লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৪

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

ত্রয়োদশ অধ্যায়

পশ্চিম প্রান্ত বরাবর ১৬ ইউ য়েন চলার শেষে তীর্থযাত্রী দল এসে পড়লেন না শিয়ে দেশের সীমান্তে। এ-দেশের শি লো শহরের একটি বৌদ্ধবিহারে বুদ্ধের করোটি রাখা আছে। এর পুরোটাই সোনায় আর সাতটি মূল্যবান পাথরে মোড়া। এই করোটির প্রতি এ-দেশের রাজার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। পাছে চুরি যায় সেই ভয়ে রাজা, শহরের মুখ্য পরিবারগুলির মধ্যে থেকে আটজনকে নিযুক্ত করেছেন পাহারা দেওয়ার জন্য। এঁদের প্রত্যেকের কাছে রয়েছে আলাদা আলাদা তালা। প্রত্যেক সকালে এই আটজন একত্রিত হয়ে নিজের নিজের সিলমোহরগুলি প্রথমে পর্যবেক্ষণ করেন তারপর একে একে দ্বার খোলা হয়।সে-কাজ সম্পূর্ণ হলে সুগন্ধি জলে হাত ধুয়ে নেন সকলে। তারপর করোটিখানি বের করে এনে মঠের বাইরের দিকে একটি বেদীর উপরে অধিষ্ঠিত করেন। এটিকে মূল্যবান সপ্ত দ্রব্যে তৈরি একখানি গোলকের উপরে রাখা হয়।আর উপরে কাচ দিয়ে ঢাকা থাকে।এসবের পুরোটাই জমকালো মুক্তা আর রত্ন খচিত। করোটী খানি হলদে সাদা রঙের,চার ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত এবং মধ্যবর্তী স্থান উত্থিত।প্রতিদিন দেহাংশটি বাইরে আনার পর,বিহারের দ্বায়িত্বে থাকা সন্ন্যাসী, উঁচু মিনারে উঠে প্রথমে বিরাট এক ভেরি, তারপর শঙখ বাজান।আর সব শেষে ঝনঝন রবে বাজাতে থাকেন কাঁসর। এই সমবেত ধ্বনি শুনতে পেলেই রাজা বিহারের পথে অগ্রসর হন।ফুল আর সুগন্ধি সহযোগে পূজা সম্পন্ন করেন।পূজা শেষে সকলে একে একে আভূমিনত প্রণাম করে, প্রস্থান করেন। পূর্ব দ্বার দিয়ে প্রবেশ এবং পশ্চিম দ্বার দিয়ে প্রস্থান করে, রাজা প্রতিদিন সকালে একইভাবে নিজের পূজা নিবেদন করেন। তারপর রাজা তার রাজ দরবারের কাজ আরম্ভ করেন। বিদ্বান ও প্রবীণ ব্যক্তিগণ প্রথমে এখানে পূজা সম্পন্ন করেন তারপর নিজ নিজ কর্মে মনোনিবেশ করেন। এই হল নিত্যদিনের সূচি। কোনোদিন এর কোনো নড়চড় হয় না।সকল পূজা সমাধা হলে করোটিখানি আবার বিহারের অন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।

বিহারের অভ্যন্তরে আছে একটি স্বতন্ত্র প্যাগোডা। এটি মূল্যবান সপ্ত দ্রব্যে তৈরি, পাঁচ ফুটের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট। প্যাগোডাটি কখনো খোলা হয়, কখনো-বা আবার বন্ধ থাকে। বিহারের মূল ফটকের সামনের দিকে প্রতিদিন সকালে ফুল আর ধূপ বিক্রেতার আনাগোনা শুরু হয়, যাতে পূজা দিতে আসা ভক্তগণ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাদের কাছ থেকে কিনতে পারেন। এ-দেশের অন্যান্য রাজা যারা আছেন, তারাও নিয়মিত তাদের অমাত্যদের প্রতিনিধি হিসেবে পূজা নিবেদন করতে পাঠান এই বৌদ্ধ বিহারে।বিহারটি চল্লিশ কদম বর্গাকৃতি বিশিষ্ট। স্বর্গ, মর্ত্য কেঁপে উঠলে, ধরনী দ্বিধা হলেও এই স্থানটি রইবে অবিচল।

