লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

অমিতরূপ চক্রবর্তী

বাঁশি

জুনের গনগনে দুপুরে চওড়া পিচরাস্তার ওপর নিমাই মোহন্তকে লাগছিল একটা ধূমকেতুর মতো। ধূমকেতুর পেছনে যে-গ্যাস আর আগুনের পুচ্ছ থাকে, নিমাই মোহন্তের পেছনে সেখানে একদল নারী-পুরুষ। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সচেতনতামূলক একটি মিছিল বের করেছে নিমাই মোহন্ত। মিছিলটি শুরু হয়েছে চড়াইমল থেকে। যাবে ধারসি নদীর চৌপথি পর্যন্ত। চেপানি হল্টের মোড়ে দেবু ডাক্তারের হোমিয়ো ফার্মেসি যথারীতি খোলা। পুরোনো লালচে রঙের একটা টেবিল ক্লথ পাতা টেবিলে ছোটো বড়ো নানা আকৃতির হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের শিশি-বোতল সাজিয়ে কাঠের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে একমনে আজকের খবরের কাগজটা পড়ছিলেন দেবু ডাক্তার। দেবু ডাক্তারের কাঠের চেয়ারে একটা ময়লা, সাদা রঙের তোয়ালে পাতা। তার এক কোনা দেবু ডাক্তারের কোমর ও পাছার ঘষটানিতে ঝুলে পড়েছে ক্রমশ কাঠের প্ল্যাংকিনের দিকে। দেবু ডাক্তারের পায়ের পাতাদুটো টেবিল ক্লথের নীচে টেবিলের পায়ার ওপর ক্রস করে রাখা। ডান দিকে রোগিদের বসার জন্য দুটো কাঠের লো বেঞ্চ রাখা আছে। বেশিরভাগ দিনই সেই বেঞ্চিগুলো শূন্যতায় ঠা ঠা করে। আজও করছে। দেবু ডাক্তারের হোমিয়ো ফার্মেসির ডান দিকে প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে রতনের পানের দোকান। দোকানের সামনে পানমশলা, গুঠখা, চিপসের ঝালর। দোকানের ভেতরে রতনের পেছনে একটা কাঠের পাটাইয়ে বসে সিগারেট টানছে কয়েকটি ছেলেছোকরা।

পিচ রোড থেকে ক্ষুদে একটা মানুষের মিলিত গলার শব্দ পেয়ে দেবু ডাক্তার খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে শব্দ যেদিক থেকে আসছিল, সেদিকে তাকালেন। মিছিলটা তখন চেপানি হল্টের চৌপথি ছাড়িয়ে দক্ষিণে ধারসি নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পাপেট শো-এর পাপেটের মতো মিছিলের মুখে নিমাই মোহন্ত বাতাসে হাত ছুড়ে কী যেন বলছে, আর সেই শব্দটা পেছনে থাকা মানুষগুলোর মাথার ওপর দিয়ে হেঁটে বা মানুষগুলোকে ফুঁড়ে উলটো দিকে চলে যাচ্ছে। পিচ রাস্তাটা আন্তঃরাজ্য ফোর লেন হবার দরুন এমন জুনের গনগনে দুপুরে সেই রাস্তায় উড়ছে তপ্ত ফুরফুরে হাওয়া। রাস্তার উত্তরে একটা মাঠের মধ্যে মানিক রায়ের দাদার বসতবাড়ির সুপুরিগাছগুলো সেই হাওয়ায় অল্প অল্প দোল খাচ্ছে। দেবু ডাক্তার খবরের কাগজে ফিরে আসতে আসতে মনে মনে বললেন, যত্তোসব আকামের কাম।

