লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

সরিতা আহমেদ

আশ্রয়

অফিসে ঢোকার মুখেই মেয়েটাকে চোখে পড়ল ইন্সপেক্টর মাইতির। কব্জি উলটে দেখলেন— দুপুর আড়াইটা। থানা থেকে এগারোটায় বেরোনোর সময়ই মেয়েটিকে ওভাবেই বসে থাকতে দেখেছিলেন। এত বেলা হল, এখনও সে ওই বেঞ্চটায় ঠাঁই বসে আছে! ওড়নার খুঁট আঙুলে পেঁচিয়ে ইতিউতি ঠান্ডা চোখে তাকাচ্ছে, যেন তাড়া নেই কোনো। এক ঝলক দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি অভুক্ত, কিন্তু চোখদুটোর আগুন যেন নেভেনি এখনও।

কনস্টেবল বড়ুয়ার কাছে জানা গেল, মেয়েটি ‘সারেন্ডার’ করতে এসেছে।

সারেন্ডার!

— কী কেস?

“স্যার, কেসটাই তো ভালো বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটা একটা মোবাইল জমা দিয়েছে ঐ টেবিলে। বলছে, সব নাকি মোবাইলে বলা আছে।”

— ইন্টারেস্টিং। আর কিছু বলেনি?

“না… মানে হ্যাঁ, ওই তো বলছে সারেন্ডার করতে এসেছে। আসলে সকাল থেকে আপনারাও ছিলেন না। বড়োবাবুও গেছেন মিটিঙে। আমি আগের কেসটা নিয়ে একটু ব্যস্ত… মানে, সেই জন্যই… তবে আমি বলেছিলাম, ‘মোবাইলটা রেখে যা। স্যার এলে ওনাকে দিয়ে দেব।’ কিন্তু ও বলছে এখানেই বসে থাকবে যতক্ষণ না ঐ রেকর্ডিং শোনা হচ্ছে। বুঝুন, কোনো মানে হয় স্যার!”

— হুম্‌, বুঝলাম। ঠিক আছে আমি মোবাইলটা দেখছি। ততক্ষণ মেয়েটিকে কিছু খেতে দিন। নিজে থেকে মুখ না খুললে বেশি জোড়াজুড়ি করা ঠিক হবে না। আগে দেখি রেকর্ডিংটা কী, তারপর বাকি ব্যবস্থা হবে।

“আমি প্রতিমা মাঝি। এবারে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছি। আমি সারেন্ডার করতে চাই, কারণ, কাকাদের বাড়ির সবার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছি। চমকে গেলেন! সব বলছি। আচ্ছা, সরকার থেকে নাকি কয়েদি পড়ুয়াদের সাহায্য করে। সত্যি? আমার কেসটা একটু দেখবেন, স্যার।

হাতিপোতা গ্রামে আমার বাবা ‘একশো দিন’ শ্রমিক ছিল, আর মা দু-বাড়ি রান্নার কাজ করত। আমিও মাঝে মাঝে খেটে দিতাম। দাদা নাইনে উঠে স্কুল ছেড়ে বাবার সঙ্গে কাজে যোগ দেয়। অভাব থাকলেও বাবা কোনোদিন চায়নি আমাদের স্কুলছুট করতে। তাই দাদা ড্রপ আউট হতেই আমাকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন দ্বিগুণ বেড়ে গেছিল। বলত, “বেটি, বড়ো হয়ে তুই অফিসার হবি, কেমন!” দিব্যি চলছিল টানাটানির সংসার। কে জানে কবে মা ধীরে ধীরে বদলে গেল। আমার সোজাসিধা মা যে কিনা স্বামী আর সংসার ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝত না, সে-ই পালিয়ে গেল আমাদের ফেলে। দু-বছর হয়ে গেল আজ অবধি মাকে দেখিনি। জানেন স্যার, মাধ্যমিকে আমি খুব খারাপ নাম্বার পাইনি। স্কুলে সবাই বলেছিল সায়েন্স নিতে, কিন্তু বাড়ির ওইরকম বিচ্ছিরি পরিবেশে সায়েন্সের কথাটা বলতেই পারলাম না। মা চলে যাওয়ার পরে আমার হাসিখুশি বাবাটা কেমন যেন হয়ে গেল। সকালেই উঠেই কাজে যাওয়া আর কাজ থেকে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়া— এর বাইরে আমরা কেমন আছি, আদৌ আছি কিনা সে-সব দিকে তাকাবার যেন সময়ই পেত না মানুষটা।

