লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

নুজহাত ইসলাম নৌশিন

ডাহুকের কাল

রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে মোহনার মনে হল— পুরুষ মাত্রই পুরুষ। মহাপুরুষ একটা বানানো শব্দ। যা নেই তা নিয়ে মিথ্যা সান্ত্বনা। পুরুষ কখনো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না জেনেই নিজের গায়ে একটা তকমা লাগিয়ে দিল। অথচ নারীদের এমন ব্যাপার নেই। কখনো কোনো নারী কি দাবি করেছে সে মহানারী! শোনা কিংবা দেখা যায়নি। সে জানে প্রকৃতি তাকে মহা হবার উপাদান সবটা ঢেলে দিয়েছে তাই আলাদাভাবে মহা হওয়ার কিংবা তকমা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে না। এই কাড়াকাড়ি পুরুষরাই করে নিজের দুর্বলতা ঢাকতে। ঢাকুক, যদি পারে।

হায়, সর্বনাশ!

কথাটা কানে আসতেই মোহনা সর্তক হল। ওড়নাটা অবাধ্য বাতাসে একটু সরে যেতেই পাশ থেকে একটা মন্তব্য। আচ্ছা এই “হায় সর্বনাশ” বলা লোকটা নিজের বাসায় কতবার এই শব্দটা বলে? তার তিন বছরের পুরোনো প্রেমিক কখনো কি রাস্তায় কোনো মেয়ে দেখে এমন বলেছে! হয়তো মুখে দিয়ে উচ্চারণ করেনি কিন্তু মন দিয়ে? কে জানে কী— এ-সব ভাবতে গেলে ভয় হয়। নিজের পছন্দ করা জামার মতো, পছন্দ হওয়া ছেলে যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে কিছু দিন বাদে— তাকে নিয়ে এরকম সন্দেহ হওয়া ঠিক না। মন বিগড়ে যায়, কিন্তু যদি ওই রাস্তার প্রৌঢ় লোকটার মতো এমন অভ্যাস থাকে। সহ্য হবে কি—

শাহেদ কেমন! গত তিন বছরে অনেক বার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। কাটাকুটি আর যোগবিয়োগে শেষ অবধি ভেবেছে খারাপ না। চলে। কিন্তু সারাজীবন কি চলবে? একজন মানুষ প্রেমিক হিসেবে একরকম আর স্বামী হলে পুরো অন্য গ্রহের মানুষ। শাহেদ মনে হয় খুব শীঘ্রই অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে যাবে।

মানুষ কত দ্রুত বদলায়। কাজটা করার পর ভেবে কোনো লাভ নেই। ইদানীং মনে হয় মানুষ কী বলবে ভেবেই সে শাহেদকে বিয়ে করেছে। “এত বছর প্রেম করলে বিয়ের বেলা অন্য ছেলে, লোভী, স্বার্থপর” এই গালিগুলো যেন শুনতে না হয় সেজন্য সে শাহেদকে বিয়ে করেছে। তাতে কী হল— এই কথাগুলো শোনা লাগছে না এখন। কিন্তু ভেতরে যে দাবানল জ্বলছে।

“মা, আমার শাহেদের সাথে যাচ্ছে না। ও ও”—

“কী, ও”— কাপড় আলমারিতে রাখতে গিয়ে বিরক্ত হলেন মেয়ের কথার ধরনে।বিয়ে কি ছেলে খেলা! তিন বছরের একটা মেয়ে আছে, দু-দিন পর স্কুলে ভর্তি করাবে, তারপর সেই মেয়ের পড়াশোনা, আরও পরে বিয়েশাদি— এখন তার মেয়ে বলছে জামাইয়ের সাথে যাচ্ছে না। বিরক্তই লাগে।
“ওর বাজে স্বভাব আছে। কাজের মেয়ের দিকে কেমন করে তাকায়, তোমায় বলতে রুচিতে বাঁধছে। আমি চাই না অমি এ-সব দেখে বড়ো হোক।”

মনোয়ারা চূড়ান্তরকম বিরক্ত হলেন এবার। তার মেয়ে এই কথা বলতে ছুটে এসেছে। তিনি ভেবেছিলেন কী না কী। “ব্যাটা ছেলে একটু এমনই হয়, তোর বাপও তো এমন। তাই বলে ছেড়ে চলে গিয়েছি নাকি! আর তুই নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিস। এখন এ-সব ডিভোর্স নাকি এ-সব করলে লোকে কী বলবে! এ-সব কথা সাতখান হলে তখন”—

এরপর আসলে কিছু বলা চলে না। তার নিজের বাবা এমন— আর তার মা এটা গর্ব করে বলছে। রাজাবাদশাহী আমল হলে আরও ভালো হত, তার বাবার অনেকগুলো উপপত্নী থাকত। বর্তমান সময়ে রক্ষিতা। জিনিস একই শুধু মোড়ক বদলে নাম বদল।

“মা, আমরা কি বেড়াতে যাচ্ছি!”

