লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

অলোকপর্ণা

রাজু ও নোনতা লোক

লোকটাকে ঠিক বাবার মতো দেখতে। রাজু লক্ষ করে দেখেছে। রোজ সকালে নোনতা মুখে রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে চলে যায়। অর্থাৎ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে লোকটার চলে যাওয়া দেখে রাজু প্রতিদিন। লোকটা যায়, কিন্তু ফেরে না। রাজু তার ফিরে আসা দেখেনি কোনোদিন। রাজু জানে লোকটাকে চলে যেতে কেমন দেখতে লাগে, লোকটার ফিরে আসা কেমন— রাজু জানে না। রাজুর বাড়ির সামনের দিয়ে রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটা সকাল সকাল শুধু চলেই যায়, ফেরে না।

কোথায় যায়? নিশ্চয়ই কাজে। কীসে যায়? ট্রেনে নিশ্চয়। স্টেশন তো বাঁ-দিকেই। যে-সময় লোকটা নোনতা মুখে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে যায়, সে-সময় স্টেশনে গেলে আপ বনগাঁ লোকাল আর ডাউন শিয়ালদা লোকাল বারো বগি আসে পরপর। লোকটা হয়তো শিয়ালদা যায়। লোকটা হয়তো বনগাঁ যায়। রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটা রোজ সকালে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে দ্রুত হেঁটে যায়।

লোকটার চারটে জামা, সবক-টা হলদেটে। লোকটার দুটো ফুল প্যান্ট, একটা খয়েরি, একটা ধূসর। লোকটার খয়েরি চামড়ার জুতোজোড়া মাসে দু-বার পালিশ হয়। হাতের রুপোলি চেনের ঘড়ি লোকটার পিঠে থেকে থেকে চাবুক মারে। লোকটার চুল ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে পাট করে রাখা। রোজ সকালে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে স্টেশনে যাওয়ার সময় রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটাকে কেউ বলে না, যে-হলদে রং তার গায়ে বেমানান।

রাজু লোকটাকে দেখে এসে কলতলায় মুখ ধুয়ে ফেলে। তারপর মাঝে মাঝে মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে দেওয়ালে নোনতা লোকটার মতো দেখতে রাজুর বাবার ছবি ১৯৮৫ সালের ১৩ই ডিসেম্বর থেকে ঝুলছে। নোনতা লোকটার মতো দেখতে রাজুর বাবা কোথাও যায় না, না ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে, না বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে, শুধু ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। নোনতা মুখে।

¬¬তার পাশেই ইদানীং মায়ের ছবিটা, যা রাজু লক্ষ করে না। মায়ের বেশি বয়সের ছবির পাশে বাবার অল্প বয়সের ছবি বসবাস করতে করতে বাবাকে একসময় মায়ের ছোটোভাই বা যুবক বয়সে হারিয়ে যাওয়া ছেলের মতো দেখায়। হয়তো নকশাল আমলে পুলিশের গু খেয়ে মৃত। অথবা পথদুর্ঘটনায়। অর্থাৎ, পথদুর্ঘটনায়।

রাজুর আর মনে থাকে না, নোনতা লোকটার মতো দেখতে মানুষটা রাজুর বাবা। মায়ের ছোটো বয়সে হারানো ভাই বা ছেলের মতো, নোনতা লোকটার মতো দেখতে রাজুর বাবার ছবি রাজুদের দেওয়াল থেকে ঝুলে থাকে। রাজু ছবিদের ঝুলে থাকা দেখতে দেখতে সকালের চা খায়।

আর ভাবে, এখন নিশ্চয় লোকটা দমদম ক্যান্টনমেন্ট, অথবা বামুনগাছি।

অথবা বৃষ্টির কারণে ট্রেন লেট করায় ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মনে কান খাড়া করে রেল লাইন দেখছে।

লোকটার অপেক্ষা ভাবতে গিয়ে রাজু গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিভ আংশিক পুড়িয়ে ফেলে।

কোনোদিন সকালে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে যাওয়ার সময় লোকটা ব্রাশমুখে রাজুকে লক্ষ করে না। কোনো দিকে না তাকিয়ে স্টেশনের তরফে নোনতা মুখে ধেয়ে যায়। লোকটার মুখ সকাল সকাল নোনতা হয় কীভাবে? লোকটার বউ অভিযোগ করে না এই নিয়ে? কেন হররোজ লোকটা নোনতা মুখে ঘর থেকে বেরোয় আর ফিরে আসে না? রাজু নিজের মনেই গুম হয়ে থাকে। রাজু জানে না লোকটাকে হাসলে কেমন দেখায়। রাজু তবু জানে লোকটাকে হাসলে কেমন দেখায়।— বাবার মতো। এভাবেই রাজু জানে লোকটাকে কাঁদলে, রাগ করলে, কষ্ট পেলে কেমন দেখতে লাগে। তবু রাজু জানে না। রাজুর বেশি বেশি জানতে লোভ হয়।

