লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

রাজদীপ রায়

প্রাণাধিক দেবতা আমার

কী দুঃখ কী সুখ সবেতেই অবিচল থাকে এই কাঠের শরীর—
ঘর আজ বন্ধ। কেউ আসবে না। রাস্তায় জুতোর শব্দ, তারা কেউ
আসবে না ঘরের ভেতর। এই সময় যদি রক্তখাকি রোদ্দুরের কথা
ভেবে শিরা কেটে রাখি, তবে বেশ হয়! আমি পড়তে বসে যাই আমার
নিজস্ব মৃতদেহ ছড়িয়ে— তার বুকে মাঠ রেখে অনুভব করি
পৃথিবী অনেককাল আগেই মরেছে; এখন শুধুই সেই মরা নিয়ে টানাটানি—
দুর্বল হৃদয় কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; তারা চলে গেছে পাহাড়ে।
কামুক কিছু মানুষ সমুদ্রের ধারে গিয়ে পোশাক খুলে দিয়েছে।
কালজয়ী হবার কথা এখনো ভুলতে না পেরে
বারবার মাথা পুঁতে দিচ্ছি নরম বালিশে;
এই দুঃখ কে বুকে নেবে?
এই মৃতদেহ কে পুড়িয়ে দেবে?
টবের সামনে সমানে দাঁড়িয়ে আছে বেড়ালটা, যাকে চাইলে সমস্ত মনের কথা
বলে দিতে পারতুম। খুব দেরি নেই পৃথিবীর অন্য এক নামকরণ হবে—
আমরা সেই আনন্দফোয়ারার মুখ রেখে সেলিব্রেট করব পুংজন্ম…
চেনা বারান্দা থেকে রুমাল উড়ে আসবে,
তারও অনেক ওপরে
প্যারাস্যুটে ভাসমান ধ্বংস হয়ে যাওয়া চাঁদের ভগ্নাংশ—
শেষবার বলো, তুমি এই টিপ্পনীর ভাষাকে অন্তত
কবিতা বলে ভুল করোনি।


সহজ-সরল কথা কে আর শোনাবে? আপনার মতো?
জ্বর হলে মাথায় কে পট্টি দিয়ে দেবে…
আহা কুহকের অতিজাল ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে যে বয়স্ক ঘুড়ি
আমি জানি কোন আকাশের কাছে তার কামভাব সংশ্লিষ্ট আছে!
তার ভিজে যাওয়া মুখে সূর্যাস্তের শর্করা ছড়িয়ে…
মানুষ সহিষ্ণু হবে— কথা ছিল— দুঃখের কথা বলবে গলা জড়িয়ে।
কিন্তু ইতিহাসকে সান্ত্বনা দিয়ে সে এখন কোন পাড়ায় ঝালমুড়ি
বিক্রি করে? বলতে পারেন সে কেন কথা বলে এত জটিল ভাষায়?

স্তাবকের আদিখ্যেতা বুঝে-বুঝে অণ্ডকোষ গাঢ় হয়ে যায়, দেখি
রাত্তিরে পেচ্ছাপ করবার মতো একটি সরল অনুভূতিও আজ
আকাশের কাছে এসে শুকতারা উপহার চাইছে—
অতএব সময় নেই।

আমাকে শেখান ভালোবেসে,
কাকে বলে ভিটামিন-সি, কাকে বলে প্রসন্ন কৌতুক
কাকে বলে অচিন রাগিণী, কাকে বলে তারাপদ রায়…


এমন দুঃখ দেবেন না, যা থেকে মুষড়ে পড়ি, আপনাকে আলবিদা জানাই—
বলি, এতদিন কাছাকাছি ছিলেন বলেই সরলতা জানা হল না…
আজন্ম কূটচিন্তার পাঁক আমাকে পাঠিয়ে দিল স্থাপত্যের দিকে
খিলান, গম্বুজ ঘুরে বুঝলাম এসব পূর্বপুরুষের কীর্তি।
আমরা এদের জিন বয়ে নিয়ে চলেছি সমানে, নারীসঙ্গ বর্জিত এক
সকালের কাছে, দাঁড়িয়ে দেখেছি কীটনাশক আমাদের শরীরে বেমালুম
পরাজিত। অতএব এখন নিশ্চিন্তে পৌরুষ ত্যাগ করা যেতে পারে—
বুঝতে পারেননি আসলে মাথায় শুধুই ঘিলু নয়, কিছু দ্রাবিড় সভ্যতাও ঘুমিয়ে ছিল।
তার ঠাটবাট আর ঠাকুমার গল্পের মতো দুটি মনমরা অথচ ফুর্তিবাজ মেয়ে।
মনে পড়ে, তাদের একজনকে অহিংসার পথ ছেড়ে দেবার সময় ভালোবেসেছিলাম
খুব, তারা বলেছিল, আপনার মূর্তি বসানো হয়েছে তেমাথার মোড়ে—
ওখানে লোকজন বিশেষ যায়-টায় না। দূরপাল্লার বাস দাঁড়ায় না।
শুধু একটা পাগল আকাশের দিকে তাক করে বাটি নাড়ে,
আর বিড়বিড় করে বলে: হে প্রভু, পরমেশ্বর, জুতোর মোলায়েমখানি
খুলে দিন না!
একটু পরাক্রম চাটি…


