লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

পার্থজিৎ চন্দ

রক্তবীজমাতা

যুদ্ধে যাচ্ছি, তার আগে মায়ের মন্দিরে একবার প্রণাম করে যাই। ছোটো ছোটো যুদ্ধ, গেরিলাযুদ্ধ… অস্ত্রের হাতে বন্দি আমরা নিছক সৈনিক। মন্দিরের সামনে রক্তমাখানো জবাফুল-হাতে লম্বালাইন, শত্রুমিত্র সবার একই মাতৃ-আরাধনা; ইনি ঈশ্বরেরও মা অসুরেরও মা…রক্তবীজমাতা। যুদ্ধক্ষেত্রের এক ধারে দেবীকে সাময়িক প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সৈন্য নিধনের দিনে ইনি শত্রু-মিত্রে সৈন্য সাপ্লাই দেন। যুদ্ধে যাচ্ছি, মায়ের মন্দির থেকে সোনার পালকি করে, মাথায় রাজছত্র, দেবীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আবার কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। মিলেমিশে আছে তার পালকিবাহক, সহাবস্থানে আছে সেবাইত। হুম হুম করে তারা মন্ত্র পড়ছে, একই মন্ত্র, ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ…’, মাঝ-রাস্তায় তারা শুনতে পাবে গর্ভযন্ত্রণা তীব্র হচ্ছে, মোচন জরুরি। শিবিকা নামিয়ে তারা মুণ্ড কাটাকাটি যুদ্ধ করবে আর রক্তবীজমাতা কয়েকটি প্রসব করে কিছুটা তৃপ্তি পাবেন। তারপর দীর্ঘ যুদ্ধ, রক্তবীজমাতার যোনী থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসবে ঈশ্বর-অসুর। আমি তালবনে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, এখানে সবাই তাঁর অবোধ অথবা সুবোধ সন্তান, কে তবে দেবীর কাছে প্রতিদিন দিয়ে আসে এত জন্মবীজ!

শরীর

‘উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে’, আত্মা হননও করে না, হতও হয় না… দুপুরে মেঘ করলেই এই শ্লোকটির কাছে বাজে পুরানো রেডিয়ো। বাজতে বাজতে একদিন তার লাল-শাদা এভারেডি গলে যায়… রেডিয়ো চুইয়ে বিছানায় পড়ে ব্যাটারির রস, ঠিক যেন শয্যাগতর মূত্রপ্রবাহ। একদিন মানুষের শরীর থেকে আত্মাকে বের করে এনে ভরে ফেলা হবে ছোটো ছোটো ক্যাপসুলে; টানা করিডর, হাসপাতালের আলো, ট্রলির ওপর শুয়ে আত্মার গলিত ক্যাপসুল। কোটি কোটি ক্যাপসুল, লাল আর শাদা এভারেডি বেরিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে তারা শরীরের ভেতর ঢুকবে, একটি শরীরে ভুলক্রমে দু-টি ক্যাপসুল ঢুকে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটাবে। লাল ও শাদা এভারেডির মধ্যে ঘনিয়ে উঠবে দ্বন্দ্বমূলক সহাবস্থান। ধীরে ধীরে গলে যাবে আত্মার ক্যাপসুল, কিন্তু শরীর থাকবে। নতুন নতুন আত্মার কাছে তখন সুযোগ থাকবে শরীর বাছার। মোট কথা, সেদিনই যথার্থ প্রমাণ হবে, শরীর অবিনশ্বর— সে হননও করে না, হতও হয় না।

খাদ্য

এই সেই নিষাদীর গ্রাম, রুক্ষপথের ধুলোঝড় পার করে আমাদের গাড়ি থেমেছিল বিকেলবেলায়। বনজঙ্গলভরা টিলা, শরপঞ্চ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রসন্তান এ-রাস্তা ধরেই মদ আর মাংসের লোভে ঢুকে পড়েছিল জতুগৃহের কালো গহ্বরে, তাদের সঙ্গে ছিল পোষ্য রাজহাঁস। ক্রূর অভিসন্ধিময় হত্যার পাশে, নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের দগ্ধ শরীরের পাশে পড়েছিল সেই রাজহাঁস। সন্ধ্যে নামছে, বিরাট দিঘির জলে উড়ে যাওয়া পাখিদের ছায়া, জলের ভেতর সেই ছায়া যেন ঝলসানো হাঁসের শরীর। আমাদের সমস্ত অক্ষরের গায়ে ছায়া-ফেলা ঝলসানো হাঁস, তার ঠোঁট থেকে গড়িয়ে নামছে শ্লোক— অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো, এ-বনের ভেতর কোথাও ঝলসে উঠছে হাঁসের মাংস ঝলসে উঠছে তোমার খাদ্য

