লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

গৌতম অধিকারী

চৌগাছার নীলবিদ্রোহ: ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়

বাংলাদেশের সংগঠিত নীলবিদ্রোহের ইতিহাসে চৌগাছার বিদ্রোহ গুরুত্ব পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই বিদ্রোহের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বর্তমানে চৌগাছা নামে একটি গ্রামের মানুষ ছিলেন। ফলে চৌগাছার বিদ্রোহরূপেই এর পরিচিতি। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য এই যে চৌগাছার কৃষকরা বিদ্রোহে অংশ নিলেও প্রতিরোধটি শুরু হয় গোবিন্দপুরে, বর্তমানে নদিয়া জেলার চূর্ণী-তীরবর্তী র্হাঁসখালি ব্লকে যার অবস্থান। বিদ্রোহের প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৮৮০ সালের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় এই বিদ্রোহের প্রথম পরিচিতি প্রকাশিত হয়। রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘A Story of Patriotism in Bengal’। লিখেছিলেন নীলবিদ্রোহের অন্যতম সুহৃদ ও অগ্রণী মানুষ শিশিরকুমার ঘোষ। পরবর্তীতে রচনাটি তাঁর ‘Pictures of Indian Life’ গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে। সত্যিকারের কথা হল, এই লেখাটির সূত্রেই বাঙালি গবেষক সমাজ প্রথম চৌগাছার ঐতিহাসিক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু আমার মনে এই বিষয়ে অন্তত দু-টি ছোট্ট প্রশ্ন বার বার উত্থাপিত হয়েছে, নীলবিদ্রোহের এত বড়ো লড়াইটা শেষপর্যন্ত প্রচারের আলোয় আসতে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় লেগে গেল কেন? দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহের স্থান হিসেবে কোন জায়গাটিকে ধরা হবে? তাহলে কি ধরে নেওয়া হবে, এই বিদ্রোহের যে-বিশেষ গুরুত্বের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে, সমসময় সে-বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল না!

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ প্রণেতা সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, চৌগাছার অবস্থান যশোরের জেলার ঝিকরগাছা থানাধীন। পক্ষান্তরে ‘নদীয়া কাহিনী’-র লেখক কুমুদনাথ মল্লিক সিদ্ধান্ত করেছেন নদিয়া জেলার চূর্ণী তীরবর্তী গ্রাম চৌগাছা, যার আজকের অবস্থান কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে। কোনো সোজাসাপ্টা সিদ্ধান্তে আপাতত আমি যাচ্ছি না। শুধু জানিয়ে রাখি পরবর্তীতে এই বিষয়ে যে-সমস্ত লেখালেখি হয়েছে, তার কোনোটাই শিশিরকুমারের বর্ণিত ঘটনার বাইরে নয়। এবং এইসব লেখাপত্রে চৌগাছার স্থানিক পরিচয় থেকে শুরু করে বিদ্রোহের আসল চরিত্র ও ঘটনা সম্পর্কে গবেষকমহল নিজেদের পছন্দমতো ব্যাখ্যা দিতেই আগ্রহী হয়েছেন। ফলে চৌগাছার নীল বিদ্রোহ বলে কথিত বিদ্রোহের আসল ঘটনা ইতিহাসের আড়ালে গেছে হারিয়ে। হারানো সেই ইতিহাস-অনুসন্ধানে প্রথমে আমরা শিশিরকুমারের রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।