একদিন সকালে রাজুর বাড়ির সামনের রাস্তায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আর ঠিক সেই সময়েই ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে হেঁটে যাচ্ছিল বাবার মতো দেখতে লোকটা। প্রবল বর্ষায় দুটো পথকুকুরের সাথে লোকটা তার নোনতা মাথা বাঁচাতে রাজুদের খোলা বারান্দায় আশ্রয় নিল।

রাজু বলল, “ভিতরে এসে বসতে পারেন,”

লোকটাকে ভেলকি দেখাবে বলে রাজু নিয়ে এল তার মায়ের ঘরে, যেখানে দেওয়াল থেকে মায়ের পাশাপাশি যুবক বাবার ছবি লেগে আছে। লোকটা চুপ করে বসল চেয়ারে। খয়েরি প্যান্টটা পরেছে সে আজ, তারই পিছনের পকেট থেকে আরও খয়েরি একটা রুমাল বের করে মাথা, কপাল, দুহাত থেকে জলকণা মুছে নিল। রাজু বলল, “চা খাবেন?”

“না না, দরকার নেই,”

“আমি খাব এখন, আপনার জন্যেও আনি,”

রাজু মন দিয়ে চা করে। বেশি বেশি চিনি দেয়। লোকটার হাতে সেই চা পৌঁছে দিয়ে দেওয়ালের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে এমনভাবে যাতে যে-কেউ ভদ্রতাবশত প্রশ্ন করে, “আপনার বাবা মা?”

“আপনার মা বাবা?”, নোনতা লোকটা জানতে চায়।

রাজুর চোখ চকচক করে ওঠে। নোনতা লোকটা এবার নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে, যখন সে বুঝবে তাকে হুবহু রাজুর বাবার মতো দেখতে। রাজু প্রতিক্ষা করে।

“আপনার মা বাবা?” লোকটা আবার সহজ প্রশ্ন করে, অবাক হয় না।

রাজু উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, আমার বাবা অহিভূষণ সরকার, মা উমা সরকার। বাবা কর বিভাগে কাজ করতেন। ১৯৮৫ সালের ১লা ডিসেম্বর তিন দিনের জ্বরে মারা যান।” বলে রাজু ফের নোনতা লোকটার অবাক হওয়ার অপেক্ষা করে। তবু লোকটা অহিভূষণ সরকারের সঙ্গে নিজের মুখের মিল খেয়াল করে না।

রাজু চুপ করে চায়ে চুমুক দেয়, প্রতি চুমুকে সে আশা করে লোকটা এইবার তার বাবার সাথে নিজের মুখের মিল টের পাবে। বাইরে বৃষ্টি উত্তরোত্তর বাড়ছে। রাজু জানে ছাদের ফাটা জায়গাগুলো দিয়ে জল পড়া আরম্ভ হবে এবার।

এই সুযোগ, অহিভূষণ সরকারের ছবির সামনে লোকটাকে বসিয়ে রেখে রাজু উঠে দাঁড়ায়, “আপনি বসুন, আমি বালতি নিয়ে আসি।”

দু-হাতে দুটো বালতি আর একটা মগ নিয়ে ফিরে সে দেখে লোকটা এখনও চুপচাপ চা খেয়ে চলেছে।

ঘরের তিনটে জায়গায় নিপুণ লক্ষ্যভেদে দুটো বালতি ও একটা মগ রেখে দিয়ে রাজু চেয়ারে এসে বসে। কাছ থেকে লোকটাকে দেখতে সহজ লাগছে রাজুর। হলদে জামা খয়েরি প্যান্ট। হাতের রুপোলি ঘড়ি। লোকটার নখগুলো দেখে রাজু। কেজো নখ। না ধূর্ত, না ভোঁতা। রাজু আরাম পায়। এতদিনে কাছ থেকে লোকটার আগাপাশতলা সে দেখতে পাচ্ছে। আরামে রাজুর আনন্দ হয়, সে বলেই ফেলে, “আপনার সাথে কিন্তু আমার বাবার মুখের খুব মিল,”

লোকটা অন্যমনস্ক ছিল, ফিরে এসে অবাক চোখে বলল, “তাই?”