জানেন, দাদাকে ধমকানোর সাহস শুধু মায়ের ছিল। মা চলে যেতেই দাদাটাও যেন লাগামহীন ঘোড়ার মতো পাগলা হয়ে গেল। কাজেও কামাই করতে লাগল। রাতদিন অন্য পাড়ার নানারকম লোকেদের সাথে কী কী সব বাজে আড্ডায় মেতে থাকত। দিন যত যাচ্ছিল নানারকম গুন্ডা টাইপের লোকের সঙ্গে ওর মেলামেশাও বাড়ছিল। রাতের পর রাত বাড়ি ফিরত না। জিজ্ঞেস করলে বলত, “কাজে গেছিলাম। তুই বুঝবি না।”

আমি কিন্তু একটু একটু বুঝতে পারছিলাম যে, দাদা কোনো খারাপ দলে ভিড়ে গেছে। একদিন ঠিক আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসবে দাদার খোঁজে। বাবা কিন্তু কিছুতেই মানতে চাইত না এ-সব। এইসবের মধ্যেই একদিন “বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি”, বলে দাদা সত্যিই বেপাত্তা হয়ে গেল।

এ-বছরের গোড়ায় বাবার একটা ছোটো অ্যাক্সিডেন্ট হল। পায়ের ঘাটা এমন বিষিয়ে গেছিল যে, টানা দু-মাস কাজে যেতে পারেনি। মার্চের মাঝামাঝিতে কে যেন খবর দিল নয়া ‘মজদুর-লিস্ট’ বেরিয়েছে যাতে বাবার নাম নেই। কোথায়, কার কাছে দরবার করলে সমাধান হবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লকডাউন শুরু হয়ে গেল। এমনিতেই মায়ের আর দাদার শোকে পাগলাটে হয়ে গেছিল বাবা, লকডাউনে টানা তিন মাস রাতদিন ঘরে থাকতে থাকতে উন্মাদ হয়ে উঠল যেন। ওষুধপত্র আর সংসার খরচে জমানো টাকাও দ্রুত ফুরাচ্ছিল! মাঝে মাঝে কাঁদতে কাঁদতে এমন ছটফট করত যে, আমি সামলাতে পারতাম না। এরকমই একদিন সকালে উঠে দেখি, উঠানের বাঁশে ফাঁস লাগিয়েছে বাবা।

হাসপাতালে যে নিয়ে যাব, তার সময়টুকুও দিল না।

করোনাকালে লোকে আত্মহত্যা করলেও নাকি লাশের দায়িত্ব কেউ নেয় না। পুলিশ এল, ঘর তোলপাড় করে ছানবিন করল, তারপর ‘সুইসাইড’ লিখে কেস বন্ধ করে দিল। কিন্তু আমার কী হবে— তার উত্তর কেউ দিল না। জানি, বাবা সারাজীবন অশান্তি সয়েছে। মরেই হয়তো শান্তি পেতে চেয়েছিল। সেটুকুও কি জুটবে না! তাই যে কাকা আমাদের কোনোদিনই পাশে দাঁড়ায়নি— তাদেরই হাতে পায়ে ধরতে বাধ্য হলাম। দাদাকে মৃত বাবার খবরটুকুও দেওয়া হল না। সবাই বলল, ফাঁকা বাড়িতে একলা থাকা ঠিক না— তাই ‘বাবার কাজ’ মেটার পরে কাকার বাড়িতেই উঠতে হল। খাওয়া থাকার বদলে ঘরের সব কাজই করতাম। ওপর ওপর সব ঠিক থাকলেও, ওদের কথাবার্তায় মনের খটকা দিন দিন বাড়ছিল।

