লেখক নয় , লেখাই মূলধন

স্মরণ

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

চলচ্চিত্র সম্পর্কিত একটি ব্যক্তিগত গদ্য

ছোটোবেলায় বেলা বালাজের ‘Theory of the Film’-এ একটা লাইন পড়ে বেশ উত্তেজিত হয়েছিলাম Cinema is the tenth muse। বইটি কেউ পড়তে নিয়ে দীর্ঘকাল বাদে ফেরত দিয়ে যাবার পর সেদিন নাড়াচাড়া করে দেখলাম। ওই লাইনটির তলায় সেই দাগ আজও আছে।

বাসে যেতে যেতে এদিক ওদিক তাকালাম। একটা বিজ্ঞাপন এখনও চোখে পড়ল। ইংরেজিতে। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘প্রেম করে যাও, বাচ্চা উৎপাদন কোরো না’। চোখে পড়ল ‘ফুলশয্যা’ ‘এক যে ছিল দেশ’ ‘জাল সন্ন্যাসী’। সন্ন্যাসীর হাতে ছুরি। বাংলা ছবি। হুড়মুড় করে নামল বৃষ্টি। ঝপ ঝপ বাসের ভেতর জানলা বন্ধ হতে লাগল। জলে ধুয়ে যাওয়া কাচের ওপারে দেখলাম বৃষ্টির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে তৃপ্ত ও সুখী, বাংলা ছবির দর্শক ও তাদের মা মাসি বউ বোনেরা। মনে পড়ল, আমি একটা বড়ো ছবি করার কথা ভাবছি। জানলা তুলে দেখলাম। বাসের ভেতর দেখলাম। ভয়ে শিউরে উঠলাম। একটি মুখও মনে হল না আমার ছবির দর্শকের। দেখলাম, ফাঁকা চেয়ারের সার, কাউন্টারে হাই তোলা টিকিটবাবু। মাছি। কিলবিল করতে করতে চলা উদাসীন, ভ্রূক্ষেপহীন মানুষ-মানুষি।

এই দুঃস্বপ্নের ছবি দেখেন প্রায় প্রত্যেকেই। যাঁরা ছবি করতে চাইছেন নিজের মতন করে, যাঁরা নিজেদের ভাবনা-চিন্তা-বিশ্বাসের কাছাকাছি থাকতে চাইছেন, যাঁরা নিরুপায় ও চমৎকৃত এক ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই স্বপ্নতন্তু জাল ছিঁড়ে এই দুঃস্বপ্নেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ে। আর তাঁদের বুকের ভেতর গুটিয়ে রাখা কয়েক লক্ষ ফুট আন-এক্সপোজ্ড ফিল্ম নেগেটিভে যে-সব ছবি ফুটে ওঠে, মাঝরাতে উঠে একা অন্ধকারে জেগে থেকে তাঁদের দেখতে হয় সেইসব। ফাঁকা, বহুদূর চলে যাওয়া রাস্তা, দূর থেকে গরগর শব্দ করে একটা বিন্দুর মতো প্রথমে দেখা দিয়ে সামনে দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে একটা মোটরসাইকেল। আবার। ফাঁকা রাস্তা বহুদূর পর্যন্ত, গরগর করে ছুটে আসছে এক মোটরসাইকেল। যে চালাচ্ছে সে পাথরের মতো, তার মুখ উলটো দিক করে বসানো আর তার চোখদু-টি অদ্ভুত আয়ত, কেন-না কাচের।

মানুষ বিয়ে করে সুখী হয়। বাচ্চা উৎপাদন করে বা না করে সুখী হয়, রাশ রাশ পদ্য লিখে ফেলে সুখী, হাঁ হয় ও দাঁত খোঁটে ও আবার রাশ রাশ পদ্য লিখে ফেলে, চাকরি করে সুখী হয়, সমালোচনা লিখে সুখী হয়। কেউ ব্রিজ বানায়। সুখী হয়। কেউ আদর্শের জন্য দালাল ও তার ভেড়ুয়াদের দ্বারা কবলিত হয়েও প্রাণ ভিক্ষা করে না— স্বপ্ন দেখে বদলে দেবার লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে। কেউ-বা মরা মাছের চোখ নিয়ে আরও অনেক ভেসে ওঠা মাছের সঙ্গে থেকে গিয়ে দেখে যায় সবকিছু ও সুখী হয়। ফিল্ম ভালোবেসে একজন যা করে তা হল লাফ দিয়ে সে উঠে পড়ে এক তাতানো তাওয়ায়। বা তা হল এক জ্যান্ত ইঁদুর গিলে ফেলার ব্যাপার। একদিন ঘুমাতে যাবার আগে সে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে বিছানায়, তার হাড়ের কুচি ও গুঁড়ো সে স্পষ্ট দেখতে পায় শেষবারের মতো। কিংবা শেষ-ভাজা হয়ে মাথা পর্যন্ত চাদর টেনে দেয় সে নিজেই। দেশ, ভারতবর্ষ।

