শরীর রহস‍্যের ক্রমাগত ব‍্যবহার ভুলে গেছে আজ।

একটা না-ঘটনা ছুটে যাচ্ছে কাহিনির দিকে। চারদিকে জলের অশৌচ। কথায় কথায় ঢেকে যাচ্ছে খড়ের মানুষ। অবলুপ্ত দেহ— তবুও সুন্দর তোমাকে ছেড়ে যায়নি। ছোটো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে দূরদেশের গাড়ি। তুমি বাথরুমে সাবান রেখে সেই যে ছুটে এলে…

আড়চোখের ভাষা সিগন্যাল পেরোচ্ছে। চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে যতদূর…

শেষ পাতা

Categories
গদ্য

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা


রবীন্দ্রনাথের গান আমায় ঘুমোতে দেয় না। আশ্চর্য সুরে শব্দের প্রান্তর ছেড়ে কতবার ছুটে গেছি। তারপর একসময় দেখি শব্দের দিকে, অর্থের দিকে পৌঁছতে বড়ো বেশি দেরি হয়ে গেছে। তবুও জেগে থাকি। কত অপ্রত্যাশিত শব্দ ছুটে আসে। ভাবি আমি কোনোদিন রবীন্দ্রনাথের মতো ‘শ্রাবণসন্ন‍্যাসী’-র মতো শব্দ দিয়ে গান রচনা করতে পারতাম কি? কত আশ্চর্য এক অনুভবে তিনি লিখতে পারেন— ‘ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রানীরব রাতে/অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে’। অন্ধকারের জপের মালা সেই অপ্রত্যাশিত এক অনুভূতির মায়ায় ছুটিয়ে বেড়ায়। যখন গাই— ‘ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে নির্মম ভাগ‍্যের পায়ে’ তখন মনেই থাকে না এই গানটির একটি কবিতা রূপ আছে ‘সানাই’ কাব‍্যগ্রন্থে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘জাগায়ো না ওরে, জাগায়ো না।/ও আজি মেনেছে হার/ক্রূর বিধাতার কাছে।’ চমকে উঠতে হয় এমন অরাবীন্দ্রিক ‘ক্রূর’ শব্দের ব‍্যবহারে। আবার যখন লেখেন ‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গানটি, তখন অনায়াসে কবিতারূপে ঢুকে যায় ‘উপহাসভরে’-র মতো শব্দ। শুষ্ক পাতার সাজাই তরুণী থেকে শুধুমাত্র মাইক্রোফোনের কথা ভেবে যখন ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী’ লেখেন তখন ওই ছিন্ন শব্দ ঘিরেই এক অপ্রত্যাশিত ভাবনার আলিপন শুরু হয়ে যায়। ‘এসেছিলে তবু আস নাই’— এই বিরোধাভাস পেরিয়ে একদিন যখন সুর থেমে যায় তখন ফুটে ওঠে অবগুণ্ঠিত এক ছবি: ‘তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল,/শ‍্যামল বনান্তভূমি করে ছলোছল্।’

তারপর একদিন শুরু হল স্বর্ণযুগের গান। কয়েক দশক জুড়ে আকাশবাণীর অবশ‍্যম্ভাবী অনুরোধের আসর। ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার অনুষ্ঠানের পরিচিতিতে লেখা হল ‘আধুনিক বাংলা’ গান। ১৯৩০ সালের ২৭শে এপ্রিল। শিল্পী হৃদয়রঞ্জন রায়। রবীন্দ্রনাথ-অতুলপ্রসাদ-নজরুল পরবর্তী গানের দিন। যখন কথায় একই রবীন্দ্র নির্ভরতা। সুর আর শিল্পীর গায়কীর আধুনিকতা কথার গায়ে লাগেনি। কিছুটা ব‍্যতিক্রমী সলিল চৌধুরী। আর মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত শব্দের ব‍্যবহার। মনে পড়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ গানটির কথা। যেখানে অনায়াসে কবিতার মতো এসে পড়ে ‘অশান্ত সৃষ্টির প্রশান্ত মন্থর অবকাশ’ কিংবা ‘একফালি নাগরিক আকাশে’-র মতো শব্দব‍্যবহার শ্রোতার কানের তোয়াক্কা না করেই। সলিল চৌধুরীর সুরে এই গানের কথা লেখেন কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ। এই বিমলচন্দ্র ঘোষেরই লেখা ‘শাপমোচন’ ছবির ‘শোনো বন্ধু শোনো’ গানটি। রবীন্দ্রনাথ যে-শব্দ গানে রাখেননি, এখানে অনায়াসে এল ‘ক্রূর’ শব্দটি। তিনি লিখলেন আর উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত গাইলেন— ‘জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে সুকঠিন ফুটপাতে/অতি সঞ্চয়ী ক্রূর দানবের উদ্ধত পদাঘাতে’। সুবীর সেনের গলায় একদিন ভেসে এল ‘নগর জীবন ছবির মতো হয়তো’ গানটি। আর সেখানে কথার একটুকরো আধুনিকতা: ‘রাজপথে পোষা কৃষ্ণচূড়ায় বসন্ত আসে নেমে/তবু এখানে হৃদয় বাঁধবে না কেউ শকুন্তলার প্রেমে।’ কৃষ্ণচূড়ার আগে পোষা শব্দের এই অপ্রত্যাশিত ব‍্যবহার বাংলাগানের কথার সামর্থ্যের একটুকরো উজ্জ্বল দলিল। কত আশ্চর্য লাগে যখন দেখি সত্তরের দশকে লেখা হয়— ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলা/তুমি ভোরের বেলা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে’। ভোরের বেলা হয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে একটা গোটা জীবন, একটা গোটা দশকের গান। মাঝে মাঝে মনে হয় যখন জীবনানন্দ ‘শতভিষা’ পত্রিকার পাতায় লেখেন— ‘আমারই হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন;/সূর্য না কি সূর্যের চপ্পলে/পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে/পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়।’ এই অপ্রত‍্যাশিত চপ্পলের মতো শব্দটিকে ধারণের মতো শক্তি সেই পঞ্চাশের দশকে স্বর্ণযুগের বাংলা গানের ছিল কি?


কচ্ছপ বুকে নিয়ে মানুষ বেরিয়েছে অফিসের পথে। মুখের উপর দিয়ে চলে যায় লেডিস স্পেশাল। হাঁটু অবধি জড়ানো কাপড়ে একটি মৃত মানুষ বাথরুমের বিজ্ঞাপনের পাশে উবু হয়ে বসে। তবু একান্ত রোদ্দুরের অভাব এই গন‍্যমান‍্যের দেশে। বহুদূর পথ। গন্তব্য ভিজে আছে বর্ষাবাদলে। এইবার কথা হোক। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের হাতে আছে আগ্নেয়গিরির সমান লাভা নিঃসরণ। তারপর সন্ধ‍্যার ভিড় পেরিয়ে থলেভরতি রঙিন আপেল নিয়ে বাড়ি ফেরা। ভাঙা সাঁকো পেরিয়ে তোমার হলুদ বাড়ি লুকিয়ে রেখেছি অপ্রস্তুত গেঞ্জির ভিতরে। আজ উড়োজাহাজের দিনলিপি উড়ছে খেলনার চারপাশে। লিপিকর জানে রাতের শরীর দু-জনের মাঝখানে, অবুঝ সন্তান, প্রতিটি ভোরের রাতে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধ।

আটটা দশের লোকাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি পানের দোকানে। বাথরুম সারি। দু-একটা ফোন আসে নগ্ন বাহু মেলে। এই বিপুল সংসারে আমি চাই নিছক অজুহাত। পালাবার নগন্য রেখা সুযোগসন্ধানী। সন্ধ‍্যার মেঘে আলোর পোকায় আমি নষ্ট হয়ে যাই।

