লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুবাদ

পিটার মার্কাস

বব অথবা নৌকায় থাকা লোকটা
[Bob, or Man on Boat]

ভাষান্তর: অত্রি ভট্টাচার্য

ভূমিকা: হেরাক্লিটাস-এর প্রবাদবাক্য: “কোনো মানুষই এক নদীতে দু-বার পা ডোবায় না”। এর লাজবাব প্রত্যুত্তরে পিটার মার্কাস এক বিপ্রতীপ কথন তুলে ধরেছেন; নদী সে একাই এবং একটিই, যে-মানুষ তাতে পা ডোবায় সে-ই নদী হয়ে যায়। শুধুমাত্র এক সহজ চোখে চেয়ে থাকাই নদী ও কর্দমাক্ততার গভীরের রহস্যকে খোলতাই করতে থাকে। এখানে, মার্কাসের এই নদীবিশ্বে সকল চরিত্রের নামই বব। এখানে মানুষ মাছ হয়ে যায়। মাছ হয়ে যায় মানুষ। যেখানে জাদুর সবুজ আলো কাদার ভিতরে। যেখানে স্বপ্নে ছেলেরা পোশাকের মতো গায়ে চাপিয়ে নেয় বাবার চামড়া। ‘বব, অর ম্যান অন বোট’ বইটির উৎসর্গপত্রে পিটার তাঁর নদীপথ চেনানো বাবা ও নক্ষত্রের গল্প শোনানো মায়ের কথা বলেছেন। দু-চার মিনিট গুগ্ল করলেই পিটার মার্কাস সম্পর্কে যৎসামান্য যা জানা যাবেই সেই দুর্গম পথ ধরে অনুসন্ধিৎসু বাঙালি পাঠক অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে পৌঁছে যাবেন বোধহয়। এই উপন্যাসের অংশবিশেষ এখানে অনুবাদ করা হয়েছে।

*
কখনো কখনো, রাতের বেলা যখন মাছেরা ছিপে কামড় দিতে দেরি করে, বব নদীর ওপর থেকে মুখ সরিয়ে আকাশের দিকে মুখ তোলে নক্ষত্র দেখবে বলে।

সেরকম রাতে, বব দেখে আকাশে ক-টা নক্ষত্র সে গুনতে পারে।

এক-একদিন রাতে বব দু-হাজার বাইশটা নক্ষত্র গুনে ফেলে।

সেই রাতগুলো মাছ ধরার জন্য খারাপ।

সেই রাতগুলো নক্ষত্র গোনার জন্য উপযুক্ত।

বেশিরভাগ রাতেই বব দশটা নক্ষত্র গোনার আগেই মাছেরা ছিপ কামড়ে ধরে।

মাছ ধরার জন্য উপযুক্ত একটি রাতে, যে-রাত নক্ষত্র গোনার জন্য অনুপযুক্ত, সেরকম রাতে বব নিজের নৌকা ভরে ফেলে আকাশে যত নক্ষত্র আছে তার থেকেও বেশি মাছে।

এই রাতগুলোতে, ববের নৌকা আর শুধুমাত্র একটা নৌকা থাকে না, হয়ে ওঠে মাছেদের নক্ষত্রসমাবেশ।

*
একবার বড়ো শহরে ঘুরতে গিয়ে আমি একটা লোককে রাস্তায় নিজের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলাম।

ওই একই শহরে একই রাস্তায় আমি আরও একজনকে গান গেয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম।

আমাকে ওই শহরের ওই সময়ের এক বাসিন্দা বলেছিল, এদের উভয়েরই মাথায় ছিট আছে।

ওই কথার উত্তরে, আমি বলেছিলাম, আমাদের মধ্যে কে আছে যে অমন নয়?

বেশিরভাগ লোক যাদের যাদের আমি এ-কথা বলেছিলাম, যখন এদের বলেছিলাম, তখন সবাই মাথা হ্যাঁ-এর দিকে ঝুঁকিয়েছিল।

বব অন্য কারোর থেকে বেশি ছিটগ্রস্ত নয়।

সোজাসাপ্টা কথা হল, বব জানে ওর কী ভালো লাগে।

আর বব তা-ই করে যা ওর সবথেকে বেশি পছন্দ
বব নিজের মনের কথা শোনে।

ববের মনটা একটি মাছের মতন।

*
এটা একটা আলাদাই ব্যাপার যে, বব একই নদীতে ওর পাশের মাছ ধরা জেলেটার থেকে বেশি মাছ ধরে।

বব নদীতে থুতু ফেলতে পছন্দ করে।

বব নদীতে মুততে পছন্দ করে।

সৌভাগ্যের জন্য।

*
সেই রাতে বিছানায় আমার বউ আবার ওই একই কথা বলে উঠল।

‘আমি নিশ্চয়ই একটা জেলেকে বিয়ে করিনি’

