Categories
2021-July-Translation

হ্যান ক্যাং

“যদি আমি ১০০ % সুস্থ হতাম তাহলে আমি লেখক হতাম না”

ভাষান্তর: শতানীক রায়

আপনার নতুন বইটি আপনার দিদির কাহিনিকে ঘিরে যে জন্মানোর দু-ঘণ্টা পরে মারা যায়। আপনাকে এখন এই কাহিনি লেখার জন্য— কী বাধ্য করল— বা অনুভব করালো?
আমি ভেবেচিন্তে আমার বড়োদিদির সম্পর্কে লিখিনি। আমাকে বড়ো করে তুলেছে আমার বাবা-মা যারা কখনো তাকে ভুলতে পারেনি। আমি যখন ‘হিউম্যান অ্যাক্টস্‌’ লিখছিলাম, সেখানে একটা এক লাইনের সংলাপ ছিল: “মরে যেয়ো না, অনুরোধ করছি মরে যেয়ো না।” সেটা আশ্চর্যভাবে একইরকম আর সেটা আমার ভেতর অনুরণনিত হয়েছে। তখনই আমি আবিষ্কার করি সেটা আমার মায়ের স্মৃতি থেকে প্রভাবিত আমকে সে বলেছিল যে, সে ওই শব্দগুলো ক্রমাগত দিদিকে বলে গেছিল যে আমার জন্মানোর আগেই মারা গেছিল।

আপনি লেখেন যে, কীভাবে আপনি “জন্মেছেন আর বড়ো হয়ে উঠেছেন সেই মৃত্যুস্থানেই”। সেটা আপনার বড়ো হয়ে ওঠাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?
সেটা শুধু বিচ্ছেদের ব্যাপার ছিল না। সেটা ছিল আমাদেরকে কেন্দ্র করে যে, আমরা কত মূল্যবান। বাবা-মা আমার ভাই আর আমাকে বলেছিল: “তোমরা আমাদের কাছে খুব মূল্যবান হয়ে জন্মেছ আর আমরা তোমাদের জন্য অনেককাল ধরে প্রতীক্ষা করেছি।” কিন্তু সেখানে শোকও ছিল। সেটা ছিল শোক আর মূল্যবান জীবনের মিশ্রিত বোধ।

আপনি বইতে স্বীকার করেছেন যে, যদি আপনাদের মায়ের প্রথম দুটো সন্তান মারা না যেত, তাহলে হয়তো আপনি আর আপনার ভাই জন্মাতেন না। এটা আপনাকে কীরকমভাবে ভাবায়?
যখন আমার মা আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিল, সে খুব অসুস্থ ছিল, তাকে অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছিল। যেহেতু সে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সে গর্ভপাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তারপরই সে আমার নড়াচড়া নিজের ভেতর অনুভব করে আর সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে জন্ম দেওয়ার। আমার মনে হয় এই জগৎ পরিবর্তনশীল আর ভাগ্যবশত আমাকে এই জগৎটা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

বইয়ের শুরুর পৃষ্ঠাগুলোতে, আপনি বলছেন যে, আপনি চাইছেন এই বইয়ের লেখার প্রক্রিয়া যেন রূপান্তরকারী হয়, সেটা কি হয়েছে?
হ্যাঁ, এই প্রক্রিয়া আমাকে সত্যি সহযোগিতা করেছে। নিত্যদিন সেটা ছিল একটা ছোটো আচারের মতো: প্রার্থনার মতো। যখন আমি লিখছিলাম, সেটা মনে হচ্ছিল যেন আমি নিত্যদিন কাছে আরও কাছে পৌঁছে যাচ্ছি, দিনের পর দিন, আমাদের ভেতরের সেই জায়গায় যা কখনো ধ্বংস করা যাবে না, যা সৃষ্টিও করা সম্ভব নয় বা নষ্ট করাও যাবে না।

কৈশোরাবস্থায় আপনার একটা নিস্তেজ করা মাইগ্রেন ছিল। সেটা আপনাকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে?
আমার মাইগ্রেনের ব্যথা আমাকে সবসময় মনে করায় যে, আমি একজন মানুষ। কারণ, যখনই মাইগ্রেন শুরু হয়, আমাকে থামিয়ে দিতে হয় আমার কাজ, আমার পড়াশুনো, আমার রোজনামচা, সেটা আমাকে সবসময় আমাকে নম্র করে এসেছে, আমাকে সহযোগিতা করেছে এটা বুঝতে যে, আমি মরণশীল আর দুর্বল। যদি আমি ১০০ % সুস্থ আর প্রবল অনলস হতাম তাহলে হয়তো আমি লেখক হতাম না।

আপনি বলেছেন, ১৪ বছর বয়সেই আপনি জানতেন যে, আপনি লেখক হতে চান। আপনি কীভাবে জানতে পারলেন?
আমি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। আর তখনই, পাঠক হিসেবে, আমি অনুভব করলাম প্রতিটি লেখকই উত্তর খুঁজছেন আর তাঁদের কাছে কোনো উপসংহার নেই, কিন্তু তাঁরা লিখে যাচ্ছেন। সেই অবস্থান থেকে আমি ভাবলাম, কেন আমিও সেটা শুরু করে দিই?

আপনার বাবাও একজন ঔপন্যাসিক। তিনি আপনাকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন?
আমি যে-বাড়িতে বড়ো হয়ে উঠছি সেখানে অনেক বই ছিল— আমার মনে হয় এটা একটা বিশেষ দিক।

আপনার পছন্দের কিছু ছোটোদের বই কী কী ছিল?
আমি অনেক কোরিয়ান লেখকদেরই পছন্দ করতাম আর অনুবাদ বইও, যেমন অ্যাস্ত্রিদ লিনড্রেন-এর ‘দ্য ব্রাদার্স লাইয়োনহার্ট’।

কোন লেখকেরা সবচেয়ে বেশি আপনার লেখনিকে অনুপ্রাণিত করেছে?
কোরিয়ান লেখকদের মধ্যে আমি লিম চুল-উ-এর ছোটোগল্প ভালোবাসি। আর বিদেশি লেখকদের মধ্যে আমি ভালোবাসি দস্তয়েভ্‌স্কিকে।

কোন সাহিত্যিকের সঙ্গে, মৃত বা জীবিত, আপনি সবচেয়ে বেশি ইচ্ছুক দেখা করতে?
আমি লেখকদের সঙ্গে দেখা করতে চাই না: আমি তাঁদের সঙ্গে আগেই দেখা করেছি তাঁদের বইয়ের মাধ্যমে। যদি আমি তাঁদের বই পড়ে থাকি আর কিছু অনুভব করি, সেটাই আমার কাছে খুব মূল্যবান বিষয়। লেখকেরা তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব নিজের বইতেই দিয়ে দেন সেই কারণেই আমার পক্ষে সে-সব বই পড়াই যথেষ্ট।

