লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

শীর্ষা মণ্ডল

অথ যাত্রাকথা


আমাদের সুরেলা কান্নার শব্দ শুষে নেয় কুকুরের গলা– দিন মরে যাওয়ার প্রলাপে এপাড়া-ওপাড়া জুড়ে বাজতে থাকে নিকষ শোকের বীণ, সমস্ত অন্ধকারের স্তন জুড়ে ফুটে ওঠে বেদনার বৃন্তকুসুম— এরকম অপরূপ সমাধিস্থলে জেগে থাকা চোখ গুনতে থাকে অগুনতি প্রহরের ছায়া; আর বেদনার্ত শিউলির ফ্যাকাশে শরীর মাতৃচ্যুত হয়ে রজনীদাইয়ের কোলে নির্বাক শ্মশানযাত্রা করে। এরূপ অনুপম যাত্রার পথে পড়ে থাকা খইয়ের মতো আমাদের সফেদ সুরেলা কান্নার শব্দ শুষে নেয় কুকুরের গলা। শুষে নেয় যুধিষ্ঠিরের একাকিত্ব শুঁকতে থাকা লেজ।


একটি বসন্তকে ছেড়ে দ্বিতীয় বসন্তের দিকে যাত্রা— অনেকটা যুধিষ্ঠির আর অনুগামী সারমেয়র যাত্রার মতোই। ক্ষীণ মৌন দৃষ্টি, ধীর পদক্ষেপ— একটি লোক থেকে দ্বিতীয় লোকে। একটি ইন্দ্রিয় থেকে দ্বিতীয় ইন্দ্রিয়ের দিকে। এমনই যাত্রা অনন্তের স্রোতে— আমরা চলেছি। হাঁটছি। পথ আর অনন্তকে সমার্থক করে তুলছি। মাতৃপক্ষীকুল ফিরে আসছে গার্হস্থ্যে। সুতো বুনে বুনে আরও নিবিড় করে তুলছে গার্হস্থ্যের রং। একটি বসন্তকে ছেড়ে দ্বিতীয় বসন্তের দিকে চলমান মানুষ সেই শিল্পীসত্তার নাগাল পেতে অসমর্থ— যাবতীয় প্রাণীজাতির প্রতি অক্লান্ত আক্ষেপ-দৃষ্টি মানুষকে নিরাসক্ত করে তুলছে। কিংবা আসক্তি অব্দি পৌঁছোতে না পারার যন্ত্রণাকাতরতা। নির্লিপ্ত যন্ত্রণা। যেহেতু যন্ত্রণার কোনো গন্ধ নেই। যন্ত্রণা নিজেই একটি শমীবৃক্ষ। জল বা সার ছাড়াই যে নিজেকে চড়চড় করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আকাশ ছোঁয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেখে। স্বর্গের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মাতৃপক্ষীকুল তার গায়ে উপেক্ষা মাখিয়ে চলে যায়। ফুল ফোটে। ফুলের ছায়া পর্যন্ত যন্ত্রণা পৌঁছে যায়। যন্ত্রণাফুল অনেকটা রংহীন, গন্ধহীন মনে হয়। আপাত মনে হওয়া। আদতে যন্ত্রণাগাছের জাইলেম-ফ্লোয়েম দিয়ে নুন-জল নয়, বসন্ত যাত্রা করে। একটি বসন্তের খোলস যন্ত্রণাগাছের পায়ের কাছে মরে পরে থাকে। যুধিষ্ঠিরের পার্থিব ত্যাগ করা কুকুরের হিসি লেগে থাকে সেই মরা বসন্তের শরীরে। দ্বিতীয় বসন্তটি তখন ঘাড় গুঁজে ওঠানামা করছে। আড়াল হচ্ছে সেই অসীম যাত্রার নিঃশব্দ বাঁশিটি। একটি স্বর্গীয়ফুলের দিকে যাত্রা করছে যুধিষ্ঠির আর তার সারমেয়। একটি অনন্ত লোভের দিকে যাত্রা করছে যুধিষ্ঠির আর তার সারমেয়। একটি অনন্ত যাত্রার দিকে যাত্রাপালা করছে জগতের সমস্ত যুধিষ্ঠির আর তাদের অস্থির সারমেয়দল।


