Categories
2021-May-Poem কবিতা

দেবাশিস বিশ্বাস

তাস ও রক্তের স্পট: একটি অমেরুদণ্ডী নোট

[মহোদয়, আমি অসমের জঙ্গলে যাইনি। কিন্তু সামনের বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে তর্ক শুনছি গণ্ডারের। অণ্ডকোষের আশায় গণ্ডারকে হত্যা করা হবে। এবং তার মিহি দাঁতের ফুঁ ছড়িয়ে দেওয়া হবে সবুজ কাষ্ঠলে…]

মস্তিষ্কের খোঁজে লণ্ডভণ্ড করেছে বাগান
তরমুজের জেদ ফাটিয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে
‘মুক্ত করো জনজাতি মানবসভ্যতা’
জোনাকির মিটি মিটি টাইমের বর্গ
জড়িয়ে থাকে যারা তাদের অস্তিত্ব অজগরের মতন

*
লোম ছুঁয়ে পালিয়ে যাওয়া হাওয়া
‘ভাল্লুক থাবা চাটছে’—
তাকে পাশ কাটিয়ে
ট্রাক
ধাতুকে ধাক্কা দেয়

বরফের উপরে আছড়ে পড়ে OZONE
মস্তিষ্ক,
ও কিছুই না।
দুর্বল পাখি তাড়ানোর মেশিন।

দ্রাঘিমা টেনে রেখে পালিয়ে গিয়েছে ম্যাকাও,
তার জঙ্গলে মুক্ত চুমু
ভাবো, পরশু থেকে, আজ দাবার প্রত্যেক ঘরে কোনো খেলা নেই।
দু-বার না উড়ে একবারেই
মাথার চুলগুলো কমে যাচ্ছে… ডুবে যাচ্ছে যাদের অস্তিত্ব অজগরের মতো

একদল হরিণ,
কখনোই ভাবিনি রাস্তা তার পিতামহের স্মৃতি নিয়ে যাবে

অস্থির সময়ে, টেবিলের অন্ধকারে পাখির ডাক
লালায় অ্যাসিড…! দাঁতের তড়িৎক্ষরণ বিলাসিতার কারণ।
কল্পনায় দোষ নেই, যতবার খুশি গলায় ফাঁস পড়তে পারো
ক্ষেপে উঠছে টলটলে হাত
চাবুক
মাছি
তেলের ব্যাড়েল গড়ানো
এই তোলা হল, সাজিভরতি, জবাফুল। মন্দির।

[তারপর পবিত্র কুসুমের ডাল ছিঁড়ে মায়াহীন বিষুবতলে হলুদ সূর্যমুখী ফুল থেঁতলে তুমি ঠিক পালিয়ে যাচ্ছ অণ্ডকোষ জ্বালিয়ে। একটু বোসো, নিরিবিলি সন্তানের নড়ে ওঠা দাঁতের মিথ্যায় ইঁদুরকে আন্দাজ করো। তুমি কি ভাগ্যবান! জমি বন্ধকের অজুহাতে ড্রিল করছ নাভিতে। সে-নাভি দুর্গন্ধময়।
ভাবছ, এবার রোপওয়ে থেকে ঝাঁপ দেবে?]

তুলতুলে পোঁদ-পাকা বুলবুলি অরাজনৈতিক
বহু পুরোনো প্লাস্টিক জানলায় বাঁধা আছে,
ওখানে ফোন ঝোলানো থাকে
ট্রান্সফরমার ফ্ল্যাশ করে। দু-একটা বাঁদুরের বার্স্ট।
নেমে গেলে শ্রমিকের কালো ধোন, বিশেষরূপে তার যৌনতার কোনো দাম নেই।
লক্ষ লক্ষ যুগের রূপান্তর, মানুষ গাছের শাখাপ্রশাখা খোঁজে।
মনে পড়ছে, হাতকাটা ৫০ হাজার মিলিয়নের থেকেও বেশি রক্তের মুঠি।
চা পাতা চেবাতেও জল ওড়ে, অরোগ্রাফিকভ্রান্তি
বুকে হাঁটা বালি, অর্ধেক আংলি ছাড়া কিছুই নয়

[কটেজের সামনেই বাদামের খোসা। কিছু তাস ও রক্তের স্পট। ইয়া, বিশাল লোহার গেটে ঘাতকের তড়িঘড়ি ছুটে পালানোর রেখা। লতিয়ে সন্ধ্যা নামে বা ভেঙে পড়ে সকালের সূর্য। জন্তু তো, রড কোষ দিয়ে দ্যাখে, কটেজের আকাশ দিয়ে জেট বিমান উড়ে যায়…]

আমি পলাতক হাজার হাজার কচ্ছপের পিঠের শ্যাওলায়
কেউ টিপে দিয়ে স্যুইং খায়
অযথা গভীর সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কলোনিবিমুখ হয়ে পড়ি
তারা খসা ও মেরুন কালারের হাতুড়ি-মুখো তিমির পেটে অজস্র মাছ
বলেছিল, শান্তি এক দুর্ভিক্ষের নাম…
ভাবুক অনায়াসে গাছগুলো ছেঁটে দেয়… বাড়তি খনিজ
লম্বা লম্বা পা… এ-সব রূপকথারই গল্প।
সেও একা

জলে জলে ঘোরে
পৃষ্ঠটানের জন্যই সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
গৃহহীন পিছলে যাওয়া সৌরে আচমকা দেখা হয়ে যায় দেয়াল। চুনের রেখায় বুদ্ধি… লা লা লা

এবারের মতো প্রথম আবিষ্কারের খাতা থেকে তোমায় বাদ দেওয়া হল

ঐরাবতের কাহিনি


মোচড়ানো বৃক্ষের জাহাজ, উড়ে গেছে কি — কবিতার
ফাঁকা অনিঃশেষে দাঁড়ানো ঐরাবত, চুলগুলো বারুদ
কোথায় ছিল সে, অনুমানে তিনটে খুন হয়
যতই রটানো হোক তিলখেতে বাঙালার পাখি ধরা হয়—
বদমেজাজি লোক সে, সীসার হৃদয় থেকে ভার নিয়ে নেয়
ধরা যাক, শ্বাসরুদ্ধ
অপর পাশে কবিতার খেত

উচ্ছে কবিতার কাছে, ঘেঁষে আছে খুনি নিবারণ—


যথাসম্ভব টান দিলেই পুকুরের নলি ছিঁড়ে যাবে, শান্ত মৌরলার চঞ্চল
মাথাদের বিশ্রাম চাই… এই অজুহাতে আঁশ তোলা হয়
কঠোরের দিক ওইদিকে, একটু কান ঘেঁষে গেলেই বাড়ি ঘর জঙ্গলে, মাতৃ হাঁ শ্বাসের আওয়াজ
শোনো, অবিকল জিতে যাওয়া ট্রফির চিক্কন—
ছুঁড়ে কেউ জমেছে এমন… মা-মরা সন্ধ্যার একায়?
আবহাওয়া মাছেদেরই থাকে
তবু কোনো চোর আসে, যথাসম্ভব টান দিয়ে মৌরলার ঠোঁট ছিঁড়ে নেয়


যতটা ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি, মাফলার জমে যাওয়া বরফ
আমি তা কুকুর চোদার মতো দেখি
এই গরল, তামার পাত্র উপচে ওঠে দোকানের ঘরে
বিধিসম্মত কফিনের পেরেকে খুঁচিয়ে তুলছে সে কবেকার জমে থাকা ফ্লেশ!
কালো জাদুতে বিশ্বাসী, ঐরাবত
গন্ধের অভাব বোঝে, নাসারন্ধ্র থেকেও দূরে, সূর্যের প্রজ্জ্বলন
এ কেমন মহামায়া রুপোর জলের কাছে আবেদন যেন
মৃত পশুদের দল স্টিল হয়ে আছে, ধীর হয়ে আছে
ঘাসের ক্রমশ হাত মানুষ তুচ্ছ করে
যেন সে পশু নয়
কফিন বানানো তার কাজ, অদৃশ্য জাতক!

Categories
2021-May-Poem কবিতা

রাজদীপ পুরী

অদৃষ্ট

হাওয়ায় পুড়ে গেল ঈশ্বরের ছায়া, এখন নীল রঙের রোদ হাতে নিয়ে
ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান মাঠে ঘাটে, ধুলোর আলপনা জমে তাঁর গায়ে,
নব্য প্রেমিক প্রেমিকারা তাঁকে পাথর মনে করে নিজেদের নাম
যত্ন করে লিখে রাখে— ঈশ্বর সব দেখেন আর মুচকি হাসেন,
নতুন অলংকার পেয়ে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে পুড়ে যান ঈশ্বর…

বধূবরণ

সেদিন চৌকাঠ ডিঙিয়ে রোদ্দুর এল, এল আলো বাতাস জল—
একটা আস্ত সমুদ্র এসে ভাসিয়ে দিল খাট, আলমারি, ঘরের সমস্ত আসবাব…
এখন খোলা জানলার পাশে ভ্যান গখের হলুদ গমখেত,
আর রাতের বেলায় ছাদ জুড়ে মুনলাইট সোনাটা!
তোমার অর্ধেক আকাশ ‘এই শুনছ…’ বলে আলতো টোকা দিল আমার অর্ধেককে…
দু-চারটে তারা খসে পড়ার পর— সেদিন তোমার সঙ্গে চৌকাঠ ডিঙিয়ে
গোটা পৃথিবী এল আমার ঘরে আর আস্ত একটা সূর্য এসে
আটকে রইল আমাদের বাড়ির আশমানে

একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ

পিরীত দিও গো কন্যে, দিও মন, মেলে দিও ডানা এক আশমান—
বাতাসে উড়েছে রঞ্জক, কদমের বনে দ্যাখো একা বিষণ্ণ কানহাইয়া…
সুর নেই তাঁর, লয় কেটে গেছে, বাঁশিতে ফিসফাস, কিসব গুঞ্জন!

