Categories
2021-June-Swaron

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

চলচ্চিত্র সম্পর্কিত একটি ব্যক্তিগত গদ্য

ছোটোবেলায় বেলা বালাজের ‘Theory of the Film’-এ একটা লাইন পড়ে বেশ উত্তেজিত হয়েছিলাম Cinema is the tenth muse। বইটি কেউ পড়তে নিয়ে দীর্ঘকাল বাদে ফেরত দিয়ে যাবার পর সেদিন নাড়াচাড়া করে দেখলাম। ওই লাইনটির তলায় সেই দাগ আজও আছে।

বাসে যেতে যেতে এদিক ওদিক তাকালাম। একটা বিজ্ঞাপন এখনও চোখে পড়ল। ইংরেজিতে। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘প্রেম করে যাও, বাচ্চা উৎপাদন কোরো না’। চোখে পড়ল ‘ফুলশয্যা’ ‘এক যে ছিল দেশ’ ‘জাল সন্ন্যাসী’। সন্ন্যাসীর হাতে ছুরি। বাংলা ছবি। হুড়মুড় করে নামল বৃষ্টি। ঝপ ঝপ বাসের ভেতর জানলা বন্ধ হতে লাগল। জলে ধুয়ে যাওয়া কাচের ওপারে দেখলাম বৃষ্টির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে তৃপ্ত ও সুখী, বাংলা ছবির দর্শক ও তাদের মা মাসি বউ বোনেরা। মনে পড়ল, আমি একটা বড়ো ছবি করার কথা ভাবছি। জানলা তুলে দেখলাম। বাসের ভেতর দেখলাম। ভয়ে শিউরে উঠলাম। একটি মুখও মনে হল না আমার ছবির দর্শকের। দেখলাম, ফাঁকা চেয়ারের সার, কাউন্টারে হাই তোলা টিকিটবাবু। মাছি। কিলবিল করতে করতে চলা উদাসীন, ভ্রূক্ষেপহীন মানুষ-মানুষি।

এই দুঃস্বপ্নের ছবি দেখেন প্রায় প্রত্যেকেই। যাঁরা ছবি করতে চাইছেন নিজের মতন করে, যাঁরা নিজেদের ভাবনা-চিন্তা-বিশ্বাসের কাছাকাছি থাকতে চাইছেন, যাঁরা নিরুপায় ও চমৎকৃত এক ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই স্বপ্নতন্তু জাল ছিঁড়ে এই দুঃস্বপ্নেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ে। আর তাঁদের বুকের ভেতর গুটিয়ে রাখা কয়েক লক্ষ ফুট আন-এক্সপোজ্ড ফিল্ম নেগেটিভে যে-সব ছবি ফুটে ওঠে, মাঝরাতে উঠে একা অন্ধকারে জেগে থেকে তাঁদের দেখতে হয় সেইসব। ফাঁকা, বহুদূর চলে যাওয়া রাস্তা, দূর থেকে গরগর শব্দ করে একটা বিন্দুর মতো প্রথমে দেখা দিয়ে সামনে দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে একটা মোটরসাইকেল। আবার। ফাঁকা রাস্তা বহুদূর পর্যন্ত, গরগর করে ছুটে আসছে এক মোটরসাইকেল। যে চালাচ্ছে সে পাথরের মতো, তার মুখ উলটো দিক করে বসানো আর তার চোখদু-টি অদ্ভুত আয়ত, কেন-না কাচের।

মানুষ বিয়ে করে সুখী হয়। বাচ্চা উৎপাদন করে বা না করে সুখী হয়, রাশ রাশ পদ্য লিখে ফেলে সুখী, হাঁ হয় ও দাঁত খোঁটে ও আবার রাশ রাশ পদ্য লিখে ফেলে, চাকরি করে সুখী হয়, সমালোচনা লিখে সুখী হয়। কেউ ব্রিজ বানায়। সুখী হয়। কেউ আদর্শের জন্য দালাল ও তার ভেড়ুয়াদের দ্বারা কবলিত হয়েও প্রাণ ভিক্ষা করে না— স্বপ্ন দেখে বদলে দেবার লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে। কেউ-বা মরা মাছের চোখ নিয়ে আরও অনেক ভেসে ওঠা মাছের সঙ্গে থেকে গিয়ে দেখে যায় সবকিছু ও সুখী হয়। ফিল্ম ভালোবেসে একজন যা করে তা হল লাফ দিয়ে সে উঠে পড়ে এক তাতানো তাওয়ায়। বা তা হল এক জ্যান্ত ইঁদুর গিলে ফেলার ব্যাপার। একদিন ঘুমাতে যাবার আগে সে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে বিছানায়, তার হাড়ের কুচি ও গুঁড়ো সে স্পষ্ট দেখতে পায় শেষবারের মতো। কিংবা শেষ-ভাজা হয়ে মাথা পর্যন্ত চাদর টেনে দেয় সে নিজেই। দেশ, ভারতবর্ষ।

তবুও প্যাঁচা জাগে। আর জেগে থাকে সে। স্ক্রিপ্টের পাতা উলটে যায়। কাটে, লেখে, কাটে। তারপর একদিন তার বাঁ-দিকে ডান দিকে অশেষ দুর্ভোগ দাঁড় করিয়ে রেখে সে তার জীবনের প্রথম বড়ো ছবির শুটিং-এর দিনটির সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। যতদিনে ছবি শেষ হয়, ততদিনে কবিতা থেকে পাঠক সরে গেছে আরও দূরে, ছবি থেকে দর্শক সরে গিয়ে আরও ভুল ও সংক্রামক এক অপ-ছবির অন্ধকারে জড়ো হয়েছে দলে দলে। সে মর্মাহত হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু খুব গোপনে অন্তত একবার নিজের কাঁধে হাত রেখে সে বলতে পারে যে, যথাসম্ভব কম নুয়ে সে কিছু করতে চেয়েছিল। রাত যায়, একদিন প্যাঁচাও ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকে সে।

