লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

শুভদীপ ঘোষ

চার্লি ও চ্যাপলিনের কথা

চার্লির কথা ১: বাবা ছিল গায়ক ও অভিনেতা। ভালো গানের গলা ছিল, নামডাক ছিল। আমাদের এখানে বাণিজ্যিক রঙ্গমঞ্চ যেরকম ছিল কতকটা সেরকমই ছিল লন্ডনের মিউজিক হল বা আমেরিকার ভদেভিল। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের গ্রুপ থিয়েটারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের। সাধারণ মানুষের আনাগোনা লেগে থাকত, সারা শহর ঘুরে ঘুরে হত নাটক, গান, সার্কাস, মাইম, বক্তৃতা, জিমনাস্টিক এমনকী সন্মোহন জাতীয় ব্যাপার-স্যাপারও। ভীষণ জনপ্রিয় এই প্রদর্শনগুলিতে দর্শকরা নেমে এসে বিপুল উৎসাহে শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দিত, চলত দেদার মদ্যপান। বাবা ছিল এইরকমই ঘোর মদ্যপ। নাম চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন সিনিয়ার। চার্লির যখন বারো বছর বয়স তখন তার বাবা এই মদ্যপান জনিত অসুখের কারণে মারা যায়, মৃত্যুর সময় বাবার বয়স ছিল সাইত্রিশ। সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, বাবার সঙ্গে চার্লি ও তার দাদা সিডনির তা একেবারেই ছিল না। কয়েকবারের কিছু সাক্ষাৎ বাবার স্মৃতি হিসেবে থেকে গিয়েছিল তাদের মনে। তথাপি চ্যাপলিনের ছবিতে তার বাবার প্রভাব আছে নানাভাবে। মা ছিল বাবার মতোই ব্রিটিশ মিউজিক হলের গায়িকা ও অভিনেত্রী। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তার শিল্পীজীবন শুরু হয়। নাম হানা পেডলিংহাম চ্যাপলিন। বিজ্ঞাপনে বা হ্যান্ডবিলে ‘লিলি হার্লি’ নাম দেখা যেত। চ্যাপলিন সিনিয়ারের প্রেমে পড়ে ঐ কম বয়সেই। ১৮৮৩ নাগাদ সিডনি হক্‌স বলে একজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়, হক্‌স তাকে সোনার-খনিতে সমৃদ্ধ সাউথ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্ট্রান্ডে নিয়ে যায়। এখানে তাকে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়। এর অল্পকাল পড়েই হানা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পুনরায় ব্রিটেন ফিরে আসে। জন্ম হয় সিডনি হক্‌সের ছেলে সিডনি চ্যাপলিনের। উত্তর ফ্রান্সের লে হেভরের রয়াল মিউজিক হলে শুরু হয় পুনরায় গান গাওয়া। ব্রিস্টল, ডাবলিন, গ্লাসগো, বেলফাস্টে তার গান ও অভিনয় শুরু হয় সিনিয়ার চ্যাপলিনকে বিয়ে করার পর। ১৮৮৬ সালের ১৬ই এপ্রিল জন্ম হয় চার্লি চ্যাপলিনের (চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন জুনিয়ার)। মা বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল চার্লির সেটা বোঝার বয়স হওয়ার আগেই মা বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চার্লি ও সিডনি মায়ের সঙ্গে আলাদা থাকত লন্ডনের লাম্বেথ অঞ্চলে। হুইলার ডাইড্রেন নামে মায়ের আর এক ছেলের কথা তারা জানতে পারে অনেক পরে! এই গম্ভীর রোগা ডাইড্রেনকে চার্লির শেষের দিকের কিছু ছবিতে অভিনয়ও করতে দেখা গেছে। বাবার মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান, উত্তর আমেরিকা ভ্রমণের সময়কার অজানা কিছু ঘটনা, অন্য এই ছেলের রহস্য, না কি মায়ের কখনো ঠিক না হওয়া মানসিক অপ্রকৃতিস্থতা, প্রকৃত কারণ কী ছিল ছাড়াছাড়ির! চার্লিদের কাছে রহস্যই থেকে গেছে গোটা ব্যাপারটা। পরবর্তীকালের গবেষণা থেকে জানা যায় হানা চ্যাপলিন সম্ভবত সিফিলিস আক্রান্ত ছিল। অস্বাভাবিক মাথাব্যথা, মাঝে মাঝেই গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোনো বন্ধ হয়ে যাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক গৈরুষা, সার্বিক স্বাস্থের অবনতি-সহ শেষাবধি ডিমেন্সিয়া এই সিফিলিসের কারণেই হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়!