জানেন স্যার, শত অভাবেও নিজেকে কোনোদিন এত অসহায় লাগেনি। কিন্তু বাবা নামের বটগাছটা মরে যেতেই বুঝলাম মাথার উপর থেকে বড়ো ছাতাটা এ-জন্মের মতো সরে গেছে। কাউকে ভরসা করতেই ভয় লাগে। ভয়টা সত্যি করতেই যেন ঝড়টা এল— ‘আমফান’। চোখের সামনে দেখলাম আমাদের বাড়িখানাকে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল দানবটা। ভেবেছিলাম সময় করে ট্র্যাঙ্ক থেকে নিজের পড়ার জিনিস, ব্যাঙ্কের বই সব গুছিয়ে আনব।

কিন্তু ভাগ্য! মায়ের রান্নাঘর যেখানে ছিল সেখানে এখন পাঁকভরতি ডোবা। ওদিকে রোজ মাইকে ঘোষণা হচ্ছে “আমরা থাকব ঘরে/করোনা পালাবে দূরে”। রাতারাতি ঘরহীন হওয়া লোকজন এ-সব শুনে হাসবে না, বলুন!

গত সাতদিন ধরে এক নয়া বিপদের আঁচ পাচ্ছি। ওদের বাড়িতে এক বুড়ো আসা-যাওয়া করছে। মেয়েদের দিকে লোকটার নজর একদম ভালো না। সেদিন লোকটার সঙ্গে কাকা বেজায় ঝামেলা করে এসে বেদম পিটিয়েছিল আমাকে। নেশার ঘোরে বলা কথায় বুঝেছিলাম, ওরা আমাকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে। কান্নাকাটি করতেই, কাকী বোঝাতে লাগল, “তুই একা নাকি। আরও কত মেয়ে যাচ্ছে। বড়ো শহর, বড়ো কাজ। অল্প খাটনি, অনেক টাকা। লাইফ একেবারে সেট!”

অনেক চেষ্টাতেও যখন আমি রাজি হলাম না, তখন কাকী আর দিদি মিলে খুব মারল, একদিন খেতে না দিয়ে ঘরে আটকে রাখল। বুঝলাম যে-করেই হোক পালাতে হবে আমায়। কিন্তু পালাতে গেলেও তো টাকা চাই। ব্যাঙ্কের বই আমফানে উড়িয়ে নিয়েছে, ‘শিক্ষাশ্রী’ আর ‘কন্যাশ্রী’-র টাকা তোলার কোনো উপায় দেখছি না। স্কুলও বন্ধ, টিচারদের কাছে সাহায্য নেব সেই সুযোগও নেই। এদিকে প্রমাণ ছাড়া তো থানায় আসাও মানা, সে আমি বাবার কেসের সময় খুব বুঝেছিলাম।

কাকাদের হাতে রোজ মারধর গালিগালাজ খেতে খেতে কীভাবে কাটিয়েছি সে আমিই জানি। তাই শেষমেষ আজ ওদের রাতের খাবারে কীটনাশক মিশিয়ে দিয়েছি। খুব অল্প মাত্রায়। বড়ো চাষি ওরা, ওটুকু বিষ জোগাড়ে কোনো অসুবিধা হয়নি। এখন সবাই খুব বমি করছে। বিষটা খুব ধীরে কাজ করে। ভোর হতে এখনও দেরি, তাই এই কথাগুলো গুছিয়ে রেকর্ড করলাম।

এবার ফোন করব হাসপাতালে। তারপর যাব থানায়। না স্যার, আমি ফেরার আসামি হব না। কারণ, আমি জানি, বাইরের দুনিয়ার থেকে এই মুহূর্তে জেলই আমার সবচেয়ে নিরাপদ ঠিকানা হতে পারে। ভাবছেন হয়তো, এলামই যদি তবে কেন আগে এলাম না থানায়? কী হত স্যার, বিনা প্রমাণে আপনারা বিশ্বাস করতেন আমায়?