নিমাই মোহন্তের বাঁ-চোখটা নষ্ট। ছেলেবেলায় বাঁশের আর্চারি খেলতে গিয়ে নষ্ট হয়েছে। ঘেমে নেয়ে ওঠা চশমা দিয়ে নিমাই মোহন্ত ক্রমাগতই মুখটা ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে লক্ষ্য করছিল আশেপাশের প্রতিক্রিয়া। তার নেতৃত্বে মিছিলটি এখন চওড়া রাস্তার বাঁ-দিকে গমগমে দোতলা স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসটাকে রেখে আরও দক্ষিণে ধারসি নদীর চৌপথির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চায়েত অফিসটা পার হলে এ-দিকে বসতভিটে খুব ছাড়া ছাড়া। জমি-জিরেতই বেশি। কিছু অর্ধসমাপ্ত দালানবাড়ির গাঁথুনি। পাটের পাঁজা। মাটি কাটার জেসিবি থামিয়ে নিথর করে রাখা। এগুলো পেরুলে ছায়ামণি পোদ্দারের দু-কামরার বাড়ি। প্রায় রাস্তার ধারেই। সামনে ঢেউটিনের বানানো ঢলঢলে গেট। নিমাই মোহন্ত মিছিলের লোকগুলোকে চাঙ্গা রাখতে একটা স্লোগান দিচ্ছে নির্দিষ্ট বিরতিতে, গাছ লাগাও/প্রাণ বাঁচাও কিংবা সবুজ নিধন বন্ধ করো ইত্যাদি। ইতিমধ্যে মিছিলটির পাশ দিয়ে বারোবিশার দিকে বা বারোবিশা থেকে আলিপুরদুয়ারের দিকে বেশ কতগুলো সরকারি বাস, যাত্রী বওয়া সুমো গাড়ি, কয়েকটি যুদ্ধব্যস্ত বাইক আর নিতান্তই শালিখ শালিখ চেহারার কয়েকটি সাইকেল চলে গেছে। নিমাই মোহন্ত মনে মনে যেন একটু হতাশ। যেন ভাবনার ভেতর প্রকাণ্ড ফোলা একটি বেলুন লিক করে চুপসে যাচ্ছে। চড়াইমল থেকে এই কড়া, চাঁদি- ফাটানো রোদ্দুরে বেশ কয়েক মাইল হাঁটা হয়ে গেছে। মানুষগুলোর চাপা বিরক্তি স্পষ্ট টের পাচ্ছে নিমাই মোহন্ত।

তা হোক— নিমাই মোহন্ত তার খুলিতে এসে বসা একটি কদাকার কাককে হুশ হুশ করে তাড়িয়ে দেয় যেন। মোহন্ত পাড়া ওয়েলফেয়ার সমিতির সে প্রেসিডেন্ট। পদের সুবাদে, জনসচেতনতার কথা ভেবে এমন কিছু কর্মসূচি পালন করতে হয়। আর এইসব চাষা-ভুষা লোকজনদের এইসব কর্মসূচিতে একটু জোর করেই আনতে হয়। আনিয়ে অভ্যাস করাতে হয়। মানুষকে বৃহত্তর চিন্তা-ভাবনা করতে শেখানোটা অনেকটা জলাতঙ্কের রোগিকে পুকুরে চুবিয়ে স্নান করানোর মতো। এটুকু করতে না পারলে তার কৃতিত্ব কোথায়?

এর আগে নিমাই মোহন্তের নেতৃত্বে যে-কর্মসূচিটি হয়েছে, তা রবীন্দ্র জন্মসার্ধশতবর্ষ পালন। চড়াইমল প্রাইমারি ইশকুলের বারান্দাই ডেকোরেশন করে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ। মঞ্চের সামনে পলিথিন আর বাঁশ দিয়ে দো-চালার মতো করে দর্শকাসন। তিনটি বাঁশ সমান্তরালে বেঁধে তার এপারে বিশিষ্ট অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। দুই কোণ থেকে ফুঁ-দেওয়া ওঝার মতো দুটো মিশমিশে পেডেস্টাল ফ্যান। পাখার কী শব্দ তাদের! এতেই অতিষ্ঠ হয়েই তো এলাকার বিশিষ্ট ধনী নিরেন অধিকারী বলেই ফেললেন, এই দুটাকে কেউ বন্ধ কর তো! বন্ধ কর। এইগুলা ফ্যান না কড়াইয়ের কারখানা!