শিশিরকুমার জানাচ্ছেন, চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও পোড়াগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস দু-জনেই ছিলেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীলকুঠিতে কর্মরত দেওয়ান। বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিলেন ছোটো জমিদার (a small Zeminder) এবং দিগম্বর বিশ্বাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মহাজন’, যিনি টাকা ও ধান খাটাতেন সুদের বিনিময়ে (lent money and paddy on interest)। অর্থাৎ, প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা নীলচাষের অংশভাগ, এবং এই সূত্রে উপার্জিত অর্থে সমৃদ্ধ গৃহস্থও বটে। নীলকুঠিতে দেওয়ান হিসেবে চাকরি করতে করতেই তাঁদের মধ্যে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে বিরূপ মানসিকতার জন্ম হয়। কারণ, শিশিরকুমারের মতে— “they were men of indomitable perseverance and courage.” সবচেয়ে বড়ো কথা— “They were, besides, men of heart, and has large share of the intelligence which generally characteristics a Bengali gentleman.” এবং এ-জন্য তাঁরা দেওয়ানের চাকরি ছাড়েন। আর শিশিরকুমার মনে করেছেন— “they were obliged to leave service in disguist, as Dewans of indigo factories, who hearts, had to do in those days.” খুব স্পষ্ট যে সময় ও কালের আহবানে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস দেওয়ানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নীলচাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন এবং নেতৃত্ব দেন। নেতৃত্ব দেন শুধু নয়, “সম্ভব হলে তাদের একেবারে দেশ-ছাড়া করবার শপথ নিয়েছিলেন।”

কিন্তু নিছক নীলচাষিদের প্রতি দরদ ও দায়বদ্ধতা থেকে দিগম্বর বা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস নীলবিদ্রোহের পথে হেঁটেছিলেন, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। পুলক চন্দ তাঁর ‘নীল বিদ্রোহ’ গ্রন্থটিতে লিখেছেন— “বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠির নীলকর হোয়াইটের সঙ্গে মহাজনি কারবারকে কেন্দ্র করে বিশ্বাসের ছিল এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মহাজনিতে তখন তাঁদের প্রবাহী পুঁজি (floating capital) ছিল কম করেও লাখ টাকা। সুতরাং ঐ অঞ্চলে ধানচালের ব্যবসার একচেটিয়া কারবার করার পথে বিশ্বাসেরাই ছিলেন বড়ো বাঁধা।” আবার নীলকর হোয়াইটও নীলচাষের পাশাপাশি ধানের কারবারে অর্থ লগ্নি করতেন। তিনি চাইলেন বিশ্বাসদের মজুদ ধান কিনে নিতে। বিরোধ বাঁধল চুক্তির শর্তাবলীতে। তখন হোয়াইট শক্তি প্রয়োগ করে ধান লুঠ করার চেষ্টা করে এবং বিশ্বাসদের কাছে যে সব চাষী ধার-কর্জ নিয়েছিল, তাদের উপর প্রভাব খাটাতে শুরু করেন কর্জ শোধ না করতে। বোঝা যায়, প্রথম দিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার কারণেই বিশ্বাসেরা নীলকরদের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়। পুলক চন্দের এই বক্তব্যে ‘অন্য সূত্র’ কথাদুটো থাকলেও সূত্রটি স্পষ্ট নয়। যদিও স্বয়ং শিশিরকুমার তাঁর লেখাটিতেও বিশ্বাসদের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন— “In the village Chougatcha, district Nadia, lived two gentlemen babus Vishnu Charan Biswas and Digambar Biswas. They were both men of some property: Babu Vishnu Charan Biswas was a small zamindar, and Babu Digambar Biswas, a Mahajan, that is lent money and paddy with the interest.” ফলে এইসব কারবারকে কেন্দ্র করে সেকালে নীলকর ও স্থানীয় জমিদার ও ভূমধ্যকারীদের মধ্যে হামেশাই বিরোধ লেগে থাকত। এক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব। তবুও এ-কথা স্বীকার করতেই হবে, টিঁকে থাকার প্রয়োজন এবং আহত মর্যাদা রক্ষার তাগিদ থেকে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস কোমর বেঁধে নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বীরত্ব ও আত্মত্যাগের নিষ্ঠায় তাঁরা রেখে যান বিরল দৃষ্টান্ত এবং তাঁদের নেতৃত্বে প্রবল গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে নিজেদের স্বার্থপর কথা ভেবে পিছিয়ে আসেননি, হারিয়েছেন সর্বস্ব।