আপনার উপন্যাস ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’ ইন্টারন্যাশনাল ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করে। সেটা আপনার লেখকজীবনে কীরকম প্রভাব ফ্যালে?
আমি অনেক বেশি পাঠক আর বৃহৎ দর্শকের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু কয়েক মাস পরেই আমি ফিরে যেতে চেয়েছি আমার ব্যক্তিজীবনে, কারণ, একজন লেখকের জন্য সর্বক্ষণ খুব বেশি মনোযোগ ভালো নয়। আবার মনোযোগের তোয়াক্কা না করে এবং ক্রমাগত লিখে যাওয়া, এটা অসম্ভব।

Categories
2021-July-Essay

তোর্সা বোস

নাচনি নাচ

নাচনি নাচ বিষয়টি মূলত ঝুমুর গানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই নাচের ক্ষেত্রে মূলত উপস্থিত মহিলা নৃত্যশিল্পীগণ প্রথমেই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে স্মরণ করে বা এক প্রকার আসর বন্দনা দিয়ে নাচ শুরু করেন। এই নাচের বিষয়বস্তু থাকত মূলত রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ, রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিরহ লীলা ইত্যাদিকে ভিত্তি করে। প্রাচীনকাল থেকে মূলত পুরুলিয়া অঞ্চলের রাজদরবারে বিশেষত কাশিপুর রাজবাড়িতে এই নাচনি নাচের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই নৃত্যে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত মাদল, ঢোল, সানাই, সিংগা, হারমোনিয়াম প্রভৃতি কখনো কখনো এর সঙ্গে বাজানো হত আড়বাঁশি। সেই প্রাচীনকাল থেকেই নাচনিদলে সাধারণত দশ থেকে কুড়ি জন শিল্পী থাকতেন দলের প্রধান পুরুষকে বলা হত রসিক এবং যে-সকল মহিলারা নর্তকী হিসেবে দলে নাচতেন তাঁদেরকেই বলা হত নাচনি।

নাচনি প্রথার উৎপত্তি:

পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চলে নাচনি প্রথার শুরু হয়েছিল মধ্যযুগীয় শিল্পী বরজুরাম দাসের হাত ধরে। ইতিহাসের সূত্র ধরে যদি আমরা নাচনি নাচ কোথা থেকে এসেছে তা জানবার চেষ্টা করি তবে দেখা যায় যে, মূলত উত্তর ভারতের বাইজি নাচের যে-সংস্কৃতি তাকে অনুকরণ করে এই নাচনি প্রথা বাংলায় আসে। তবে এ-কথা প্রথমেই জানিয়ে রাখি নাচনি নাচে, কিন্তু কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা অংশগ্রহণ করতেন না। এতে অংশগ্রহণ করতেন মূলত নীচু সম্প্রদায়ের গরিব ঘরের মেয়েরা। নাচনিদের ইতিহাসে যিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন তিনি ছিলেন শ্রীমতি সিন্ধুবালা দেবী। যদিও উনি কাশীপুরের রাজবাড়িতে নাচনি হিসেবে যে-সমাদর লাভ করেছিলেন তা ওঁর নাগর বা রসিক চেপা মাহাতোর হাত ধরে। যদিও সমাজ এই নাচনিদের শিল্পীদের কখনোই ভালো চোখে দেখত না। কেবলমাত্র রাজ-রাজাদের বা সম্ভ্রান্ত জমিদারদের মনোরঞ্জন করাই ছিল এদের কাজ। নাচনিরা তাদের রসিককে কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকত। শিখত নাচ গান, অর্থাৎ, এই রসিকই ছিলেন এদের জীবনসঙ্গী আবার শিক্ষাগুরু। তবে এইসকল রসিকদের কাছে যে-সব মেয়েরাই নাচনি হিসেবে যোগ দিত তারা অনেকেই ছিল পথভ্রষ্ট। এইসকল নাচনিরা কখনো হয়তো বাবা-মায়ের অর্থকষ্টের কারণে বিক্রি হয়ে গেছে শিশুকালেই কোনো-না-কোনো রসিকের কাছে। জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ কী তা তারা কখনোই দেখেনি রসিকের সাথে এদের জীবন কাটত নানান সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। রসিকরা এদের নাচ গান শিখিয়ে অতি দ্রুত নিজেদের মনের মতন করে গড়ে তুলতেন। নাচনি মেয়েদের কাজ হত গ্রামের রাজা কিংবা জমিদারদের মনোরঞ্জন করা কিন্তু তার বিনিময়ে এরা কখনোই যোগ্য মর্যাদা বা ন্যূনতম সম্মানটুকু পেতেন না। সম্ভ্রান্ত সমাজ এদেরকে মানুষ বলি বলেই গণ্য করতেন না। একসময় কোনো নাচনি মারা গেলে তার দেহ সৎকার পর্যন্ত করা হত না। পায়ে দড়ি বেঁধে ধাঙ্গড় দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে কোনো ভাগাড়ে সেই নাচনির মৃতদেহ ফেলে আসা হত। কী মর্মান্তিক তাদের জীবনের শেষ পরিণতি নাচনিদের জীবনের এই ইতিহাস অনেকটা যেন বাংলার বাউলানি, অর্থাৎ, যারা বাউলদের সঙ্গিনী তাদের সঙ্গে মেলে। যদিও এই বাউলানিরাই বাঁচিয়ে রাখে তাদের বাউলদেরকে কিন্তু শেষ জীবনে তাদেরও অবস্থা হয় এই নাচনিদেরই মতন। বর্তমানকালে একজন উল্লেখযোগ্য এবং স্বনামধন্য নাচনি শিল্পী হলেন শ্রীমতি পস্ত বালা দেবী কর্মকার। ২০১৮ সালে তাঁকে লালন পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। যদিও আজ যে আমরা তাঁকে খ্যাতির জায়গায় বসিয়েছি লালন পুরস্কারে ভূষিত করেছি তা কিন্তু তাঁর জীবনে এত সহজে আসেনি। পস্তবালার জীবনের ইতিহাস ভীষণই করুণ। তাঁর মা বিমলা দেবী ছিলেন একজন নাচনি যিনি তৎকালীন জমিদার বাড়িতে নিযুক্ত ছিলেন। পস্ত বালার ক্ষেত্রে তাঁর মা-ই নিজে তাঁকে এই পথে এগিয়ে দেন। পেটের দায়ে সেই ছোট্ট পস্তবালা নানান লোকের বাড়িতে ঘরের ফাইফরমাশের কাজ, ঝিয়ের কাজ এমনকী ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে একজন অতি বৃদ্ধের সঙ্গে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। স্বভাবতই এই বিয়ে তাঁর ক্ষেত্রে সুখের হয়নি। নানান অত্যাচার সহ্য করে একসময় তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। এর পর তাঁর জীবনে নাচের হাতে খড়ি হয় শ্রদ্ধেয়া সিন্ধু বালা দেবীর কাছে। এর পর তাঁর জীবনে রসিক হয়ে আসেন বিজয় কর্মকার। ভালোবাসার টানে তিনি ঘর বাঁধেন বিজয় কর্মকারের সঙ্গে যদিও বিজয় ছিলেন বিবাহিত এবং কয়েকজন সন্তানের পিতা। পস্ত বালা নিজেই বলেছেন রসিকের বাড়িতে এসো তাঁর কপালে সুখ জোটেনি বরং রসিক তাঁর নিজের পরিবার বাঁচাতে পস্তর উপার্জন করা পয়সা আত্মসাৎ করে নিতেন। এভাবে দিনের পর দিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কাটাতে কাটাতে একসময় শুরু হয়, কিছু শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হাত ধরে এই নাচনিদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলন। অবশেষে ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নাচনিদের স্বীকৃতি দেন তৈরি হয় মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নাচনি উন্নয়ন সমিতি। যেখানে এখন সম্পাদিকা আসনে রয়েছেন পস্ত বালা দেবী। যে-রসিক বিজয় কর্মকারের বাড়িতে একসময় তাঁর জায়গাটুকুও জোটেনি আজ নিজের অধিকারে তিনি সেই জায়গা করে নিয়েছেন। যথেষ্ট সমাদর করা হয় তাঁকে। তাঁর নিজস্ব একটি বাসস্থান হয়েছে। বহু জায়গা থেকে ডাক আসে তাঁর, গ্রামে গ্রামে এমনকী শহরেও তিনি নৃত্য পরিবেশন করতে আসেন। যদিও এত কিছু সত্ত্বেও নাচনিদের নৃত্যের যে-ভঙ্গিমা বা শৈলী তা কিন্তু আজও আমাদের বাবু সমাজ বা তথাকথিত সভ্য মানুষরা ভালো চোখে দেখেন না তবে যেহেতু এটি একটি অতি প্রাচীন লোকসংস্কৃতির বা আদিমতম একটি লোকনৃত্যের অঙ্গ বা অংশ তাই তাঁদের সেই মৌলিকত্বকে খণ্ডন করার বা অস্বীকার করার কোনো অধিকারই আমাদের নেই।