কাচের গ্লাসে কমলা রঙের শরবত পরিবেশন করা হয়েছিল অতিথিদের মধ্যে। ভেলভেটের কাপর বিছানো ট্রে-তে করে সেই শরবত বিশিষ্টদের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল হরেনের মেয়ে চুমকি। তাকে পরানো হয়েছিল ঠাসবুনোট চওড়া পাড়ের সিল্কের শাড়ি। ব্লাউজের ঢলঢলে হাতা বগলের নীচে টেনে সেফটিপিন দিয়ে আটকে খাপানো হয়েছিল। মাথার চুল তেল মেরে টান করে বেঁধে খোপায় আটকানো হয়েছিল ফুলঘর থেকে আনা নকল ফুলের একটি। এই সম্পূর্ণ বিষয়টার নেপথ্যে ছিল নিমাই মোহন্তের ভাবনা। শরবত পরিবেশন যখন প্রায় শেষের পথে, বসন্ত দাসের বড়োছেলে মঞ্চে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে ‘এসো হে বৈশাখ এসো, এসো’— তখনই চুমকি লুটোনো শাড়িতে পা আটকে ট্রে-সুদ্ধু হুমড়ি খেয়ে পড়ল শৈলেন মাস্টারের গায়ে, শরবতে শৈলেন মাস্টারের বাক্স বাক্স ছাপকাটা জামার বুক-পেট ভিজে জবজবে, তখন দর্শকাসনের ব্যারিকেডের বাইরে যে-সমস্ত মামুলি, অশিক্ষিত গু-গোবর খাওয়া লোক ভিড় করে অনুষ্ঠান নয়, তামশা দেখে— তাদের মধ্যে থেকে ঠোঁটকাটা ধজেন চিৎকার করে বলেছিল— ওই নিমাই মোহন্তরে ফাঁসি দ্যাও!

নিমাই মোহন্তর গায়ে জ্বলুনি ধরলেও মুখে কিছু বলেনি। একটা সুদীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে এসে নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ রাখার এই আশ্চর্য শক্তিটা লাভ করেছে নিমাই। অন্তত সাত বছর আগে হলেও ধজেনের এই উক্তির পর পরিস্থিতি আমূল পালটে যেত। বাড়ি ফিরে হাতে একটা দাঁ নিয়ে বাড়ির সীমানার গেটের কাছে দৈত্যের মতো আচরণ করত নিমাই মোহন্ত। কোপ দিয়ে কেটে ফেলত সীমানার ধারে বাড়তে থাকা কোনো নিরপরাধ ঘোড়ানিমের ডাল। আর দরজায় দাঁড়িয়ে নিমাই মোহন্তের উচ্চমাধ্যমিক পড়া মেয়ে চারপাশের পরিস্থিতি আন্দাজ করে চরম বিরক্তিতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকত, বাবা, তুমি ঘরে আসবা?

গায়ে শরবত উলটে পড়ার পর কিন্তু শৈলেন মাস্টারের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। নিমাই মোহন্ত লক্ষ করেছে কেমন যেন কোমল হয়ে এসেছে শৈলেন মাস্টারের বদরাগী মেজাজ। শৈলেন মাস্টারের বয়স প্রায় বাহান্নোর কাছাকাছি। বিয়ে-থা করেনি। এর কারণ হিসেবে লোকেরা পেছনে বলাবলি করে শৈলেন মাস্টারের যন্ত্রটাই নাকি খারাপ। শোনা যায়, কোনো একসময় শৈলেন মাস্টারের বিয়ের কথা অনেকদূর এগিয়েও তারপর ভেঙে যায়।

এই ব্যাপারে সবচেয়ে সরস মন্তব্যটি করে রথীন্দ্র। পেশায় সে নব্য প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক। পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে চাকরিটি পেয়েছে ও। সন্ধ্যায় নাদুর দোকানে চা খেতে খেতে বলে— হওয়ারই কথা। মেয়ের বাড়ি হয়তো টের পেয়ে গিয়েছিল শৈলেন মাস্টারের কলাটা আসলে বিচাকলা। কামের কাম হয় না। হাতে দিলে বান্দরেও খাবে না।

রথীন্দ্রর এই কথায় দীপাবলীর রাতে বাজি-পটকা পোড়ার মতো হাসির রোল ওঠে নাদুর চায়ের দোকানে। নাদু একটা পচন-ধরা টেবিলে এঁটো চায়ের গ্লাসগুলি দু-হাতে ধুতে ধুতে বলে, এখন না ওষুধ পাওয়া যায়?