সে কী করতে পারত? সে নিশ্চয়ই ঠোঙা ভরা বাদামভাজা নিয়ে বসে থাকতে পারত না কেন-না সে ভালোবেসেছে ছবি তৈরি করার ব্যাপারটাকে। তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের দ্বন্দ্ব সে তুলে ধরতে চেয়েছে এখানেই। তাই ভেঙে পড়া অতল খাদের ভেতর থেকে কালো বেড়ালের হাতছানির ডাকে একেবারে সামনে এগিয়ে গিয়েও সে শেষপর্যন্ত পিছিয়ে আসে। চোয়াল শক্ত করে সে আবার বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে সে জানতে চায় ইয়োরিস ইভেন্‌স-এর ‘The Camera and I’, বইটি আছে? তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি তরুণ চলচ্চিত্রকার ও তাঁদের দর্শকদের ভীষণ কাছের মানুষ ইয়োরিস৷ লেনিন ও মাও-এর দেশের বহু অতুলনীয় তথ্যচিত্রের পরিচালক। একদিন দেখেছিলাম কয়লাখনির শ্রমিকদের দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট নিয়ে তাঁর ছবি ‘বোরিনেজ’— না, নেই, সব, সব ফুরিয়ে গেছে। বিক্রেতা সখেদে জানান। বইটি না পেয়েও সে খুশি হয়ে বেরিয়ে আসে। সে ভাবতে থাকে তাদের, যাদের হাতে হাতে বইটি ঘুরছে। সে কেনে ডটপেন ও কাগজ। ফুটে ওঠে আবার নতুন ছবির দৃশ্য। তার চোখের সামনে না থাকলেও আছে, হয়তো অজস্র নয় তবু কিছু নতুন প্রাণের দর্শক, যাদের জন্য আপাতত কষ্টেসৃষ্টে হলেও সে বাঁচিয়ে রাখবে অন্তত তার ছবি করার ইচ্ছেটাকে। সে লিখতে থাকে। লেন্স ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখাতে থাকে প্রথম দৃশ্য। বহুদূর কালো এক রাস্তা দিয়ে গরগর করে ছুটে আসছে উলটো মাথার সেই মটোর সাইকেল-চালক তার আয়ত কাচের চোখ নিয়ে। একটার পর একটা হলে ঢুকে দৌড়ে চলে যাচ্ছে ওপরে, ভুল ও মিথ্যাকে বিশ্বাস করানোর জন্য সাদা ও রঙিন ছবির ক্যান খুলে গোটানো রিলের প্রথমটুকু হাতে ধরে সে নীচে ফেলে দিচ্ছে সে-সব, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, কেন-না নীচ থেকে একজন আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রথম দৃশ্য শেষ হয়। হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।

আমরা সত্তরের যীশু, ১৯৭৭ (পত্রিকা), স্বপ্ন, সময় ও সিনেমা (গ্রন্থ)

ঋণ: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

Categories
2021-June-Haiku

মো. মুহাইমীন আরিফ

নভোমণ্ডল
দূরবীক্ষণে চোখ
বৃত্তদর্শন

চাঁদে গ্রহণ
জোয়ারে উপচানো
জলপেয়ালা

সমুদ্রজল
সৈকতে লাবণিক
লবণস্তূপ

চন্দ্রালোকিত
জলের আয়নায়
কে চাঁদমুখ

মুখে আহার্য
পিপীলিকার দল
শীত আসন্ন

বরফরোদ
প্রতিবিম্বিত সূর্য
ডিমকুসুম

পাহাড়শীর্ষে
গলাধঃপ্রক্রিয়ায়
গোধূলি সূর্য

পশ্চিমা বায়ু
পুবে পাতার স্তূপ
ভঙ্গুর বৃক্ষ

শ্রাবণবিন্দু
দিঘির ক্যানভাসে
জ্যামিতি বৃত্ত

১০

মাছের ঝাঁক
বক জেলের কানে
জলের গান

Categories
2021-June-Translation অনুবাদ

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

ভাষান্তর: অগ্নি রায়

লাতিন আমেরিকার নিঃসঙ্গতা

ফ্লোরেন্সের নাবিক আন্তোনিও পিগাফেত্তা, বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন ম্যাগেলানকে সঙ্গে নিয়ে। আমেরিকার দক্ষিণ ভাগের যাত্রার সেই বিবরণ তিনি লিখে রেখে গিয়েছেন। সেই ভ্রমণকথা একদিকে যেমন খুঁটিনাটি তথ্যে ভরা, অন্য দিকে কল্প-অভিযানের মতোই মুচমুচে তার স্বাদ। ওই বিবরণে তিনি লিখেছেন এক বিচিত্রদর্শন বরাহের কাহিনি! যার নাভি নাকি ছিল পশ্চাদদেশে! লিখেছেন নখহীন পাখি, জিভহীন পেলিক্যানদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের কথা। এক আশ্চর্জন্তুর কথাও বলা হচ্ছে, যার মাথা এবং কান খচ্চরের মতন, ধড়টা উটের, পাগুলো হরিণের! পাটাগোনিয়ায় এক আদিবাসীর সঙ্গে সংঘাতের বিবরণ রয়েছে ওই দলিলে। শুধুমাত্র একটা আয়না সামনে ধরে যার আক্রমণ রুখে দেওয়া গিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে জ্ঞান হারায় সেই দানবের মতো চেহারার আদিবাসী সর্দার।

ওই সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার বইটিতে এক আধুনিক উপন্যাসের বীজ সুপ্ত। সেই সময়ের সংগ্রামী বাস্তবের সে এক দলিলও বটে। আমাদের কাছে যা মায়ারাজ্য, সেই এল ডোরাডোর কথাও রয়েছে তাঁর বইতে। ওই এল ডোরাডো, মানচিত্রে বার বার নিজের জায়গা পালটেছে সমসাময়িক ভৌগলিকদের আন্দাজ ও কল্পনার সঙ্গে তাল রেখে। উত্তর মেক্সিকোয় আট বছর বিফল মনোরথ এক অভিযান চালিয়েছিলেন আলভার নুনেজ কাবেজা ডি ভাকা। তাঁর ছ-শো সঙ্গীর মধ্যে মাত্র পাঁচজন প্রাণ হাতে ফিরতে পেরেছিলেন। ওই সময়কালীন বহু রহস্যময় কল্পকাহিনির মধ্যে একটি সেই প্রখ্যাত এগারো হাজার খচ্চরের গপ্পো।

স্প্যানিশ আধিপত্য থেকে আমরা আজ মুক্ত হয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেই উন্মাদ মনোজগৎ থেকে কত দূরেই-বা যেতে পেরেছি! মেক্সিকোর স্বৈরতন্ত্রী নায়ক জেনারেল আন্তোনিও লেপেজ ড সান্তা জাঁকজমক করে তাঁর ডান পায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিলেন! সে-সময়কার প্যাস্ট্রির যুদ্ধে যা খোওয়া গিয়েছিল। টানা ষোলো বছর ইকুয়েডরের শাসক ছিলেন জেনারেল গ্যার্বিয়াল গার্সিয়া মোরেনা। তিনি ঘুম থেকে ওঠার সময় তাঁর চারপাশের প্রেসিডেন্সিয়াল চেয়ারগুলোতে শবদেহ বসানো থাকত ইউনিফর্ম এবং মেডেল-সহ।