ডানা থেকে খসে পড়ে ময়ূরকন্ঠী আলো, সেই আলো গায়ে মেখে
আর পোড়াইও না শ্রীঅঙ্গ

কোজাগরী

বিপদের ছায়ার মতো স্নিগ্ধ আর উদাসীন আমাদের বেঁচে থাকা,
মৃত্যুর চেয়েও রূঢ় চোখে আমরা তাকিয়ে থাকি অমরত্বের দিকে,
বাঘনখ দিয়ে প্রতিপক্ষকে ফালা ফালা করে ফেলার ভেতর
যে অদম্য উল্লাস কাজ করে… খুচরো পয়সার মতো তা জমিয়ে রাখি
লক্ষ্মীর ভাঁড়ে, জীবনকে মোচ্ছব বানাতে দেওয়ালে দেওয়ালে
টাঙিয়ে রাখি কাঁচা মেয়ের ছবি…

রূপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে, লক্ষ্মী ঠাকরুনের লাল আলতা পা ছাপে
গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে ফেরার হয়ে যান এক কবি

দাম্পত্য

আমাদের সারারাত খুনসুটি আর তুমুল ঝগড়াঝাটির পর
এই যে সূর্য ওঠে আর রোদ এসে ঝিলমিল করে
আমাদের ছোট ঘরে… আমাদের ছোট ছোট সুখ, ছোট ছোট রাগ অভিমান—
এই যে আমরা ভাগাভাগি করে নিই, কি নিই না বল?
আমাদের চারহাত দুহাত হয়ে যাওয়ার পরও এই যে
আমরা প্রেমিক প্রেমিকা সাজি, আর তালি বাজাতে বাজাতে
পার হয়ে যাই দিন মাস বছর, আস্ত ট্রাম লাইন…

হট প্যান্ট আর স্ট্রবেরী কন্ডোমে টগবগ করে আমাদের
খেজুর রঙের দাম্পত্য!

Categories
2021-May-Poem কবিতা

বাপি গাইন

 

ভেঙে পড়বার মতো এক কাঠের চেয়ার কেবল, মানুষ নই
সারাদিন বারান্দায় জানালার সামনে বসে থাকি
যেন জন্মের আগে থেকে এই চোখের অপূর্ব এক খিদে
যেন মৃত্যুর পরেও এই চোখের কোনো বিরাম নেই

সুখী ও সফল মানুষের পৃথিবীতে
ঋতু পরিবর্তন হয় তবু
কেবল প্রার্থনায় বসার এই ভঙ্গিমার
কোনো পরিবর্তন হয় না

অশ্রু হারানোর পর, চোখ নয় জেগে থাকে পাথুরে দৃষ্টির চর

আমার ভেতরে যত মেঘ, আমি ততটাই শুষ্ক মাটি চাইছি ঝরে পড়ার, তোমার কাছে। যতটা আগুন আমাকে ঘিরেছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ততটা জলীয় ত্রান চেয়েছি, তোমাকে হত্যা করতে আসিনি। অথচ তুমি আমার শোবার ঘর তুলে নিয়ে গেছ, তোমার বরদির কাছে। যে-আঘাতে আঘাতে পাথর তাকে তুমি এনেছ আমার শোবার ঘরে। ফলে আমার অসহ্য রাতদিন, আমার কুয়াশায় কুঁকড়ে যাওয়া ভাষা তারও সহজপাঠ হবে না স্বাভাবিক। এ-সমস্তই হালকাভাবে নিতে হবে। আমার ভেতরে যত মেঘ, হালকাভাবে নিতে হবে আমাকেই। আমার ভেতরে যে-আগুন, শেষপর্যন্ত আমাকেই নিতে হবে তার ছাইয়ের অধিকার।

কতদিন লিখি না কিছুই
পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো যেন সব কথা ঝরে গেছে, সব ব্যথা
জল থেকে উড়ে যাওয়া পাখি
জলে সামান্য ঢেউ এই মাটিতে আছড়ে পড়েছে।
হতভম্ব পাথরের মতো শুধু দেখে যাওয়া, এই চোখ
আর কোনো প্রশ্ন করে না।
এক্ষুনি অথবা একটু পরে মরে যাব
এই চেতনা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখনও।

নিভৃত প্রশ্নের আলোয়
মৃত্যু নিয়ে অহেতুক কষ্ট পাচ্ছ তুমি
জীবন যেভাবে সম্ভব যায় নিজেকে অতিক্রম করে
প্রকৃতির গর্ভে সেভাবে কিছুই অপচয় হয় না।

প্রতিটা উত্তরের পর তাই
যে-প্রশ্নটির মৃত্যু ঘনিয়ে আসে
অজ্ঞানতাবশত তার জীবনপ্রণালী লক্ষ করি
দেখি জন্ম ও মৃত্যুকেই একমাত্র খিদে দিয়ে প্রশ্ন করা যাচ্ছে
অর্থাৎ এই প্রশ্নমুখর খিদের অজ্ঞানতাই জীবন
জীবন আমাকে ভুলতে বসেছে পথেঘাটে।

একমাত্র উৎসবের দিন এলে বোঝা যায়
উৎসবের মানুষ আমি না
আলো ও অন্ধকারের ভেতর— বেড়ালের গলায় আটকে থাকা ঘড়ির কাঁটা।

দিনের শেষে মানুষের তবু একটাই গল্প থাকে, উল্লেখ করার মতো।
গল্পের খাতিরে মানুষ ফুলপ্যান্ট পরা শেখে
দু-আঙুলে সিগারেট ধরার কৌশলও, অভ্যেস হয়ে যায় ঠিক একদিন।

গল্প এতটাই গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক
উঠতে বসতে তাকে নিয়ে ট্রেনে-বাসে-নেটে
এমনকী মন্দির আর বিধানসভায়ও মানুষের নিস্তার নেই।

ধর্মযুদ্ধ আর অজ্ঞাতবাসেও গল্পের মহিমা বহু প্রাচীন।

নেই নেই করেও অতিচর্চিত এক গল্পের আওতায়
প্রতি মুহূর্তে আমি মুদ্রিত হচ্ছি
যার স্বত্ব এখনও অরক্ষিত পৃথিবীর কাছে।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

গৌতম সরকার

হরেশ কাকার স্যান্ডো আর শরীরে লবণ দিয়ে ভারতবর্ষ আঁকা।
সে-ম্যাপে আছে পাকিস্তান, চীন, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ।
সে যখন হাল দেয় তখন মাটির গন্ধ গায়ে মাখতে ঘুটকুরি আসে, দুধ সাদা বক, টেকেনাই…। এরা
কোন এক প্রাচীন কাল থেকে স্নান করে না। শরীরে তাদের শামুক খোলের মতো মেঠো গন্ধের আস্তরণ।
প্রতীক্ষা নিয়ে বসে থাকে… এক আড়াই আঙুলের লোভে।
আর সেই ডানপিটে আড়াই অন্ধকারকে দড়ি বানিয়ে বানিয়ে ভাগ করে— নুন, ভাত, ফ্যানা।

তোমাকে পেতে চেয়ে শরীর পেতেছি।
আর পেতেছি দুধ সাদা বুক…
তোমাকে চেয়ে উল্লেখযোগ্য উলঙ্গ হয়েছি। অথবা দৃষ্টান্ত হব বলে।
উপরে দিয়েছি ভেজা খড়। ছেঁড়া ধকর। ছোটো ছোটো টেকা দেখব বলে ভোরের আঁচল সরিয়েছি।
ছেনিতে ছুয়েছি জল। মুস দিয়েছি মাখিয়ে…
এত কাণ্ডের পর জুহুরি এসে যখন বল— ও তো খাস্তান!!
তবে পরাগও মিছামিছি মিলন করে। শরীর চেপে থাকে রস।

পাগলা গোরুটাকে অনেক কষ্টে বাগাতে পেরেছি।
সে এখন ডান বাম বোঝে। উঠস বইস বোঝে।
হাই তোলে না আর আগের মতো। লাঙল তুলে দিই ঘারে। তাল তাল সন্তান পাবার আশায় বীজ পুঁতে দিই জমির শরীরটাতে…
জানো নন্দ— এতে কতবার শরীর ভাঙে।
আমার, জমির, গোরুর।
আর তুমি শুধু উল্লেখযোগ্য ভাম ধরো। বাজে খেলো। নীতি করো। আমি কতটুকু তোমার নিয়েছি? আর তুমি কতটা পেয়েছ নন্দ?
চলো খেরোর খাতা খোলো…

মা বলে— বাসন একখানে থাকলে ওমন শব্দ হবেই।
রোজই রেগে ওঠে বড়ো মুখ ওয়ালা ডেকচি। ঝনাঝন শব্দ হয়। কেটলির কারি আর আগুন মোতা গরম সইতে পারি না বলে একা চলে যাই দূরে।
কেকারুদের বাগানে বড়ো গাছে গিয়ে লুকোচুরি হই। মা হয় হয়রান। বাবা হয় আগুন
মা বলল— একদিন দেখিস
সেই যে টুকুনটা ছিল। আমি তাকে বলতাম চিকনঠোঁটি। সে গতকাল হাতবদল হয়েছে। তার কান্না দেখে আমি ভান করেছি।

মা আর কিছু বলে না।
এখন শুধু ভাত হতে ইচ্ছে করে…

পিতা হওয়ার চিন্তা আঁকি। কিংবা আদরের কোল।
দুই থেকে বারো ঘরের নামতা মুখস্থ হয়নি কোনো কালেই। তাই, যোগ আর ভাগের সময় অনেক দাঁড়ি কেটেছি খাতায়।
বলে আপাত এই শ্বাশত বুক ছিঁড়ি। হাতের রেখায় মৃত্যু যোগ খুঁজে একের পর এক গুণ কষতে থাকি। ইনফিনিটি চিহ্ন ছেড়ে হাল কষি ততক্ষণ, যতক্ষণ না বুদ্ধের চরণ অবধি পৌঁছাতে পারি…

পুতুলনাচ এখন নতুন করে ভাবি…
কেমন এক অদৃশ্য সুতোয় ঝুলে আছে মেঘ।
যেমন থাকে জন্ম ও মৃত্যুর সম্পর্কের মাঝামাঝি। উলম্ব… কোনো মোহযুক্ত টান নেই অযথা ঝড়ে যাওয়ার। নেহাতই নিয়ম মেনে চলা ক্লাস সেভেনের ছাত্র সে…
ঘণ্টা-রুটিন-পোশাক…