— ওই ভোমরা পাঁঠার আর ওষুধেও কাজ করবে না। ওইটা নিয়া ওই ব্যাটা স্বর্গে যাবে। পার্টির লোকাল কমিটির চেয়ারম্যান হইয়া কম তো বদমাইশি করে নাই, এইটা তার ফল।

চায়ের দোকান থেকে পয়সা মিটিয়ে ঝড়ের মতো বাইক চালিয়ে উধাও হয়ে যায় রথীন। চায়ের দোকানে বসা সবাই জানে রথীন যাচ্ছে চেপানি চৌপথির কাছে নতুন খোলা একটি পার্টি অফিসে।

শৈলেন মাস্টারের ব্যবহারের কোমলতা নজর এড়ায় না নিমাই মোহন্তর। একদিন সন্ধ্যের সময় যখন নিমাই মোহন্ত খাপসাডাঙা বাজার থেকে ফিরছে, পিচ রাস্তা ক্রস করবে—তখনই বাইক নিয়ে পেছন থেকে নিমাই মোহন্তের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শৈলেন মাস্টার। দীর্ঘ পথশ্রমের পর বাইকটা তখন ধুকছে। গরগর করছে বাইকটার চোখের আলো। আকাশে তৃতীয়ার চাঁদ। পিচ রাস্তার ওপর প্রচণ্ড হাওয়া।

— কোথায় গেসিলা নিমাই?

— এই একটু বাজার থেকা ঘুইরা আসলাম।

— বাড়ির সব খবর ভালো তো? মেয়ের তো এমএ-তে রেজাল্ট ভালো হইছে শুনলাম।

— হ্যাঁ, তবে আর একটু বেটার হইতে পারত। পরীক্ষার আগে তিন মাস জন্ডিসে ভুগল।

— অসুখ তো আর পরীক্ষা বোঝে না। তবে তোমার মেয়ে ব্রিলিয়ান্ট। অসুখ ওরে হারাইতে পারবে না।

— দেখি।

— সেই দিনের ঘটনাটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। পরে আমি চুমকির খোঁজ নিছি। ব্যথা-বেদনা পায় নাই। তবে তোমার আইডিয়াটা ছিল ব্রিলিয়ান্ট। বিশিষ্ট মানুষের জন্য একটু বিশিষ্ট ব্যবস্থা করাই লাগে। লোকাল কমিটির চেয়ারম্যান থাকার সময় কলকাতা থেইকা আর্টিস্ট আনাইয়া খলিসামারির মাঠে প্রোগ্রাম করছিলাম তোমার মনে আছে? কত খরচ হইছিল কও তো? এক লক্ষ বাহাত্তুর হাজার টাকা। এক নয়া পয়সাও কোথাও নড়চড় হয় নাই। অ্যানুয়াল মিটিং-এ সেই আয়-ব্যয় আমি ক্যাশমেমো, ভাউচার দিয়া পেশ করছিলাম। কারো মুখে একটা কথা নাই। ভাবতে পারো?

আধো-অন্ধকারে নিমাই মোহন্ত হাসার চেষ্টা করে একটু।

— আমি কী করছিলাম জানো? আয়-ব্যয়ের হিসাব হ্যান্ডবিলের মতো কইরা ছাপায়া সবার হাতে ধরায়া দিসিলাম। তাতে লেজার খাতার পেজ নম্বর, ক্যাশমেমো নম্বর, ভাউচার নম্বর— এইগুলাও ছাপায়া দিসিলাম। নে, এখন কে কী কবি ক! তবে তোমাদের ব্যাপারটা অন্যরকম। মিশনের সবে শুরু। যাই হউক, প্রোগ্রামটা ছোটো হইলেও বেশ ভাল হইছে। মাঝেমধ্যে এইসব অনুষ্ঠান কইরা সাংস্কৃতিক চেতনাটারে বাঁচায়া রাখবা। লোকে পিছনে অনেক কথাই বলবে, মনে নিবা না। মনীষীদের জন্মটন্ম পালনের পাশাপাশি জাতীয়, ইন্টার ন্যাশনাল ইসুগুলার দিকেও নজর রাইখো। আন্তর্জাতিক ভাবনাগুলার সঙ্গেও মানুষের পরিচয় করানোটা জরুরি। দরকার পড়লে ডাকবা, আমি আছি।

এর পরেও ঝিমন্ত বাইক জাগিয়ে আকাশে তৃতীয়ার চাঁদের নীচ দিয়ে পিচরাস্তা দিয়ে কোথাও চলে গেছিল শৈলেন মাস্টার। রথীনের কানে কথাটা গেলে রথীন নিমাই মোহন্তকে বলেছিল, কাকা, ঘটনাটা বুঝলা না?

