Categories
2021-July-Poem

অনিকেশ দাশগুপ্ত

চাঁদের ডিঙা

জঙ্গল-রমণীর মতন জোয়ার-চাঁদটি
মুছে ফেলল সমস্ত পশ্চিম, নীল তাঁতের সীমানায়—
দু-খানি আদুর উৎস থেকে ঝরে পড়ল চাঁদনি গাঙ,
পার্বত্য মেষের বিতান ছিল এমন এক; নতুন পাতার—
ঘ্রাণে ভরে ওঠা মাঝরাতের অরণ্য কীভাবে যে
শালের মদে পোয়াতি হয়ে উঠত ধীরে-ধীরে, নীল ঠোঙার
খাঁজ, নুনে-ঠেকানো-জিহ্বা আর বিষের কালো খনি—
একাকার হয়ে কুমকুমের গাঢ়-কিশোরী-ছোঁয়া বয়ে বেড়াত,
মৃণালে তার চাঁদের কত পঙ্‌ক্তি, কাজলের বেড়ি—
নিরন্ন বোবা আঙিনায় আইবুড়ো বৃক্ষ-দুহিতাটির চারপাশে
সাদা মাড়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে ভাসিয়ে দিত আকাশী ডিঙা

সমাধি

যেদিন ফিরে এলাম প্রাচীন এ-সমাধিপ্রাঙ্গনে
ঘাসের শতসহস্র মণির অন্তরে লুটিয়ে পড়ে শরীর ভরে যেন
মুগ্ধ সবুজ সর, আকাশ-নীল কাঁটার মতো সুউচ্চ বৃক্ষকামে
মেনে নিলাম তীব্র বসতি, সোপানের আশ্চর্য শ্লথ ফাটলে
আঙুল রেখে একটি স্ফুরণে পরিপূর্ণ হল নিঃসীম
বাগিচা, রঙিন বাস্কেট থেকে সরীসৃপ চক্ষুর মতো মনে হল
ঘাস-লতা, বাবুই-আঁশ; নখের ডগায় এই এক কণা অভ্রের বাতি
পুরোনো জানলার পারে ছড়িয়ে পড়ল, তালপাতার হাওয়ায়
জ্যোৎস্না-হৃদয়গুলির এপার-ওপার ভেদ করে সহস্র
বছর ধরে উড়ে এল ঘাসের আত্মা

আষাঢ়

হলুদ শিখাটিকে লক্ষ করে ছুটে চলেছে
নিদ্রাতুর পাতার ওপরে ময়ূরবর্ণের মেঘ-পুঞ্জ
রানির অন্তিম জরি থেকে নানান ছল ও কৌশলের
নাতিদীর্ঘ স্বচ্ছতা, অন্তহীন জলছাপ রেখে পাখির শ্যামলিমে
হারায়, হারায় আলোকোজ্জ্বল সাইকেলে প্রথম নিষ্ক্রমণ
একে-একে, জ্যোতিষ্কপারে রুধিরে চন্দ্র-হংসের দীঘলতায়,
অরব মর্ষকামী ওষ্ঠে লেগে থাকে মীন-চাঞ্চল্য
পাখোয়াজ-নীল তরঙ্গে বিবশ কাঁচুলি ও-ঘাটে—
শ্রী-অঙ্গে ভিজেছে কোন দূরের জলতিলক-নারী-ঘাস
সারসের নিবিড় রক্তিমতা ছুঁয়ে নেমে আসে অলক্ষ্যের আকাশ

চৌকাঠ

কখনো-বা মোড় ঘুরেই আবিষ্কৃত হত বিবশ নদীর প্রিয়তমা,
নীল অরণ্য-চাদরে মাথা পেতে দেখতাম শীর্ণ সৌর-পথ
তিরের অন্তিম আবেগ আর একটু পরেই যেন থিতিয়ে পড়বে
শতসহস্র বৃক্ষশাবকে; বঙ্কিম সমুদ্রধারে এমনই এক সান্ধ্য
লাইটহাউসে আমরা, জন্তুদের কর্কশ দেহতল
উপড়ে ফেলেছিলাম

সাদা ধাতব মার্জনার ঠোঁটে লেগে থাকত মদ, চূর্ণ চন্দ্রদ্বয়,
মগ্ন পিপুলের নীচে বিষাক্ত দাঁড় টেনে-টেনে কখন যেন
ক্ষয়ে যেত সে-বিশুদ্ধ বজ্রসুখ, নীরক্ত অটল সমৃদ্ধির

ট্রামডিপোর অন্য প্রান্তে

ডিপোর বিজ্ঞাপনগুলি এমন মেঘলা দিনে
নীল সীমন্তের বঙ্কিম ট্রামসারিতে কাঁপা-কাঁপা তর্জমায়
উঠে আসে, তেঁতুলবীজের চুরমার ধ্বনিতে
বাদামি টেলিগ্রাফ তার থেকে
নিঃসীমে সরোবর কোণে উড়ে গেলে তুমি
যেন কোনো পতঙ্গবিদের
গাঢ় অসীম বীক্ষণ, নরম আরক্তিম এই পাদানিতে তখন
ঝড় বয়ে এসেছিল অন্য আর এক শতাব্দীর

বাজখাঁই খামের হাঁ থেকে সারি-সারি অশ্বখুরাকৃতি মঞ্চ
নেমে এলে নিমেষেই ধরে ফেলা হচ্ছিল অনন্ত সপ্তক
মন্দ্রে জোনাকিদের ঢেউ—

ইস্কাপনের সোনালি রিম থেকে তোমায় দেখেছি এলোমেলো
কানামাছির মতো কাদার মণ্ডে চমকপ্রদ ছুরি গেঁথে ফেলতে

 

