লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

বন্ধুসুন্দর পাল

ভিতরে

ভিতরে আলাপ, আর কত কাছে যেতে হবে!
শুকনো পাতার দলে
কাঠকুড়ুনির পায়ের আওয়াজ বেচে
নামিয়ে এনেছে যে আমাকে
তার অবসর কেন শুধু আমি একাই গ্রহণ করব!

সে কি আশ্রয়ের চেনাশোনা কেউ?
অথবা পালতোলা নৌকা, যার শুধু বিরহ দিয়েই মাথা ঢাকা
নিচে, প্রেমিক-প্রেমিকারা পয়সা দিয়ে একঘণ্টা সময় কিনে নিচ্ছে ইচ্ছেমতো…

তা দিয়েই পেট চলে অপূর্ণ নদীর
ভেসে যাই আমি যার নির্দেশে, অতলে
সেও কি ভিতরে ডাকে! আমি সাড়া পাই…

অথবা স্তনহীন বৃদ্ধা, যে, মাছের পেটের ভিতর
আজন্ম যৌনতা চাপা দিয়ে সে পালিয়ে বেরিয়েছে
নদী থেকে সমুদ্রের তলা ভেদ করে

আর তার উপর দিয়ে একটা শকুন কার যেন মরা-চোখ খুবলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে
তাদের কি শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হইল…

বাহানা

ফুরিয়েছে গৃহকোণ, ফুরিয়েছে আলো-চাল
ফুরিয়েছে ব্যথা

এসো চিঠি খুলে চিনি, এটা কার হাতের-লেখা

চিনেছি নোলক পড়া নাকের বাগান
চিনেছি ভাতের ফ্যান
গড়িয়েছি বালিমাখা মুখের বেগম

এত যে ঐশ্বর্য, তা কি অশৌচের কেউ নয়?

এসো হে জীবন, আমাকেও ছুঁয়ে দ্যাখো,
কেমন তোমার অতিমারির বাহানা…

পায়রা

সাধনা বিলিয়ে দিচ্ছি, ফিরে তাকিয়ো না, প্রিয় মুখ। অথৈ অবজ্ঞার অনুষ্ঠানে পাতপেরে খেতে এসো আলো। তোমার নাভির নির্মাণকার্য শেষ হলে একটা পায়রা পুষব সেখানে। সারা গায়ে তখন অনুরোধের আসর বসবে। তোমাকে যারা অনুশোচনার মতো দেখতে বলে বিদ্রূপ করত চিলেকোঠার ওপার থেকে, তাদের শরীর বেয়ে আকন্দফুল ঝরে পড়বে। আমার শীতলতা গ্রাস করো, বর্ণা, এই জঙ্গল আমাকে অশৌচ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তোমার কাছে। ব্যাপ্তির তলদেশ ফাঁক করে যে-ক-টা শুকনো কাঠ কুড়িয়ে এনেছি, সেগুলো একান্তই শুধু আমার। সেখানে যে-সব শব্দ জোর করে ভাগ বসাতে আসবে তাদেরকে বৈধব্য আগুনে পুড়ে মরতে হবে। আমার শরীরে কোনো সিঁড়ি নেই, তুমি যেখানেই পা ফেলবে সেখানেই পোড়া কাঠ দেখতে পাবে। এভাবেই এক পা এক পা করে পা ফেলতে ফেলতে, ক্লান্ত হয়ে যখন আমার চিলেকোঠার ছাদে গিয়ে একদিন বসবে, তখন সমস্ত পোড়া কাঠ পায়রা হয়ে পুরো ছাদ সমেত তোমাকে ঘিরে ফেলবে। তোমার আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই…

ক্ষমা

জবরদখলকারী বিদ্বেষের মনোরম আতিথেয়তা আমাকে স্বীকার করবে বলে আলোরা দরজার সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। আমার সারা শরীর তখন ঘুমে ঢাকা। অতল মিশিয়ে দিয়েছে যে, তার কোনো বিকেলের ফেরিওয়ালা নেই। সন্ধ্যেবেলার গুমোগন্ধে যে-কাঁথাটা লাজুক কবিতার নিম্নদেশে এসে বার বার চিৎকার করে বলছে, ‘আমি তাকে চিনি!’ তবুও রাজহাঁসের মনখারাপে পুকুরপাড়ে মেঘ করে আসে না। ঘাসেদের সংগমের শব্দকে কোনো পাগল আর প্রেমিকা বলে ডাকে না। তবুও তোমার পিঠ বরাবর যে-শব্দ গড়িয়ে পড়ছে আমার অতল ভেঙে, ক্রমশ নীচে আরও নীচে, তাকে তুমি ‘ক্ষমা’ বলে ডেকো…

সমঝোতা

আশ্রয়ের দিকে মুখ না ফিরিয়ে যে চলে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড পৃষ্ঠা ভরে, তার দিকে সময় হাঁ করে ঢোঁক গিলে নিচ্ছে। এই যে বিষম খাওয়া জলজ সময়, এই যে আলজিভে কবিতা লুকিয়ে রোদের পিঠে ছুরি মারা অবয়ব, যা তাকে সম্পূর্ণতা দিয়েও হিসেব করতে বসেছে, তার কোনো পটচিত্র নেই আমার এই ঘুমন্ত বিছানায়। আমার পাশ ফেরার আগেই যে-জানালা রোজ উলঙ্গ কাঙালপনায় অক্ষরের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছে, আমাকে দোষী সাব্যস্ত প্রমাণ করে আমার থেকে ভোরবেলা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, তার থেকে আমি কখনো সকাল ভিক্ষে করিনি ।

আয়োজনে যে-আলো শরীর ঢেকে দেয়, তারও তো বৈশাখী ঝড়ে উড়ে যেতে মন চায়। এই নির্ভরতার উপোসবেলা ভেঙে যে আজও প্রতিটা ঘরের দোরে দোরে সন্ধ্যে দেওয়ার জল পড়ার শব্দ শোনে তার কাছে থেকে একটা অন্ধকার চুরি করে পালিয়ে বেরিয়েছি। তুমি আমকে শাস্তি দেওয়ার ছলে একবার অন্তত জড়িয়ে ধরো, দ্যাখো, আমি কেমন বিচ্ছিন্ন হতে হতে একটা নতুন শব্দের মতো চুপ করে শুয়ে আছি তোমার কোলে। কেউ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর তোমাকে খুঁড়তে যে-সব শব্দকর্মীরা এসেছিল, তারা কেউ পারিশ্রমিক না পেয়ে জেলে হয়ে গেছে…

 

Facebook Comments

পছন্দের বই