লেখক নয় , লেখাই মূলধন

স্মরণ

গৌতম বসু

সেনেট হলে কবিসম্মেলন

বাংলা কবিতার দু-টি ভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী চেহারা আমরা দেখতে পাই, রাজবেশ আর কাঙালবেশ। একে-অপরের যতটা কাছে এরা, ঠিক ততটাই দূরে। কেবল পারস্পরিক দূরত্বেরই প্রসঙ্গ কেন উত্থাপন করলাম, এদের মধ্যে বৈরীভাব, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থাও প্রবল।

কল্পনা করা যাক, গোরা স্থাপত্যের ওই তেজস্বী নিদর্শন, কলেজ স্ট্রিটের সেনেট হল, অক্ষত আছে এবং কবিতাপাঠের এক বিপুল আয়োজন করা হয়েছে সেখানে; আহ্বায়ক, আয়োজক এবং সঞ্চালক ‘সোনার তরী’ প্রণেতা তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! অর্বাচীন ভাষায় রচিত কাব্যের সঙ্গে ঋষি বাল্মীকি, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ও কালিদাসের কিছুমাত্র সংস্রব না-থাকারই কথা, কিন্তু অতিবিশিষ্ট আয়োজকের আমন্ত্রণ তাঁরা কেউই উপেক্ষা করতে পারেননি। মূলত উৎসাহ প্রদান এবং কিছু পরিমাণে কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য, তিন ভগবানই বিশেষ অতিথিরূপে উপস্থিত রয়েছেন। কবিতাপাঠ চলছে। কাহ্ন, জয়দেব, বড়ু চণ্ডীদাস, আলাওল প্রভৃতি পূর্বগামী কবিরা তাঁদের স্বনির্বাচিত লেখা পাঠ সমাপ্ত করে ফিরেও এসেছেন শ্রোতার আসনে; কেউ আত্মবিশ্বাসী, কেউ কুণ্ঠিত, কেউ বিরক্ত। এখন, কবিতা পাঠ করছেন, থুড়ি, ঢাকঢোল কাঁসা সহযোগে গান গাইছেন কবিওয়ালা গোরক্ষনাথ। সঞ্চালক মহাশয় ব্যক্তিগতভাবে, কপট প্রতিযোগিতায় উৎসাহী, কবিওয়ালাদের বিনোদনসর্বস্ব হইহট্টগোল পছন্দ করেন না মোটেই, কিন্তু কলকাতা মহানগরীতে বসে তো আর কবিওয়ালাদের উপেক্ষা করা যায় না, তিনি মাথা নীচু করে বসে-বসে ভাবছেন, আমার কারণে স্বয়ং বেদব্যাসকে কী কষ্টটাই না পেতে হচ্ছে! বেদব্যাস প্রসন্ন, অবিচলিত ও শান্ত। বিনোদনের যে-কদর্য চেহারা তিনি দেখে এসেছেন তার প্রতিতুলনায় এই চ্যাঁচামিচি সহ্য করা অতিসামান্য শাস্তি তাঁর কাছে, গায়ে আঁচড়ও কাটে না।

সহনশীলতা মধুসূদনের বহু চারিত্র্যগুণের মধ্যে পড়ে না, তিনি অকস্মাৎ উঠে পড়ে গট্মট্‌ বেরিয়ে এলেন অলিন্দে। সভাস্থলে ধূমপান নিষিদ্ধ; ধ্বস্ত মেজাজ পুনরুদ্ধারের জন্য পকেট থেকে তাঁর প্রিয় পাইপখানা বার করলেন মধুসূদন, তামাক গুঁজতে-গুঁজতে এদিক-ওদিক তাকালেন৷ দেখলেন, কয়েক গজ দূরে, অলিন্দের থামের ছায়ায় এক শীর্ণকায় প্রৌঢ় উবু হয়ে বসে আছেন। ঈশান যুগী। কোঁচড় থেকে সাবধানে একখানা বিড়ি বার করে আনতে-আনতে ঈশান যুগী মধুসূদনের কৌতুকমিশ্রিত কৌতূহলের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। হাতটা তাঁর, কোঁচড়েই রয়ে গেল।

‘Another poet?’ নিজেকে প্রশ্ন করলেন মধুসূদন।

বাঙলা কবিতার রাজবেশ আর কাঙালবেশ। ২০০৯।

পুনর্লিখন: ১৪২৩/২০১৭, গদ্যসংগ্রহ (আদম)

 

ঋণ: পঙ্কজ চক্রবর্তী

গৌতম বসু

জন্ম ১৩ মে, ১৯৫৫/২৯ বৈশাখ ১৩৬২, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ। প্রকাশিত বই: ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ (১৩৮৮/১৯৮১), ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’ (১৩৯৮/১৯৯১) রসাতল (১৪০৮/২০০১) ও অন্যান্য। গ্রন্থ-সম্পাদনা: ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা, দেবদাস আচার্য’ (২০০৮), ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা’ (যৌথ সম্পাদনা, ভূমেন্দ্র গুহ-এর সঙ্গে, ২০১৩) ও অন্যান্য। পুরস্কার: বীরেন্দ্র পুরস্কার ২০০৩— ‘রসাতল’-এর জন্য (এটি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত একটি বার্ষিক পুরস্কার), রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ২০১৫— ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’-এর জন্য (পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বার্ষিক পুরস্কার)।

পছন্দের বই