লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৩

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


বিকেল মুছে দিয়ে সন্ধ্যের মায়া সবে ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে, মানে নগর কলকাতায় সন্ধ্যা যতটুকু আদল পায় হ্যালোজেন আলো চিরে, সেই ততটুকু মায়া যখন নাগরিক মানুষকেও আনমনা করে তুলছে, এমনকী দোকানে বসা রূপাকেও, তখনই নীল আলোর হঠাৎ ঝলকানি রূপার দোকানের সাঁঝমায়াকে তছনছ করে দিল! রূপা সচকিত হয়ে দেখে মেয়র পারিষদ আব্বাসের এসইউভি গাড়ি রাস্তার ভিড় সরিয়ে ছুটে চলে গেল পলকে। সাঁঝের মায়ায় আচ্ছন্ন রূপা সে-নীলে আরও আনমনা যেন।

আব্বাসউদ্দিন— মেটিয়াবুরুজের বেতাজ বাদশা! ডক অঞ্চলের ডন। মাফিয়া। তবুও সরকারি গাড়ি, নীল আলোর বৈভব-বিভা! রূপা ভাবে অভ্যস্ত হাতে কাজ সারতে সারতেই। কাচ্চি সড়কে আস্তানা আব্বাসের। সে-ওয়ার্ডের বরাবরের কাউন্সিলার সে। এবং নির্দল। তবুও সরকারি তাজ তার মাথায় বরাবর। এমনই প্রভাব, এমনই নিয়ন্ত্রণ তার তামাম এ-এলাকায়। সে-ই ঠিক করে দেয় এখনকার এমএলএ কে হবে। বিরোধী দল, নাকি সরকারি দল! এখন যেমন মেটিয়াবুরুজের এমএলএ বিরোধী দলের। আব্বাসের বরাভয় যেহেতু তার ওপর, তাই। যেহেতু এমএলএ বিরোধী হলেও মুসলমান। যদিও সরকারি লাল পার্টির প্রার্থী ছিল পার্টিরই দোর্দণ্ডপ্রতাপ জোনাল সেক্রেটারি প্রদীপ রায়। হিন্দু! তাছাড়াও এলাকার উড়ো কথায় একটা মৌখিক সিলসিলার কিস্‌সাও ভেসে উঠেছিল। সুতরাং সবক— এ-জবানটিও লেপ্টেছিল সে-কিস্সায়। আবার আব্বাসের টক্করও যে কেবল প্রদীপ রায়ের সঙ্গেই— সাম্রাজ্যের দখলদারিতে! মেটিয়াবুরুজে সত্তর শতাংশ মুসলমান হলেও, মুসলমানদের সত্তর শতাংশ আবার বাংলাভাষী মুসলমান। হিন্দু এলাকা তো বটেই, এমনকী বাংলাভাষী মুসলমান এলাকায়ও লাল পার্টির প্রবল প্রভাব, আর লাল পার্টি মানেই তো প্রদীপ রায়! এবারে প্রদীপ রায় দাঁড়াবে শুনে আব্বাস মস্ত চাল চেলেছিল। এক বাঙালি দর্জি মুসলমানকে বিরোধী প্রার্থী করে সে। তবুও নির্দল আব্বাসের মাথায় সরকারি নীল তাজ। রূপার মনে ভাবনারা বুজকুরি কাটে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে লোকটা নিজে কোনোদিন এমএলএ পদে দাঁড়ায় না। নিজের ওয়ার্ডের কাউন্সিলার হয়েই সন্তুষ্ট থাকে সে বরাবর। তবুও সে এলাকার বেতাজ বাদশা! কিং-মেকার!

