লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

রোদ্দুর মিত্র

বিলেদা

বিস্তর বছর এই পৃথিবীতে বেঁচে, একজন সুন্দর, অথবা একজন দুঃখী প্রাণপণে চাইছে ধুলো হয়ে যেতে।

যে-মানুষেরা তাকে জড়িয়ে ছিল— ধুলো হয়েছে কবেই। ভাঙতে ভাঙতে নিজের ছায়াটুকুও এখন মাটি, হয়তো কেউ এসে উড়িয়ে দেবে এক ফু-এ।

আছে বলতে নিজস্ব কিছু ক্ষত আর এই পার্থিব শরীরটা— অনেক সুতোর মাথায় কাটা খাওয়া ময়ূরপক্ষীর মতো, এতই অনুদ্বিগ্ন যেন চাইছেই না অ্যান্টেনায় জট পাকিয়ে আর ক-টা দিন উড়তে।

অথচ বিলেদা উড়তেই চেয়েছিল— আজীবন। স্বপ্নে যেমন প্রতি রাতে ঘুড়ি হয়ে যেত সে, পাশবালিশ হত লাটাই।

রংচটা দেওয়ালে ঝুলছিল পাহাড়ি উপত্যকার ছবি আঁকা একটা ক্যালেন্ডারে। সেখান থেকেই, কে জানে কখন, আশ্চর্য সব তুলো তুলো মেঘ চুপিচুপি নেমে এসে বিলেদাকে নিয়ে মস্ত উড়ান দিত। তার দু-কামরার ঘরে তখন হয়তো আলুথালু ছড়িয়ে ছিল তেলচিটে শাড়ি, ময়লা পায়জামা, আন্ডারওয়্যার, সায়া, গামছা… বিছানার পাশে উলটে পড়েছিল টিপ পরা ছোটো আয়না। ভূতের মতো দেখতে, ট্যাপ খাওয়া আলমারিটাও বিলেদাকে তখন ভয় দেখাতে পারে না। স্বপ্নে আবার ভয় কী! সেখানে যে সবাই নেচে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়, পথ হারানোর পরে খুঁজে পায় একটা পাঁচতে ঘুড়ি। ছাদ থেকে পড়ে গেলেও স্বপ্নে তার মৃত্যু নেই— বোধহয় সে ঈশ্বর— ক্ষণিকের ঈশ্বর।

মাঘ মাসের আকাশ ঘন নীল। কাঁচা রোদের মাদুর বিছোনো পথে, শিরশিরে হাওয়া আলো ফোটা ইস্তক এই মেঘ সেই মেঘ করছে। দাঁত মাজতে মাজতে সেই যে বিলেদা ছাদে উঠল, এবার অনায়াসে কাটিয়ে দেবে গোটা একটা দিন। যতক্ষণ আলো আছে, বিলেদা ছাদে আছে। তার শরীরের একটা অংশ পেটকাটি হয়ে উড়ছে আকাশে, এই টান টান টান টান, ভোওওওওকাট্টা!

হ্যাঁ, শরীরেরই একটা অংশ, যে-অংশটুকু বিলেদা নিশ্চিন্তে ভাসিয়ে দিতে পারত হাওয়ায়। আবার আলো যখন নিভু নিভু— সুতো টেনে টেনে, নারকেল গাছ, শিরীষ গাছের করাল চাহনি সামলে নামিয়ে নিয়ে আসত ছাদে। অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়েই নিশ্চয়ই বিলেদা নিজের ভেতরে জুড়ে নিত সেই অংশ— অবিচ্ছেদ্য কিনা!

