লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

অনিকেশ দাশগুপ্ত

চাঁদের ডিঙা

জঙ্গল-রমণীর মতন জোয়ার-চাঁদটি
মুছে ফেলল সমস্ত পশ্চিম, নীল তাঁতের সীমানায়—
দু-খানি আদুর উৎস থেকে ঝরে পড়ল চাঁদনি গাঙ,
পার্বত্য মেষের বিতান ছিল এমন এক; নতুন পাতার—
ঘ্রাণে ভরে ওঠা মাঝরাতের অরণ্য কীভাবে যে
শালের মদে পোয়াতি হয়ে উঠত ধীরে-ধীরে, নীল ঠোঙার
খাঁজ, নুনে-ঠেকানো-জিহ্বা আর বিষের কালো খনি—
একাকার হয়ে কুমকুমের গাঢ়-কিশোরী-ছোঁয়া বয়ে বেড়াত,
মৃণালে তার চাঁদের কত পঙ্‌ক্তি, কাজলের বেড়ি—
নিরন্ন বোবা আঙিনায় আইবুড়ো বৃক্ষ-দুহিতাটির চারপাশে
সাদা মাড়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে ভাসিয়ে দিত আকাশী ডিঙা

সমাধি

যেদিন ফিরে এলাম প্রাচীন এ-সমাধিপ্রাঙ্গনে
ঘাসের শতসহস্র মণির অন্তরে লুটিয়ে পড়ে শরীর ভরে যেন
মুগ্ধ সবুজ সর, আকাশ-নীল কাঁটার মতো সুউচ্চ বৃক্ষকামে
মেনে নিলাম তীব্র বসতি, সোপানের আশ্চর্য শ্লথ ফাটলে
আঙুল রেখে একটি স্ফুরণে পরিপূর্ণ হল নিঃসীম
বাগিচা, রঙিন বাস্কেট থেকে সরীসৃপ চক্ষুর মতো মনে হল
ঘাস-লতা, বাবুই-আঁশ; নখের ডগায় এই এক কণা অভ্রের বাতি
পুরোনো জানলার পারে ছড়িয়ে পড়ল, তালপাতার হাওয়ায়
জ্যোৎস্না-হৃদয়গুলির এপার-ওপার ভেদ করে সহস্র
বছর ধরে উড়ে এল ঘাসের আত্মা

আষাঢ়

হলুদ শিখাটিকে লক্ষ করে ছুটে চলেছে
নিদ্রাতুর পাতার ওপরে ময়ূরবর্ণের মেঘ-পুঞ্জ
রানির অন্তিম জরি থেকে নানান ছল ও কৌশলের
নাতিদীর্ঘ স্বচ্ছতা, অন্তহীন জলছাপ রেখে পাখির শ্যামলিমে
হারায়, হারায় আলোকোজ্জ্বল সাইকেলে প্রথম নিষ্ক্রমণ
একে-একে, জ্যোতিষ্কপারে রুধিরে চন্দ্র-হংসের দীঘলতায়,
অরব মর্ষকামী ওষ্ঠে লেগে থাকে মীন-চাঞ্চল্য
পাখোয়াজ-নীল তরঙ্গে বিবশ কাঁচুলি ও-ঘাটে—
শ্রী-অঙ্গে ভিজেছে কোন দূরের জলতিলক-নারী-ঘাস
সারসের নিবিড় রক্তিমতা ছুঁয়ে নেমে আসে অলক্ষ্যের আকাশ

চৌকাঠ

কখনো-বা মোড় ঘুরেই আবিষ্কৃত হত বিবশ নদীর প্রিয়তমা,
নীল অরণ্য-চাদরে মাথা পেতে দেখতাম শীর্ণ সৌর-পথ
তিরের অন্তিম আবেগ আর একটু পরেই যেন থিতিয়ে পড়বে
শতসহস্র বৃক্ষশাবকে; বঙ্কিম সমুদ্রধারে এমনই এক সান্ধ্য
লাইটহাউসে আমরা, জন্তুদের কর্কশ দেহতল
উপড়ে ফেলেছিলাম

সাদা ধাতব মার্জনার ঠোঁটে লেগে থাকত মদ, চূর্ণ চন্দ্রদ্বয়,
মগ্ন পিপুলের নীচে বিষাক্ত দাঁড় টেনে-টেনে কখন যেন
ক্ষয়ে যেত সে-বিশুদ্ধ বজ্রসুখ, নীরক্ত অটল সমৃদ্ধির

ট্রামডিপোর অন্য প্রান্তে

ডিপোর বিজ্ঞাপনগুলি এমন মেঘলা দিনে
নীল সীমন্তের বঙ্কিম ট্রামসারিতে কাঁপা-কাঁপা তর্জমায়
উঠে আসে, তেঁতুলবীজের চুরমার ধ্বনিতে
বাদামি টেলিগ্রাফ তার থেকে
নিঃসীমে সরোবর কোণে উড়ে গেলে তুমি
যেন কোনো পতঙ্গবিদের
গাঢ় অসীম বীক্ষণ, নরম আরক্তিম এই পাদানিতে তখন
ঝড় বয়ে এসেছিল অন্য আর এক শতাব্দীর

বাজখাঁই খামের হাঁ থেকে সারি-সারি অশ্বখুরাকৃতি মঞ্চ
নেমে এলে নিমেষেই ধরে ফেলা হচ্ছিল অনন্ত সপ্তক
মন্দ্রে জোনাকিদের ঢেউ—

ইস্কাপনের সোনালি রিম থেকে তোমায় দেখেছি এলোমেলো
কানামাছির মতো কাদার মণ্ডে চমকপ্রদ ছুরি গেঁথে ফেলতে

 

Facebook Comments

পছন্দের বই