ছোটোবেলায় চার্লি

সুন্দরী কতটা ছিল তেমন জানা না গেলেও মায়ের রূপে-গুণে চার্লি ও সিডনি ছিল মুগ্ধ। অনেক রাত করে মা বাড়ি ফিরত, ফিরে দেখত ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, সকালে উঠে ছেলেরা দেখত মা ঘুমোচ্ছে, টেবিলে সাজিয়ে রাখা আছে তাদের খাবার। দাদু দিদারা এসে মাঝে সাঝে থাকত ওদের সাথে, হানার রোজগারে আধপেটা খেয়ে কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত। ছুটির দিনে কখনো লাম্বেথের ফুটপাথে কখনো কেনিংটন রোডের ধারে কখনো-বা ওয়েস্টমিনিস্টারের ব্রিজের ধারে, মায়ের সঙ্গে লাইলাক গাছের ডাল ধরে সুন্দর কেটে যেত তাদের বিকেলগুলি। গান গেয়ে, নেচে, কদাচিৎ আইসক্রিম কিনে দিয়ে অভাব অনটন কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত মা। কিন্তু এরই মধ্যে দুঃস্বপ্নের একটি রাত চার্লি কোনোদিন ভোলেনি।

প্রথম দৃশ্য— লাম্বেথে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মায়ের সাজপোশাকের প্রিয় পেটিটা খুলে বসেছে দুই ভাই, মা সাজগোজ করে বেরোবে, গন্তব্য অ্যালডারসটের ক্যান্টিন মিউজিক হল। চার্লির কথায়, “ভাড়া বাড়িতে একা রেখে যাওয়ার চাইতে মা সাধারনত আমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করত”।

দ্বিতীয় দৃশ্য— জমকালো পোশাকে মোহময়ী হানা গান ধরেছে। অ্যালডারসটের ক্যান্টিনে তুমুল হইচই হচ্ছে, দর্শক শ্রোতারা অধিকাংশই সৈনিক, তুমল বিশৃঙ্খলা, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে, শিস পড়ছে, উড়ে আসছে অশ্লীল শব্দ ও চুমু ‘চার্মিং লিট্‌ল চান্টার’ হানার প্রতি। দু-একজন মদ্যপ পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বদমায়েশি করে, গান গাইতে গাইতেই হানা হাত দিয়ে বাড়ি মেরে দূর করে দিচ্ছে তাদের। নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সব দেখছে শুনছে পাঁচ বছরের চার্লি।

তৃতীয় দৃশ্য— হঠাৎ গানের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, এদিকে মা প্রাণপণ চেষ্টা করছে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে! অর্কেস্ট্রা বন্ধ হয়ে গেছে। নাঃ! মা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে তড়িঘড়ি দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল আর কিছু বোঝার আগেই হিড়হিড় করে টেনে মঞ্চে তুলে দেওয়া হল পাঁচ বছরের চার্লিকে!

চতুর্থ দৃশ্য— চারপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া, তার মুখের উপর এসে পড়েছে স্পটলাইটের আলো। আবার শোনা যাচ্ছে যন্ত্রের আওয়াজ! অর্কেস্ট্রা বেজে উঠেছে, আর কিছু করার নেই, গান বেরিয়ে এল মানুষের গলা দিয়ে। স্বভাব কবিদের মতো স্বভাব অভিনেতা-গায়ক চার্লি গান ধরেছে, জ্যাক জোন্সের গান!

পঞ্চম দৃশ্য— শুরু হয়ে গেছে পয়সার বৃষ্টি, পুচকে চার্লি গান গাইতে গাইতে মায়ের ভাঙা গলা নকল করছে মাঝে মাঝে আর অদ্ভুত মুখভঙ্গি করতে করতে তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিচ্ছে পয়সাগুলো যাতে কতৃপক্ষ ঝেড়ে না দিতে পারে! এই কাণ্ড দেখে দর্শকরা হেসে কুটিপাটি।

ক্যানটারবেরি হল, লাম্বেথ

এই ছিল চার্লির প্রথম রঙ্গমঞ্চের অভিজ্ঞতা। কান্নাহাসির দোলদোলানো এই শৈশব, হাসির অন্তরালের বিষাদের উৎসভূমি ছিল। কৌতুক ও বিষাদের সমমিশ্রণ না ঘটলে মানুষ হাসে না ও হাসির শেষে মানুষের চোখে জল আসে না। এ-সব বোঝা হয়ে গিয়েছিল চার্লির অনেক ছোটোবেলায়। দারিদ্র্য দুর্দশা ঐটুকু ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছিল নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে। তাই প্রথম রঙ্গমঞ্চের কুড়িয়ে নেওয়া টাকার মতো চার্লি ঐশ্বর্যের শিখরে পৌঁছেও ছিল সমান হিসেবি।

শিল্পীজীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সুস্থতা মায়ের আর আসেনি। জামাকাপড় সেলাই করে মা কোনোরকমে সংসার চালাত। পাউনিল টেরাসের বস্তিতে উঠে আসে তারা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। দুই ভায়েরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং শুরু হয় রোজগারের নানারকম চেষ্টা। বাড়ির সব জিনিস বেঁচে দিতে হয় একে একে, এমনকী তাদের সবচেয়ে প্রিয় মায়ের সাজগোজের পেটিটা পর্যন্ত! এরপর দেনার দায়ে সেলাইয়ের মেশিনটাও নিয়ে যায় পাওনাদার। লাম্বেথের ওয়ার্কহাউসে গরিব ও অনাথ বাচ্চাদের সাথে দুই ছেলেকে ভর্তি করে দেওয়া ছাড়া হানার আর কোনো উপায় থাকে না। রোজগারের বৈধ ও নিষিদ্ধ বিভিন্ন উপায়ে কাটতে থাকে হানার জীবন।