যে-সমস্ত ইচ্ছে-অভিলাষ-মেয়েমানুষ আমাদের অস্থির করে তোলে, উঁচু উঁচু বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে লাট খায়, বিলেদা ঠিক তাদের তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করত, ভালোবাসার চেষ্টা করত সামান্য ঘুড়ি দিয়ে।

আর এই সামান্য ঘুড়িই আজীবন তাড়া করে বেড়াচ্ছে বিলেদাকে। কক্ষনো থিতু হতে দিচ্ছে না। না উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছে, না লোকাল চেয়ারম্যানকে ধরে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পেরেছে। সহজ কথায়, সে একজন বেকার, অন্যান্যদের মতো যুবক ঠিক নয়, বয়স পঞ্চাশের দোরগোড়ায়।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি বিলেদার রোজনামচাকে ভাগ করে ফেলা যায়, স্পষ্ট দেখা যাবে, সে কত অনিশ্চিত। এই যেমন সকালে সে হয়ে ওঠে পাড়ার সেইসমস্ত দাদাদের মতো, যারা শুধুমাত্র ক্যারামই খেলতে পারে, আড়চোখে মেয়ে দেখে, আর মানুষের জটলা হলেই অতিথির মতো হাজির হয়— কলার তোলে, রোয়াব নেয়, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন অঙ্কটাকেও তারা সমাধান করে দেবে বিড়ির ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়।

— “ধুর শালা, তুই চুপ করবি?”

— “চুপ কেন করব বিলেদা? চুপ করে ছিলাম বলেই তো আমার আজ এই হাল। বউটার হাতে দুটো পয়সা দিতে পারছি না, মাস শেষের আগে দেখবে আমিই হয়তো টেঁসে গেছি, আর এরা বলে কিনা আমি চোর?”

সাত-আটজনের একটা দল প্রায় কামড়াতে যায়, “চোর বলব না তো কি পোঙায় তুলে নাচব? রামু নিজের চোখে দেখেছে, কাল রাতে তুই আমাদের ভেড়ি থেকে মাছ চুরি করেছিস। এই রামু, তুই দেখিসনি বল?”

— “হ্যাঁ গো বিলেদা! মাঠের কোনায় হাগতে গিয়ে, আমাদের গজা গো, চাদর মুড়ি-টুড়ি দিয়ে সুরসুর করে ভেড়িতে নেমে গেল গো। হাতে আবার একটা ইয়াব্বড়ো টিনের ডেরাম। আমি তখনই গো সন্দেহ করেছিলাম, সবাইকে ডেকে এনে দেখি, ব্যাটা হাওয়া।”

— “সাড়ে সাতশো টাকার মাছ চুরি গেছে বিলেদা।”

— “গজার একার বাড়িতেই বউ নেই। আমরাও শালা মুখে রক্ত তুলে খাটি। আমাদের ট্যাঁকেও পয়সা থাকে না। গামছা বেঁধে রাখতে হয়।”

— “ব্যাটা চোর গো—”

— “ব্যাটা চোর গো! রামু তখন এত হাগছিল যে, কাকে দেখতে কাকে দেখেছে!”

— “চুরি করে এখন সতী সাজছিস বাঞ্চোত। মাল খেতে তো সেই আমাদের কাছেই আসবি, তখন এমন হুড়কো দেব না—”

— “কতবার বলব, কাল রাতে আমি পিসির বাড়ি গেছিলাম। পিসির খুব শরীর খারাপ, তাই—”

— “হয়েছে হয়েছে। কানের মাথা খেল হতভাগারা”, মোচ করে একটা আড়মোড়া পেড়ে বিলেদা বলল, “এবার সত্যি করে বল তো গজা, কাল রাতে তুই কোথায় ছিলি, আমার দিব্যি।”

ব্যাস। এত চুলোচুলির মধ্যে বিলেদা নিজের মোক্ষম অস্ত্রখানা প্রয়োগ করেছে। অথচ চাইলেই সে ঝামেলার সূত্রপাতেই বলতে পারত, “সত্যি করে বল গজা, আমার দিব্যি।” তবু বলেনি, ইচ্ছে করেই বলেনি, আসলে বিলেদা ওদের কথা শুনতে চায়। গজার দুঃখ, রামুর গায়ের আঁশটে গন্ধ, গামছায় লেগে থাকা মাছের রক্ত বিলেদার বড়ো ভালো লাগে।

