লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

অনুপম মুখোপাধ্যায়

আন্ডারপাস এবং প্লাস্টিকের চেয়ার

বাড়ির কাছে একটা আন্ডারপাস। সন্ধ্যের পর সেটা একরকম শুনশান থাকে। মাথার উপর দিয়ে বিরাট বিরাট লরি যায়, বাস যায়, টেম্পো, ম্যাটাডোর, পিক আপ ভ্যান, ফিনফিনে মোটরবাইক যায়, রয়্যাল এনফিল্ড যায়। আন্ডারপাসের ভিতরে একঠায় একটা আলো জ্বলে থাকে, খাঁ-খাঁ করে। ওটা তৈরি হয়েছিল স্কুলের ছেলেমেয়েদের সুবিধার জন্য। এক বছরের উপর হয়ে গেল স্কুল বন্ধ।

কিছুদিন আগেও দেখতাম সন্ধ্যেবেলায় চেয়ার পেতে আন্ডারপাসটার মুখে একজন দশাসই পুরুষ বসে আছেন। বাড়ির সামনে। কিন্তু ওঁর বাড়ির লোককে ওঁর পাশে কখনো দেখিনি। একদম একা। বিরাট চেহারা। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় সমান। ঘাড়টা ঝুঁকে থাকত বুকের উপর। একটা লুঙ্গি কোনোক্রমে কোমরে আটকানো। মাঝেমধ্যে পায়চারি করতেও দেখতাম, মনে হত কষ্ট করে পা ফেলছেন। আজ শুনলাম তিনি কয়েকদিন হল মারা গেছেন।

“স্ট্রোক?”

“না। কোভিড। বডি দ্যায়নি পুলিশ।”

ঠিক বিশ্বাস হল না। পাড়ার আর একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, “আরে ওর তো বিভিন্নরকমের প্রবলেম ছিল। হার্ট। কিডনি। সে-জন্যই গেছে।”

“পুলিশ বডি দিল না কেন?”

“সে পুলিশ আজকাল অমনই করছে। সন্দেহ হলেই কোভিড পেশেন্ট বলে বডি দিচ্ছে না।”

“সন্দেহ কেন? টেস্ট হয়নি?”

“অত জানি না।”

মৃত্যু এমনই একটা অবাক শূন্যস্থান তৈরি করে। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে একটা দোকান থেকে রোজ রাত্তিরে সিগারেট কিনতাম। নিয়মিত অভ্যাস ছিল। একদিন দেখলাম দোকান বন্ধ। পাশের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার? এর কি শরীর খারাপ-টারাপ?”

“মরে গেছে।”

“সে কী! কী হয়েছিল?”

“বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বিষ খেয়েছে।”

সেই চমক আমার আজও কাটেনি। দিব্য হাসিখুশি লোক। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে এটাই বিশ্বাস করা মুশকিল। সে ঝগড়া তো করলই, আবার বিষ খেল, মরেও গেল! সেই রাত্তিরে মাথার উপর তারায় ভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল ওর দোকান থেকে কেনা আমার সব সিগারেটের আগুন যেন সেখানে জ্বলছে, ইয়ার্কি মারছে।

এখন আন্ডারপাসটার কাছে গেলে একটা ফাঁকা প্লাস্টিক চেয়ার চোখে পড়বে।

লোকটার ওজন ঐটুকু একটা চেয়ার কী করে রাখত, তখন অবাক হতাম, এখনও অবাক হয়েই ভাবছি।

সন্ধ্যেবেলায় একটু হাঁটতে না বেরোলে চলে না। লকডাউন চলছে। সব দোকানপাট বন্ধ থাকে। লোকজন রাস্তায় নেই। যারা মহামারিকে ভয় পায় না, তারাও পুলিশকে ভয় পায়। পুলিশের মার পুরোদমে চলছে শহরে। কোনো কিছু না ভেবেই তারা লাঠি চালিয়ে দিচ্ছে শুনছি। আমাকে বেরোতেই হয়। সন্ধ্যেবেলায় একটু বাইরের হাওয়ায় না বেরোলে দম আটকে আসে। যতই অসামাজিক হোক, আত্মবিধ্বংসী হোক, কিছু ক্ষেত্রে তো করার কিছু থাকে না।

আন্ডারপাসটা পেরিয়ে দেখলাম প্লাস্টিকের চেয়ারে আজ ভদ্রলোকের ছেলে বসে আছে। অশৌচের পোশাক পরে আছে। এরও চেহারাটা খুব মোটার দিকে। হয়তো একদিন বাবার মতোই ওবেসিটি ধরবে একেও। অমনই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকবে, কষ্টেসৃষ্টে নড়াচড়া করবে।

একবার এই ছেলেটার সঙ্গে আমার রাস্তায় তর্ক হয়েছিল। হঠাৎ করে আমার মোটরবাইকের সামনে এসে হাজির হয়েছিল। আমি ব্রেক কষতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। ছেলেটা নিজের দোষ স্বীকার করেনি।

সেই থেকে এর সঙ্গে দেখা হলেই মনটা কিছুটা তেতো হয়ে যায়।

আজ তবু দাঁড়ালাম। বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে। ছেলেটা মুখে মাস্ক পরে নেই। বাড়ির সামনে রাস্তা থাকলেও সেখানে কেউ মাস্ক পরতে চায় না। বাড়ি আর নিরাপত্তা যেন দুটো অবিচ্ছেদ্য ধারণা।

বললাম, “খবরটা আমি আজ শুনলাম। উনি কি তাহলে কোভিডেই…”

“না না, বাবার অনেকরকমের অসুস্থতা ছিল। কোত্থেকে কোভিডের গুজবটা রটেছে কে জানে! আসলে এখন কেউ মারা গেলেই কোভিড ভেবে নিচ্ছে লোকজন।”

“তবে যে শুনলাম বডি… ইয়ে… দেহ দ্যায়নি পুলিশ!”

ছেলেটা বিরক্ত মুখে বলল, “কে বলল? আমি নিজে মুখাগ্নি করেছি। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।”

“ওহো…”

আমি আর না দাঁড়িয়ে পা বাড়ালাম। আজ সম্ভবত ছেলেটার সঙ্গে তিক্ততা আরও বাড়ল। এরপর রাস্তাঘাটে দেখা হলে মুখটা আরও বিস্বাদ লাগবে।

ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছি। নিজের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। দু-পাশে বাড়িঘর পড়ছে। ভিতরে আলো জ্বলে আছে। কথাবার্তা আবছা শুনতে পাচ্ছি। রান্নাবান্নার আওয়াজ। টিভির শব্দ। রাস্তায় কুকুরগুলো এখন কেউ গেলেই মুখ তুলে দেখে নিচ্ছে লোকটা কে। এখন সন্ধ্যের পর থেকে সারা শহরের রাস্তায় কুকুরগুলোই প্রভুত্ব করে।

নদীর ধারে এসে পড়ল রাস্তাটা। একদম নির্জন। এখানে কুকুরও নেই। শুনশান হাওয়া দিচ্ছে একটা।

একটু কাশলাম। সেই শব্দ নদীর ওপার থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।

কী খেয়াল হল, হাততালি দিলাম।

নদীর ওপার থেকে হাততালিটা ফিরে এল।

জানতাম আসবে।

অনুপম মুখোপাধ্যায়

পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে থাকেন। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সমস্ত বিভাগেই তিনি লিখতে স্বচ্ছন্দ। সম্পাদনা করছেন বাঙলা কবিতার প্রথম ব্লকজিন ‘বাক্‌’। ই-মেইল : anupam_gtl@yahoo.co.in

পছন্দের বই