দু-দিন আগেও ১০০ নাম্বারে ডায়াল করেছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম আমায় ওরা পাচার করে দিচ্ছে— কেউ পাত্তাই দেয়নি। তাই এবার ভাবলাম, বড়ো কিছু করে তবেই আসব আপনাদের কাছে।

জেলে শুনেছি খাওয়া-থাকা-কাজের পাশাপাশি লেখাপড়ারও সুযোগ মেলে। দেবেন আমাকেও লেখাপড়ার সুযোগ? আমার বড়োলোক হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। দাদার মতো ভুল পথে গেলে হাতে যা টাকা আসত তাতে দামি জীবন পেতে পারতাম, মায়ের মতো পালিয়ে গেলেও হয়তো পেতাম। কিন্তু আমি সারাজীবন সরল সিধা বাবার মতো হতে চেয়েছি। আমার সেই ভালো মানুষ বাবা, যে বলত আমাকে বড়ো হয়ে অফিসার হতে হবে। দেবেন আমায় বড়ো হতে?

সাব-ইন্সপেক্টর মিঃ ঘোষের সঙ্গে দু-জন কনস্টেবলকে সিটি হসপিটালে পাঠিয়ে দিয়ে এবং অডিয়ো ফাইলটার দুটো কপি করতে বলে মাইতিবাবু প্রতিমার কাছে গেলেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এত অল্পবয়সি মেয়ে এমন মরিয়া হয়ে রীতিমতো পরিকল্পনা করে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে! কেসটা ভালো করে স্টাডি করতে হবে।

— খেয়েছ কিছু?

শান্ত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রতিমা মাথা হেলালো। তারপর বলল, “আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন না তো?”

— বলছি, তার আগে বলো এই ফোনটি কার?

‘কাকীমার’ বলেই হাতজোড় করে তাড়াতাড়ি বলে উঠল “ওদের কিছু হবে না স্যার। ওরা হাসপাতালে আছে। বেঁচে যাবে। কিন্তু দয়া করে ওদের কাছে ফিরে যেতে বলবেন না স্যার।”

— তুমি জানো, যা কিছু তুমি বলেছ তা যদি সত্যি হয় তবে বেশ কঠিন সাজা হবে তোমার।

ইন্সপেক্টর মাইতিকে অবাক করে দিয়ে প্রতিমা বলল, “জানি। সাজা না হলে জেলে থাকব কী করে?”

— তুমি জেলে থাকতে এত আগ্রহী! স্ট্রেঞ্জ! তোমার একটুও ভয় করছে না?

শান্ত দৃষ্টিতে প্রতিমা কিছুক্ষণ ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর পায়ের আঙুলে আঙুল ঘষতে ঘষতে কেটে কেটে বলল, “ভয় করছিল বলেই তো আপনার কাছে এসেছি।”

আর্কাইভে যেতে যেতে আর একবার প্রতিমার দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর মাইতি। শেষ বিকেলের অদ্ভুত এক জেদি আলো শ্যামলা মুখটায় পড়েছে। আর্কাইভে ঢুকতে ঢুকতে বার বার তাঁর মনে হচ্ছিল এটা বোধহয় দামোদর মাঝির কেসের লিঙ্ক। দ্রুত হাতে ফাইলের স্তূপ ঘাঁটতে লাগলেন তিনি। এই অঞ্চলে এমন কিছু কাজের চাপ থাকে না। দু-একটা চুরি কিংবা মোলেস্টেশনের কেস আসে অবশ্য। কাঙ্ক্ষিত ফাইলটি খুঁজে পেতে খুব বেশি দেরি হল না তাঁর। মাত্র দেড় মাস আগের সুইসাইডের ঘটনা। মেয়েটির বয়ানের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। সুইসাইড নোটের খোঁজে খানাতল্লাশি চালিয়ে সেরকম কিছুই মেলেনি তাঁদের, তবে মাইতি বাবুর হাতে এসেছিল একটা পাতলা নোটবুক। ফাইলের মধ্যে সেটিও আছে। এতদিন খুলে দেখার দরকার পড়েনি, তবে আজ দেখলেন। এটি প্রতিমা মাঝির কবিতার খাতা।

