লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

রূপায়ণ ঘোষ

চৈতন্যদর্শন: এক বৈপ্লবিক সমাজবাদ

“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনিয়ঃ সদা হরিঃ।।”

নাহ্, এই শ্লোকটির রচয়িতা কোনো প্রাজ্ঞ পক্বকেশ পুঁথিবিদ্যাসর্বস্ব সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নন। সুললিত এরকম অসংখ্য শ্লোকের রচনাকার হলেন বাংলা তথা ভারতীয় ভক্তি-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিশ্বম্ভর মিশ্র-সমাজ ও ইতিহাস যাঁকে চিনেছে শ্রীচৈতন্য রূপে। শ্লোকটির আক্ষরিক অর্থের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে (তৃণাদপি) অর্থাৎ, তৃণের চেয়ে ক্ষুদ্র হও কিন্তু (তরোরিব) বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু হওয়া আবশ্যক। যে-মানুষ অন্যকে সম্মানের চোখে, সমানের চোখে দেখেন তারই পক্ষে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। পঞ্চদশ শতাব্দীর (১৪৮৬ খ্রিঃ) যে-সময়ে চৈতন্যদেবের জন্ম সেই সময় বাংলা তথা সমগ্র ভারতে সুলতানি শাসনের কর্তৃত্ব মধ্যগগনে। অন্য দিকে বঙ্গদেশ ও নবদ্বীপ ছিল তৎকালীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান। সেন শাসনকাল থেকে বিস্তীর্ণ গঙ্গার দু-পাশে জমি ও বিপুল অর্থৈশ্বর্য লাভ করে কুলীন ব্রাহ্মণকুল যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন। এই সময়কালে নবদ্বীপ- শান্তিপুর অঞ্চল ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, দেশের নানান প্রান্ত থেকে বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা এসে এখানে অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও বিদ্যাচর্চা যেমন করতেন তেমনই বিষয়রসে আকৃষ্ট হয়ে গোঁড়ামির প্রবল উন্মত্ততাও লালন করতেন। স্মৃতিশাস্ত্র শাসিত সমাজ ছিল জাতি ও বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পুরাতন স্মৃতিব্যবস্থাগুলির মধ্যেই রোপিত ছিল প্রাচীন ভারতীয় অপসংস্কৃতির বিষাক্ত বীজ। যে-মনুস্মৃতিতে নারী, শূদ্র ও কুকুরকে এক শ্রেণিতে ফেলে নিন্দা করা হয়েছে, যে-স্মৃতিশাস্ত্রে নারী ভোগবাদের অপার স্বাধীনতা ও পুরুষতান্ত্রিক মদমত্ততাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সেই শাস্ত্র শাসিত সমাজ যে আদতে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রাহ্মণ শ্রেণির বেলাগাম অত্যাচারে প্রাণান্তকর অবস্থায় নিম্নবর্গের প্রভূত মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করেন। আশ্চর্যজনকভাবে একই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ক্ষমতাতন্ত্রের সমান নিদর্শন প্রতিফলিত হচ্ছে। পঞ্চদশ শতকের ইতালিতে যে-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়, সেখানে প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে গেল। তৃতীয় ফ্রেডরিক (১৪৫৩-১৪৯২), তৃতীয় চার্লস (১৪৯৬-১৫২১)-এর মতো শাসকেরা ছিলেন নিঃসন্দেহে জ্ঞানদীপ্ত তথাপি আগ্রাসী স্বৈরাচারী। ইউরোপীয় নবজাগরণের যুগেও সেখানে ক্ষমতা ও চার্চকেন্দ্রিক অন্ধসংস্কারের যে-চিত্র ফুটে ওঠে, পঞ্চদশ শতকের ভারত তার চেয়ে পৃথক কিছু নয়। ঠিক এই সময়কালে চৈতন্যদেবের সমাজ সংস্কারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ- মধ্যযুগীয় ভারতের বর্বর প্রথা অবসানের সূচনামুখ।

রূপ গোস্বামী সংকলিত পদ্যাবল্যাং সংখ্যক নয়-এ গৌরাঙ্গ বলছেন,

“নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো।
নাহং বর্ণী ন চ গৃহরপতির্নো বনস্থো যতির্বা।।”