চিলি নিবাসী পাবলো নেরুদা, যিনি আমাদের সময়ের এক অনন্য কবি, এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর শব্দমায়ায় শ্রোতাদের প্রণোদিত করে গিয়েছেন এগারো বছর আগে। সেই থেকে ইউরোপের মানুষ আরও বেশি করে শিহরিত হচ্ছে লাতিন আমেরিকার অলৌকিক স্পন্দনে। এখানকার নারী ইতিহাসসিদ্ধা এবং তাড়া খাওয়ায় অভ্যস্ত পুরুষের মাথা না ঝোঁকানোর স্পর্ধা আজ কিংবদন্তীতে পরিণত। ক্ষণিক বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশও ছিল না আমাদের। একবার এক অসমসাহসী প্রেসিডেন্ট জ্বলন্ত প্রাসাদে আটকে পড়েও একলা বিপক্ষ সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান, যতক্ষণ তাঁর প্রাণ ছিল। দু-টি রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ যার কূলকিনারা করা আজও সম্ভব হয়নি। ওই দুর্ঘটনায় মারা যান এক মহাত্মা প্রেসিডেন্ট এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য লড়াই করা এক সেনাও। এর পর পাঁচ পাঁচটি যুদ্ধ, সতেরোটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর উঠে আসে এক নিষ্ঠুর নির্দয় স্বৈরতন্ত্রী, যে প্রথমবারের মতো আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় জাতিদাঙ্গা ও গণহত্যার বীজ। বিশ লক্ষ শিশুর মৃত্যু ঘটে। আর্জেন্টিনার কারাগারে বলপূর্বক কয়েদ করা হয় গর্ভবতী মহিলাদের। সেখানে ভূমিষ্ঠ হয় সন্তানেরা। সামরিক শাসকের নির্দেশে তাদের পাঠানো হয় অনাথাশ্রমে। কাউকে কাউকে দত্তকও নেওয়া হয়। নির্যাতনের প্রকোপে স্রেফ মুছে যান দু-লাখ মানুষ। তাঁদের অপরাধ ছিল একটাই— তাঁরা সমাজ বদল করতে চেয়েছিলেন। এইসবের জেরে লাতিন আমেরিকার তিনটি ছোটো এবং বর্ণময় রাষ্ট্র নিকারাগুয়া, এল সালভাদোর এবং গোয়াতেমালা থেকেই উদ্বাস্তু হতে হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ।

আতিথ্যের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে যে-রাষ্ট্রের, সেই চিলি থেকে পালিয়ে গিয়েছেন দশ লাখ মানুষ। দেশের মোট জনসংখ্যার যা প্রায দশ শতাংশ। মহাদেশের সবচেয়ে সভ্য দেশ হিসাবে যার খ্যাতি সেই পঁচিশ লাখ মানুষের ছোট্ট দেশ উরুগুয়ে। সেখানেও প্রতি পাঁচ নাগরিকের মধ্যে একজনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি নির্বাসিত! ১৯৭৯ সালের পর থেকে এল সালভাদোর-এর গৃহযুদ্ধে উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছেন প্রতি কুড়ি মিনিটে একজন। লাতিন আমেরিকার এই বিপুল সংখ্যক নির্বাসিত ও উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে একত্র করলে তা হয়তো নরওয়ের জনসংখ্যার চেয়ে বেশিই হবে।

আজ এটা আমি ভেবে নিতেই পারি শুধুমাত্র সাহিত্যগুণের জন্য নয়, এখানকার বাস্তবতার বেঢপ সাইজ সুইডিশ আকাদেমির নজর কেড়েছে। এই বাস্তব শুধুমাত্র কাগুজে নয়। এই বাস্তবতা আমাদের ভিতরে লালিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যহের অসংখ্য মৃত্যু দিয়ে যা তৈরি। কখনোই তৃপ্ত না হওয়া সৃজনের আঁচকে যা লালন করেছে। বিষাদ এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত, ভবঘুরে এবং স্মৃতিমেদুর কলম্বিয়ার নাগরিককে মনোনয়ন করা হয়েছে নেহাতই ভাগ্যক্রমে। যেখানকার কবি এবং ভিক্ষুক, সংগীতকার এবং সন্ন্যাসী, সেনা এবং বাউণ্ডুলে— সকলেই এবং প্রত্যেকেই এখানকার এক অন্য বাস্তবের কুশিলব। আমাদের জীবনকে সব্বার বোধগম্য করে তোলার মতো প্রথামাফিক মালমশলার বড়োই অভাব আসলে। বন্ধুগণ সেটাই আমাদের নিঃসঙ্গতার মোদ্দা কথা।

আমাদের সংকটের ইটপাথরগুলোই আমাদের ঘিরে দেওয়াল রচনা করেছে। পৃথিবীর এই অংশের মানুষ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চশমা পরে উপায় খুঁজে পান না, আমাদের বুঝে ওঠার। খুবই স্বাভাবিক যে, তাঁরা নিজেদের যে-বাটখারায় বিচার করেন, সেই একই বাটখারা ব্যবহার করেন আমাদের মাপতেও। সব সংঘাত যে এক নয়, সেটা তাঁরা বিস্মৃত হন। আমাদের নিজস্ব শিকড়ের সন্ধানের যাত্রা যতটা রক্তাক্ত এবং এবং ঝঞ্ঝাময়, তা ওদের থেকে কিছু কম নয়। কিন্তু আমাদের নিজস্ব নয়, এমনই কোনো নকশায় আমাদের জীবনকে ধরতে চাওয়ার সেই চেষ্টা, আমাদের ক্রমশ আরও নির্জন, আরও অজ্ঞাত এবং পরাধীন করে তোলে। বরং ইউরোপ যদি তাদের নিজের অতীত ছেনে আমাদের বুঝতে চেষ্টা করে তাহলে তা অনেকটাই যাথার্থ পাবে। লন্ডন শহরের প্রথম দেওয়ালটি তৈরি হতে সময় লেগেছিল তিনশো বছর। আরও তিনশো বছর চলে যায় শহরের প্রথম বিশপকে বেছে নিতে।

তিপান্ন বছর আগে এই মঞ্চেই টমাস মান তাঁর লেখা উপন্যাস টোনিও ক্রোগার থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আশা জাগিয়েছিলেন, সংযমী উত্তর একদিন আবেগময় দক্ষিণের সঙ্গে করমর্দন করবে। এই তত্ত্বে আমার আস্থা ছিল না। কিন্তু এটাও বিশ্বাস করি যে, ইউরোপে যে-সব মানুষের দৃষ্ট স্বচ্ছ আজও তাঁদের লাগাতার উদ্যোগ, আমাদের সাহায্য করতে সক্ষম। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁদের দেখার চোখ বদলাতে হবে। শুধুমাত্র আমাদের স্বপ্নের প্রতি তাঁদের মমতা থাকলেই যে, আমাদের নিঃসঙ্গতা ধুয়ে যাবে, ব্যাপারটা তো এমন নয়। বিশ্বের বন্টনে সমস্ত মানুষের জীবন যাপন করার যে-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তাকে যদি হাতে কলমে সাহায্য না করা হয়, তাহলে কোনো বদল আসবে না।

