লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব১

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

প্রথম অধ্যায়

ফা-হিয়েন পূর্বে যখন চঙান প্রদেশে ছিলেন, বৌদ্ধ গ্রন্থের তিনটি ভাগের মধ্যে শৃঙ্খলা বিষয়টির অসম্পূর্ণ অবস্থা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। এবং পরবর্তীতে হাঙ শির দ্বিতীয় বছর অর্থাৎ কিনা ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হুই সিঙ, টাও চেঙ, হুই জিঙ ও আরও কয়েকজন মিলে ভারতবর্ষ ভ্রমণ স্থির করলেন। উদ্দেশ্য, বাকি বৌদ্ধ শৃঙ্খলাগুলি সংগ্রহের চেষ্টা করা। চঙান থেকে যাত্রা শুরু করে পর্বত পেরিয়ে তাঁরা এসে পৌঁছলেন সিয়েন কুই রাজার রাজ্যে। ইতিমধ্যে বর্ষা আগত, তাই বর্ষাকাল তাঁরা এখানেই কাটালেন। বর্ষা শেষে আবার শুরু হল পথচলা। এবার এসে থামলেন নু তান রাজার রাজ্যে। সেখান থেকে ইয়াং লু পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে সৈন্য কবলিত স্যাঙ ইয়ে শহরে এসে উঠলেন। স্যাঙ ইয়েতে তখন চলছে রাজদ্রোহ, এবং পথ দুর্লঙ্ঘ্য। ফলত তার বৌদ্ধ অতিথিদের বিষয়ে রাজা বেশ উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক স্বরূপ তখন তিনি নিজস্ব ব্যায়ে তাঁদের সেখানেই রেখে দিলেন। সেখানে দৈবক্রমে তাদের সাক্ষাৎ হল পথ চলতে চলতে পূর্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া চি ইয়েন, হুই চেন, সেং শাও, পাও উন, সেং চিঙ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে। এবারের বর্ষাকাল অতিবাহিত হল এখানেই। তারপর বর্ষা অন্তে আবার চলতে থাকা। এবার এসে পৌঁছানো গেল তুন হুয়াং। এখানে রয়েছে সংরক্ষিত শিবির; পূর্ব থেকে পশ্চিমে আশি ফুটের মতো, আর উত্তর থেকে দক্ষিণে চল্লিশ ফুটের কাছাকাছি এই শিবির। মাসাধিক সময় এখানে অতিবাহিত করার পর ফা-হিয়েন-সহ পাঁচজন পরিব্রাজক এবার যাত্রা আরম্ভ করে সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন। বাকিরা রইলেন সেখানেই। এভাবে পাও উন আর তার সাথীদের সঙ্গে আর একবার বিচ্ছেদ হল ফা-হিয়েনের।

তুন হুয়াং শিবিরের অধ্যক্ষ, গোবি মরুভূমি অতিক্রমের সমস্ত আবশ্যক সামগ্রী তাঁদেরকে দিলেন। মরুভূমিতে অশুভ আত্মার বাস আর হাওয়ায় উত্তাপ। এ-হাওয়ার সম্মুখীন হওয়ার অর্থ ভয়ংকর মৃত্যু। আকাশে নেই কোনো পাখির কলরব, মাটিতে নেই কোনো পশুপ্রাণী। একটি পথের চিহ্ন খুঁজে চেয়ে থাকো অনিমেষ। পথ মেলে না। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল মৃত মানুষের ক্ষয়াটে হাড়। এই যেন গন্তব্যের দিশা, এই যেন একমাত্র পথের সংকেত। সতেরো দিন প্রাণপণে হেঁটে প্রায় পনেরোশো লি পথ অতিক্রম করে অবশেষে এসে পড়া গেল মাখাই মরুভূমি।

দ্বিতীয় অধ্যায়

এ-ভূমি উষর, এবড়ো-খেবড়ো। চীনাদের মতো এখানকার লোকেদের পোশাকও মোটা, অমসৃণ; পার্থক্য একটাই এরা পশম আর টেকসই মোটা কাপড় ব্যবহার করে। এই রাজ্যের রাজা বৌদ্ধে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি। এখানে প্রায় চার হাজার সন্ন্যাসী আছেন এবং সবাই হীনযান মতাবলম্বী।