গ্রামে গ্রামে চাষিদের কারণে নীলচাষ বন্ধ করবার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বাসেরা সরাসরি। জানতেন নীলকর সাহেবরা সহজে ছাড়বে না। হিংস্র আক্রমণ নেমে আসবে নিশ্চিত জেনে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন, সশস্ত্র চাষিবাহিনীর পাশাপাশি বরিশাল থেকে দক্ষ লাঠিয়াল আনিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম পর্যায়ে বিষ্ণুচরণের গ্রাম চৌগাছা ছাড়া সাড়া মিলল আর মাত্রা একটি গ্রাম থেকে। শিশিরকুমার লিখেছেন— “All the villages declined to join them except one, and to that village they sent eight spearsmen for its protection. The planter, who was thus defied, resolved to nip the rebellion in the bud, and collect about a thousand men, about one hundred of whom were regulars. Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম অবশ্য শিশিরকুমার উল্লেখ করেননি।

চাষিদের এই প্রস্তুতির খবর নীলকর হোয়াইটের অগোচরে থাকার কথা নয়। অঙ্কুরেই বিদ্রোহকে দমন করতে তার শিবিরেও সাজো-সাজো রব। বিভিন্ন জায়গা থেকে এক হাজার পেশাদার লাঠিয়াল সংগ্রহ করে তৈরি হলেও বাহিনী। ধুরন্ধর হোয়াইট রটিয়ে দিল এক নির্দিষ্ট দিনে আক্রমণ করা হবে চৌগাছা গ্রাম। শিশিরকুমারের বর্ণনা— “The planters spread a rumour to the effect that they would attack the village Chougatcha on a certain day,…” বাস্তবে হোয়াইট তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী পাঠালেন ঐ গ্রামটির দিকে, যেখানেই নেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের শক্তিশালী প্রস্তুতি। কিন্তু গুজবের শিকার হয়ে গাঁয়ের চাষিরা আটজন শড়কিওয়ালার মধ্যে চারজনকে আগেই চৌগাছা আক্রমণ প্রতিহত করতে পাঠিয়েছিল। ফলে কম শক্তিতে কিছুটা হলেও তারা প্রাণপণ লড়াই করেছিল। পরাজিত হবার পর বিধ্বংসী অত্যাচার নেমে আসে গ্রামে, চলে অবাধ লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষে আহত হয়ে মারা যায় একজন লাঠিয়াল।

প্রথম পরাজয়ের আঘাতে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়তো ভেঙে পড়ত, কিন্তু ভাঙেনি, “এক অশেষ সৌভাগ্যপূর্ণ পরিস্থিতি”-র কারণে, শিশিরকুমারের ভাষায়— “So the first battle was lost, and the combination might have collapsed, but for an extremely lucky circumstances.” সেটি হল, এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেছিলেন আর. এল. টোটেনহাম নামে এক উৎসাহী যুবক। এই ঘটনার বিচারের ভার পড়ে তাঁর হাতে। তিনি হোয়াইটকে দোষি সাব্যস্ত করে তিনশো টাকা জরিমানা আদায় করেন। যে-সময়ে নীলকর সাহেবদের সমস্ত অপরাধ সহজেই মাফ করে দেওয়াটাই ছিল রেওয়াজ, সেই সময়ে সামান্য হলেও এই শাস্তিবিধান কৃষকদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। গ্রামে গ্রামে নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রচার তুঙ্গে ওঠে, তৈরি হয় সশস্ত্র বাহিনী। প্রতিরোধের একটা স্তরে নীলকর সাহেবরা মিথ্যে মামলায় চাষীদের সর্বস্বান্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে, এদের মামলার খরচ, বিপন্ন সংসারের দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে দিগম্বর বিশ্বাস নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন এই সময় রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী খানিকটা হলেও দিগম্বর বিশ্বাসের পাশে দাঁড়ান।