রূপা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। সে-অবসরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। ভাবনারা ভেসে আসে আবারও। মস্তান, ডন, মাফিয়া আব্বাস আজ নেতা! সরকারি বিভা তার মাথায়। অথচ তার কৃষ্ণ…! সন্ধ্যার মায়া মুছে রাত গুঁড়ি মেরে কখন যে গেঁড়ে বসেছে দোকানে রূপা জানতেই পারে না।

খদ্দেররা আসে, যায়— দোকানে জমাট রাতের অন্ধকার ঠাই নাড়া হয়। অন্ধকার চলাচল করে রূপার মনেও।

সেদিনও ছিল অন্ধকার থকথকে গাঢ, কেন-না নাইট শো তখন শেষ হয়েছে। আব্বাসের দলের চারটে ছেলে সিনেমা শেষে হল থেকে বেরোবার মুখে দেওয়ালে পানের পিক ফেলে। কৃষ্ণর তো ঠেক রূপশ্রী সিনেমা হলের উলটো দিকের কানা গলিটায়। খবর ওড়ে, বাতাস পায়— মুহূর্তে পৌঁছে যায় কৃষ্ণের কানে। কে না জানে যে— রাজারা কান দিয়ে শোনে। কৃষ্ণের হিলহিলে শরীরটা তড়াক দেওয়া সোজা, খাড়া। হাতে অস্ত্র নিমেষে এঁটে বসে। চারটি ছেলেকে কৃষ্ণ শাস্তি দেয়। তবে চরম না তা, কেবল একটা শিক্ষা, একটা চেতাবনি যে, এ-এলাকা কৃষ্ণের। যাবতীয় বেয়াদপি তোমাদের পাড়ায়— পিসন, খাতুনমহলে করো, এখানে হার্গিস নয়!

যদিও সে-রাত সেখানে শেষ হয় না, বরং তা আরও পিচ্ছিল ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে। আধঘণ্টাও না— রূপশ্রী হল চত্বর ঝলসে ওঠে উপর্যুপর ঝলকানিতে, যার ফেউ হিসেবে আসে ভয় জাগানো আওয়াজ— বুম! বুম! বুম! বোমার আঘাতে রাত জেগে ওঠে। আব্বাসের দল জানান দেয় নিজেদের। বুম বুম শব্দে এই প্রথম এ-পাড়ার রাত নিশির ডাকে জেগে ওঠে, ভয়ে কাঁপে, জানলা ঝটঝট ছিটকিনি আঁটে!

তবে যেমন গর্জাল তেমন বর্ষাল না। থেমে গেল আচমকা সে-যুদ্ধ। কেন-না উলুখাগড়া এক— তার প্রাণ গিয়েছিল সে-যুদ্ধে, যুদ্ধের প্রারম্ভেই। শ্রীকান্ত পোড়ে— চাকরি না পাওয়া ভালো ছাত্র, যেহেতু ভালো তাই নিরীহও, টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল ঠিক সে-সময়েই। সে নিরীহ উলুখাগড়া না জেনেই যুদ্ধের মাঝে পড়ে যায় এবং তার মাথার আধখানা উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের বন্ধ শাটারে ঘুঁটে হেন হাসতে থাকে যেন! যা জনহীনতা আনে। ফলে নির্জন, নিস্তব্ধ রাত কেঁপে উঠে হা-হা হেসে ওঠে। হাসি মোচড় দেয়, ঘূর্ণি তোলে— সে-ঘূর্ণির টানে রাত থকথকে পাঁকপিচ্ছিল। হ্যাঁ, কৃষ্ণ জমানায় প্রথম সে-পাড়ায়। এবং শেষও। যেহেতু ভদ্র-নিরীহ পাড়া, তাই পার্টি নামক অলোখ-অমোঘ শক্তি তত্ক্ষণাত্‍ হস্তক্ষেপ করে। আর বাংলা তখন লাল রঙে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত, শ্বাসরুদ্ধ তাই। মেটিয়াবুরুজও তার ব্যতিক্রম নয়। যতই এখানে বিরোধী দলের এমএলএ থাকুক না কেন, সে যেন মাটির দুর্গে অন্তরীণই, শুধু তাজটুকুই সম্বল— যেমন ছিল নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্‌ তার তাজটুকু সম্বল করে অন্তরীণ তারই নিজের হাতে গড়া মেটিয়াবুরুজে!