ঠোঁটে একটু হাসি টেনে একচোখে কেমন বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়েছিল নিমাই মোহন্ত। রথীন বলল, তোমারে হ্যার ক্যালি শুনাইল। ওই প্রোগ্রামে নব্বই হাজার টাকার বেশি খরচা হয়-ই নাই। যে মাছচোর, সে-ই শাক দিয়া মাছ ঢাকার জন্য ওইসব করে। আমার তো এও মনে হয়, চুমকির গায়ের গন্ধও ব্যাটার ভাল্লাগছে। নাইলে অত দরদ কীসের। ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস-এ কামরুলের মেয়েটা যখন দৌড়াইতে গিয়া পা ভাঙল— তখন তো দেখতে আসে নাই! শালা, বদমাইশ ব্যাটা। চরিত্রহীন!


মুসুরির ডালে পেঁয়াজ ফোড়ন দিলে তার যা স্বাদ, যা গন্ধ— তাতেই মনটা চনমন করে ওঠে। গরম ভাতের সঙ্গে যদি এমন ডাল হয় আর সঙ্গে একটু আলুসেদ্ধ বা ছোটো মাছের চচ্চড়ি হয়, তাহলে দু-বেলার ভাত একবেলায়-ই খেয়ে ফেলতে পারে নিমাই। আজকের এই বিশেষ দিনটির জন্য সে তেমনই আয়োজন করেছিল। আগের দিনই খাপসাডাঙার সন্ধ্যের বাজার থেকে তাজা ছোটমাছ, বড়ো দানার লাল আলু এনে রেখেছিল নিমাই মোহন্ত। খরচের ব্যাপারে সে একটু হিসেবি, যে-চরিত্রটাকে লোকে বিকৃত করে বলে কৃপণ। লোকে বলতেই পারে, কিন্তু এই বিশেষণ একেবারেই মানতে নারাজ নিমাই মোহন্ত। কৃপণ তো সুবল দেবনাথ, যে পাঁচ পাঁচটা চালগুদামের মালিক হয়েও এইসব সাংস্কৃতিক বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে পঞ্চাশ টাকাও চাঁদা দেয় না। কৃপণ তো শান্তিশ্বরী হাইস্কুলের ক্লার্ক নিশীথ পাল। যে সাইড-এ আবার নার্সারির ব্যাবসা করে। অরণ্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে তার কাছে সমিতির পক্ষ থেকে জনসাধারণকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করার জন্য একশো চারাগাছ চাইতে গিয়েছিল নিমাই মোহন্ত। প্রতি চারা পনেরো টাকা চেয়ে বসল নিশীথ পাল। নিমাই মোহন্ত মাথা চুলকে বলেছিল, এটা একটা সামাজিক কাজ, তাই যদি টাকাটা না নিতেন…।

— অসম্ভব! আমার পক্ষে অসম্ভব! সবে শেয়ারে বিজনেসটা শুরু করেছি। প্রায় পঞ্চাশ থেকে এক লাখ টাকা বাজারে পড়ে আছে। এখনও ওঠাতে পারিনি। উন্নত টেকনিকের চারা। গোড়ায় বেশ মোটা মাটি পাবে। কুড়ি টাকার কমে দেওয়াই যায় না, তবু তোমাদের উদ্দেশ্যটা ভালো দেখে পনেরো টাকায় দিচ্ছি, নিয়ে যাও। আর পয়সা কিন্তু ক্যাশ নেব। সই করা ব্ল্যাঙ্ক বিল নিলে আরও তিনশো টাকা এক্সট্রা।

নিশীথ পালের ঘরের মেঝেতে ঘি রঙা টাইলস বসানো। কোনার একটা টেবিলে রঙিন টেলিভিশন তখন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। একটা বেঁটে আলমারির ভেতর সাজিয়ে রাখা কাচের কাপ-ডিশ ইত্যাদি। সোফার সামনের টেবিলটায় পেতলের অ্যাশট্রে, তাতে অনেক দগ্ধ সিগারেট। নিশীথ পালের পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাঁটুসমান কালো একটা ঢলঢলে হাফপ্যান্ট। তখন বেলা সাড়ে আটটা বাজে। এককাপ চা পর্যন্ত ও-বাড়ি থেকে আসেনি নিমাই মোহন্তের জন্য। এরা কৃপণ না হলে কৃপণ কে?