অর্থাৎ, আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র নই, নই গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বনবাসী এমনকী সন্ন্যাসীও নই। তাহলে তিনি কী? তিনি আদ্যোপান্ত মানবেশ্বর প্রেমে মত্ত আর এক মানুষ— যিনি কেবল মানবকে মানবরূপে, সত্যকে পরিপূর্ণ সত্য জেনে সাধনা করেছেন, সেবা করেছেন। কোনো আরোপিত ধর্মমোহের প্রয়োজন তাঁর পড়েনি। সম্মোহন সাধনার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি প্রচার করেছেন প্রেমসর্বস্ব, ত্যাগসর্বস্ব ভক্তিবাদের। তাঁর কাছে আচারব্যূহে নিমজ্জিত ধর্মভাবের কোনো গুরুত্ব ছিল না, উপনিষদের ‘আনন্দরূপচেতনা’-ই হল চৈতন্যদর্শনের মূল আধার। বৈষ্ণব গ্রন্থ ‘ভক্তমাল’-এ বর্ণিত গুজরাতের ঘোগা গ্রামে নটী-শ্রেষ্ঠা অসামান্যা রূপবতী বারমুখীর সম্মুখে অশ্রুসজল নয়নে তিনি উচ্চারণ করছেন— হে সখী, হৃদয়ের অভ্যন্তর হইতে ঈশ্বরের নিমিত্ত প্রেম সঞ্চার করো, সে-স্থানে জগতের নাম, রূপ, কর্ম সদা সঞ্চারণশীল, উহাতেই মুক্তি। আশ্চর্যের বিষয় বৃহদারণ্যক উপনিষদের খিলকাণ্ডের পঞ্চম অধ্যায়ে ধ্বনিত হচ্ছে একই স্বর—

“এষ প্রজাপতির্যদ্ধৃদয়মেতদ্ ব্রহ্মৈতৎ সর্বং তদেতৎ ত্র্যক্ষরং হৃদয়মিতি হৃ ইত্যেকমক্ষরমভিহরন্ত্যস্মৈ।।”

অর্থাৎ, হৃদয়ের ভূমিতে নাম, রূপ, কর্মের নিবাস। হৃদয়ই সর্বভূতের অধিষ্ঠান ও সর্বভূতাত্মক প্রজাপতি। অতএব সকল স্তরে, জীবে, শ্রেণিতে হৃদয়ব্রহ্মই এক এবং একমাত্র উপাস্য। যে-বিষয়টি এখানে লক্ষণীয় তা হল, বেদান্ত দর্শনের উপলব্ধিকে কেবলমাত্র ভক্তিরসের মাধ্যমে জনমানসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সন্ন্যাসী, শাসক, নগরনটীর মধ্যে কোনো পার্থক্য বিন্যাস তো করছেনই না উপরন্তু যবন হরিদাসের ভক্ষিত খাদ্য গ্রহণ করতে করতে বিশ্বম্ভর পুলক-বেদনার পরমাশ্রয়ে সমাহিত হয়ে পড়ছেন। আবার এই গৌরাঙ্গই স-পার্ষদ গণ-আন্দোলনের পথে অগ্রসর হচ্ছেন! ষোড়শ শতকের সেই বাংলা তখন সর্বাংশেই সুলতানি শাসনাধীন, দিল্লির মসনদে আসীন সিকন্দর লোদি, বাংলার সিংহাসনে হুসেন শাহ। এই পরিস্থিতিতে নবদ্বীপে নাম-সংকীর্তনের দল সংখ্যায় ভারী হয়ে উঠলে সেখানকার মুসলমান কাজী ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় ভীত হয়ে কীর্তন বন্ধের ফরমান জারি করেন। হাওয়ায় খবর রটে যায় নদীপথে নৌকাযোগে সুলতানের সেনাবাহিনী আসছে লুঠতরাজ এবং হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। যদিও তা শেষপর্যন্ত সত্যি হয়নি, কারণ, হুসেন শাহের মতো বিচক্ষণ শাসক বরাবর সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে এই পরিস্থিতিতেই চৈতন্যদেব সর্বপ্রথম সংঘবদ্ধ গণশক্তির সাহায্যে স্বৈরাচারী শাসননীতির প্রতিবাদ করেন, স-পার্ষদ কাজীর বাড়ি অবরোধ করে দুই রাত্রি অবস্থান বিক্ষোভের পর কাজী নাম-সংকীর্তনের অনুমতি দিতে বাধ্য হন। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করবার নয় যে, নিমাইয়ের জনপ্রিয়তা অনেক ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব হিন্দুদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এক্ষেত্রে কাজীর সঙ্গে তাদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আসলে বিশ্বম্ভরের আড়ম্বরহীনতা, সরল সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছিল। নবদ্বীপ এবং আশেপাশের অঞ্চলের ধনী ব্রাহ্মণরা (মূলত যারা যজমানি জীবিকার সঙ্গে যুক্ত) বুঝতে পেরেছিলেন তাদের সর্বাত্মক প্রতিপত্তির উপর চৈতন্যের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও ‘কাজীদলন’ ঘটনাটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কবি কর্ণপুরের গ্রন্থে এ-কাহিনির কোনো উল্লেখ নেই আবার মুরারিতে রয়েছে গৌরাঙ্গ কর্তৃক ম্লেচ্ছ উদ্ধারের কথা। কিন্তু এই ঘটনার আত্যন্তিকতা বাদ দিলেও যে-সত্য ধরা পড়ে তা হল, বিশ্বম্ভর তাঁর ধর্মপ্রচারে প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন! রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ নাটকে ক্ষেমংকর নবধর্মকে বাধা দেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে সৈন্য নিয়ে অভিযান করতে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে নবধর্মের প্রচার ও প্রসার স্তব্ধ করে দিতে ক্ষেমংকরেরা চিরকালই উৎসাহী। অনুরূপ ব্যাপার চৈতন্যের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত কিন্তু সম্ভবত হুসেন শাহের মতো প্রশাসকের সদর্থক উপস্থিতি এখানে যথেষ্ট কার্যকরী প্রতিভাত হয়েছিল।

লক্ষ করার বিষয় হল, কার্ল মার্কস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘Communist Manifesto’-তে শাসকের বিপক্ষে সাধারণ সর্বহারা শ্রেণির যে-গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলছেন তার অন্তত সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে বঙ্গদেশের মাটিতে চৈতন্যদেব সেই আন্দোলনের সূচনা করে ফেলেছেন। গণ-আন্দোলন সম্পর্কে মার্কসের ধারণা হল, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিপীড়িত মানুষের সুবিশাল সমূহকে বিপ্লবের ছাতার তলায় একত্রিত করা। অন্য দিকে বিংশ শতাব্দীর প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক তথা দার্শনিক আলব্যের কামু বিপ্লব সম্পর্কে বলছেন—

“More and more, revolution has found itself delivered into the hands of its bureaucrats and doctrinaires on the one hand, and to the enfeebled and bewildered masses on the other.”

অথচ তার চার-পাঁচশো বছর পূর্বে মধ্যযুগীয় ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে চৈতন্যদেব দু-হাতেই গণ-বিপ্লবকে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কোনো স্থান সেখানে ছিল না, রক্তের যেটুকু ক্ষয়— তার সমস্তটাই নিজের। ক্ষমতাতন্ত্রের কোনোরকম পুজো না করেই অহিংস ভক্তিবাদকে কেন্দ্রাবর্তে রেখে সমাজের একেবারে অন্ত্যজবর্গকেও সঙ্গে করে তিনি পথ হাঁটছেন, উত্তরসূরি সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে মৌলিক পার্থক্যটি এখানেই। দখলের পরিবর্তে তিনি হৃদয়ের জয়ে অধিক বিশ্বাসী। মনে রাখতে হবে তৎকালীন হিন্দু সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তিই ছিলেন পঞ্চোপাসক, স্মার্ত (স্মৃ প্রত্যয় জাত, অর্থে— স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ)।

অন্ধসংস্কার, লোকবিশ্বাসের মতো ক্ষতিকর ধারণা পূর্ণ মাত্রায় প্রচলিত ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য, রাজসংযোগানুসারে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রভৃতির দ্বারা সমাজকে নিজস্ব পদ্ধতিতে চালানোর লোভ ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দোসর ছিল কিছু নির্বাচিত উচ্চবর্গীয় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। তাদের একাধিপত্যের ফলে সমাজের বহু নিম্নবর্গীয় জাতি রাতারাতি শূদ্র বলে পরিগণিত হতে থাকেন; উচ্চ-নীচ শ্রেণির ভেদাভেদ বড়ো হয়ে দেখা দেয়— বলা বাহুল্য তা সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের পক্ষে খুব একটা সুখকর অবস্থা ছিল না। বিশ্বম্ভরের সংকল্প ছিল এই সমস্ত স্ত্রী-শূদ্র-অন্ত্যজ শ্রেণিকে ভক্তির মাধ্যমে উন্নত এবং মুক্ত জীবনযাপনের দিকে নিয়ে যাওয়া।

সে-কারণেই তিনি নিত্যানন্দকে নীলাচল থেকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন, সন্ন্যাসী না হয়ে তাকে সমাজসেবক হওয়ার পরামর্শ দেন। ফলস্বরূপ নিত্যানন্দের অবাধ সান্নিধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি সমাজের বিবিধ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বৈষ্ণব ধর্মের ছত্রছায়ায় আসতে শুরু করেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, চৈতন্যদেব সকলকেই সাদরে গ্রহণ করেছিলেন— ব্রাহ্মণ-শূদ্র-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র ধীরে ধীরে একীভূত হতে থাকলে সমাজের সর্বাঙ্গীন ঐক্য সাধিত হয়। চৈতন্যভাগবতের ‘কাজীদলন’ অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে নিম্নবর্ণের শ্রীধরের কুটিরে লোহার পাত্র থেকে বিশ্বম্ভর জল পান করছেন, শ্রীধর জন্মগত জাতি সংস্কারের বিধি-নিয়মে তখনও আবদ্ধ— ভয়ে সে শিউরে উঠলেও গৌরাঙ্গ নির্বিকার। পূর্বেও আমরা দেখেছি বিশ্বম্ভর আদতে ঐক্যবিধায়ক শক্তি, সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙতেই তাঁর যাবতীয় উৎসাহ এবং উদ্দীপনা। ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যেন এই ঘটনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন; গোরায় দেখা যায়, চরের ঘোষপুরের নাপিতের ঘরে জল পান করে এক মুসলমান যুবক, প্রবল নীলকর সাহেব ও গোঁড়া হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে সেই নাপিত মুসলমান ফরু সর্দারের পুত্র তমিজকে ঘরে এনে রেখেছিল। উপন্যাসে দেখা যাবে গোরা এই তথাকথিত হিন্দু সমাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, অনুরূপভাবে চৈতন্যের আচরণেও সেই একই দ্রোহচিহ্ন; সে-যুগের প্রেক্ষিতে যা এক বিপ্লবের সমতুল্য বলা চলে।

পুরীতে অবস্থানকালে জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত জনৈক সার্বভৌম আচার্য ভগ্নিপতি গোপীনাথ ভট্টাচার্যের কাছে চৈতন্য সম্পর্কে জানতে চাইলে গোপীনাথ উত্তর দেন—

“ইঁহার নাহি বাহ্যাপেক্ষা/ অতি বড় সম্প্রদায়েতে উপেক্ষা।।”

বিশ্বম্ভর যে আদ্যোপান্ত অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ ছিলেন, সমাজের সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে যে তার অবস্থান- বৃন্দাবন দাস স্থানে স্থানে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। খাণ্ডবা গ্রামের সেবাদাসী ইন্দিরা বাঈ, কিংবা নারোজি দস্যু, ভিল পান্থদের মতো ভিন্ন ভিন্ন বর্গের মানুষকে অবনমনের পথ থেকে সরিয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন। আবার পুরীতেই মন্দিরের পাণ্ডারা তাঁর বিরোধিতা এমনকী ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছেন। কলিঙ্গ সেই মুহূর্তে বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ কলহে পর্যুদস্ত, তদসত্ত্বেও দু-টি শক্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে চৈতন্য ও মহারাজ প্রতাপরুদ্র অপর দিকে গোবিন্দ বিদ্যাধর, জগন্নাথ দাশের মতো মন্দিরের পাণ্ডাবৃন্দ। সে-সময় প্রতাপরুদ্র দক্ষিণাঞ্চলের রাজা কৃষ্ণদেবের কাছে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছেন, তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সংকোচিত হয়ে আসছে। মন্দিরের সেবায়েতবৃন্দ ধীরে ধীরে নীলাচলের নিয়ামক হয়ে উঠতে শুরু করলে গৌরাঙ্গকে নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করতে হয়। অর্থাৎ সমাজের অভ্যন্তরে ‘প্রাধান্য ও আধিপত্যবাদ’ যেখানে শাসকের চরিত্রকে সর্বকালীন দোর্দণ্ডতা প্রদান করছিল সেখানে গৌরাঙ্গ সমাজের দুর্বল শ্রেণিদের একত্রিত করছেন, ঈশ্বরের ভক্তিবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন শাসক ও ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে! কারণ, তিনি জানতেন প্রভুত্ব অধিকার করে, প্রতিপত্তি অর্জন করে রাষ্ট্রশক্তি ক্ষান্ত হয় না। তার মূল লক্ষ্য থাকে সংস্কৃতি ও সামাজিক ভাবাদর্শের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেওয়া।

কী অদ্ভুত! চৈতন্যের এই কার্যকলাপের পরবর্তীতে আধুনিক ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি আনছেন (Hegemony and Dominance) তত্ত্ব! আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে চৈতন্যের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়— “The bourgeoisie acquires all the authority of Society through the establishment of Hegemony.” (Prison Notebooks)

দু-জন পৃথক ব্যক্তি, দু-টি আলাদা মহাদেশ— মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান প্রায় চারশো বছর। একজন ঘোষিত সমাজবাদী দার্শনিক অন্যজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী; অথচ প্রায় হুবহু একই চিন্তন উদ্ভাসিত হচ্ছে দু-জনের মননে, কার্যক্রমে! একে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সময়োপযোগী উত্তরণ ছাড়া অন্য কিছু বলা সম্ভবই নয়। আবার এই প্রবল সাম্যবাদী সন্ন্যাসী সমাজ-সংস্কারক বিশ্বম্ভর কর্ম ও ভক্তি দ্বারা দুঃখের সাগর পাড়ি দিতে চান। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান সময়পর্বে ভক্ত ও ভক্তির যে-আতিশয্য চতুর্দিকে দেখা যাচ্ছে গৌরাঙ্গের ‘ভক্তি’ তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতের কথা বলে। তাতে স্নেহ, প্রেম, বাৎসল্য, মধুরতা, শান্ত, দাস্য, শখ্য উপস্থিত— এ হল চৈতন্যতত্ত্ব। এখানে হিংস্র অন্ধভক্তির কোথাও কোনো স্থান নেই।

“নয়নং গলদশ্রুধারয়া বদনং গদ্গদরুদ্ধয়া গিরা।
পুলকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি।।”

রূপ গোস্বামী সংকলিত চৈতন্যের এই ছয় সংখ্যক পদাবলীটিতে সেই ভক্তি এবং ভক্তি দ্বারা মুক্তির কথা ধ্বনিত হয়। এই মুক্তি কি দেহাবসানের কথা বলে?

না, এই স্বর প্রকৃত অর্থে জাগতিক লালসা ও স্বার্থান্বেষী জীবনচর্যার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ-সাম্যের কথা বলে। এমন অশ্রুধারা যা সংবরণ করা যায় না, কথা বা বাক্ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় তার ক্রিয়া স্তব্ধ করে (এখানে ইন্দ্রিয় নিঃসন্দেহেই পঞ্চেন্দ্রিয়) সুতরাং ইন্দ্রিয় সুখের লোভ পরিত্যাগ করে সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তবে কি বিশ্বম্ভর আরাধ্যের প্রাপ্তিকে সমাজ-সংস্কারের মধ্যে দিয়েই অনুভব করতে চান? না হলে কৃষ্ণনাম ব্যতীত সমাজ-সাম্যের এত বিপুল প্রচেষ্টা তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে কেন? তবে কি সাম্যবাদের উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছেন পূর্বসূরির সূত্রে? ভুললে চলবে না ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে মানব-সাম্যের সর্বপ্রথম পাঠ গৌতমবুদ্ধের মহাবৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার ফসল। ‘ধম্মপদ’-এর বুদ্ধবর্গে তিনি বলছেন—

“বহুং বে সরণং যন্তি পরবতানি বনানি চ।
আরামরুকখচেত্যানি মনুসসা ভয়তজ্জিতা।।

দুকখং দুকখসমুপপাদং দুকখসস্ চ অতিককমং।
অরিয়ঞ্চটঠঙ্গিকং মগগং দুকখূপসমগমনং।
এতং সরণামাগমম্ সব্বদুকখা পমুচ্চতি।।”
(শ্লোক: ১৮৮, ১৮৯)

(মনুসসা ভয়তজ্জিতা) ‌মনুষ্যগণ ভয়বিহ্বল হয়ে বনে, পর্বতে, উদ্যানে আশ্রয় নেয়। কারণ দুঃখ থেকে, লোভ এবং হিংস্রতা থেকে উৎপত্তি হয় ভয়ের। কিন্তু এই বহির্জগতের আড়াল উত্তম আশ্রয় কখনোই নয়। তার জন্য প্রয়োজন আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখের মুক্তি। দুঃখ (দুকখং) ও দুঃখের মায়াকে অতিক্রম করে (দুকখসমুপপাদং) অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথে সম্যক সত্য প্রজ্ঞার দর্শনে (সম্মপঞ্ঞায় পসসতি) মুক্তি সম্ভব। গৌতমবুদ্ধ এই সর্ব-দুঃখের পরিত্রাণকে বলেছেন (সব্বদুকখা পমুচ্চতি) আর চৈতন্য বলছেন (প্রোদ্যন্নিখিলপরমান্দপূর্ণামৃতান্ধে) সংসারের সর্বপ্রকার মায়া থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তি, কর্ম-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির এই সত্যের ক্রমানুসন্ধানই অহিংসা ও প্রেমের সামাজিক সাম্যাবস্থার একমাত্র প্রতিষ্ঠা পথ।

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার’/সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।” অথবা “নীরব রাত্রি হারাইয়া বাক্/বাহির আমার বাহিরে মিশাক/দেখা দিক মম অন্তরতম/অখণ্ড আকারে।”

‘গীতাঞ্জলি’-র মর্মে মর্মে এক ও অখণ্ডতার কথা কি রবীন্দ্রনাথও বলছেন না? ‘বিহার’ শব্দের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে স্পর্শ করছেন বুদ্ধ ও চৈতন্যকে। এক অর্থে ‘বিহার’ বৌদ্ধ শ্রমণদের বাসস্থান— মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণকারী সাম্যের নিরন্তর চর্চার প্রাণকেন্দ্র অন্য দিকে চৈতন্যের বিহার হল ‘প্রেমবিহার’। কীর্তনের মহাভাবে প্রতিনিয়ত শান্তি, মুক্তি এবং সাম্যের বাণীকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

এই পর্বে এসে আশ্চর্য প্রবহমানতায় আমরা লক্ষ করছি, প্রাচীন ও আধুনিক দুই কালচক্রের সমাজকে, তার বিবর্তনকে সাম্যের পারম্পর্যে জুড়ে দিচ্ছেন মধ্যযুগের আর এক লোকতান্ত্রিক দার্শনিক তথা সন্ন্যাসী। মানুষের দুঃখের উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টায়, মধ্যযুগীয় সামাজিক অব্যবস্থার বিপক্ষে সরাসরি লড়াইয়ের চেষ্টায় তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামই যে চৈতন্যদেবকে আজ মহত্ত্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে সে-কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Facebook Comments

পছন্দের বই