এখন লাল রং যেমন প্রাণেরও, তেমনই ভয়েরও প্রতীক। যে-ভয়ে সে-হত্যার সাক্ষী কেউ থাকে না। আব্বাস-কৃষ্ণ, উঠতি চরিত্র দু-জনেই পার্টির আশ্রয় পায়। প্রভুভক্ত পুলিশও অতএব নাক শুকে চলে যায়— দোষী ধরা পড়ে না। নামহীন কয়েকজনের নামে এফআইআর হয়, যেমন দস্তুর! যারা ফেরারও নাকি! আর তখন পার্টি, মানে প্রদীপ রায় এ-রায়ে শীলমোহর দেয় যে, হিন্দু এ-পাড়া কৃষ্ণের আর উর্দু জবানের কাচ্চি সড়ক-বাত্তিকল-ধানখেতি-আয়রন গেট এলাকা আব্বাসের। যদিও এ-চুক্তি আগে থেকেই অলিখিতভাবে জারি ছিলই, তবুও এবারে তাতে পার্টি, মানে প্রশাসনের শীলমোহর দেগে বসে পাকাপাকিভাবে।

সেই থেকে কৃষ্ণের এ-অঞ্চলে কি-বা রাত, কি-বা দিন থকথকে পাঁকপিচ্ছিল হয়নি আর কখনো। তবে হিলহিলে চোরা ভয়ের স্রোত বইতো নাকি মানুষের মনে! বইলেও মানুষ সে-ভয়কে গিলে নিত মনের অন্ধকারে, চোখে ফুটে উঠতে দিত না। হ্যাঁ, ভয়েই!

তখন রূপা কিশোরী— স্কুল বালিকা। থোকাবাঁধা হলেও স্কুলবালিকা তারাও তো তখন অকারণ মাথা নামিয়েই বাক্হা‌রা ত্রস্ত পায়ে পেরিয়ে যেত রূপশ্রী তলা ইশকুল যাতায়াতের পথে। কেমন একটা শিরশিরানি স্রোত যেন হিলহিলিয়ে উঠতে থাকত শিরদাঁড়া বেয়ে! কিন্তু কেন জানে না সে আজও। হয়তো রাজার দরবারের সামনে দিয়ে যেতে গেলে মনে যে-ভয় সমীহ আঁকে, তাই-ই তা! জানে না রূপা আজও। যদিও কৃষ্ণের শাসনে এ-এলাকায় শান্তিই তো বিরাজিত করত, অন্তত যতদিন সে বেঁচে ছিল ততদিন! যদিও হাওয়ায় ফিশফিশানি এ-রব চোরা বইত যে, সে ছিল শ্মশানের শান্তি!

কিন্তু আজ? কিংবা কৃষ্ণের মথুরাজয়ের আগে! রূপা যান্ত্রিক অভ্যাসে খদ্দের সামলাতে সামলাতে আঁচল দিয়ে মুখ-গলার ঘাম মোছে। সে-নরম প্রশ্রয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রূপার বুক চিরে, যা অন্ধকার ঘনিয়ে তোলে রূপার মনে আরও। ফলে দোকানে রাত ঘন হয় যেন।