ও মুখ ঘুরিয়ে নিল ওর নিজের দিকে।

ওর পিঠে ঠেকে গেছে আমার পেট।

এভাবেই, ও গন্তব্যে পৌঁছায় আর নিভিয়ে দেয় আলো।

*
সেই রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম বব মাছ ধরছে।

সেই স্বপ্নের ভিতরে আমিও ববের সাথে মাছ ধরছিলাম।

আমি মাছ ধরছিলাম ববের নৌকাতে বসে।

বব আমাকে কীভাবে মাছ ধরতে হয় শেখাচ্ছিল।

সে আঙুল তুলে ইঙ্গিত দিচ্ছিল নদীর ভেতরে সেইসব জায়গার দিকে যেখানে ধরবার জন্য সবসময় একটার বেশি মাছ থাকে।

তারপর বব আমাকে বলল, হাতদুটো বাড়িয়ে দাও।

তাই আমার হাতদুটো আমি বাড়িয়ে দিলাম।

ও আমার হাত নিজের হাতে নিল।

ও দেখতে থাকল আমার হাতদুটো।

আমি বলতে পারি ও দেখছিল।

আমি ওর হাতের দিকে তাকালাম।

ওর হাত ছিল মাছের আঁশ আর ছাল।

ওর হাত ছিল মাছের পাখনা।

আমি নিজের হাতটা ববের থেকে ছিনিয়ে নিলাম

‘কি ব্যাপারটা কী?’

বব জিজ্ঞেস করল।

‘তুমি কি কখনো মাছের সঙ্গে হাত মেলাওনি নাকি?’

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।

ওটাই তোমার সমস্যা, বব আমায় বলল।

বব ঘুরল আর বলতে-না-বলতেই নিজের নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দিল।

নদীর ভিতরে।

সে সাঁতরে এগোচ্ছিল।

আর তখন আমি একা হয়ে গেলাম নদীতে ভাসতে থাকা ববের নৌকায়।

*
সকালে আমি নিজের নৌকা নিয়ে ববের নৌকার কাছে গেলাম।

বব সেখানে ছিল না।

আমি চারপাশে ববকে খুঁজলাম।

সকালে সাধারণত বব মাছের গা সাফ করে।

সূর্য উঠেছে নদীর ওপরে।

নদীর ওপরে একটু ধোঁয়াশা এনেছে সূর্যটা।

বব, নাম ধরে চেঁচালাম।

আমার কণ্ঠস্বর একটা পাথরের মতো নদীর ওপরে বেঁকে চলে গেল।

আমি মাছ-ধরা নৌকায় বসে থাকা একটা লোককে জিজ্ঞেস করলাম ববকে দেখেছে কিনা

সে মাথা নেড়ে না বলল।

আমি বাড়ি চলে এলাম।

বাড়ি এসে ফোনটা তুললাম।

আমার জানা ছিল না কী অথবা কাকে আমার ফোন করা উচিত। অথবা আমাকে কথাই যদি বলতে হয় তবে কী বলব।

বব কি তার নৌকাতে নেই?

বব কি আমার স্বপ্নে মাছ হয়ে গেছে?

*
ওই রাতে আমি ঘুমাতে ঘুমাতে সোফা থেকে পড়ে গেছিলাম।

আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না।

আমি চোখ বুজলাম আর মাথার ভিতরে সাঁতার কাটতে থাকা মাছগুলো গুনতে থাকলাম।

আকাশে যত নক্ষত্র তার থেকেও বেশি মাছ ছিল সেদিন আমার মাথায়।

সারারাত্তির ধরে আমি এই শব্দগুলোই শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম

আমি একটি মাছ

আমি একটি মাছ

আমি একটি মাছ

এটা ছাড়াও শুনতে পাচ্ছিলাম আমার ছেলের গলা, ‘বাবা আমি চাই না তুমি মাছ হয়ে যাও’

*
রাতের বেলা একদিন সেটা আমায় ধাক্কা মেরেছিল।

হয়তো আমার ছেলেই ঠিক বলেছে।

হয়তো আমি একটা মাছ।

ববের জন্য নির্দিষ্ট মাছ।

সেই মাছ যার জন্য বব এখন নদীতে মাছ ধরে চলেছে।

Facebook Comments

অনুবাদক: অত্রি ভট্টাচার্য

মূলত লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখিতে উৎসাহী। অন্যধারার প্রকাশনা সংস্থা ‘কোয়ার্ক পাবলিশার্স ‘-এর সঙ্গে যুক্ত। এছাড়াও সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বাংলা মুখপত্র ‘প্রতিরোধে আমার দেশ’-এর সম্পাদনা করে।

পছন্দের বই