শুধু কি ভালো লাগে? তাকে ভাবায়ও তো। সাত-আটজন মিলে, হয়তো তিন দিনের ভাতের পয়সা বাঁচিয়েছে; মোরগ ডাকার আগেই হয়তো মাঠে গিয়ে ধান বুনেছে— দু-তিন টাকা বেশি পাওয়ায় আশায়। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে উজাড় করে দিয়েছিল একটা ভেড়ি কিনবে বলে। একসাথে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

এই যৌথ যাপনের ঘাম বিলেদাকে টানে, সে আষ্টেপৃষ্ঠে গায়ে মাখতে চায়, মনে মনে হাততালি দিয়ে ওঠে, যখন টাকা গুনতে গুনতে ওদের মুখে একচিলতে হাসি ফোটে। এই যে পৃথিবীর সকল মানুষ শুধু আমার আমার বলে উতলা, আরও চাই আরও চাই বলে হদ্দ পাগল, কেমন করে যেন বিলেদা এই পৃথিবীতেই, রামুদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে আমাদের শব্দটাকে। তাই শব্দকে সে বাঁচিয়ে রাখে— লালন করে— আগলে নেয়। অস্ফুটে বলে, তোমরা দীর্ঘজীবী হও।

সেই জন্যই তো দিব্যি দেওয়া। নইলে খামোখা কেউ নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়, পাতি মাছ চুরির গণ্ডগোলে। এবার গজা ভীষণভাবে চাইলেও আর বিলেদার সামনে মিথ্যে বলবে না— বলতে পারবে না— বিলেদা ওদের দিনান্তের আশ্রয়, মিথ্যে বললে আশ্রয়ও মিথ্যে হয়ে যাবে। অথবা আস্ত একটা ঘর, যে-ঘরে অনায়াসে বলা যায় মালিককে দিতে না পারা খিস্তি, উগড়ে দেওয়া যায় বউয়ের প্রতি ক্ষোভ, এই পচাগলা পণ্যমুখী সভ্যতার প্রতি অনন্ত ঘৃণা।

চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সামান্যগুলোকে জড়ো করে যদি কেউ আকার দিত, প্রাণ ভরে দিত কেউ, তাহলে আমি নিশ্চিত, বিলেদা আবার জন্ম নিত।

— “কী হল, থম মেরে গেলি যে! বল কাল রাতে তুই কোথায় ছিলি?”

— “তুমি দিব্যি তুলে নাও বিলেদা!”

— “তার মানে রামু সত্যিই তোকে কাল রাতে—”

— “হ্যাঁ দেখেছে। বেশ করেছে দেখেছে। ভূপেনদা বলেছিল চুরি করলে টাকা দেবে, তাই করেছি।”

সাত-আটজনের দল একসাথে বিস্মিত হয়, “ভূপেনদা!”

— “ভূপেন চক্কোত্তি? ওই ঢ্যামনার হাত টপকেই ভেড়িটা কিনেছিলি না তোরা?”

রামুর ভীষণ কান্না পায়। হতে পারে গজা তাদের দলের কেউ না, মাছ নিয়ে গজা অন্য বাজারে বসতেই পারে, তবু তো গজা তাদের মতোই মাছওয়ালা— চোর নয়। অল্প ক-টা টাকার লোভ দেখিয়ে ভূপেনদা এইভাবে নিজের জাত চেনাবে তাই বলে!

— “ভূপেনদা পরশুর আগের দিন বাড়িতে এসেছিল। বলল, আমায় নাকি একটা কাজ করে দিতে হবে। কাজ হাসিল হলে অনেক টাকা। মাছ বেচে বেচে আর দিন চলছে না বিলেদা, হাতে ক-টা পয়সাই-বা পড়ে থাকে বলো?”

