লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

দেবব্রত শ্যামরায়

বাবাকে নিয়ে, ব্যক্তিগত

একজন সাধারণ মানুষ কত নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারে। নিঃশব্দ৷ আড়ম্বরহীন। বড়ো মানুষ চলে গেলে কাগজে লেখালেখি হয়। তাঁর কাজ নিয়ে কত আলোচনা। যুবা নায়ক আত্মহত্যা করলে গুণমুগ্ধরা দীর্ঘদিন কাঁদে। স্বাভাবিক। নামহীন মানুষের সে-সব বিড়ম্বনা নেই। তার জীবনের মতোই তার মৃত্যুও বড়ো মূল্যহীন৷ সে আর কোথাও নেই, দেহে নেই, আত্মায় নেই, তার জড় উপাদানগুলি ভেঙেচুরে পঞ্চভূতে লীন। সারা জীবন সংসার ঠেলে যাওয়া ছাড়া তার বৃহত্তর কোনো কাজ নেই। প্রিয়জনের স্মৃতি ছাড়া তার আর কোনো বাসভূমি নেই। সেই স্মৃতিও ক্রমশ ধূসর হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাবে একদিন। পুরোনো জামাকাপড় দিয়ে দেওয়া হবে একে-তাকে৷ চশমাটা শুধু পড়ে থাকবে তাকের কোণায়। এই নিভৃত, নিরুপদ্রব মুছে যাওয়াটাই প্রকৃতির ভারি পছন্দের জিনিস। এই মহাবিশ্বে বিরাট বিপুল নক্ষত্র বা ধরা যাক ছোটো কোনো ফুল, সবই টুপটাপ ঝরে যায়। এই লেখাটি লিখিত হওয়ার সময়েও খুব কাছে, হয়তো-বা বহু আলোবছর দূরে খসে গেল কেউ, তার খবর পৌঁছোল না কোথাও। এই নীরবতা যাপনই প্রকৃতির অভ্যেস। একমাত্র মানুষই ব্যতিক্রম— স্বজনবিয়োগে মানুষই বোধহয় সবচেয়ে বেশি কাঁদে, কেঁদে কেঁদে আঁকড়ে ধরতে চায়।

কোভিড আমার বাবাকে সহসা এই নীরবতা এনে দিল। কোভিড-মৃত্যু, তাই কোনো শ্মশানবন্ধু নেই। রাত দুটোর কোভিড-নির্ধারিত শ্মশান প্রায় জনশূন্য, শুধু ভাগীরথীতীরে দু-একটা কুকুর আর ভিনগ্রহী জীবের মতো পিপিই-পরা দু-জন শ্মশানকর্মীর ঘোরাফেরা যেন কোনো অচেনা ভবিষ্যতের এক ডিসটোপিক পৃথিবীর ছবি আঁকছে। এই নীরব প্রস্থান পিতার কাঙ্ক্ষিত ছিল কিনা জানি না, তবে স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আচার-অবিশ্বাসী সন্তান সামান্য স্বস্তি পেল। মুখাগ্নি নেই, মন্ত্রপাঠ নেই, ব্রাহ্মণ নেই। নির্জন পবিত্র শোক ছাড়া বাইরে থেকে আরোপিত কিছু নেই। মনে হল, নিজের জন্যেও ঠিক এমনই নিরাভরণ বিদায় চায় সে।

বিদায় মুহূর্তটি শান্ত, নিরুপদ্রব— এই ভুল ভেঙে যেতে বেশি দেরি হল না। পিপিই-পরা সৎকারকর্মীরা অচিরেই নানা পরিষেবার দরপত্র খুলে বসলেন। কালো প্লাস্টিক সরিয়ে মৃতের মুখ দেখার মূল্য পাঁচশো, দাহের পর মৃতের নাভিকুণ্ডটি সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে চাইলে তার জন্য নগদ হাজার দুয়েক। তাঁরা জানায় যে শোকার্ত পরিজনকে তাঁরা বিরক্ত করতে চায় না, কিন্তু অনন্যোপায়, কারণ, নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড বডি নিয়ে তাঁদের ঘাঁটাঘাঁটি করতে হচ্ছে, অতএব এই সামান্য উপরিটুকু তাঁদের প্রাপ্য। না, কোনো পরিষেবাই আমার দরকার নেই, শুধু বাবার চলে যাওয়াটুকু দূর থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে চাই। তা সম্ভব নয়, কেন-না ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। অতএব পকেটে যা ছিল তা দিয়ে বকশিস মিটিয়ে যখন বেরিয়ে আসি, ততক্ষণে স্বয়ংক্রিয় কনভেয়ারে অমোঘ চুল্লির ভেতরে ঢুকে গেছে প্লাস্টিকসমেত বাবার শরীর। অবিভক্ত ভারতের নারায়ণগঞ্জ জেলার কুমুন গ্রামে একাশি বছর আগে যে-শিশুটির জন্ম হয়েছিল, দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে দিদির হাত ধরে এপারে এসে জীবনভর যে-সংগ্রামের শুরু, তার সৎ ও পরিশ্রমী জীবনের শেষতম পার্থিব চিহ্নটি এক শরতের রাতে পানিহাটির গঙ্গাতীরে একটি কোভিড শ্মশানে চিরতরে মুছে গেল। আর কোভিডকালে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য স্বজনহারা মানুষের সঙ্গে একই সুতোয় জড়িয়ে গেল আমার নাম।