যে-যাত্রার কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা দ্ব্যর্থক হতে পারত। কিংবা বহু-অর্থক? পাঠক নিজেই তার সাব্যস্তকারী। লেখকের দোয়াতে ব্যাখ্যার লাশ নির্বাক। লেখকের আস্ত কলমটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে তাঁরই হৃৎপিণ্ড। রক্ত পাম্প করার যে-প্রত্যাশিত যন্ত্রটি লেখকের প্রতি শিরায় প্রতি কোশে জীবন পৌঁছে দিচ্ছে মিলিসেকেন্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, সেই যন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা পড়ে থাকে সাদা পাতায়— একটি বিকল জাহাজ যেন একবুক অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডেকে দাঁড়িয়ে লেখক। কিংবা রবিনহুড। হাতে দূরবিন। মগজে বাঁচার নিরুত্তাপ চিন্তা তার হাত-পা-লেজ কুকুরের মতো গুটিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অলস। জাহাজের চারিপাশে শুধুই নৌকা। লাইফবোট নয়, নিছক কাগজের সাদা সাদা নৌকা। যেন এক-একটি শ্বেতশুভ্র রাজহংস। সরস্বতীর কাপড় ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে দেশান্তরে। ডেকের রবিনহুড স্থিরনেত্রে দেখছে কীভাবে অজস্র সাদা রাজহাঁস দেশান্তরে চলেছে। কীভাবে তারা যাবতীয় রঙের পালক খসিয়ে ফেলে কষ্টের বজরা বানিয়ে নিজেদের ছুড়ে দিচ্ছে আকাশে। একে একে। দূরে পাহাড়ের মাথায় স্তব্ধ কুটির। কালিদাস একমনে যক্ষ রচনা করে চলেছে। মৃন্ময় যক্ষ। সারি দিয়ে দাঁড়ানো। তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ভাঁজ হওয়া সাদা মেঘের দল। ওরফে রাজহংস। ওরফে কাগজের নৌকো। রবিনহুডের দূরবিনের কাচ ঝাপসা হয়ে উঠছে জমাট বাঁধা উপেক্ষার ধোঁয়ায়। এরকম অবস্থায় সিগারেট ছাড়া রবিনহুডের আর কোনো সঙ্গী থাকার কথা না। এরকম অবস্থায় একটি যাত্রা কত-অর্থক হয়ে উঠতে পারে? রবিনহুড তা জানতে চায় না।


জানা এবং অজানার মধ্যবর্তী যে-রাস্তা, তার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকো তুমি। তোমার চোখ রবিনহুডের। পা-দুটো যুধিষ্ঠিরের। আর তোমার লেজ, যেটা আমি ছাড়া আর কেউ কখনো দেখতে পায়নি, তা সারমেয়র। একটি অজানার প্রতি নির্মিত অদৃশ্য সিঁড়ির দিকে উদাস তোমার চোখ। যাকে পড়তে চেয়ে রবিনহুড দূরবীন কিনে ফেলেছিল তার হৃৎপিণ্ড বন্ধক রেখে। তোমার যুধিষ্ঠির পা-দু-টি ঘুঙুরহীন— যে-অমৃতশব্দের ভারকে তুমি বিক্রি করেছ বসন্তরোগ চিকিৎসকের ক্যাম্বিসব্যাগের কাছে। অতঃপর তুমি একটি ভারহীন প্রাণী। সারমেয়র মতোই। জানা থেকে অজানার দিকে ধাবিত হওয়ার পথে তুমি ভারশূন্য। তোমার সারমেয় ভারশূন্য। বসন্তঋতুর বাতাসের মতো দায়হীন। আর সেই ভারশূন্যতার যাত্রাপথে দ্বিতীয় একটি তীব্র গতিসম্পন্ন হৃৎপিণ্ড কিংবা বসন্তকালীন নিঃসঙ্গতা তোমার গতিরোধ করছে। তোমার যুধিষ্ঠির পায়ের ছাপ নিঃসঙ্গতার শরীরে ধাক্কা লেগে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘনিষ্ঠ সারমেয়র ডাক তোমাকে গন্তব্যের ফুল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছে না। পথ দেখাতে পারছে না। একটি নিঃসঙ্গতার ভেতরে যে-স্থিতিশক্তির ভাণ্ডার, তা তোমার গতিজাড্যকে চূড়ান্ত হারিয়ে দিচ্ছে। তুমি হতাশার সিঁড়িতে ধপ্‌ করে বসে পড়ছ। তোমার সারমেয় তোমার পায়ের কাছে লেজ গুটিয়ে। তোমার এই পরাজয়ের আনন্দ, রবিনহুডের পরাজয়ের আনন্দ থালায় সাজিয়ে এগিয়ে আসছে দ্বিতীয় সেই জেদি বসন্তঋতুটি। রোগের পুষ্পবৃষ্টি দিয়ে তোমার বরণ হচ্ছে সুমধুর। হে প্রেমিকা, হে জগতের সমস্ত দুর্বার পতঙ্গপ্রেমিকার দল— একটি যাত্রা কি শুধুই নিছক একটি যাত্রা হতে পারে না?

Facebook Comments

পছন্দের বই