অমির চুলগুলো গুছিয়ে ঝুঁটি করে বলল, “না, মা— আমরা এই বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।”

“বাবা—”

মোহনা শাহেদের দিকে তাকাল। হয়তো এটাই শেষ দেখা— কী সুন্দর ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। খেয়েই যাচ্ছে— নির্বিকার। মোহনার চলে যাওয়া এটাই যেন স্বাভাবিক। অথচ সাত বছর আগে, একটু অভিমান করলেই শাহেদের পৃথিবী উলটে যেত। এগুলো কি সত্যি নাকি অভিনয়! বিশ্বাস করতে এখন কষ্ট হয়।

“তোমার বাবা মাঝেমধ্যে যাবে তোমাকে দেখতে।” বাচ্চা মেয়েটার মন সত্যি বলে নোংরা করে কী লাভ— খারাপ একটা ধারণা নিয়ে বড়ো হবে। মিথ্যার প্রলেপে যদি সুখ পাওয়া যায় তবে তাতে মন্দ কী!

ব্যাগ গুছানো শেষ করে শেষ বার ঘরের দিকে তাকালো। এখানে এই ঘরে অন্য কেউ আসবে— শাহেদের অল্প বয়সি মেয়ে কলিগ সুফিয়াও আসতে পারে। শাহেদের সাথে বেশ মাখামাখি। মন্দ হবে না। অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছিল শাহেদকে বদলাতে— হল না। কেউ আসলে বদলায় না, শুধু নিজেকে বদলানো যায়। মোহনা শেষ অবধি দ্বিতীয়টা বেছে নিল।

বাস চলছে। শীতের দুরন্ত বাতাস। অমির কান-গলা ভালো করে ঢেকে দিল। মেয়েটা ভীষণ ছটফটে। বার বার মাফলার খুলে জানলা দিয়ে বাইরে মাথা বের করছে।

“আহ্, শান্ত হয়ে বসো তো।”

“দেখি না একটু বাইরে—”

বাসে ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যে একটা বাচ্চার পা ঘাড়ে লাগল। বিরক্ত হয়ে তাকালো মোহনা।

নাকের নীচে সর্দির শুকনো রেখা। দেখেই গা গুলিয়ে আসছে। বাচ্চা কোলে মহিলাকে দেখে অভাবের চূড়ান্ত রূপ চোখে ধাক্কা লাগে। এই ডিসেম্বরের শীতে আধময়লা ছেঁড়া শাড়ি। দ্বিতীয় বার এদের দিকে তাকানোর ইচ্ছে করে না বলে মোহনা অমির ঘুমন্ত মাথা কোলে চেপে রাখল।

“আফা কিছু টাকা দেন।”

মোহনার বিরক্তি লাগা সত্ত্বেও ব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার কয়েকটা নোট বের করে দিল। উটকো ঝামেলা থেকে যত দ্রুত সারা যায়। বাস চলার পর থেকে ঘাড়ের পিছনে যে দাঁড়িয়েছে— নামার সময় এই ঘ্যান ঘ্যান।

পাঁচ টাকার কয়েকটা নোট দিতে গিয়ে আচমকাই প্রশ্ন বের হয়ে এল মুখে— “বাচ্চাটার একটা চিকিৎসা করাও না কেন? গায়ে তো খোসপাঁচড়ার বাসা হচ্ছে।”

আধছেঁড়া শাড়ি পড়া এবার ঝামটা দিয়ে উঠল— “চিকিৎসা কি গাছের ফল! পোলার বাপ আমারে তাড়ায়ে দিছে, ঘরে আর এক আবাগী বেটিকে তুলছে। খাইতে পাই না আবার—”

ময়লা শাড়ি অনেক দূর চলে গেছে। রিকশায় বসার পর মোহনার মনে হল তার আর ময়লা শাড়ির সাথে কোথায় যেন মিল আছে ।

সে শিক্ষিত এবং চাকুরির জোরে স্বামীকে ত্যাগ করতে পেরেছে। এবং শাহেদ সুন্দরভাবে বলেছে— “তোমার যেখানে সাধ চলিবার, চলে যাও।”

আর ময়লা শাড়িকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অভদ্রভাবে। যে যার খোলস অনুযায়ী ব্যবহার করেছে।

স্বামী পরিত্যক্ত দুই নারীর দুই দিকে গন্তব্য। একটা ভদ্রভাবে আর একটা নির্মমভাবে। দূরে কোথাও ডাহুকটা ডেকেই যাচ্ছে। দুপুর রোদে ডাহুক ডাকে না— গভীর রাতে ডাকে। কে জানে কেন ডাকছে এখন। ডাহুকের সংসারেও কি ভাঙন ধরে ভদ্র-অভদ্র ভেদে।

রিকশার ঝাঁকুনিতে মোহনার মনে হল ভাঙনটাই স্বাভাবিক।

Facebook Comments

পছন্দের বই