সে যখন লাবণ্য খায়। বিয়ে হয়…।
খিদে বাড়ে আরও।
মনে হয় আর নয়। নয় আর…
তারপর আবার চরম হতে চায়। শক্ত হয় আটি… তুলতুলে হয় দানব। সে তো এক ভয়াবহ চক্রব্যূহে লড়াই!! লড়তে থাকা ক্লান্ত ভক্ষক চেটেপুটে খেতে থাকে রস।
এরপর না-থাকার এক দশর্ন পাঠ করে। আর না। না আর… সাধু হয়।
না-বাচকের পাঠক হয়।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

অর্ণব রায়

ধ্বংসশহর: একটি অনুবাদ কবিতা

একবার আমাদের পুরোনো পিক আপ ভ্যান আর চার ক্রেট বিয়ার নিয়ে অসীমের প্রান্ত দেখব বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সে-প্রান্তটি, দেখা গেল, এক অচেনা মহিলার বাড়ির সামনে দুম করে থেমে গেল। ইতিমধ্যে ক্রেটের সব বরফ গলে জল হয়ে গেছে। অছিলা নয়, সত্যি সত্যি বরফ চাইতেই সেই বাড়ির সামনে থেমেছিলাম। আদিগন্ত গমের খেতের মধ্যে সেই একখানা একক কাঠের বাড়ি। ফিকে হলুদ আর কালচে রং করা।

আমি কোনোদিনও ভুলব না সেই সামনের কাঠের বারান্দা। ঝোলানো হ্যামক। আইসড টি। ভাই লুসি, অতদূর তুই কোনোদিন যাসনি। অতক্ষণ গাড়ি চালানোর পরে অমন একজোড়া চোখ, চোয়ালের ধার, নরম গ্রীবা আর কখনো কেউ দেখেনি। আর কেউ কখনো অমনভাবে কারোর বলা কথার দিকে হৃদয় পেতে রাখেনি।

এইসব আগুনঝড় ভূমিকম্প পাতালের আগ্রাসন মিটে গেলে একদিন আমরা ওই বাড়িটার খোঁজে বেরিয়ে পড়ব। দড়জায় টোকা মেরে বলব, একটু বরফ পাওয়া যাবে আপনার কাছে? এক আধটা পিক আপ ভ্যান আর কয়েক ক্রেট বিয়ারও জোগাড় হয়ে যাবে নিশ্চই।

ভাই লুসি, ওই বুঝি শুরু হল। আগুনের হলকার মতো এক একটা বাতাসের ঝাপটা বুঝি আসতে শুরু করল। রাত থাকতে চক্রাকার লাল মেঘ বাবায়ারামের মাথার ওপর জমতে শুরু করেছিল। যেন আমরা জানতাম, শেষের শুরু এরকমটাই হবে।

আমরা এ-সব পাশে নিয়েই রাস্তায় হেঁটে বেরিয়েছি। কিছু যে হবে, তা আমরা জানতাম। কিন্তু বিশ্বাস করতাম, কিছুই হবে না। আমাদের জানা আর বিশ্বাসের মাঝে এখন গরম হাওয়া বইছে। গা যেন পুড়ে যাচ্ছে।

এখন কবরস্থানের পাশে গিয়ে প্রার্থনা করার সময়। যে যার পাপের জন্য নিজ নিজ মাপে শাস্তি চেয়ে নেওয়ার সময়।

কিন্তু যদি কেউই না দেখছে, প্রার্থনা করে কী করব? ঈশ্বর এ-শহর ছেড়ে স্মিথদের ওয়াগনে চেপে চলে গেছেন।

যেন এক বিষণ্ণ মেলায় মাঝরাতে এসে উপস্থিত হয়েছি। এখানে লোকের মুখ নিথর। নাগরদোলা থেকে বিষণ্ণতা উপচে পড়ছে। খেলনার দোকান থেকে দুঃখের ফেনা ভসভস করে বেরিয়ে আসছে। আলোগুলি উজ্জ্বল কিন্তু ফিনফিনে কালো চাদরে ঢাকা। ডাঁই করে রাখা খাবারগুলি পাথর হয়ে গেছে। ছুঁয়ে দিলে ভেঙে যাবে।

আমরা, মানে আমি মার্থা আর বাচ্চারা একবার এই মেলায় এসেছিলাম। প্রচুর জিনিস দু-হাত ভরে কেনার পর, এখানেই আমাদের মধ্যে কিছু একটা বিষয় নিয়ে তীব্র ঝাঁঝালো ঝগড়া শুরু হয়। সেই ঝগড়া শুরুর মুহূর্ত থেকে মেলাটি সেই অবস্থায় স্থির হয়ে আছে। আর ধীরে ধীরে ভঙ্গুর পাথর হয়ে যাচ্ছে।

ভাই লুসি, সেই থেকে একটি ঘামে চটচটে মেলায় আমি পথ হারিয়ে ফেলি। সম্পূর্ণ ফাঁকা মাঠে অসংখ্য গলিপথ সৃষ্টি হয়। অগুন্তি ফেরিওয়ালা তাদের বেলুন, বুদবুদ, খেলনা বাঁদর নিয়ে আমার মুখের ওপর ‘পিকাবু’ বলে উঁকি দিয়ে যায়। অচেনা মুখের পাথর আমি রোজ দেখি।
আজ তোর সাথে মেলায় এসেছি। আজ আবার মেলা চালু হবে। এ-পর্যন্ত সরল আজ আমরা হব।

প্রবীণ বয়সে এসে হোমার অন্ধত্বের গুরূত্ব বুঝলেন। সারাজীবন আলোর জন্য হাহাকার করেছেন। সারাজীবন তার কল্পিত জগৎকে একবার দেখার জন্য আকুলি বিকুলি করেছেন। শেষ জীবনে এসে বুঝলেন, আলো নয়, আলোয় উদ্ভাসিত প্রিয়মুখ, ঘরবাড়ি বস্তুপুঞ্জ— কিছু নয়। অন্ধকারই আসল রূপ। নিকষ সীমাহীন অবয়বহীন কালো। এখন তিনি সেই অন্ধকারের ওপর অন্ধকার দিয়ে আঙুল নেড়ে নেড়ে আলপনা আঁকেন।

ভাই লুসি, আমরাও কি সেরকমই কোনো অন্ধত্বে ডুবে গেছি? দেখতে পাচ্ছি কি পাচ্ছি না তা-ই বুঝতে পারছি না। আলো আঁধার গোধূলি সকাল সাদা কালো ধোঁয়া ধূসর— কিচ্ছুটি এখানে নেই। এখান বলতে ঠিক কোথায় তা-ও স্পষ্ট নয়। পৃথিবীর বুক থেকে আমাদের শহর স্বেচ্ছায় গুটিয়ে নেই হয়ে গেছে। শহরের স্মৃতিও আর আমাদের মধ্যে নেই।

লুসি, আমি তোকে ডাকছি, কথা বলছি বটে, তুই আদৌ আমার সাথে শোনার দূরত্বে আছিস কি না জানি না। গাধাটি কোথায় গেল? আমিই-বা কই?

এ-সবের মাঝে হোমারই-বা কী করছেন? কী লিখছেন?

প্রথম ক-দিন ওরা খুব ঈশ্বর ডেকেছিল। ওরা, যে যেরকম, মাটিপূজারী, পাখিবাদী, ব্যথাসঞ্চয়ী, অবিশ্বাসী— যে যার মতন করে প্রাণ থেকে আবেদন পৌঁছোনোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। একদিনও কোনো গাছতলা, গুহা, পাতালঘর, যাদুর মাধ্যমে রোগ সারানো— একটি দরবারের একটি সিটও খালি যায়নি। লোকে রাস্তায় হাঁটু ভেঙে ভেঙে বসে পড়েছে যখন তখন।

প্রথম যেদিন বাবায়ারামের মাথা নড়ে উঠল, তার প্রায় একমাস আগে থেকে চৌকো টেলিভিশনের ভেতরে থাকা মেয়েটি হাত পা নেড়ে আমাদের নীচে, মাটির তলায় সান্দ্র আগুনের চলাচলের কথা বলে আসছিল। শহরের কেউ শুনতে পায়নি। শহরের সকলে সকাল হলে গাড়ি নিয়ে ট্রাফিকের মধ্যে লাফিয়ে পড়তে, বিকেল হলে সেই ট্রাফিক ভেঙে ভেঙে বাড়ি ফিরতে, সপ্তাহ শেষে আবার সেই গাড়ি নিয়ে সমুদ্রের জলে পা ডোবাতে বেরিয়ে পড়তে ব্যস্ত ছিল। রেস্তোঁরাগুলি প্রতি সন্ধ্যায় মানুষের সমবেত গুনগুনানিতে গুনগুন করছিল। প্রথম যেদিন বাবায়ারামের মাথা নড়ে উঠল, টেলিভিশনের ভেতরে থাকা মেয়েটি সেদিন আর হাত পা নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করল না। সেদিন তার ঠোঁটের একপাশে এক নীরব আধখানা হাসি ফুটে উঠল। সেদিনও গোটা শহরে তাকে দেখার কেউ ছিল না। সকলে, যে যেখানে ছিল, স্তব্ধ বিস্ময়ে বাবায়ারামের মাথার দিকে তাকিয়ে ছিল।
ঈশ্বর ডাকার পর্ব একদিন শেষ হলে সকলে শুঁড়িখানায় গিয়ে ভিড় জমাতে শুরু করে।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

সুস্মিতা কৌশিকী

সময়

কোথাও তীব্র বাজছে মুহূর্ত
নদী না, ডোডো পাখির সঙ্গম না, প্রচ্ছন্ন আভাস না
ব্যবহারিক অথবা অপেক্ষাকৃত জান্তব গতির অসঙ্গতি
মর্মান্তিক ভুলের কাছে গুটিয়ে যাচ্ছে চিৎ কণিকারা