রাজ্যের সাধারণ মানুষ এবং সাধু সন্তদের মধ্যে ভারতবর্ষের ধর্ম সর্বব্যাপী বর্তমান। কিন্তু তাদের অভ্যাসের ক্ষেত্রে রুক্ষতা ও পরিমার্জনার একটা প্রভেদ দেখা যায়। এ-অঞ্চল থেকে পশ্চিমে যত এগোনো যায়, যে-সব দেশ অতিক্রম করবে তা সবই প্রায় একরকম। প্রভেদ একটাই যে, টারটার উপভাষায় তারা কথা বলে তা সর্বত্র সমান নয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ সকলেই ভারতীয় পুথি অধ্যয়ন করেন, এবং ভারতীয় কথ্যভাষার চর্চা করেন। মাসাধিক কাল এখানে অতিবাহিত করার পর ফা-হিয়েন আর তাঁর সঙ্গীরা উত্তর-পশ্চিম দিক ধরে চলা শুরু করলেন। পনেরো দিন একটানা ভ্রমণের পর পোঁছলেন উ-ই নামের একটি দেশে। এই উ-ই প্রদেশের চার হাজারের অধিক সন্ন্যাসীগণ, সকলেই হীনযান মতাবলম্বী। ধর্মাচরণ যথাযথ পালন করা হত। চীন দেশ থেকে শ্রমণেরা যখন এখানে এসে পড়লেন, দেখা গেল এ-দেশীয় সন্নাসীদের আচার অনুষ্ঠানে তাঁরা খানিকটা অনভ্যস্ত। ফু সিং তাং ও কুঙ, সানের সুরক্ষা পেয়ে ফা-হিয়েন দুই মাসেরও কিছু বেশি সময় এখানে কাটিয়ে যান। এর পর তিনি পাও উন আর বাকি সঙ্গীদের কাছে ফিরে আসেন। এর পর সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, এই প্রদেশের মানুষেরা নম্রতা, প্রতিবেশীর প্রতি কৃত্য এ-সবের কোনো চর্চা রাখে না। আগন্তুকের প্রতি এদের আচরণে বড়োই শীতলতা। পরবর্তীতে চি ইয়েন, হুই চিয়েন, এবং হুই ওয়েই ভ্রমণের উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কাও চাং প্রদেশে ফিরে যান। তবে ফা-হিয়েন ও তাঁর দলের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেহেতু ফু আর কুঙ সান সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন তাই তাঁরা অবিলম্বে দক্ষিণ-পূর্ব দিক ধরে যাত্রা আরম্ভ করলেন। জনশূন্য এ-প্রান্তর। স্থল বলো, আর জল, পথ কেবল দুর্গম। এ-পথের নির্মমতা তুলনা রহিত। এই রাস্তা পেরোতে যে-অসম্ভব কষ্ট তাঁরা ভোগ করেছিলেন তা উপমার অতীত। পথের নিষ্ঠুরতায় কেটে গেল এক মাস। তারও দিন পাঁচেক পর তাঁরা গিয়ে পৌঁছলেন উ টিয়েন।

