Categories
2021-July-Poem

দেবজ্যোতি রায়

শারীরিক

কুন্তল, পাহাড়ি নদী। মেঘে সোহাগসিদুঁর।
সিল্কের খসখস। মোম গলে যায়।

স্টেশন, অলস ট্রেন। নির্জন কামরায়
অন্ধগায়ক।

আড়মোড়া ভাঙছে রাত্রি
খোঁপা থেকে খসে বেলকুঁড়ি।
সুগন্ধ জড়িয়ে ধরে বিছানা, চাদর
সুগন্ধছায়ায় আমি রিটার্ন টিকিট হারিয়ে ফেলেছি

জঙ্গলের ত্রস্তপথ। পাতা ঢেকে রাখে শ্বাপদের থাবা

অস্ত্র, শাণিত পাপড়ি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রূপকথা জাগে
মখমল বিছিয়ে রাখে নিভৃত শরীর
তুমি বায়ুভূত, তুমি জ্বলন্ত সাকার

মুঠোয় লাগাম টাঙাওয়ালির
স্নান করো আদিম হ্রেষায়।
অলৌকিক কক্ষপথে আপেলবাগান।
তুমি আকাশযানের মতো উড়ে যাও
তোমার আশ্চর্য পিঠে নক্ষত্রভ্রমণ করছে
রোমাঞ্চিত হরিদাস পাল।

শিলাপুষ্প

বনস্পতির ডালে, ওষধিলতায়
তুমি আছ,
জ্ঞানযোগে, অবিদ্যামাদকে।
উপনিষদের পাশে ফ্রয়েড, ইয়ুং
তোমার জিভেই সায়ানাইড, আগুনের শিখা।

তুমি কি পর্বতশৃঙ্গে পোশাক বদলাও?
অবতলে নেমে আস, বরফকিন্নরী
ডানা ও বাতাসে গূঢ় বোঝাপড়া!

তুমি সহজযানের সূত্র
সমুদ্রতরঙ্গ থেকে তুলে আনো ফুসফুস
মৃত নাবিকের।

কল্পবিজ্ঞানের মতো তোমার বিস্তার
শক্ থেরাপির স্রোত

আমার প্রত‍্যঙ্গ কাঁপে বিদ্যুৎছোবলে

ভেসে আছি জল কেটে কেটে
আশ্চর্য সন্ধানে
কোথায় শস্যের গোলা, টিলা, খাদ,
মধু, পাপ, শিলাপুষ্প, হলুদ পরাগ?

মহামহিমান্বিতকে

ঘড়ির কাঁটা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরছে
কেশব নাগকে বিহ্বল করে বদলে যাচ্ছে অঙ্কের
সূত্র-সমাধান
থালা থেকে উড়ে যাচ্ছে রুটি অভিকর্ষের বাইরে

ভয়ে ভয়ে জড়ো হলাম লঙ্গরখানায়,
বুড়ো বটগাছের নীচে
মরা মোষের দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় হাওয়ায়
স্তম্ভিত আকাশে ঝুলছে মুণ্ডমালা
আমরা শনাক্ত করতে পারছি না
ধড়বিচ্ছিন্ন মাথাগুলি।
থ্রি-নট-থ্রি বুলেটের মতো চাঁদ পাক খাচ্ছে
অন্ত্রে, পায়ুপথে।

বন্ধ কারখানা-শ্রমিকের খিদে
সুখলালের পাথর বসানো চোখ
নিহত জঙ্গির চিঠির বয়ান—
মাংসাশী ফুলের শিল্পে ফুটে আছে রক্তের গভীরে।

আমাদের আর একবার দেখা হবে
শাণিত চপারের নীচে
শ্রেণিচেতনার পাঠ ছড়িয়ে পড়বে
হাজারিবাগ জঙ্গল থেকে ছিন্নমস্তার মিথে,
সাংখ‍্যযোগে শোনা যাবে বলির বাজনা
ভীমসেন যোশীর মালকোশে পথশিশুর কান্না।