বর্তমানকালের নাচনি এবং তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থান:

পূর্বের সিন্ধু বালা দেবী বা বর্তমানের পস্ত বালার মতো এখন আরও যে-সব নাচনি শিল্পীরা রয়েছেন যেমন বিমলা দেবী, সরস্বতী দেবী এঁদের মতো গুটিকয়েক শিল্পীরাই কিন্তু কেবলমাত্র এখন আর এই পেশার সঙ্গে টিঁকে আছেন। এঁদের পরে জানি না আর কে বা কারা এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, কারণ, কী-ই-বা আছে এঁদের? সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত না আছে এই শিল্পীদের জীবনে কোনোরকম কোনো নিশ্চয়তা, সম্মান, যোগ্য মর্যাদা, যোগ্য মজুরি কিংবা দু-বেলা দু-মুঠোভাতের জোগান। যদিও-বা আগেকার দিনে এইসকল নাচনিদেরকে অন্তত কাজ দিয়ে জমিদারবাড়ি কিংবা রাজদরবারের রাখা হত এখন সেই রাজাও নেই রাজদরবারও নেই ফলে নেই নাচনিদের খোঁজ। এখন এইসব নাচনিদের দেখা পাওয়া যায় পুরুলিয়া এবং তাঁর আশেপাশের অঞ্চলে যে-সকল পালা-পার্বণ বা মেলা হয় তাতে, কিন্তু তা আর কতই-বা হয় আর তা দিয়ে তাঁদের কী-ই-বা অর্থ আসে হাতে। ফলে অর্থের এবং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই শিল্প আজ ধ্বংসের সম্মুখীন।

নাচনি সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা:

লোকসংগীতের একজন ক্ষুদ্র গবেষক হিসেবে একসময় জানতে চেয়েছিলাম পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিকে আর সেই সুবাদেই পুরুলিয়ায় বা পুরুলিয়ার আশেপাশের বেশ কিছু মেলা কিংবা বা বাধনা, মকর, টুসু ইত্যাদি পালা পার্বণে ছুটে যেতাম। এমনই একবার শীতকালে পুরুলিয়ার একটি জনপ্রিয় বাৎসরিক মেলায় (সৃজন উৎসবে) উপস্থিত হই। সেখানে নানা শিল্পীদের আগমন, নানারকম শিল্পের সম্ভার, বলা যেতে পারে গোটা ভারতবর্ষে যেন সেখানে এসে হাজির হয়েছিল এবং তার পাশাপাশি ছিল এই হারিয়ে যাওয়া নাচনিদের দলও। উৎসুক মনে গিয়ে দাঁড়াই সেই নাচনি দলের কাছে। যদিও যতদূর মনে পড়ে, তাঁরা মেতেছিলেন তাঁদের নিজেদের দলের মানুষদের সঙ্গে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মতো শহুরে মানুষদেরকে আশেপাশে দেখলেও এঁরা একটু ভয়ই পান। যাইহোক খানিক ইতস্তত হয়েও এগিয়ে যাই এঁদের সঙ্গে আলাপ জমাতে প্রথমেই মাঝবয়সি যে-মহিলা নাচনি শিল্পীরা সঙ্গে কথা হয় তাঁর নাম ছিল কাজল বালা দেবী। কথায় কথায় জানতে পারি তাঁর বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি। অনেক ছোটো বয়স থেকেই তিনি এই পেশায় আসেন। তাঁর মাও ছিলেন পেশায় একজন নাচনি। আর তিনিও একটা বয়সের পরে এই পেশায় আসেন। তাঁর জীবনেও আছে রসিক যদিও এই রসিক পরিবর্তন হয়েছে দু-একবার। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর জীবনের প্রথম রসিক তাঁকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। তারপর আসেন দ্বিতীয় জন, এখন তিনিই তাঁর স্বামী বা রসিক। আলাপ জমতে থাকে ক্রমশ। জানতে চাই তাঁদের এই যে অপূর্ব সাজসজ্জা তার সম্পর্কে। কীভাবে এঁরা তাঁদের কেশবিন্যাস করেন বা কী কী অলংকার পরেন এই নাচনি নাচের সময়। নিজের চোখেই দেখি খুবই রংচঙে সাজগোজ বাহারি শাড়ি হাতের চুরি গলায় মালা ইত্যাদি। উনি ওঁর সাধ্যমতো উত্তর দেন তবে এরই মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উনি দেয় যে, তা হল এঁদের সাজ-পোশাকের ক্ষেত্রে কোমরে একটি কোমরবন্ধ পরা হয়। যেটি কিনা এই নাচের সাজসজ্জার একটি বিশেষ অলংকার। এর পরে শুরু হয় তাঁদের নাচ সঙ্গে ঝুমুর গান দুই মিলে তৈরি হয় স্বর্গীয় পরিবেশ আমিও হারিয়ে যাই সেই আদিরসের সুরে। বেশ রাতের দিকে থামে এঁদের পরিবেশনা। ভেঙে যায় মেলা। আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলি আমার ডেরার দিকে। ফেরার পথে ভাবতে থাকি কাজল দেবীর সাথে বলা কথাগুলো সম্পর্কে। আহা, কী আফসোস তাঁর কণ্ঠে ছিল। পরিষ্কার বলেছিলেন, আজকাল আর ক-টা জায়গাতে নাচনি নাচের আসর বসে আর বসলেই-বা আমাদের কী-বা এমন পাই? খুবই কম টাকা দেয়। এমনকী কোথাও কোথাও তো রাতের খাবারটুকুও তাঁদের দেওয়া হয় না। ভাবছিলাম তবে কোথায় উন্নত হল আমাদের সমাজ? আমরা তো আমাদের আদিমতম সংস্কৃতির কথাই ভুলতে বসেছি। তার বদলে জায়গা নিয়ে নিয়েছে সস্তার চটুল সংস্কৃতি। আচ্ছা যাঁরা আজও নাচনিদের সেই আগেকার দিনের মতোই খারাপ চোখে দেখেন, নাচনি মানেই খারাপ পথে যাওয়া মেয়ে মানুষ তাঁরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন কেন নাচনিদের নাচে গানে অশ্লীলতা (যদিও কোনটা অশ্লীলতা আর কোনটা শ্লীলতা এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার) প্রয়োগ রয়েছে? আসলে আমরা ভাবি বড়োই কম আর সেই কম ভাবনার উপর মন্তব্য করি বা নিজেদের ভাবনাকে চাপাই অনেক বেশি তাই হয়তো নাচনিরা আজও সমাজের সেই অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। যে-নাচনি নাচের ভঙ্গিমা বা শৈলীকে অশ্লীল বলা হত বা আজও বলা হয় তা কীসের জন্য তার জন্য দায়ী ছিল তৎকালীন উচ্চবিত্ত বাবুসমাজ। উচ্চবিত্তদের অতি স্থুল রুচিবোধেই তো ছিল নাচনিদের নৃত্যের যে-কুরুচিকর ভঙ্গিমা বা শৈলী তার কারণ। বাবুদের মনোরঞ্জনের চাহিদা মেটাতে এই নাচনিরা নাচের সাথে কিছু অশ্লীল দেহ-ভঙ্গিমার আশ্রয় নিয়েছিলেন তাহলে এতে নাচনিদের দোষ কোথায়?