Categories
2021-July-Poem

শুভাগত রায়

জীবন

আলপথে শুয়ে আছি। গভীর রাত এখন, কানের পাশে চিরবিরহের উপকথা শোনায় ধানগাছ। প্রসূতি ধানের বুক থেকে ওঠে মায়ের গন্ধ, ইঁদুর এসে ধান কাটে, কাটে এই মাটির শরীর। অনন্ত অপেক্ষায় শুয়ে আছি, মাটি ভিজে যাবে জলে।

প্রার্থনা

বুড়ো অশ্বত্থের গহ্বরে ঘুমিয়ে আছেন পির। অশ্বত্থের গায়ে দোলে কত জন্মের কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছেরা। আলো পড়ে এলে, মিলিয়ে আসে মাঘরিবের সুর, একলা দরবেশ চিরাগ জ্বালান দরগায়। আরও কত বছর কাটে দেখা হওয়া-না-হওয়ায়, অন্ধকার এক মানুষ চোখের জলে ভেসে যায়, বার বার মাথা রাখে নির্জন দরগায়।

প্রেম

সহস্র বছর ধরে একাকিনী বয় তরুণী নদী। গর্ভে সময়ের যন্ত্রণা নিয়ে মনে মনে একা ক্ষয় হয়, পাথরে মাথা ঠুকে কাঁদে। অগ্রহায়ণের চাঁদ ঢলে গেলে শেষ রাতে, বয়ে আসে মাটির দিকে। ঝুরো মাটি ভিজে যায় জলে। দূরে কোথাও নিভে যাচ্ছে কোমল সব দুঃখরা।

বিষাদ

আলপথ ধরে এখনও তোমার পায়ের ছাপ। ফুলগাছের নীচে ঘুমিয়ে ভ্রমরের মৃতদেহ। তোমার অতল জলের চোখ,বুকের ভেতর প্রেমিকের মুখ, এইসব আগলে রাখে হেমন্ত শেষের হাওয়া, সান্দ্র সন্ধ্যের প্রহর।
আর হেমন্ত শেষের হাওয়ায় ঝরা পাতাকে জেনেছি প্রেম, জেনেছি, সুগভীর দুঃখছাপ।

শূন্যতা

উঠোন পেরিয়ে পা রাখলেই পা ভিজে যাচ্ছে মেঘে,
নিমফুলের গন্ধমাখা দুপুর একা বসে হেমন্তের হিসেব গোটাচ্ছে। টিনের জাহাজভরতি ফসল ডুবে গেছে পদ্মদহের জলে, শেষ অঘ্রানের হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে গেল কিশোরী শিউলি ফুলের বুক,
ভোরে মাটি জুড়ে ঝরে আছে তাঁর কোমল লজ্জার দেহ।
মেঘেদের গায়ে এক অলীক শূন্যতা,
যেন প্রেমিকার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার বিকেলবেলা।
বেনেবউ পাখিদের মতো রোদ উড়ে গেছে দূরে তোমার শহরের দিকে।

 

Categories
2021-July-Poem

সৌমাল্য গরাই

প্রস্তাবনা

একটি লাইন থেকে
দূরে সরে গিয়ে
অস্পষ্ট মমির মধ্যে খুঁজে পেল কেউ
ধ্বংসাবশেষের নীচে করুণ সংকেত
অলিখিত বৌদ্ধগুম্ফা
ভিক্ষার আড়ালে তার ধ্বনিসংঘ পাতা

তার থেকে দূরে

পানাপুকুরের নীচে হারিয়েছে কেউ
গুপ্ত পাপ, মিথুন কৌশল
চরাচরজুড়ে শুধু হাঁস খুঁটে খুঁটে খায়
প্রকৃত শামুক যারা গভীর জলের গানে
খুলে দেয় শালুক দুয়ার

অন্তিম লাইনে এসে লৌহকণা, রক্তবীজ ফেটে
ফিরে আসে অচেনা হাড়ের তলদেশে
ব্যক্তিগত মৃত্যু প্রস্তাবনায়
টের পাই, একটা শূন্য সাদা পাতা
মাথার ভিতর ঘুরে ঘুরে
আমাকে খেলায়

ছায়াছবি

রাত্রি এল, সঙ্গে দু-একটা তারার ভাসানো জেলে নৌকা
একসাথে হেঁটে যাব, এমন আকাশপথে ছোটো গ্রামপুঞ্জ
জ্বলে উঠল দেশলাইকাঠির মতন

হাওয়াদের বিবাহ লেগেছে
কোথাও সানাই নেই অথচ নীচের
মণ্ডপে বঁধূরা মিলে শঙ্খ বাজিয়েছে
নেশায় মাতাল চাঁদ, বড়ো একা, টলমল দেহে দিঘিটির কালো জলে
ওর ভাঙা বুক সকরুণ কাঁপিতেছে

কুসুম-কথা

কুসুম, তোমাকে বলি শোনো
চিরস্তব্ধ সময়ের কাছে
প্রার্থনা করেছি সেই মুহূর্তের হাত
শরীরের তাপ নিভে গেলেও তোমাকে
দিয়ে যাব এ-জীবনে না-হওয়া সংসার
সাবধানে রেখো অশ্রু, লুকানো সিঁদুর

দূর কক্ষপথে
এখন সবাই আমরা পুতুলের মতো
যন্ত্রদের কাছে বলি যন্ত্রণার কথা
শরীরের-ও মন থাকে কে-ই-বা বুঝেছে

পরিচিত টিলাটির কাছে আর
দাঁড়াতে পারিনি কখনোই
দীর্ঘশ্বাসে আসে শুধু
নিরুপায় পরিত্যক্ত হাওয়া
মনে হয় সূর্যাস্ত আসলে
তোমার-ই গোপন চলে যাওয়া