ভীতু আকাশের নীচে তস্য ভীরু চাঁদ, তার নীচে রোঁয়াচঞ্চু রেশনভিমানী
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছে একটা আরশোলা ক্রমশ গিলে নেবে বলে
এগিয়ে আসছে— অপদার্থ বাতাস কেমন শান্ত, লঘু
যেন খোলা মুখে আর একটু পরেই কেউ কীটনাশক ঢেলে দিয়ে যাবে
কেউ বলবে সন্ধ্যে হল, মুখ ঢেকে নাও— এখনই মৃতদেহ নিতে আসবে
নিয়ো শ্মশানের ডোম, অবচেতনের দেশে তাদের প্রত্যেকের হাতে
প্লাস্টিকের মেরুদণ্ড কাঁটা-চামচের মতো পরখ করবে— কার কত আয়ু বাকি
কে কত ইন্দ্রিয়পরায়ণ… জিভের অসাড় দিয়ে ছুঁয়ে থাকি সে-সব কাহিনি
শ্মশানযাত্রীরা দেখছে, কিছুটা আড়াল থেকে বিড়ি মুখে, স্নিগ্ধ আততায়ীর মতো।
তাদের প্রশ্নের কোল ঘেঁষে উঠে গেছে ছদ্মবেশী তারা; যার দূরাগত আলো দেখে
বুঝতে পারা যাচ্ছে না, জীবিত না মৃত, ঠিক কীরূপ প্রতিমা দিয়ে গড়া হবে
সত্যের স্বরূপ… এখন ঘুমোতে চলো, ভয়ের উপনিবেশে সবচেয়ে বেশি
শান্ত থাকে আবহাওয়া। প্রতিবেশী মাঠে রক্তদান শিবির বসেছে— মানুষ এসেছে সবে
ফিরে যাবে বলে; নাড়ি টিপে রক্তচাপ বোঝে সুঠাম ডাক্তার: ভয় কিসে?
আমার চোখের জল এখন ধূলার চেয়ে অতি সহজেই ভেঙে ভেঙে যায়!
যেন কোনো মহাপুরুষের পদধ্বনি কথা বলে:
এসেছ এতটা পথ? থেকে যাবে? তাহলে রসিকপ্রাণ হও।


জন্মের অনেক আগে আমরা সব পাথর ছিলাম।
খিলানে খিলানে তার মৃদু রসিকতা ফুটে উঠত নক্ষত্রের মতো—
কারা এই সৃষ্টিকাজ পছন্দ করেনি, কারা একে অশ্লীলতা মনে করে
আলকাতরা লেপে দিয়ে গেছে নাক-বরাবর… স্থির অনুপাতে
বসে দেখেছি সেসব পুড়িয়ে দেওয়া শিলালিপি থেকে
গতিমান অশ্ব, রাজার ধনুক আবার শরীর পাচ্ছে—
এইসব রাতজাগা তারাদের, যারা ভুলেও দেখেনি,
তাদের অসূয়া থেকে জেগে ওঠা আতুপুতু প্রেমের কবিতা
জয়টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের মাথায়—
এরপর এইভাবেই লিখতে হবে, পৌরজন কেঁদে ভাসাবেন।
কালজয়ী এ-সব কর্মের সামান্য আগে তোমার প্রভূত জমি
ফাঁকা পড়ে আছে, প্রখর শয়তানি দিয়ে লেখো তো জমিয়ে
বানাও— বানাও নষ্টামি মাখানো কোনো তুমুল উপাখ্যান।
ভণ্ড আস্তিকের দেশে ওই নকল লেখাও কারা ভালোবেসে
মাথায় করবে— কড়া রোদে লণ্ঠন লেলিয়ে বলবে
সাবধানে যেয়ো ওগো প্রাণাধিক দেবতা আমার…


তুমি সত্য বলে দেবে কীভাবে লিখিতে হয়—সত্যিকার উপকথা
মর্ষকামী শোকের উল্লাস। কিংবা বড়োদিন আর ছোটোভাইমেজোভাই
ছিপ ফেলে বসে আছে, কখন নিরন্ন মাছ ধরা দেবে
সরকারি বিজ্ঞপ্তি এড়িয়ে—

ধারাপাত শেষ হয়ে গেছে, গ্রামার মুখস্থ করে উপকণ্ঠের ছেলেরা
সব বাড়িভাড়া বাকি রেখে ফিরে গেছে দেশে,
এখন শীতার্ত বোধ— জীবিকা হারানো
তুমুল অনিশ্চয়তা নিয়ে টোকা মারে, দেখ ঢাউস চাকরির নীচে
মারা গেল তোমার গ্রহিতা। সরলতা আদতে বিজ্ঞান— প্রসন্ন, চতুর
অনাহার প্রসবের কিছু আগে

ভোর হয় হয়… কালপুরুষের ছায়া ঘিরে ধরেছে তালবন
আতঙ্কিত যূথচারীদের রক্তের অভাবে আকাশ শুকিয়ে গেল!
তোমার এ-সমস্তই মনে হল প্রাকৃতিক রসিকতা;
সত্য কী? কীভাবে তা ঘটে, এইসব ভাবিতে ভাবিতে অসহায় আমি
বিড়ি ফুঁকে, ঢোঁক গিলে, খানিক বিষম খেয়ে—
পিণ্ডদান করে এলাম বাংলা কবিতার।

Facebook Comments

পছন্দের বই