উপসংহার:

পুরুলিয়া তথা মানভূমের লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের পাতা থেকে নাচনি নাচের আজ যে-অবলুপ্তি তার জন্য কিন্তু দায়ী আমরাই, কারণ, সিন্ধু বালা, পস্ত বালা কিংবা এঁদের পরে আর সামান্য কয়েকজন যাঁরা আজও খুব কঠিনভাবে এই শিল্পকে বুকে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন এঁদের পরে এই শিল্পকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আর কিন্তু কেউ নেই। কারণ, সমাজ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি আজকাল আর পুরুলিয়া বা তার আশেপাশের অঞ্চলের মেয়েরা এই নাচনি গানের সঙ্গে যুক্ত হতে রাজি নয়। তাঁরা বরং লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরির খোঁজে পাড়ি দেয় দেশের নানা প্রান্তে। যদিও যুগের পরিবর্তন অনুযায়ী অতি স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু তবুও কি এমনভাবে এইরকম একটি সুপ্রাচীন শিল্পকে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেখা যায়? এ কি মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক নয়? আজও যাঁরা লোকসংস্কৃতি লোকসমাজ কিংবা লোকশিল্প নিয়ে বিন্দুমাত্র হলেও চিন্তিত এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী সেইসকল শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদেরকে উচিত নয় কি সরকারের দরজা অবধি এই নাচনি শিল্পের কথা পৌঁছে দেওয়া? যাতে কেবলমাত্র গুটিকয়েক নাচনি শিল্পীকে কেবলমাত্র বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত না করে এই সমগ্র শিল্পটিকে পুরুলিয়ার অন্যান্য যে-সকল সমাদৃত শিল্প যেমন ছৌ নাচ কিংবা ঝুমুরের কাছাকাছি নিয়ে আসা অথবা এর পাশাপাশি সরকারের দৃষ্টিপাত করা উচিত যাতে আজও যাঁরা নাচনি পেশায় নিযুক্ত তাঁরা যাতে পুনর্বাসন কিংবা মাসিক একটি ভাতা বা বার্ধক্যের জন্য সুচিকিৎসার সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি সরকার এবং লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন তাঁদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন বা আবেদনে বলা চলে যাতে করে একাডেমিক স্তরে এই নাচনি শিল্পকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। যাতে অন্তত কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী যোগ দেয় এতে। নাচনি গান বা নাচ আসলে কি তা তাঁরা যেন শেখে এবং এর ফলেই একদিন আশা করা যায় হয়তো এঁদের হাত ধরেই বর্তমানকালের কিছু পরিবর্তনকে সঙ্গে রেখেই এই নাচনি শিল্প আবার উঠে আসবে। এতে যেমন করে এই শিল্পটি আবার প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি বাঁচবে এই শিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রান্তিক শিল্পীরা। কারণ, আমরা সকলেই জানি শিল্পী বাঁচলে তবেই শিল্প বাচবে। যে-নাচনিদের পায়ের ঘুঙুরের তালে মেতে ওঠে রসিক দর্শকেরা বা শিল্প অনুরাগীগণ সেই নাচনিদের পায়ে যেন আর কোনোদিনই তাঁদের মৃত্যুর পরে দড়ি বেঁধে টেনে না নিয়ে যাওয়া হয়। যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার পাশাপাশি, অন্তত মৃত্যুর পরে যেন তাঁরা তাঁদের শেষ কৃত্যের যোগ্য মর্যাদাটুকু পায়।

Categories
2021-July-Poem

মহিউদ্দিন সাইফ

শুরুর দিনের কথা

সেই হাঁসীর শূন্যতা ভরা মুখ ঈর্ষ্যারতি-র
জেনে কাছে গেলাম।
সাধ হল, এত অপাঠ্য পীত লিপি কার?
চকিতে আকাশের ইঙ্গিতময় সুবাস কষ্টিপাথরের হয়ে এল।
যে-আভাস বহুদিন, বহুকাল থেকে
উঠব উঠব করে রোজ গাঢ় হচ্ছিল
আজ নেহাতই অবলীলায় সরোবর খুলে বেরিয়ে এল
ঝাড়তে ঝাড়তে শত ডানা।

বাতাসের সূক্ষ্ম কণাগুলি,
যেগুলিকে জানতাম ধুলোপিণ্ডের সারাৎসার বলে,
সহসা চৌচির হয়ে
ফোটাতে লাগল একটি করে নিশুত কদম।

আমি আকাশ আর মাটির মাঝখানে
সিঁদুর-হরিতাল খুঁটিটা ধরে ভাবছি,
হাঁস, হব কি হব না…!