ছলনার ডানা তুমি জানো যে-কোনো ফলের দু-দিকে রয়েছে ঢালু পথ। তর্কচূড়ামণি জানেন গাছের সন্দেহ। জানলায় বসে দেখি সামান্য উঠোনের ডালপালা সেও চলেছে পরবাসে।


আমরা মফস্‌সলের ছেলে। সেখানে তখন কথায় কথায় রুমাল, সেন্ট, পাউডার, সাবান দেখা যেত না। আমার মাসির দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ে লতিকাদি। দিল্লির রাইসিনা কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কথায় কথায় পাউডার, সেন্ট মাখত লতিকাদি। আমি নীচু ক্লাসের বালক। লতিকাদির সুগন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম। একদিন দেশভাগ হয়ে গেল। আমরা সপরিবারে কলকাতায় এলাম। মেসো এলেন কলকাতায় বদলি হয়ে। লতিকাদির বিয়ে হয়ে গেল। লতিকাদি আমার স্বপ্নের প্রথম রমণী। কলকাতা যাবার পথে প্ল‍্যাটফর্মে পড়ে গিয়েছিল লতিকাদির রুমাল। সেই সুগন্ধী রুমাল স্বপ্নের ভিতর বহুদিন যত্নে রেখেছিলাম আমি। আমার প্রথম প্রেম লতিকাদির কুহকে আচ্ছন্ন।

একদিন মাসি মারা গেলেন। মেসোমশাই একা। ব‍্যাঙ্কে ছেলেদের পাঠানো টাকা পড়ে থাকে। তোলার কেউ নেই। ছেলেরা বাবার দায়িত্ব নিতে চায় না। বরং পাউন্ড ডবল করে দেয়। অনিচ্ছুক লতিকাদি শেষপর্যন্ত বাবাকে হাওড়ার নিজের শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে রাখে। একদিন তার চিঠি পেয়ে হাওড়ায় লতিকাদির বাড়িতে গেলাম। স্বপ্নের লতিকাদি এখন গিন্নিবান্নি। বড়োছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছে। দোতলায় মেসোকে দেখে চমকে উঠলাম। লতিকাদির অত‍্যাচারে মরণাপন্ন। স্মৃতিভ্রষ্ট একজন মানুষ। লতিকাদি দুই ভাইকে বঞ্চিত করে বাবাকে দিয়ে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেয়। তারপর একদিন হুইল চেয়ারে বসিয়ে স্মৃতিলুপ্ত বাবাকে বেওয়ারিশ তুলে দেয় কালকা মেলে। পরদিন নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন। আমার স্বপ্নের নারী কাজ হাসিল করে বাবাকে নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কত অমানবিক, কত নিষ্ঠুর। এই রমণী আজ এক পাষাণ। শুধু সেই অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুরতার সাক্ষী আমি আর একটি ডুমুর গাছ।

সকালে উঠে একদিন অমিতাভ বুঝতে পারল সে কথা বলতে পারছে না। অথচ গতকাল রাতপর্যন্ত সে কথা বলেছে। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ নয় শুধু বাষ্প বেরোচ্ছে। হতাশ হয়ে পড়ল অমিতাভ। সমস্ত শব্দ তার কণ্ঠ ছেড়ে গেছে। তার কান্না পেল। তারপর চুপচাপ বসে রইল বিছানায়। স্ত্রী রমলাকে এখনই কিছু বলা দরকার। অথচ শব্দ নেই। মনোবিদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও যায় না সে শেষপর্যন্ত। শুধু রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তারপর অনেক দৃশ্যের ভিতর দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে অমিতাভ। রমলা জানতে চায় ডাক্তারের কাছে সে গেছে কি না। অমিতাভ মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ পর অপ্রত্যাশিত অমিতাভ বুঝতে পারে অনেক কথা বলছে তার হাত আর প্রতিটি আঙুল। আবার শুরু হয়েছে নতুন এক কথা বলা। চৌত্রিশ বছর পর আর এক অপরূপ আনন্দ বেদনায় বোবা ভাষার অবচেতনায় অপ্রত্যাশিত আলো এসে পড়ে। শুরু হয় না-কথার এক ভাষাতীত জীবন।

১০
কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সবসময়ই শিল্প সৃষ্টি করার আগ্রহ, চিন্তার দুশ্ছেদ‍্য অঙ্কুরিত বোঝা বহন করে বেড়াবার জন্মগত পাপ। কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে। আজও কারেন্টের বিল পড়ে আছে তোষকের নীচে। যাওয়া হয়নি। কত উদ‍্যম নষ্ট হয়ে গেছে। আজ সন্ধ‍্যার অলৌকিক বিছানা পেরিয়ে আমি টের পাই জলের অশৌচে ভরে উঠেছে শহর। সামান্য খ‍্যাতির জন‍্য মনে হয় দাঁড়াই বৃত্তের ভিতরে; তবু পথ শেষ হয় না। সাদা পাতার দিকে তাকিয়ে আজ আমি ভুলে যেতে চাই সমস্ত মনোবেদনার কথা। জানলার বাইরে অসুখ। দরজা পেরিয়ে দেখি শৈশবের অন্ধকার বসে আছে হেলানো বটগাছের গায়ে। কত অপরাধ সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে ফেলেছি একদিন। আজ এতদিন পর সমস্ত উদাসীন দুপুরের চারপাশে আমি জানলা খুলে দিই। কী চেয়েছিলাম আমি! যেন সমস্ত অপ্রত্যাশিত চুম্বন এসে জড়ো হয় সভ‍্যতার উলটো দিকের সাদা পাতায়। সেই দিন ছলনার বিরুদ্ধে আমি মেলে দেব জন্মের দু-কূল ঘেরা রঙিন পোশাক। তোমার অবলুপ্ত ভাষার শরীরে পেতে দেব সাঁকো। সে আরেক জীবনের বৃত্তান্ত। যখন বাসি বিস্কুটের ছায়া পেরিয়ে উটের মালিকের জন্য আমরা দরজা খুলে দিই।

ঋণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বনফুল, বিমল কর, বিমলচন্দ্র ঘোষ, সলিল চৌধুরী, অমিতাভ সমাজপতি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ‍্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, রাধানাথ মণ্ডল, সুকান্ত সিংহ।

প্রথম পাতা

Categories
গদ্য

ঈশিতা দেসরকারের গদ্য

সাদা রোগ

গাছে সাদা চুল। চুল জড়িয়ে আছে চোখে। কখনো তুলো কখনো উপুড় হওয়া কলমের ডগায় রামপ্রসাদী বেড়া। বেড়া বাঁধতে গিয়ে মন থেকে খসে যায় এক টুকরো আতস বাজি। স্বরলিপি না মেনে আতাফল খুলবে তার গোপন না পাওয়া। না পাওয়া থেকে যতটা জল চুঁইয়ে পড়ে; ততটুকু জমিয়ে ঢালি আমার ছাদ বাগানের পাণ্ডুলিপিতে। চুষে নেওয়ার তুমুল সাক্ষাৎকার দেখি রোজ। একটা খয়েরি সংক্রমণ আমার না লেখা কবিতা থেকে দৌড়োয় টবের কোমড়ে। টব সরালে বরাদ্দ ঘুমের স্বস্তি। স্থল পদ্মের মাথায় গুঁড়ো ক্ষত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে বলে নুন জল খায়। জবার আঙুলে আমের কাঁধে পেয়ারা পাতার চিবুকে তোলপাড়ের ষড়যন্ত্র আমার ছাদবাগানেও। যদিও ছাদ রাষ্ট্র এখানে দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলছে না; দু-এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ওদের ক্ষতি হারিয়ে যাবে চিলেকোঠার সিগারেটে। বৃষ্টির অপেক্ষায় কুচো চারা ডেপুটেশনের বিবৃতি লিখছে। নীলকণ্ঠের লতানো নাভি কিছুটা বোঝে। কিছুটা সময় এলে জবাব দেওয়া গানের রেওয়াজে মন দেয়। গাছেরা সেদ্ধ ভাত খায় শুধু। পথ্য ছাড়াই লাফিয়ে যায় মানুষের দিকে। মানুষ তখন দরজার হেরে যাওয়া দেখছে। মুখস্থ করছে আইসোলেশনের চতুর্থ সূত্র।