কিন্তু যে-আত্মমর্যাদা রক্ষা এবং চাষিদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার জন্য এতটা আত্মত্যাগের পথে হেঁটেছিলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস, তা অবশ্য অচিরেই সফল হয়। শিশিরকুমার লিখেছেন— “Another village joined them, and another. Within the course of a year and-a-half they found the factory tottering. The ryots had become then the stronger party. The tidings spread far and wide that the indigo ryots had fought and won against planter.” কাঠগড়া থেকে লোকনাথপুর সব কুঠির অধীন বিরানব্বইটি গ্রামের চাষী-প্রজারা ঘোষণা করে দিল, “বুনব না নীল”। শিশিরকুমারের অভিমত, ১৮৬০-এর নীলচাষ-বিরোধী আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই চৌগাছা থেকেই। শিশিরকুমারের আক্ষেপ উচ্চারিত হয়েছিল প্রবন্ধের একদম শেষে। তিনি লিখেছেন— “Their [Vishnu Charan and Digambar Biswas] names are not even known, and this is the first time that we are induced to give publicity to their doing.”

শিশিরকুমারের এই বক্তব্য প্রমাণ করে, এই আন্দোলনের সমকালে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজ চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না। এমনকী নীলচাষিদের একান্ত সুহৃদ শিশিরকুমারও হয়তো সবিস্তার অবগত ছিলেন না। কিন্তু আমরা জানি, এই ১৮৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে কর্মবীর শিশিরকুমার তাঁর বড়দার প্রয়াণে কিঞ্চিৎ মানসিক অসহাতার শিকার হয়ে এসেছিলেন নদিয়া জেলার হাঁসখালিতে, বাস করতেন চূর্ণীপাড়ের কালীপাড়ার এক পরিত্যক্ত নীলকুঠিতে। এখানে বসেই ‘শ্রীঅমিয়নিমাই চরিত’ লেখার প্রেরণা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এখানে এসেই সবিস্তারে হয়তো শুনে থাকবেন চূর্ণীপাড়ের নীলবিদ্রোহের কাহিনি, যা লিপিবদ্ধ করলেন ‘A story of patriotism of Bengal’ প্রবন্ধে। চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে পরবর্তীতে যা কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেগুলোর একমাত্র আকর এই প্রবন্ধটি। কিন্তু শিশিরকুমারের প্রবন্ধটি খুঁটিয়ে না পড়ে অনেকেই চৌগাছার বিদ্রোহের স্থান সম্পর্কে নিজের নিজের বক্তব্য হাজির করেছেন, তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। আমরা চেষ্টা করব আর কিছু পার্শ্ব উপাত্ত ও শিশিরকুমারের প্রবন্ধের ভিত্তিতে গভীরতর সত্যে পৌঁছুতে। তার আগে অবশ্যই বিভ্রান্তির জায়গাগুলো একটু সামনে আনা দরকার।