পাখিঅলা

একদিন এক পাখিঅলা এল, আমাদের খুশবুদার দেশে।
জন্মের পর এই প্রথম।
পাখিদের মুখ এত গাঢ়!
রঙ্কিনীর মনে হল।

সে কত কিসিমের, কত ছাঁদের রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা।
নির্মল কেশগুচ্ছে গরবিনী
পীতধড়ায় ইঙ্গিতময়,
কাঁচা অঙ্গের মখমলে সাত ঘোড়া
চরে বেড়াচ্ছে, প্রগল্ভ মাঠ।

লাল পদ্মের মতো পাখিঅলা,
যেন দীর্ঘ জীবন পার হয়ে এসে শোনাল অভিনব কথা।
ত্রিভুবনের গূঢ় রঙ ছেনে ফোটাল
স্ফূর্তি নামের এক বুদবুদ।

আমরা ছেলেবুড়োরা যাবতীয় চোখ খুলে দেখতে লাগলাম
ভিন্ন ভিন্ন পাখি থেকে উত্থিত হচ্ছে
একএকটি নিরল শব্দ।
সেই ধ্বনি ক্রমে গাঢ় হতে হতে
আমাদেরই মাঝে রুয়ে দিচ্ছে শত শত যুগনদ্ধ তরু।

ঘোড়াজন্ম

পড়ে থাকি
অর্জুন গাছের গোড়ায়
আরও সব দারাসুত
মুখে মুখ গুঁজে, গুফতুগু
বপ্তা মংলার সাথে, খুবধীরে, প্রণয়মেদুর।
সে এক ইশানচাপা, নেশাড়ু অখিল,
ছড়িয়ে রাখে উঁইমেকা, থানে
একগাছি সুতো, কাজল, এয়োতির সিঁদুর।
এন্তেজাম করে, সাঁকরাতে, মাধুকরী
গন্ধে উথাল জুড়িভোগ।

পিতার থেকে মন্ত্র নিয়ে, অঙ্কুরিত নাদ
বেঁধেছে এই কচ্ছপী বীণা।
সেই থেকে তার হাতে ভরণ-পোষণ,
গান শুনি: অর্ধমাগধি দোঁহা।

নির্ভাবুক বসে থাকি, দ্রুতমন্দ ছায়ায়
গোপন টুরুই ডাকে কোনো কোনো দিন।

জ্যোৎস্না রাতে

জ্যোৎস্নায় লহর, উড়ছে চরকার সুতো।
শুক্লা দ্বাদশীর আকাশ, পাহাড়ি নীল ও মন্থর।
তা-ই অধিকার করে বসে আছে বুড়ি
বৃহন্নলা বটের তলায়।

সীতালাউ ফুল টুপাতে রাখা
অপার্থিব দোপাটির আলো, শিশির স্বাগতা।

এদেরই গোপথ দিয়ে নেমে আসে
আরও একটি বুড়ি, অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ।
ত্বকের কুঞ্চনে সৌরভ, গুলঞ্চবাহার।
মহাদানা ঘাটে দূরজন্মের স্মৃতির মতো নেমে
ভাঙে গোল পাথরটির গুমান।
মাখিয়ে দেয় মাথায় চন্দন পায়ে গেরুমাটি।

হাত ধুতে ধুতে
ব্রহ্মানন্দ তালশাঁসের মতো হয়ে আসে পুকুর।
একটি মোহন পাখির দিকে চোখ ঠেরে
হেসে ওঠে,
কে এই মরমিয়া?

জল…

নিরাময়

‘একদিন জলাশয়ের মতো এক যুবতী এসে
আমাদের শৈশবের কাঁথাকানি রাখা
প্যাটরা খুলতেই চারপাশে প্রস্রাবের মহক।’

এটুকু শুনেই মনে হল, কার কাছে যেন
রাখা আছে তামার ঘুনসি।
পিতামহের জালকাঠিগুলি পেলাম না বলে
নামাজ-পাটির থেকেও উঠে এল প্রাণ?
হাঁস আর সাপের খেল দেখতে চেয়ে
সারারাত কাবার হল জ্যোৎস্নার খোঁজে…

কিন্তু এ-ধূলিশয়ান সংসারে দেখলাম
একটি কাবরা ছাগল চরে বেড়াচ্ছে সঞ্চালিত বাতাসে।
আউল করা সবুজে দু-একখানা বংশলোচন।
আর অদূরে মকরধ্বজ আকাশে
কে যেন আমাদের হরিমান রোগ
শুক আর শারিতে স্থাপন করছে,
বুনো হরিদ্রায় ছড়িয়ে দিচ্ছে।

 

Categories
2021-July-Poem

পিন্টু পাল

দৃশ্যের বাগান থেকে


শুয়োপোকার মতো কামনা হু-হু করে ঢুকে পড়ে বুকে। প্রেমবিহ্বল আবেগ। যেন স্থির জলে খোলামকুচি এঁকে দিয়েছে ঢেউয়ের আলপনা। বিকলাঙ্গ অতীত ক্রমশ পাথর করে দেয় সব।শিমুলের ডালে নেমে আসে বছরের প্রথম বসন্ত। প্রচ্ছন্ন আগ্নেয়গিরির মতো উদ্বেগ উসকে দেয় জন্মদাগের উঠোন।

ওগো সর্বগ্রাসী, ভালোবাসায় যে বড়ো ভয়!


ধীরে ধীরে আগাছা শিকড় নামায়। ভুল মন্ত্রোচ্চারণের মতো শঙ্কা চিড় ধরায় হাড়ে। রজনীগন্ধা সুবাস হারিয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। দক্ষিণে নলখাগড়া দল পাকাতে পাকাতে ঝাঁক বেঁধে আসে।জ্বরে পুড়ে যায় পিঠ।

কালো বিড়াল আঁচড়ে দেয় দেহজবলয়।


শালগাছের পাশেই রাধাচূড়া। সাদা পায়রার দল সোনালি গমের শীষ নিয়ে বসে। চঞ্চল ঠোঁট। দূরে লাজুক শালুক পুকুরে ফুটতে ফুটতে আড়চোখে দ্যাখে উন্মাদ মাছরাঙা পাখি। গাছে গাছে শ্যামাকোকিল আকাশ ছুঁয়ে গান আনে। গোঁসাইপুর ডিঙিয়ে বেজে ওঠে একতারার সুর।

তবে কি বৃষ্টি এল এই!


অন্ধকারে চকচক করে ওঠে যোনি। যেন অভ্র ছিটিনো জলভেজা বালুতট। পায়ে রাবার গাছের আঠা। বৃষ্টি নামছে দেখে পেখম মেলে এগিয়ে আসে ময়ূর।

অন্ধকারে শরীর এগিয়ে যায় সাপের মতন


এই ঘন আলিঙ্গনের মাঝে রাস্তা বয়ে যায়। মৃত পালকের মতো মায়া ভাসতে ভাসতে আছড়ে পড়ে মাটিতে। কাঠঠোকরার নরম ঠোঁটে লেগে থাকে বুড়ো পলাশের রস। জাদুনগরীর জানালায় শোক চুপটি করে বসে। দু-চোখের দৃশ্য ভেঙে ভেঙে যায়।

প্রতি রাতে জোনাকিপোকা আলো নিয়ে অসুখ সারায়

 

Categories
2021-July-Poem

খুরশিদ আলম

গোলপোস্ট

অন্ধ আয়নার ভিতর মুখ দেখছি
দেখা অ-দেখা মুখের নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের
শেষ দেউটি কবে নিভে গিয়েছিল হাতের পাঁচের মতো
তারপরেও গুনে চলেছি ক্রমপর্যায়।
কখনো ব্যর্থ প্রেমিক কখনো দাবা খেলার ছক।
এই যে এত এত ঘুঁটি সাজিয়ে নিরঙ্কুশ আশাবাদ ব্যক্ত করা
একের পর এক তাঁবু সাজিয়ে স্ট্রাইকার না ফরওয়ার্ড
অথচ পাশ ফিরে তাকালেই ফাঁকা গোলপোস্ট