মনে হয় হার মানতে নারাজ; এক ডানাভর
ঝুপ করে নেমে আসা মাছরাঙা ঠোঁট
তখনও কিছুই তেমন গুছিয়ে তোলা হয়নি
ছোঁ মেরে নিয়ে গেল

দেখে কাতর লাগে; তৃষ্ণার ছিল কিছু বাকি
আপৎকালীন, প্রিয়তার মুখ, যাপনের যৎকিঞ্চিৎ সঞ্চয়
প্রত্যাশার জন্ম-জড়ুল ছুঁয়ে ছেলেমানুষি জিদ

তবু একরোখা; বর্তুলের ভিতর ঢুকে পড়া ছিপ
তুলে নিল নিখুঁত ব্যবধানে
নিমেষ, শূন্যতা, অনাদী, বিষণ্ণ।

বৃদ্ধ গাছ ও স্বতন্ত্র কুঠার

গাছটার বয়স হয়েছে যথেষ্ট
গায়ে ধরা পোকা খুঁটে খায় রঙিন কাঠঠোকরা
এদিক ওদিক সুযোগসন্ধানী পরগাছা ধরেছে জাপটে
দুটো ডাল দুঃখের স্মৃতির মতো আটকে রয়েছে বেহায়া শরীরে

তবু সামান্য স্নেহগন্ধ বৃষ্টিতে এখনও কেমন মেলে ধরে ডানা
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আকাঙ্ক্ষার নবপত্রিকা
ফল মুখে উড়ে আসে বিবিধ গোপন পাখি
ডালে বসে, গান গায়
আহ্লাদের খড়কুটো নীড় গড়ে তোলে
সালতামামির প্রজনন শেষে সুখের উড়াল

এ-সবই ক্ষণকালের জাদুবাস্তবতা— গ্রাহ্য করে না
সারাবেলা সজাগ অতন্দ্র কাঠুরিয়া,
হাতে নিয়ে স্বতন্ত্র কঠিন কুঠার।

অক্ষয় বৃক্ষচরিত

যেটুকু দিয়েছ ভোগ সেটুকুই, এর বেশি যাঞ্চা করিনি
ফিরেয়ে দিতে পেরেছি লাবণ্য আকর, মাটি ও উর্বরতা
অনীহা উদাসীনতপ উপেক্ষার অনুপূর্ব যাতায়াতে
মুখ ঘুরিয়ে চলে যাইনি ইচ্ছামৃত্যুর ললিতসভায়
হাতে ধরানো ফেরারি সুইসাইডনোট নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি একা—
ত্রিভুবন শয্যার পাশে দৃশ্যহীন বাহুডোরে, যেমন দ্যুতিহীন শ্লীল কঠোরতা আপন হয় অক্লেশে।

মানুষের স্বার্থপরতা দেখেছি, পরশ্রীকাতরতা, উল্লাস
সব ছেড়ে নিজস্ব নির্বান ঘিরে ঐশী বিভার পরন্তপ
দেহপল্লব, সুতনু ঘ্রাণ, চিন্তার মণিকোঠায় জলজ প্রকরণ।

সুদৃশ্য মাইলফলকে অতিক্রমহীন দূরত্ব জ্ঞাপক গেঁথে
পাড়ি দিয়েছি দুরূহ প্রব্রজ্যা, ঋতুপর্ণ মন্থনের কালে
এই দেহ সন্ন্যাসে গোপনে রাখিনি কোনো যৌন-শঙ্খল সাপ।

কেবল হাওয়ার আদলে বদলে গেছি থেকে থেকে, আর
শব্দযোনী খুঁড়ে তুলে এনেছি ওঁ-কার
ব্যথা ভুলবার মন্ত্রে রচিত হয়েছে অক্ষয় বৃক্ষচরিত।

কণ্ঠিবদল

ভেঙে ছিল আবাল্য প্রেম তারুণ্য বিভাজিকায়
দোহাই সৌন্দর্যহীনতা
তারপর একে একে গেছে সব প্রেম, সংসার আবিল
ভেঙেছে যাবতীয় ক্ষোভে ও অভাবে
পথে পথে ঘুরে হাতবদলের ফেরে হয়েছে পতিতা
শরীর ছুঁয়েছে অযুতে, অধরাই থেকে গেছে মন
নেই মান
মানুষের সমাজে ঘৃণ্য সমান।

শেষে এক অন্ধ বাউল
হাত ধরে নিয়ে যায় মাটির কুটিরে
আকাশপ্রদীপ জ্বলে, উদ্ভাসিত একতারা
মন দিয়ে ছুঁয়ে দেয় মন, মাটির নিরালায়
শত শঙ্খ বাজে যে-আঁধারে, অলৌকিক উলু,
তুলসী কাঠের মালা হিরেমোতি আলোর বাহক
যাপন বিন্যাসে গেয়ে ফেরে পথে পথে
বাজে খঞ্জনি দেহতত্ত্ব গানে
সুন্দর হয়েছে সত্য, সত্য‌ অমর্ত্য।

বেঁচে থাক আত্মার বাঙ্ময় আলো, দেহকাঁচা, ফকিরাত।

ব্যক্তিগত জার্নাল

জানাও— কতটুকু আঁধার, কতটুকু অনালোক। আঁধারে বাজুক সেতার সর্বভুক, অনালোক ছুঁয়ে ফেলো সন্ন্যাস জোছনায়। তলিয়ে যেতে যেতে তোমার সিংহকেশর পৌরুষ শাসন করুক আমার ভূলোক দ্যুর্লোক। অমার্জিত প্রেমে বনেচর জীবন ডায়নার খরস্রোত। আমাকে বখে যেতে দাও।

পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। আহা! জলজ মীন জীবন। পলকহীন চোখে দর্পণের পিপাসা। ইন্দ্রিয়গুলো একে একে মরে যেতে থাকে। স্পর্শ পাখনা ক্ষতিগ্রস্থ হলে জলতল ভুল হয়ে যায়, যেভাবে গন্ধ মরে গেলে বাঁচেনা প্রেম। প্রতিকূল নয় কিছুই, কেবল ধর্মের শিঙা বাজাতে শিখিনি বলে…

আমাকে থামিয়ে দিয়েছ বিনাশরেখা থেকে সংকটপূর্ণ দুরত্বে। রোজ একটু একটু পরখ করে নিই, কতটা অবলম্বনহীন বেড়ে ওঠে বিরুৎজীবন। মুখ লুকোবার পরিসরে পাথর খাদান। তবু ব্যভিচারী আঙুলগুলো সেজে ওঠে অভয়মুদ্রায়।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

মণিশংকর বিশ্বাস

ফল

রোদের জটা থেকে ছিটকে ওঠে কয়েকটি শালিখ
‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ কিশোরীর মতো ধানখেত একা শিস দেয়
গোলাপ ফুলটি আসলে ততটা বড়ো, যতদূর তার সুগন্ধ
বহুদূর হতে আকাশে জীবন্ত কোনো গ্রহ তাকে প্রেম নিবেদন করে।
এইসব মিলেমিশে থাকে আমার ভিতর—
বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এই মিলমিশ—
একটি বৃহৎ সংখ্যা যেরকম দুই বা দুইয়ের অধিক ক্ষুদ্রতর সংখ্যার যোগফল।

অশোকনগর

ভালোবাসি— এই ব্যক্তিগত বোধগম্যতার আঁধারে
একটি জোনাকি ক্রমাগত জ্বলে বা নেভে।
বরষাঘন চোখের মতো পুকুরের ধারে
দাঁড়িয়ে রয়েছি, ভিজে কুকুরের আনুগত্য নিয়ে।
সাইকেলে বাঁধা বেলুনগুচ্ছের মতো
কী যেন একটা
ছটফট করে, উলটো দিকে ছুটে যেতে চায়।

তোমার চোখের বিন্দুবিসর্গ আমার ভালো লাগে

আমি চাই ও-দু-খানি চোখ জানালা দিয়ে এসে
আমাকে তুলে নিয়ে যাক

…নিয়ে যাক তোমার নিজ্‌ঝুমে, অশোকনগর।

কলাবউ

তোমাকেই পেতে চেয়ে বাকি সব আগডুম বাগডুম
এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকও চলে গেল
তুমি সেই দেহতত্ত্ব গান।
সুন্দরের জলে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে—

দুপুরের নির্জন খয়েরিনীল কচুরিপানায়
যেরকম ডুবে থাকে রাজহাঁস।
মনে পড়ে গত শতকের আশির দশক—
মানুষের যা যা দরকার, সব আবিষ্কার হয়ে গেছে
দুপুরবেলা আমিও আবিষ্কার করেছি কখন
প্রতিদিন তুমি শাড়ি খুলে উড়াও পাখির ঝাঁক
পুকুরের জলে মেশে বৃত্তাকার হলুদ
ওই উদ্বৃত্ত নাভিদেশ পরক্ষণেই অন্য মহাদেশ
বৃষ্টিবন…
পঁচিশ বছর দেখা হোক বা না হোক

আজও তোমার মুখের ’পরে
আমার সকল যৌনইচ্ছা খেলা করে।

প্রাক্তন

পুরোনো দিনগুলিকে দুর্বোধ্য সংকেত মনে হয়।

কী যেন ভুলতে হবে—
সারাক্ষণ মনে পড়ে।
রক্তের গভীরে ফোটা এই রক্তজবার মালা
অতর্কিতে দেবতার পায়ের দিকে চেয়ে
হাড়িকাঠের মান্যতা চায়
অন্ধের চোখের সাদা অংশের মতো ভয়
ও কালো অংশের মতো উদ্দেশ্যহীনতা
ছাগশিশুটির ’পরে ভর করে।