চ্যাপলিনের কথা ১: মানুষকে দেদার সাহায্য করার সময়ও আমরা আত্মসচেতন এক চ্যাপলিনকে দেখি তার ছোটো বড়ো সমস্ত ছবিতে। পয়সা রোজগার করার কত ফিকির আমরা দেখতে পাই তার ছবিতে। ধনসম্পদের বৈষম্যই যে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কায়েমি রাখার মূল চাবিকাঠি এই বোধ চ্যাপলিন যেরকম চার্লির জীবন থেকে পেয়েছিল সেইমতো তার প্যান্টোমাইম চলচ্চিত্র যাত্রার শুরুর চলচ্চিত্রটির নামও অদ্ভুতভাবে ‘মেকিং এ লিভিং’ (১৯১৪)। এই ‘মেকিং এ লিভিং’-এর চ্যাপলিন কিন্তু আমাদের চেনা ঢোলা প্যান্ট, ছোটো গোঁফ, ছড়ি টুপির ভবঘুরে আর্কিটাইপ চ্যাপলিন নয়। ঐ চরিত্রটিকে খুঁজে পেতে তাকে পরের ছবি ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’ (১৯১৪) অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরপর একে একে ‘হিজ নিউ প্রফেশান’ (১৯১৫), ‘হিজ নিউ জব’ (১৯১৫), ‘ওয়ার্ক’ (১৯১৫), ‘দি পন শপ’ (১৯১৬), ‘এ ডগ্‌স লাইফ’ (১৯১৮) জুড়ে শুধু ঢোলা প্যান্ট, ছেঁড়া টাইট কোট, ছড়ি, টুপি, ছোটো গোঁফ আর হাঁস জুতোটুকুও যাতে চলে না যায় সেই জন্য রোজগারের নানান ধান্দা। ‘এ ডগ্‌স লাইফ’-এ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে লোকভরতি বেঞ্চের একধারে বসে থাকা চ্যাপলিন মাটিতে পড়ে যায় যখন অন্য প্রান্তে একটি মোটা লোক এসে বসে। সমাজের বিস্মৃত মানুষের সর্বোত্তম প্রতিনিধি চ্যাপলিনকে এর পর বিশ্বাসযোগ্যভাবে অভিনয় করতে দেখি এমন এক প্রাহসনিক দৃশ্যে যেখানে বেঞ্চ থেকে উঠে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে জানালায় তার পৌঁছোনোর আগেই অন্য কেউ-না-কেউ পৌঁচ্ছে যাচ্ছে! সমাজের একেবারে নীচু তলার মানুষের অবস্থা নিয়ে এরকম শ্লেষাত্মক বিবৃতি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল!

চার পয়সা ধার দিয়ে ফাঁকতালে এক পয়সা নিজের জন্য সরিয়ে রাখে সে, কিংবা ‘সিটি লাইট’ (১৯৩১)-এ জলে ডুবন্ত সেই উন্মাদ ধনকুবেরকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে আগে জল থেকে ওঠার চেষ্টা করে! ‘Be brave! Face life!’, স্বগতোক্তির মতো শোনায়, বুক চাপড়ে এ-কথা বলতে গিয়ে চ্যাপলিনের আত্মপ্রবঞ্চনাময় কাশির দমক আমাদের হাসিতে ভরিয়ে দেয়। ‘Tomorrow the bird will sing’, আত্মহত্যা করতে যাওয়া যে-মানুষকে চ্যাপলিন এ-কথা বলছে সে একজন ধনকুবের! উদ্বৃত্ত অর্থের স্রোত, সমস্ত ভোগ করে ফেলার পর মানুষের বুঝি এই অবস্থা হয়! অথচ উলটোটাই তো কথা ছিল, কিন্তু ভবঘুরে আধপেটা খাওয়া চ্যাপলিন ভাবেনি সে-কথা, এখানেই ব্যক্তি চার্লির দুর্মর আশাবাদ চলচ্চিত্রের চ্যাপলিনের প্রতিভায় প্রকাশিত হয়েছে। এই ধনকুবের চরিত্রটির মধ্যে নিহিত আছে চার্লির বাবার ছায়া। মদ্যপ ধনকুবেরটি যেন চ্যাপলিনের বাবার ইগো আর নেশা ছুটে যাওয়া দাম্ভিক ধনকুবেরটি যেন তার বাবার অলটার ইগো।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অপ্রস্তুত চার্লিকে একদা ঘাড় ধরে তুলে দেওয়া হয়েছিল মঞ্চে, এই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন রূপ নিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে চ্যাপলিনের ছবিতে। ‘দি সার্কাস’ (১৯২৭) ছবিটিতে পুলিশের তাড়া খেয়ে চ্যাপলিনকে আমরা ঢুকে পড়তে দেখি সার্কাসের মঞ্চে, তারপর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে শুরু হয় ট্রাপিজের হাজার কসরত! ছবিতে সার্কাসের দর্শকরা সে-সব দেখে হেসে অস্থির তাদের কাছে প্রকৃত সত্য জানা নেই, আর আমরা ছবির দর্শকরাও হেসে অস্থির কিন্তু আমাদের অবস্থান চ্যাপলিনের সঙ্গে। ছবির এক জায়গায় সার্কাসের ম্যানেজারের মন্তব্য ভেসে উঠতে দেখি ইন্টারটাইটেলে, “He’s a sensation but he doesn’t know it…”। এতকাল বাদে এই স্বতঃস্ফুর্ত স্ল্যাপ্সটিকগুলির দিকে ফিরে তাকালে ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে এ-কথা কৌতুকপূর্ণভাবে সর্বৈব সত্য বলে মনে হয়। আবার প্রথম দিকের ‘এ নাইট ইন দ্য শো’ (১৯১৫)-তে আমরা দেখা পাই ব্রিটিশ মিউজিক হল বা আমেরিকার ভদেভিল জাতীয় রঙ্গমঞ্চের! ছবির এক জায়গায় মদের নেশায় চ্যাপলিন আচমকা গিয়ে রঙ্গমঞ্চের উপর উঠে পরে, তারপর শুরু হয় তার চিরাচরিত স্ল্যাপস্টিক মারপিট! অনেকে বলে থাকেন চ্যাপলিনের ছবি আসলে মানুষের আজীবন লালিত সুপ্ত শৈশবকে প্রাণিত করে তাই তার ছবির বয়সে ছোটো দর্শকের থেকে বয়সে বড়ো দর্শকের সংখ্যাই বেশি। মদ্যপ চ্যাপলিন আরও বেশি করে যেন ঐ শৈশবে প্রণত, তাই ভদেভিল রঙ্গমঞ্চে মদ্যপ চ্যাপলিন যেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে উঠে পড়ে, যেন এ তার অনেক ছোটোবেলার অভ্যাস! এখানে ছবির ভদেভিলের দর্শকদের থেকে ছবির দর্শক হিসেবে আমাদের অবস্থান অনেক বেশি ব্যক্তি-চ্যাপলিন নিষ্ঠ। ‘হিজ ফেভারিট পাস্টাইম’ (১৯১৪), ‘দ্য রাউন্ডার্স’ (১৯১৪) থেকে ‘সিটি লাইট’ মাতাল চ্যাপলিনের মগ্নচৈতন্যের শৈশবযাপন। যুক্তিবুদ্ধির ধারণা থেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে যা খুশি করা, কিছুক্ষণের জন্য শিশুসুলভ দুষ্টুমি করে চলা। স্ল্যাপস্টিক প্রদর্শনের এরকম সুযোগ চ্যাপলিন কখনো ছাড়েনি।

চিরাচরিত স্ল্যাপস্টিক, ‘এ নাইট ইন দ্য শো’ (১৯১৫)

চার্লির কথা ২: বন্দিত্ব ও একাকিত্ব বস্তিবাসীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। লাম্বেথের ওয়ার্কহাউসে একদিন তার মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হয়। জেরিমি বেন্থাম রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে বলেছিলেন প্যান-অপটিকনিয়ান। বলা নেই কওয়া নেই, সমাজসেবী পাদ্রির দল কোথা থেকে এসে নিয়ম নামক কবচ ঝুলিয়ে তার সাধের চুল কেটে দিয়ে চলে গেল! গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সমস্তরকম সমাজব্যবস্থায় মানুষ যে একটা সংখ্যার বেশি কিছু নয় চার্লি সেটা ঐ কম বয়সেই টের পেয়েছিল যখন সে দেখল আসলে নিজের শরীরটাও নিজের নয়। যে-শরীরকে সে চিরকাল ব্যবহার করেছে মানুষকে আনন্দ দিতে যে-শরীর তার শিল্পের যাপনভূমি সেইখানেই ঘটে গেল অতর্কিত হামলা। তার এই অভিজ্ঞতার কথা জানা থাকা দর্শক হিসেবে তার ছবি সমাদর করার প্রাক্-শর্ত।

মায়ের মধ্যে পাগলামির লক্ষণ দেখা দিলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। হানার পরিবারে মানসিক অসুস্থতার বেশ কিছু নজির আছে। হানার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া না কি সিফিলিস ঘটিত তা আজও পরিষ্কার নয়। মা হাসপাতালে চলে গেলে সরকারি নিয়মে চার্লি ও সিডনি কেনিংটনে তার বাবার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য গৃহকত্রী বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী লুইস ব্যপারটা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। খাদ্য জুটত কিন্তু তার থেকেও বেশি জুটত অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য। পরে মা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোলে তারা মায়ের সঙ্গে পাউনাল টেরাসের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। এখানে থাকা কালিন দারিদ্র্য চরমে পৌঁছোয়। আগের মতোই উপার্জনের নানা পন্থা এবং উপায় না থাকলে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়ানো এইভাবেই কাটত মায়ের নিত্যদিন। এই সময়েরই একটি ঘটনার কথা চার্লি অনেক জায়গায় বলে গেছে।

প্রথম দৃশ্য— মা বেরিয়েছে উপার্জনের জন্য। সিডনি কোথায় সে জানে না। ছাদের কড়িকাঠে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে, সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে চার্লির।

দ্বিতীয় দৃশ্য— বাইরে হঠাৎ হইচই-এর শব্দ। চার্লির তন্দ্রা ছুটে গেছে, সে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

তৃতীয় দৃশ্য— একটা আধপাগল ধরনের লোক মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে একটা ভেড়াকে তাড়া করে রাস্তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারের লোকজন বিশেষত চার্লির বয়সি ছোটোরা দারুণ উপভোগ করছে ব্যাপারটা আর হাততালি দিচ্ছে। চার্লিও দারুণ মজা পেয়েছে, সে অন্যদের সঙ্গে হাততালি দিতে দিতে দৌড়চ্ছে লোকটার পিছন পিছন।

দৃশ্য চার— রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁচ্ছে গেছে সবাই, লোকটা ভেড়াটাকে টেনে ঢুকিয়ে দিল একটা বাড়িতে। চার্লি চোখ তুলে দেখে সেটা একটা কসাইখানা! এই অনভিপ্রেত ঘটনার অভিঘাতে চার্লি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “ওরা একে মারতে নিয়ে যাচ্ছে!!”

১৯০১ সালে বাবা মারা যায়। দাদা সিডনি জাহাজে কাজ নিয়ে দূরে। চার্লি এই সময় মুদিদোকান থেকে মুচিগিরি সমস্তরকম কাজে নিজেকে যুক্ত করেছে, রঙ্গমঞ্চে গান অভিনয়ও চলেছে পাশাপাশি, বিদ্যালয়েও গেছে মাঝে মাঝে, আর শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছে উপলব্ধি করছে মানুষের স্বভাব ও মানুষের সমাজ। একদিন জানতে পারে মা সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে, তাকে আবার মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অসুখ তার আর কোনোদিনও সারেনি।

১৯১০ সাল নাগাদ চার্লি ব্রিটিশ মিউজিক হলের বিখ্যাত অভিনেতা ও স্ল্যাপস্টিক কৌতুকাভিনেতা ফ্রেড কার্নোর দলে যোগ দেয়। পরবর্তীকালে চ্যাপলিনের ছবিতে এর ওর মুখে বড়ো কেক বা পেস্ট্রি ছুড়ে মারার যে-দৃশ্যগুলি দেখতে পাওয়া যায় সেই স্ল্যাপস্টিক প্রকরণটি এই ফ্রেড কার্নোর মস্তিষ্কপ্রসূত, একে custard-pie-in-the-face gag বলে। ইনি ছিলেন স্ল্যাপস্টিক কমেডি এবং সাইলেন্ট কমেডির প্রবর্তকদের অন্যতম। এর হাত ধরেই চার্লির আমেরিকা যাত্রা ও ‘কমেডির রাজা’ ম্যাক সেনেটের ‘কিস্টোন স্টুডিয়ো’-তে যোগদান। এই বছরগুলিতেই স্ল্যাপস্টিক কমেডির উপযোগী শারীরিক দক্ষতা সে রপ্ত করে ফেলে, প্রায় স্প্রিঙের মতো বানিয়ে ফেলে শরীরটাকে। সঙ্গে লন্ডনের ‘ককনি’ বাচনভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে যা মার্কিন রঙ্গমঞ্চের জন্য একেবারেই উপযোগী ছিল না। পরে ‘এসানে স্টুডিয়ো’, ‘মিউচুয়াল ফিল্ম কর্পোরেশন’ হয়ে সব শেষে নিজে ‘ইউনাইটেড আর্টিস্ট’ তৈরি করে খ্যাতি ও সমৃদ্ধির শিখর ছোঁয়। মা তার সঙ্গেই ছিল আমেরিকাতে। ছেলের সাফল্য ও খ্যাতিতে যদিও সে নিস্তেজই থাকত। অবশেষে ১৯২৮ সালে তার মৃত্যু হয়।

চ্যাপলিনের কথা ২: বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের কাহিনি বলার কোনো দায় নেই বলেছিলেন বেলা বালাজ, জিভা ভের্তভের মতো চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকেরা। সেক্ষেত্রে মানতেই হবে চ্যাপলিনের সাইলেন্ট কমেডিগুলি বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের আদর্শ নিদর্শন। আর চ্যাপলিন সেখানে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকারী, একটা দাগ একটা ক্ষত। ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’-এর কথা ভাবুন, অভিজাতদের বাচ্চাদের গাড়ির রেসের ভিডিয়ো তোলা হচ্ছে সেখানে চ্যাপলিন ঢুকে পড়ছে বার বার! লাথি, গলা ধাক্কা যাই দেওয়া হোক সে নাছোড় বান্দা। একদম শেষে তাকে ভেংচি কাটতে দেখা যায় ক্যামেরার সামনে এসে। কতৃপক্ষ ও বড়োলোকেদের যাবতীয় ব্যাবস্থাকে সে যে সারাজীবন বুড়ো আঙুল দেখাবে এখানেই তার সূচনা হয়ে যায়। অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশের পর নানান অশান্তি করে ছবির মূল বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়া চ্যাপলিনের অনেক ছবিরই নিত্যদিনের ব্যাপার। এই ছবি থেকেই ভবঘুরে ঢোলা প্যান্ট টুপি ছড়ি ছোটো গোঁফের আর্কিটাইপ চ্যাপলিনের দেখা পাই আমরা। শোনা যায় ম্যাক সেনেটের নির্দেশে সে নিজেই তার এই রূপকল্প তৈরি করেছিল, অনেকে আবার বলে ঝড়জলের সন্ধ্যায় এইরকম দেখতে একটি মানুষের সন্ধান পেয়েছিল সে।

সেই বিখ্যাত ভেংচি, ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’ (১৯১৪)

‘ইজি স্ট্রিট’ (১৯১৭)-র একটি দৃশ্য আছে যেখানে চ্যাপলিন বাক্স থেকে খাবার বের করে বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে এমনভাবে যেন তারা মানবশিশু নয় তারা মুরগির ছানা! সের্গেই আইজেনস্টাইনকে এই দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে চার্লি বলেছিল, “জানেন তো— আমি এটা কেন করেছিলাম কেন-না শিশুদের আমি অপছন্দ করি। তাদের আমার ভালো লাগে না।” আপাত নির্মম এই কথার পিছনে লুকিয়ে আছে চার্লির বিপর্যস্ত শৈশব। প্রকৃতপক্ষে শিশু নয়, চার্লি অপছন্দ করত শৈশবকে। শিশুরা ছিল সেই অপছন্দের শৈশবের প্রতিমূর্তি।

‘শান্তি ও সমৃদ্ধির’ প্রতীক শ্বেত শুভ্র স্তম্ভের উদ্বোধন হবে। শহরের গণ্যমান্যরা উপস্থিত দলবল সমেত। পাইক-বরকন্দাজ পাদ্রি কেউ বাকি নেই। ঢাকা সরতেই দেখা যায় শ্বেত শুভ্র স্তম্ভের গায়ে কালো আঁচরের মতো কী একটা লেগে আছে যেন! ওহ্‌ ঐ শালা ভিখিরি ভবঘুরেটা! ঘুম ভেঙে উঠে হতভম্ভ চ্যাপলিন, তাকে যত নেমে আসার হুমকি দেওয়া হয় তত একবার তার প্যান্ট আটকে যায় মার্বেলের তলোয়ারে, একবার সে বসে পড়ে একটি মূর্তির মুখের উপর নিতম্ব রেখে! এদিকে বিউগল বেজে উঠতেই বাকিদের সঙ্গে সেও ঐ অবস্থাতেই স্যালুটের ভঙ্গি নেয়। বোঝা যায় ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত নয়। সমাজ যাদের ভুলে থাকতে চায় তাদের এরকম অবাঞ্ছিত উপস্থিতি দিয়েই শুরু হয় ‘সিটি লাইট’। ঝাঁ চকচকে শহরের অভ্যস্ত আলো নয়, যে-সব মানুষ বা যে-সব অঞ্চল ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রাত্যই থেকে গেছে, এই আলো সেই বাইরের নগরের। বস্তুত ‘সিটি লাইট’-এর সময় হলিউডে বাক্-চিত্র এসে গেছে। কিন্তু নৃত্যগীতবাদ্য মুখর কর্ণভেদী বাক্-চিত্রের বিপরীতে মাঝে মাঝে কিছু আওয়াজ ও নেপথ্যসংগীত ছাড়া ‘সিটি লাইট’-এর নির্বাক্‌ চলমান চিত্রমালায় এমন একটা সুখ ছিল যা এই ছবিটিকে শেষপর্যন্ত প্রায় মন্ত্রে-শান্তিতে উন্নীত করে দেয়!

সে এখানে স্বয়ং পাদ্রি এবং অবশ্যই অবধারিতভাবে জালি পাদ্রি, আদতে জেল পালানো আসামী। এদিকে শহরের শেরিফ চ্যাপলিন-আসামীকে চিনতে পারে ও তাকে বন্দি করে। কিন্তু তার উদারতায় ততক্ষণে সবাই মুগ্ধ তাই শেরিফ তাকে আমেরিকা থেকে পালিয়ে মেক্সিকোতে চলে যেতে সাহায্য করতে চায়। আমেরিকার সীমানায় নিয়ে গিয়ে যতবার তাকে মেক্সিকোতে পাঠানো হয় ততবার সে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে (নাকি বুঝতে না চেয়ে!) সীমানা টোপকে ফের আমেরিকা চলে আসে! শেষে বিরক্ত শেরিফ পশ্চাদদেশে লাথি মেরে তাকে মেক্সিকো পাঠিয়ে নিজে পালিয়ে চলে যায়। চ্যাপলিন তখন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়, এক পা আমেরিকার দিকে আর এক পা মেক্সিকোর দিকে দিয়ে লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে কী একটা গণ্ডগোল শুরু হয়েছে খুব গোলাগুলি চলছে। সে কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে ঐ লাইন ধরে দু-দিকে দুই পা রেখে দিগন্তের দিকে হাঁটা দেয় তার বিখ্যাত পাতিহাঁসের মতো হাঁটার ভঙ্গিতে! ‘দ্য পিলগ্রিম’ (১৯২৩) ছবির পরিসমাপ্তি ঘটে এখানেই। এই তার চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক ভাষা। প্রান্তবাসী অন্তেবাসী মানুষের প্রতিনিধি সে, তাই যেখানে দু-দেশের সীমারেখা সেখানেই তার বসবাস।

আমেরিকার স্টুডিয়ো সিস্টেম থুড়ি আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা তার এই ‘আঁতলামো’ ভালোভাবে নেয়নি। ‘মডার্ন টাইম্স’ (১৯৩৬) ছবিতে যন্ত্রপাতির ভিতরে ঘুরতে থাকা চ্যাপলিন তাই যতটা বোধ-বুদ্ধি রহিত প্রযুক্তির ব্যবহারকে ব্যঙ্গ করে ততটাই স্টার-ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের জাঁতাকলে তার কী অবস্থা হয়েছে সেটাও প্রকাশ করে। ব্যাপারটা ‘গোল্ড রাশ’ (১৯২৫)-এর সময় থেকেই শুরু হয়। চার্লির জবানবন্দি থেকে জানা যায় ক্লন্ডিক গোল্ড রাশের গল্পটা তার মাথায় আসে চিলকূট গিরি পথে যাবার সময়। নিজেকে নধর মুরগি হিসেবে ভাবার দৃশ্য পরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে আমেরিকার পথিকৃৎ একজনের নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ক্যানিবালিজ্‌ম-এর ঘটনা থেকে! চ্যাপলিন তাই মনে করত হাস্যরস আপাতবিরোধী কারণ তা উত্থিত হয় বিষাদ বা দুঃখ থেকে। উপহাসের ভিতর দিয়ে যে-হাস্যরস নির্গত হয় তা মানুষের অনেক অসহায়তাতে প্রলেপ দেয়, না হলে সে পাগল হয়ে যেত। নরভুকবৃত্তির এ হেন ব্যাঞ্জনা আমাদের হাসতে হাসতে স্তব্ধ করে দেয়। এই মুরগি অনুষঙ্গ রাষ্ট্রের চোখে আসলে ছিল প্রান্তিক মানুষের প্রতিমূর্তি!

নধর মুরগিরূপী চ্যাপলিন, ‘গোল্ড রাশ’ (১৯২৫)

এখান থেকে শুরু, ১৯৪০-এর ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ হাঁস জুতো টুপি ছড়ির ভবঘুরে চ্যাপলিন অন্তর্হিত, পড়ে আছে শুধু তার গোঁফটা! আসলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ চার্লির বন্ধু ভেনডারবিল্ট জার্মানি থেকে তাকে পাঠাতে থাকে কিছু পোস্টকার্ড। সেখানেই প্রথম চোখে পরে গোঁফ চুরির ব্যাপারটা! চার্লি লিখেছে সে-কথা, “ও আমার গোঁফ চুরি করেছে! ঐ গোঁফ আমি আবিষ্কার করেছিলাম! অবশ্য এই গোঁফ-সহ ওর মুখ আমার মুখের বাজে নকল— পুচকে ঠোঁট ও এলোমেলো চুল নিয়ে ঐ মুখে ফুটে উঠেছে অশ্লীল ভাঁড়ামো। হিটলারকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা আমি ভাবিওনি। কিন্তু যখন আইনস্টাইন ও টমাস মানকে জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে হল, তখন হিটলারের ঐ মুখ আর কমিক না থেকে হয়ে উঠল ভয়ংকর।” ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ শুরুর সময়ে খবর আসতে থাকে জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আমেরিকা-ইংল্যান্ড জল মাপতে শুরু করে, নাৎসি জার্মানিকে আপাতত চটানো যাবে না। ছবিটার বিরোধিতা শুরু হয়। বলা হয় ছবিটার মুক্তি এই দু-টি দেশে চিরকালের মতো নিষিদ্ধ করতে হবে। এদিকে ফ্রান্সের অঁদ্রে ম্যাজিনোর নামে নামাঙ্কিত ‘ম্যাজিনো লাইন’ নামক যুদ্ধের জন্য তৈরি দুর্গ ধূলিসাৎ হয়, ফ্রান্স অধীনস্থ হয় হিটলারের, অতঃপর ডানকার্কের দিকে এগিয়ে চলে রণতরী যুদ্ধ-বিমান। আমেরিকা প্রমাদ গোনে ও ডাক পড়ে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর! বলা হয় “তোমার ছবি তাড়াতাড়ি কর, সবাই অপেক্ষা করছে এটার জন্য।” কিন্তু ডিক্টেটর হ্যানকেল (হিটলারের নকল)-রূপী ইহুদি নাপিতের শেষ সম্ভাষণ মনঃপূত হয় না প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট-সহ গোটা মার্কিন সাংবাদিককুলের, বিশেষত, “in the name of the democracy— let us use that power— let us all unite…”। রাষ্ট্রশক্তি বুঝতে শুরু করে যা আগে কেবল সন্দেহ ছিল আজ তা প্রমাণিত হচ্ছে, এ-লোক খুবই বিপজ্জনক। ১৯৪৭-এ ‘মঁসিয়ে ভের্দু’ ঝড় বইয়ে দেয় আমেরিকা জুড়ে, বন্ধ করে দেওয়া হয় ছবির মুক্তি! নিজে বিবাহিত হয়েও, বড়োলোক মহিলাদের বিয়ে করা ও তারপর তাদের হত্যা করা এই এখন চ্যাপলিনের কাজ! সরাসরি পুঁজিরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ফতোয়া ম্যাকার্থি যুগে চ্যাপলিনকে দেগে দেয় আমেরিকাবিরোধী হিসেবে, দেশদ্রোহী হিসেবে, কমিউনিস্ট হিসেবে! যদিও তিনি এইচ. জি. ওয়েল্‌সকে বলেছিলেন, “আপনি যদি সমাজতন্ত্রী হন তাহলে বিশ্বাস করুন, পুঁজিবাদ বিনষ্ট, পৃথিবীর জন্য আর কী আশা থাকবে যদি রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র ব্যার্থ হয়?” ১৯৫২ সালে তাকে স্থায়ীভাবে মার্কিন দেশ ছাড়া করা হয়।

ডিক্টেটর হ্যানকেল (হিটলারের নকল), ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (১৯৪০)

প্রকৃতপক্ষে চলচ্চিত্রের আদি যুগে যে ক-জন বিরল প্রতিভাধর স্রষ্টার সৃষ্টি চলচ্চিত্রকে নাটক ও সাহিত্যের মধ্যবর্তী স্থানে উপনীত করেছিল চ্যাপলিন তাদের মধ্যে প্রধান বললেও অত্যুক্তি হয় না। ভঙ্গি, বেশভূষা, চরিত্রচিত্রণ সব কিছুর মধ্যে শুরু থেকেই তার স্রষ্টাসুলভ সাক্ষর বিদ্যমান, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বানিয়ে তোলা জিনিশ নয়, হয়ে ওঠা পদার্থ’। শিল্পের এই আদন্ত মৌলিক রূপ তার চলচ্চিত্রগুলিকে যেমন দিয়েছে বিশুদ্ধতার স্বীকৃতি তেমনই তার প্রতিভাকে করে তুলেছে শেক্সপিয়ারের সমতুল্য! কারণ, সেও শেক্সপিয়ারে মতোই বাণিজ্যের চলতি সবগুলি প্রথা মেনে নিয়েও স্তর-বহুল শিল্পী হতে পেরেছিল। অর্থাৎ, ভোক্তার তারতম্য অনুযায়ী তার আবেদনের স্তরও আলাদা-আলাদা, কিন্তু নিম্নতম স্তরেও বঞ্চিত হতে হয় না যেহেতু নিছক বিনোদন-উপভোগের সমান অংশীদার সবাই।

উপলব্ধি কী? চার্লির জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায়, “‘লাইম লাইট’ (১৯৫২)-এর ছবির চূড়ান্ত পর্যায়ে কমেডিয়ান ক্যালভেরোর উপলব্ধিই আমার উপলব্ধি: জীবন গতিশীল এবং তাই প্রগতি।” ‘লাইম লাইট’ ছবির শেষে পিয়ানো বাদকের ভুমিকায় যে-অভিনেতার দেখা পাই আমরা তার নাম ‘বাস্টার কিটন’। চ্যাপলিনের সমতুল্য প্রতিভার এই স্ল্যাপস্টিক কমেডিয়ানের সুদিন তখন পড়ে আসছে কিন্তু ক্যালভেরোর ভালোবাসা থেকে যায় তার প্রতি। চার্লি ও চ্যাপলিন সত্যিই কোনোদিন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। কি ‘মঁসিয়ে ভের্দু’-তে কি ‘সিটি লাইট’-এ, কি প্রতিবাদে কি প্রেমে, সদা প্রাণবন্ত এই ভাঁড় এই ভবঘুরে তাই আজও আমাদের এত প্রিয়। ক্যালভেরো মারা যায় টেরিকে প্রাদ প্রদীপের আলোর নীচে রেখে, কিন্তু আমরা জানি আর একজন চার্লি চ্যাপলিন (মৃত্যু— ২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৭৭) আর কোনোদিনও আসবে না এই পৃথিবীতে!

Facebook Comments

পছন্দের বই