লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

পঙ্কজ চক্রবর্তী

ধুলোবালি

মেঝেতে ধুলোয় প্রতিদিন ভাঙছে সংসার। আমি টের পাই অন্যমনস্ক বাতাস দু-একটি বাসনপত্র নাড়াচাড়া করে। জীবন প্রস্তুত নয়। শূন্যতা ভরা বেলুন উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। লেখা নেই, শুধু এক চতুরতা এতদিনে লায়েক হয়েছে। ঐ তো ভাসছে মেঘফুলের তরী। দৃশ্যমানতায়। তোমার সিঁড়ি বেয়ে এসেছে খ্যাতি, স্বল্পবাক্ মানুষের ভাঙাচোরা যেটুকু দিগন্ত।

ধুলোবালি, কতদিন রাতে আমি মাথায় বুলিয়ে দিয়েছি এই হাত। তবু ভোরবেলা মানুষের সংসারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছ প্রতিদিন।

পিতামহ

শতাব্দী প্রাচীন একটা জানলা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন আমার পিতামহ। আর লোকজন এলে গল্প করতেন বাসি বোয়াল মাছের ঝোলের। আস্তে আস্তে তার চশমা ডুবে যেত জলের গভীরে। মাঝরাতে জ্যোৎস্নার উঠোনে ঘুরে বেড়াত নেত্রকোনা সাবডিভিশন। ধানখেতের মাথায় মরা জামগাছ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন অনেকদিন। কথায় কথায় চালের হাঁড়ির ভিতরে দেখতে চাইতেন এই স্মৃতি কতদিন পর্যাপ্ত। আমার সমস্ত বই তার বানান থেকে দূরে উদাসীন দুপুরের চিৎকার।

সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের এক নাবালককে তিনি শাসন করতেন একফালি বারান্দায় বসে।

সীমানা

একটি কাঠবেড়ালি মৃত্যু বসে আছে নিমগাছের ডালে। আমি ভেবেছিলাম তোমার রেলপথ এমনই বিস্তৃত। জামগাছের আড়ালে ঐ তো স্টেশন, টিকিটঘর। জনহীন দুপুর। শুধু ঘাসের জঙ্গলে বসে একজন বুড়ো মানুষ দিবাস্বপ্নের ভিতর হাসছে। এইসব জীবন বিপ্লব থেকে বহুদূরে। এমনকী শ্মশানের কাঠ তত মধুময় নয়। শতাব্দী প্রাচীন কাঠবেড়ালি তোমাকে আদেশ করি স্পর্শটুকু নাও।

সরে দাঁড়াও ঈষৎ ট্রেনের ঐ বাঁশি। আরও বেশি গাছপালা, কয়েকটি স্টেশন পাওয়া যাবে। তোমার কাঁসার থালায় বরিশালের রোদ্দুর। জলের নাভি থেকে উঠে আসছে রামকৃষ্ণ উদ্বাস্তু কলোনি।

দূরদেশি

ওগো ছোটোখাটো দুঃখ ভালো মানুষের উপেক্ষার ভিতর দীর্ঘ শীতকাল ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার অলীক দরজা পেরিয়ে যেটুকু ফসলের ছায়া, প্রস্তুত হই। একজন লিপিকর জলের ছায়ায় মুখ রেখে চলে গেছে দীর্ঘকবিতার দেশে। আমি কি ভোরের পায়চারি থেকে তুলে নেব সফল জীবন? মহৎ শিল্পের পাশে বসে ঐ যে কুকুর তুলে নেয় বাসি বিস্কুটের ছায়া। আমি শুধু মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি খড়কুটো, মাছেদের অসুখী জীবন।

এমন তো হতেই পারে বড়ো দুঃখ প্রতিবেশীর ঘরে আসন পেতেছে। আমি যাচ্ছি যাই করে করে আজীবন পেয়ারা গাছের নীচে রাত কাটালাম।