নিজস্ব ধ্যানধারণাকে গচ্ছিত রেখে লাতিন আমেরিকা কারো দাবার বোড়ে হয়ে থাকতে চায়নি। এমনটা চাওয়ার কোনো কারণও নেই। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় তার অভিযান এবং মৌলিক বোধ পশ্চিমের চাওয়া পাওয়ার ছকে পর্যবসিত এটা ভাবা মূর্খামি। নৌ পরিবহনের সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার ভৌগলিক দূরত্ব কম হয়েছে এটা ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব কিন্তু ক্রমশ বেড়েই গিয়েছে। সাহিত্যে ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিকত্বকে সহজেই স্বীকৃতি দিয়েও, সমাজ বদলের প্রশ্নে আমাদের কঠিন প্রয়াসকে কেন গ্রাহ্য করা হবে না। নিজেদের দেশগুলির সামাজিক ন্যায় প্রবর্তনের যে-লক্ষ্য রয়েছে প্রগতিশীল ইউরোপিয়ানদের, তা কেন লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রেও প্রবর্তিত হবে না। সেই লক্ষ্য পূরণের কৌশল ভিন্ন হতে পারে, কারণ, পরিবেশ ভিন্ন। আমাদের ইতিহাসের অপরিমেয় হিংসা এবং বেদনার কারণ হল যুগবাহিত অসাম্য এবং তিক্ততা, যা এখনও বজায় রয়েছে। আমাদের ঘর থেকে তিন হাজার মাইল দূরের কোনো ষড়যন্ত্রকের ফলশ্রুতি নয় তা। ইউরোপের বহু নেতা এবং চিন্তাবিদ কিন্তু এমন ভুলটাই করেছেন। নিজেদের যৌবনের সক্রিয় আন্দোলনকে ভুলে মেরে দিয়ে এইসব বৃদ্ধেরা বালখিল্যের মতো ভেবেছেন, বিশ্বের দুই মহাশক্তির দয়ার হাতে নিজেদের ছেড়ে দেওয়ার বাইরে কোনো কিছু করার নেই। প্রিয়বরেষু, এটাই আমাদের নিঃসঙ্গতার মূল কথা।

এ-সব সত্ত্বে নিপীড়ন, লুঠপাট এবং একঘরে করে দেওয়ার সতত চেষ্টার মধ্যেও আমরা জীবনের ডাকে বার বার সাড়া দিয়েছি. বন্যা অথবা প্লেগ, দুর্ভিক্ষ অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, এমনকী শতকের পর শতক ধরে চলা যুদ্ধ ব্যর্থ হয়েছে মৃত্যুর কাছে জীবনকে হারিয়ে দিতে। প্রতি বছর মৃত্যুর তুলনায় থেকে জন্মের সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি বেশি। জন্মের হার দরিদ্র দেশগুলিতেই বেশি, লাতিন আমেরিকার দেশগুলিও যার মধ্যে পড়ে। অন্য দিকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলি এমন ধ্বংসাত্মক শক্তি করায়ত্ত করতে পেরেছে যা গোটা বিশ্বের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য, আগের তুলনায় একশোগুণ শক্তিশালীই শুধু নয়, এই গ্রহের সমস্ত জীবিত সত্তাকে নিকেশ করে দেওয়ার জন্য তা আগের তুলনায় অধিক ক্ষমতা নিয়ে হাজির।

আজকের মতনই একটি দিনে আমার শিক্ষক উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, “মানুষ শেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মানতে রাজি নই।” ছত্রিশ বছর আগে কোনো মহাকায় ট্র্যাজেডিকে তিনি কেন মেনে নিতে চাননি, কেন তা অস্বীকার করেছিলেন, তা যদি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি, কেবলমাত্র তাহলেই আজ এই মঞ্চে দাঁড়ানোর যোগ্যতা আমাতে বর্তাবে। সভ্যতার ইতিহাসে ওই ট্র্যাজেডি আজ বিজ্ঞানের এক সহজ সম্ভাবনা মাত্র। মানবজাতি চিরকাল যাকে কল্পকাহিনি ভেবে এসেছে, আজ সেই অভূতপূর্ব বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে মনে সমান্তরাল এক বিশ্বাস ও কল্পকাহিনি তৈরি করার অধিকারও কিন্তু তৈরি হয়েছে। এখনও দেরি হয়ে যায়নি। সে এক নতুন এবং সর্বগ্রাসী এক ইউটোপিয়া, যা জীবনের কথা বলবে। যেখানে কেউ অন্যের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করবে না। যেখানে ভালোবাসাই একমাত্র সত্য হয়ে উঠবে। আনন্দের দিনরাত বোনা সম্ভব হবে। যে-জাতি একশো বছরের নিঃসঙ্গতার অভিশাপ ভোগ করেছে, তারা শাশ্বতকালের জন্য পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় সুযোগ পাবে।

Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


রূপা সকালে আগে দেওয়াল থেকে তার কৃষ্ণের ফোটোটা নামায়। পেছনে জমা ঝুলকালি পরিষ্কার করে। পরম মমতায় নিজের আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে ছবির ওপর জমা তেলকালির ধূসরতা মুছে দিতে থাকে সে। যেন তার কৃষ্ণের পরশ পায় সে-আদরে। হ্যাঁ, আদরই দেয় রূপা কৃষ্ণকে, তার রাজাকে কত-কত দিন পর। চোখ ভিজে ওঠে তার। ফোটোটা যথাস্থানে ঝুলিয়ে একটা গোড়ের মালা পরিয়ে দেয় ছবিতে। তার ঝাপসা চোখে গোড়ের মালা অতীত আঁকে।

উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়েই যেন! এক সন্ধ্যেবেলা কৃষ্ণ হাজির তাদের বাড়ি।

— কাল সকালে রেডি থাকবে। সকাল দশটা। এই নাও।

একটা সুদৃশ্য, কলকাতার বড়ো দোকানের ব্যাগ তার হাতে ধরিয়ে দেয় কৃষ্ণ।

— শাড়ি আছে। গয়নাও। কাল সকালে রেডি থাকবে। কাল বিয়ে করব আমরা। কালিঘাটে।

রূপা কী বলবে? সে নির্বাক প্রস্তরমূর্তি যেন বা। শুধু বুকের ভেতরটা তিরতির কেঁপে জানান দিচ্ছিল যে, সে বেঁচে আছে, মরেনি। যদিও ভয়, ভালোবাসা, জয়— জীবনের তীব্রতম আকুতিতে সে মরেই যেতে চেয়েছিল সে-সাঁঝে!

ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির নিথর বাবার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলেছিল কৃষ্ণ— এটা রাখুন। সামান্য টাকা। বড়োমেয়ের বিয়ের ঠিক করুন। সব দায় আমার।

কাটা-কাটা স্বরে উচ্চারণ ভাসিয়ে কৃষ্ণ পিছন ফিরেছিল। এমনই কাটা-কাটা কথাতে অভ্যস্ত ছিল সে। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই বলাই তার অভ্যাস। ঘরের চৌকাঠে পা দিয়ে চকিতে মুখ ঘুরিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে কথা ক-টাও—রামুকে দু-দিন পর দেখা করতে বলবেন আমার সঙ্গে। আমার ঠেকে। সকাল আটটায়। সাবান কলে লোক নেবে।

বেরিয়ে যায় কৃষ্ণ আঁধার ঠেলে বস্তির কয়েক জোড়া অদৃশ্য চোখকে পাত্তা না দিয়েই। রাত চিরে বাইক গর্জে উঠেছে ততক্ষণে।

পরের দিন সকালে সাদা প্যান্টের ওপর ঘি-রঙা সিল্কের পাঞ্জাবিতে আর গোড়ের মালায় কী অপূর্বই দেখতে লেগেছিল তার কৃষ্ণকে— যেন স্বয়ং কেষ্ট ঠাকুরটিই!

কালিঘাট মন্দির থেকে ওরা সদলবলে পার্ক স্ট্রিটে বড়ো হোটেলে গিয়েছিল। রূপার জীবনে প্রথম অত বড়ো হোটেলে খাওয়া। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বার বার আড়চোখে দেখেছিল সে তার রাখাল রাজাকে। আনন্দে-আহ্লাদে!

গোড়ের মালায় আর সকালের নবীন রোদে কৃষ্ণের ফোটোটা ঝলমল করে ওঠে। যেন হাসে রূপার দিকে তাকিয়ে। এমনিতে গম্ভীর, চোখজোড়া সদা চঞ্চল, যা আভাস দেয় তার মন কোথাও স্থির না, ডাঙা পাচ্ছে না এমনই ভাসমান— সে গম্ভীর কৃষ্ণ হাসত খুবই কম। তবু রূপার মনে হত একমাত্র তার কাছে এলে যেন দাপুটে লোকটা কোথাও ডাঙা পেত, যা ভরসা, আশ্রয়ই হয়তো। তার মুখে হাসির সজল মায়া জাগৎ রূপার সান্নিধ্যেই যেন। তেমনি তো হেসেছিল সেদিন। যেদিন কৃষ্ণ প্রথম মায়া এঁকেছিল তার মনে, তার পরের দিন কলেজে ফি দিতে গিয়ে দেখে তার সারা বছরের ফি মেটানো হয়ে গেছে। তবে কি সে, সে-ই! সদ্য ফোটা রূপার মনে দোলা ছিল! লজ্জায় মাথা তুলতে পারে নি কলেজের অফিস কাউন্টারে। ক্লার্ক নৃপতিবাবু কি হেসেছিল!

কলেজ ছুটির পরে ফেরার পথে লজ্জায় মুখ নামিয়েই রূপশ্রী হল পার হচ্ছিল সে। কেন-না এই হলের আশেপাশেই তো ওদের আড্ডা। তখন বিকেল মায়া সাজাচ্ছে আকাশে। সে-মায়ায় এক কালো ছায়া ঢেকে নেয় তাকে— কেমন চমক দিলাম!

হে ধরণী দ্বিধা হও— এমনই যেন রূপার ভঙ্গিমা তখন। তবু অপাঙ্গে তার ঝিলিক হেনেছিল এক নিরুচ্চার হাসির উদ্ভাস। সে-উদ্ভাসই যেন আজ এই সকালে ঝিলিক হানে পৌঢ়া রূপার চোখে। ঝাপসা চোখে সহসা সকাল মুছে সাঁঝমায়া! রূপশ্রী হল আলো ঝলমল সুর বোনে— দশ কা বিশ! দশ কা বিশ! হারু হিমসিম খায় খদ্দের সামলাতে!

রূপার সজল চোখে ছায়া ফেলে সে-জলরঙা ছবির মায়ালু পেলবতাও। কৃষ্ণ কথা রেখেছিল। তার দিদির বিয়ের সব খরচ কৃষ্ণই দিয়েছিল। রামু সাবান কলে আজও চাকরি করে। ভালই মাইনে পায়। শুধু তাই-ই নয়, তার পরের বোনের বিয়ে, ছোটোভাইয়ের ল্যাম্প ফ্যাক্টরিতে চাকরি— সব দায়িত্ব যেন কৃষ্ণেরই। অথচ…। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পৌঢা রূপা।! আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। ফলে সকল সজলতা মুছে আলো ঝলমল সে-সন্ধ্যা হারিয়ে যায়। সকালের নবীন সে-রোদ তখন খর। দোকান সাজায় রূপা খদ্দেরর আশায়।

দু-একজন করে খদ্দের আসে। চা চায় তারা, খায়। গুলতানি মারে। বৃদ্ধ কিছু মানুষের আড্ডাখানাও যেন তার এই দোকান। রিটায়ার্ড, ঘরে সময় কাটে না। দোকানে আসে, ঘণ্টাখানেক গল্পগুজব করে। বাঘ মারে, হাতি মারে— বাতের গল্প আর নিজেদের বাতিল জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প। বার দুয়েক চায়ের অর্ডার দেয়। রূপা কিছু বলে না। রূপশ্রী হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তেমন খদ্দের হয় না আর। বাজার এলাকা তো নয়! ওই স্থানীয় লোকজন, পাশের পার্টি অফিসের লোকজন আর পথ চলতি দু-একজন— এই তো তার খদ্দের! বুড়ো লোকগুলো এলে ফাঁকটা অনেকটাই ভরে ওঠে। ভালো লাগে রূপার। ভালো লাগে যখন এমনই কথা ভেসে ওঠে ওদের চায়ের তৃপ্ত চুমুকে মিশে। কাটা। কাটা।

— মানুষ ছিল একটাই সে-সময়! আর নাই।

— হ্যাঁ, রাজা মানুষ। যে কোনো সমস্যায় তার দরবারে একবার হাজির হলেই হল।

ফলে গল্প গজায়, পল্লবিত হয়, মিথের মাহাত্ম্য ডানা মেলে।

— ওই তো সেবার! হালদার পাড়ার পাঁচু রিকশাঅলা, মেয়ের বিয়ের জন্য ধরলে— এমন বিয়ে হল যে তেমন তেমন বড়োলোকও হার মেনে যায়!

— আর দীনু মিস্ত্রির বাগানের ওই অনন্ত গো! জাহাজ কলে কাজ করতে করতে মরে গেল যে। তার বিধবা কৃষ্ণকে ধরতেই এক মাসের মধ্যে চাকরি পাকা তার ছেলের।

— ফতেপুরের শিবু ছেলেটা! ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেল। ভর্তির টাকা দিল তো কৃষ্ণই!

এমনতর গল্পের মাহাত্ম্য দোকানের চিলতে ঘরে মাথার ওপর পাক খায়, খেয়েই যায় ঘুর্ণিয়মান পাখার সঙ্গে! আর সে মাহাত্ম্যে হঠাত্‍ একফালি উড়ো সাদা মেঘ সূর্যকে ঢাকে যেন। সে-সকাল মলিন হয় সহসা। সে-ছায়ায় কথারা গলা নামায়। যেন কৃষ্ণের বিধবা না শোনে। দুঃখ না পায়!