এখান থেকে উত্তরে এক ইউ ইয়েন দূরত্ব অতিক্রম করে তীর্থযাত্রী দল, না শিয়ের রাজধানীতে এসে পৌঁছোল। এখানে বোধিসত্ত্ব পাঁচটি বৃন্ত বিশিষ্ট ফুল নিবেদন করেছিলেন দীপংকর বুদ্ধকে। বুদ্ধের দাঁতের স্মারক নিয়ে তৈরি প্যাগোডা রয়েছে এ-শহরে। করোটির উদ্দেশে যেভাবে পূজা করা হয় সেই একই উপচারে পূজা দেওয়া হয় এই প্যাগোডাতেও।

এখান থেকে চলে যাও এক ইউ ইয়েন উত্তরপূর্বে, গিয়ে পড়বে একটি উপত্যকার প্রবেশ মুখে। এখানে রাখা আছে বুদ্ধের রূপদস্তায় তৈরি যষ্টি। এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একখানি বিহার আর এখানেই পূজা করা হয় দণ্ডটিকে। গো-শির চন্দনে প্রস্তুত এই দণ্ড, ১৬-১৭ ফুট দীর্ঘ। একটি কাঠের খাপের ভিতরে রাখা আছে এটি। শত বা সহস্র জন মিলেও এই খাপ থেকে দণ্ডটিকে সরানো যায় না।

এই উপত্যকায় পশ্চিম দিক বরাবর দিন চারেকের পথ পেরোলে এসে পৌঁছোনো যাবে এক বৌদ্ধ বিহারে। এখানে পূজিত হয় বুদ্ধের সংহাতি বা কাসায় বস্ত্র। কথিত আছে যে, এ-দেশ যখন অত্যধিক খরার কবলে পড়ে, রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিগণ ও সাধারণ মানুষজন মিলে বুদ্ধের বস্ত্রটি বাইরে বের করে আনে এবং পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করে। অনতিবিলম্বে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়।

এই স্থান থেকে অর্ধ ইউ ইয়েন দূরে, শহরের দক্ষিণ দিকে আছে একটি গুহা। বৃহৎ পর্বতশৃঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে এই গুহা। বুদ্ধ তার ছায়া রেখে যান এই গিরি-গুহা গাত্রে। দশ কদমের অধিক দূরত্ব থেকে দেখলে, স্বর্ণাভ বর্ণের একখানি, উজ্জ্বল, ঝলমলে, বুদ্ধের পূর্ণাবয়ব সিল্যুয়েট ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যত এগিয়ে যেতে থাকবে এই ছায়ার দিকে, তত অস্পষ্টতা ঘিরে ফেলবে তোমায়। রইবে কেবল ছায়া, কেবল একফালি আঁধার।তথাগত রইবেন অধরা।

পড়শি রাষ্ট্রগুলি থেকে সম্রাটগণ সবচেয়ে দক্ষ চিত্রকর পাঠালেন এই ছায়া অনুসরণে একখানি ছবি আঁকাবার উদ্দেশ্যে। হায়! সব নৈপুণ্যের অতীত তিনি। কেউ পারল না ছবিতে তাঁকে বাঁধতে। এ-দেশের মানুষের বিশ্বাস, তথাগত তাঁর সহস্র জন্মের ছায়া রেখে যাবেন এই গুহা গাত্রে। বুদ্ধ যখন জীবিত ছিলেন, এই ছায়া-স্থল থেকে একশো কদম পশ্চিমে একটি জায়গায় নখ কাটেন আর শির মুণ্ডন করান। এর পর ভবিষ্যতে প্যাগোডার আদর্শ নমুনা হিসাবে তার শিষ্যদের সহায়তায় সত্তর-আশি ফুট উচ্চতার একটি প্যাগোডা নির্মাণ করান।এই প্যাগোডা বর্তমানে বিদ্যমান। এর পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একখানি মন্দির। আর এই মন্দিরে থাকেন সাতশো জন সন্ন্যাসী।