তৃতীয় অধ্যায়

সমৃদ্ধশালী, সুখী দেশ। মানুষ সচ্ছল, শ্রীমন্ত। ধর্মবিশ্বাস তাঁদের কাছে স্বীকৃত, সকলেই বৌদ্ধ ধর্মে ধধর্মান্তরিত। ধর্মীয় সংগীতেই পরিতৃপ্তি খুঁজে পেত তারা। কয়েক হাজার সন্ন্যাসী, বেশিরভাগই মহাযান সম্প্রদায়ের। সকলের খাদ্যের যোগান আসত একটি সর্বজনীন তহবিল থেকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসত করত মানুষ আর প্রত্যেক বাড়ির দরজার সামনে ছোটো প্যাগোডা তৈরি করত যার সবচেয়ে ছোটোটির উচ্চতা কুড়ি ফুট। পর্যটক শ্রমণদের জন্য ঘর তৈরি করে রাখত। যে-সব শ্রমণেরা তাদের অতিথি হয়ে আসত তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব এই ঘরে রাখা থাকত। যারাই এসে পৌঁছত, সকলেই পেত আতিথ্য। দেশের রাজা, ফা-হিয়েন আর তাঁর সঙ্গীদের স্বাচ্ছন্দবাস স্থির হল চু মা টি নামক মঠে। মঠটি মহাযান সম্প্রদায়ের। বৌদ্ধ ঘণ্টার শব্দে তিন হাজার সন্ন্যাসী একত্রিত হলেন আহারের উদ্দেশ্যে। ভোজনকক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁদের আচরণ গভীর ও শিষ্টাচারপূর্ণ। সুবিন্যস্ত ক্রমান্বয়ে তাঁরা আসন গ্রহণ করলেন। এ-সবই হল নিঃশব্দে। আহারপাত্রে ঝংকার উঠল না কোনো, খাদ্যের জন্য সশব্দে ডাকলেন না কোনো পরিচারককে, কেবলমাত্র ইঙ্গিত করলেন হাত দিয়ে। হুই চিং, তাও চেং আর হুই তা কাশগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, কিন্তু ফা-হিয়েন আর অন্যেরা তিন মাস যাবৎকাল সেখানে রইলেন প্রতিমূর্তির শোভাযাত্রা দেখবার জন্য। ছোটোখাটো মঠগুলি বাদ দিলে এখানে বৃহৎ মঠের সংখ্যা তাও দাঁড়াবে গোটা চোদ্দোয়। পক্ষকাল অন্তর এ-সব মঠের সন্নাসীরা শহরের রাস্তায় জলছড়া দেন, ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেন। এর পর মূল সড়কপথগুলিকে সাজিয়ে তোলেন। শহরে প্রবেশ দ্বারের উপর দিয়ে বিছিয়ে দেন অলংকৃত, সুদৃশ্য এক মস্ত শামিয়ানা। রাজা তাঁর রানঔফ এবং মহিষীদের নিয়ে এখানে বসত করেন কিছুকাল। চু মা টি মঠের সন্নাসীরা মহাযান সম্প্রদায়ের। আর রাজাও এই মহাযান তত্ত্বে গভীর শ্রদ্ধাবান। শোভাযাত্রার সূচনায় আছেন সন্নাসীগণ। শহর থেকে তিন চার লি দূরত্বে চতুঃচক্র বিশিষ্ট প্রতিকী যান তৈরি করা হত। তিরিশ ফুটের বেশি উচ্চতার এই যানটিকে দেখে মনে হত চলন্ত পটমণ্ডপ। সাতটি মূল্যবান দ্রব্যে খচিত এই সজ্জা, সোনা, রূপা, পান্না, স্ফটিক, চুনী, তৃণমণি, আর অকীক। চূড়ায় শোভা পাচ্ছে আন্দোলিত পতাকা আর কারুচিহ্নিত চন্দ্রাতপ। যানের একেবারে মধ্যভাগে স্থাপিত রয়েছে মূর্তি। সঙ্গী দুই সেবক বোধিসত্ত্ব। মূল বিগ্রহের পরেই রয়েছে বাকি উপদেবতাদের প্রতিমূর্তি। সোনা, রূপায় মণ্ডিত এই মূর্তিগুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে শূন্যে। শহরের প্রধান দ্বার থেকে বিগ্রহ যখন একশো কদম দূরে রাজা নামিয়ে রাখলেন রাজমুকুট, পরে নিলেন নতুন পোশাক। এর পর হাতে ফুল ও সুগন্ধি অর্ঘ্য সাজিয়ে খালি পায়ে চললেন প্রতিমা সন্দর্শনে। রাজ সেবকগণ রাজার অনুসারী হল। ফুল ছড়িয়ে, সুগন্ধি জ্বালিয়ে ভূমিতে আনত হলেন রাজা।

বিগ্রহ শহরে প্রবেশের মুখে রানি ও মহিষীগণ প্রবেশ দ্বারের উপর থেকে রংবেরঙের ফুল ছুড়তে থাকলেন দূর পর্যন্ত। যেন মেঘদল হতে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে সে-ফুল। আর এভাবেই রচিত হচ্ছে পূজার অর্ঘ্য। প্রতিটি মঠের বিগ্রহযান ভিন্ন ভিন্ন। আর প্রত্যেকের জন্য ধার্য করা আছে আলাদা দিন। পক্ষকালের হিসেবে প্রথম চন্দ্রোদয়ের দিন থেকে শুরু হয় আর শেষ হয় চৌদ্দোতম দিনে। শোভাযাত্রার সম্পূর্ণ সমাপ্তি শেষে রাজা ও রানি ফিরে গেলেন তাদের রাজপ্রাসাদে। শহর ছাড়িয়ে সাত আট লি গেলেই পড়বে একটি মঠ। নাম তার ওয়াং সিন। আশিটি বৎসর আর তিন রাজার রাজত্ব ব্যায় হয়ে যায় এই মঠ নির্মাণে। দুইশো পঞ্চাশ ফুট উচ্চে খোদাই করে খচিত রয়েছে সোনা রূপা। এই সুউচ্চ নির্মাণের বিশালতাকে পরিপূর্ণ করেছে নানা রত্নের সমাহার। উচ্চ মিনারের পিছনেই আছে চমৎকার সজ্জিত একটি উপাসনা গৃহ।

কড়িবরগা, থাম, দরজা, জানালা সকলই স্বর্ণে মোড়া। আর আছে শ্রমণদের থাকার ঘর। সে-সবের সজ্জা ভাষার অতীত। পর্বতের পুব প্রান্তের ছয়টি রাজ্যের রাজা তাঁদের মূল্যবান মণিরত্নময় অর্ঘ্য দান করেন এই মঠে।

চিত্রঋণ: গুগল

Facebook Comments

অনুবাদক: সঙ্গীতা দাস

শৈশব ও বেড়ে ওঠা উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপাড়া। অত এক দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামের স্কুলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত। অন্তর্মুখী জীবন নিয়ে একা একা লোফালুফি খেলেন। অনুবাদ, লেখালেখি, পাঠ এ সবই নীরব কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এই অনুবাদ, এ তাঁরই জীবনের অংশ, তাই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

পছন্দের বই