— “তাই বলে শালা ভূপেন চক্কোত্তি চুরি করতে বললে সেটাই করবি? কেন বুঝিস না, ভূপেন চক্কোত্তিদের মতো কুত্তাগুলো হরবকত চাইছে তোরা নিজেরাই খেয়োখেয়ি করে মর। এতে ফায়দা হবে ওই ঢ্যামনার। ভেড়ির মালিকানা হাত ফসকেছে তো কী হয়েছে, গজার মতো আকাট-মুখ্যুদের পয়সার লোভ দেখিয়ে বদলা নেবে— মাছ নষ্ট করে দেবে— তোদের ভাত মেরে নিজে খাবে— বাঞ্চোত, এরা মানুষ?”

সমাজকে এতটা তলিয়ে দেখতে জানে যে-মানুষ, সে নিজের প্রতি যখন ভয়ানক রকমের উদাসীন হয়ে থাকে, তখন মনে হয়, বিলেদার এত জীবনবোধ আদপে ফক্কা— সে আসলে পাড়ার বাতেলাবাজ দাদাই, এর বেশি কিছু নয়।

এর চেয়ে বেশি কিছু হতে চাইলে দশ-বারো বছর আগে বিলেদার গা থেকে অগোছালোতার খোলস ঝেড়ে ফেলত হত, বাবার চাকরিটা নিয়ে ঢুকে পড়তে হত কারখানায়, ময়ূরপক্ষী আর চাপড়াসের ঢিলিপ্যাঁচ থেকে চোখ নামিয়ে কয়েক মুহূর্ত ঠায় তাকিয়ে থাকতে হত মায়ের কালি কালি মুখের দিকে— কী অপরিসীম অসহায়তা, উনুনের ধোঁয়ার সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করেছে এক ব্যর্থ মায়াবী সিল্যুয়েট।

— “তুই কি আমার মরামুখ দেখলে শান্তি পাবি?”

— “সকাল সকাল শুরু করলে দেখছি। বললাম তো, নারাণদার সাথে কালই কথা হয়েছে।”

— “তোর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তো রোজই নারাণদার সাথে কথা বলছিস। তারপরেও লোকের কাছে নির্লজ্জের মতো হাত পাততে হচ্ছে। তখন এতবার করে বললাম, বাবার চাকরিটা নিয়ে নে, নিয়ে নে—”

— “আচ্ছা মুশকিল হল তো! তোমার জ্বালায় বাড়িতে থাকাই দায় আমার।”

— “চলে যা, চলেই যা। কে বলেছে তোকে থাকতে হতচ্ছাড়া?”

বিলেদা আর কথা বাড়াল না। ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাবার চাকরিটা বিলেদা চাইলেই নিতে পারত। শুধু একবার তুষারবাবুর সামনে গিয়ে, কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে হত, “স্যার, আমার চাকরিটা যদি করিয়ে দেন, তাহলে বেঁচে যাই।”

তুষারবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলত, “কেন করিয়ে দেব না? নেতা হয়েছি কি এমনি এমনি!”

কুৎসিত হাসির পেছনে যে না-কথাগুলো থাকত, যে না-কথাগুলো ইশারায় বুঝে নিতে হত বিলেদাকে, “ওহে বুঝলে, তুমি আজ থেকে আমার বাঁধা!”

ঘেন্না করে বিলেদা— তুষারবাবু, ভূপেন চক্কোত্তির মতো প্রত্যেককে বিলেদা মনে মনে থুতু দেয়। তুষারবাবুর মুখের ওপর বলতে ইচ্ছে করে, “তোর চাকরি আমার চাই না।”

মনে পড়ে, সতেরো-আঠেরো বছর বয়সে কারা যেন শিখিয়েছিল, এরাই হচ্ছে শ্রেণিশত্রু— এদের খতম করো— নইলে আমরা মরে যাব— গরিব আরও গরিব হবে— ধনী আরও ধনী।

নকশাল আন্দোলনের আগুন সারা পশ্চিমবঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলছে। সেই আগুনে পাছা স্যাঁকার লোভে পাড়ার পাঁচুদাও শ্রেণিশত্রু নিধনযজ্ঞে সামিল— যদি বাড়িটার আর একতলা তুলে ফেলা যায়, কিছু কাঁচা টাকা পাওয়া গেলে সোনাদানা গড়িয়ে রাখা যায় এই সুযোগে।

— “কানার মতো ভ্যান চালাবি তাই বলে? দিয়েছিস তো বাগানটার পিণ্ডি চটকে!”

— “দ্যাখতে পাইনি বাবু। খড়ের গাদায় বোঝাই তো, পেছন দ্যাখা দায়।”

— “মুখে মুখে যতই তর্ক কর, আজ তোকে ছাড়া হবে না। চণ্ডী বাড়ি ফিরুক, তারপর নিজেই বুঝে নেবে।”

পরিস্থিতি আপাতত গম্ভীর।

চণ্ডীদা, এই তো গত পরশুই বাড়ির সামনে মরশুমি ফুল গাছ লাগিয়েছে। বেড়াও দিল বাঁশের। আজ সকালে, খড়বোঝাই একটা ভ্যান, মোড় ঘুরতে গিয়ে, নিতান্তই ভুলবশত বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়েছে বাগানে, মাড়িয়ে দিয়েছে সদ্য লাগানো চন্দ্রমল্লিকার চারা। চণ্ডীদা কাজে বেরিয়েছে, বাড়িতে তার বুড়ি মা একলা। তিনি বেজায় অনুদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন একমাত্র মোহিনী সান্যাল— চণ্ডীদার প্রতিবেশী— সরকারি চাকুরে, ঢালাও পয়সা, সেই সময়েই হাঁকিয়েছে তিনতলা বাড়ি। বাড়িতে বড়োসড়ো গোয়াল আছে।

মোহিনী সান্যাল ঘটনার সময় বারান্দায় বসে রেডিয়ো শুনছিল। চেঁচামেচি করে বিলেদার দলবলকে সেই ডেকে এনেছে।

— “ঐ ব্যাটাকে ধরে রাখ বিলে, একদম ছাড়বি না।”

— “ছাড়ব কেন মোহিনীদা, এবার দড়ি দিয়ে বাঁধব!”

ভ্যানচালকের প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। বিলেদার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, “আমারে ছেড়ে দ্যান বাবু। বেলা গড়ায়ে গেলে আর দাম পাবুনি। খড়ের আঁটিগুলা যে সব পচি যাবে।”

একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে এবার। চণ্ডীদার বুড়ি মা জানালায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বিলেদার দলবল রে রে করে তেড়ে যাচ্ছে ভ্যানচালকের দিকে, আবার পিছিয়ে আসছে।

— “দাম পাবি না, পাবি না! আনাড়ির মতো ভ্যান চালাবি, তাতে আমরা কী করব! সন্ধ্যে অবধি চুপ করে বসে থাক শালা।”

মোহিনী সান্যাল বেশ কিছুক্ষণ পর, বেশ বক্তৃতার ঢঙে বলল, “ছেড়ে দিতে পারি, যদি ঐ খড়ের আদ্ধেকটা আমায় দিয়ে দিস।”

— “এমনি এমনি দে দেব?”

— “নয়তো কী! ক্ষতিপূরণ, ক্ষতিপূরণ। কী বিলে, তাই তো?”