চতুর্দশ অধ্যায়

ক্রমে শীত তার হিমের পসরা সাজিয়ে হাজির হল। এ-ঋতুর দ্বিতীয় চাঁদে ফা-হিয়েন আর তাঁর দু-জন সহযাত্রী মিলে আরও দক্ষিণে অগ্রসর হতে শুরু করলেন।পার করলেন বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গ। শীত গ্রীষ্মের প্রভেদ নেই কোনো। চির তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণি। পর্বতের উত্তর গাত্র ছায়াবৃত, তাই ভয়ংকর ঠান্ডা। যখন হাওয়া বইতে শুরু করে, হাড় পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। কাঁপুনির চোটে মুখ খোলা দুষ্কর। দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হয়ে একাকার, তাই নীরব থাকাই যেন বাধ্যতামূলক। হুই চিং-এর আর এগোবার ক্ষমতা নেই, মুখের ভিতর ফেনা। অতি কষ্টে ফা-হিয়েনকে বললেন, “আমার আর উদ্ধার নেই, আর বাঁচব না আমি। তুমি এগিয়ে যাও, যতক্ষণ পারো। নতুবা আমরা সকলে একসঙ্গে প্রাণ হারাব।” মৃতদেহের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে ফা-হিয়েন হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। বলতে লাগলেন, “ভ্রমণের মূল পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত করা যাবে না। এই ছিল ভবিতব্য!” সকলের উদ্যম যেন সত্যিই নিঃশেষিত। তারপরও নিজেদেরকে আরও একবার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলা শুরু।পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে দক্ষিণ ঢালে এসে পৌঁছলেন তাঁরা। অবশেষে এসে পড়া গেল আফগানিস্তান। তিন হাজার সন্ন্যাসী আছেন এ-রাজ্যে। সকলেই মহাযান ধর্মাবলম্বী। এবারের বর্ষা এ-দেশেই কাটল। আর বর্ষা অন্তে আবার বেরিয়ে পড়া দক্ষিণ প্রান্ত ধরে। এবার এসে পৌঁছোলেন তাইওয়ান প্রদেশে। এখানেও রয়েছেন তিন হাজারের বেশি সন্ন্যাসী। তবে এখানে সকলেই হীনযান সম্প্রদায়ের। এই স্থল থেকে ঠিক তিন দিন ভ্রমণ করে তাঁরা আরও একবার হিন-তো নদী পার করলেন। এই নদীর দুই তীর একেবারে সমতল।

পঞ্চদশ অধ্যায়

নদীর অপর তীরে আছে পি-তু নামের একটি দেশ। এখানে বৌদ্ধধর্ম তার সকল সমৃদ্ধি নিয়ে বর্তমান, তা সে হীনযান হোক বা মহাযান। এ-দেশের মানুষেরা যখন দেখল সুদূর চীন থেকে একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এসেছেন, বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটে না তাদের। এই ব্যাপারটি দারুণ প্রভাবিত করল সাধারণ মানুষকে। সংসার ত্যাগী হয়ে একজন বিদেশির পক্ষে এই সুদূর পরবাসে ধর্ম সন্ধান, এ একপ্রকার অকল্পনীয় তাদের কাছে। তীর্থযাত্রীদের প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর বন্দোবস্ত করলেন তারা। অতিথিদের প্রতি তাদের আচরণ ছিল বুদ্ধের নীতি অনুসারী।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

 

Facebook Comments

অনুবাদক: সঙ্গীতা দাস

শৈশব ও বেড়ে ওঠা উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপাড়া। অত এক দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামের স্কুলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত। অন্তর্মুখী জীবন নিয়ে একা একা লোফালুফি খেলেন। অনুবাদ, লেখালেখি, পাঠ এ সবই নীরব কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এই অনুবাদ, এ তাঁরই জীবনের অংশ, তাই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

পছন্দের বই