মিছিল শুরু হবে বেলা সাড়ে দশটায় চড়াইমল প্রাইমারি স্কুলের মাঠ থেকে। আগের দিন শোবার সময় নিমাই মোহন্ত যখন একটা বিড়ি ধরিয়ে জানালার সামনে বসেছে, দেখতে পেল অনেক দূরে দিগন্তের অন্ধকার আকাশে ক্রুর হাসির মতো বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। বিদ্যুৎ পড়ছে। জানালা দিয়ে আসা রাতের বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো। পরদিন বৃষ্টি থাকলে মিছিলটা হবে না। এই কর্মসূচিটাও পণ্ড হবে। এই সমিতির রেজিস্ট্রেশন করানোর তোড়জোড় চলছে। একজনকে ধরে পয়সাও দেওয়া হয়েছে। এখন কিছু দিন নানান কর্মসূচি করে যেতে হবে। তবে একসময় গিয়ে সরকারি ফান্ড পাওয়া যাবে। নিমাই মোহন্ত এ-সব চিন্তা করেই প্রতি রাত্রে একটু একটু করে কর্মসূচির জাল বোনে, যেরকমভাবে নদীতে মাছ ধরতে যাবার আগে জাল বোনে মাঝি। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ পেয়ে নিমাই মোহন্ত একটু মুষড়ে পড়ল যেন।

এই ঠেঁটিয়া লোকগুলাকে বোঝানোই যায় না! তার ওপর বৃষ্টি হইলে তো আর আসবেই না। হারামজাদার হারামজাদা কপাল। বিড় বিড় করে বলল নিমাই মোহন্ত।

যদিও সেই রাতে বৃষ্টি হয়নি। সকালে ঘুম ভাঙার পর নিমাই মোহন্ত দেখল নতুন বউয়ের মতো চিবুক অবধি ঘোমটা টেনে রোদ দুয়ারে এসেছে। সময় যতই গড়াবে, এই বউ-ই ঘোমটা সরিয়ে হয়ে উঠবে একেবারে যক্ষিণী।

স্নান-পায়খানা সেরে প্রস্তুত হতে হতে একটু দেরিই হয়ে গেল নিমাই মোহন্তর। পাতে সবে গরম ভাত, পেঁয়াজ দেওয়া ডালের সঙ্গে মেখে একটু আলুসেদ্ধর তাল ভেঙে মুখে দিয়েছে, সেই সময়েই বাইরে থেকে শ্যামলের ডাক- কাকা, ও নিমাইকাকা, আরে লোকজন তো আসছে। আর দেরি করলে হবে না।

একটু ঝোল-সহ মাছের চচ্চড়িটা মুখে দিয়ে উঠে পড়তে হল নিমাই মোহন্তকে। মুখের ভেতরটাও ভালো করে ধোওয়া হল না। সেটা নিমাই মোহন্ত এখন বুঝছে। গালের দাঁতের সারির ফাঁকে ভাতের কুচি, আলুসেদ্ধর টুকরো, মাছের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো- টাকরা আটকে আছে। স্লোগান দেবার সময় জিভের নড়াচড়ার ফলে, লালার আঘাতের ফলে সেগুলো বাইরে বেরিয়ে আসছে। আহ! কী স্বাদ হয়েছিল মাছের চচ্চড়িটা!