পড়তে পড়তে তিনি বুঝলেন এতে প্রতিমা শুধু কবিতা নয়, স্বপ্নেরও চাষ করেছে। অপটু কাঁচা হাতে লেখা ছন্দহীন লাইনগুলোর পরতে পরতে ভাষার জড়তা স্পষ্ট। তবে তাতে বক্তব্যের আড়ষ্টতা নেই। ভাঙা টালির ফুটো দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদকে হয়তো দশ টাকার কয়েনের মতোই লাগে, তবে তাতে জোছনার বন্যা আটকানো যায় না। এ যেন তেমনই।

ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বহু বছর আগে ফেলে আসা এমনই কিছু স্মৃতি হুড়মুড় করে মাইতিবাবুর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল।

সেই স্মৃতিতে আছে, জলপাইগুড়ির এক মলিন বোকাসোকা যুবকের ছবি— নিজের বাড়ি থেকে যাকে অন্যায়ভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ভিন জাতে বিয়ে করার দোষে। আর আর এক বাড়ি থেকে কেস দেওয়া হয়েছিল তাদের নাবালিকা মেয়েকে ফুসলিয়ে পালিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

স্ত্রীর সঙ্গে আলাদা হয়ে একা জেলের কুঠুরিতে বসে বসে ছেলেটি কেবল নিজের দোষ খুঁজত।

“মিনতিকে একবার দেখতে দেবেন না, স্যার?”— প্রথম দিকে এর উত্তরে “ও বাড়ি চলে গেছে” বলে কাটিয়ে দিলেও, দিনের পর দিন একই প্রশ্নে বিরক্ত জেলার তাকে বেধড়ক মারধর করত। তবু প্রশ্ন করা থামাত না সে। আদালত চত্বরে একশো পুলিশের ঠেলাঠেলি সত্ত্বেও মিনতি তার হাত জড়িয়ে কেঁদে উঠেছিল— “আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না গো। আর পেটেরটাও যে রাক্ষুসে খিদে নিয়ে আছড়িপিছড়ি করছে। তুমি না থাকলে…” ওই শেষবারের মতো দেখেছিল পানপাতার মতো মুখের ছোটোখাটো মেয়েটিকে। যাকে বড়ো ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সে।

আর সেই ভালোবাসার দিব্যি কেটেই যুবকটি বিশ্বাস করত মিনতিরা তাঁর জন্য কোথাও-না-কোথাও নিশ্চয় আছে। তাই হয়তো প্রতিবার মার খাওয়ার পরে সে চিৎকার করে উঠত, “আমি কি বিনা দোষেই সাজা কাটব, স্যার! একটা সুযোগ দিন। নইলে জেল ভেঙে পালিয়ে যাব ঠিক। মিনতিকে একটিবার দেখে আসি, পাকাপাকি একটা দোষ না হয় করেই আসি।”

বিড়বিড় করতে করতে কতবার সে জেল পালিয়ে মিনতির জানলায় দাঁড়াত, কতবার সে ভাবত জেলই যখন হল তখন বিনা দোষে কেন হল! কতবার যে তার আঘাতের গায়ে আলো ছড়িয়ে চাঁদ ডুবে যেত কালো রাতের বুকে। তবু প্রশ্ন করা থামাত না সে। যাকে সামনে পেত একই কথা বার বার বলত, “বলো না গো, আঠারো বছর পুরলেও কি মিনতি আমার হবে না? ও যে আমার বিয়ে করা বউ গো।” কেউ বলত প্রেমে পাগল হেয়ে গেছে ছোকরা, কেউ বলত আকাট বোকা, মূর্খ লোক। যে যা-ই বলুক, সে জীবনের শেষদিন অবধি এ-কথাই বিশ্বাস করেছিল হয়তো-বা তার অন্তহীন প্রশ্ন করার বোকামিটাই তাকে তপনবাবুর নজরে ফেলে দিয়েছিল।