ভাষাশাবক

তারপর দূর কোনো স্ট্যাডেল— গুহার দিকে জেগে ওঠে মাছ-জীবনের ভোর। গলিত নৌকো ও নোহার হাড়গোড়… দীর্ঘ জড়ানো স্নায়ু মাংসপিণ্ড সমুদ্রগাছের ছায়া গুহামুখে। বিগত প্লাবন শিকড় উপড়ে এক কালো হাঁ-মুখের শূন্য রেখে গেছে। তার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে গুহার ভিতর নির্মিত হতে দেখি কিমাকার জান্তব আদিম শরীর। সে মৎসশিকারে নেমে যায় নদীর গভীরে। নোহা ও নদীর কাছে শুয়ে থাকা মারমেড তার গর্ভে ধরে রেখেছিল এক ভাষাশাবকের ভ্রূণ। স্ট্যাডেল-গুহার গূঢ় অন্ধকারে ভাষাশাবকের গায়ে ফুটে ওঠে টোটেম ও ট্যাটুর গান। মূর্ত টোটেম ও বিমূর্ত গানের দ্বৈরথে যজ্ঞসম্ভূত তমসার জন্ম হয়েছিল। ফলে তমসার ডলফিনগুলি বিমূর্ত লাল বল নিয়ে সারারাত পাক খায়। ঘুম-সারেঙের ছিন্ন নৌকাটিকে ঘিরে পাক দিয়ে ঘোরে। জলের ভেতর মাছ-জীবনের দিকে হেঁটে আসে সিংহপুরুষ। তার অস্ফূট গান সারেঙের শ্রবণমাত্রার ঠিক নীচে ভেসে থাকে স্থির; লুব্ধক। অনিবার্য, অথচ সুদূর। সারেঙের গান ও আর্তনাদে তমসার সচকিত ডলফিন। যেন মাথাটুকু তুলে, নাসিকারন্ধ্রটুকু তুলে মহাপ্লাবনের দিনে ভেসে যাওয়া প্রাণীদের জগৎ-সংসার। তাদের মাথার কোটরে ঢুকে যাচ্ছে সারেঙ-শব্দ আর ভাষা-তমসার নীচে তার দেহটিকে কামড়ে ধরেছে সিংহপুরুষ। এই মূর্ত টোটেম ও বিমূর্ত গানের মাঝখানে রক্তলাঞ্ছিত দু-টি শুশুকের মুখ; যারা ভাষাশাবকের খাবার খুঁজতে এতটা এসেছে

হত্যা

সচেতন চর্যাপদে তোমাকে শপিং-মলের কাছে রেখে দিয়ে যাই। তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো থাই-ফাটা জিন্স ম্যানিকুইনের ঠেলে ওঠা বুক (যদিও ইউনিসেক্স), কিছু বিনিময় ছাড়া কী-আশ্চর্য, তুমিও শপিং-মলের অমোঘ অংশ হয়ে ওঠো। লক্ষ বছরের ইতিহা্সে, শুধু দর্শনে এ প্রথম বাণিজ্য সম্পন্ন হল। যৌনতাও। কাহ্ন-ভুসু্কু ভাষানদীতীরে মূর্ছা গেলেন। রক্তমাংসমেদ ছাড়া নগরীতে বিবাহের বাদ্যি বাজল। ভুসুকুর খুলি থেকে নিয়ো-লিবার‌্যাল মদ চেটে খেতে খেতে ফেরার প্রহর ঘনিয়ে এসেছে। সচকিত ছেলেমেয়ে, ও.বি-ভ্যানে চেপে যারা বনভোজনের দিকে এসেছিল তার ফিরে যায়। তার আগে তছনছ করে যায় বাস্তুতন্ত্র। নৌকার সন্ত্রাসে নদী থরথর করে কাঁপে সচেতন চর্যাপদে তোমাকে শপিং-মলের কাছে এক অচলায়তনে রেখে দিয়ে আসি

Facebook Comments

পছন্দের বই