তুলাযন্ত্র

বৈরীপথে আটকে পড়েছে
পাথরের প্রসবসমূহ
জলহীন, শব্দহীন
খোলসের স্তূপে
ফুটে আছে মাতৃমুখী বীজ
তাদের আচ্ছন্ন ডাকে
ব্রহ্মাণ্ডের শীর্ষদেশে শুদ্ধ সহজিয়াদের
কম্পিত শ্রীখোল বাজে। আলো কৃষ্ণ হয়ে আসে
নীল নভোদ্বীপে

নিঃশব্দে হাওয়াতে শান দেয় বর্গীমেঘ।
হাতের কৃপাণরূপে আধখানা চাঁদ জেগে ওঠে
শেষ রাতে তার ক্লান্ত ঘুমের সুযোগে
দ্রুত গতিবেগে অশ্বারোহীর শিকল খুলে
পরিপূর্ণ সূর্যডিম্ব নামে গড়াতে গড়াতে
এবং এরই পাশে
দু-টি সম্ভাবনা নিয়ে আটকে থাকে যে-ভ্রূণ

তার মতো জন্ম
তার মতো মৃত্যু
আমাদের হৃদপিণ্ডে স্পন্দিত হতে থাকে

নভোশ্চর

মনে ভর দিয়ে হাঁটি। কেন-না মনের চেয়ে দ্রুতগামী কিছু নেই। জীবন সড়ক জুড়ে বিসর্পিল পথ একইরকমভাবে ঘাপটি মেরে আছে। সব রাস্তা, সব বিজ্ঞাপন অবিকলভাবে রূপায়িত।

তাহলে আমি কি পাব না সেই অবারিত মুক্তদলবিশিষ্ট পয়ার যামিনী? দ্বৈতশিশুর ন্যায় যাদের পিঠে শজারুর কাঁটা গেঁথে দেওয়া আর তার অভ্যন্তরভাগে রয়েছ সুন্দরী তুমি! মুকুলিত, গুঞ্জনময়।সেকেন্ড বড়ো জোরে ছোটে, তাই তোমাকেদেখামাত্র ফিরে আসতে হল বিজুরীপলকে।প্রত্যাবর্তন কালে দেখি— আমি কোথায়? তুমিই দাঁড়িয়ে আছ ঘরে।

চমৎকার স্বনকের কম্পনে পেন্ডুলাম দুলে উঠল। আশ্চর্য এ কী হল!
তুমি বা আমি নাই, ঘরটাই নিজেকে দু-রকমভাবে দেখছিল

Categories
2021-July-Poem

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়

মালীকাহন

খেদ মার্জনা করি অহরহ
তবে আমি রূপকার নই

সংবর্তের চেনা রূপকের মতো
ঢিল-পাটকেল খেলা—
দিনাতিপাতেরও আগে পুরোনো কবিতা থেকে
পুনরায় জ্বালাটি না মেনে
দেরাজসুতুলি ধরে চলে আসে আর এক প্রবীণে

যেহেতু সূর্যস্নান আজও মরালীখাতার মদ ছাড়া
অভাগা বাঁশরি—
টিলার আতশ চিন্ময়ী বিষে সদগুরু সাঁতারের অনুপান তুলে রাখে মহৎ কুজনে

নিমফুলে ঘন হয় আহামরি রসুইস্বভাব…

খাজনা

তেচোখা ফাগুন এই নেমেছে
আরামপ্রদ ঝিলে

সভ্যতা খননের শব্দে চমক বেঁচে থাক

বিধুর ছিপের ডগা জলফড়িঙের মতো সুরে
মরমিয়া দখিনার পলাশনিশুতি পায়ে
চামড় বোলায়

নির্মোহ শীর্ষক গিরিখাতে বিভাজিত প্রতিধ্বনির
কাছে ঢালু কবরীর যজমানি,
প্রণালীর আচার্যপথে হাঁসফাঁস
এক সুতনু পাথুরে স্নেহে হোঁচটসুষমা আর
টুকরো রেহাই বেড়ে দিয়ে

ফাগুন নিজের মতো, নিথর, তেচোখা,
ভেসে যায়…

গার্হস্থ্য

ফলন্ত মোহনার হেম

নিড়ানির সাহায্য ঝাঁপ খায় সরাইখানায়

আভোগ পালনে চড়া দাওয়াই বেঁধেছে সঞ্চারী

মৃণালবক্ষে এই দজ্জাল তলদেশ, মহাগুঞ্জন—

উপান্তে লাঙলের শেখরপ্রতাপ ঘিরে
নোঙরের পিঠ চাপড়ানি আর স্বত্ব আদায়।

ঠাট

নদীর জন্ম নিয়ে নৌকোর
হালে খই ফোটে

নদীর আঘাত নিয়ে ইহমানবিক,
নৌকোটি

নদীর বাঁধন নিয়ে নৌকোপাঁজর
ভাসে উত্থানে,
পতনবিনীত

নদীর মৃত্যু নিয়ে নৌকোর অপরাধ
একলাটি বসে থাকে
এপার ওপার

রাত-প্রজাপতি
আর
দিনের জোনাকি
যদি ছইয়ের সাহসে ভর করে
একবার,
ডানার ওপরে রাখে
পায়ের তলায় রাখে হাত

মেঘের পাহাড়ি ঝগড়ার
বন্ধুতাটুকু জন্মের শৈশব থেকে
তুলে রাখা সঞ্চয়ে,
ছেঁচে ফেলে দেবে ছানি
হাসির শুকনো আফশোস

খোলভাঙা শামুকের বেয়ে আসা পথে,
নটেগাছ একবুক নিঃশ্বাস ভরে দেবে
মুড়োবার আগে,
কোলপোঁছা পাতাটির বাচাল শিরায়…

অবতরণিকা

চরিতের অমৃতঝিমুনি—

এ-মেহন বহুকাল চাঁদের ফলার আঁচিয়েছে

বৃত্তের মাত্রাটি নিলীন বর্ণে সংযত

চোটফসলের দায়ে কৈফিয়তের কানাকড়ি
চেখে নেওয়া মূঢ় শিরার সেঁজুতি

অর্ধভুক্ত বাতায়নের দোহাই
দ্যাখো দেনার ধারালো গোঙানির ভোঁতা অভিযানে
লিখেছে অশোক

আর হিমের অভাব থেকে সুচতুর ঘুম সরে গেছে…

Categories
2021-July-Poem

উদয় সাহা

গুলমায় গুম হলাম যেদিন


মেঘের চোখে শিউলি ফুল
অথবা লজ্জা?

পাহাড়ের ঠোঁটের কাছে এসে
কেমন খুলে গেল আঁচল,
আর মেঘগন্ধে ভরে গেল বাতাস…!

কই এভাবে তো বিষাদ ভাঙে না
অবরুদ্ধ বাদল দুপুর থেকে…

সকাল, তুমি নিরুত্তর কেন?


আমাদের জংলি যাপনের সামনে
সটান দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সোমবারের বুট

বাক্যের তাপে সেরে ফেলি স্নান…

এই ঘাতকগ্রহে মাথা হেঁট করে
আমরা অপেক্ষা করি,

গাছ ধোঁয়াটে সূর্যের বিকেল আর
পাখি ওড়ার গান


আকাশের স্বাদ মেখে নিতে
দরজা খুলে দিলাম—

নাছোড় বর্ষার আচ্ছন্ন দুপুরে মনে হয়,
আকাশ নাকি মন?

প্রিয় গল্পের মতো নিশ্চুপ ধূলিকণা
স্থবির, কুয়াশাজড়ানো সারি সারি গাছ—

যেন স্মৃতি


আমার সমস্ত দৃঢ়তার কোলে
শুয়ে আছে শান্ত নীচু মেঘ

চাদরের নীচে বাসনার বস্তি
এই মানববাগান…

একটা পাহাড়কে ঢাকা হয়েছিল
সাদা চাদর দিয়ে
আর যখন ঘি মাখানো হল
আমার হাতে ফুটে উঠেছিল
পাললিক বর্ণমালা…


ঝড়ে যে-স্বপ্নগুলো গাছহীন হল
সে-স্বপ্নগুলো এই পৃথিবীর সকল
আম আদমির মতন—

ঠিকানাচ্যুত হলে ফলের বোঁটায়
যে-কস লেগে থাকে
সেটুকুই মায়া…


বাতাস পাথর হলে
দুঃখরা বৈদিক ঋষি হয়ে যায়

নদীর ভেতর চৌষট্টি কলা—

একটা ক্রান্তিকালীন চাঁদ

 

Categories
2021-July-Poem

নিমাই জানা

সাইকেলটি প্রেমিকা, কেমোথেরাপি আর কোরিয়োগ্রাফার


সাইকেলে রাখা ফরসেপটি এক লোমশ ডাক্তারের ডান হাতের ছত্রাক সংক্রমণ
অপারেশন থিয়েটারের নীল বিছানাটি হঠাৎ ঘামে জবজবে, ক্যামপোজ ইঞ্জেকশনটি শিরদাঁড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সাপের মতো, অবচেতনেই প্রেতশিলা দ্যাখে সবাই অথবা ঈশ্বরকে, শববাহী গাড়ির চালক অনন্ত নেশা ঘোরে থাকে দিনরাত
তার চোখে অনলবৎ চিতাগ্নি জ্বলে সারাটা জীবন
গভীর রাতে কেউ হেঁটে যায় মৃদু ছন্দ তালে


লাল রঙের কঠিন আলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কতজন মরুভূমির জোনাকি হয়ে গেছে
নিজের বুকপকেটে জমিয়ে রাখা তিল ক্ষেত্র আর হাইপোথ্যালামাসের লজ্জাবতী গাছ পাতা মুড়িয়ে ডেকান ট্র্যাপে আটকে গেল
ব্রন মুখে কতজনের মুখ, সিলিকন ক্যাথেটার, নর্মাল স্যালাইন আর ডিসপোভ্যানের উদর ছাড়া সবাই সন্ন্যাস, আসলে সকলের গায়ে মৃদু তাপমাত্রার জ্বর ছিল। দেবতার পায়ে আলতা পরাতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছে কাচের প্রিজম শিশি
তারপর মানুষেরা বিকলাঙ্গ কবিয়াল হয়ে গেছে
মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না সংগমকালে


মৃত্যুর পরে কতজন সন্তান এক বিছানায় ঘুমিয়েছে ১৫ দিন নিরামিষ ভোজ্য খেয়ে
চাদরে টিকটিকি আরশোলা ছাড়া সবাই প্রদীপের আলোয় শিখে নিচ্ছে নিজেদের সংশ্লেষণ ক্ষমতার ক্যাপাসিটি, পাঠ্যপুস্তকের
দিদিমণি শেষ সময়ে কলমের পেছন দিকটা খুঁচিয়ে দেখছে চোখের উপপাতার স্পন্দন, বুকের কাছে স্টেথোস্কোপ রাখতেই মুহূর্তে জেনেছিলাম এক্সপায়ারি নোটের পিছন দিকে অনেক অনুর্বর ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে, গর্ভবতী হয়ে পড়ার খবরটি ঠিক তার মতোই ব্ল্যাঙ্ক্স, ম্যানকাইন্ডের প্রেগা নিউজ


সাদা দিদিমণির ইউনিফর্মে অদৃশ্যভাবে দেখেছিলাম পেছনের রঙিন স্ট্রিপ, এই যৌনতা দেখতে গিয়ে আমার চোখ বুঝিয়ে দিল কোনো এক অপরিচিতা অন্ধকারের ওপারে দাঁড়িয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ কদমের কবিতা শোনাতে পারে
অথচ যে-কেশরাশির জন্য পাগল হয়ে সাইকেল চালানো ছেড়ে দিয়েছ, তার লিভারের অসুখটি বৃত্তের ক্ষেত্রফলের মতো
সে আসলে কেউ নয় নিজের শুয়ে থাকা সায়ানাইড বেডসিড কথা
শরীরের সব ছিদ্র মশার কামড়ে মারা গেছে


দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আগে মাথার হাড় আর চোখের প্যানিক ডিজঅর্ডারের মতো কাজল, সাইকেলের সাথে মৃত্যুবরণ করেছে
তার পাদানিতে সুয়েজ খাল ছিল, পিঠে কত ভূমধ্যসাগরের চিত্র অংকন করেছি ফেব্রিক কালি দিয়ে, গ্রে ম্যাটারের ডিপ শেডিং
ইচ্ছা করে কোনো জলবিন্দু আঁকিনি বুকের দিকে সাইকেলের হৃদপিণ্ডে জলজ হিমঘর আছে
তার প্রতিটি শিরায় ত্রিভুজের কালচে রক্তস্রাব
আগুন জানে সাইকেলটি একটি মৃত সাইনবোর্ডের মতো ভীতু, ঘনঘন ডিলিট করে ম্যাসেঞ্জারের চ্যাটিং, ইমোজিতেও ভয়
স্পাইরাল পাতাবাহার নতুবা একটি উচ্ছল ইনস্টাগ্রাম অবলা গ্রিটিংস কার্ডকে ছুড়ে দিয়েছে মরচে ফুলের সাথে
মৃতপ্রায় পরজীবী হাঁ করে দেখে নিমগাছ
আর বাকিরা অশরীর প্রেমের সমীকরণ ভুলেছে
জানালাটি তারপর দীর্ঘ রাস্তা আর ফুলটব হয়ে গেছে


আমি শুধু একটি কাপড় রঙের সাইকেলের কথা ভাবি, কীভাবে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে পিছনের ক্যারিয়ারে বসিয়ে মৃত প্রেমিকার কাছে নিয়ে যায়, প্রেমিকার দাঁতে হলুদ রঙের ক্যাভিটি ছিল সাদা কবরের ভেতর পাশাপাশি ইষ্টমন্ত্রের গেরো খুলে বাইবেল পড়ার পর দু-জনে দুটো মেডিকেটেড পিল খেয়েছিল
তারপর কেউ সারারাত ঘুমোইনি, ভিঞ্চি দাঁত খিঁচিয়ে কোর্টে আপিল করেছেন।
দু-কৌটো রঙিন আপেলের জন্য কেউ হাত পোড়াতে পারে, অথচ তার রঙের কৌটায় জীবন্ত কোবরা সাপ, যেন পিচ্ছিল ম্যাজেন্টা মোনালিসা আঁকার পর গভীর রাতে উঠে নিজের জীবনের ছবি ফুটিয়ে তুলতে এঁকে বসলেন একটি পাত্রীওয়ালা পিদিম
তার পিঠের উপর একগোছা স্তনের চারাগাছ


নিজের পায়ের তলায় ফুট অ্যাবসেস আছে কোনো ওষুধেই কাজ করছে না বয়স্ক বাবার ক্যাথিটার ছাড়া সবেতেই বিছানার বেডসোর গন্ধ
রঙিন জলীয় দ্রবণে অণুজীব আর রঙিন মাছেরা ফেরোমেন নির্গত করে, প্রজননের নেশায় কত সৈন্য অপেক্ষা করে আছে রাত জলাশয়ের ধারে, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র
ওই তো দ্যাখো, উঠে আসছে যুধিষ্ঠির ছায়ার মতো


হাতে মহাপ্রস্থানের দলিল হায়ারোগ্লিফিকে লেখা, এক অবৈধ দ্বিভাষী দরকার
মৃত মুরগির চামড়ার মতো কাঁকড়া বিছার অসুখটি চেপে রাখবে বুকের পাঁজরে
নৌকার আয়ু এত কম হওয়ার কথা নয় তারা, পারাপার জুড়ে দিয়েছে প্রবাল নেশায় শববাহী গাড়িতে করে আত্মারা ছুটে যায় ধূপ গন্ধের দিকে, ঘূর্ণাবর্ত ধোঁয়া, ব্রহ্মাণ্ড
মাটির ছোপকে ব্রহ্মাণ্ড বলা যায় কী ভাবতে ভাবতেই সাইকেলটির দুটো পাখনা গজিয়ে গেল সাইকেল আর রিমফিতার কোনো সমাধানসূত্র বের হল না
সাইকেলটির ব্রহ্মলোকে বিয়ে হওয়ার পর দুই শতাব্দী কেটে গেছে, জন্ম নিয়েছে একটি চিন্তিত নার্সের ভাঁজ করা কপাল
মৃত সাইকেলটির শরীর জুড়ে প্রাক্তন প্রেমিকারা নাচ জুড়ে দিয়েছে
রোদ এখন কোরিয়োগ্রাফার

Categories
2021-July-Poem

পায়েল দেব

জলশরীর থেকে


অসুখের শব্দে ঘুম খোলে
ভয় থেকে নুনজল বেয়ে কিছু বালিহাঁস, প্যাকপ্যাকানিতে খুলে যাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে সঞ্চিত খিদের মতো
বের করি
বাঁশের পালায় জমানো পয়সা
তামাটে বাতের বলয় বলয় আকৃতি

ঘুমের ভেতর যেতে চাইছি, অথচ গোঙানির শব্দ খুঁটে খুঁটে সব খেয়ে নিচ্ছে


তলপেট জুড়ে যে-শিশুটি শুয়ে আছে, তার খেলনার কথা ভাবি, হাততালি আসে, ধরে রাখি
এরকম রাতে একটি শ্রীমুখের আদল বানাতে চেয়েছিলাম
হয়তো পেরেছি

মায়েদের তলপেট আভা হয়ে লেগে আছে দূর দিগন্তে


বাবা দাড়ি কামাতে বসেন, শেইভিং কিটটির বয়স অনেক, গালের একাংশ ফুলিয়ে, গোঁফের একপাশ বেঁকিয়ে নতুন নতুন মুখ করে দেখেন— আয়না আসলে সুন্দর, বাবার বয়স হয়েছে, আয়নারও— মাঝে মাঝে ছেড়ে গেছে পারদ

দুব্বো ঘেরা উঠোনে হা-করে আমি আর ভাই বাবার ভঙ্গি দেখছি
শিশুদের খিলখিলে ভরে গেছে মায়ের রান্নাঘর


ধর্মকে অনুবাদ করতে বসব, কলম হয়ে দাঁড়াল ভারত, এত বড়ো দেশ কীভাবে ধরব ভাবছি, মধ্যমা আর তর্জনীর ভেতর বেঁধে গেল বিদ্রোহ, এবার ধীরে এলেন ধর্ম, ধারালো চক্র ছেড়ে দিলেন আর চোখের নিমেষে টুকরো টুকরো হয়ে গেল দেশটি

তাই আর অনুবাদ সম্ভব হচ্ছে না, আপাতত কলম খুঁজছি।


পিতামহীর দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বকটি
এক পা ছুঁয়ে নামছে দেশভাগ
অন্য পায়ে জড়িয়ে ঘটিবাটি

এমন বর্ষায় কতবার সব অপরাধ ধুয়ে মুছে গেছে
বক তবু ঠায় দাঁড়িয়ে


আমাদের ময়নাটিকে যে-রাতে বনবিড়ালটি ছিঁড়ে খেল
কী অপরূপ অন্ধকার
তুমুল ঘুমে, আমি কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে মাতাল


ঘরে তিনটি খাট, একটির পায়া ভাঙা, একটির ময়ূরের পেখম
অন্যটি সংগম শেষে ঘুম বেড়ে দেয়,
বাকি দুটো খেয়েদেয়ে নিজেদের নষ্টের ভেতর সটান শুয়ে থাকে।

Categories
2021-July-Poem

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়

গতানুগতিক

একদিন সমস্ত জঙ্গল ফুরিয়ে যাবে আর ধুলো থেকে অক্ষর তুলে তুলে আমরা চিঠি লিখব গতজন্মের। পাখির বাসার দিকে ছড়ানো হবে মনখারাপ। একটা ডিমের হলুদ আর একটা ডিমের হলুদকে ডেকে বলবে— রমণ আদতে একটা প্রয়োজন। ভালোবাসা দিয়ে তাকে ঢেকে রাখাটাই কৌশল।

পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাবে পুরানো রেডিয়ো স্টেশন। সন্ধ্যার দিকে বিষাদ বাজবে খুব। থান ইট মাথায় দিয়ে আমিও শুয়ে পড়ব নির্ভার। শুধু তুমিই জানবে না—

দিগন্ত দীর্ঘ হলেও, বানানে হ্রস্বই লেখাটাই বিধি।

অনিবার্য এই ফেরা

মাঝরাত্তিরে উড়ে আসে গোলাপিমাথা হাঁসের দল। পুরানো ডাকবাক্স ভেঙে ঠুকরে খায় মরে যাওয়া চিঠির অক্ষর। জোনাকিহীন এই অন্ধকারে জেগে থাকে যে-সব বাতিস্তম্ভ, আসলে তারা ছায়াহীন। জল ঘুমালেও, তৃষ্ণা জেগে থাকে। হাঁসেরা নেমে আসে প্রেমিকার মতো— মুখে, ঠোঁটে, বুকে। স্মৃতি পর্যন্ত ঝলমল করে ওঠে।

মৃতদের নাম ধরে ডাকে। ডানা থেকে গড়িয়ে নামে আঁধার তরল। কুয়াশায় পালক ফেলে রেখে— এভাবেই অনিবার্য ফিরে যায় শোকপ্রস্তাবের ভেতর।

যে-আঘাত আনন্দের অধিক

সংলাপের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে গমখেতের সংযম। মেধা থেকে মনন পর্যন্ত দীর্ঘ মাংসপথ, বিষপিঁপড়ের ছায়ার মতো সরল ও জটিল। আপ্রাণ উচ্চারণ করি এমন আব্রু। ভাঙন লিখবে বলেই ছেঁড়া পর্দার পাশে আলজিভও শুয়ে থাকে নিরলস। হাওয়ারা শিথিল হয় নিম্নাঙ্গের দিকে। অন্ধকার পেরোতে পেরোতে অন্ধকারে এসে নামে শব্দ। আপাত যৌনতার কথা বলে। বলে সম্ভোগ ও সম্ভাষণ।

হে গোপন রক্তপাত, সর্বনাশের মতো তোমাকে সহ্য করি। আহত হই নন্দনের সাথে।

আত্মগ্লানি

ভেঙে যাওয়া কাঠের গোপনে গুলিয়ে ফেলেছি বিষণ্ণ সবুজ।

এই মরা চোখে অসম্ভব সন্ধ্যা নেমেছিল আর রক্তে উন্মাদনা ছড়িয়ে সেজে উঠেছিল দূরের রণভূমি। মৃত শিশুদের চোখ, ধসে যাওয়া বালির পাড়ের মতো ঠোঁট কিংবা পড়ে থাকা পাথরের বিষাদ পেরোতে পেরোতে হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রাচীন হাড়ের দামামা, নির্দ্ধারিত রণনিপুণতা।

বালিকার হাসির পাশে নক্ষত্র ডুবে গেলে ক্ষতি নেই। আমি চাই— সমস্ত ক্ষতচিহ্নের গভীরে আরও ভারী হোক এই আত্মগ্লানি।

ভিন-দোঁহার

ভাঙা হারমোনিয়াম আলগোছে তুলে রাখছে যুবতি বৈষ্ণবীর স্তনছায়া। তুলসীমঞ্চ পেরিয়ে সন্ধ্যা নামছে আশ্চর্য। এই আহ্নিকে আমাদের দেখা হল না বলে, অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে জোড়ভাঙা খরিস। দূরে সন্ধ্যামণি ফুটছে। একটা দুটো করে লাল পিঁপড়ে এসে জড়ো হচ্ছে তিলক চন্দনে।

ভাঙা কাঁসার করতালে কিছুতেই সুর মেলাতে পারছে না দোঁহার। নামগান থেকে শরীর ভিজছে না। শুধু গোপনে গোপনে ফুলে উঠছে শ্রীখোলের গর্ভ।

Categories
2021-July-Poem

মানিক সাহা

বৃক্ষকথা

ইদানীং আমি আর খড়গোশ হতে পারি না
ঘাস সবুজ হয়ে পড়ে থাকে
ঘাস হলুদ হয়ে পড়ে থাকে

মাটি সরিয়ে দেখি
এতসব দানাপানি, সাজিয়ে রাখা আতরের শিশি
রং-করা টিনসেল, খেলার জন্য নরম তুলতুলে দুটো বল
এ-সব আমার ভোগ ও বিলাসিতার পাপ
এতদিন পর এইসব বুঝতে পেরেছি

আলোর কবর থেকে উঠে আসছি বৃক্ষের মতো

গাছ আমার প্রিয় সহচর
সে আমাকে অক্ষর চিনিয়েছে।

অন্ধত্ব

নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একা হয়ে আছি

মাটি ও জলের সংসারে মানুষ একা হতে খুব ভয় পায়
কষ্ট পায়। আমিও পেয়েছি।

মানুষের কাছে আমার তেমন কিছুই চাওয়ার ছিল না।
হাত ও পা খুলে রেখে পুকুরে স্নান করেছি
পূণ্যবান হতে চেয়েছি
এবং আমার চোখদু-টি— সেই কুক্ষণে—
কোথায় যে হারিয়ে গেছে! খুঁজে পাইনি।
এতদিন ধরে তাই অন্ধ হয়ে আছি।

মুখোশ

ভাণ করার মতো ভালো একটা মুখোশ খুজেছি এতদিন
ঘাস কাটতে আসা এক বুড়ি আমাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে

একা মাঠে নেমে গেছি, পোশাক পুড়িয়েছি।তার ছাই দিয়ে
রঙিন পাখি বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছি আকাশে

গাছ চিনে চিনে পুরোনো মুখোশগুলি বাড়ি ফিরে গেছে।

নিরাময়

আমাকে যে বাড়িতে ফেলে তোমরা আলো হয়ে গেছ
কোনোদিন আমি তার আদরের কণামাত্র ভাগ চেয়েছি কি?

বৃক্ষের কাছে আমি আরোগ্য প্রার্থনা করেছি—
সে আমাকে ফুল-ফল, ছায়া ও নিরাময় দিয়েছে।

অথচ বারংবার আমাকে তোমরা এই বাড়িতেই ফেলে চলে গেছ
আমি তাই বাড়িটির বুক জুড়ে বৃক্ষের নিরাময় ছড়িয়ে দিয়েছি।

 

 

Categories
2021-July-Poem

অরূপরতন হালদার

আমি সেই ধুলো যা বিকারগ্রস্ত হয়ে আছে, আর সূর্যের অতিক্রমকামী আলো আমাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। এই সম্পর্কের মধ্যে তুমি ঢুকে পড়ো ও বিভ্রান্ত হও যেমন একটা ষাঁড় তার দৃষ্টির তির্যক আভায় দেখে লাল এবং ছুটে যায়। নারকীয় যা যা আছে তার সৌকর্য তোমাকে সুকুমারী এক ছায়ার কথা বলে ভুলিয়ে আনে সেই অসমাপ্ত প্রকৃতির মধ্যে, আর আদি ও অন্নপূর্ণা একাধারে খুলে যায়, এবং যতিচিহ্ন বলে তখন থাকে না কিছু, শুধু সাময়িক এক বিশ্রাম থাকে। তখন তামাকের স্বাদ আমাকে অতিলৌকিক এক পৃথিবীতে নিয়ে যায়, আর শাস্তিপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য প্রার্থনায় বসি আমি

হে বাসব, সমুদ্রঝড় বলো, বলো সেই আতুর আশ্রয়, কীভাবেই-বা আমি আমাকে আদমের পাপের কাছাকাছি নিয়ে যাব, আর নক্ষত্ররা গেয়ে উঠবে আমার জন্য। সব ভণ্ড, সুবাসিত সিঁড়িগুলো হাওয়ায় দোলে আর আমার মুখে এক প্রসন্ন হাসি খেলে যায়

হে পালিত পুত্র, মনে রেখো এই সীমানা যে অবোধ দিনের মধ্যে তোমাকে পেয়েছিল তার দেহ নিষ্কাম ছিল না, তবু তুমি সমস্ত আসবাব ত্যাগ করে যে খেলায় ফিরে যেতে চেয়েছিলে তার আরাধ্য আসলে তুমিই। এই পাবক, অস্থির ঠোঁট নিয়ে কেঁপে চলা প্যাঁচা ও অপার দেহবোধ ছলকে উঠেছিল নিয়তির ভেতর। তা তুমি প্রত্যক্ষ করেছিলে এনায়েতপুরের দরবেশের ম্লান মুখে। ছিন্ন কথিকাগুলি মরণের জল ছুঁয়ে ছিল কতকাল। আজ এই তূষ্ণীম্ভাব, এই মোহ গলে যাচ্ছে যে-শতরঞ্জের আগুনে সেখানে ক্ষুধার্ত কুকুরেরা কাঁদে। এই বিতৃষ্ণ জ্যামিতি ঘিরে আছে চৈতন্য আমার, অথচ সুগোল একটি পৃথিবী আমাকে প্ররোচিত করে, নিয়ে যায় দৈব অছিলায় যে-বনান্তে তার দহন আজ আর স্পর্শ করে না কাউকে

হে বলরাম, তোমার মুখনিঃসৃত অনন্ত সর্প আমাদের দমিত করুক। এই মেধা, ক্ষুন্নিবৃত্তির সকাল যেমন প্রমিত আজ তেমন আর কিছুই শ্রবণের এত অন্ধকার নিয়ে শব্দ বোনে না, কেবল অশক্ত মদিরা গড়িয়ে যায় নতমুখ চাঁদের শরীরে

আমার উন্মাদ উঠোনে তোমাকে দেখি, সে-দৃষ্টির মধ্যে ঘরের প্রলাপ, ছায়াময় বন্দর ঘুমিয়ে পড়েছে, আর এই সন্ধিক্ষণ বড়ো মমতাময়, চেনা শব্দদের ধরে ধরে চা গুমটিতে ডেকে নেয়। তারপর যে-আলাপ নামে ভূপালীর দেহে তেমন সকাতর নিদ্রাহরণী মেলে না সহজে। এই চুম্বিত শ্বাসাঘাত, আলেখ্যর নিরসন আমার কেন্দ্র যেন, তবু মাটির গর্ভ আমাকে ফিরিয়ে দেয় সে-করকমল, বিস্রস্ত হায়াসিন্থ। এই তো গোলাপের শেষ অশ্রু, পথের দাগ চলে গেছে অবোধ দিনের আলো পেরিয়ে, আর আমি যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই আমার তুরগ থেকে, তৃণশীর্ষ থেকে সে-ইতিহাস ভেঙে পড়েছে কবে এক তৃষিত নয়নপথে

কবেকার কুসুমপ্রস্তাব যে-অবরোহের কথা বলেছিল তা প্রকৃত দৈব নয়। স্তবকের প্রতিরোধ আমাকে সীমান্ত চিনিয়েছিল, আর সব শুভ নাম মুছে গিয়েছিল শুশুকের স্মৃতি থেকে। এ-যাবৎ নিসর্গ এভাবেই সমগ্রতা চেয়েছে, আর আমি ডুবে গেছি নিরাসক্ত জলে

এই মায়াগন্ধ, মুঠোভরা সূচের উদ্গাতা আমি আজ। লেবুফুল আসে, শৃঙ্গার যেন প্রাচীন বাঘ আমার বিছানায়। যে ছিঁড়ে ফেলা বাকলের সদ্য সহচর আমি তার কুয়াশামাখা বছরগুলো উড়ে যায় মেরুন অন্ধকারে, জল চায়, অস্ত্রের গৌরব দখিনা হাওয়ায় ঘোরে, ঘোরে নিরর্থ আলোয়। অদাহ্য কিছুই নেই বুঝি যে গোপনে সেইখানে তুমি তৃণাঞ্জন আজ, তবু মরুর ভেতর স্তব্ধ বালিয়াড়ি ঘড়ির অন্ধকার মুছে নিয়ে আসে। সহনীয় জিভের উপর যে-জয়ভেরী বাজে তা আমাকে একদিন নিয়ে যায় অশক্ত সমুদ্রের কাছে। হায়, চন্দ্রাভিলাষ! মারীচ, তুমি রক্তে থিতু হবার পরেও আমাকে ঘুরিয়ে মারে গলিপথে। এই ধাতু, এই বিযুক্ত হাওয়া, ঊর্ণাজাল থেকে ভেসে আসা মদ আমাকে সম্পৃক্ত করে, তারপর শ্রমণের পায়ের শব্দ আধোঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায় অবোধ পাখিটিকে মন্ত্রোচ্চারণে

সেই থেকে অপেক্ষা আরও বাষ্পময়। মোচনের নীচুস্বর সব বোঝাপড়া পার হয়ে শ্যাওলাপড়া, পিছল পথটি ধরে নেমে যায় চন্দনের বনে

আমি রোদের কৃষ্ণ অঞ্জন, স্নান সারি মৃদঙ্গের জলে, আর অসীম ঘুঘুটি উড়ে আসে কার্নিশে। অনেক নীচে আঁধারের পেয়ালা উথলে যায় যে-কোশে সে এক মুর্শিদ। বায়ুর স্থির হওয়া দেখি, দেখি তার রক্তে নিরসন হয় পায়ে লেগে থাকা ঘাসবিন্দু ও কাঁটার, আর স্বর্গীয় আপেলের বিভা মাটির নিঃসরণে মেশে। তোমাকে অপাঙ্গে দেখি, মুহূর্তের জল ছলকে যায় অজানায়, পেছনে বছরের লঘুতায় এলিয়ে পড়েছে স্বাদ; দুপুরের বিবশতা মৃদু সখ্যের কথা ভুলে চলে গেছে ভাঙা জাহাজের কাছে

তোমার পায়ের নীচে ধুলো দেখে স্তব্ধতা মঙ্গলময়, আর সহজ যে-পথ তার ছায়া পড়ে দক্ষিণ উপকূলে। করুণার স্তন কাঁদে বারুণী রাতে, পা ডুবে গেছে কবে হিমঠান্ডা জলে। এখন এক-একটা গুপ্তহত্যা যে-সান্নিধ্যের কথা বলে তার জন্য কোনো পানপাত্র পড়ে নেই আর। হে নির্বন্ধ, তোমার দৈবপ্রহরগুলো খুলে দাও, রিপুর বিনাশকাল ফিরে এল গঙ্গাসকাশে