আজকে পার্টির বিশেষ মিটিং আছে বোধহয়। পাশের পার্টি অফিসের মুখে সাত সকালেই জটলা। ফলে রূপার চায়ের দোকানেও ভিড় বেশ। রূপা হিমসিম খায় যেন একা হাতে। হারুর কথা মনে পড়ে— থাকলে ভালোই হত। কিন্তু…। তবুও কিন্তু শব্দটা বাস্তবতা আঁকে। এ-ভিড় তো দু-এক মাসে একবার হয়তো। বাকি দিন তো ফাঁকাই। পথ চলতি লোক বা রিকশাঅলা দু-একজন। এই তো খদ্দের। নিজেরই চলে না, তো হারুকে পোষা! হাতের ব্যস্ততার সঙ্গে রূপার মনও নড়েচড়ে। হ্যাঁ, তখন ছিল বটে দিন, যখন রূপশ্রী গমগম করে চলত। খদ্দের সামলাতে হারু হিমসিম খেয়ে যেত। অন্দরে হেঁসেলে ঠাকুর টোস্ট সেঁকে, ভেজিটেবল-ডেভিল ভেজে কূলকিনারা পেত না। সঙ্গে চায়ের জল তো একটা উনুনে ফুটেই চলেছে, ফুটেই চলেছে অনবরত! অতীতচারী রূপা মনে মনে সে-ছবি ফুটিয়ে তুলতে থাকে অভ্যস্ত ছন্দে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই। সে-বিগত ছায়া দেখতে চেয়েই সে যেন বাইরে উদাস চোখ মেলে ধরে। আর অমনি সাদা এক আম্বাসাডার গাড়ি এক প্রবল ধাক্কায় রূপাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে। সে-সাদা গাড়ি থেকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির কালো কুচকুচে লোকটা নেমে আসে। ওই নামাটুকু মাত্র— সঙ্গে সঙ্গেই পার্টি অফিসের মুখের জটলাটা ঝাঁক বাঁধে লোকটাকে ঘিরে। এক কমরেডের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে চলে লোকটা ধীর-নিক্তি মাপা পায়ে পার্টি অফিসের দিকে। প্রদীপ রায়— পার্টির জোনাল সেক্রেটারি। মেটিয়াবুরুজের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র! তার চিকন কালো হাতের ছোঁয়া কাঁধ দেওয়া কমরেডের মুখে কৃতার্থের ছবি এঁকে দেয় নিমেষে। মুহূর্তে সে-বিগলিত মায়া জাদু করে জোটবাঁধা বাকি কমরেডদের, কেন-না সবার মুখেই কৃতার্থের বিগলিত হাসি ঝুলে থাকে, যেন-বা লোল পড়-পড়! কেউ কেউ মনে মনে ইনকিলাব জিন্দাবাদ— এ-শ্লোগানও দিয়েছিল বোধহয়, নইলে চারতলা পার্টি অফিসের মাথায় টাঙানো ন্যাতানো লাল পতাকাটা হঠাত্‍ হাওয়ায় পত্‌-পত্‌ করে উড়বেই বা কেন ঠিক সে-সময়েই! যদিও কেউ দেখে না তা। শুধু রাস্তার উলটো দিকের দেওয়ালে আবছা হয়ে আসা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করুন— এ-বৈপ্লবিক শপথখানি তা দেখে এবং আরও একটু অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে পার্টির এ হেন প্রতাপে!

এ-দৃশ্যে দীর্ঘশ্বাস জমে রূপার মনে এবং তা তার বুক চিরে বেরিয়েও যায় সে-লহমাই, শুধু এক-একটুকরো ছবি ভাসিয়ে দিয়ে! তখন স্কুলবালিকা। তখন জরুরি অবস্থা পেরিয়ে গাই-বাছুরকে তাড়িয়ে কাস্তে-হাতুড়ির লালরাজ সবে মৌরসিপাট্টা কায়েম করেছে। তবুও গোরুর রাখাল সবুজ যুবাদের প্রতাপের রেশ সবটুকু মুছে যায়নি। ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড রোডের মথুর সিং তখনও তোলাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। এবং পুলিশের যোগ সাজসেই বোধহয় তার প্রতাপ ক্রমশ ক্রমবর্ধিত হতে থাকে, কেন-না মথুর সিং তখনও তো সবুজ রঙাই! এবং কাস্তে-হাতুড়ির লালরঙে তখনও আদর্শের মায়া। আবার যেহেতু ক্ষমতার ধর্মই হচ্ছে তার বিস্ফার, সে-কারণেও হয়তো সে, মথুর সিং ময়লা ডিপো, ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড, ফতেপুর ছাড়িয়ে তার রাজত্ব বিস্তার করে বাঁধা বটতলা, রূপশ্রী সিনেমা হল পর্যন্ত। মাঝে মাঝেই রাত-বিরেতে বোমার আওয়াজে কেঁপে ওঠে এ-তল্লাট। এবং তা অকারণেই কেন-না রাজ কায়েম করতে হলে অস্ত্রের, যা ক্ষমতার চিহ্ন, তার প্রদর্শন করতেই হয়।