বাইরে তখন ধুম ফাগুনের গীতিনাট্য। রাস্তার ইটের সখ্য বেড়েছে হেলে পড়া ঘাসের। হাওয়া এলে টবে টবে খুলে যায় গাছের অন্তর্বাস। কুর্চি ফুল গা সেঁকে নেয় এই সুযোগে। পেটভরতি খিদে পুরু মেঘের মতো।

ওদের ফেলে আসা আলোয় আমার অপারগতার চিরাগ রোজ সন্ধ্যায় গীর্জার নিঝুমে জ্বলে। পোড়া বন্দরের নিঃশ্বাসে গাছ বসায় রাতের ভাত। গাছেরা শক্তিনগরের কালিমন্দিরের আলো; কুমারডাঙ্গির মসজিদের আতরের সাথে উড়ে গেল। শুকনো পাতায় আমার কুঞ্চিত প্রেম নাম। এক। অধিক। সর্বাধিক। চিরাগ জ্বলত গাছে গাছেও। জ্বালাত রতনদা। রতনদা এখন সাদা জোব্বা পরে থাকে। সাদা রোগের সাথে ম্যাচিং করে। প্রতি মাসে টবের গা ধোয় রতনদা। ছাদের উঠোন লেপে দেয়। অবাঞ্ছিত কথাবার্তা সরিয়ে শেকড়ে ঢালে তামরসের হকিকত। পাতার মাথা আঁচড়ায়। দুটো বিনুনি বাঁধে সন্ধ্যা তারা ফুল রঙে;… শেষ ট্রেকার ধরার আগে। সাদা রোগ নিরাময়ের উড়ো চুমু টাঙিয়ে রোগারে জল মিশিয়ে যন্ত্রণাকে করে ‘পাখি হুস…’।

ডেপুটেশনের খসড়ায় রতনদার অনুপস্থিতি ও অপর্যাপ্ত শস্য সংলাপ উঠে আসছে বারবার। গাছ ও রতনদা উভয়েই অদেখার অশান্তিতে কম ঘুমোয়। বেশি রাতে গাছের হৃদয় পায়চারি করাকালীন গায় ‘বনমালী তুমি; পরজনমে হইয়ো রাধা’।

লকডাউনে স্নান বেড়েছে। জলের যোগ্য সন্তান যেন আমরা। স্নানঘরে ফেনার দুঃখ দেখি। কীভাবে মুহূর্তের লাস্য নিকাশি ব্যবস্থায় ফুরিয়ে যায়। এতক্ষণ জন্মসুন্দরী কখনো দেখিনি। যাদের স্নান ঘর নেই; কলতলায় রূপসি ফেনা দ্রুত হারিয়ে যায় অনাবিষ্কৃত শ্যাওলায়।

স্নানের ঘণ্টা বাজছে চারদিকে। তারই মাঝে ডাক শোনা যায় কার যেন!… জলের পেছল আগলে দরজায় যাই। রতনদা দরজার সামনে গণসংগীত রেখে গেছে। ৪৫ দিন ঘরে বসে থাকাত পর নয় কিমি হেঁটে গ্রামের বাড়ি থেকে কাজের খোঁজে শহরের গলিতে কাজফুল কুড়োয়। পরিচিত ছাদবাগানগুলোতে গাছের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চায় টিফিনবক্স। মেহনতি হাত দরজার বাইরে হাতুড়ি খুরপির ছাঁচটুকু রাখে। গাছ জল খায়। দলা মাটি ভিজিয়ে খায়। রতনদা খায় অপেক্ষা। জলে মুড়ি ভেজানোর কৃষি কাজ শেখে। মোবাইল ক্যানভাসে রতনদা এবড়ো খেবড়ো রং জড়িয়েছে কেমন!

রতনদা হাঁটছে। হেঁটে আসে। হেঁটে ফিরে যায়। ১৮ কিমি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে। ওর বুকের হারমোনিয়াম; গুপ্তধনে ঢুকে যাওয়া পেটের গন্ধ টের পাই। হাঁফাতে হাঁফাতে ওর বলা কথারা একে-অপরের গায়ে চেপে বসছে। ঘ্যানর ঘ্যানর কোকিলের ডাককে দূরভাষ শাসন করেছে অগ্রিম। ফাগুনের ধুনকর আমার কানে গুঁজে দিয়েছে শিমুল বীজ। শ্বাসগুলো শিশুর মতো নরম। কানের পাটাতনে যে-খিদে-করতাল বাজে; আমি আজ তার সওয়ারি। ছাদে যাই। পাতায় ঝুঁকে পড়া পেটের আর্তি। তুলো ভেদ করে কার্লভাট ডিঙিয়ে চিৎকার আমার ক্লিপে মিশে গেছে কখন!

নিজেকে ছোটো করে জলের ট্যাঙ্কের নীচে বসি। লালন সমগ্র এনে দিচ্ছে না কেউ। সাঁইজি আমার কখন খেলে এই খেলা! প্রতিটা আর্তরব রতনদার। প্রতিটা শব্দে মেনে না নাওয়ার তারস্বর। রতনদা ভাত বেশি খায়। ও গাছের যত্ন করতে এলে দু-কৌটা চাল বেশি লাগে।

‘গতর খাটি তো; ভাতলা বেশি নাগে; ভাতের তানে এঠিনা কাম করতি আসি।’ হাসতে হাসতে বলে রতনদা। বলতে বলতে মুখে গ্রাস তোলার সময় রতনদাকে গ্রিক পুরুষের মতো দেখায়। এত সুন্দর দেখতে রতনদা?! রতনদার ঘেমে যাওয়া কালো পিঠে স্বদেশের সুজলা সুফলা জমিন। এই আবাদ কাজ ঈশিতা জানে না। ব্যর্থ স্বার্থপর আঙুলে একলব্যর অভিমান ঘুমের ওষুধে রান্নাবাটি খেলে কেবল। ওদিকে আরও স্পষ্ট হচ্ছে গাছের সাদা রোগ। পতাকা বদলে যাচ্ছে অধিকারের নামাবলীতে। গাছ অধিকার ফিরে ফেলে রতনদার দুয়ারে বারবার লক্ষ্মী ছাপ আঁকবে পড়ুয়া। লক্ষ্মী রতনদার বড়ো মেয়ে: যে-নামের আমাদের বাড়ির সাদা সন্ধ্যাতারাকে ডাকে রতনদা। আজান শুরু হলে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখি মাঝে মাঝে।

সাহস করে জানতে চাইনি।

জানি না কি অথই বেদনা আজানের ডালপালায় পায় রতনদা; আমি জানি না; আমার ছাদবাগানের ডালপালারা জানে ঠিক…