আমাদের সম্পর্ককে, অতঃপর, জলে ধুয়ে ফেলা রক্তের দাগ মনে হয়।

নিজের পুরোনো কবিতার মুখোমুখি

যখন পিছন ফিরি তোমাকে দেখতে
মনে করি এ কোন সময়?
তুমি কি গভীর নও তত
তবে কেন এত জল, এত কান্না উপচে পড়ছে?
ফার্নপাতা, শ্যাওলায় ঢেকে গেছে প্রেমিকার চুল
পাথরের শ্বেতাভ হাসির দাগ লেগে আছে
ওই মর্মরজটিল বেদেনির ঠোঁটে…
লতানো ফুলের গাছ থেকে
ঝরে পড়ে ফুল, আরও শাদা ফুল।
একটি গোখরো হিলহিলে, সহসা উঁকি মারে
সবুজ পিচ্ছিল অক্ষরের ফাঁকে

অধীর প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন।

Categories
2021-May-Translation অনুবাদ

ডোনাল্ড বার্থেলমে

রেবেকা

ভাষান্তর: ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ

রেবেকা লিজার্ড তার নামের— কুচ্ছিৎ, সরীসৃপীয়, একেবারে অগ্রহণযোগ্য— শেষের অংশটুকু বদলানোর চেষ্টা করছিল।

‘লিজার্ড’, বিচারক বললেন। ‘লিজার্ড, লিজার্ড, লিজার্ড, লিজার্ড। আপনি যদি এটুকু অনেকবার উচ্চারণ করেন তাহলে এতে আর কোনো সমস্যা থাকে না। এ-সব তুচ্ছ উপদ্রবে আপনি আদালতের ক্যালেন্ডার তছনছ করে দিতে পারেন না। অনেকেই সম্প্রতি তাদের নাম বদলেছে। নাম পরিবর্তন টেলিফোন কোম্পানি, বিদ্যুৎ কোম্পানি এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চ স্বার্থের সাথে যায় না। প্রস্তাবটি নাকচ করা হল।’

লিজার্ড কেঁদে ফেলল। নাকের নীচে চেপে ধরল চন্দ্রমল্লিকার সুবাস মাখা ক্লিনেক্স টিস্যু।

‘দুর্বল মহিলা’, একজন বলল, ‘আপনি কি স্কুলশিক্ষক?’

অবশ্যই তিনি একজন স্কুলশিক্ষক, নির্বোধ কোথাকার। দেখতে পাচ্ছ না, বেচারি ভেঙে পড়েছেন? তাকে একলা থাকতে দিচ্ছ না কেন?

‘আপনি কি সমকামী লেসবিয়ান নারী? এই কারণেই কি আপনি কখনো বিয়ে করেননি?’

ওহ্ যিশু, হ্যাঁ, তিনি সমকামী লেসবিয়ান নারী, তুমি যেমনটি বললে। তুমি কি তোমার মুখটা একটু বন্ধ করবে?

রেবেকা জঘন্য এক চর্মবিশেষজ্ঞের কাছে গেল (নতুন এক জঘন্য চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ), কিন্তু তিনিও আগের বিশেষজ্ঞদের মতো একই কথা বললেন। ‘সবুজাভ’, তিনি বললেন, ‘ত্বকের হালকা সবুজ, এটা বংশগত অস্বাভাবিকতা, কিছুই করার নেই, আমার শঙ্কা হচ্ছে মিসেস লিজার্ড।’

‘মিস লিজার্ড।’

‘কিছুই করার নেই মিস লিজার্ড।’

‘ধন্যবাদ ডাক্তার। বিরক্ত করার জন্য কি আমি সামান্য কিছু আপনাকে দিতে পারি?’

‘পঞ্চাশ ডলার।’

বাড়ি ফিরল রেবেকা। মেইলবক্সে পেঁচিয়ে থাকা বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিস তার জন্য অপেক্ষায় ছিল। বর্ধিত এই ভাড়া আবার আগের মাসগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ব্যাপারটা একেবারে ধর্মঘটী নাছোড় শিক্ষার্থীদের মতো।

অবশ্যই আরও কিছু ক্লিনেক্স লাগবে। কিংবা একটা পিএইচডি। কোনো উপায় নেই আর।

চুলায় মাথা ঢুকিয়ে রাখার কথা ভাবল সে। কিন্তু তারটা তো ইলেক্ট্রিক ওভেন।

রেবেকার প্রেমিকা হিল্ডা ফিরল দেরি করে।

‘কেমন কাটল?’ দিনটা কেমন ছিল তাই জানতে চাইল হিল্ডা।

‘বিচ্ছিরি।’

‘হুমম’, বলল হিল্ডা। চুপচাপ সে দু-জনের জন্য কড়া একটা পানীয় তৈরি করল।

হিল্ডা দেখতে খুব সুন্দরী। রেবেকাও সুন্দরী। তারা একে-অপরকে ভালোবাসে— আমরা যেমন জানি, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ও সুনিপুণ ব্যাপার। হিল্ডার চুল সুদীর্ঘ ও সোনালি, একটু ছায়াময়তা সেই সোনালি চুলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রেবেকারও আছে ধ্রুপদী এবং আবেদনময় গঠন। যেই দেখে সেই তার প্রশংসা করে।

‘দেরি করলে কেন’, বলল রেবেকা, ‘কোথায় ছিলে?’

‘স্টেফানির সাথে একটু পান করছিলাম।’

‘স্টেফানির সাথে পান করলে কেন?’

‘সে আমার অফিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এসে বলল।’

‘কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’

‘বার্কলেতে।’

‘স্টেফানি কেমন আছে?’

‘সে ভালো আছে।’

‘স্টেফানির সাথেই তোমার পান করতে হবে কেন?’

‘আমিও একটু পান করতে চাইছিলাম।’

‘স্টেফানি হালকা সবুজাভ নয়, তাই তো? চমৎকার, গোলাপি রং স্টেফানির?

হিল্ডা উঠে গেল। সিঅ্যান্ডডব্লিউ-র চমৎকার একটা অ্যালবাম চালিয়ে দিল রেকর্ড প্লেয়ারে। এটা ড্যাভিড রজার্সের ‘ফেয়ারওয়েল টু দ্য রায়মান’ আটলান্টিক এসডি সেভন টু এইট থ্রি। এতে আছে ‘ব্লু মুন অব কেন্টাকি’, ‘গ্রেট স্পিকেল্ড বার্ড,’ ‘আই এম মুভিং অন’, এবং ‘ওয়াকিং দ্য ফ্লোর ওভার ইউ’-র মতো জনপ্রিয় গানগুলো। ন্যাশভিলের সেরা সব ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটেছে এই রেকর্ডে।

‘গোলাপি রংটাই সব কিছু নয়’, বলল হিল্ডা। ‘এবং স্টেফানি কিছুটা বিরক্তিকরও। তুমি তো তা জানো।’

‘এতটা বিরক্তিকর নয় যে, তুমি তার সাথে পান করতে যেতে পারো না।’

‘স্টেফানির ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই।’

‘আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময়’, রেবেকা বলল, ‘একটা লোক আমার জিপার খুলে ফেলেছিল।’

ড্যাভিড রজার্স গাইছেন ‘ওহ্, প্লিজ রিলিজ মি, লেট মি গো।’

‘কী পরে ছিলে তুমি?’

‘এখন যা পরে আছি।’

‘তাহলে তো বলতে হয়’, হিল্ডা বলল, ‘পাছার ব্যাপার লোকটার ভালোই রুচি আছে।’

রেবেকাকে সে সোফায় ফেলে জড়িয়ে ধরল। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, বলল সে।

‘সরো’, ঠান্ডা গলায় বলল রেবেকা। ‘যাও, স্টেফানি সাসারের সাথে সময় কাটাও গিয়ে।’

‘স্টেফানি সাসারের ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই’, দ্বিতীয়বারের মতো বলল হিল্ডা।

কেউ যেটাকে সবচেয়ে বেশি আঁকড়ে ধরতে চায় সেটাকেই আবার প্রায়শ ‘দূরে ঠেলে’ দেয়, ঠিক প্রেমিকের মতো। খুবই সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু খুব পীড়াদায়ক, মনোস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এক্ষেত্রে (আমার মতামত) এমন এক ব্যাপার ঘটে যে, যা প্রকাশ করা হল তা যেন ‘বিশুদ্ধভাবে’ প্রকাশ করা হল না। যেন ছোটো একটা ক্ষত থেকে গেছে তাতে, থেকে যায় কোথাও মারাত্মক কোনো একটা জায়গা। এমনকী, ঘটতে পারে ভয়ংকর কোনো কিছু।

‘রেবেকা’, হিল্ডা বলল, ‘আমি আসলেই তোমার এই হালকা সবুজ রংটা পছন্দ করি না।’

‘লিজার্ড’ শব্দটি টিকটিকি, গুইসাপ, গিরগিটি, আঞ্জিনার মতো নানা কিছুর সাথে যুক্ত। ‘লারোস এনসাইক্লোপিডিয়া অব অ্যানিমেল লাইফ’-এর তথ্য অনুযায়ী এই ধরনের প্রাণীর অন্তত বিশটি পরিবার এখনও বিদ্যমান। বিলুপ্ত হওয়া আরও চারটির কথা জানা যায় জীবাশ্ম থেকে। এই প্রাণীগুলোর রয়েছে অন্তত আড়াই হাজার প্রজাতি। এরা হাঁটা, দৌড়ানো, আরোহন করা, গর্ত খোঁড়া— এই ধরনের নানা অভিযোজনে সক্ষম হয়েছে। অনেকগুলোর আবার আকর্ষণীয় নামও আছে। যেমন— রঙিন টিকটিকি, চ্যাটালো পা টিকটিকি, কটিবন্ধ টিকটিকি, দেওয়াল টিকটিকি।

‘বেশ কয়েক বছর ধরে আমি সেটা এড়িয়ে গেছি, কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমি আসলে এটা খুব একটা পছন্দ করি না’, হিল্ডা বলল। ‘এটা কিছুটা—’

‘জানি আমি’, বলল রেবেকা।

রেবেকা বেডরুমে গেল। কোনো একটা কারণে চালিয়ে দিল রঙিন টেলিভিশনটা। সবুজ একটা আভা ছড়িয়ে ‘গ্রিন হিল’ ছবিটা তখন টিভিতে শুরু হচ্ছে মাত্র।

আমি অসুস্থ, আমি অসুস্থ।

আমি এক চাষী হব।

আমাদের ভালোবাসা, আমাদের যৌনপ্রেম, আমাদের সাধারণ প্রেম!