পথ

পথের দূরত্ব নিয়ে কথা হল, তর্কও হল
প্রতিযুক্তি উড়ছে বাতাসে
আসা ও যাওয়ার মধ্যে চিরকালই
একটি নদী থাকে।
মহাপ্রস্থানের পথে অদৃশ্য কুকুর থাকে, অনুষঙ্গময়

নৌকো থাকবে কিনা, দোলনাবাহক
কোহলপ্রত‍্যাশী বন্ধু, ফুলমালা স্মৃতি, ন‍্যায়, বেদান্তদর্শন?
এ-সব প্রশ্নের মধ্যে ড্রপসিন আবার নামুক
নীরবতা, পজ্

পথই তদন্তসূত্র, ঢেউ, চোরাবালি
নিয়তি হাতের ছাপ রেখে গেল জানালার কাচে
ওপারে কুয়াশাঘেরা ধূসর পাহাড়
মুসাফির হেঁটে যান

শিকারির খাদ্যনালি ছিঁড়ে
অরণ্যসংহিতা লেখে নির্মম শিকার
এও এক পথের মাহাত্ম্য!

জানালার এপাশে, মুক্তিপদ মাস্টারের ঘুম পায়
নাইট ল‍্যাম্পের আলো
তার মনে হয়—
পথের রহস্য আছে, হিংসা ও পক্ষপাত আছে
জ্ঞান ও মূর্খতা-সহ আবর্ত, তুলোর গদি, ছারপোকা
কী নেই পথের?

উজ্জ্বল নিশান ওড়ে,
ভাড়া ফাঁকি দিয়ে তীরে পৌঁছোনোর কূটাভাস
তবু পথ ঢলে পড়ে নিমিত্তের দিকে
তার ভবিতব্য লেখে পথযাত্রী, যুগান্তের
রাতজাগা পাখি।

শ্রমণ

এই ঋতু কাব্যধর্মী
উপমা, রূপকে বহমান।

পার হল রূপনগরের গহন পরিখা

শ্রমণের কাঁধে বোঝা
সময়ের, কার্যকারণের

ক্রমশ পায়ের শব্দ গুম্ফার দিকে
শরীরে পতঙ্গ ওড়ে, পাখি বসে, মাছ ঘাই মারে
যেন সাক্ষাৎ প্রকৃতি।
শোনা যায় প্রার্থনাসংগীত

চলেছে শ্রমণ
তার ছায়া ধীরে ধীরে মোহহীন, শান্ত, নিরাকার।

Categories
2021-July-Chitrakala

সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

সিরিজ নাম: গ্রহণ

মাধ্যম : কাগজের ওপর জলরং.
সাল: ২০২১

মরেও মরিনি আজও লিখে যাই হাই তুলি ঘুমোই ও ঘুম থেকে উঠি
ফুটপাথে হেঁটে যাই মনে হয় শরীর ছিল না কোনোকালে
আমার পোশাক শুধু হেঁটে চলে ভিড়ের ভেতর
বন্ধু বলে কিছু নেই আজ আর, যা ছিল তা অতীত জীবনে
স্মৃতি মরে গেছে, আজ চপ্পলের মতো এক সহনশীলতা নিয়ে ঘোরাফেরি করি
যখন ঘুমোই জাগে স্তন, কার স্তন ঠিক ঠাহর করি না
অচেনা পঞ্চম নারী আমার পাতালসখী
দূর অন্ধকারবর্ষে শুঁড়িপথে টেনে নিয়ে যায়
সিরসিরিয়ে ওঠে হাড়, পাদু’টো অবশ, মাথাভর্তি নীল মেঘ
বেঁচে থাকা থেকে দূরে বহু দূরে এই দেশ, নগ্নতাকে তুচ্ছ মনে হয়

তুষার চৌধুরীর ‘পত্রমর্মরের দেশে’