আর সে-জন্যই কলকাতা শহরের হাজারটা কেসের ভিড়ে তার হেরে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, বাতিল হওয়া কেস আবারও দিনের আলো দেখল। বাকিটা ইতিহাস।

বউ-ছেলেকে ফিরে পেয়ে যেন পৃথিবী জিতে নিয়েছিল সে। ভেসে যাওয়ারই কথা ছিল তাদের। কিন্তু তপনবাবুর মতো সজ্জন ব্যারিস্টারের নেক নজরই তাদের মুঠোয় খড়কুটো জুটিয়ে দিল কোনো যাদুবলে মোটর গ্যারাজে কাজ পেল সে। মেকানিক-কাম-দারোয়ান। মালিকের কৃপায় গ্যারাজের কোনায় পাতা হল সংসার। যাতে সম্বল বলতে ছিল তাদের সততা, মুক্তির স্বপ্ন আর শান্তি বলতে ছিল একটা ডায়রি। ছেলেকে দিবারাত্র মুড়ে রাখা নিরাপদ কাঁথাটায় বাপের স্বপ্নের নকশাগুলোর খোঁজ, যদিও মিলেছিল বহু বছর বাদে। ততদিনে সেই জেলখাটা মোটর মেকানিকের ছেলে ইন্সপেক্টর হয়ে গেছে।

ইতিহাস কি এভাবেই বার বার ফিরে আসে, মানুষের সামনে আয়না হয়ে?

থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথেও প্রশ্নটা তাড়া করছিল মাইতিকে। আরও একজন কয়েদির পালভাঙা জীবনে কি আর একটা তপন সিনহা হাল ধরতে পারেন না!

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামল হঠাৎ। গাড়িটা একটু আগেই জ্যামে আটকে ছিল। আনলক ফেজ শুরু হতেই রাস্তায় ভিড় বেড়েছে। এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা প্রতিমা যেন হঠাৎ একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। পেছনের তারজালি আঁটা শার্সিতে মুখ চেপে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে কি! ইন্সপেক্টর মাইতি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকালেন। গাড়ি তখন শম্বুক গতিতে পার হচ্ছে ‘নেতাজী বালিকা বিদ্যামন্দির’। ছ-মাস ধরে সব স্কুল বন্ধ। গেটের ভেতর থেকে এক বিরাট ছাতিমগাছের মাথা বেরিয়ে আছে। রাস্তা থেকে স্কুলের সামনেটায় ধুলো আর আগাছা ভরে গেছে। তারই মধ্যে শান্ত পাহাড়ের মতো নির্লিপ্ত ঔদাসীন্য নিয়ে স্কুলবাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে দেখার মতো কিছুই নেই। তবু সেটা থেকে প্রতিমার পলক পড়ছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অপলক দেখেছে সে।

— “কী রে, এটা তোর স্কুল?”

প্রশ্নটা বোধহয় শুনতে পেল না প্রতিমা। নাকি অস্ফুটে বলল কিছু! মুখে চেপে বসে থাকা কালো মাস্কে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারলেন না মাইতিবাবু। কিন্তু ওর চোখের দিকে চেয়ে তিনি স্থাণু হয়ে গেলেন। প্রতিমার ডাগর দু-চোখে তখন যেন শুষে নিতে চাইছে বাইরের পৃথিবীর সবটুকু আলো, সবটুকু হাসি, সবুটুকু স্বপ্ন।

“একদিন এখানে ঠিক ফিরে আসব”— বাঙময় চোখের ভাষা পড়তে ভুল হল না ইন্সপেক্টর মাইতির।

এমন উজ্জ্বল চাহনির জেদি পরিন্দাকে আইনের খাঁচায় পুরে ডানা কেটে ফেলবে, পুলিশ ভ্যানের ক্ষুদ্র তারজালির এত সাধ্যি কোথায়! প্রতিমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে শক্ত চোয়ালে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি দেখতে লাগলেন তিনি।

Facebook Comments

পছন্দের বই