Categories
অনুবাদ গল্প

আসল-নকল

সংগ্রাহক: রেভারেন্ড লাল বিহারী দে

ভাষান্তর: গৌরব বিশ্বাস

[সংগ্রাহক পরিচিতি: রেভারেন্ড লাল বিহারী দে। জন্ম: ১৮ই ডিসেম্বর ১৮২৪, বর্ধমানের সোনাপলাশী গ্রামে। কয়েকবছর গ্রামের স্কুলে পড়াশুনোর পর ছোটোবেলাতেই বাবার সাথে কলকাতায় এসে ভর্তি হন, রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফের স্কুলে (এখন স্কটিশচার্চ স্কুল)। ছাত্রাবস্থাতেই খ্রীস্ট ধর্ম গ্ৰহণ। স্কুল কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি করেছেন সাংবাদিকতাও। আর গ্রামবাংলার জীবন সংস্কৃতি নিয়ে নিরলসভাবে রচনা করেছেন গ্রন্থ। কৃষকদের দুরবস্থা, জমিদারদের অত্যাচার নিয়ে ইংরেজিতে লিখেছেন— ‘Govinda Samanta’, ‘Bengal Peasant Life’-এর মতো গ্রন্থ। সংগ্রহ করেছেন বাংলার উপকথা। দিদিমা ঠাকুমারা যে-সব গল্প শুনিয়েছেন বংশ পরম্পরায়, সে-সব উপকথাই সংগ্ৰহ করে ইংরেজিতে প্রকাশ করলেন— ‘Folk Tales of Bengal’s’। সম্ভবত এটিই বাংলার উপকথার প্রথম কোনো সংকলন। এই গ্রন্থেরই কাহিনি— ‘The Ghost-Brahman’-এর বাংলা অনুবাদ আমি করেছি। রেভারেন্ড লাল বিহারী দে মারা যান ১৮৯২ সালে কলকাতায়।]

সে বহুকাল আগের কথা। এক গাঁয়ে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাস করতেন। ব্রাহ্মণ কুলীন ছিলেন না। তাই বিয়ে করে সংসার পাতা তাঁর জন্য বড়ো দুঃসাধ্য ব্যাপার। ব্রাহ্মণ গাঁয়ের স্বচ্ছল মানুষদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে অর্থ সাহায্য চাইতে লাগলেন, যাতে অন্তত বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করতে পারেন। বিয়ের জন্য অর্থের প্রয়োজন। বিয়েতে জন্য বেশি কিছু খরচ না করলেও মেয়ের বাপ মাকে কিছু অর্থ তো দিতে হবে! ব্রাহ্মণ তাই গাঁয়ের দোরে দোরে ঘোরেন, গাঁয়ের বড়ো মানুষদের তোষামুদি করে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। শেষ অবধি এদিক-সেদিক করে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় হল। তারপর এক শুভ দিনে বিবাহ সম্পন্ন করে নতুন বউকে ঘরে তুললেন। ব্রাহ্মণ তাঁর মা আর নবোঢ়াকে নিয়ে একসাথে বাস করতে থাকলেন।

কয়েকদিন বাদে ব্রাহ্মণ মাকে বললেন— ‘দেখো মা, এবার তো আমায় তোমার পাশে, বউয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। তোমাদের সুখে শান্তিতে রাখব এমন অর্থ তো আমার নেই। তার জন্য, দূর দেশে গিয়ে যা হোক কিছু কাজকম্ম করে আমি অর্থ উপার্জন করব। কয়েক বছর দূর দেশে কাটাতে হবে আমায়, যতদিন না পর্যন্ত বেশ কিছু টাকা হাতে আসে। আমার কাছে এখন যা আছে, তা তোমায় দিয়ে যাব। ততদিন এই দিয়েই কষ্টে করে চালিয়ে নাও। সেই সাথে তোমার বৌমাকেও একটু দেখে শুনে রেখো।’

তারপর একদিন মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ব্রাহ্মণ পথে বেরিয়ে পড়লেন। আর ঠিক সেই দিনই সন্ধ্যেবেলায় এক প্রেত হবহু ব্রাহ্মণের রূপ ধরে ব্রাহ্মণের বাড়িতে হাজির হল। নববধূ প্রেতকে নিজের স্বামী ভেবে বসল। সে তো অবাক হয়ে বলল— ‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে বড়ো! এই যে বললে, কয়েক বছর তুমি বাইরে থাকবে! এত তাড়াতাড়ি মন বদলে গেল!’

ব্রাহ্মণের রূপধারী প্রেত ইতস্তত হয়ে জবাব দিল— ‘মানে… ওই… যাত্রা করার জন্য আজকের দিনটা ঠিক শুভ নয়। তাই ফিরে এলাম আরকী! তাছাড়া হঠাৎ করে হাতে বেশ কিছু টাকাও চলে এল… তাই আর…।’

ব্রাহ্মণের মা-ও প্রেতকে নিজে ছেলে ভেবে বসলেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও জাগল না। প্রেত ব্রাহ্মণের ভেক ধরে বাড়ির কর্তা সেজে দিব্যি থাকতে লাগল— সেই-ই যেন আসল ব্রাহ্মণ। বৃদ্ধা মায়ের সন্তান, নবোঢ়ার স্বামী। ব্রাহ্মণরূপী প্রেতকে দেখতে একেবারে আসল ব্রাহ্মণের মতো। কড়াইশুঁটির দুই দানার মতো হবহু এক। আলাদা করার উপায় নেই। পাড়া প্রতিবেশীরাও তাই প্রেতকেই ব্রাহ্মণ ভেবে ভুল করল।

বেশ কয়েকবছর বাদে দূরদেশ থেকে আসল ব্রাহ্মণ বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ঢুকেই তো তাঁর চোখ কপালে। একি! বাড়িতে হুবহু তারই মতো দেখতে আরেকজন! প্রেত দাঁত কিড়মিড় করে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করল— ‘এই, তুই কে রে! আমার বাড়িতে তোর কী দরকার! ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে উত্তর দিল— ‘আমি কে মানে! আগে বলো তুমি কে? এটা তো আমার বাড়ি। ইনি আমার মা। এ আমার বউ’।

প্রেত ব্রাহ্মণকে বলল— ‘আরে, তুই তো আজব কথা বলছিস রে! গাঁয়ের সক্কলে জানে, এ আমার বাড়ি। এরা আমার মা, বউ। বহুদিন ধরে আমরা এ গাঁয়ে আছি। আর তুই আজ কোত্থেকে এসে এমন ভান করছিস, যেন এটা তোর বাড়ি, এরা তোর মা আর বউ! তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি রে ব্রাহ্মণ! যা যা, দূর হ এখান থেকে!’ এ-সব বলে প্রেত ব্রাহ্মণকেই তাঁর নিজের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল।

এমন অদ্ভুত ঘটনায় ব্রাহ্মণ বাক্যহারা হয়ে গেলেন। এখন কী করা উচিত, হতবুদ্ধি ব্রাহ্মণ ভেবে কূল পেলেন না। শেষ অবধি ভেবেচিন্তে রাজার কাছে গিয়ে ব্রাহ্মণ সব ঘটনা খুলে বললেন। রাজা ঘটনার বিচার করতে এলেন। ব্রাহ্মণ আর ভেকধারী প্রেত দু-জনকে দেখেই রাজা অবাক বনে গেলেন। যেন দুই হবহু প্রতিলিপি। কী করে এ-দ্বন্দ্বের তিনি মীমাংসা করবেন সত্যিই তিনি কিছু ভেবে পেলেন না।

ব্রাহ্মণ দিনের পর দিন রাজার কাছে সুবিচারের আশায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন। তাঁর বাড়ি ঘরদোর, বউ আর মাকে ফিরে পাওয়ার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে, রাজাকে কত করে অনুরোধ করেন। রাজা ব্রাহ্মণকে কী বলে শান্ত করবেন বুঝে পান না। রাজা তাই প্রতিদিনই বলেন— ‘কাল এসো, দেখছি’। ব্রাহ্মণও প্রতিদিন রাজার দরবার থেকে বেরিয়ে কপাল চাপড়ে কাঁদতে থাকেন— ‘কলির কাল! আমাকেই কি না আমার বাড়ি থেকে দূর করে দেওয়া হল! অন্য একটা বাইরের লোক আমার ঘরদোর স্ত্রী সবকিছু দখল করে নিল… হে ভগবান… আর রাজাই-বা কেমন! প্রজাদের সুবিচার দিতে পারেন না? আমার কপাল পুড়ল…’।