Categories
2021-July-dharabahik

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


বিকেল মুছে দিয়ে সন্ধ্যের মায়া সবে ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে, মানে নগর কলকাতায় সন্ধ্যা যতটুকু আদল পায় হ্যালোজেন আলো চিরে, সেই ততটুকু মায়া যখন নাগরিক মানুষকেও আনমনা করে তুলছে, এমনকী দোকানে বসা রূপাকেও, তখনই নীল আলোর হঠাৎ ঝলকানি রূপার দোকানের সাঁঝমায়াকে তছনছ করে দিল! রূপা সচকিত হয়ে দেখে মেয়র পারিষদ আব্বাসের এসইউভি গাড়ি রাস্তার ভিড় সরিয়ে ছুটে চলে গেল পলকে। সাঁঝের মায়ায় আচ্ছন্ন রূপা সে-নীলে আরও আনমনা যেন।

আব্বাসউদ্দিন— মেটিয়াবুরুজের বেতাজ বাদশা! ডক অঞ্চলের ডন। মাফিয়া। তবুও সরকারি গাড়ি, নীল আলোর বৈভব-বিভা! রূপা ভাবে অভ্যস্ত হাতে কাজ সারতে সারতেই। কাচ্চি সড়কে আস্তানা আব্বাসের। সে-ওয়ার্ডের বরাবরের কাউন্সিলার সে। এবং নির্দল। তবুও সরকারি তাজ তার মাথায় বরাবর। এমনই প্রভাব, এমনই নিয়ন্ত্রণ তার তামাম এ-এলাকায়। সে-ই ঠিক করে দেয় এখনকার এমএলএ কে হবে। বিরোধী দল, নাকি সরকারি দল! এখন যেমন মেটিয়াবুরুজের এমএলএ বিরোধী দলের। আব্বাসের বরাভয় যেহেতু তার ওপর, তাই। যেহেতু এমএলএ বিরোধী হলেও মুসলমান। যদিও সরকারি লাল পার্টির প্রার্থী ছিল পার্টিরই দোর্দণ্ডপ্রতাপ জোনাল সেক্রেটারি প্রদীপ রায়। হিন্দু! তাছাড়াও এলাকার উড়ো কথায় একটা মৌখিক সিলসিলার কিস্‌সাও ভেসে উঠেছিল। সুতরাং সবক— এ-জবানটিও লেপ্টেছিল সে-কিস্সায়। আবার আব্বাসের টক্করও যে কেবল প্রদীপ রায়ের সঙ্গেই— সাম্রাজ্যের দখলদারিতে! মেটিয়াবুরুজে সত্তর শতাংশ মুসলমান হলেও, মুসলমানদের সত্তর শতাংশ আবার বাংলাভাষী মুসলমান। হিন্দু এলাকা তো বটেই, এমনকী বাংলাভাষী মুসলমান এলাকায়ও লাল পার্টির প্রবল প্রভাব, আর লাল পার্টি মানেই তো প্রদীপ রায়! এবারে প্রদীপ রায় দাঁড়াবে শুনে আব্বাস মস্ত চাল চেলেছিল। এক বাঙালি দর্জি মুসলমানকে বিরোধী প্রার্থী করে সে। তবুও নির্দল আব্বাসের মাথায় সরকারি নীল তাজ। রূপার মনে ভাবনারা বুজকুরি কাটে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে লোকটা নিজে কোনোদিন এমএলএ পদে দাঁড়ায় না। নিজের ওয়ার্ডের কাউন্সিলার হয়েই সন্তুষ্ট থাকে সে বরাবর। তবুও সে এলাকার বেতাজ বাদশা! কিং-মেকার!

রূপা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। সে-অবসরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। ভাবনারা ভেসে আসে আবারও। মস্তান, ডন, মাফিয়া আব্বাস আজ নেতা! সরকারি বিভা তার মাথায়। অথচ তার কৃষ্ণ…! সন্ধ্যার মায়া মুছে রাত গুঁড়ি মেরে কখন যে গেঁড়ে বসেছে দোকানে রূপা জানতেই পারে না।

খদ্দেররা আসে, যায়— দোকানে জমাট রাতের অন্ধকার ঠাই নাড়া হয়। অন্ধকার চলাচল করে রূপার মনেও।

