লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৪

সোমা মুখোপাধ্যায়

নিশারানির কন্যাশ্রী পুতুল

বাংলায় বিভিন্ন ধরনের পুতুল রয়েছে। একসময় কাদামাটি দিয়ে প্রথম পুতুল বানিয়ে ছিল মানুষ। ধীরে ধীরে নানা মাধ্যমে তা তৈরি হতে থাকে। এভাবেই পুরোনো কাপড় দিয়ে একসময় পুতুল তৈরি করা শুরু হয়। সে-সময় বাইরের বিনোদন অন্দরে প্রবেশ করেনি তখন এগুলোই ছিল মেয়েদের বিনোদনের মাধ্যম। এতে তাদের সৃষ্টিশীলতাও প্রকাশ পেত। তাই সংসারের অবসরে এমন কাপড়ের পুতুল বানাত মেয়েরা। একসময় এই কাপড়ের পুতুল মেয়েদের রুজি রোজগারের অবলম্বন হয়ে যায়। আজ এমন স্বাবলম্বী এক গৃহবধূর শিল্প কথা শোনাব।

কোচবিহার জেলার মহিষবাথানের বাসিন্দা নিশারানি একজন গৃহবধূ। ছাপোষা সংসারে দুই মেয়ে এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়েই দিন কাটাতেন। পয়সার অভাবে মেয়েদের পুতুল কিনে দেবার সাধ থাকলেও সাধারণ ছিল না। তাই মেয়েরা পুরোনো কাপড় দিয়েই নিজেদের খেলার পুতুল তৈরি করত। কাপড়ে তুলো ভরা পুতুলগুলো দাঁড়াতে পারত না। তাই মেয়েরা স্কুলে চলে গেলে সংসারের কাজ সেরে নিশারানি সেই পুতুলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে করতে একদিন নিজেই স্বাবলম্বী হয়ে গেলেন। মাধ্যম এই কাপড়ের পুতুল।

বছর পাঁচেক আগে কলকাতার রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় ঘুরতে ঘুরতে চোখ আটকে গিয়েছিল কারুভাষায় নিশারানির কন্যাশ্রী পুতুলে। স্কুলের শাড়ি পরে হাতে বই খাতা নিয়ে বড়ো বড়ো উজ্জ্বল চোখে চেয়ে আছে কন্যাশ্রীরা। এই পুতুল জেলা স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল। তাই এখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল। আমি দপ্তরের কর্মীদের কাছ থেকে তখনই নিশারানির ফোন নম্বর নিয়ে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আর তৈরি হয় এক আত্মীয়তা।

ছোটোবেলায় দিদিমাকে দেখতাম এই কাপড়ের পুতুল তৈরি করতে। পুতুলের দেহের নানা অংশ কেটে নিয়ে তুলো পুরে সেলাই করে জুড়ে জুড়ে রূপ দিতেন। উল বা কাপড়ের পাড়ের সুতো দিয়ে চুল, চোখ নাক মুখ করতেন। নিশারানির পদ্ধতী এক কিন্তু আরও সৌখিন আরও নিপুণভাবে তৈরি এই পুতুলগুলো। আর আছে উদ্ভাবনী শক্তি।

সে-সময় সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প শুরু করেছেন। নিশারানি তাকেই রূপ দিলেন। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এমনটাই তাঁরও স্বপ্ন। সেই স্বপ্নপূরণ করলেন নানা ধরনের কন্যাশ্রী পুতুল। সবাই অবাক হয়ে গেল দেখে। কন্যাশ্রী দিবসে সরকারি দপ্তরে আমন্ত্রিত হয়ে প্রদর্শনীতে সাজালেন পুতুল। পাশাপাশি সবুজসাথ-সহ আরও প্রকল্পকে রূপ দিলেন।

এর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতিও স্থান পেল তাঁর ভাবনায়। তিনি নিজে রাজবংশী। তাই রাজবংশী বিয়ের বৈরাতি নৃত্য স্থান পেল তাঁর ভাবনায়। এই সমাজে বর এলে এয়োস্ত্রীরা নাচে গানে বরকে বরণ করেন এর নাম বৈরাতি নৃত্য। পুতুলের মাধ্যমে তাঁকে রূপায়ণ করলেন তিনি। পাশাপাশি বিয়ের বিভিন্ন দৃশ্য তুলে ধরলেন। স্থান পেল আদিবাসী সংস্কৃতির ঝলকও।

সমাজে এখনও রয়েছে মেয়েদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার আর কুপ্রথা। নিশারানি তাঁর পুতুলের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধেও প্রচার করেছেন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রয়েছে তাঁর পুতুল।

আমার সঙ্গে নিশারানির দেখা হয় বেশ কয়েক বছর আগে।দমদমে ছেলের বাড়িতে এসেছিলেন। ছেলে আর বউমা দু-জনেই কলকাতায় চাকরি করেন। রয়েছে একটি ছোটো নাতি। দোহারা চেহারার সদালাপী নিশারানি প্রথম আলাপে বুঝতেই দেননি আমাদের প্রথম এই দেখা হচ্ছে। বেড়াতে এসেও সঙ্গে আনতে ভোলেননি পুতুলের সরঞ্জাম। আমাকে একটা সুন্দর কন্যাশ্রী পুতুল উপহার দিয়েছিলেন। আর কথা বলতে বলতেই তৈরি করছিলেন পুতুল।

নিশারানি একাই এই পুতুল তৈরি করেন। অন্যদের মতো তাঁর কোনো দল নেই। আর এই পুতুলগুলো একেবারেই সবটাই কাপড় দিয়ে তৈরি। এখানে কোনো মাটির মুখ বা কাঠের কাঠামো তিনি ব্যবহার করেন না। তাঁর পুতুল দেখলেই আলাদাভাবে চেনা যায়।

Facebook Comments

পছন্দের বই