ছায়ামণি পোদ্দারের ঢললে টিনের গেটের কাছে এসে স্লোগানের তীব্রতা আরও বাড়ালো নিমাই মোহন্ত। মিছিল নিয়ে এই অ্যাতোখানি চড়া রোদ্দুরে হেঁটে আসার পরেও আশেপাশের ঘরদুয়ার, মানুষজনদের থেকে তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। ঘরদুয়ার, মানুষজন বা গাই-বলদ, চাপাকল, ধানের মড়াই নিয়ে ছড়ানো সংসারগুলো যেন নিজেদের মধ্যে নিজেরাই ডুবে আছে। বাইরের কোনো আওয়াজ, শব্দ বা কম্পন— কোনোটাই ওদের কানে পৌঁছাচ্ছে না। শুধু চড়াইমল থেকে ধুলোভরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে পিচরাস্তায় ওঠার সময় এক দঙ্গল বাচ্চা ছেলেমেয়ে মিছিলের পেছন পেছন দৌড়ে আসছিল, তাতে মিছিলটার গুরুত্ব কমছিল। নিমাই মোহন্ত তারস্বরে চেঁচিয়ে ওদের ভাগিয়ে দেয়।

কিন্তু ছায়ামণি পোদ্দারের ক্ষেত্রে এমনটা হবার কথাই নয়। বিধবা ছায়ামণি পোদ্দার কপাল থেকে নাকের ডগা অবধি রসকলি এঁকে, বাইফোকাল কাচের চশমা চোখে দিয়ে চষে বেড়ায় দুনিয়ার শেষ ঘাট অবধি। দূর কোনো বাড়ির গাছের নারকেল ঝুপ করে ডোবার জলে পড়লে, তার শব্দ পৌঁছে যায় ছায়ামণি পোদ্দারের কানে এবং সেটা সংবাদ হয়ে ইথারে ছড়াতে কোনো সময় লাগে না। ছায়ামণি পোদ্দারের বাড়িটার ওপর পেছন দিয়ে উঠে মাথা এল করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাবগাছ। সেখানে কী একটা পাখি স্লোগানটাকে নকল করেই যেন তেমনই সুরে ডাকছে।

বুড়া হরিপদ রোদে হেঁটে হেঁটে হাঁপিয়ে গিয়েছিল। সে বলল, নিমাই এককাপ চা খাওয়াবা না? একটু জিরানো দরকার। রোদটাও যে উঠছে, সেই রোদ।

পরেশের বউয়ের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। জুলপির কাছ দিয়ে টলটলে ঘামের ফোঁটা গাল বেয়ে নামছে— স্পষ্ট দেখা যায়। খোঁড়া গৌরহরির ধুতির গিঁট আলগা হয়ে ময়লা আন্ডারওয়্যার দেখা যাচ্ছে।

নিমাই মোহন্ত নোংরা হলুদ হলুদ দাঁতে হেসে বলল, আইসাই তো পড়ছি কাকা। ধারসি চৌপথিতে চায়ের দোকানে চা খাব।

বুড়া হরিপদ হলহল করে হেসে বলল, শুধু চা?

— না, পিস (পাউরুটি) আছে। পিস খাইতে পারো।

— লোকজনেরে তেমন পাওয়া গেল না নিমাই, কী কও?

— তাই তো দেখি।

— তাইলে আর হাঁটনের কাম কী? এইখানে একটু বইসা নেই, কী কও?

— এমন কথা কইয়ো না কাকা, আমরা একটা বৃহত্তর ইসুতে এই মিছিলটা বাইর করছি। বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ভাবো তো! পরিবেশ না থাকলে পৃথিবীটার কী হবে? আমাদের দেশের কী হবে? আমাদের কী হবে? আমাদের পরের প্রজন্মের কী হবে?ভাবতাছ ওরা বাঁইচা থাকবে? নিশ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস থাকবে না। পাতালে গেলেও খাবার জল পাবা না। এই সুজলা-সুফলা দেশ সাহারা মরুভূমি হবে। লোকজনেরে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু তাতে তো কান দিয়া লাভ নাই! দেশ-দশের মঙ্গলে সবাই আসে না, আসে গুটিকয়টা মানুষ। তারাই পথ দেখায়। ইতিহাস তাদেরই মনে রাখে।