ব্রাহ্মণ প্রায় প্রতিদিনই রাজার দরবার থেকে বেরিয়ে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে পথ চলেন। পথের মধ্যে একটা ছোট্ট মাঠ পড়ে। সেই মাঠে একদল রাখাল ছেলে খেলে বেড়ায়। গোরুগুলোকে চড়তে দিয়ে, একটা বড়ো গাছতলায় জটলা করে রাখাল ছেলেরা খেলা করে। বড়ো অদ্ভুত তাদের খেলা। ছেলেদের মধ্যেই কেউ সাজে রাজা, কেউ হয় মন্ত্রী, কেউ আবার হয় কোতোয়াল। রাখাল ছেলেরা প্রায় প্রতিদিনই ব্রাহ্মণকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখে।

যে-ছেলেটি রাখালদের রাজা, সে একদিন মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল— ওই ব্রাহ্মণ প্রতিদিন কাঁদেন কেন? মন্ত্রী, তুমি কিছু জানো? মন্ত্রী ছেলেটি কিছু জানত না এ-ব্যাপারে। তাই উত্তর দিতে সে অপারগ। তখন রাখাল রাজা একজন কোতোয়ালকে নির্দেশ দিলেন, ব্রাহ্মণকে তার সামনে হাজির করতে। একজন কোতোয়াল তখন ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বলল— ‘আমাদের রাজা একবার এক্ষুণি আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান’। ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে— ‘কেন কী ব্যাপার! এই তো রাজামশাইয়ের কাছ থেকে এলাম। উনি তো আমায় আগামীকাল আসতে বলে ভাগিয়ে দিলেন। এখন আবার আমায় ডাকছেন কেন?’

কোতোয়াল বলল— ‘না না রাজামশাই নন। এ আমাদের রাখাল রাজা।

ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে বলল— ‘রাখাল রাজা! তিনি আবার কে? বলছ যখন, চলো গিয়েই দেখি’।

ব্রাহ্মণ রাখাল রাজার কাছে এলেন। রাখাল রাজা ব্রাহ্মণের কাছে তাঁর প্রতিদিন এভাবে কাঁদার কারণ জানতে চাইল। ব্রাহ্মণ সবিস্তারে তাঁর দুঃখের কথা জানালেন রাখাল রাজাকে।

রাখাল রাজা সব কিছু শুনে বলল— ‘হুম। বুঝতে পেরেছি কী সমস্যা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি নিশ্চয়ই নিজের সব কিছু ফেরত পাবেন। আপনি শুধু রাজামশায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসুন, উনি যাতে আপনার এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব আমাকে দেন’।

ব্রাহ্মণ আবার গেলেন রাজামশাইয়ের কাছে। রাজমশাইকে অনুরোধ করলেন, রাখাল রাজাকে তাঁর এই সমস্যা সমাধানের অনুমতি দিতে। রাজামশাই এমনিতেই ব্রাহ্মণের এই বিচিত্র সমস্যার সমাধান নিয়ে তিতিরিক্ত ছিলেন। তাই ব্রাহ্মণের অনুরোধে কোনো আপত্তি করলেন না।

ঠিক হল, আগামীকাল সকালেই এই সমস্যার নিষ্পত্তি করা হবে। রাখাল রাজা সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল। সে এক বুদ্ধি বার করল।

পরের দিন সকালে রাখাল রাজা হাজির হল। সঙ্গে সরু মুখের ছোট্ট একটা শিশি। ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণের রূপধারী প্রেত দু-জনই রাখাল রাজার বিচার সভায় উপস্থিত। রাখাল রাজা সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখল। পাড়া প্রতিবেশীদের কথাবার্তাও শোনা হল। তারপর রাখাল রাজা বলল— ‘ব্যস, অনেক কথা শুনলাম। আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। এবার এক্ষুণি এ-সমস্যার নিষ্পত্তি করব। আমার হাতে এই যে-ছোট্ট শিশিটা সবাই দেখতে পাচ্ছেন, দু-জন বিচারপ্রার্থীর মধ্যে যিনি এই শিশির ভেতর ঢুকতে পারবেন, আমার আদালত তাকেই সমস্ত সম্পত্তির প্ৰকৃত অধিকারী বলে ঘোষণা করবে এবং তিনিই হলেন আসল ব্রাহ্মণ। এখন দেখা যাক, কে এর মধ্যে ঢুকতে পারে’।

রাখাল রাজার এমন বিচারে ব্রাহ্মণ হতভম্ব হয়ে গেলেন। দুঃখ করে বললেন— ‘নাঃ… রাখাল রাজা, তুমি সত্যিই ছেলেমানুষ। এ না হলে কেমন বিচার! এইটুকু শিশির ভেতর কোনো মানুষ কি ঢুকতে পারে?’

রাখাল রাজা নির্বিকার কণ্ঠে বলল— ‘ও, আপনি তাহলে এর মধ্যে ঢুকতে পারবেন না? ঠিক আছে। আপনি যদি এর ভেতর ঢুকতে না পারেন, তাহলে সম্পত্তি, বাড়িঘর কোনো কিছুই আপনার নয়’।

‘আপনি কি পারেবন?’ প্রেতকে জিজ্ঞেস করল রাখাল রাজা। ‘যদি আপনি পারেন, তাহলে প্রমাণিত হবে, সম্পত্তি বাড়ি ঘর, স্ত্রী, মা সব আপনার। আপনিই আসল ব্যক্তি’।

রাখাল রাজার প্রস্তাবে, প্রেত একগাল হেসে বলল— ‘এ আর এমন কী! এ তো আমার বাঁ-হাতের খেলা’।

পরমুহূর্তেই সবাই দেখল, প্রেতের শরীর ছোটো হতে হতে একটা ক্ষুদ্র কীটের মতো আকার ধারণ করল। তারপর টুক করে ঢুকে গেল শিশির ভিতর। আর রাখাল রাজা সঙ্গে সঙ্গে শিশির মুখে শক্ত করে ছিপি এঁটে দিল। ছিপির ভিতর আটকা রইল প্রেত।

রাখাল রাজা শিশিটা ব্রাক্ষণের হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল— ‘যান, এই শিশিটা এবার ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিন। তারপর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর মায়ের সাথে সুখে বাস করুন’।

এরপর ব্রাহ্মণ নিজের বাড়িতে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন। সন্তান-সন্ততিতে তাঁর সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
“আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো।।”

হতে হতে একটা ক্ষুদ্র কীটের মতো আকার ধারণ করল। তারপর টুক করে ঢুকে গেল শিশির ভিতর। আর রাখাল রাজা সঙ্গে সঙ্গে শিশির মুখে শক্ত করে ছিপি এঁটে দিল। ছিপির ভিতর আটকা রইল প্রেত।

রাখাল রাজা শিশিটা ব্রাক্ষণের হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল— ‘যান, এই শিশিটা এবার ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিন। তারপর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর মায়ের সাথে সুখে বাস করুন’।

এরপর ব্রাহ্মণ নিজের বাড়িতে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন। সন্তান-সন্ততিতে তাঁর সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
“আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো।।”

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দ্বাদশ পর্ব 

আকাশপ্রদীপ ও ডিকটেটরের হাতে স্বপ্ন

হেমন্ত আসছে, বহুদূর থেকে মাঠঘাট পেরিয়ে সে আসছে। বিকেলের রোদ্দুর আর হাওয়ার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে কার যেন উদাসীন কান্না, দীর্ঘ নিঃশ্বাস। হেমন্তসন্ধ্যা বিচ্ছেদের, সে কাপ থেকে প্লেটকে আলাদা করে দেবে… নৌকা থেকে নদীকে।