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদার লিখেছেন— “যশোরের অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস বাস করিতেন।… চৌগাছা কাঠগড়া কুঠির অন্তর্গত।” ‘যশোর জেলার নীলচাষ: নীলকর ও নীলচাষী সম্পর্ক’ নামের অতীব তথ্যপূর্ণ একটি গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদারের কথাকেই অনুসরণ করেছেন লেখক মোঃ রেজাউল করিম। যশোরের ইতিহাস-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘যশোরাদ্য দেশ’-এর রচয়িতা হোসেন উদ্দিন হোসেনও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের বাসস্থান ও বিদ্রোহ-স্থান হিসেবে ‘ঝিকরগাছা থানার অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে’-র কথাই বলতে চেয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, যশোরের কাঠগড়া কানসার্ণের অন্তর্ভুক্ত একটি নীলকুঠি চৌগাছা এবং তার অবস্থান কপোতাক্ষ তীরে। কিছু শিশিরকুমারের বক্তব্য থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের লড়াইটা শুরু হয়েছিল বাঁশবেড়িয়া কুঠিবাড়ি নীলকর হোয়াইট সাহেবের বিরুদ্ধে প্রথম। আর নিশ্চিতভাবেই বাঁশবেড়িয়া কুঠির অবস্থান নদীয়ার জেলার মধ্যে। চাকরিসূত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের সম্পর্ক কাঠগড়া কুঠিবাড়ি সঙ্গী ছিল, কেন-না তাঁরা একাধিক কুঠির দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু তাতে বিশ্বাসদের বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল পালটে যেতে পারে না। সব চেয়ে বড়ো কথা স্বয়ং শিশিরকুমারের লেখাতেই বিদ্রোহের প্রস্তুতি-অঞ্চল হিসেবে মনে করিয়ে দিয়েছেন— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম আমরা প্রথম জানতে পারছি মার্কিন ঐতিহাসিক ব্লেয়ার. বি. ক্লিং-এর গবেষণাগ্রন্থ ‘The Blue Mutiny: The Indigo Dusturbances of Bengal’ থেকে। ব্লেয়ার তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘The Conspirators’ শিরোনামে মহেশচন্দ্র দত্ত, লালচাঁদ সাহা, রতন মণ্ডল প্রমুখের পরপরই লিখেছেন— “Two other minor landlords and moneylenders who became leaders of the peasants had become legendary heroes in Bengal. They were Digambar Biswas and Bishnu charan Biswas, leading Indian employees of the Bansbaria concern in Nadia District.” (pp. 95) অর্থাৎ, ব্লেয়ার আমাদের নিশ্চিত করে দিলেন আরও একবার বাঁশবেড়িয়া কানসার্ণের বিরুদ্ধেই বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, কপোতাক্ষ-তীরের কাঠগড়া কানসার্ণের বিরুদ্ধে নয়। এর পর ব্লেয়ার আবার লিখছেন— “On September 13, 1859, white sent more than hundred Lathials, some mounted on elephants to attack Govindapur.” শিশিরকুমার কথিত— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.”-ই যে গোবিন্দপুর তাতে বোধ করি কোনো সন্দেহ থাকে না। আর গোবিন্দপুরের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে ইচ্ছে থাকলেও কপোতাক্ষ তীরের ঝিকরগাছা থানার চৌগাছায় বসে যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয় কথা এই, স্বয়ং শিশিরকুমার ছিলেন ঝিকরগাছা থানার পলুয়া-মাগুরার মানুষ, তাঁর অঞ্চলের নীলবিদ্রোহে শুধু নয় গোটা বাংলাদেশের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। নিজের বাড়ির পাশের বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐ ১৮৫৮-১৮৫৯-এ সংঘটিত বিদ্রোহ সম্পর্কে কুড়ি বৎসর তাঁর অন্ধকারে থাকার কথা নয়।

কৃষ্ণনগর সদর শহর থেকে আট-দশ মাইল দূরের গোবিন্দপুর বাংলাদেশের সগংঠিত নীল বিদ্রোহের প্রথম রণক্ষেত্র, সংঘাত শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালে বগুলা নীলকুঠির অত্যাচারকে কেন্দ্র করে শ্যামনগরের কাল্লু মণ্ডল, আমীর মণ্ডলের নেতৃত্বে। তার বিকশিত রূপের হাল ধরলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস। আর রণক্ষেত্র-কুরুক্ষেত্র তীর্থের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর। যে-সংঘাতের কয়েকদিন পরে আহতাবস্থায় শহিদ হন একজন সড়কিওয়ালা‌। সংগঠিত নীলবিদ্রোহের প্রথম শহিদের নামে আজও বাঙালি জানে না। কিন্তু ঐ বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই শহিদ হয়েছিলেন আর একজন ছোটো ভূমধ্যকারী-গোপাল তরফদার। ইতিহাসে তাঁর কথাও রয়ে গেল উপেক্ষিত।