দেবোত্তর

১৮৫৫, তোমার সোনার ছটা আমাদেরও গায়ে এসে লাগে। ছোটোখাটো ঘরের কাজ আর বাসন ধোয়ার জলটুকু ছাড়া এই জীবন অপরাধী, উচ্ছিষ্ট আহারের মতো প্রতারক। মন্দিরের গায়ে, মানতের ঢিলে শুধু তো প্রার্থনা নয়, কামনাও থাকে। থাকে অভিশাপ। কয়েক পুরুষের ভিজে গামছার নীচে রক্তের শ্রাবণ। জামগাছের নীচে জামাকাপড় ইস্তিরি করছে একজন দেহাতি মানুষ‌। তুমি তার কেউ নও। শুধু এক দালানের সিঁড়ি বুকে চেপে হাঁটে চতুষ্পদ।

আজ দেবোত্তর সম্পত্তির দিকে বাড়ানো সমস্ত হাত খসে গেছে। ওগো চরাচর, ১৮৫৫, আজও মানুষ তেমনই পাথর, শুধু এক ভ্রমণকারীর খাতা স্থাপত্য টুকে রাখে খুচরো অভিমানে।

শ্রমিক

টের পায়, ব্যক্তিত্বহীন মানুষ টের পায় শহর তাকে গ্রহণ করেনি। বন্ধ কারখানার বাতিল যন্ত্রপাতির ঘরে এখনও দু-একটি গেঞ্জি আছে তার নামে। প্রতিটি সূর্যাস্তের চুম্বন। দেখে মনে হয় খালি পায়ের ভ্রমণ। শুধু এক চায়ের দোকানদার মধ্যস্বত্বভোগী। দিনের পর দিন যায়। আগাছার পাশে বুনোফুল বেড়ে ওঠে রোজ। একদিন ফিরে যেতে হবে ঘনিষ্ঠ অন্ধকারে উটের মালিকের দেশে।

তবুও জলের কাছে ছায়ার মানুষটিকে দেখে তার আশ মেটে না। দেশান্তরের জল। তার নাভির ভেতরে রাখা আছে তালাচাবি বন্ধ কারখানার।

রাতের শহরে

নিজের ছায়া বিক্রি করে এই শহরে পড়তে এসেছি। অন্ধকারে মানিব্যাগে অবশ্যপাঠ্য বইয়ের চিরকুট। গম্ভীর এক লাইব্রেরিয়ান চুলের মুঠি ধরে দেখে নেয় ছদ্মবেশী পাঠকের ঘুম। তারপর খাঁচা ভর্তি এক ঝাঁক পাখি রেখে যায় টেবিলের ওপর। ফোর্থ ক্লাস স্টাফের সঙ্গে রফা হয়। দুস্প্রাপ্য বইয়ের পোকার জীবনের পিছুপিছু হেঁটে দেখি সামনে পথ নেই। শুধু এক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের নির্বাচিত দেহটুকু নিয়ে হাসির ফোয়ারা। ফুটপাতে অলৌকিক জেরক্সের দোকানে আলো জ্বলছে এই মধ্যরাতে।

আমি দেখি দুপুরের ঘাম, অবশিষ্ট ভাতের নীচে আতসকাচের এক গ্রাম। বহুদূর থেকে পড়তে এসেছে রাতের শহরে।

স্বর্ণযুগ

অর্থহীন শব্দের কুয়াশা, আমি রাজপথ ছেড়ে নেমেছি তোমার গলিপথে। দেখছি মানুষের ভিতর এক উট চলেছে আলোকবর্ষ সুদূরে। কামরাঙা গাছের মদিরা। ভাঙাচোরা মানুষ মাটির দাওয়ায় বসে পাঁউরুটি ভিজিয়ে নিচ্ছে চায়ের গেলাসে। আমার সমস্ত ধারবাকি তার বুকের পাঁজরে লিখে রাখি। মহৎ শিল্পের পাশে এই ধুলোমাটির জীবন বলছে তোমার মুখর ছায়ার কোনো বিকল্প নেই।

উটের ছায়ায় চলেছে বেঁটে মানুষের বউ। তাকে কিছু বলার আগেই বুঝি কথা শেষ— শুরু হল তোমাদের স্বর্ণযুগের সব গান।

Facebook Comments

পছন্দের বই