লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সোমা মুখোপাধ্যায়

আরতী পালের ঝুলনের পুতুল

তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। উলটোডাঙার মুচি বাজারের কাছে আরিফ রোডে থাকতাম। বাজারে ঝুলনের সময় মাটির পুতুল বিক্রি হত। এখান থেকেই কিনেছিলাম একটা সুন্দর পুতুল। একটি ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। পেছনে ল্যাম্প পোস্ট। ফুটপাথ আকাশি রং করা আর চৌকো খোপ কাটা। ল্যাম্প পোস্টের গায়ে রুপোলি রং। বাতিটা সাদা। ছেলেটা লাল হাফ প্যান্ট আর হলুদ জামা পরা। তার দিয়ে তৈরি ঘুড়ির সুতোয় কাগজের ঘুড়ি। সবটাই একআঙুল মাপের। অসম্ভব দক্ষ এই কাজ। বহুদিন ছিল ওটা। তারপর হারিয়ে যায়।

২০১৫ সালে মাটির পুতুলের খোঁজে গিয়েছিলাম নাগের বাজার রথের মেলায়। জমজমাট মেলায় ঘুরতে ঘুরতে সদ্য নির্মীয়মান ব্রিজের একধারে নজর চলে যায়। চমকে উঠি। সেই ছোটোবেলার ঝুলনের পুতুল সাজানো আছে। ভিড় ঠেলে উঁকি দিয়ে আর নজর ফেরাতে পারি না। রং-বেরঙের কত পুতুল। সকলেই ঐ একআঙুল সমান। আর পুতুল বিক্রি করছেন এক দম্পতি। ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করে নাম জানলাম মনোরঞ্জন পাল। ফোন নাম্বার চাইতে মহিলাকে ডাকলেন। খদ্দের সামলাতে সামলাতে বললেন মহিলাটি ওঁর নাম আরতী পাল। নিমতা কুমোরটুলিতে থাকেন। নাম্বার দিলেন। আমি সেই ছোটোবেলার ঘুড়ি ওড়ানো পুতুল নিয়ে সেদিন ফিরে এলাম। এরপর গড়ে উঠল আলাপ।

সে-সময় বিশ্ববাংলা স্টোরের জন্য চলছিল বাংলার পুতুল সংগ্রহ। আমিও যুক্ত ছিলাম। সেই কারণে গেলাম কিছু দিনের মধ্যেই আরতী পালের বাড়ি। একেবারে বিরাটি যাওয়ার মূল রাস্তার পাশেই। বাড়িতে ঢোকার মুখে ছোটো ছোটো পুতুল সাজানো। কোনোটায় রং হয়েছে কোনোটায় হয়নি। এটাই ওদের স্টুডিয়ো। এখানেই নানা ঠাকুর গড়া হয়।

ঝুলনে সাজানো হলেও রথ আর ছাতুবাবুর বাজারের চড়কের মেলাতেও একসময় বিক্রি হত এই পুতুলগুলো। একখোল ছাঁচে পুতুলের দেহটা তৈরি করে সেটা শুকিয়ে খড়িমাটির গোলা লাগিয়ে তবে রং করা হয়। এই রংটা খুব সাবধানে করতে হয়। এত ছোটো পুতুল। আরতী পাল সংসারের কাজের ফাঁকে এটা করেন স্বামীর সঙ্গে। হাত লাগায় ছেলেও।

কুমোর পরিবারের মহিলারা এমন পুতুল গড়ার সঙ্গে অনেক দিন ধরেই যুক্ত। কাঁচা মাটির এই পুতুলগুলোতে একদিকে আছে পৌরাণিক পুতুল আর অন্য দিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচা। মেয়েদের রান্না, মাছকাটা, শিবপুজো, মা ও ছেলে, পিওন, পুলিশ, আইসক্রিম থেকে ফুচকাওয়ালা, সবজিওয়ালা এমনকী হাল আমলের রিয়েলিটি শো থেকে জনপ্রিয় সিরিয়ালের চরিত্রের সন্ধান— সবটাই মিলবে আরতী পালের পুতুলে। আর পৌরাণিক পুতুলেতে আছে কৃষ্ণলীলা আর রামায়ণের কাহিনির দৃশ্য। রাধাকৃষ্ণ, পুতনা বধ, কালীয় দমন থেকে দশানন রাবণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটে সমাজে লোকশিল্পী তাকে প্রকাশ করেন নিজের মতো করে। ঝুলনের পুতুলে তারই প্রভাব আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের একটা বড়ো অংশ এখানে রূপায়িত হয়।

এই পুতুল তৈরি কীভাবে হয় তা চাক্ষুস দেখেছিলাম ওঁদের বাড়িতে। পুতুলের মাটি আসে ডায়মন্ড হারবার থেকে সোদপুরে। সেখান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এই আঠালো পলি মাটি ভালো করে চটকে নিয়ে চটা দিতে হয়, অর্থাৎ, কাঠি দিতে হয়। তারপর ছাঁচে পুতুলের দেহটা তোলা হয়। এরপর হাত দিয়ে দেওয়া হয় ‘ফিনিশিং টাচ’।