হাঁসখালির ভূমধ্যকারী ছোটো জমিদার গোপাল তরফদার গোবিন্দপুর আক্রান্ত হওয়ার সময়ে লড়াইয়ের প্রথম সারিতেই ছিলেন। এই সময় কৃষ্ণনগর থানার দারোগা হিসেবে কর্মরত ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু। নীল কমিশনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যদাতা এই পুলিশ আধিকারিক চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘নবজীবন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’ (শ্রাবণ ১২৯৩-শ্রাবণ ১২৯৪)। পরের বছর বাংলা ১২৯৫, অর্থাৎ, ইংরেজি ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে ঢাকা থেকে এটি গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানেই, একমাত্র সেখানেই রয়েছে গোপাল তরফদারের শহিদ হবার কাহিনি। গিরিশচন্দ্র লিখেছেন— “… হাঁসখালির গোবিন্দপুরের গোপাল তরফদার। সেই ব্যক্তি তাহার গ্রামের প্রজাবর্গের সাহায্যে কুঠির বিরূদ্ধাচরণ করাতে একদিবস রাত্রে একটি হস্তীসমেত কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক গোবিন্দপুর গ্রাম আক্রমণ করিয়া দীন দরিদ্র চাষী প্রজাদিগের যথাসর্ব্বস্ব লুঠপাট এবং অপচয় করে এবং অবশেষে তরফদারকে যৎপরোনাস্তি বে-ইজ্জত করিয়া ধরিয়া লইয়া যায়।” এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আর. এস. টটেনহাম (পরে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি)। তাঁর সাহায্যে নানান চেষ্টা করেও গোপাল তরফদারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। গিরিশচন্দ্র গোপাল তরফদারের পরিণতি সম্পর্কে লিখেছেন— “অবশেষে শুনিলাম, যে ধরিবার সময় গোপাল তরফদারকে আঘাত করিয়া ধরা হইয়াছিল এবং সেই অবস্থায় তাহাকে নানা স্থানে চালান করাতে, সেই ক্লেশে তাহার মৃত্যু হয় এবং তাহার মৃতদেহ তাহার বন্ধুবান্ধবের হস্তে পড়িতে না পারে, সেই জন্য তাহা নীলের গিঠির দ্বারা জ্বালাইয়া ভস্মসাৎ করিয়া ফেলা হয়।”

খুব সংগতভাবেই শিশিরকুমার তাঁর রচনায় চৌগাছা নীল বিদ্রোহের ব্যাপক প্রভাব এবং সেক্ষেত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের ভূমিকার মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু যে-কোনোভাবেই হোক না কেন এই বিদ্রোহের ব্যাপকতায় গোপাল তরফদারের শহিদ হবার ঘটনা ইতাহাসের উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। গোপাল তরফদারের গুম-মৃত্যুর ঘটনায় যে চাষিসমাজে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, তার প্রতক্ষ্যদর্শী গিরিশচন্দ্র বসু লিখেছেন— “কিন্তু গোপাল তরফদারের মৃত্যুই নীলকরের কাল হইল‌… গোপাল মরিয়া যেন কৃষ্ণনগর এবং যশোহর জেলার সমুদয় প্রজাকে খেপাইয়া তুলিল। নীলকরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাব দাবানলের ন্যায় হুহু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ‘মোরা আর নীল করবো না’ বলিয়া প্রজারা যে সুর ধরিল, তাহা আর কেহ নিরস্ত করিতে পারিল না।” অবস্থা এমন হয়েছিল যে, যে-সাহেবদের ইঙ্গিতে শত শত লাঠিওয়ালা-সড়কিওয়ালা‌ দাঁড়িয়ে পড়ত, তারাই ভয়ে “স্বীয় স্বীয় প্রাণরক্ষার নিমিত্ত গবর্ণমেন্টকে কৃষ্ণনগর ও যশোহর জেলার স্থানে স্থানে অশ্বারোহী সেনা আনিয়া স্থাপিত করিতে বাধ্য করিয়াছিল।”

ফলাফল এ-কথা বোধহয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই নীলবিদ্রোহের মগজ যদি হয় চৌগাছা, প্রতিরোধের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর।

Facebook Comments

পছন্দের বই