Categories
প্রবন্ধ

গোপাল দাসের প্রবন্ধ

পুজোর গানের গৌরবময় অতীত

একটা সময় ছিল যখন দুর্গাপুজোর মহোৎসবে ঢাকের বাদ্যি, নতুন জামাকাপড়, পুজো সংখ্যা পত্র-পত্রিকার সঙ্গে উচ্চারিত হত পুজোর গানের কথা। বাঙালি শ্রোতারা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকত পুজোর সময় কোন শিল্পীর কী গান বেরোবে তা শোনার জন্য। রেকর্ড কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে আগেভাগেই জানিয়ে দিত তারা সে-বছর কোন কোন বিখ্যাত শিল্পীর কী কী গান শ্রোতাদের সামনে হাজির করতে চলেছেন। খবরের কাগজে বা পোস্টার-ফেস্টুনে ছাপানো বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি রেডিয়োর বিজ্ঞাপনে শোনা যেত গানের কিছুটা অংশও। লোকে পুজোর বাজার করতে গিয়ে তাঁদের পছন্দের গানের রেকর্ডটিও কিনে আনতেন। আয়েশ করে বসে কালো রঙের ডিস্ক বা রেকর্ডটি জ্যাকেটের মধ্যে থেকে সযত্নে বার করে রেকর্ড প্লেয়ারে চাপিয়ে দিয়ে গান শুনতে শুনতে বিভোর হতেন। বাড়ির সব সদস্যরা হাতের কাজ সেরে এক জায়গায় জড়ো হয়ে প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে শুনতেন সেইসব গান।

এভাবেই গুছিয়ে বসে শোনা হত সেকালের পুজোর গান। পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজো মণ্ডপগুলিতেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাজানো হত পুরোনো দিনের গানের সঙ্গে সে-বছরের পুজোর নতুন গান। ফলে যাঁদের বাড়িতে গান শোনার যন্ত্রটি ছিল না তাঁরাও বাদ পড়তেন না গান শোনার আনন্দ থেকে। বারবার শুনে অনেকেরই গানগুলি মুখস্থ হয়ে যেত। প্রেমিক-প্রেমিকারা সে-সব গানের কলি গেয়ে বা প্রেমপত্রে ব্যবহার করে একে-অপরকে ইমপ্রেস করার প্রয়াস পেত। ফেসবুক, হোয়াট্‌সঅ্যাপের প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে এর রোম্যান্টিক আবেদন বলে বোঝানো যাবে না।

উপরের বর্ণনাটা পড়তে পড়তে পাঠকের মনে এতক্ষণে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট যুগের একটা ছবি নিশ্চয় ফুটে উঠেছে। এটা মোটামুটি গত শতকের কুড়ির দশক থেকে আশির দশকের ছবি। এবার আরও একটু পিছনে যাওয়া যাক। এই পুজোর গানের ব্যাপারটা কবে থেকে চালু হয়েছিল তার খুব প্রামাণ্য ইতিহাস না থাকলেও, সূচনা পর্বের কিছু কথা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া যায়। ইতিহাসের সেই ধূসর পৃষ্ঠাগুলোতে একটু চোখ বোলানো যাক।

লন্ডনের গ্রামোফোন কোম্পানি ১৯০১ সালে কলকাতার এসপ্লানেড ইস্টে তাঁদের অফিস খোলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘দ্য গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার কোম্পানি লিমিটেড’। পরবর্তীকালে ‘টাইপরাইটার’ শব্দটি ছেঁটে দেওয়া হয়। যাইহোক লন্ডন থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির এজেন্ট হয়ে ১৯০২ সালের ২৮ অক্টোবর কলকাতায় এসেছিলেন ফ্রেডরিক উইলিয়াম গেইসবার্গ। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ক্লাসিক থিয়েটারের নর্তকী মিস্ শশীমুখীর একটি গান রেকর্ড করলেন। গানটি ছিল ‘কাঁহা জীবনধন’। আর তারিখটি ছিল সেই বছরের ৮ই নভেম্বর। শুরু হয়ে গেল কলকাতা তথা ভারতবর্ষে গান রেকর্ডিংয়ের জয়যাত্রা। এভাবেই কলকাতার থিয়েটারপাড়া আর বাঈজিপাড়া ঘুরে ঘুরে গেইসবার্গ বেশ কিছু গানবাজনা রেকর্ড করেছিলেন সেই সময়। সেইসব শিল্পীদের মধ্যে তাঁর সেরা আবিষ্কার গহরজান। জমিদার বাড়ি আর বাঈজিবাড়ির ঘেরাটোপ থেকে গানবাজনা এবার ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের নাগালে আসতে শুরু করল গ্রামোফোন রেকর্ডের দৌলতে।

বাণিজ্যিক সাফল্যের হাতছানিতে আরও কিছু বিদেশি কোম্পানি কলকাতায় এসে গান রেকর্ডিংয়ের ব্যবসা শুরু করে দিল। ‘কলম্বিয়া’, ‘ইনরেকো’, ‘অ্যাঞ্জেল’ প্রভৃতি ব্র্যান্ডের রেকর্ড বাজারে এসে গেল। আমাদের দেশিয় ব্যবসায়ীরাও পিছিয়ে রইলেন না। এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম নাম করতে হয় এইচ. বোসের। পরবর্তীতে জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ‘মেগাফোন’, চন্ডীচরণ সাহার ‘হিন্দুস্তান রেকর্ডস্’, বিভূতিভূষণ সেনের ‘সেনোলা’ কোম্পানির রেকর্ড। নানা ধরনের কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীতের পাশাপাশি নাটক, যাত্রাপালা, গীতিনাট্য প্রভৃতি রেকর্ডবাহিত হয়ে পৌঁছে যেতে লাগল শ্রোতাদের গৃহকোণে। প্রতি মাসেই নতুন কিছু রেকর্ড বাজারে আসতে লাগল। ক্রমে কোম্পানিগুলোর নজর পড়ল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর দিকে। পুজোর বাজার ধরতে রেকর্ড কোম্পানিগুলো সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বছরের সেরা গান-বাজনার ডালি হাজির করতে লাগলেন শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য। শুরু হয়ে গেল বাঙালির পুজোর গান।

পুজোর গানের রেকর্ড কবে থেকে বেরোতে শুরু করেছিল তার নির্ভুল সাল তারিখ ঠিকমতো জানা যায় না। তবে নথিপত্র ঘেঁটে গবেষকরা আন্দাজ দিয়েছেন ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রামোফোন কোম্পানির ১৭টি পুজোর নতুন গানের রেকর্ড ক্যাটালগের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভায়োলেট কালারের এই রেকর্ডগুলি ছিল ১০ ইঞ্চি মাপের, দুই পিঠে রেকর্ডিং করা। দাম তিন টাকা। বাংলা ও ইংরেজিতে বিজ্ঞাপিত ওই তালিকায় শিল্পীদের নাম, গানের প্রথম লাইন, গানের পর্যায়, রাগ ইত্যাদি মুদ্রিত ছিল। ওই ক্যাটালগের কয়েকটি হল: মানদাসুন্দরী দাসীর— ‘এস এস বলে রসিক নেয়ে’ (কীর্তন), ‘আমার সুন্দর মা’ (কীর্তন), নারায়ণচন্দ্র মুখার্জির— ‘দেখ লো সজনী আসে ধীরি ধীরি (আগমনী, বেহাগ-খাম্বাজ), ‘ও মা ত্রিনয়না যেও না যেও না’ (বিজয়া-ভৈরবী), কে. মল্লিকের— ‘এ কী তব বিবেচনা (আগমনী, কাফী-মিশ্র), ‘কী হবে কী হবে উমা চলে যাবে’ (বিজয়া-ভৈরবী), ইত্যাদি।