রাজু বুঝল লোকটা অবাক হওয়ার ভাণ করছে, আসলে অবাক হয়নি। লোকটা এখন রাজুর বাবাকে মন দিয়ে দেখার ভাণ করছে। লোকটা এখন নিজেদের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়ার ভাণে মাথা নাড়ছে। বালতি আর মগে জল পড়ার টপ টপ আওয়াজ শুরু হল।

লোকটার মুখ এখন আর নোনতা নয়, মিঠে লাগছে রাজুর। চিনির প্রলেপ দেওয়া। মেকি। উগ্র গন্ধ পারফিউম যেমন ফুলের গন্ধের ভাণ করে, লোকটা তেমন অবাক হওয়ার ভাণ করে রাজুর সকালটা একটু একটু করে চালাক করে দিচ্ছে।

একটা চালাক বৃষ্টির সকালে অবাক হতে চাওয়া একটা লোকের সামনে বসে আছে রাজু, হাতে চায়ের কাপ। চা খাওয়া শেষ, দূরে বালতিতে ছাদ ফেটে বৃষ্টির জল জমা হওয়ার শব্দ। দেওয়ালে রাজুর সদ্যপ্রয়াত মা, এবং অহিভূষণ সরকার।

এর মধ্যেই লোকটা চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়াল। ভাণ করল রান্নাঘর খোঁজার, বলল, “কোথায় রাখব,”

“আমাকে দিন” বলে রাজু হাত বাড়ালো আর লোকটার চামড়া ছুঁয়ে দিল তার হাত।

রাজুর চোখে মুখে চড় চড় করে একটা বাজ পড়ল। রাজু টের পেল— লোকটারও তাই।

রাজু দাবার ঘুটির মতো হিসেবি পায়ে রান্নঘরে এসে চায়ের দুটো কাপ পাশাপাশি নামিয়ে রেখে আবার অংকের মতো হিসেব করে করে মায়ের ঘরে ফিরে এসে দেখল লোকটা এখনও বজ্রাহত স্থির দাঁড়িয়ে আছে।

রাজু যেভাবে তাকে রেখে গেছিল, সেভাবেই।

কাছাকাছি ফের বাজ পড়ল কোথাও।

রাজুর ঠোঁটের ভিতর লোকটার নোনতা ঠোঁট মিশে যাচ্ছে। রাজুর পেশিতে পেশিতে লোকটার বাজ পড়ছে। বালতিতে টপ টপ করে রাজুরা জমা হচ্ছে। অহিভূষণ সরকার এবং উমা সরকারের ছবির সামনে নোনতা লোকটা রাজুকে গিলে ফেলছে টপাটপ। রাজু জোর টান মেরে লোকটার হলদে শার্ট চড়চড় করে ছিঁড়ে ফেলল।

বোতামেরা মাটিতে কিছুক্ষণ লুটোপুটি খায়। দূরে জল পড়ার টপ টপ শব্দ হতে থাকে।

রাজুর দুনিয়া নোনতা হয়ে যায়।

লোকটাকে খানিকটা বাবার মতো দেখতে, হুবহু নয়। রাজু বোঝে এখন। রোজ সকালে নোনতা মুখে রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে এখনও চলে যায়। দাঁত ব্রাশ করতে করতে লোকটার চলে যাওয়া দেখে রাজু প্রতিদিন।

কোথায় যায়? নিশ্চয়ই কাজে। কীসে যায়? ট্রেনে নিশ্চয়। স্টেশন তো বুকের বাঁ-দিকেই। যে-সময় লোকটা নোনতা মুখে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে যায়, সে সময় স্টেশনে গেলে আপ রাজু লোকাল আর ডাউন রাজু সরকার লোকাল বারো বগি আসে পরপর। লোকটা হয়তো রাজুতে যায়। লোকটা হয়তো রাজুতে আসে। রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে নোনতা লোকটা একবারও রাজুর দিকে ফিরে তাকায় না।

লোকটা এখন তিনটে হলদে জামা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে। লোকটার দুটো ফুল প্যান্ট, একটা ধূসর, একটা খয়েরি— যাতে সেদিন রাজু লেগে গেছিল। রোজ সকালে, ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে চোয়াল শক্ত করে স্টেশনে যাওয়ার সময় রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটাকে কেউ বলে না, রাজু তাকে হাঁ করে দেখছে।

লোকটা যায়, কিন্তু ফেরে না। রাজু তার ফিরে আসা কোনোদিন দেখেনি। রাজু জানে লোকটাকে চলে যেতে কেমন দেখতে লাগে, লোকটার ফিরে আসা কেমন দেখায় তা রাজু জানে না।

সেই যে একদিন এসেছিল, তারপর রাজুর জীবন থেকে দূরে, আরও দূরে রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটা সকাল সকাল শুধু চলেই যায়, রাজুর কাছে কোনোদিন ফিরে আসে না। আসবে না।

রাস্তায় আকাশ ভেঙে পড়লেও না। কাছে-দূরে কোথাও বাজ পড়লেও না। রাজু রাজুতে মিশে থাকে। এখনও নোনতা হয়ে থাকে।

মুখ ভরা পেস্টও নোনতা হয়ে যায়। মুখ ধুয়ে ফেলতে ফেলতে রাজু ভাবে– “আজকাল সবাই টুথপেস্টে নুন দিচ্ছে নাকি রে বাবা”

Facebook Comments

পছন্দের বই