আর তারপর সিনেমায় যেমন হয়, তেমনই হয়। উঠতি যুবা, কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি কৃষ্ণ, নেতৃত্ব যার সহজাত— সেই কৃষ্ণ মথুর সিং-এর দলবলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন মথুর সিং-এর দু-জন সাকরেদকে পাড়ায় দেখতে পেয়ে ক্লাবের ছেলেদের জুটিয়ে তাড়া করে। প্রথমটাই বাহুবলী দু-জন এমন অভাবিত ঘটনায় আশ্চর্যই হয় যেন। কেন-না নিরীহ ডরপুক বাঙ্গালি-আদমি তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে— এ তাদের ভাবনাতেই ছিল না। ফলে কোমরে গোঁজা অস্ত্র বার করতে গিয়ে জলদিতে হাত একটু কেঁপে যাওয়ায়, কিংবা দেশি ওয়ান শটার বেইমানি করেও হয়তো সে-ক্ষণে, তাই ছুটন্ত তাদের পিস্তল হাওয়াতেই গুলি উগড়ে দেয়। বা ইচ্ছে করেই হয়তো শূন্যে গুলি ছোড়ে নিতান্তই ভয় দেখাতে পেছনে ছুটে আসা ডরপুক নাদান বাঙ্গালি বাচ্চালোগোঁকে! কিন্তু অবাক তারা দেখে যে, বাঙালিবাচ্চারা ভয় না খেয়ে দৌড়েই আসে তাদের দিকে। আগুন উগড়ে সে-মুহূর্তে খালি ওয়ান শটার পিস্তল— তাতে গুলি ভরতে তো সময় লাগবে এবং গতিও শ্লথ করতে হবে। এরকম দোনামনা ভাবনাই হোক, বা পিস্তলে গুলি ভরতে চেয়েই হোক, তাদের গতি ক্ষণিকের জন্য শ্লথ হয়ই যেন। হয়তো-বা এমন অভাবনীয় কাণ্ড তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, তেমনটাও হতে পারে। মোদ্দাকথা তাদের গতি সে-ক্ষণে তেমন তীব্র ছিল না, বা আপেক্ষিকভাবে পেছনের ছুটন্ত জনতার গতির তীব্রতা বেশিই ছিল হয়তো! যাই-ইহোক, দড়াম করে একটা আধলা এসে আছড়ে পড়ে ছুটন্ত বাহুবলীর একজনের পায়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। অন্যজন সঙ্গীকে বাঁচাবে, না নিজে বাঁচবে আগে— এই দোটানায় ক্ষণিক থামেই যেন। ফলে কৃষ্ণর যাদব-বৃষ্ণী বাহিনী তাকেও পেড়ে ফেলে মুহূর্তে। আর জনতার মার দুনিয়ার বার— সেহেতু এক মস্তান নেতিয়ে পড়ে খাবি খেতে খেতে শেষ হাওয়া টানে বোধহয় সেখানেই। অন্য জনকে পুলিশ এসে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে ঘণ্টাদুয়েক পার হয়ে যায়। কেন-না রাস্তার পুবপাড় কলকাতা পুলিশের দখলে, আর পশ্চিমপাড় বেঙ্গল পুলিশের কব্জায়। ফলে কে হ্যাপা পোয়াবে এ-মীমাংসাতেই ওই ঘণ্টা দুয়েক সময় যায়। এবং ফিতে মেপে দেখা যায়, যে মারা গেছে সে কলকাতা পুলিশের আওতায়। আর যে তখনও মরেনি সে বেঙ্গল পুলিশের ছায়ায়। দু-পুলিশ দু-জনের দায়িত্ব নেয় আলাদা আলাদাভাবে। ফলে কেস দাঁড়ায় না। অশনাক্ত জনগণের নামে দু-থানায় দু-টি এফআইআর হয়। সময়ের সাথে ক্রমে সে-কেস ধামা চাপা পড়ে যায়।