জোড়া দাঁত

জোড়া দাঁত দেখলে আমার ভয় হয়
তীব্র কোনো জ্বরের অনুষঙ্গ
আমাকে ভাবতে শেখায় সাত-পাঁচের যোগফল
মানুষ ও ভাত যেভাবে দেশ, মানচিত্র ফুটিয়ে তোলে
তা আসলে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি
যার পর্দা সরালেই আবহমান কোনো নদী আর নদীর ভিতর কান্না

দেশ

ঝুলন্ত ব্রিজের মতো একটি দেশ চারখানা পায়া
টিনের ছাওনি
যার সমস্ত শরীরজুড়ে অসংখ্য দাগ
ঋণগ্রস্ত কাঁধ নিয়ে তবু সে দাঁড়াতে চায়
স্বপ্ন দ্যাখে
মোহভঙ্গ যুবকের মতো সেও চায় একটু ভাত দুটো রুটি

মাটি

মাটি আলগা হলে বোঝা যায়
শুরু অথবা শেষ
প্রতিটি সম্পর্কের শক্ত ভিতের নাম মাটি
আলগা হলে চিড় ধরে ভেঙে যায়
নির্মাণ বিনির্মাণের ভেতর যে-বেঁচে থাকে তার উৎস হল মাটি

সফল

ক্ষতচিহ্ন মাত্রই অবস্থান বদল করে
ভাবতে শেখায় দোষ গুণের পরিধি
আলো উৎসের সন্ধান
সফলতা মানে এক দৌড়ে আকাশ ছোঁয়া নয়
প্রতিটি সফলতার পূর্বে শিখতে হয়
এক-একটি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কৌশল

 

Categories
2021-July-Poem

বন্ধুসুন্দর পাল

ভিতরে

ভিতরে আলাপ, আর কত কাছে যেতে হবে!
শুকনো পাতার দলে
কাঠকুড়ুনির পায়ের আওয়াজ বেচে
নামিয়ে এনেছে যে আমাকে
তার অবসর কেন শুধু আমি একাই গ্রহণ করব!

সে কি আশ্রয়ের চেনাশোনা কেউ?
অথবা পালতোলা নৌকা, যার শুধু বিরহ দিয়েই মাথা ঢাকা
নিচে, প্রেমিক-প্রেমিকারা পয়সা দিয়ে একঘণ্টা সময় কিনে নিচ্ছে ইচ্ছেমতো…

তা দিয়েই পেট চলে অপূর্ণ নদীর
ভেসে যাই আমি যার নির্দেশে, অতলে
সেও কি ভিতরে ডাকে! আমি সাড়া পাই…

অথবা স্তনহীন বৃদ্ধা, যে, মাছের পেটের ভিতর
আজন্ম যৌনতা চাপা দিয়ে সে পালিয়ে বেরিয়েছে
নদী থেকে সমুদ্রের তলা ভেদ করে

আর তার উপর দিয়ে একটা শকুন কার যেন মরা-চোখ খুবলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে
তাদের কি শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হইল…

বাহানা

ফুরিয়েছে গৃহকোণ, ফুরিয়েছে আলো-চাল
ফুরিয়েছে ব্যথা

এসো চিঠি খুলে চিনি, এটা কার হাতের-লেখা

চিনেছি নোলক পড়া নাকের বাগান
চিনেছি ভাতের ফ্যান
গড়িয়েছি বালিমাখা মুখের বেগম

এত যে ঐশ্বর্য, তা কি অশৌচের কেউ নয়?

এসো হে জীবন, আমাকেও ছুঁয়ে দ্যাখো,
কেমন তোমার অতিমারির বাহানা…

পায়রা

সাধনা বিলিয়ে দিচ্ছি, ফিরে তাকিয়ো না, প্রিয় মুখ। অথৈ অবজ্ঞার অনুষ্ঠানে পাতপেরে খেতে এসো আলো। তোমার নাভির নির্মাণকার্য শেষ হলে একটা পায়রা পুষব সেখানে। সারা গায়ে তখন অনুরোধের আসর বসবে। তোমাকে যারা অনুশোচনার মতো দেখতে বলে বিদ্রূপ করত চিলেকোঠার ওপার থেকে, তাদের শরীর বেয়ে আকন্দফুল ঝরে পড়বে। আমার শীতলতা গ্রাস করো, বর্ণা, এই জঙ্গল আমাকে অশৌচ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তোমার কাছে। ব্যাপ্তির তলদেশ ফাঁক করে যে-ক-টা শুকনো কাঠ কুড়িয়ে এনেছি, সেগুলো একান্তই শুধু আমার। সেখানে যে-সব শব্দ জোর করে ভাগ বসাতে আসবে তাদেরকে বৈধব্য আগুনে পুড়ে মরতে হবে। আমার শরীরে কোনো সিঁড়ি নেই, তুমি যেখানেই পা ফেলবে সেখানেই পোড়া কাঠ দেখতে পাবে। এভাবেই এক পা এক পা করে পা ফেলতে ফেলতে, ক্লান্ত হয়ে যখন আমার চিলেকোঠার ছাদে গিয়ে একদিন বসবে, তখন সমস্ত পোড়া কাঠ পায়রা হয়ে পুরো ছাদ সমেত তোমাকে ঘিরে ফেলবে। তোমার আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই…

ক্ষমা

জবরদখলকারী বিদ্বেষের মনোরম আতিথেয়তা আমাকে স্বীকার করবে বলে আলোরা দরজার সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। আমার সারা শরীর তখন ঘুমে ঢাকা। অতল মিশিয়ে দিয়েছে যে, তার কোনো বিকেলের ফেরিওয়ালা নেই। সন্ধ্যেবেলার গুমোগন্ধে যে-কাঁথাটা লাজুক কবিতার নিম্নদেশে এসে বার বার চিৎকার করে বলছে, ‘আমি তাকে চিনি!’ তবুও রাজহাঁসের মনখারাপে পুকুরপাড়ে মেঘ করে আসে না। ঘাসেদের সংগমের শব্দকে কোনো পাগল আর প্রেমিকা বলে ডাকে না। তবুও তোমার পিঠ বরাবর যে-শব্দ গড়িয়ে পড়ছে আমার অতল ভেঙে, ক্রমশ নীচে আরও নীচে, তাকে তুমি ‘ক্ষমা’ বলে ডেকো…

সমঝোতা

আশ্রয়ের দিকে মুখ না ফিরিয়ে যে চলে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড পৃষ্ঠা ভরে, তার দিকে সময় হাঁ করে ঢোঁক গিলে নিচ্ছে। এই যে বিষম খাওয়া জলজ সময়, এই যে আলজিভে কবিতা লুকিয়ে রোদের পিঠে ছুরি মারা অবয়ব, যা তাকে সম্পূর্ণতা দিয়েও হিসেব করতে বসেছে, তার কোনো পটচিত্র নেই আমার এই ঘুমন্ত বিছানায়। আমার পাশ ফেরার আগেই যে-জানালা রোজ উলঙ্গ কাঙালপনায় অক্ষরের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছে, আমাকে দোষী সাব্যস্ত প্রমাণ করে আমার থেকে ভোরবেলা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, তার থেকে আমি কখনো সকাল ভিক্ষে করিনি ।

আয়োজনে যে-আলো শরীর ঢেকে দেয়, তারও তো বৈশাখী ঝড়ে উড়ে যেতে মন চায়। এই নির্ভরতার উপোসবেলা ভেঙে যে আজও প্রতিটা ঘরের দোরে দোরে সন্ধ্যে দেওয়ার জল পড়ার শব্দ শোনে তার কাছে থেকে একটা অন্ধকার চুরি করে পালিয়ে বেরিয়েছি। তুমি আমকে শাস্তি দেওয়ার ছলে একবার অন্তত জড়িয়ে ধরো, দ্যাখো, আমি কেমন বিচ্ছিন্ন হতে হতে একটা নতুন শব্দের মতো চুপ করে শুয়ে আছি তোমার কোলে। কেউ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর তোমাকে খুঁড়তে যে-সব শব্দকর্মীরা এসেছিল, তারা কেউ পারিশ্রমিক না পেয়ে জেলে হয়ে গেছে…

 

Categories
2021-July-Poem

সৌরভ মন্ডল

সেরে ওঠো সভ্যতা


খটখটে মটির ফাটল দিয়ে দুটো হাত
কচি সবুজ সকাল নিয়ে আসে দু-চোখে;
প্রথম কেঁদে ওঠা বিদ্রোহে
আদম-ইভের কামনা লেগে থাকে;
পরস্পর-বিরুদ্ধ; ভেতর থেকে বাইরে
পাপের সংক্রমণ ভালোবাসার কবচকুণ্ডল
পরিয়ে দেয় কাজলের টিপে।
নাভির অন্তর্লীন যোগ আলগা হলে
প্রথম কঁকিয়ে ওঠা যন্ত্রণায় থাকেন ‘মা’।

গতকাল জন্মদিনের বাসি কষা মাংস
ডাইনিং টেবিলে; আহারান্তে
ইল্বল ডেকে ওঠে: “বাতাপি! বাতাপি!”
খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক নষ্ট করে
প্রতিটি নতুন সম্ভাবনা।
আশ্রয় আশায় ছোটো ছোটো ডাল-পাতা:
কেউ যদি ভালোবেসে বেড়া এঁকে দেয় চারধারে।
বাড়ন্ত বেলায় হাত এগিয়ে যায়
পড়শির নিষিদ্ধ প্রদেশ ছোঁবে তাই;
সব বেড়া ভাঙতে চায়,
ভালোবাসা ঘৃণায় বদলে যায়।

খাবার ডেলিভারি বয় লাঞ্চ-প্যাকেট হাতে
পুরোনো বন্ধুর দরজায়;
উপযোগিতার বাজারে আত্মীয়তা
অপ্রাসঙ্গিক। “রেটিংটা প্লিজ
দিয়ে দিন স্যার।”
সুস্বাদু বিরিয়ানির গন্ধে, উষ্ণতায়
মিয়ানো ঝালমুড়ির স্মৃতি শ্বাসরুদ্ধ;
স্বপ্নরা রোদের সাথে যুদ্ধ করে করে
ক্লান্ত হয়; কত সূর্যমুখী
ভরদুপুরের আশ্রয় খুঁজে চলে
কল-বয়ের রোমশ ক্লিভেজে।

বিকেলের ফ্ল্যাট ছোটো হতে হতে
খাঁচা হয়; খাঁচার পাখি উড়িয়ে দিলে
দেদার আকাশ!
আকাশে মুক্তি আছে, আছে ভয়ও।
সূর্য লুকিয়েছে পাটে। “ইকারাস!
আরও, আরও উঁচুতে উড়ে যাও,
আকাশে আকাশ হয়ে যাও।”
পড়ন্ত বেলা; মোমেরও ক্লান্তি আছে,
ঘসা লেগে লেগে সন্ধি আলগা হয়ে গেলে
ডালে এসে বসে পাখি;
দুপুরে স্খলিত বীর্য জল হয়ে আসে
বিকেলে; আশ্রিত আশ্রয় হয়ে ওঠে।

শেষ বেলায় পাখিরা বাসায় ফেরে;
গাছের ডাল কিংবা খাঁচায় কোনো তফাত নেই
অন্ধকারে; রঙের কোনো ভেদ নেই,
সব ক্ষমতার রংই কালো।
রোদ্দুর-ধোওয়া পালকের আলো নেভে কবে,
কেউ তার হদিশ রাখে না।
যারা কথা ভুলে যায়, গান ভুলে যায়,
তাদের মিছিলের একক স্লোগান রোদের মতো
ফুরিয়ে আসে আপোশের ঘরে
সহবাসে; ভালো থাকার লোভে
হেজে গিয়ে নিঃশেষ হয় খোঁয়াড়ে।

গাছ আর পাখির রসায়ন বাঁচিয়ে রাখে
জন্ম-চক্র; ছানার জন্য নিয়ে আসা বীজ
খসে পড়ে মাটিতে, উর্বর মাটি
গাছের জন্ম দ্যায়; সেই গাছই তো একদিন
বাড়ি হয়ে ওঠে, বাড়িতে বাড়ে ছানা।
বাড়ি আসলে ঘটনাচক্র;
এক অসংগঠিত বিদ্রোহ।
কত ঘর ভেঙে যায়, ভেসে যায়,
পুড়ে ছারখার হয়; তবু সভ্যতা
গড়ে তোলে বাড়ি, শূন্যে;
তঞ্চক সভ্যতা কি হিসেব রেখেছে
কত পাখি চলে গেছে বনে, অন্তরীক্ষে, সমুদ্রে
মিথ্যে নিয়মের পিছনে লাথি মেরে;
অভিশাপ ছুড়ে গেছে কত!
সেরে ওঠো সভ্যতা; বেঁচে থাক
মানুষ।

Categories
2021-July-Poem

উজ্জ্বল ঘোষ

শস্যময়ূর

ক্রন্দসী, তাঁতের কণ্ঠদাগ ধরে ধরে গিয়ে দেখি
নীল মাঠে শস্যময়ূর ফোটাচ্ছ তুমি।
অক্ষরের মাঠ বরাবর হেঁটে হেঁটে
এসে পড়লাম এ কোন শস্যের মাঠে!
গর্ভস্থ ভ্রূণের মতো বাঁধা পড়লাম তাঁতের নাড়ির ডাকে।
ধ্বনিময় মাতৃগর্ভে, আশ্চর্য ছন্দের ঘরে, শুনি
মাতুলকুলের হাতে বোনা হয় গায়েহলুদের হলদে শাড়ি।

দূর নও, শান্তিপুর, মায়ের যমজ দেশ তুমি;
আমাকে ফসল করো, শস্যে ভরে দাও।

ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে

ঘুঁটে পোড়ে, তবু কেন গোবর হাসে, মা?
দহনে তৃপ্তির স্বাদ কেন খোঁজে আর এক দহন?

গোবরের গোল থেকে নাড়ি ছেঁড়া দুটো ঘুঁটে
ভীষণ আলাদা কেন পোড়ে;
হৃদিপদ্ম ছাই হলে মিশে যায় উনুনের বুকে!

অন্ধকার সুতো বাড়ে তোমাতে আমাতে।
অনক্ষ রুমালে বাঁধা থেকে যাব তুমি আর আমি?

সংখ্যার জননী তুমি সৃজনের গোল;
যদি চোখ মেলে দাও, যদি সেই শিশুর ঘুমোনো
বাবা আর মা-কে মলে দাও কান, তবে
পুড়ে ছাই ধুকপুক থেকে হৃদয় নিঃসৃত হবে।

প্যারাসুট

ধ্বনির প্রহরী আমি, পদাঙ্কের কান;
মনোমোনিয়ামে দেখো বেলো করে কারা—
বেলো করে পৃথিবীর পাঁচটি আঙুল

পাখিরা শুদ্ধ ‘নি’ জানে, কোমল ‘রে’ তাও জানে;
আমি মনোমোনিয়াম, বাজি
ভীষণ গোপনে, শোনো,
সারেগামা প্যারাসুট বোনে

ঠেলে নিয়ে যাও যদি খাদের কিনারে
প্রজাপতি প্যারাসুটে উড়ে যাব দূরে

আবার প্রসূত হব মাটি আর জলে

লবণ সত্যাগ্রহ

দিগম্বর ফকিরের বেশে হেঁটে যাই চলো দু-শো একচল্লিশ মাইল।
এসো ডাক পাড়ি, সাড়া দিই, শুনি সমুদ্রকথন।
শব্দেরা ঢেউয়ের মতো ছুঁয়ে দিক এসে;
স্বরের ভেতর ছবি, ছবির ভেতর স্বরলিপি
রেখে দিয়ে, ফিরে যাক নিজেদের দেশে।
দিগম্বর ফকিরের বেশে তৈরি করি চলো প্রাণের লবণ।

বলো বীর

(গৌতম বসু-র শ্রীচরণে নিবেদিত)

“জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলাভে, অয়ি,
বীরের সদ্‌গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।”
— কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অঘোর পল্লব নিয়ে ধরাশায়ী শাল
ভাগীরথী বুকে বেঁধে দাঁড়িয়ে মশাল
ঠান্ডা পর্ণে লেগে আছে বীরের গঠন
তোমার চিন্ময় জল তোমার বাহন

পরাস্ত বাতাসে বয় জয়ী ইতিহাস
যাপন চিন্তিত মেঘ, জীবন আকাশ
আকাশ ভ্রমণপথ, আকাশই পথিক
পাতালে অর্ধেক বৃত্ত— অদেখা অনীক

শ্মশানে শুধোয় এসে রাজার সন্তাপ :
বীরের সদ্‌গতি থেকে ভ্রষ্ট হওয়া পাপ?

 

Categories
2021-July-Poem

রূপক চট্টোপাধ্যায়

একগুচ্ছ গোলাপের প্রলাপ


প্রলাপের তীর ঘেঁষে আমার
জ্বরের সংসার!
রোজ থালাবাটি ছোঁড়া। গালাগালি। অরন্ধন। তবু
বনের কোনে ধাতব চাঁদ এলে
গার্হস্থ নিয়মের পদাবলী ফেলে, কালো
কলজে ধুতে যাই, জোৎস্না গোলা জলে।


তির ছুড়ে দাও।
বুক পেতে আছি! আমি ইচ্ছামৃত্যু চাই না।
বরং মৃত্যুর কাঁধে ভর দিয়ে, তোমার দুপুর
দেখব। দেখব বিকেলের বিনুনি তুমি কত
সহজ করে বাঁধো!
কত সহজ হয়ে যায়
বসন্তকাল! শীতের পিছু পিছু
সাদা রাজহাঁস ছুটে যায়। আমার
মৃত্যুর পিছু পিছু ছুটে আসুক
আদিম বর্ষাকাল!


সৌভাগ্যের শৈলশিরায় একদিন
সূর্যোদয় হোক। আমরা সবান্ধব দেখতে
যাব। আমরা ধাতব যন্ত্রণাকে বুকের ভেতরই
কবর দিয়েছি! সেখানে এখন বনতুলসীর ঝোপ,
বিষণ্ণ ডাহুক। আর ছিটকে পড়া ভ্রম!


একদিন ঠিক ধর্মের বাকল খুলে,
সূর্যোদয়ের সামনে,
উলঙ্গ মানুষ হয়ে দাঁড়াব।
সেই হবে শ্রেষ্ঠ পরিচিতি। নাগরিক মানপত্র
ছিঁড়ে ফেলে, ভাসাব আড়বাঁশিতে
ভীমপলশ্রী। চন্দনবনের রাধাকে দেখে
ডেকে উঠবে ডাহুক পুরুষ!


শরীর জুড়ে ক্যাকটাস হিংস্রতা নিয়ে
জেগে আছি জগদ্দল ভ্রমে। মৃতনদীর
তৃষ্ণারা জোনাকি সেজেছে। এই দায়ভার
বইতে পারি না আর। তীব্র আকাঙ্ক্ষায়
জ্বলে উঠে কালপুরুষ হই মাঝরাতে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীর অন্তঃস্থলে বসে
আমিই গর্ভসঞ্চারের শেষ মানবশিশু হব!

 

Categories
2021-July-Poem

শীর্ষেন্দু পাল

দেয়াল

দেয়াল ভাঙা হলে
ইটেরা সবচেয়ে খুশি হয়
জমাট বাঁধা বিভাজনরেখা থেকে
খসে পড়ে মাটির অনিচ্ছা…
পুড়ে ইট হয়ে গেলেও
মাটি কোনোদিনই বিভাজন চায় না।

বাসনকোসন

যত সাবধানেই রাখা হোক
শব্দ একটু হবেই
গড়িয়ে পড়ে গায়ে লেগে থাকা জল
আসলে… কান্নার সময়
প্রত্যেকেই একটু আনত হয়।

জুতোর র‍্যাক

জুতোর র‍্যাক আসলে নির্বাক বেড়াল
থাবাতে লুকিয়ে রাখে
পথের দুঃখরেণু
ছাতা এক প্রকার আনন্দ
যা হারালে দুঃখের চেয়েও
শোক হয় বেশি।

আয়না

শুধু কি আয়নাই জানে
তোমার শরীরে ক-টা তিল
ফুটন্ত চায়ের জল দেখলে মনে হয়
তোমার তিলগুলো চোখ রাঙাচ্ছে
উষ্ণতায় জেগে উঠবে বলে

বিছানা

কুঁকড়ে গেছে মাঝখানের সুতো
সংগমের পর বিছানা চাদর যেন
সকাল বিকেল নির্বাক ছলছুতো
জানি— সহজ কথা
বলা হল না এখনও।

কুকার

আবহে শিবরঞ্জনী নয়
বিদ্রূপ করে কুকারের সিটি
চমকে ওঠা ধরা পড়ার ভয়ে
ভিতর প্রদেশ আলগা করে মুঠি।