সেদিনও ছিল অন্ধকার থকথকে গাঢ, কেন-না নাইট শো তখন শেষ হয়েছে। আব্বাসের দলের চারটে ছেলে সিনেমা শেষে হল থেকে বেরোবার মুখে দেওয়ালে পানের পিক ফেলে। কৃষ্ণর তো ঠেক রূপশ্রী সিনেমা হলের উলটো দিকের কানা গলিটায়। খবর ওড়ে, বাতাস পায়— মুহূর্তে পৌঁছে যায় কৃষ্ণের কানে। কে না জানে যে— রাজারা কান দিয়ে শোনে। কৃষ্ণের হিলহিলে শরীরটা তড়াক দেওয়া সোজা, খাড়া। হাতে অস্ত্র নিমেষে এঁটে বসে। চারটি ছেলেকে কৃষ্ণ শাস্তি দেয়। তবে চরম না তা, কেবল একটা শিক্ষা, একটা চেতাবনি যে, এ-এলাকা কৃষ্ণের। যাবতীয় বেয়াদপি তোমাদের পাড়ায়— পিসন, খাতুনমহলে করো, এখানে হার্গিস নয়!

যদিও সে-রাত সেখানে শেষ হয় না, বরং তা আরও পিচ্ছিল ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে। আধঘণ্টাও না— রূপশ্রী হল চত্বর ঝলসে ওঠে উপর্যুপর ঝলকানিতে, যার ফেউ হিসেবে আসে ভয় জাগানো আওয়াজ— বুম! বুম! বুম! বোমার আঘাতে রাত জেগে ওঠে। আব্বাসের দল জানান দেয় নিজেদের। বুম বুম শব্দে এই প্রথম এ-পাড়ার রাত নিশির ডাকে জেগে ওঠে, ভয়ে কাঁপে, জানলা ঝটঝট ছিটকিনি আঁটে!

তবে যেমন গর্জাল তেমন বর্ষাল না। থেমে গেল আচমকা সে-যুদ্ধ। কেন-না উলুখাগড়া এক— তার প্রাণ গিয়েছিল সে-যুদ্ধে, যুদ্ধের প্রারম্ভেই। শ্রীকান্ত পোড়ে— চাকরি না পাওয়া ভালো ছাত্র, যেহেতু ভালো তাই নিরীহও, টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল ঠিক সে-সময়েই। সে নিরীহ উলুখাগড়া না জেনেই যুদ্ধের মাঝে পড়ে যায় এবং তার মাথার আধখানা উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের বন্ধ শাটারে ঘুঁটে হেন হাসতে থাকে যেন! যা জনহীনতা আনে। ফলে নির্জন, নিস্তব্ধ রাত কেঁপে উঠে হা-হা হেসে ওঠে। হাসি মোচড় দেয়, ঘূর্ণি তোলে— সে-ঘূর্ণির টানে রাত থকথকে পাঁকপিচ্ছিল। হ্যাঁ, কৃষ্ণ জমানায় প্রথম সে-পাড়ায়। এবং শেষও। যেহেতু ভদ্র-নিরীহ পাড়া, তাই পার্টি নামক অলোখ-অমোঘ শক্তি তত্ক্ষণাত্‍ হস্তক্ষেপ করে। আর বাংলা তখন লাল রঙে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত, শ্বাসরুদ্ধ তাই। মেটিয়াবুরুজও তার ব্যতিক্রম নয়। যতই এখানে বিরোধী দলের এমএলএ থাকুক না কেন, সে যেন মাটির দুর্গে অন্তরীণই, শুধু তাজটুকুই সম্বল— যেমন ছিল নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্‌ তার তাজটুকু সম্বল করে অন্তরীণ তারই নিজের হাতে গড়া মেটিয়াবুরুজে!