তবুও প্যাঁচা জাগে। আর জেগে থাকে সে। স্ক্রিপ্টের পাতা উলটে যায়। কাটে, লেখে, কাটে। তারপর একদিন তার বাঁ-দিকে ডান দিকে অশেষ দুর্ভোগ দাঁড় করিয়ে রেখে সে তার জীবনের প্রথম বড়ো ছবির শুটিং-এর দিনটির সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। যতদিনে ছবি শেষ হয়, ততদিনে কবিতা থেকে পাঠক সরে গেছে আরও দূরে, ছবি থেকে দর্শক সরে গিয়ে আরও ভুল ও সংক্রামক এক অপ-ছবির অন্ধকারে জড়ো হয়েছে দলে দলে। সে মর্মাহত হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু খুব গোপনে অন্তত একবার নিজের কাঁধে হাত রেখে সে বলতে পারে যে, যথাসম্ভব কম নুয়ে সে কিছু করতে চেয়েছিল। রাত যায়, একদিন প্যাঁচাও ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকে সে।

সে কী করতে পারত? সে নিশ্চয়ই ঠোঙা ভরা বাদামভাজা নিয়ে বসে থাকতে পারত না কেন-না সে ভালোবেসেছে ছবি তৈরি করার ব্যাপারটাকে। তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের দ্বন্দ্ব সে তুলে ধরতে চেয়েছে এখানেই। তাই ভেঙে পড়া অতল খাদের ভেতর থেকে কালো বেড়ালের হাতছানির ডাকে একেবারে সামনে এগিয়ে গিয়েও সে শেষপর্যন্ত পিছিয়ে আসে। চোয়াল শক্ত করে সে আবার বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে সে জানতে চায় ইয়োরিস ইভেন্‌স-এর ‘The Camera and I’, বইটি আছে? তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি তরুণ চলচ্চিত্রকার ও তাঁদের দর্শকদের ভীষণ কাছের মানুষ ইয়োরিস৷ লেনিন ও মাও-এর দেশের বহু অতুলনীয় তথ্যচিত্রের পরিচালক। একদিন দেখেছিলাম কয়লাখনির শ্রমিকদের দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট নিয়ে তাঁর ছবি ‘বোরিনেজ’— না, নেই, সব, সব ফুরিয়ে গেছে। বিক্রেতা সখেদে জানান। বইটি না পেয়েও সে খুশি হয়ে বেরিয়ে আসে। সে ভাবতে থাকে তাদের, যাদের হাতে হাতে বইটি ঘুরছে। সে কেনে ডটপেন ও কাগজ। ফুটে ওঠে আবার নতুন ছবির দৃশ্য। তার চোখের সামনে না থাকলেও আছে, হয়তো অজস্র নয় তবু কিছু নতুন প্রাণের দর্শক, যাদের জন্য আপাতত কষ্টেসৃষ্টে হলেও সে বাঁচিয়ে রাখবে অন্তত তার ছবি করার ইচ্ছেটাকে। সে লিখতে থাকে। লেন্স ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখাতে থাকে প্রথম দৃশ্য। বহুদূর কালো এক রাস্তা দিয়ে গরগর করে ছুটে আসছে উলটো মাথার সেই মটোর সাইকেল-চালক তার আয়ত কাচের চোখ নিয়ে। একটার পর একটা হলে ঢুকে দৌড়ে চলে যাচ্ছে ওপরে, ভুল ও মিথ্যাকে বিশ্বাস করানোর জন্য সাদা ও রঙিন ছবির ক্যান খুলে গোটানো রিলের প্রথমটুকু হাতে ধরে সে নীচে ফেলে দিচ্ছে সে-সব, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, কেন-না নীচ থেকে একজন আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রথম দৃশ্য শেষ হয়। হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।

আমরা সত্তরের যীশু, ১৯৭৭ (পত্রিকা), স্বপ্ন, সময় ও সিনেমা (গ্রন্থ)

ঋণ: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

Facebook Comments

পছন্দের বই