অনেকে বলেন ঝুলনে সাজানো হয় বলে এটা পোড়ানো হয় না। আরতী পাল তা মনে করেন না। তাঁর মতে তাঁদের মাটিতে এখানে চটা বা কাঠি থাকে বলে পোড়ানো‌ হয় না। কুমোরটুলি থেকে শুকনো রং কিনে আনা হয়। তেঁতুলের বিচির আঠা দিয়ে আগে জাল দিতে হয়। এই রঙের সঙ্গে আঠা মেশানো হয়। এখন যাকে মিডিয়াম বলে তেমন। এর ফলে রংটা হাতে লাগলে ওঠে না।

আরতী দেবীর মা এই পুতুলগুলো বানাতেন। ওঁর ছেলে রং করেন, চোখ আঁকেন। নারকেল মালায় রং রাখা হয়। বাজারি তুলি ব্যবহার করা হয়। ইতিমধ্যেই আরতী পালের পুতুল বেশ পরিচিত হয়েছে। বিশ্ববাংলা পার্ক স্ট্রিটের স্টোরে রয়েছে তাঁর ছবি। শিল্পী হিসেবে এ কম প্রাপ্তি নয়! এছাড়াও সরকারি বেসরকারি নানা মেলায় আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন তিনি। সারাবছর আগেও তৈরি হত এ-পুতুল কিন্তু এখন চাহিদা বেড়েছে অনেক।

আরতী পালের এই পুতুলগুলো এক অসাধারণ শিল্পকলার উদাহরণ। আমাদের রাজ্যে নানা অঞ্চলে এমন পুতুল হয়। কিন্তু আঙ্গিকের দিক থেকে আরতী পালের পুতুলের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। বাংলার মাটির পুতুলের মধ্যে একটা যুগ প্রবাহ দেখা যায়। এই পুতুলগুলো একেবারেই বাস্তবানুগ (naturalistic) কৃষ্ণনগরের মতো মডেল-এর মতো বাস্তবধর্মী নয় (materialistic) নয়। অর্থাৎ, শিল্পী যেমনভাবে তাঁর পারিপার্শ্বিককে দেখে তাঁকে নিজের মতো করে রূপায়ণ করেন। হবহু‌ তুলে ধরেন না। এখানেই আমাদের শিল্পের মূল নির্যাস ধরা পড়ে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে এই বিষয়টা ভারি চমৎকার বলেছেন—
“একবার কৃষ্ণনগরের পুতুল গড়ার কারিগর জ্যোতিকা’র একটা মূর্তি গড়ল। অমন সুন্দর চেহারা তাঁর, যেমন রং তেমন মুখের ডৌল— মূর্তি গড়ে তাকে নানা রং দিয়ে এনে যখন সামনে ধরল সে যা বিশ্রী কান্ড হল, শিশুমনও তা পছন্দ করবে না। মাটির কেষ্ট ঠাকুরের পুতুল বরং বেশি ভাল তার চোখে। পুতুলগড়া সোজা ব্যাপার নয়। তার গায়ে এখানে‌-ওখানে বুঝে একটু-আধটু রং দেওয়া, চোখের লাইন টানা, একটু খোঁচা দিয়ে গয়না বোঝানো, এ বড় কঠিন। সত্যি বলব, আমি তো পুতুল নিয়ে এত নাড়াচাড়া করলুম, এখনো সেই জিনিসটি ধরতে পারিনি। একটু ‘টাচ’ দিয়ে দেয় এখানে-ওখানে, বড় শক্ত তা ধরা। সেবার পরগনায় যাচ্ছি বোটে সঙ্গে মনীষী আছে। কোথায় রইল সে এখন একা-একা পড়ে, কী শিখল না-শিখল একবার লড়তে এলে তো বুঝব। তা সেবার খাল বেয়ে যেতে যেতে দেখি এক নৌকো বোঝাই পুতুল নিয়ে চলেছে এক কারিগর। বললুম, ‘থামা থামা বোট, ডাক্ ঐ পুতুলের নৌকো।’ মাঝিরা বোট থামিয়ে ডাকলে নৌকোর মাঝিকে, নৌকো এসে লাগল আমার বোটের পাশে। নানা রংবেরঙের খেলনা, তার মাঝে দেখি কতগুলো নীল রঙের মাটির বেড়াল। বড়ো ভালো লাগল। নীল রংটা ছাই রঙের জায়গায় ব্যবহার করেছে তারা, ছাই রং পায়নি নীলেই কাজ সেরেছে‌। অনেকগুলো সেই নীল বেড়াল কিনে ছেলেমেয়েদের বিতরণ করলুম। পুতুলের গায়ের ‘টাচ’ বড় চমৎকার।”

আরতী পালের কৃতিত্ব এখানেই। বংশ পরম্পরায় এক ধারাকে নিয়ে চলেছেন তিনি। আর তা বহন‌ করছেন ওঁর ছেলে। পড়াশোনা করে চাকরি করলেও নিজেদের পেশাকে ভোলেননি।

আরতী আর মনোরঞ্জন পালের সুন্দর সাজানো পরিবার। এক ছেলে আর মেয়ে। রয়েছে নাতনিও। স্টুডিয়ো পার হয়েই ওঁদের থাকবার ঘর। পাশেই রান্নাঘর। গেলেই অমায়িক আপ্যায়ন মেলে। কখন‌ এই শিল্পী দম্পতি যেন অনেক কাছে চলে এসেছেন। জীবন আর শিল্পের মেলবন্ধনে গড়া এই শিল্পীর পরিবার।

প্রথম পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই