লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

শব্দ-কল্প-ঋত্বিক

[‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শব্দ ভাবনা ও ধ্বনি মন্তাজ]

সনৎ বলল, কথা আছে। চলো। নীতার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে ‘না’ বলে পাশ কাটিয়ে বেরোতে চাইতেই, সনৎ তার হাত ধরে ফেলে। বিস্মিত গলায় বলে, নীতা! নীতা সনতের চোখে প্রখর দৃষ্টির দিকে তাকায়। কয়লার ট্রেন ইঞ্জিনের এক সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল আমাদের বুকে এসে ধাক্কা মারে। সনৎ অপ্রস্তুতের মতো হাত ছেড়ে দেয়। সনতের মতো আমরাও সচকিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। এই হুইস্‌লের আওয়াজে আমাদের আলাপ শুরু হয়।

এই সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল কেন ত্রস্ত করে? ছোটো জলার পাশে ঝুঁকে পড়া গাছ ও মাঠকে সঙ্গে রেখে রেললাইন চলে গেছে। মুহুর্মুহু না হলেও, এখানে ট্রেনের অবশ্যম্ভাবী আনাগোনা। এবং ঋত্বিক ইতিমধ্যেই, হুইস্‌ল বাজিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া, দু-বার দেখিয়ে ফেলেছেন। ছবির শুরুতে নীতার দাদা শঙ্করকে আমরা মাঠে বসে গান গাইতে শুনি। নীতা তার দিকে প্রশ্রয়ের চোখে তাকায়। দাদা-বোনের পশ্চাদ্‌পটে ট্রেন চলে যায় একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে। ছবি আরও কিছুটা অগ্রসর হলে, নীতা ও সনৎ ওই ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে বসে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। নীতা উঠে দাঁড়াতে গেলে সনৎ হাত ধরে বলে, নীতা। ট্রেনের হুইস্‌লের আওয়াজ ভেসে আসে। নীতা বসে পড়ে। সন্ধ্যার আনত আলোয় তাদের সামনে রেখে ট্রেন চলে যায়। তারা একে-অপরের সামনে নম্র সুরে বসে থাকে।

তাহলে? তৃতীয় দৃশ্যের সঙ্গে, এই দুই দৃশ্যের মূল পার্থক্য অবস্থানের। তৃতীয় দৃশ্যের অব্যবহিত পূর্বেই নীতা কাশির দমকে রক্ত আবিষ্কার করেছে। সনৎ বিয়ে করেছে নীতার বোন গীতাকে। শঙ্কর গান গেয়ে নাম করার আশায় ঘরছাড়া। তাই ঋত্বিক এই দৃশ্যে ধ্বনি সংযোজন করেন বিশেষ মাত্রায়, যা ধ্বনি মন্তাজের রূপ নেয়। চলচ্চিত্রে মূলত দু-ভাগে ধ্বনিকে ভাগ করা হয়। যে-ধ্বনির উৎস আমরা দৃশ্যে বা শটে দেখতে পাচ্ছি— ডায়াজেটিক এবং যেক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি না— ননডায়াজেটিক। প্রথমদুটো দৃশ্যে ট্রেনের চলে যাওয়া যে-শটে আমরা দেখতে পাই, সেই শটেই হুইস্‌লের ধ্বনি প্রয়োগ করেন ঋত্বিক। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে হুইস্‌লের ধ্বনি আসে দু-টি শট আগে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। হুইস্‌লের ধ্বনি শোনার পর আরও একটি শটে, নীতা ও সনৎকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখান ঋত্বিক। যে-শটে সনৎ ত্রস্ত হয়ে নীতার হাত ছেড়ে দেয়। তার পরের শটটিতে নীতা ও সনৎ ঝুঁকে পড়া গাছটির নীচে বসে থাকে। আমরা ট্রেনের চলে যাওয়া দেখতে পাই। এবং ঋত্বিক এই তিনটি শটকে জোড়েন দ্রুত লয়ে চলা ট্রেনের চাকার শব্দে।

অর্থাৎ, এই তৃতীয় দৃশ্যে এসে ট্রেনের হুইস্‌লের শব্দ তিনটি শটে ননডায়াজেটিক থেকে ডায়াজেটিক হয় এবং ঋত্বিক সেই ধ্বনির কম্পাঙ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলেন। যে-সনৎকে নীতা ভালোবেসে নিজের অধিকার দিয়েছিল, সনতের উন্নতির স্বার্থে ত্যাগ করবে ভেবেছিল নিজের আকাঙ্ক্ষা, সনৎ সেই অধিকার হারিয়েছে। সনতের তথা আপামর পুরুষজাতির, সম্পত্তি-মনস্তাত্ত্বিকরণের উপর এই স্বাভাবিকের চেয়ে তীক্ষ্ণ ট্রেনের বাঁশি, নিছক রেলের হুইস্‌ল হয়ে থাকে না, তা অ্যালার্মিং সাউন্ড এফেক্টে আছড়ে পড়ে। অথচ তা নিছক সাউন্ড এফেক্টে সীমাবদ্ধ থাকে না। দৃশ্যটিতে ধ্বনির উৎসকে অপরূপ কম্পোজিশনে দেখিয়ে, আমাদের মননে তা মিশিয়ে দেন এবং তাৎক্ষণিক উত্তেজনাকে প্রশমিত করে শান্ত ও গম্ভীর রসে পূর্ণ সংলাপে কাহিনির খাত বইয়ে দেন ঋত্বিক।

অথচ সাউন্ড এফেক্টের সরাসরি ব্যবহার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে বিদ্যমান এবং তা বহুলচর্চিত। চাবুকের শব্দকে ঋত্বিক তিনবার তিন চরিত্রের জন্য ব্যবহার করেন, যদিও প্রেক্ষিত বদলে দেন প্রতিবার। এই চাবুকের শব্দ ননডায়াজেটিক ধ্বনি হিসেবেই প্রতিবার থাকে ও এর থেকে ক্লাসিকাল ধ্বনি মন্তাজের একটি উদাহরণ আমরা শিখে নিতে পারি। ঋত্বিক প্রতিবারই এই ধ্বনির সঙ্গে সমাপতন ঘটান দ্রুত লয়ে সেতারের বাজনে। এতে এফেক্টটি আরও তীব্র হয়।

সনতের পালটে যাওয়া বাহির ও অন্তরঙ্গকে দেখে নীতা। একইসঙ্গে সনতের বাড়িতে গীতার উপস্থিতিও সে টের পায়। ঋত্বিক কশাঘাতের ধ্বনি প্রথমবারের জন্য ব্যবহার করেন। দ্বিতীয়বার আমরা এই ধ্বনি শুনতে পাই ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানের শেষে এসে। শঙ্করের ব্যথিত মুখ পর্দায় ভেসে থাকে ক্লোজ-আপে। পিছনে তিনবার সশব্দে চাবুক পড়ে। তৃতীয় তথা অন্তিম প্রয়োগ, ঋত্বিক করেন ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে, যা এই রচনার আধার, সেই দৃশ্যে। এবার নীতার চলে যাওয়ায়, সনতের অপরাধী মুখে অনবরত পড়ে কশাঘাতের আওয়াজ। অর্থাৎ নীতা, শঙ্কর ও সনৎ— কিন্তু প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই সাউন্ড এফেক্টের ব্যবহার, একই ভাবনায় হয় না। ভাবনার অন্তর ঘটে, যা পরিচালকের বক্তব্যকে সরাসরি আমাদের কাছে এনে দেয়।

সনতের প্রত্যাখানে নীতার চরিত্রের ট্র্যাজিকধর্মীতা আর সূক্ষ্ম থাকে না। তা রূঢ় রূপে আমাদের সামনে চলে আসে। তাই সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে কশাঘাতের ধ্বনিপ্রয়োগ যেন অনেকটাই সাহিত্যধর্মী। যেন ঋত্বিক লিখছেন, ‘সনতের কথাগুলি ও তার শীতল ব্যবহার, নীতার হৃদয়ে কশাঘাতের মতো বাজিতে লাগিল।’ এরকমটি আমরা আগে জানিনি। কাজেই এখানে এক মুখ্য চরিত্র আর এক মুখ্য চরিত্রকে কশাঘাতে আহত করেছে, সেই ভাবই বর্ণিত। তৃতীয় প্রয়োগে, চরিত্রের প্রতি পরিচালকের মনোভাবকে আমরা প্রকাশ পেতে দেখি, এই ধ্বনির বারংবার ব্যবহারে। সনতের যাবতীয় প্রতিশ্রুতির যে আর কোনো মূল্যই নীতার জীবনে নেই, সনৎও যে আদতে একটি চিরন্তন পলায়নমুখী কাপুরুষ, নীতার তা জানা হয়ে গেছে বহুকাল। তাই সনতের মুখে প্রায়শ্চিত্ত ও আদর্শের কথা, নীতার কাছে অতি অবশ্যম্ভাবী খেলো মনে হবেই। টিউবারকিউলোসিস জর্জরিত ফুসফুসের কাছে এ-আলোচনা নিছক অপ্রয়োজনীয়। তাই সনতের শেষ কথাগুলিতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে, ছাতা মাথায় তার চলে যাওয়ায়, সনৎ যেমন বুঝতে পারে, তার প্রায়শ্চিত্তের কোনো সুযোগ নেই (অন্তত নীতার কাছে সে-প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন ফুরিয়েছে), তেমনি উপর্যুপরি কশাঘাতে ঋত্বিক যেন সনতকে শাস্তি দেন এই বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে।

তবে দ্বিতীয় প্রয়োগটি এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আত্মসমালোচনাময়। শঙ্কর চরিত্রটি, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে, ঋত্বিকের আত্মস্বরূপ। সে-শিল্পী, ভ্যাগাবন্ড, ছেলেমানুষীতে ভরা এবং সাফল্য পাওয়ার আগের মূহূর্ত অবধি গোটা ছবিতেই সমাজের চোখে অপাঙ্‌ক্তেয়। এ হেন শঙ্করের কাছে নীতা যখন গান শিখতে চায়, বলে, বাসরে গাইতে হবে না! (গীতা ও সনতের বিয়ে)— শঙ্কর কি গান শেখায়? ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে।’ অর্থাৎ, সে বুঝতে পারে। নীতার একটু একটু করে চলে যাওয়াকে সে প্রতিনিয়ত অনুভব করে। কিন্তু কিছু করতে পারে না। সে বেদনায় নীল হয়ে যায়। পরিচালকের অসহায়তা এভাবেই তার মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোয়। শেষ দৃশ্যে নীতারই মতো আর একটি মেয়ের চটি ছিঁড়ে যাওয়ায়, সে যেন পুনরায় নীতাকে দেখতে পায় ও কেঁদে ফেলে। গানের দৃশ্যে চাবুকের ধ্বনি, তাই ঋত্বিক যেন নিজের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেন। এই অসহায়তা ও শোষণ তিনি সহ্য করতে পারেন না।

ছবিটিতে ঝিঁঝিপোকার ডাকের প্রয়োগও লক্ষ্যণীয়। আর পাঁচটা গড়পড়তা ছবিতে ঝিঁঝিপোকার ডাক আসে পারিপার্শ্বিকের সাথে, শুধুমাত্র আর একটি ধ্বনি উপাদান হিসেবে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র প্রথমার্ধেও এভাবেই এই উপাদানটিকে রাখেন ঋত্বিক। এর বদল হয় যখন নীতার ছোটোভাই মন্টুর দুর্ঘটনার খবর আসে চিঠিতে। অনেক বেশি মাত্রার কম্পাঙ্কে ব্যবহৃত হয় ঝিঁঝিপোকার ডাক। ফলে এক আশ্চর্য আধিভৌতিক এফেক্ট তৈরি করে এই ধ্বনি। ঋত্বিক এখানেই থেমে থাকেন না। এরপর যখনই নীতার মাথা ঘুরে ওঠে (যার শুরু মন্টুকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালে), যখনই সে কাশিতে রক্ত পায়, যখনই তাকে একের পর এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হয়, ঝিঁঝিপোকারা এক আশ্চর্য অতিরিক্ত মাত্রার কম্পাঙ্কে ডেকে ওঠে। এমনকী, ঝুঁকে পড়া গাছের নীচের দৃশ্যটিতেও, নীতা বলে, এখন ভেবে দেখছি ও-সব ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছি। এখন তো শুধু কাজ। পাখির কলতান ও একটি কোকিলের অনবরত ডেকে যাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে, ঝিঁঝিপোকার সেই আশ্চর্য ডেকে চলা, এক অপার্থিব নৈঃশব্দ্য তৈরি করে।