ভিড় করে আসে স্মৃতি। স্মৃতিতে ভর করে আর আত্মীয়স্বজনের কাছে শোনা কথা থেকে নির্মাণ করে নিই মানুষটিকে। কোন মানুষটার কথা বলি, কোন মানুষটাকেই-বা বাদ দিই! যে-মানুষটাকে কচি বয়সেই দাদা-দিদিদের সঙ্গে উদ্বাস্তু কলোনির রাস্তায় জলের লাইনে দাঁড়াতে হত। স্কুলফেরতা গোবর কুড়োতে হত তাঁকে, মা ঘুঁটে দেবেন বলে। সেই মানুষটা ব্যারাকপুরে দেবীপ্রসাদ স্কুলে অনেকবার অংকে একশো পেয়েছে, নব্বইয়ের নীচে কোনোদিন পায়নি। যে-মানুষ উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই নিজের খরচ চালাতে নিয়মিত টিউশনি করত, এমনকী নিজের ক্লাসের ছেলেদেরও পড়াতে পারত। সেই মানুষটাকেই একদিন বাড়ির ওপর চাপ কমাতে পড়াশুনোর পার্ট দ্রুত গুটিয়ে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হতে হয়, টেকনিকাল স্কুলের সার্টিফিকেট নিয়ে আপন দক্ষতায় চাকরি জোটে সাহেবি ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানিতে। পদোন্নতি হচ্ছিল, হঠাৎ সাহেবি কম্পানি এ-দেশে ব্যাবসা গুটোনোয় চাকরি যায়। আর পরের চাকরি না করে হাতেকলমে কিছু করার তাগিদে কিছু সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিন কিনে শুরু হয় একান্ত নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক্স। ইতিমধ্যে জীবনে প্রেম এসেছে। কালো লোককে কোনোদিনই পছন্দ ছিল না মায়ের। ফুচকাওলার রং কালো বলে ফুচকা না খেয়ে পয়সা ফেরত নিয়েছিল বর্ণবৈষম্যবাদী মা। এহেন মায়ের কালো প্রেমিক ও স্বামী জুটল। অতঃপর একটি সন্তান। সব কিছুর মধ্যে হুগলি শিল্পাঞ্চলের কয়েকশো অতিক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগের মধ্যে একটি হয়ে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নেয় বাবার কারখানা। সংকটও আসে, কখনো অর্থনৈতিক, কখনো-বা রাজনৈতিক। উত্থানে-পতনে, ঘাতে-প্রতিঘাতে এইভাবেই জীবন এগিয়ে চলে। জীবন যেরকম…

জীবন এরকমই। উনিশ অথবা বিশ। জনমানুষের তুচ্ছ যাপনের ভিড়ে আরও একটি সামান্য জীবনের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা কী-ই-বা প্রয়োজন? সন্তানের আগ্রহ থাকতে পারে, কিছুটা পক্ষপাতও। কিন্তু প্রতিটি মানুষের জীবনেই তো এমন কাহিনি আছে, তাতে জিত আছে, হার আছে, কিন্তু সে-সবই বড়ো আটপৌরে৷ তাতে কোনো অতিরিক্ত বীরত্ব নেই, সমাজ-সংসারে হইচই ফেলে দেওয়া প্রথাভাঙা কৃতিত্ব নেই, অ্যাডভেঞ্চার নেই, বরং কিছুটা অসহায় ভীরুতাই থেকে যায়, ঠিক যেমন নকশাল আমলে প্রতি রাতে আপিস ও তারপর টিউশনি সেরে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরত বাবা আর গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করত এক নববধূ।

কিন্তু আজ যখন বাবা নেই, মনে হচ্ছে, বাবার সঙ্গে বসে আরও কিছুটা সময় কাটানো উচিত ছিল আমার। আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানোর খাতিরেই না হয় পাশে বসে দেখা উচিত ছিল বাবার পছন্দের সিরিয়াল। জানা হল না বাবার অনেক কিছু! আমি জানতে পারলাম না, কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি, বাবার পছন্দের রং কী? আদৌ ‘পছন্দের রং’ শব্দবন্ধটা নিয়ে কোনোদিন কিছু ভেবেছে কিনা আমার সাদামাটা বাবা। জানা হল না, এ-জীবনে তাঁর কোনো অপ্রাপ্তির বোধ রয়ে গেল কিনা! হ্যাঁ, আন্দামানের গল্প শুনে কথায় কথায় একবার ঘুরতে যেতে চেয়েছিল বাবা। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের হাজারো বাধ্যবাধকতার চাপে সে-সব নিয়ে কথা হয়নি আর। ঠিক যেমন জানা হল না, আর একটিবার বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে নিজের গ্রামের মাটিতে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল কিনা! সম্ভবত না, বাবা পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে ভালোবাসত না তেমন। সকালের বাজার, বসবার ঘরে নিজের চেয়ার ও টেবিলে খবরের কাগজ, চায়ের ফ্লাস্ক আর টিভির রিমোট নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছিল অবসরের দিনগুলো। বাবার হাতে অনেক সময় ছিল কথা বলার জন্য, আমারই শোনার সময় ছিল না তেমন। তাই অনেক কিছুই ভালো করে জানা হল না, বাবা…!

ঠিক যেমন জানা হল না… কোভিড হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে জীবনের শেষ সাতদিন একা একা শুয়ে, কষ্ট পেতে পেতে, চেতন থেকে অচেতনের দিকে ক্রমশ ডুবে যেতে যেতে, কার কথা ভাবছিল লোকটা? মায়ের কথা? উজানের কথা? কার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছিল, শেষবারের মতো কার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল বাবার?

কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার পর বাজারে গেলে বাবা মাঝেমধ্যে হারিয়ে যেত। এক ঘণ্টা… দু-ঘণ্টা। আমি বাড়ি থাকলে মা-র ঘ্যানঘ্যান সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে পড়তাম। হন্যে হয়ে বাবাকে খুঁজতাম।

আমাদের সবুজ মফস্সলে রাস্তার দু-ধারে সকালের রোদে বাজার বসত। আশেপাশের গ্রাম থেকে তাজা শাকসবজি আর মাটিমাখা ডিম নিয়ে আসতেন চাষি-বউ। খুব ভোরে ঘোষেদের পুকুরে জাল পড়ত। ওপার বাংলার রোদে-জলে পুষ্ট বাবার নিয়মিত মাছ না হলে চলত না। শাকও কিনত প্রচুর। বাজারের থলে উপচে পড়ত কলমি, পালং, আলোরং কুমড়ো ফুলে। মা-র মুখ ভার হত। এত শাক আনো কেন? নষ্ট হয় তো! বাজারে গিয়ে বাবার প্রথম কাজ ছিল এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘোরা। বাজার করার এটাই নাকি প্রথম সূত্র। বাজার করার আগে বাজারকে হাতের তালুর মতো চিনে নিতে হয়। দেখতে হয় কার কাছে আজ ভালো কী কী এসেছে, কী তার দাম। তারপর বাজার করা শুরু।

শুরু হত বটে, কিন্তু বাজার করা শেষই হত না অনেক সময়। বাজারের মাঝখানে ঢুকে পড়ত গল্প। রাজনীতির আলোচনা। গরম চায়ের গেলাস। সকাল হলেই আমাদের শান্ত শহরতলির রাস্তা ভরে উঠত সাইকেলের ঘণ্টিতে৷ জার্মান সিলভারের সস্তা টিফিন বাক্স চটের ব্যাগে ঝুলিয়ে সাইকেল চেপে আশেপাশের কলকারখানায় পৌঁছে যেতেন পানিহাটি শিল্পাঞ্চলের মানুষজন। ঠিক আটটায় জুটমিলের ভোঁ বাজত। পাড়ায় কোনো-না-কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসত বিনুনিবাঁধা বালিকার গলা সাধার আওয়াজ৷ চায়ের দোকানের কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত হেমন্তের অলস সকাল। রাস্তার পাশে সেদিনের গণশক্তি আটকানো থাকত বাঁশের চটায়। বাবা একাধিক খবরের কাগজ পড়ে, চা খেয়ে, চেনাজানা নানা মানুষের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরত। বাড়ির কাছাকাছি এলে অবশ্য হাঁটার গতি বেড়ে যেত৷ অপেক্ষমান মায়ের রাগত মুখটা মনে পড়ত বোধহয়। যেদিন মনে পড়ত না আমি গিয়ে খুঁজে আনতাম। বাবাকে পেতাম কোনো চায়ের দোকানে, খবরের কাগজের ঠেকে অথবা ধীরে ধীরে সংখ্যায় কমতে থাকা বন্ধুদের আড্ডায়।

বহুদিন আর সাইকেলের ঘণ্টি কোরাস শোনা যায় না। মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে কবেই। বেশিরভাগ কারখানা ভেঙে তৈরি হয়েছে টাউনশিপ। বাস্তু-অনুমোদিত অ্যাপার্টমেন্ট্স। সত্তর শতাংশ গ্রিনারি। এছাড়া যে-সব কারখানার জমিজমা নিয়ে মামলা চলছিল, সেগুলোও এক এক করে কিনে নিয়েছেন এলাকার এমএলএ-র জামাই। গোডাউন তৈরি হবে। পথের দু-ধারে মাথা তুলেছে আরও কিছু শ্রীহীন আবাসন। রাস্তা থেকে উঠে এমনই এক আবাসনের নীচে ঢুকে গেছে পুর বাজার। কৃত্রিম আলোয় ছলকে উঠছে মৃত মাছের চোখ। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কাতলার ট্রাক ঢুকেছে রাতের শহরে।

আজ বাজারের সামনে ফ্ল্যাটের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে এইসব পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। বাবার ক্রিমেশন সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আমি তখন হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি একটা জেরক্সের দোকান!

মানুষ বুড়ো হলে হঠাৎ একসময় আকাশের তারা হয়ে যায়। উজানের দাদা অর্থাৎ, ঠাকুরদাও তারা হয়ে গেছে— বছর পাঁচেকের শিশুটিকে শোকে কিছু আস্বস্ত করার তাগিদে বিষয়টা এইভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তাকে এসব বলার পর থেকে আরেক নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে৷ এখন সে যার নামই শোনে— মার্ক জুকেরবার্গ থেকে মমতা ব্যানার্জি— একবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেয়, দুর্দৈবক্রমে এঁরা কেউ স্টার হয়ে গেছেন কিনা! বালাই ষাট!

যাইহোক, শিশুদিবসে উজানের ইশকুল থেকে অনলাইনে বাড়ির কাজ এসেছিল— এক পাতা হাতের লেখা— আই লাভ চাচা নেহেরু। চাচা নেহেরু কে? চাচা নেহেরু কি তারা হয়ে গেছে? হ্যাঁ, তা হয়েছে। করোনায়? না না, অনেকদিন আগেই। চাচা নেহেরুর সঙ্গে কি আমার দাদার দেখা হয়েছে? আমি ভাবতে চেষ্টা করি, নেহেরু যখন রাণাঘাটে উদ্বাস্তু শিবিরে এসেছিলেন, বাবারা ততদিনে ব্যারাকপুর সদরবাজারে, মুসলিমদের খালি করে চলে যাওয়া মহল্লায়। অর্থাৎ, জীবিত অবস্থায় কারো সঙ্গে কারো দেখা হয়নি। কিন্তু উজান আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দেয়, ওই যে চাচা নেহেরু আর দাদা গল্প করছে। আমি সন্ধ্যের আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাই। দেশভাগের ক্ষত পুষে রাখা ও একসময় সক্রিয়ভাবে আরএসএস করা আমার বাবা আজ নেহেরুকে দেখে খুশি হচ্ছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। নাকি আজকের রামরাজত্বে নেহেরুকে সামনে পেয়ে তিনি একটু খুশিই হচ্ছেন? মনে আছে, আঠাশ বছর আগের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি-ভাঙাকে জাস্টিফাই না করতে পারলেও আমার মতো বিষণ্ণ ও ক্রুদ্ধ হতে পারেননি আমার বাবা। তারপর থেকে ক্রমশ বুড়ো হতে থাকা বাবাকে যত আঁকড়ে ধরেছি আমি, পুত্রের থেকে পিতা, রাজনৈতিক বোধে ও দৃষ্টিকোণে, ততই দূরতর হয়েছেন। সে-দূরত্ব আর ঘোচেনি।

উজান আঙুল দিয়ে দেখায়, দাদার পাশে অন্য ছোটো তারাটা কে বলো তো বাবাই? কে রে? ওটা পদ্মাপিসির শাশুড়ি। আমি হেসে ফেলি। পদ্মাদি, উজানের পদ্মাপিসি আমাদের পরিবারের গৃহপরিচারিকা। সম্প্রতি বৃদ্ধা শাশুড়ি মারা যাওয়ায় অশৌচ পালনের জন্য পদ্মাদি কাজে আসতে পারেনি বেশ ক-দিন। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, দুই বিরুদ্ধমতের পুরুষ কথা বলছেন, তর্ক করছেন। আর এক অনামা বৃদ্ধা চুপচাপ তাঁদের জন্য দু-কাপ গরম চা করে দিচ্ছেন। মৃত্যুর পরেও গৃহপরিচারিকার জীবন থেকে তাঁর মুক্তি হল না, এই ভেবে তিনি দুঃখিত হচ্ছেন। তাঁর দীর্ঘশ্বাসে তারার আলো কাঁপছে।

সকালের বৃষ্টিধোয়া গঞ্জের বাজার। কাঁচা আমলকি একশো গ্রামের দাম পঁচিশ টাকা। অর্থাৎ, আড়াইশো টাকা কিলো। বেশ দাম! আমি আমলকি কোনোদিনই পছন্দ করতাম না তেমনভাবে। বাবা ভালোবাসতেন। দুপুরে খাবার পর আমলকি কেটে অল্প অল্প নুন ছুঁইয়ে খেতেন। মাকে দিতেন৷ আমাকেও জোর করতেন খাওয়ার জন্য। কখনো খেতাম, কখনো খেতাম না। আমলকি খাওয়ার পর এক গেলাস জল খেলে মুখটা মিষ্টি হয়ে যায়। আজ হঠাৎ আমলকি খেতে ইচ্ছে করল। বাবার স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হচ্ছে। আমি খুব চেষ্টা করেও আজকাল আর মনে করতে পারছি না বাবার সবগুলো ওষুধের নাম। এক বছর আগেও যা ঠোঁটস্থ ছিল। অন্য দিকে আমি আস্তে আস্তে বাবার মতো হয়ে যাচ্ছি। সেই একইভাবে চুলে পাক ধরছে আমার। একইভাবে বাজার ঘুরে ব্যাগভরতি সবজি নিয়ে বাড়ি ফিরছি। বাবা প্রায় সব সবজিওয়ালা মাছওয়ালাদের নামে চিনতেন। তাঁদের বাড়ির খবরাখবর জানতেন। আমিও চিনতে শুরু করেছি অনেককেই। একটাই কারণ— বৎসরাধিক কোভিডকালে ও বাবার অবর্তমানে আমার বাজার যাওয়াটা অনেকটাই বেড়ে গেছে। সৌমেন সকালে ডিম বিক্রি করে৷ বিকেলে টোটো চালায়। গত লকডাউনে ব্যাবসা লাটে ওঠায় বাজারে মাছ নিয়ে বসেছিল কেউ কেউ। তাঁদের অনেকে এ-বছর ফিরে গেছে পুরোনো পেশায়। অটো বন্ধ ছিল যখন, সিনেমাহলের সামনে চিকেন তন্দুরের ঠেলা বসিয়েছিল রতন। বেশ সস্তা। ভালো রোজগারও হচ্ছিল। কিন্তু ওরা চিরকালের মার্কামারা বাম পরিবার বলেই নাকি তৃণমূল-নিয়ন্ত্রিত ব্যাবসায়ী সমিতি আনলকের শুরুতেই তন্দুর উঠিয়ে নিতে বলেছে, রতন সেদিনই বলছিল।

যে-কথা বলছিলাম, আমি বাবার মতো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। আত্মা জলে ভেজে না, আগুনে পোড়ে না…। আত্মা বুড়ো হয় শুধু। ক্রমশ আমার হাঁটার গতি কমবে। শান্ত হয়ে আসবে হরমোন। মাঝেমধ্যে খিটখিট করব। ফুল সাউন্ড দিয়ে টিভি দেখব, এতটাই যে বিরক্ত হবে বাড়ির লোক। আর আমলকি খেতে ভালো লাগবে খুব। একশো গ্রাম ওজনে পাল্লায় চারটে মাত্র আমলকি। তাদের সবুজ শরীরে সবে হলুদ রং ধরেছে। আজ খাওয়া-দাওয়া সেরে অল্প নুন লাগিয়ে খাব৷ বসার ঘরে রাখা কাঠের চেয়ারটা ফাঁকা। সপ্তাহ মাস বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। বর্ষা আসতে এখনও কয়েকদিন দেরি। একটুকরো অসময়ের মেঘ ঝুলে রইল শেষ দুপুরের আকাশে।

Facebook Comments

পছন্দের বই