হিল্ডা বেডরুমে ঢুকল। বলল, ‘খাবার রেডি আছে।’

‘কী খাবার?’

‘পর্ক আর রেড ক্যাবেজ।’

‘আমি এখন মাতাল’, বলল রেবেকা।

আমাদের নাগরিকদের অনেকেই মাঝে মাঝে এমন একটা সময়ে মাতাল হয় যখন আসলে তাদের মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার। এই যেমন রাতের খাবারের সময়টায়। মাতাল হলে ঘড়ি কোথায় রাখতে হয়, চাবি কোথায় থাকবে, মানি ক্লিপটা কোথায় রাখবে— এ-সব তোমনে থাকে না। অন্যের সুস্বাস্থ্য, প্রশান্তি, প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনশীলতা কমে যায়। অতিমাত্রায় অ্যালকোহল নেওয়ার কারণগুলো অ্যালকোহলের প্রতিক্রিয়ার মতো তত পরিষ্কার নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণত মনে করেন যে, মদ্যপান খুব গুরুতর সমস্যা হলেও কিছু ক্ষেত্রে তার চিকিৎসাও আছে। বলা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে অ্যাঅ্যা (মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং চিকিৎসা সংস্থা ‘অ্যালকোহলিক্স অ্যানোনিমাস’) বেশ জনপ্রিয় ও কার্যকর। আসল ব্যাপার হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি।

‘এখন উঠো’, হিল্ডা বলল। ‘যা বলেছি তার জন্য আমি দুঃখিত।’

‘তুমি তো সত্যিই বলেছ।’

‘হ্যাঁ, তা সত্য’, স্বীকার করল হিল্ডা।

‘কিন্তু শুরুতেই এই সত্যটুকু তুমি আমাকে বলোনি। শুরুতে তুমি বলেছ আমার এই রংটা সুন্দর।’

‘শুরুতে আমি তোমাকে সত্যটাই বলেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম যে তা সুন্দর। তখন।’

হিল্ডার সংক্ষিপ্ত তিনটি বাক্যের মধ্যে এই ‘তখন’টা চরম শব্দ। যখন শব্দটি এভাবে ব্যবহৃত হয় তখন এটি মানুষের শব্দভাণ্ডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা উস্কে দেওয়া শব্দ। বিগত হয়ে যাওয়া সময়! সেই সময়ের সাথে বিগত হয়ে যাওয়া অবস্থা! মানুষের যন্ত্রণাকে কীভাবে পরিমাপ করা হবে? কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, হিল্ডা এই অবস্থায়ও রেবেকার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করছে, কিন্তু, পাঠক, হিল্ডার এই অবস্থানকেও ঈর্ষণীয় বলে বিবেচনা করা যায় না, সত্য হচ্ছে, বের্গসঁ যেমন জানতেন, এক কঠিন আপেল কঠিনই, তা সে কেউ ধরুক আর কেউ ছুঁড়ুক।

‘তাহলে আর কী?’ পাথরকণ্ঠে বলল রেবেকা।

‘তারপরও আমি তোমাকে ভালবাসি—’

তোমার এই তারপরও যে-ভালোবাসা সেটি কি আমি চাই? তুমি চাও? কেউ কি তা চায়? তারপরও আমরা কি কিছুটা তেমনই নই? আমাদের সবার মধ্যেই কি এমন ব্যাপার নেই যা বলতে গেলে আমাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে। আমি তোমার কিছু বিষয় দেখেও দেখি না, তুমি একইভাবে আমার কিছু দিককে নজরের বাইরে রাখো, আর এই কিছু বিষয়ে আমাদের পরস্পরের অন্ধ থাকা, এই বন্ধ রাখা চোখের চোখাচোখি, ১৯৬০ দশকের শুরু থেকে এই অভিব্যক্তির ব্যবহার, আমরা আমাদের কড়কড়ে আর সুরভিত জীবনযাপন বজায় রেখে চলেছি, নিশ্চয়ই এটাকে বলে ‘সেরাটা করা’। যেটিকে আমি বরং সবসময় বিবেচনা করেছি আমেরিকার আদর্শের ম্যাড়ম্যাড়ে ধারণা হিসেবে। আমার এই সমালোচনাকে অন্যদের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। উদাহরণ হিসেবে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ম্যাকিনলের কথা বলা যায়। যিনি মেনে চলতেন যে, সবসময় হাসিখুশি থাকা সম্ভব না হলেও ভালো মেজাজ বজায় রাখাটা মূল্যবান এবং সঠিক।

রেবেকার মাথায় হাত রাখল হিল্ডা।

‘তুষার পড়তে শুরু করেছে’, বলল সে। ‘তুষারপাতের মৌসুম আসছে শিগগিরই। আগের সেই তুষারের দিনগুলোর মতোই আবার আমরা একসাথে। আগুনের পাশে বসে বাস্টহ্যাড পান করা। সত্য হচ্ছে এক বদ্ধ ঘর। যে-ঘরে দরজায় মাঝে মাঝেই আমরা ঠকঠক করি এবং সেটি বন্ধই থেকে যায়। আগামীকাল তুমি আমাকে আবার দুঃখ দেবে এবং আমি তোমাকে আবার বলব যে, তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ এবং তারপর আবার দুঃখ দেবে, তারপর আবার। জাহান্নামে যাক। এসো হে নীলচে সবুজ রঙের বন্ধু আমার, এসো আমার সাথে বসে রাতের খাবার খাও।’

তারা একসাথে খেতে বসল। তাদের সামনে রাখা পর্ক আর রেড ক্যাবেজ থেকে ভাঁপ উঠছে। তারা ম্যাককিনলে প্রশাসন নিয়ে ধীরে ধীরে আলাপ করছে। সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদরা বিষয়টি সংশোধন করছিলেন। কাহিনি এখানেই শেষ। এই কাহিনি লেখা হয়েছে বিভিন্ন কারণে। কারণগুলোর মধ্যে নয়টিই গোপন। দশমটি হচ্ছে, মানব প্রেমের বিষয়ে— যা সবসময়ই ভীষণ এবং সোনালি— বিবেচনা কখনোই বন্ধ করা উচিত নয়, উষ্ণ ত্বকের পাতায় যে রং আর নকশার উল্কিতেই তা খচিত থাকুক না কেন।

Categories
2021-May-Story গল্প

আদিদেব মুখোপাধ্যায়

এখন ভস্মের অধ্যায় শেষ হচ্ছে

অনেকক্ষণ হয়ে গেল, আমি একভাবে শুয়ে আছি, নড়তে চড়তে পারছি না। চাইছিও কি নড়তে, হয়তো না। আমার পেটে আবছা ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে, কেন করছে ব্যথা?সাতসকালেই খারাপ কিছু খেয়েছি কি আমি? মনে পড়ছে না। ব্যথাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে ফের। এটা আসলে একটা ঘূর্ণি, একটা প্যাঁচানো রাস্তায় ব্যাপারটা চলে; ছড়িয়ে পড়া, ফিরে আসা, আবার ছড়িয়ে পড়ার পথে এটা শুরু আর শেষ আর ফিরে শুরু হতে থাকে, এটা, মানে এই ব্যথাটার কথা বলছি আরকী। ব্যথা আমাকে শুধু ব্যথার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, ব্যথার কথা মনে করাচ্ছে ঘূর্ণির কথা, ঘূর্ণি আবার ব্যথায় বদলে যাচ্ছে, ব্যথা আমায় আর অন্য কিছুই মনে করাচ্ছে না। রক্তশূন্যতায় শাদা একটা নিথর সিলিং, তার দিকে একভাবে চেয়ে আছি আমি। চোখের পাতাও কি পড়ছে, হয়তো পড়ছে, হয়তো পড়ছে না। কোনো কিছু স্থির করে মনে করতে যে কতদিন পারিনি। রোদের একটা রেখা নাক বরাবর চলে গ্যাছে, তার ভেতরে চকচকে ধুলো ঘুরে ঘুরে উঠছে। কোথায় পৌঁছেছে রেখাটা? আমি বলতে পারি না। আমি ঘাড় তুলতে পারি না, আমি নড়তে পারি না, আমি চড়তে পারি না, আমি চেয়ে থাকতে পারি কেবল। হয়তো রেখাটা কোথাও মিশে গ্যাছে। কিংবা হারিয়ে গ্যাছে। হয়তো সেখানে, যেখান থেকে ফোঁপানিটা উঠে উঠে আসছে। উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথায়? যেখান থেকে উঠে আসছে, সেখানেই কি? জানি না। কী করেই-বা জানব। দিক সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আচ্ছা, আমি কোথায় আছি? এই বালিশের নরম, এই বিছানার নরম আমায় ছুঁয়ে আছে। আমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে আমি তোমাকে কী বলব? যা কিছু নরম তাদের মধ্যে আমি শুয়ে থাকি আর ততটুকুই আমি বুঝি যতটুকু আমায় ছুঁয়ে থাকে? কিন্তু না, আমি এ-সব ভাবব না। আমি এখন মুখ ডুবিয়ে দিয়েছি আলোতে। তাপ শুষে নিচ্ছি। রক্ত কলকল করে উঠছে আমার মধ্যে, কোলাহলে আমি ভরে যাচ্ছি। ঘাসের মধ্যে নিবিড় একটা সাপ অতি ধীরে তার খোলস ছাড়ে আর স্থির হয়ে শুয়ে থাকে আর শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবে। তুমি, ওহ্‌ তুমি, সামান্য জিভ কাঁপানোর ক্ষমতাও আমার নেই, ফিশফিশ করা, তাও কি আছে, তোমার গাল অপর দিকে ফেরাতে কি আমায় হাত ব্যবহার করতে হবে? সহসা হাওয়া দিলে অন্ধকার দুলে দুলে ওঠে, ঘনত্ব পাতলা হয়ে আসে, অন্ধকারের প্রথম কণা তার দ্বিতীয় কণার থেকে আলগা হয়, সরে যায়, অপেক্ষাকৃত পাতলা অন্ধকার এসে সেই মাঝখানের জায়গা দখল করে নেয়। তুমি মুখ নীচু করে একভাবে বসে থাকো, নড়ো না, চড়ো না, চেরা চেরা শুকনো জিভ কেঁপে ওঠে। শিরশিরে হাওয়া দেয়, রেখা বেঁকে যায়, বিন্দুরা অবস্থান পালটায়, বক্রতলে বদলে যায় সমতল, বাতাস এসে বক্রিমার শূন্যতাকে ভরাট ও অবলুপ্ত করে। আমি নিঃশ্বাস চেপে রাখি। আড়াল থেকে গোয়েন্দা কিংবা চোরের মতো আমি দেখছি তোমায়। দেওয়ালের প্লাস্টারে নখগুলো বসে যাচ্ছে। বাস্তবতা সময়ের মধ্যে তার ঝুরিগুলো নামিয়ে দিয়েছে, ঝুরিরা ক্রমাগত নিজেদের বিন্যাস পালটাতে থাকে। সামান্য পালটে যাওয়া, ব্যাস, তাতেই স্মৃতি দুমড়ে যায়, আকার মুচড়ে যায়, অস্ফুটে কঁকিয়ে ওঠার শব্দ আসে। এতক্ষণের নৈঃশব্দ্য ভেঙে পড়ে। ইতস্তত পড়ে থাকে মুহূর্ত, মাড়িয়ে এগোলে তারা কাচ ফেটে যাওয়ার শব্দ করে ওঠে। আস্তে আস্তে তোমার চুল ছড়িয়ে পড়ে আর মিশে যেতে থাকে নরম অন্ধকারে। সাপ নড়েচড়ে ওঠে, ঘাসের ওপর তার নিথর খোলসচিহ্ন পড়ে আছে। আমি কাঁপা কাঁপা আঙুল বাড়িয়ে দিই ভাঙা ছবিদের আর অস্পষ্ট শব্দদের গুলিয়ে-যাওয়া দিকে। দপ্ করে লাফিয়ে ওঠে শিখা, অল্প অল্প অন্ধকার পুড়ে ছাই হয়ে ঝরে যেতে থাকে। আমার কামনা এখন জ্বলন্ত মোমবাতি হয়েছে, গলে-যাওয়া তার একটি ফোঁটা আসলে একটি অশ্রুবিন্দু, মোমবাতির গোড়ায় এসে অশ্রু জমে কামনা হতে থাকে। এই বদলে-যাওয়া দেখে অস্পষ্ট হেসে ওঠো তুমি। বা হয়তো ভুল দেখি, তুমি হাসছ না, শুধুই চেয়ে আছ, বা হয়তো হাসছ, বা আমি জানি না ঠিক। আলো-আঁধারিতে কেবলই ভ্রম তৈরি হয়। আমি আলতো করে ছুঁই তোমাকে। পাথরের ঠান্ডা উঠে আসে আঙুলের ডগায়। আবার হাওয়া দেয়, ঘুরে ঘুরে ওঠে, আলোছায়া কাঁপতে কাঁপতে সন্ত্রস্ত দানব হয়ে যায়। আমি দু-হাত দিয়ে চেপে ধরি তোমার মুখ। নখ বসে যায় গালে। এটা কী, মুকুট, হ্যাঁ, মুকুটই তো। একটা কাঁটার মুকুট পরানো তোমার মাথায়, কে পরিয়েছে, কেন পরিয়েছে? আমি বুঝতে পারি না। থিরথির করে চেরা জিভ কেঁপে ওঠে। স্রিক স্রিক শব্দ হয়। টিক টিক করে একটা ঘড়ি কোথা থেকে প্রতিবাদ জানায়। দেখি, তোমার চোখের কোণা দিয়ে রক্ত নেমে আসছে। না-বলা ব্যথায় তোমার চামড়া নীল হয়ে গ্যাছে। আমি রোধ অনুভব করি। গরাদের মতো সে জেগে ওঠে, সর্বস্ব দিয়ে আমাকে নিরস্ত করে। আমি আমার রোগা হাতেদুটো দিয়ে শিক ধরে থাকি। শিকের ওপর বিদ্যুৎ পিছলে যেতে থাকে। ক্রুদ্ধ, ফোঁসফোঁস শব্দ ওঠে। ঘাসের ওপর দুটো নুড়ি রৌদ্রে ঝকঝক করতে থাকে। আমার কামনার জ্বলন্ত শীর্ষ আমি হাতের আড়ালে ধরি। বাতাসের অভাবে সে ছটফট করে। নিভে যায়। লুপ্ত চরাচরে আমি একা, একমাত্র অস্তিত্ব বজায় রাখি। শুধু অস্তিত্ব, যার দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, হয়তো উচ্চতাও নেই। হয়তো সে বিন্দুর মতো, কে জানে, আমি বুঝতে পারি না। সে কি স্থির, না কি সে অসীমের দিকে উঠে যাচ্ছে, না কি ঢুকে আসছে এক অতল কুয়োয়? আমি নিশ্চিত হতে পারি না। হয়তো আমি শুধুই একটা বিন্দু, কেবলই বিন্দু, যে-আমি একবিন্দু ব্যথা হয়ে বিন্দু-আমার ভেতরে ঢুকে পড়েছে কখন। অতলতা এক ঘূর্ণি, তার প্রথম বলয় থেকে অনন্ত বলয়ের দিকে ব্যথা নেমে আসে। ব্যথা স্থির হয়। ব্যথা উঠে আসতে থাকে। অসীম, অতল ও স্থিরতার মধ্যেকার যে-রাস্তা তার প্যাঁচগুলো আমার অস্তিত্ব কিংবা ব্যথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে থাকে। এই একঘেয়েমি আমাকে সহ্য করে নিতে হয়। এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না। জিভ নাড়াতে পারি না। ফিশফিশ করতে পারি না। একটা ঘড়িও থাকে না যে, সময় জানব। আমাকে ছুঁয়ে থাকে নরম। সিলিং-এর রক্তশূন্যতায় তোমার মুখ কল্পনা করি। পারি না। একটা আঁচড়ও কাটতে পারি না। এটা আসলে একটা অনন্ত সাদা, অনন্ত শীতলতা, এখানে কোনো প্রশ্ন নেই, উত্তরও নেই, প্রশ্ন উত্তরের মাঝামাঝি কিছু, বিবৃতি, তাও কি আছে? হয়তো নেই। আঃ। নতুন করে কিছুই আর ভাবতে পারি না। ব্যথা শুধুই ব্যথা আর ঘূর্ণি হয়ে জেগে থাকে। শ্বাসপ্রশ্বাস জেগে থাকে শ্বাসপ্রশ্বাস হয়ে। রক্তের কোলাহল কোলাহলের বেশি কিছু বলে না। আমি বরং এক দুই তিন গুনি। মনে মনে। সংখ্যাগুলো সহসা থমকে দাঁড়ায়। সিঁড়ির ধাপে বুটের শব্দ, থমকে যায়। দরজায় আঘাতের শব্দ, এবার, এবার। গেস্টাপোরা এক্ষুণি ঢুকে পড়বে ঘরের ভেতর। একটা দুটো না, প্রতিটি সকালে এই ভয়ে তুমি ঘুমোতে পারতে না। মনস্তাত্বিক লাকঁ তোমার চিকিৎসা করেছিলেন। গেস্টাপোর কাছাকাছি একটা ফরাসি শব্দের মানে হল স্পর্শ। ছোঁয়া, কিন্তু আলতো করে। বেশ, তুমি তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো এবার। বালিশের নরম তোমায় ছুঁয়ে থাকবে। ২০০২ সালে গুজরাতের একটি হাসপাতালে মুকেশ ঠাকুর আর বশির আহমেদ পাশাপাশি বেডে শুয়ে ছিল। তাদের রক্ত গড়িয়ে পরস্পর মিশে যাচ্ছিল মেঝেতে। তারা প্রায় একইরকম ছোঁয়া পেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ছিল। শুধু শব্দের মানে পালটে দেওয়া। একটা চিহ্ন, তার ঈষৎ বদল। না, এ-সব কথা তোমার উদ্দেশে আমি বলি না। আমি জানি না আর কোনো কথার কোনো মানে আছে কি না। কথারা অতিদ্রুত কথা বাড়িয়ে তোলে। শূন্যতাকে দুমড়ে দেয়। নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে ফ্যালে। থাক, বরং মুহূর্তেরা মুহূর্তের মতোই থাক। তাদের কথায় বদলে দিও না। অর্থ খোঁজা এক ভয়াবহ জুয়োখেলা। ঐ আড্ডায় আমি আর কিছুতেই যাব না। এরা কোথা থেকে উঠে আসছে, এইসব কথারা? আমি বলতে পারি না। হয়তো যেখানে আবার এরা মিশে যাবে সেখান থেকেই। আমি জানি না। আমি বিড়বিড় করতে পারি না। আমি নড়তে চড়তে পারি না। ফিশফিশ করতে? তাও না। আমি শুধু তোমার কথা ভাবতে থাকি। হায় তুমি, সর্বত্র তুমি ব্যাপন করে আছ, সুতরাং সবকিছু তুমিই হয়েছ। আবার সবকিছুরই রূপ হয়ে তুমি বসে আছ নরম অন্ধকারের কেন্দ্রে। তোমার গাল কী করে ছোঁব আমি, কী করে বসিয়ে দেব নখ? তোমার চোখের রক্ত কী করে আমি মুছে নেব কাঁপা কাঁপা আঙুলে? দ্যাখ, আমার কামনা কখন বদলে গ্যাছে প্রেমে, আমার প্রেম তার নিষ্কম্প শীর্ষে উদাসীনতা হয়ে জ্বলে আছে। তোমার দিকে এবার একটু ঝুঁকে পড়ি আমি, প্রথমবারের মতো লক্ষ করি এটা একটা হুইলচেয়ার, যার ওপর তুমি বসে। এখানে কি ভূমিকম্প হয়েছিল কোনো? মেঝে ফাটলো কী করে? তোমার হুইলচেয়ার ঢুকে গ্যাছে মেঝেতে। আমি ঝুঁকে বসি আর দু-হাত দিয়ে তুলতে থাকি একটা চাকা। আমার ঘাম হয়, পরিশ্রম হয়। মনে হয় কেউ আমায় লক্ষ করছে আড়াল থেকে, কখন মুণ্ডু লুটিয়ে দেবে ভূঁয়ে। কই, চাকা তো এতটুকু উঠছে না! আমি আকুল হয়ে উঠি, গালি দিতে যাই নজরদারের উদ্দেশে, ডাকতে যাই তার নাম ধরে। থমকে যাই। রোধের গরাদ ওঠে। কিছুই মনে পড়ে না আমার। কার নাম, কাকে ডাকব, কী বলে ডাকব, কিছুই মনে আসে না। দু-মুঠোয় শিকের ধাতবতা, আমি চেয়ে থাকি। ঘাসের মধ্যে সাপ আবার তার মুখ নামিয়ে নেয়। রোদ্দুরে দুটো নুড়ি শুধু চকচক করে। আস্তে আস্তে আবার নরমে মিশে যাই। ধুলোরা এলোমেলো ঘুরে ওঠে। এক বিন্দু ব্যথা হয়ে ঢুকে আসি বিন্দুসত্তার ভেতরে। কী খাবার খেয়েছি মনে আসে না। হয়তো খাওয়াই হয়নি সকাল থেকে। জানি না। বুঝতে পারি না। ব্যথা শুধু ব্যথার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ঘূর্ণি মনে পড়ায় ঘূর্ণির কথা। ব্যথা আর ঘূর্ণি কখন একাকার হয়ে যায়। বাস্তবতা সময়ের মধ্যে তার ঝুরিগুলো নামিয়ে দিয়েছে, তাদের বিন্যাস প্রতি পলে বদলে বদলে যায়। রক্তশূন্য সিলিং তার রক্তশূন্যতায় ছড়িয়ে থাকে। প্রশ্ন ও উত্তরের অতীত তার শীতলতা, তার অবরোধ। তারই মধ্যে চূড়ান্ত বিবৃতি খুঁজি। মেলে না। ও কার ফোঁপানি? বুঝতে পারি না। ভাঙা ছবি আর অস্পষ্ট শব্দেরা একটু একটু করে মুছে যায়। শ্যাওলায় আচ্ছন্ন প্রাচীন কুয়ো দিয়ে আমি অতলতার দিকে ঘুরে ঘুরে নেমে যেতে থাকি।