এইসব কথার ফাঁকে নিমাই মোহন্ত একবার চকিতে দেখল পরেশের বউকে। গনগনে হাওয়ায় ওর সিঁথিরদু’পাশে কিছু চুল উড়ছে। রাস্তার ডানদিকে বেশ খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে বহমান ধারসি নদী। একটা প্যাঁচানো রুপোলি শাড়ির মতো। নদীটা পুব থেকে এসে দক্ষিণে ঘুরে বয়ে গেছে। দক্ষিণে এই নদীটার ওপরেই বড়ো সেতু। সেই সেতু পেরোলে ধারসি চৌপথি। এই সেতু যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন গ্রামে গ্রামে প্রচণ্ড ছেলেধরার গুজব ছড়িয়েছিল। ছেলেধরারা নাকি কখনো সাধু বা বোষ্টমের বেশে বাড়িতে বাড়িতে ঘোরে। ঘোরে ঠিক দুপুরবেলা, যখন বাড়ি প্রায় পুরুষশূন্য। মন্ত্রবলে বাড়ির মেয়েলোকেদের অজ্ঞান করে কচি কচি ছেলেমেয়েগুলোকে তুলে নিয়ে হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে যায়। সেইসব হারানো ছেলেমেয়েদের মাথা কেটে, তা গুঁজে দেওয়া হয় সেতুর পিলারের নীচে। তাতে নাকি সেতু মজবুত হয়। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেতুর কোনো ক্ষতি হয় না। এ-সব নেহাৎই গ্রাম্য গুজব। গুজব ছাড়া আর কী-ই-বা হতে পারে? তবে গুজবই হোক, বা আর যাই-ই হোক এই চেপানি এবং চেপানি সংলগ্ন সমস্ত গ্রাম জানে, তখনই পরেশর ছয় বছরের ছেলেটা একদিন নিখোঁজ হয়ে যায় আর তারপর থেকেই যুবতী বউটার মাথায় একটু ছিট। কখন, কোথায় ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়ে যায়। হয়তো সন্ধ্যে পার করে বাড়ি ফেরে। গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না।

নিমাই মোহন্ত দেখে পরেশের বউ অপলক চোখে নদীটার দিকে চেয়ে আছে। বাতাসে সিঁথির দু-পাশের চুল উড়ছে কী এক বক্তব্যের মতো। চাষা-ভুষা লোকগুলি এরমধ্যেই বুড়ো উটের মতো রাস্তার পাশে এখানে-সেখানে বসে পড়েছে। খোঁড়া গৌরহরি শব্দ করে নাকে নস্যি টানছে।

নিমাই মোহন্ত দেখল মাথার ওপরে যে-সূর্যটা— তার গায়ে অসংখ্য চকচকে ধারালো ছুরির ফলা। এই সূর্যের বয়েস কত কে জানে! তবে বয়েস যাইহোক, এখনও তার শরীরে প্রবল রক্তস্রোত, অদম্য বুনো আকুতি! অনেকটা কখনো-সখনো নিমাই মোহন্তর যেমন পরেশের পাগল বউটাকে দেখলে হয়।

ছায়ামণি পোদ্দারের বাড়িতে তখনও নীরবতা। গাবগাছের পাখিটা অনেকক্ষণ কী কারণে চুপ করে থাকার পর এখন আবার ডেকে উঠল। তবে ঠিক স্লোগানের সুরে নয়, অন্য আর একটি নয়া সুরে। কীরকম যেন দূর থেকে ভেসে আসা লোহা-ভাঙারির ফেরিওলার হাঁকের মতো বিষাদ সেই সুরে।

ধারসি নদীর সেতুর ওপর দিয়ে মহামায়া ট্র্যাভেলস নামের একটি চকচকে খয়েরি রঙের বাস নতুন যন্ত্রাংশের শব্দ শুনিয়ে বারোবিশার দিকে চলে গেল। বাসটি চলে যেতেই দেখা গেল ধারসি চৌপথির উলটো দিকে একটা পানের দোকানে বাইক থামিয়ে গোটা একটা দোমা পান মুখে পুরেছে শৈলেন মাস্টার। রাস্তায় ছত্রাকের আকারে পানের পিক ফেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বলদ নিমাই মোহন্তের কাণ্ডকারখানা। হঠাৎ তার চেয়ারম্যান-চেতনা বলে উঠল এমন বলদের দরকার সবসময়ই আছে, ছিলও। পৃথিবীর খানিকটা ইতিহাস তো বলদেরই ইতিহাস।

Facebook Comments

পছন্দের বই