— ও তো মস্তানি করতো ডকে, কারখানার চৌহুদ্দিতে। ওটা ছিল তার রাজপাট।

— পাড়ায় কিন্তু সে কোনোদিন কিছু করেনি। তার জন্য পাড়ায় আমরা শান্তিতেই ছিলাম সে সময়। ফোস করে সমবেত নিঃশ্বাস পড়ে যেন। সে-নিঃশ্বাসের অভিঘাতেই যেন মেঘ ভেসে যায়, সূর্য স্বমহিম হয়।

আর ঠিক সে সময়েই কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ছায়া বিলিয়ে সূর্য ঢোকে। সূর্য মিত্র। নকশাল ছিল নাকি সে! আলজাইমার রুগি। হাত-দুটো সবসময় কাঁপে। তবুও ডান হাতটা তার সর্বদা পকেটে গোঁজা থাকে। বোমা ফেটে ডানহাতের তালুটা নাকি তার নেই। যদিও সে তালুহীন হাত কেউ কোনোদিন দেখেনি। না দেখলেও ওটা সত্যই।

অন্যেরা শশব্যস্ত হয়ে সরে বসে বেঞ্চে জায়গা করে দেয় তাকে। সমীহ করে সবাই তাকে। নাকি মায়া! যেমন রূপার মায়াই হয় জীর্ণ লোকটাকে দেখে! ব্যর্থ বিপ্লব! ব্যর্থ মানুষ। শুধু সমাজ পালটানোর স্বপ্নে যৌবনটাকে পচিয়ে দিয়েছে জেলে! রূপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার কৃষ্ণও তো তাই! না, বিপ্লব সে করেনি। কিন্তু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল সেও তো! যদিও ক্ষমতার রাজনীতি, তবুও যথাসাধ্য গরিবকে সাহায্য তো কৃষ্ণও করত! তবুও কৃষ্ণ খুনি, গুন্ডা, মস্তান! যদিও এলাকার লোকের চোখে কৃষ্ণ কোনোদিন বিকৃত হয়ে কেষ্টা হয়নি। লোকের মুখে কৃষ্ণদা সম্বোধনে সমীহই ছিল। তবুও…।

রূপা জানে সূর্য মানুষটা চিনি ছাড়া লিকার চা খায়। ও চা এগিয়ে দেয় সূর্যের দিকে। টেবিলে নামিয়ে রাখে। সঙ্গে প্লেটে দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুটও।

মাথার ওপর পুরোনো পাখাটা নিশ্চুপ কথার জাল বোনে। সে নিঃশব্দতাকে বাড়িয়ে সূর্য ম্লান হাসি হাসে মুখ তুলে। ফলে নৈঃশব্দ্য জমাট বাঁধে আরও।

অগত্যা রূপই এগিয়ে আসে সে জেকে বসা নৈঃশব্দ্য তাকে ভাঙতে অন্য দিনের মতোই।

— সূর্যদা শরীর এখন ভাল তো?

— ওই চলে যাচ্ছে বোন। কাঁপা কাঁপা গলা এ-উচ্চারণও বোনে,— তোমরা সব ভাল তো!

— হ্যাঁ, দাদা চলে যাচ্ছে, চালাতে তো হয়ই!

কথা পড়তে পায় না আর। একজন লুফে নেয় কথাখানা।

— এই-ই হল আসল কথা! দিন চলে যায়, চালাতে হয়।

ফলে কথার টানে কথা বাড়ে।— সত্যি কী দিন ছিল বলো তো তখন?

— এই যে সূর্য বিপ্লব করেছিল ধান্দার জন্য? না, সমাজের ভালোর জন্যই তো!

— আমাদের কৃষ্ণর কথাই ধরো না কেন? গরিবের কত উপকার করেছে ও।

— আর এখন? রাজনীতি মানে ধান্দা, নিজের আখের গোছানো শুধু! গাড়ি-বাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালান্স-প্রমোটিং! ছিঃ ছিঃ! সমাজটা উচ্ছন্নে গেল একেবারে।

কথারা এমনই জাগে ঘরময়। পাখার হাওয়ায় লাট খায়। রূপার কানে গুঞ্জন তোলে। কিন্তু কিছুই সে শোনে না। তার মন অন্য ভাবনা বোনে। কী পেল ওরা? কৃষ্ণ-সূর্য! কৃষ্ণ তো নেই-ই আর। সূর্য থেকেও নেই। জেল ফেরত লোকটা রাজনীতির রা আর কাড়ে নি। সব স্বপ্নকে হারিয়ে মৃত মানুষই যেন সে। জেল তার সকল জীবনীশক্তিকে নিংড়ে ছিবড়ে করে দিয়েছিল। অথচ সে আগুনে সময়ে সূর্য যেন জ্বলন্ত সূর্যই, মধ্যাহ্নের। তার বিভায় মেয়েরা পাগল ছিল। তার পরে সূর্যগ্রহণ কালে সে আলো জেলের অন্ধকারে হারিয়ে গেলে, মুছে গিয়েছিল সকল জীবন্ত গান। শুধু জেগেছিল মনীষা। প্রতীক্ষায় ছিল তার সূর্যের গ্রহণমুক্তির। গ্রহণ কেটে গেলে সে সূর্যকে বরণ করে নিয়েছিল। অতদিন পরও। ততদিনে মনীষা সরকারি চাকুরে। এলাকার পাঁচজনে ধন্য ধন্য করেছিল এ প্রেমের শুভ পরিণতিতে। তারপরেও কিন্তু থেকেছিল। মনীষা জ্বলন্ত সূর্যকেই ভালবেসেছিল বোধহয়! গ্রহণলাগা এ সূর্য হয়তো আকাঙ্ক্ষিত ছিল না তার! ফলে প্রেম উবে গিয়েছিল কবছরেই, শুধু দাম্পত্যের অভ্যাসটুকুই টিকেছিল— করুণায়, দয়ায়। যা টিঁকে আছে আজও পরগাছার মতো। মনীষা তো জেনেবুঝে ভালবেসেই গ্রহণ করেছিল লোকটাকে। সরকারি চাকরি। যা মাইনে পায় তাতে তো স্বচ্ছলতা উপচে পড়ার কথা সংসারে। যেমন পুরুষ মানুষরা একার আয়েই তো স্বচ্ছল! তবে কি বিদুষী, বিপ্লবী মনীষার মনেও পুরুষতান্ত্রিকতার থাবা! রূপা ভাবে। মনীষা কি অন্য কিছু আশা করেছিল মানুষটার কাছে! বড়ো নেতা হবে? মন্ত্রী হবে? কে জানে? ভাবনারা পাক খায় দোকানের আলো আঁধারিতে, টাল খায় পাখার একঘেয়ে ঘুরে চলায়।

রূপাও কি কিছু চেয়েছিল তার কৃষ্ণের কাছে? নিভন্ত মন কোনো সংকেত আঁকে না। সামান্য নারী সে শুধু চেয়েছিল তার মানুষটা ঠাকুর-ঠাকুর করে বেঁচে থাকে যেন। কিন্তু…! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা গোপনে। পাখার হাওয়া ভারী হয়ে ওঠে। পরগাছা জীবন, তবুও সূর্য মানুষটা তো বেঁচে আছে! মনীষার হয়ে রূপা মনে মনে আদর দেয় জীর্ণ মানুষটাকে! দেওয়ালে ঝোলানো মানুষটা হাসে যেন— তেমনই মনে হয় রূপার!

ভাবে আর টুকটাক খদ্দের সামলায় রূপা। বেশিরভাগ জনই বাইরে দাঁড়িয়ে চা খায়। চা ফুটে উঠতে থাকে আগুনে। উথলায়। রূপা অভ্যস্ত হাতে হাতা দিয়ে উথলে ওঠা ডেকচির চাকে থিতু করে। কিন্তু তার মন! উথলে ওঠে, উথলে উঠতেই থাকে। খদ্দেরের আনাগোনা ছায়া আঁকে দোকানের আবছায়া পরিসরে। কথারা জেগে ওঠে, ভাসে। অভ্যাস্ত হাত তার মনহীন যন্ত্রের মসৃণতায় যেন খদ্দের সামলায়। মন তার ভেসে চলে যায় সেই সত্তরে! মনে মনে হাসে রূপা! রোগা-প্যাংলা লোকটা, দোখনের কোনো এক গ্রামে, কাঁধে রাইফেল মাঠের আল ভেঙে রাত চিরে হাঁটছে! দৃশ্যটা মনে হতেই মনের হাসি অজান্তেই রূপার ঠোঁটে আশ্রয় পায়। সচেতন রূপা সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলে তা। খুবই সরল সাধসিধে সূর্যদা! এই লোকটা বিপ্লবী! মানুষ খুন করেছে? করতে পারে অমন নরম লোকটা! অথচ রটনা তো তেমনই!

যেমন রটনা এও যে কৃষ্ণ নাকি খুনি! খুন করে কত লাশ নাকি শান্তিনগরের হোগলাবনে, ব্রূকলিন, সিকলেনের ঝিলে গুম করে দিয়েছে! ওরা নাকি সব ছিল তার বিরোধি দলের গুণ্ডা! কৃষ্ণের বিরোধি, নাকি পার্টির বিরোধি! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা। মাথার ওপর পুরোনো পাখাটা একঘেয়ে একটানা ঘুরেই চলে গরম হাওয়ার ঘূর্ণি তুলে। ঘূর্ণি ওঠে রূপার মনেও। কিন্তু কে খুন হল, কার লাশ গায়েব হল কেউ জানে না তা! পুলিশও কোনো রা কাড়েনি। তবুও রটনা— কৃষ্ণ খুনি! পার্টির প্রশ্রয়ে খুন হওয়া মানুষগুলো সমাজ-সংসার থেকে মুছে যায়। পুলিশের ডায়েরি থেকে যায় সফেদ-সাদা!

রূপার ভাবনা টাল খায়, কেন-না টলতে টলতে সূর্য কাঁপা হাতে পকেট থেকে টাকা বার করে কাউন্টারে রাখে। তারপর দোকানের আলো-আঁধারিকে দুলিয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যায় বিপ্লবী সূর্য। রূপা তাকিয়ে থাকে টলায়মান সে-অতীতের ছায়ার দিকে। তাকিয়েই থাকে, কিন্তু চোখ তার ছবি আঁকে না, সেখানে তখন অন্য আলো-আঁধারির ছায়া— খুনি সূর্য বিপ্লবী! আর তার কৃষ্ণ গুণ্ডা! মস্তান! খুনি!

রূপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আবারও। রাস্তায় গরম হাওয়া বয়। সে-হাওয়ায় প্লাস্টিকের বাতিল এক প্যাকেট উড়তে উড়তে ঠেক খায় রূপার দোকানের চৌকাঠে।

প্রথম পর্ব

Categories
অন্যান্য

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

চতুর্থ অধ্যায়
পক্ষকাল শেষে শোভাযাত্রার অবসান হতেই শেং শাও নামক দলটি শি পিনের দিকে রওনা দিল। সঙ্গী হল ওইগার প্রদেশের এক বৌদ্ধ শিষ্য। পঁচিশ দিনের অবিরাম পথ চলা শেষে ফা-হিয়েন ও তাঁর অন্য সাথীরা এসে পৌঁছোলেন জু হো প্রদেশে। এ-দেশের রাজা বৌদ্ধধর্মের উপাসক। সহস্রাধিক সন্ন্যাসী আছেন এখানে আর সকলেই মহাযান ধর্মাবলম্বী। দিন পনেরো বিশ্রাম অন্তে আবার যাত্রা। দক্ষিণ দিক লক্ষ করে চার দিন পথ চলা শেষে দলটি এসে পড়ল পলান্ডু পরিসরে। এবার আবার এক নতুন দেশ ইউ হি। আবার দিন কয়েকের বিরতি। এবারের যাত্রা হবে দীর্ঘ, বিরামহীন। একটানা পঁচিশ দিন ভ্রমণ শেষে এবার এসে পৌঁছোনো গেল চি চাহ প্রদেশে। হুই চিং আর অন্য সাথীদের সঙ্গে এসে পুনরায় মিলিত হলেন তাঁরা।

পঞ্চম অধ্যায়
দেশের রাজা পঞ্চ শীল ধারণ করেছেন। এ হল পাঁচ বছরের মহাসমাবেশ। সব শ্রমণদের রাজা আমন্ত্রণ জানান এই সমাবেশে। আর বিপুল সংখ্যায় তাঁরা যোগও দেন। তাঁদের বসার আসনগুলি পূর্ব হতেই সুসজ্জিত করে রাখা হত, ছোটো ছোটো পতাকা আর স্বর্ণ রৌপ্যের সুতায় পদ্মফুলের নকশা করা শামিয়ানা দিয়ে। আসনের পিছন দিকে একেবারে নিদাগ, ঝলমলে ঝালর দিয়ে সাজানো হত। রাজা তার সব মন্ত্রী অমাত্যদের নিয়ে যাবতীয় আচার মেনে পূজার অর্ঘ্য দিতেন। এক, দুই কখনো-বা তিন মাস পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান পর্ব চলত এবং সাধারণত বসন্তকালেই বসত আসর। রাজার সভা শেষ হলে তিনি অমাত্যদের আহ্বান জানাতেন। এবার তাঁদের পূজার অর্ঘ্যদানের পালা। এই পর্বটি চলত দু-তিন, কখনো পাঁচ দিন ধরে। সকল নৈবেদ্য সারা হলে, এইবার রাজার আদেশমতো তাঁর মন্ত্রী, অমাত্যদের নিজস্ব ঘোড়ার সমকক্ষ কিছু ঘোড়ায় লাগাম, জিন পরিয়ে সাজানো হল। আনা হল অতি শুভ্র বস্ত্র, সকল প্রকারের রত্ন সম্ভার, শ্রমণদের যেমনটি প্রয়োজন। রাজা তাঁর অমাত্যবর্গ-সহ শপথ নিয়ে এ-সব সামগ্রী শ্রমণদের দান করলেন। এভাবে সন্ন্যাসীদের থেকে ভিক্ষা সামগ্রীর মাধ্যমে মুক্ত হল শ্রমণগণ। দেশটি তো পর্বতসংকুল এবং যথারীতি শীতল। গম ছাড়া আর কোনো শষ্য জন্মায় না। শ্রমণগণ তাঁদের প্রাপ্ত সামগ্রী গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ হয়ে এল মেঘলা, ফলস্বরূপ হিমশীতল হল সকাল। এই জন্যেই এ-দেশের রাজা প্রতিনিয়ত সন্ন্যাসীদের কাছে প্রার্থনা করে গেছেন যাতে তাঁদের প্রস্থানের পূর্বে খেতের গম পেকে ওঠে। বুদ্ধের ব্যবহৃত একটি পিকদানি আছে এ-দেশে। তাঁর ভিক্ষাপাত্রের মতো এটিও একই রঙের পাথরে তৈরি। আর আছে বুদ্ধের একখানি দাঁত। এবং এই দাঁতের সম্মানে এ-দেশের মানুষ তৈরি করেছে একটি প্যাগোডা। সহস্রাধিক সন্ন্যাসী আছেন এই স্থানে, তাঁরা প্রত্যেকেই হীনযান মতাবলম্বী। যত পুবে পর্বত ঘেরা স্থানে যাওয়া যায়, সেখানে মানুষ চীনাদের মতোই মোটা, খসখসে পোশাক পরে, যদিও তাদের পশম আর গরম বস্ত্রের ব্যবহার ভিন্ন। শ্রমণদের আচার অনুষ্ঠানও এখানে বিচিত্র আর অগণিত। এই দেশটি যেন পামীর, হিন্দুকুশের কোলে শিশুর ন্যায় রয়ে গেছে। আর এখান থেকে গাছপালা, ফুল, ফলের চরিত্রও যায় বদলে। চীনের সাথে মিল পাওয়া যায় কেবল বাঁশ, পেয়ারা আর আখ গাছের।

ষষ্ঠ অধ্যায়
এই স্থান থেকে পশ্চিমে এগোও, মিলবে ভারতবর্ষের উত্তর খণ্ড। পথ মধ্যে হিন্দুকুশ, পামীরের বিস্তার। বুনো পেঁয়াজের ভারী ফলন এ-অঞ্চলে। এক মাস যাবৎ যাত্রা শেষে সফল হলেন তীর্থযাত্রী দল। পার করলেন এই ‘পেঁয়াজ পরিসর’। বরফের এই দেশে শীত গ্রীষ্মে ভেদ নাই কোনো। আর আছে বিষধর ড্রাগন। সামান্য প্ররোচনায় ঢেলে দেয় বিষময় বাতাস, বৃষ্টি, তুষার, বালি ঝড় বা পাথর। এমন বিপদের মুখে দশ হাজারে একজন পালাতে পারে না, এমনই ভয়ংকর। এ-দেশের মানুষকে ‘তুষার শৃঙ্গের মানব’ নাম দেওয়া চলে অবলীলায়। এ-সকল পর্বত পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছোলেন উত্তর ভারত। একেবারে সীমান্তে তো লি জাতির মানুষের বসতি। এঁদের মধ্যে শ্রমণেরা আছেন। প্রত্যেকেই হীনযান মতাবলম্বী।

বুদ্ধের ছিল আঠারো জন ব্যক্তিগত শিষ্য। আর জানা যায় যে, তাঁদেরই একজন নিষ্ক্রমণ শক্তি দ্বারা এক কুশলী শিল্পীকে স্বর্গরাজ্যে নিয়ে যান, সেখানে মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব মূর্তির (চীনের মন্দিরে হাস্যরত ঈশ্বরের বিগ্রহ) দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বর্ণ ও বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল, যাতে ফিরে এসে তাঁকে দিয়ে কাঠের উপর নিজের একখানি মূর্তি উৎকীর্ণ করানো যায়। এই পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে সর্বমোট তিনবার স্বর্গলোক যাত্রা করেন। অবশেষে সম্পূর্ণ করলেন আশি ফুট উচ্চতার বিশালাকায় একটি কাঠের মূর্তি, যার চরণ দু-খানিই ছিল আট ফুট লম্বা। ব্রত, উপবাসের দিনগুলোতে উজ্জ্বল দীপ্তিতে ঝলমল করে উঠত এই মূর্তি। এইখানে পূজার অর্ঘ্য দেবার জন্য এ-প্রদেশের রাজাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত।

সপ্তম অধ্যায়
পর্বতের ইশারায় এগিয়ে যাও দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত ধরে,পাবে কঠোর, দুর্গম, অতি ভয়ংকর এক পথ। পনেরো দিন এই পথে একটানা চললেন যাত্রীদল। পাথর প্রাচীরের মতো নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে এক-একটি পর্বত। মোটামুটি একহাজার জেন তাদের উচ্চতা। দৈবাৎ প্রান্তে এসে পড়লে চোখের দৃষ্টি হয় বিহ্বল। দুর্মর সাধ জাগে এগিয়ে যাই সামনে, আর সত্যিই যদি সাড়া দাও সে-ইশারায়, হারিয়ে ফেলবে মাটি, হারিয়ে ফেলবে শূন্য। নীচে স্রোতস্বিনী সিন-তন। প্রাচীন সময়ের মানুষেরা পাথর কেটে পথ তৈরি করেছিল। পর্বতপ্রান্ত ধরে সাতশো ধাপের একটি সোপান। সে-সিঁড়ি বেয়ে যদি নীচে নামা যায়, দেখা যাবে নদীর উপরে ঝুলে আছে দড়ির সেতু। নদীর দু-টি তীরের মাঝের দৈর্ঘ্য আশি কদমের কম। চিঙ-ই-র মতে হুন সাম্রাজ্য থেকে আসা ছাং চিন বা কান ইং এই স্থানে পৌঁছোতে পারেনি। সন্ন্যাসীগণ ফা-হিয়েনের কাছে জানতে চাইলেন, পুবের দেশগুলিতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার কোন সময় থেকে শুরু হয়। ফা-হিয়েন বললেন, “যার কাছেই আমি জানতে চেয়েছি সকলেই বলেছে যে, ভারতবর্ষের শ্রমণেরা প্রাচীন রীতি মেনে, মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের মূর্তি স্থাপনের দিন, নদী অতিক্রম করে বৌদ্ধ সূত্রাবলী এবং শৃঙ্খলাগুলি এখানে নিয়ে আসেন”। বুদ্ধের নির্বাণের তিনশ বছর পর এই মূর্তি স্থাপনা হয়। তখন চৌ সাম্রাজ্যের পিং ওয়াং রাজার শাসনকাল। এই সময় থেকেই বুদ্ধের উপদেশাবলি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মহান মৈত্রেয় ছাড়া আর কেউ বুদ্ধের ত্রিকায়া এবং তার উপদেশাবলির এমন সম্যক প্রচার করতে পারেননি। বিদেশিদের কাছে এই ধর্মবিশ্বাস এভাবেই পরিচিতি পায়।

হুন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা মিং টি বৌদ্ধধর্ম প্রচারের স্বপ্ন লালন করেছিলেন। আর ফলস্বরূপ পবিত্র গ্রন্থগুলি ফিরিয়ে আনার জন্য অভিযান শুরু হয়। বুদ্ধের প্রচলিত অনুশাসনগুলির উৎস যে কী, তা মিং টির স্বপ্নের মতো একরকম অমীমাংসিত রহস্যই হয়ে রইল।

প্রথম পর্ব