এবং কেস ধামাচাপা পড়তে দেওয়া হয়, কেন-না লাল রাজত্বের বিপুল শুরুয়াতের দু-বছর পার হয়ে গেছে তখন, মরিচঝাঁপি নামক শাসকের সুশাসন কিংবা সন্ত্রাসও ঘটে গেছে ততদিনে, সেহেতু লাল রং একটু রংজ্বলা যেন-বা। আর সে জ্বলে যাওয়া লালে প্রতাপান্বিত প্রদীপ রায় স্বয়ং কৃষ্ণকে ছায়া দেয়। যে-খেলায় কৃষ্ণের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বিবেচ্য বিষয় হিসাবে থাকতে পারে না, যেহেতু ক্ষমতার রাজনীতি কথাটাই শেকড় গাড়ে! থকথকে কালো সে-ছায়ার মায়ায় অতি সাধারণ, আম-কৃষ্ণ লহমায় অসাধারণ হয়ে ওঠে যেন। ক্ষমতাভিষেক হয় তার পার্টির ছত্রছায়ায়। মথুরাপতি রাজা কৃষ্ণ যেন সে। কেন-না কালো সে-ছায়া মথুর সিংকে গিলে নেয়। এতদিনে পুলিশ খুঁজে পায় তাকে! ফলে এদিকে মুদিয়ালি থেকে ফতেপুর সেকেন্ড লেন, রূপশ্রী হল, বাঁধা বটতলা, তা ছাড়িয়ে ফতেপুর, ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড রোড, সিমেন্ট কল মোড় হয়ে রামনগর পর্যন্ত একছত্র রাজ যেন কৃষ্ণের। আর কে না জানে যে, ক্ষমতা মানুষের চেহারায় একধরনের জেল্লা আনে। লোকে কৃষ্ণের মাথার পেছনে বিভা দেখতে পায় যেন। সে-বিভা সমীহ আঁকে মানুষের মনে। যা অচেনার দূরত্ব তৈরি করে হয়তো। তবু সে হেঁটে গেলে মানুষ বিহ্বল কথা থামায় আচমকা, কেউ-বা গদগদে দেঁতো হাসি ঠোঁটে ঝোলায়। কৃষ্ণ উপভোগ করে তা। ক্ষমতা তাকে এটুকুও শেখায় যে দীর্ঘদিন রাজ করতে গেলে প্রজাপীড়ন অচল।মথুর সিং-এর পরিণতি কিংবা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অতীতই হয়তো তার মনে এ-বোধ আনে। না, এ-এলাকায় সে কোনোদিনই সাধারণ মানুষের ওপর কোনো জুলুম করেনি। আর সে থাকতে আর কারো সাহস হয়নি কোনোদিন কোনোরকম ফণা তোলার। আর তাই মানুষগুলো এখনও তার কথা বলে। রূপশ্রী হলের উলটো দিকের নামহীন কানা গলিটা, যেখানে তার ঠেক ছিল, তার নাম লোকের মুখে মুখে আজও কৃষ্ণের গলি নামেই পরিচিত। তার মৃত্যুর এতগুলো বছর পরেও!

আনমনা রূপার মন সহসাই আলো আঁকে তার মুখে। আবার ওপারের বাড়ি ডিঙিয়ে ফালি রোদ তার দোকানের দরজায় উঁকি মারে এই ক্ষণে, ফলে রূপার মুখে সে-আলো স্থায়িত্ব পায়। প্রদীপ রায়ের সঙ্গে সঙ্গে জটলাটা পার্টি অফিসে ঢুকে গেছে কখন, রূপার মন খেয়াল করে না তা। দোকানের হঠাত্‍ নির্জনতা তাকে বাস্তবে ফেরায়। কর্মব্যস্ততার অবসরে সে স্বস্তির শ্বাস ফেলার ফুরসত পায় যেন। কিন্তু কতক্ষণই তা! হঠাত্‍ এ-নির্জন অবসর আবারও অতীতকে আঁকে রূপার মনে, যা কৃষ্ণময়!

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই