লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

তোর্সা বোস

নাচনি নাচ

নাচনি নাচ বিষয়টি মূলত ঝুমুর গানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই নাচের ক্ষেত্রে মূলত উপস্থিত মহিলা নৃত্যশিল্পীগণ প্রথমেই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে স্মরণ করে বা এক প্রকার আসর বন্দনা দিয়ে নাচ শুরু করেন। এই নাচের বিষয়বস্তু থাকত মূলত রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ, রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিরহ লীলা ইত্যাদিকে ভিত্তি করে। প্রাচীনকাল থেকে মূলত পুরুলিয়া অঞ্চলের রাজদরবারে বিশেষত কাশিপুর রাজবাড়িতে এই নাচনি নাচের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই নৃত্যে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত মাদল, ঢোল, সানাই, সিংগা, হারমোনিয়াম প্রভৃতি কখনো কখনো এর সঙ্গে বাজানো হত আড়বাঁশি। সেই প্রাচীনকাল থেকেই নাচনিদলে সাধারণত দশ থেকে কুড়ি জন শিল্পী থাকতেন দলের প্রধান পুরুষকে বলা হত রসিক এবং যে-সকল মহিলারা নর্তকী হিসেবে দলে নাচতেন তাঁদেরকেই বলা হত নাচনি।

নাচনি প্রথার উৎপত্তি:

পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চলে নাচনি প্রথার শুরু হয়েছিল মধ্যযুগীয় শিল্পী বরজুরাম দাসের হাত ধরে। ইতিহাসের সূত্র ধরে যদি আমরা নাচনি নাচ কোথা থেকে এসেছে তা জানবার চেষ্টা করি তবে দেখা যায় যে, মূলত উত্তর ভারতের বাইজি নাচের যে-সংস্কৃতি তাকে অনুকরণ করে এই নাচনি প্রথা বাংলায় আসে। তবে এ-কথা প্রথমেই জানিয়ে রাখি নাচনি নাচে, কিন্তু কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা অংশগ্রহণ করতেন না। এতে অংশগ্রহণ করতেন মূলত নীচু সম্প্রদায়ের গরিব ঘরের মেয়েরা। নাচনিদের ইতিহাসে যিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন তিনি ছিলেন শ্রীমতি সিন্ধুবালা দেবী। যদিও উনি কাশীপুরের রাজবাড়িতে নাচনি হিসেবে যে-সমাদর লাভ করেছিলেন তা ওঁর নাগর বা রসিক চেপা মাহাতোর হাত ধরে। যদিও সমাজ এই নাচনিদের শিল্পীদের কখনোই ভালো চোখে দেখত না। কেবলমাত্র রাজ-রাজাদের বা সম্ভ্রান্ত জমিদারদের মনোরঞ্জন করাই ছিল এদের কাজ। নাচনিরা তাদের রসিককে কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকত। শিখত নাচ গান, অর্থাৎ, এই রসিকই ছিলেন এদের জীবনসঙ্গী আবার শিক্ষাগুরু। তবে এইসকল রসিকদের কাছে যে-সব মেয়েরাই নাচনি হিসেবে যোগ দিত তারা অনেকেই ছিল পথভ্রষ্ট। এইসকল নাচনিরা কখনো হয়তো বাবা-মায়ের অর্থকষ্টের কারণে বিক্রি হয়ে গেছে শিশুকালেই কোনো-না-কোনো রসিকের কাছে। জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ কী তা তারা কখনোই দেখেনি রসিকের সাথে এদের জীবন কাটত নানান সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। রসিকরা এদের নাচ গান শিখিয়ে অতি দ্রুত নিজেদের মনের মতন করে গড়ে তুলতেন। নাচনি মেয়েদের কাজ হত গ্রামের রাজা কিংবা জমিদারদের মনোরঞ্জন করা কিন্তু তার বিনিময়ে এরা কখনোই যোগ্য মর্যাদা বা ন্যূনতম সম্মানটুকু পেতেন না। সম্ভ্রান্ত সমাজ এদেরকে মানুষ বলি বলেই গণ্য করতেন না। একসময় কোনো নাচনি মারা গেলে তার দেহ সৎকার পর্যন্ত করা হত না। পায়ে দড়ি বেঁধে ধাঙ্গড় দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে কোনো ভাগাড়ে সেই নাচনির মৃতদেহ ফেলে আসা হত। কী মর্মান্তিক তাদের জীবনের শেষ পরিণতি নাচনিদের জীবনের এই ইতিহাস অনেকটা যেন বাংলার বাউলানি, অর্থাৎ, যারা বাউলদের সঙ্গিনী তাদের সঙ্গে মেলে। যদিও এই বাউলানিরাই বাঁচিয়ে রাখে তাদের বাউলদেরকে কিন্তু শেষ জীবনে তাদেরও অবস্থা হয় এই নাচনিদেরই মতন। বর্তমানকালে একজন উল্লেখযোগ্য এবং স্বনামধন্য নাচনি শিল্পী হলেন শ্রীমতি পস্ত বালা দেবী কর্মকার। ২০১৮ সালে তাঁকে লালন পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। যদিও আজ যে আমরা তাঁকে খ্যাতির জায়গায় বসিয়েছি লালন পুরস্কারে ভূষিত করেছি তা কিন্তু তাঁর জীবনে এত সহজে আসেনি। পস্তবালার জীবনের ইতিহাস ভীষণই করুণ। তাঁর মা বিমলা দেবী ছিলেন একজন নাচনি যিনি তৎকালীন জমিদার বাড়িতে নিযুক্ত ছিলেন। পস্ত বালার ক্ষেত্রে তাঁর মা-ই নিজে তাঁকে এই পথে এগিয়ে দেন। পেটের দায়ে সেই ছোট্ট পস্তবালা নানান লোকের বাড়িতে ঘরের ফাইফরমাশের কাজ, ঝিয়ের কাজ এমনকী ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে একজন অতি বৃদ্ধের সঙ্গে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। স্বভাবতই এই বিয়ে তাঁর ক্ষেত্রে সুখের হয়নি। নানান অত্যাচার সহ্য করে একসময় তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। এর পর তাঁর জীবনে নাচের হাতে খড়ি হয় শ্রদ্ধেয়া সিন্ধু বালা দেবীর কাছে। এর পর তাঁর জীবনে রসিক হয়ে আসেন বিজয় কর্মকার। ভালোবাসার টানে তিনি ঘর বাঁধেন বিজয় কর্মকারের সঙ্গে যদিও বিজয় ছিলেন বিবাহিত এবং কয়েকজন সন্তানের পিতা। পস্ত বালা নিজেই বলেছেন রসিকের বাড়িতে এসো তাঁর কপালে সুখ জোটেনি বরং রসিক তাঁর নিজের পরিবার বাঁচাতে পস্তর উপার্জন করা পয়সা আত্মসাৎ করে নিতেন। এভাবে দিনের পর দিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কাটাতে কাটাতে একসময় শুরু হয়, কিছু শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হাত ধরে এই নাচনিদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলন। অবশেষে ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নাচনিদের স্বীকৃতি দেন তৈরি হয় মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নাচনি উন্নয়ন সমিতি। যেখানে এখন সম্পাদিকা আসনে রয়েছেন পস্ত বালা দেবী। যে-রসিক বিজয় কর্মকারের বাড়িতে একসময় তাঁর জায়গাটুকুও জোটেনি আজ নিজের অধিকারে তিনি সেই জায়গা করে নিয়েছেন। যথেষ্ট সমাদর করা হয় তাঁকে। তাঁর নিজস্ব একটি বাসস্থান হয়েছে। বহু জায়গা থেকে ডাক আসে তাঁর, গ্রামে গ্রামে এমনকী শহরেও তিনি নৃত্য পরিবেশন করতে আসেন। যদিও এত কিছু সত্ত্বেও নাচনিদের নৃত্যের যে-ভঙ্গিমা বা শৈলী তা কিন্তু আজও আমাদের বাবু সমাজ বা তথাকথিত সভ্য মানুষরা ভালো চোখে দেখেন না তবে যেহেতু এটি একটি অতি প্রাচীন লোকসংস্কৃতির বা আদিমতম একটি লোকনৃত্যের অঙ্গ বা অংশ তাই তাঁদের সেই মৌলিকত্বকে খণ্ডন করার বা অস্বীকার করার কোনো অধিকারই আমাদের নেই।

বর্তমানকালের নাচনি এবং তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থান:

পূর্বের সিন্ধু বালা দেবী বা বর্তমানের পস্ত বালার মতো এখন আরও যে-সব নাচনি শিল্পীরা রয়েছেন যেমন বিমলা দেবী, সরস্বতী দেবী এঁদের মতো গুটিকয়েক শিল্পীরাই কিন্তু কেবলমাত্র এখন আর এই পেশার সঙ্গে টিঁকে আছেন। এঁদের পরে জানি না আর কে বা কারা এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, কারণ, কী-ই-বা আছে এঁদের? সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত না আছে এই শিল্পীদের জীবনে কোনোরকম কোনো নিশ্চয়তা, সম্মান, যোগ্য মর্যাদা, যোগ্য মজুরি কিংবা দু-বেলা দু-মুঠোভাতের জোগান। যদিও-বা আগেকার দিনে এইসকল নাচনিদেরকে অন্তত কাজ দিয়ে জমিদারবাড়ি কিংবা রাজদরবারের রাখা হত এখন সেই রাজাও নেই রাজদরবারও নেই ফলে নেই নাচনিদের খোঁজ। এখন এইসব নাচনিদের দেখা পাওয়া যায় পুরুলিয়া এবং তাঁর আশেপাশের অঞ্চলে যে-সকল পালা-পার্বণ বা মেলা হয় তাতে, কিন্তু তা আর কতই-বা হয় আর তা দিয়ে তাঁদের কী-ই-বা অর্থ আসে হাতে। ফলে অর্থের এবং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই শিল্প আজ ধ্বংসের সম্মুখীন।

নাচনি সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা:

লোকসংগীতের একজন ক্ষুদ্র গবেষক হিসেবে একসময় জানতে চেয়েছিলাম পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিকে আর সেই সুবাদেই পুরুলিয়ায় বা পুরুলিয়ার আশেপাশের বেশ কিছু মেলা কিংবা বা বাধনা, মকর, টুসু ইত্যাদি পালা পার্বণে ছুটে যেতাম। এমনই একবার শীতকালে পুরুলিয়ার একটি জনপ্রিয় বাৎসরিক মেলায় (সৃজন উৎসবে) উপস্থিত হই। সেখানে নানা শিল্পীদের আগমন, নানারকম শিল্পের সম্ভার, বলা যেতে পারে গোটা ভারতবর্ষে যেন সেখানে এসে হাজির হয়েছিল এবং তার পাশাপাশি ছিল এই হারিয়ে যাওয়া নাচনিদের দলও। উৎসুক মনে গিয়ে দাঁড়াই সেই নাচনি দলের কাছে। যদিও যতদূর মনে পড়ে, তাঁরা মেতেছিলেন তাঁদের নিজেদের দলের মানুষদের সঙ্গে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মতো শহুরে মানুষদেরকে আশেপাশে দেখলেও এঁরা একটু ভয়ই পান। যাইহোক খানিক ইতস্তত হয়েও এগিয়ে যাই এঁদের সঙ্গে আলাপ জমাতে প্রথমেই মাঝবয়সি যে-মহিলা নাচনি শিল্পীরা সঙ্গে কথা হয় তাঁর নাম ছিল কাজল বালা দেবী। কথায় কথায় জানতে পারি তাঁর বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি। অনেক ছোটো বয়স থেকেই তিনি এই পেশায় আসেন। তাঁর মাও ছিলেন পেশায় একজন নাচনি। আর তিনিও একটা বয়সের পরে এই পেশায় আসেন। তাঁর জীবনেও আছে রসিক যদিও এই রসিক পরিবর্তন হয়েছে দু-একবার। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর জীবনের প্রথম রসিক তাঁকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। তারপর আসেন দ্বিতীয় জন, এখন তিনিই তাঁর স্বামী বা রসিক। আলাপ জমতে থাকে ক্রমশ। জানতে চাই তাঁদের এই যে অপূর্ব সাজসজ্জা তার সম্পর্কে। কীভাবে এঁরা তাঁদের কেশবিন্যাস করেন বা কী কী অলংকার পরেন এই নাচনি নাচের সময়। নিজের চোখেই দেখি খুবই রংচঙে সাজগোজ বাহারি শাড়ি হাতের চুরি গলায় মালা ইত্যাদি। উনি ওঁর সাধ্যমতো উত্তর দেন তবে এরই মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উনি দেয় যে, তা হল এঁদের সাজ-পোশাকের ক্ষেত্রে কোমরে একটি কোমরবন্ধ পরা হয়। যেটি কিনা এই নাচের সাজসজ্জার একটি বিশেষ অলংকার। এর পরে শুরু হয় তাঁদের নাচ সঙ্গে ঝুমুর গান দুই মিলে তৈরি হয় স্বর্গীয় পরিবেশ আমিও হারিয়ে যাই সেই আদিরসের সুরে। বেশ রাতের দিকে থামে এঁদের পরিবেশনা। ভেঙে যায় মেলা। আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলি আমার ডেরার দিকে। ফেরার পথে ভাবতে থাকি কাজল দেবীর সাথে বলা কথাগুলো সম্পর্কে। আহা, কী আফসোস তাঁর কণ্ঠে ছিল। পরিষ্কার বলেছিলেন, আজকাল আর ক-টা জায়গাতে নাচনি নাচের আসর বসে আর বসলেই-বা আমাদের কী-বা এমন পাই? খুবই কম টাকা দেয়। এমনকী কোথাও কোথাও তো রাতের খাবারটুকুও তাঁদের দেওয়া হয় না। ভাবছিলাম তবে কোথায় উন্নত হল আমাদের সমাজ? আমরা তো আমাদের আদিমতম সংস্কৃতির কথাই ভুলতে বসেছি। তার বদলে জায়গা নিয়ে নিয়েছে সস্তার চটুল সংস্কৃতি। আচ্ছা যাঁরা আজও নাচনিদের সেই আগেকার দিনের মতোই খারাপ চোখে দেখেন, নাচনি মানেই খারাপ পথে যাওয়া মেয়ে মানুষ তাঁরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন কেন নাচনিদের নাচে গানে অশ্লীলতা (যদিও কোনটা অশ্লীলতা আর কোনটা শ্লীলতা এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার) প্রয়োগ রয়েছে? আসলে আমরা ভাবি বড়োই কম আর সেই কম ভাবনার উপর মন্তব্য করি বা নিজেদের ভাবনাকে চাপাই অনেক বেশি তাই হয়তো নাচনিরা আজও সমাজের সেই অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। যে-নাচনি নাচের ভঙ্গিমা বা শৈলীকে অশ্লীল বলা হত বা আজও বলা হয় তা কীসের জন্য তার জন্য দায়ী ছিল তৎকালীন উচ্চবিত্ত বাবুসমাজ। উচ্চবিত্তদের অতি স্থুল রুচিবোধেই তো ছিল নাচনিদের নৃত্যের যে-কুরুচিকর ভঙ্গিমা বা শৈলী তার কারণ। বাবুদের মনোরঞ্জনের চাহিদা মেটাতে এই নাচনিরা নাচের সাথে কিছু অশ্লীল দেহ-ভঙ্গিমার আশ্রয় নিয়েছিলেন তাহলে এতে নাচনিদের দোষ কোথায়?

উপসংহার:

পুরুলিয়া তথা মানভূমের লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের পাতা থেকে নাচনি নাচের আজ যে-অবলুপ্তি তার জন্য কিন্তু দায়ী আমরাই, কারণ, সিন্ধু বালা, পস্ত বালা কিংবা এঁদের পরে আর সামান্য কয়েকজন যাঁরা আজও খুব কঠিনভাবে এই শিল্পকে বুকে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন এঁদের পরে এই শিল্পকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আর কিন্তু কেউ নেই। কারণ, সমাজ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি আজকাল আর পুরুলিয়া বা তার আশেপাশের অঞ্চলের মেয়েরা এই নাচনি গানের সঙ্গে যুক্ত হতে রাজি নয়। তাঁরা বরং লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরির খোঁজে পাড়ি দেয় দেশের নানা প্রান্তে। যদিও যুগের পরিবর্তন অনুযায়ী অতি স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু তবুও কি এমনভাবে এইরকম একটি সুপ্রাচীন শিল্পকে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেখা যায়? এ কি মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক নয়? আজও যাঁরা লোকসংস্কৃতি লোকসমাজ কিংবা লোকশিল্প নিয়ে বিন্দুমাত্র হলেও চিন্তিত এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী সেইসকল শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদেরকে উচিত নয় কি সরকারের দরজা অবধি এই নাচনি শিল্পের কথা পৌঁছে দেওয়া? যাতে কেবলমাত্র গুটিকয়েক নাচনি শিল্পীকে কেবলমাত্র বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত না করে এই সমগ্র শিল্পটিকে পুরুলিয়ার অন্যান্য যে-সকল সমাদৃত শিল্প যেমন ছৌ নাচ কিংবা ঝুমুরের কাছাকাছি নিয়ে আসা অথবা এর পাশাপাশি সরকারের দৃষ্টিপাত করা উচিত যাতে আজও যাঁরা নাচনি পেশায় নিযুক্ত তাঁরা যাতে পুনর্বাসন কিংবা মাসিক একটি ভাতা বা বার্ধক্যের জন্য সুচিকিৎসার সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি সরকার এবং লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন তাঁদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন বা আবেদনে বলা চলে যাতে করে একাডেমিক স্তরে এই নাচনি শিল্পকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। যাতে অন্তত কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী যোগ দেয় এতে। নাচনি গান বা নাচ আসলে কি তা তাঁরা যেন শেখে এবং এর ফলেই একদিন আশা করা যায় হয়তো এঁদের হাত ধরেই বর্তমানকালের কিছু পরিবর্তনকে সঙ্গে রেখেই এই নাচনি শিল্প আবার উঠে আসবে। এতে যেমন করে এই শিল্পটি আবার প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি বাঁচবে এই শিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রান্তিক শিল্পীরা। কারণ, আমরা সকলেই জানি শিল্পী বাঁচলে তবেই শিল্প বাচবে। যে-নাচনিদের পায়ের ঘুঙুরের তালে মেতে ওঠে রসিক দর্শকেরা বা শিল্প অনুরাগীগণ সেই নাচনিদের পায়ে যেন আর কোনোদিনই তাঁদের মৃত্যুর পরে দড়ি বেঁধে টেনে না নিয়ে যাওয়া হয়। যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার পাশাপাশি, অন্তত মৃত্যুর পরে যেন তাঁরা তাঁদের শেষ কৃত্যের যোগ্য মর্যাদাটুকু পায়।

Facebook Comments

পছন্দের বই