Categories
2021-May-Prose গদ্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

বাঁ-হাতে ছুড়ে দেওয়া লেখা

সময় আর দিনকাল— এ-দুই নিয়ে ভারি ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে মনে। অবশ্য দুয়ের মধ্যে ফারাকও কি আছে কোনো? নিজস্ব অবস্থান অনুযায়ী বিচার করি। মনে হয়, এখনকার মতো খারাপ সময় আর আসেনি। নাকি সময় বরাবরই খারাপ, আমি-অবধি এসে পৌঁছোয়নি বলে নিশ্চিন্ত ছিলাম এতদিন?

সমাজের দিকে তাকাই। বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে খারাপ আর কীই বা হতে পারে! ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো’— এই স্পর্ধামাখানো বাক্য বলার সাহসই-বা দেখাতে পারছে কে! চরমতম পরিণতি যা— মৃত্যু— সেই সুন্দরই আজ ওঁৎ পেতে রয়েছে চারপাশে। মৃত্যুচিন্তার শরীর থেকে খসে পড়ছে বহুকল্পিত সৌন্দর্যও। কদর্য ডাক আর তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা— জীবৎকালের হিংস্রতম চোর-পুলিশ খেলার সামনে দাঁড়িয়ে, আর কোন চেতনাই-বা জরুরি হয়ে উঠবে!

যদি সমাজবিচ্ছিন্ন হতাম, কিংবা মারিসীমানার বাইরে নিরাপদ অবস্থান কোনো, সময় ‘কু’ হত না ততখানি। বরং দূর থেকে বিচার করতে পারতাম; কে জানে, হয়তো নিগূঢ় কোনো দর্শনও উঁকি দিত অবরে-সবরে। কিন্তু প্রবলভাবে জড়িয়ে থেকে এটুকু বুঝেছি, পেট আর পিঠ বাঁচানোর লড়াই-এর থেকে কঠিন কিছুই নেই। নিজের ও আত্মস্বজনের পিঠ বাঁচাতে বাঁচাতে, না-পেরে, সর্বাঙ্গে চাবুকদাগ নিয়ে আর যাইহোক, সাহিত্যবিলাস হয় না। তাও এই স্বল্প সময়ে— যখন ধাতস্থ বা অভ্যস্ত হতে অনেক দেরি, চাইছিও না হতে, বরং অসম লড়াইয়ে বার বার হার মানাতে চাইছি মৃত্যুকে। শব্দ খুঁটে-খুঁটে লেখার মন আজ মৃত। তবে মনের সুবিধা এই, উপযুক্ত সঞ্জীবনী ছিটিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলা যায় আবার। দৈহিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই বিকল্প নেই। ফলে, বেঁচে থাকলে, মনকে ফিরিয়ে আনা দুষ্কর হবে না ততটাও। আপাতত এই কেঠো, অপরিকল্পিত ও চলনসই গদ্যেই সময়ের কাছে নতিস্বীকার।

বিপরীতে অন্য চিন্তাও যে উঁকি দিচ্ছে না, তা নয়। এতখানি সীমাবদ্ধ হয়ে গেলাম? বর্তমান ও তার সমস্ত নেতি-কে অতিক্রম করার যে-পথ, তা থেকে পিছলে গেলাম এতখানি! আমারই অবহেলা এর জন্যে দায়ী, সন্দেহ নেই। নিজেকে ভেসে যেতে দিয়েছি, ঝাঁপিয়ে পড়েছি বাইরের কলরোলে। কিন্তু ভয়ংকর এ-বাহিরের সামনে আত্মসমর্পণ না করেই-বা উপায় কী! সমাজ তো বটেই, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে— মৌলিক ‘আমি’-র অস্তিত্বেও যখন ভয় ঢুকে পড়ে, মনে হয়, রেহাই নেই এবার। শিল্প-সাহিত্য সেই স্তর অবধি পৌঁছোতে পারবে না। অন্তত, স্বল্প জীবনকালে এমন সংকট এর আগে দেখিনি আমি। যে-মানুষ নিজের বা অন্যের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, সমস্ত শৈল্পিক সৌকর্য সে ঢেলে দেয় মুহূর্তের ওই ক্রিয়াতেই। কোনো কবিতা-গান তখন অস্ত্র হয়ে আসে না। অস্ত্র হয় না শব্দব্যবহারের অপার্থিব সূক্ষ্মতা। বরং, শিল্পের চোখে যা ‘স্থূল’, সেসবই বাঁচাতে পারে মানুষের প্রাণ।

তাহলে শিল্পের ভূমিকা কী? বার বার খুঁজছি এর উত্তর। মারিতে আক্রান্ত বা মৃত কোনো মানুষকে কেন বাঁচাতে পারল না শিল্প? কেন নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা-উচ্চারণেই থেমে গেল তার দৌড়?
উত্তর দিয়েছে শিল্প নিজেই। মনের সঙ্গে কারসাজি তার। এবং, মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেটুকু শরীর, তার সঙ্গে। শরীরের শরীর সে ভেদ করতে পারে না। ভাইরাস পারে।

এবং, এতদিনকার আলোড়িত সেই কথাই প্রতিধ্বনিত হল আবার। সামান্য ভাইরাসের কাছে আমাদের চর্চা কৃষ্টি বোধ সূক্ষ্মতা সব অসহায়। ফলে, যে-অস্ত্র অবশ্যম্ভাবী, তাকেই তুলে নিতে হত। আর এই লেখা? থেকে যাক সময়ের অভিশাপ হয়েই। এর বেশি কোনো ভূমিকাই নেই এর। দুঃসময় কাটলে, হয়তো ফিরে পড়ব। অস্তিত্বের চরমতম সংকটে, না, কবিতা পাশে এসে দাঁড়ায়নি। দাঁড়িয়েছিল চিকিৎসা। বন্ধু। ‘বন্ধুর কবিতা থেকে আমাকে আবার দেখা যায়।’ এই মারিকালে, বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো কবিতা আর নেই। ‘জীবন’ নামের সেই কবিতাই প্রতিফলিত করছে আমাকে-তোমাকে। বেঁচে থাকা দেখতে পাচ্ছি আমি। তোমার মধ্যে। আয়নায়। লিখে-ফেলা এই অসংলগ্নতায়।

মনে পড়ে চাঁদ সওদাগরের কথা। অনিচ্ছুক হয়েও মনসার পূজা। বাঁ-হাতে ছুড়ে দিয়েছিলেন ফুল। পরিবর্তে, ফিরে পেলেন বাণিজ্যতরী। আমার এ-লেখাও তেমনই, বাঁ-হাতে ছুড়ে দেওয়া। যতই তাৎক্ষণিক হোক, না-লিখে উপায় নেই। অধরা রইল নীরস তরুবরও। কিন্তু শুষ্কং কাষ্ঠং থেকে যাওয়ার সামর্থ্যটুকু ছিনিয়ে নিতে পারবে না কেউ।

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, আবার স্বাভাবিক হবে সব। ফিরে পাব আগেকার ডুব। কোনো-না-কোনো মুহূর্তে, কারো কবিতা পড়ে আফশোস জন্মাবে আবার। মনে হবে, যদি লিখতে পারতাম এমনটি। বেঁচে থাকা সেই অতৃপ্তি উপভোগের জন্যেই। জীবন— কবিতা— এক-একটা হাতছানির নাম। সমুদ্রের বুকে বাড়তে থাকা ঘূর্ণিঝড়ের মতো। ডাঙায় আছড়ে পড়বে, ধ্বংসও আনবে; তবু না-পড়া অবধি, শান্তি নেই, শান্তি নেই তার…