এ-নৈঃশব্দ্য শেষ হয় ছবির সমাপ্তিতে। ঋত্বিক ‘আয় গো উমা’ গানটির শব্দ পরিকল্পনাতেও স্থান দেন এই আধিভৌতিক ডাককে। ‘আয় গো উমা’ গানটিকে তিনি লেট মোটিফের মতো গোটা ছবিটির সাউন্ডস্কেপে ব্যবহার করেন। কিন্তু কোনো থিম মিউজিক তৈরি হতে দেন না।

নীতাকে আমরা কাশতে দেখি অনবরত। সে কাশি চাপতে রুমাল মুখে চাপবে এবং রক্ত আবিষ্কার করবে রুমালে। এর পূর্বে অমোঘ স্বরে, ধীর লয়ে ‘আয় গো উমা কোলে লই’ গানটি বেজে চলে। গানটি দ্বিতীয়বার শুনি এক ঝড়ের রাতে। বাবা নীতাকে বলেন, তুই জিতে গেছিস। তুই চলে যা। এরা তোকে করুণা করে। নীতা তার আদরের সম্বল ফোটোফ্রেমটি, যে-ফোটোফ্রেমে সে আর দাদা ছোটোবেলায় পাহাড়ের কোলে বসে রয়েছে, নিয়ে ঝড়ের মধ্যেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। তার মুখে বিদ্যুতের আলো সরে যায়, গাছের ঝুপসি পাতা ঘন ছায়া তৈরি করে। তার মুখে এক অপার্থিব আনন্দ, মুক্তির স্বাদ যেন, খেলা করে। এ-সংসারের যাবতীয় দায়ভার তাকে আর যেন বইতে হবে না। ঝড়ো হাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে জগৎচরাচরে শোনা যায়— ‘আয় গো উমা কোলে লই, গলাতে গাঁথিয়া জুঁই।’ কন্যাকে নিজের পরম আশ্রয়ে স্থান দেওয়ার চিরকালীন মাতৃসংগীত। নীতার শেষ আশ্রয় হয় পাহাড়ের কোলে এক স্যানিটোরিয়ামে। যে-পাহাড়ে সে বার বার যেতে চেয়েছে দাদার সাথে। শেষ দৃশ্যে যখন আর একটি মেয়ের চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যায় নীতারই মতো, নীতার সংকটকে শঙ্কর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে পায়। গানটিকে লেট মোটিফের মতো পুনরায় ব্যবহার করে ঋত্বিক শুধু দৃশ্যত সংযোগস্থাপন করেন না, ধ্বনিগতভাবেও তৎকালীন মধ্যবিত্ত সংকটকে (যা আজও অনেকাংশে বর্তমান), আমাদের মননে গেঁথে দেন।

লেট মোটিফ হিসেবে ঋত্বিক এক মায়াবী সুরও পুনরাবৃত্তিতে রেখে দেন ছবিটির সাউন্ডস্কেপে। নীতা যখনই ছেলেবেলার পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সনৎকে বা শঙ্করের কাছে আবদার করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এই সুর শোনা যায়। ছবিতে যখন প্রথমবারের জন্য নীতাকে সনতের চিঠি পড়তে দেখি, এই সুরও তখন প্রথমবারের জন্য শোনা যায়। আর আশ্চর্য, চিঠি হাতে নিয়ে নীতা, পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ছেলেবেলার ছবিটি নাড়াচাড়া করে। এ এক বিচিত্র চেতনার স্তরে ধ্বনি ও দৃশ্যের মন্তাজ, যা একলহমায় নীতার অবচেতনকে আমাদের সামনে খুলে দেয়। এই মন কেমন করা নস্টালজিক সুরের উপর্যুপরি ব্যবহারে, সনতের ভালোবাসার চিঠি ও ছেলেবেলায় পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি, দু-টিকে একাসনে বসিয়ে ঋত্বিক নীতার ভিতরের পুকুরটিতে ডুব দেন ও স্বচ্ছ করে তোলেন এই অবগাহন।

অথচ অবশেষে নীতা যখন পাহাড়ে পৌঁছায়, তখন শুধুমাত্র সেই সুর বাজে না। সুরটি এক গম্ভীর করুণ আলাপে বর্ধিত হয়। আর পাহাড়ে খাদে গিরিবর্ত্মে প্রতিধ্বনিত হয় এক চিরন্তন আর্তনাদ। এখানেও ধ্বনি সংযোজনে সাহিত্যধর্মীতা লক্ষ করি আমরা। ঋত্বিক যেন লিখছেন, ‘তাহার পর নীতার ব্যাকুল আর্তনাদ সেই পাহাড়ের প্রতিটি মর্মে ধ্বনিত হইতে লাগিল।’ প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে, দৃশ্যটিকে আইকনিক পর্যায়ে পৌঁছে দেন তিনি। অথচ সেই মন কেমন করা সুর আর আগের মতো বাজে না। নীতা সনতের লেখা চিঠি এতদিনে উড়িয়ে দেয় পাহাড়ে। স্মৃতি, প্রেম ও লড়াইকে ছাপিয়ে নির্দ্বিধায় সে ছড়িয়ে দেয় তার অসহায়তা ও বেঁচে থাকার স্পৃহা। মুহূর্তে অপরাজেয় মাতৃমূর্তি ত্যাগ করে সাধারণ মানবীর চাওয়া-পাওয়ায় নিজেকে ব্যক্ত করে সে। তাকে আর উপেক্ষা করা যায় না। তার সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হয়।

এই অকপট বাস্তবের চরম উদ্ভাসে, তাই সেই আশ্চর্য নস্টালজিক সুরও মূঢ় হয়ে পড়ে। শব্দ পরিকল্পনায় বলা যেতে পারে, এটি একটি অতুলনীয় মস্তিষ্ক ও মাত্রাবোধের পরিচয়। ঋত্বিক প্রতিধ্বনির সাথে মেঘের গর্জনকে মিলিয়ে দেন সেই লয়ে, যা কশাঘাতের সাউন্ড এফেক্ট তৈরির সময় করেছেন। ফলে মেলোড্রামার প্রকৃত উদ্দেশ্য, যা ঋত্বিকের অভিপ্রেত ছিল চিরকাল, তা-ই হয়। দৃশ্যটির ধ্বনি সংযোজন আমাদের রক্ত ঝরায়।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটির শব্দ পরিকল্পনাতে অভিনিবেশ করলে তাই আমরা বার বার বিভিন্ন ভার্টিকাল মন্তাজের নিদর্শন পাই। ভার্টিকাল মন্তাজ, অর্থাৎ, দৃশ্যের সাথে ধ্বনির মিলনে জন্ম নেওয়া এক নতুন অর্থ অথবা বোধ। বস্তুত দু-টি শটের পারম্পরিক সহাবস্থানে যে-মন্তাজের সৃষ্টি হয় (যাকে হরাইজন্টাল মন্তাজ বলা হয়ে থাকে), শুধু আমাদের চোখকে পরিশীলিত করে। কিন্তু দৃশ্য ও শব্দের মন্তাজ চোখ, কান তথা মস্তিষ্ককেও পুষ্ট করে প্রখর বুদ্ধিমত্তায়। এ-বস্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজও বিরল। দৃশ্যের সাথে ধ্বনির সুপরিকল্পিত মিলনে জন্ম নেয় যে-বোধ, ঋত্বিক আমাদের সেই বোধের সন্ধান দেন। ছবিটির নির্মাণে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমাদের চেতনার নতুন স্তরে উন্নীত করে। শঙ্করের মতো আমরাও বেদনায় নীল হয়ে যাই।

Facebook Comments

পছন্দের বই