জোর গলায় মোহিনী সান্যালকে সমর্থন করতে গিয়ে কোথায় যেন থমকাল বিলেদা, চমকালও বটে। অনেক মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকে, গমগমে পরিবেশকে শান্ত করিয়ে দিয়ে, কারা যেন বলল— তুই নাকি নকশাল করিস! ছ্যা! ছ্যা! লজ্জা করে না? তোর সামনেই মোহিনী সান্যাল, হদ্দগরিব ভ্যানওয়ালাকে বাগে পেয়ে আদ্ধেক খড় বিনে পয়সায় নিজের গোয়ালে চালান করছে, আর তুই হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাচ্ছিস? তোরাই আবার শ্রেণিশত্রু খতমের কথা বলিস!

বিলেদা কেমন ভেবলে যায়। এতক্ষণ তার কানে কানে কে কথা বলছিল! হন্যে হয়ে ভিড়ের মাঝে বিলেদা তাঁকে খুঁজে বেড়ায়, পায় না, আবার খোঁজে, আবারও পায় না। বিলেদা তো হাওয়ায় ভেসে ভেসে নকশাল হয়েছে। পার্টির লাইন নিয়ে মাথা ঘামানোর সে কে! মিটিং-মিছিলে ভিড় বাড়ায়, চিৎকার করে, অস্পষ্ট কিছু কিছু কথা কানে আসে, ভুলেও যায়— ঠিক ভুলে যায় না, অবচেতনে তলিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সেইসমস্ত অস্পষ্ট কথা পৃথিবীতে নেমে আসে, বিলেদাকে ভেবলে দিয়ে চলে যায়— সে তন্নতন্ন করে খোঁজে তাদের, তারা ধরা দেয় না— অস্পষ্ট, আবছা, একটা জলীয় আস্তরণের ওপারে চলে যায়। বিলেদাও তো নিজেকে কোনোদিন আন্দোলনের কাছে ধরা দেয়নি, আলতো করে ছুঁয়েছে।

— “না মোহিনীদা। ক্ষতিপূরণ-টূরণের আর দরকার নেই। ওকে আমরা ছেড়ে দেব।”

— “ছেড়ে দিবি? চণ্ডীর বাগানটাকে ভেস্তে দেওয়ার পরে বেমালুম ছেড়ে দিবি? এই তোরা পাড়ার ছেলে? দায়িত্বজ্ঞানহীন অকম্মার—”

— “আদ্ধেক খড় দিয়েই-বা কী হবে মোহিনীদা। ওর ঢ্যাঙা শরীরটা আর একটু ঢ্যাঙা হবে, এই যা। বাকিটা আমরা দেখে নিচ্ছি, আপনি বরং ঘরে যান। এই ব্যাটা, ওঠ, চল ভাগ এখান থেকে। ভাগ!”

— “যে যা খুশি করবে আর ছেড়ে দিবি! উচ্ছন্নে যাচ্ছে পাড়াটা, উচ্ছনে যাচ্ছে— এই আমি বলে দিলাম।”

সত্তরের দশক হোক বা আজকের অসময়— আখের গোছানোর ধান্দা তো ছোঁয়াচে রোগের মতো সভ্যতার অন্দরে অন্দরে! আর বিলেদা, বোকার মতো, যেখানে যত স্বার্থান্বেষী মানুষ ছিল, আছে, তাদের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে জানিয়ে গেছে তার একক প্রতিবাদ। হতে পারে সে-প্রতিবাদ বলিষ্ঠ নয়, তবু জানিয়েছে। আবার হয়তো শুনতে চেয়েছে সেই আশ্চর্য মানবের কথা।

আঠেরো বছরের বিলেদা সেদিন চুপিসারে বাবার পকেট থেকে দশ টাকা সরিয়ে চলে গিয়েছিল চণ্ডীদার বাড়ি। চণ্ডীদা বলেছিল, “ধুর পাগল! আমারই তো দোষ। আমিই বোকার মতো মোড়ের পাশে গাছ লাগিয়েছিলাম।”

— “তাও তুমি এই টাকাটা রেখে দাও চণ্ডীদা, ভ্যানওয়ালার ক্ষতিপূরণ!”

— “খুব পেকেছিস দেখছি। বাড়ি যা তো!”

তখন বয়স কম, সংসাসের প্রতি টানও হয়তো কম। একমাত্র তখনই নিজেকে কুড়িয়ে-কাঁচিয়ে উজাড় করে দেওয়া সম্ভব। ঘরে চাল বাড়ন্ত, মাসের শেষ তিনটে দিন আধপেটা খেয়ে থাকতে হতে পারে, তবুও ভ্যানওয়ালার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যে হাত কাঁপে না।

বিলেদার টান ছিল— টেনে প্যাঁচ খেলার সময় বিলেদা তুড়ি মেরে মেরে পুরো আকাশ সাফ করে দিত— এই টান টান টান টান, ভোওওওওকাট্টা! তেমন টানে আকাশে দিব্যি টিঁকে থাকা যায়, মাটিতে ঠাঁই পাওয়া যায় না। মাটি তো স্থির হতে শেখায়, ধারণ করতে বলে, বলে চুপ করো— যদিও বিলেদা এ-সবের ধার ধারেনি কোনো কালেই।

বিলেদার যখন চল্লিশ বছর বয়স, বাবাকে হারাল সে। ঠিক দু-বছরের মধ্যে মাটাও এক অর্থে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করল। বোধহয় সেই প্রথম বিলেদাকে স্পর্শ করেছিল ছাদহীনতার কষ্ট। মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেলে নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশীদার মনে হলেও, ভাটা পড়ে ঘুড়ি ওড়ানোয়। তখন আর দুপুরে একমুঠ খেয়েই একছুট্টে ছাদে ওঠা যায় না। নিজের বোধের মধ্যে থেকে এক শক্তি তাকে আটকে দেয়, আটকে দেয়, অদৃশ্য খিল এঁটে দেয় ছাদের দরজায়, এদিকে ক্রমাগত ঠেলতে শুরু করে মুদির দোকানের দিকে— ওরা হিসেবের খাতা লেখার লোক খুঁজছে।

বিলেদা তাই হিসেবরক্ষক— পাড়ার সবচেয়ে বড়ো মুদির দোকানের। যাপনের প্রথম ভাগে, মানে সকালে সে পাড়ার দাদা, দুপুরে ঘুড়ি আর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত হিসেবরক্ষক— ভেসে বেড়ানোর মতোই বিলেদা কী অনিয়ত, তার রূপ কত অনিশ্চিত!

বিলেদা দোকানে কাজ করছিল, ঠেলে গড়িয়ে চলছিল, ঘুড়িও ওড়াচ্ছিল ইচ্ছে হলে, ভারি আশা করে বসেছিল নারাণদার ওপর— খাতালেখার কাজ থেকে তাকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র নারাণদা। কিন্তু একদিন ভোররাতে খবর এল, নারাণদার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথটুকুও সে পেরোতে পারেনি। নারাণদার মৃতদেহের সামনে বসে, দূরে, ওই ভিড়ের মধ্যে, বিলেদার ভাসা ভাসা কিশোরসুলভ চোখদুটো কাউকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল— হতে পারে সেই আশ্চর্য মানবকে, যে এই শেষবারের মতো পৃথিবীতে নেমে এসে বিলেদাকে মুক্তি দিত: যা দূর হ! তুই মুক্ত… ফুঃ…

একটা বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ, একআকাশ অতৃপ্তির মেঘ, কিংবা কোনো বিষণ্ণ শূন্যস্থান— বিলেদাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গ্রাস করছিল দিনে দিনে। দোকান থেকে প্রায় লাথি মেরেই বের করে দিল। এখন ঘুড়ি ওড়াতে উঠে প্রায়শই লাটাই থেকে সমস্ত সুতো বের করে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে। শরীরের একটা অংশ তো উড়ছেই, বাকিটা নিশ্চয়ই টেনে নেবে। মায়ের মুখঝামটা শোনার জন্যে জানলার ধারে চুপ করে বসে থাকে। মোহিনী সান্যাল, ভূপেন চক্কোত্তি কিংবা তুষারবাবুরা ভীষণ বোকা— আমিত্বের বাইরে বেরিয়ে কোনোদিন ঘুড়ি হতে পারবে না, সন্ধ্যাতারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলতে পারবে না, “নারাণদা, ক-টা টাকা দাও না, একদিন সব সুদসমেত ফেরত দেব, দেবই!”

এত ঘুড়ি, এত রং, এত নকশা, এত এত ভোকাট্টাকে টপকে, বিলেদা এখন চাইছে স্রেফ ধুলো হয়ে যেতে। পাড়ার ছোটো ছোটো বাচ্চাদের ডেকে বলে, “ঘুড়ি নিবি? দিতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে। যদি আমি ধুলো হয়ে যাই, তাহলে আমাকে উড়িয়ে দিবি তো এক ফুঁ-এ?”

ভয় পেয়ে সবাই পালায়— সচরাচর কাছে ঘেঁষতে চায় না আর। রামু বলে, “আমাদের সাথে ভেড়িতে কাজ করবে বিলেদা? টাকাপয়সা কিচ্ছু দিতে হবে না, মাক্কালি!”

গজা বলে, “আমার ছেলেটাকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়ে দেবে?”

গজা-রামু, ওরা সবাই বলে, “তুমি নকশাল করতে বিলেদা? তুষার ব্যানার্জীকে তোমরাই মেরেছিলে, না? বেশ করেছিলে মেরে!”

উষ্ণ রক্তের জ্বালাময় স্রোত আর অনুভব করতে চায় না বিলেদা। জোর করেই মনে করতে চায় না আশ্চর্য মানবের কথা। অবাঞ্ছিত পিছুটানগুলোকে সে যত এড়াতে চাইছে, ততই আরও জড়িয়ে পড়ছে— মায়ায়— জালে— মায়াজালে।

— “শোন গজা, আমি শালা যদি আজ রাতে ধুলো হয়ে যাই, কাল সকালে আমায় উড়িয়ে দিবি তোরা? অ্যাত্ত বড়ো ফু দিয়ে? একসাথে?”

নেশাজড়ানো গলায় গজা উত্তর দেয়, “তোমার জন্যে জান হাজির!”

তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে জ্বরাক্রান্তের মতো বিলেদা দৌড়োয় স্টেশানের দিকে, গায়ের ময়লা চাদর রামুর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে। দারুণ কুয়াশারাতে, একটা থ্রু ট্রেনের অ্যানাউন্স শুনে লাইনের ওপর শুয়ে পড়ে। মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যায়— জটের ভেতর জঞ্জাল— জঞ্জালে আস্তাকুঁড়ের শব্দ— আমার ছেলেটাকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়ে দেবে বিলেদা— বেশ করেছিলে মেরেছিলে— টাকাপয়সা লাগবে না— মাক্কালি— তুমি নকশাল করতে— ভেড়িতে কাজ করবে— মাক্কালি— কিচ্ছু লাগবে না— মাক্কালি…

এ যেন অমোঘ কুয়াশায় চোখ-কান-মাথা দলা পাকিয়ে এক মাংসপিণ্ড হয়ে চেতনায় হাবুডুবু হাবুডুবু করে… একহাত দূরে মানুষ দাঁড়ালে টের পাওয়া অসম্ভব। হিমশীতল ধাতব পাতের ওপর মাথা রেখে বিলেদা বিড়বিড় করে, “চার নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে, কত নম্বরে গলা পেতেছি? কোন লাইনে? নিশ্চিত চারে তো? এক্ষুনি ট্রেন আসবে। ট্রেন। আসবে। আসবে তো? আসবে? আদৌ?”

Facebook Comments

পছন্দের বই