সেই সময়ে ভক্তিমূলক গান, আগমনী-বিজয়ার গানই বেশি প্রাধান্য পেত। ওই বছরেই খ্যাতনামা নর্তকী-গায়িকা কৃষ্ণভামিনী গাইলেন ‘মাকে কে না জানে’ (মালকোষ) এবং ‘অলসে অবশে বল কালী’ (পূরবী)। এই গায়িকা গানের শেষে ‘মাই নাম ইজ কেষ্টভামিনী’ বলে রেকর্ডিং শেষ করতেন। পরবর্তীকালে ইন্দুবালা, আঙুরবালা প্রমুখ সে-যুগের অনেক মহিলা শিল্পীই নিজেদের পরিচয় জানান দেওয়ার উপায় হিসেবে এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। সে-বছরেই আরও যাঁদের রেকর্ড বেরিয়েছিল তাঁদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য নাম হল শশীভূষণ দে, চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরলা বাঈ, বেদানা দাসী, প্রভৃতি। হাসির গানের রেকর্ড করেছিলেন অভয়াপদ চট্টোপাধ্যায়— ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আদর’ ও ‘স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আদর’। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ রেকর্ডবন্দী করেছিলেন— ‘হে মোর দেবতা’ (ইমনকল্যাণ) ও ‘প্রতিদিন আমি যে জীবনস্বামী’ (সিন্ধি-কাফী)। গান দু-টির কথা ও সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘রবীন্দ্রসংগীত’ শব্দটির তখনও প্রচলন হয়নি। যে-যুগে গৃহস্থ ঘরের মহিলাদের গান শেখাটাই ছিল নিন্দনীয়, সে-যুগে অমলা দাশই প্রথম সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা যিনি রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছিলেন এবং তা জনপ্রিয়ও হয়েছিল। রেকর্ড ক্যাটালগে তার নাম ছাপা হত ‘মিস দাস (অ্যামেচার)’ বলে।

শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য রেকর্ড কোম্পানিগুলো গানের পাশাপাশি থিয়েটার, যাত্রাপালা, গীতিনাট্য প্রভৃতির রেকর্ডও প্রকাশ করতেন পুজোর সময়। ১৯১৫ সালের পুজোতে বেরিয়েছিল ‘অন্নদামঙ্গল’ ৬টি রেকর্ডে। ১৯১৬-তে বেরিয়েছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘আবুহোসেন’। এই দশকে একঝাঁক প্রতিভাধর শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছিল বাংলা গানের জগতে। অন্ধগায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, আশ্চর্যময়ী দাসী, কমলা ঝরিয়া, আঙুরবালা, ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্রচন্দ্র দাস প্রমুখ শিল্পীদের গাওয়া গান বহুকাল পর্যন্ত শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছে। ১৯১৭ সালের পুজোয় কৃষ্ণচন্দ্র দে-র দু-টি গান বেরোল— ‘আর চলে না চলে না মাগো’ এবং ‘মা তোর মুখ দেখে কি’। ১৯২২ সালে প্রথমবার পুজোর গান হিসেবে আঙুরবালা রেকর্ড করেছিলেন দু-টি ভক্তিগীতি। ১৯২৫ সালে হরেন্দ্রনাথ দত্ত গাইলেন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’। গানটির কথা সুর কাজী নজরুল ইসলামের। বিশেষজ্ঞদের মতে এটিই কাজী সাহেবের প্রথম রেকর্ডবন্দী গান। ১৯২৩ সালে ‘মেগাফোন’ কোম্পানির সূচনাই হয়েছিল নজরুলের স্বকণ্ঠে রেকর্ড করা ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ এবং ‘দিতে এলে ফুল হে প্রিয়’ গান দু-টি দিয়ে। ১৯৩১ সালের পুজোয় হীরেন বসুর কথা ও সুরে ধীরেন দাসের গাওয়া ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও’ এবং ১৯৩২ সালের পুজোয় মিস্ লাইটের গাওয়া ‘শেফালী তোমার আঁচলখানি’ আগমনী গান হিসেবে আজও সমাদৃত। সেই বছরেই (১৯৩২) সেপ্টেম্বরে ‘হিন্দুস্তান রেকর্ডস্’ থেকে বেরোল কুমার শচীনদেব বর্মণের গাওয়া ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’ এবং ‘এই পথে আজ এসো প্রিয়া’ গান দু-টি। সম্ভবত এই গান দু-টিই শচীনকর্তার প্রথম পুজোর গান।

এর মধ্যে সংগীত জগতে ঘটে গেছে দু-টি যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৩০ সালে কলকাতা বেতারে হৃদয়রঞ্জন রায় নামে এক শিল্পীর গানের অনুষ্ঠানে ‘আধুনিক বাংলা গান’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করা হল। আর সেই বছরেই বাংলা চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাক হল এবং সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। যদিও প্রথম দিকে বেশ কিছুকাল ছবি চলাকালীন প্রতিটি শোয়ে গায়ক-গায়িকাদের পর্দার আড়ালে বা পিছনে দাঁড়িয়ে ছবির সঙ্গে সঙ্গে ‘লাইভ’ গাইতে হত। এর থেকেই সম্ভবত ‘প্লে-ব্যাক’ শব্দটির উৎপত্তি। অনেক পরে রেকর্ড করা গান ছবির সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। যাইহোক ১৯৩০ সালটিকে বলা যায় বাংলা সংগীত জগতে একটি যুগ সন্ধিক্ষণ। একদিকে ‘আধুনিক বাংলা গান’, যাকে বেসিক ডিস্কের গানও বলা হয়, অন্য দিকে চলচ্চিত্র বা ছায়াছবির গান যা ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী নির্মিত। দু-ধরনের গানই শ্রোতাদের কাছে সমাদর পেয়ে এসেছে বরাবর।

চলচ্চিত্রে গান একটা বড়ো জায়গা করে নেওয়ার পরে সারা বছর ধরে যে-বেসিক গান প্রকাশ হত, তাতে ক্রমশ ভাটা পড়ল। কিন্তু শারদীয়া পুজোর প্রাক্কালে বাংলা গানের প্রকাশ সমান উৎসাহে অব্যাহত রইল। ততদিনে বাংলা গানের আঙিনায় চলে এসেছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, শচীনদেব বর্মণ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখ দিকপাল সুরকারেরা। অসাধারণ গান লিখেছেন শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, মুকুল দত্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত, অনল চট্টোপাধ্যায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গীতিকারেরা। এইসব গীতিকার ও সুরকারদের সৃষ্টিকে কণ্ঠে রূপ দিয়েছেন কুন্দনলাল সায়গল, জগন্ময় মিত্র, অখিলবন্ধু ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, তালাত মামুদ (প্রথম দিকে তপনকুমার নামে খ্যাত), সুধীরলাল চক্রবর্তী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, সনৎ সিংহ, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, অখিলবন্ধু ঘোষ, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর সেন, আরতি মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, নির্মলা মিশ্র, কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, অনুপ ঘোষাল, পিন্টু ভট্টাচার্য-সহ আরও অনেক জনপ্রিয় শিল্পী। সুরকারদের মধ্যে পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীনদেব বর্মণ, শ্যামল মিত্র, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখ শিল্পীরা নিজেরাও বহু কালজয়ী গান গেয়েছেন নিজের এবং অন্যের করা সুরে। বলা বাহুল্য, এই তালিকার বাইরে আরও অনেক শিল্পীর নাম রয়েছে।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে স্বমহিমায় বাংলা গানের জগতে পা রাখলেন সলিল চৌধুরী। বাংলা গানের নতুন দিগন্ত খুলে গেল তাঁর লেখা ও সুরের যাদুতে। মূলত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জলদ-গম্ভীর কণ্ঠে রূপ পেতে থাকল সলিলের অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। পাশাপাশি কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরকে দিয়েও গাইয়েছিলেন বহু কালজয়ী গান। অন্যান্য শিল্পীরা তো ছিলেনই। অপর দিকে মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার প্রমুখ গায়ক-গায়িকারা নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, রাহুলদেব বর্মণের সুরে একের পর এক মাইলস্টোন বাংলা গান উপহার দিয়ে গেছেন শ্রোতাদের। এক সময় এইচ. এম. ভি. থেকে পুজোর সময় রেকর্ড প্ৰকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘শারদ অর্ঘ্য’ নামে গানের বই বেরোত। তাতে শিল্পীদের ছবি, প্রতিটি গানের বাণী (কথা), গীতিকার ও সুরকারের নাম, রেকর্ডের নম্বর ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণ সুদৃশ্যভাবে ছাপা হতো। এ-সব এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।

বাংলা গানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে বহু বিচিত্র ধরনের গানে। যেহেতু বর্তমান লেখাটি পুজোর গান নিয়ে, তাই রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তর গান, কীর্তন, বাউলগান, লোকগীতি, পল্লীগীতি ও সিনেমার গানকে এই আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। তবে কোনো কোনো বছরে শারদীয়ার প্রাক্কালে এইসব গানও আলাদা করে প্রকাশিত হয়েছে। গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর পাল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, পূর্ণদাস বাউল, অংশুমান রায়ের গাওয়া বহু জনপ্রিয় গান শ্রোতাদের কাছে এসেছে পুজোর গান হিসেবে।

পুজোর গানের যে-ধারা একসময় আপন বেগে পাগলপারা ছিল আশির দশকে এসে তা ক্রমশ শীর্ণ হতে লাগল। আর এই দশকের শেষ দিকে এসে তা একেবারেই রুদ্ধ হয়ে গেল। ততদিনে বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে টেলিভিশন। প্রথমে একটি-দু-টি চ্যানেল, তারপরে কেবলের দৌলতে শত শত চ্যানেল। রিমোট কন্ট্রোলে আঙুলের একটু চাপে চোখের পলকে হাজির হয়ে যেতে লাগল দেশ-বিদেশের রকমারি বিনোদনের পসরা। পালটে গেল বিনোদনের সংজ্ঞা।

ইতিমধ্যে দিকপাল শিল্পী, সুরকার, গীতিকারেরাও অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। যে-সময়, নিষ্ঠা এবং শ্রম দিয়ে সমবেত প্রচেষ্টায় তাঁরা এক-একটি কালজয়ী গান সৃষ্টি করে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তার অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠল। সংগীত সৃষ্টির পরিবেশ এবং পরিকাঠামোতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। শ্রোতারাও যেন মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগলেন। তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন বিনোদনের নতুন নতুন আইটেমে। যদিও আশির দশকের শেষ দিকে সুমন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর পরবর্তী শিল্পীদের গাওয়া ‘জীবনমুখী গান’-এর হাত ধরে বাংলা গান তার হৃত গৌরব যেন কিছুটা ফিরে পাচ্ছিল। কিন্তু সেই ধারা বেশিদিন স্থায়ী হল না। একটা সময় এল স্বর্ণযুগের গানের রিমেকের জোয়ার। তা-ও বেশিদিন চলল না।

মাঝে মধ্যে কিছু ভালো গান এখনও যে তৈরি হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা সংখ্যায় খুবই সামান্য। সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে জনপ্রিয় হলেও মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী কোনো ছাপ রাখতে পারছে না। ফলে অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পুজোর গান প্রকাশিত হয়েছে। হাতল ঘোরানো চোঙাওয়ালা কলের গান থেকে শুরু করে রেকর্ড প্লেয়ার (78, 33 & 45 RPM রেকর্ড বাজানো যেত), ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি হয়ে অধুনা মাইক্রোচিপ ও মোবাইল ফোন পর্যন্ত গান শোনার যন্ত্র এবং রেকর্ডিংয়ের প্রযুক্তিগত বহু বিবর্তনের পথ পার হয়ে এসেও স্বর্ণ যুগের সেইসব গান আজও আমাদের আনন্দ দেয়, ভরিয়ে দেয় সুখাবেশে। প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের করে তোলে নস্ট্যালজিক।

পরিশিষ্ট :
পুজোর গানের তালিকা করতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। সেই সাধ্যাতীত চেষ্টায় না গিয়ে ষাট থেকে আশির দশকের কিছু জনপ্রিয় গানের উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করছি। এইসব গানের লাইনগুলি পাঠকের মনে সেই সময়ের আরও অনেক গানের স্মৃতি উস্কে দেবে।

১. ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ১৯৬২)।
২. ‘আবার হবে তো দেখা’ (মান্না দে, ১৯৬৪)।
৩. ‘আজ মনে হয় এই নিরালায়’ (সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৪)।
৪. ‘রানার’/‘পালকির গান’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রথম প্রকাশ ১৯৬৬)।
৫. ‘না বলে এসেছি, তা বলে ভেবোনা’/‘যদি আকাশ হতো আঁখি’ (আরতি মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৭)।
৬. ‘কী নামে ডেকে বলব তোমাকে’ (শ্যামল মিত্র, ১৯৬৭)।
৭. ‘আকাশ কেন ডাকে’ (কিশোর কুমার, ১৯৬৮)।
৮. ‘চল না দিঘার সৈকত ছেড়ে’ (পিন্টু ভট্টাচার্য, ১৯৬৮)।
৯. ‘আঁধার আমার ভালো লাগে’ (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৬৮)।
১০. ‘ঝুমঝুম ময়না নাচো না’/‘মন মাতাল সাঁঝ সকাল’ (মুকেশ, ১৯৬৮)।
১১. ‘না মন লাগে না’ (লতা মঙ্গেশকর, ১৯৬৯)।
১২. ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ (রাহলদেব বর্মণ, ১৯৬৯)।
১৩. ‘একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে’ (ভূপেন হাজারিকা, ১৯৬৯)।
১৪. ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল্ না’/‘রঙ্গিনী কত মন, মন দিতে চায়’ (মান্না দে, ১৯৬৯)।
১৫. ‘তোমার চোখের কাজলে আমার ভালোবাসার কথা’ (বিশ্বজিৎ, ১৯৭০)।
১৬. ‘ননদী বিষের কাঁটা’ (অনুপ ঘোষাল, ১৯৭০)।
১৭. ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ (ভূপেন হাজারিকা, ১৯৭১)।
১৮. ‘না, আমার এ শশী চেয়ো না’ (শচীনদেব বর্মণ, ১৯৭২)।
১৯. ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়’/‘কতদিন পরে এলে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ১৯৭৪)।
২০. ‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম’ (বনশ্রী সেনগুপ্ত, ১৯৭৬)।
২১. ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতেই’ (শ্রাবন্তী মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ১৯৭৬)।
২২. ‘এই মোম জোছনায়’ (আরতি মুখো, ১৯৭৮)।
২৩. ‘আমার পূজার ফুল’/‘সে যেন আমার পাশে’ (কিশোর কুমার, ১৯৮০)।
২৪. ‘ভালো করে তুমি চেয়ে দেখ’ (লতা মঙ্গেশকর, ১৯৮১)।
২৫. ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’ (মান্না দে, ১৯৮৫)।
২৬. ‘হাওয়ায় মেঘ সরায়ে’ (কিশোরকুমার, ১৯৮৬)।
২৭. ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’ (নির্মলা মিশ্র)।
২৮. ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও’ (তালাত মামুদ)।
২৯. ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’ (শ্যামল মিত্র)।
৩০. ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’/‘দুরন্ত ঘূর্ণির’/‘এক গোছা রজনীগন্ধা’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

একাদশ পর্ব

হেমন্তের দিনে নস্টালজিয়া

হেমন্তের বিষাদের দিকে তাকিয়ে আমার বারবার একটি ট্র্যাজেডির কথা মনে হয়, আমাদের চেনা চারপাশ থেকে অনেক দূরে আধো-আলো আধো-অন্ধকারে হিমে-ভেজা এরিনায় অভিনীত হয়ে চলেছে সেই নাটক।