এখন লাল রং যেমন প্রাণেরও, তেমনই ভয়েরও প্রতীক। যে-ভয়ে সে-হত্যার সাক্ষী কেউ থাকে না। আব্বাস-কৃষ্ণ, উঠতি চরিত্র দু-জনেই পার্টির আশ্রয় পায়। প্রভুভক্ত পুলিশও অতএব নাক শুকে চলে যায়— দোষী ধরা পড়ে না। নামহীন কয়েকজনের নামে এফআইআর হয়, যেমন দস্তুর! যারা ফেরারও নাকি! আর তখন পার্টি, মানে প্রদীপ রায় এ-রায়ে শীলমোহর দেয় যে, হিন্দু এ-পাড়া কৃষ্ণের আর উর্দু জবানের কাচ্চি সড়ক-বাত্তিকল-ধানখেতি-আয়রন গেট এলাকা আব্বাসের। যদিও এ-চুক্তি আগে থেকেই অলিখিতভাবে জারি ছিলই, তবুও এবারে তাতে পার্টি, মানে প্রশাসনের শীলমোহর দেগে বসে পাকাপাকিভাবে।

সেই থেকে কৃষ্ণের এ-অঞ্চলে কি-বা রাত, কি-বা দিন থকথকে পাঁকপিচ্ছিল হয়নি আর কখনো। তবে হিলহিলে চোরা ভয়ের স্রোত বইতো নাকি মানুষের মনে! বইলেও মানুষ সে-ভয়কে গিলে নিত মনের অন্ধকারে, চোখে ফুটে উঠতে দিত না। হ্যাঁ, ভয়েই!

তখন রূপা কিশোরী— স্কুল বালিকা। থোকাবাঁধা হলেও স্কুলবালিকা তারাও তো তখন অকারণ মাথা নামিয়েই বাক্হা‌রা ত্রস্ত পায়ে পেরিয়ে যেত রূপশ্রী তলা ইশকুল যাতায়াতের পথে। কেমন একটা শিরশিরানি স্রোত যেন হিলহিলিয়ে উঠতে থাকত শিরদাঁড়া বেয়ে! কিন্তু কেন জানে না সে আজও। হয়তো রাজার দরবারের সামনে দিয়ে যেতে গেলে মনে যে-ভয় সমীহ আঁকে, তাই-ই তা! জানে না রূপা আজও। যদিও কৃষ্ণের শাসনে এ-এলাকায় শান্তিই তো বিরাজিত করত, অন্তত যতদিন সে বেঁচে ছিল ততদিন! যদিও হাওয়ায় ফিশফিশানি এ-রব চোরা বইত যে, সে ছিল শ্মশানের শান্তি!

কিন্তু আজ? কিংবা কৃষ্ণের মথুরাজয়ের আগে! রূপা যান্ত্রিক অভ্যাসে খদ্দের সামলাতে সামলাতে আঁচল দিয়ে মুখ-গলার ঘাম মোছে। সে-নরম প্রশ্রয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রূপার বুক চিরে, যা অন্ধকার ঘনিয়ে তোলে রূপার মনে আরও। ফলে দোকানে রাত ঘন হয় যেন।


আজকে পার্টির বিশেষ মিটিং আছে বোধহয়। পাশের পার্টি অফিসের মুখে সাত সকালেই জটলা। ফলে রূপার চায়ের দোকানেও ভিড় বেশ। রূপা হিমসিম খায় যেন একা হাতে। হারুর কথা মনে পড়ে— থাকলে ভালোই হত। কিন্তু…। তবুও কিন্তু শব্দটা বাস্তবতা আঁকে। এ-ভিড় তো দু-এক মাসে একবার হয়তো। বাকি দিন তো ফাঁকাই। পথ চলতি লোক বা রিকশাঅলা দু-একজন। এই তো খদ্দের। নিজেরই চলে না, তো হারুকে পোষা! হাতের ব্যস্ততার সঙ্গে রূপার মনও নড়েচড়ে। হ্যাঁ, তখন ছিল বটে দিন, যখন রূপশ্রী গমগম করে চলত। খদ্দের সামলাতে হারু হিমসিম খেয়ে যেত। অন্দরে হেঁসেলে ঠাকুর টোস্ট সেঁকে, ভেজিটেবল-ডেভিল ভেজে কূলকিনারা পেত না। সঙ্গে চায়ের জল তো একটা উনুনে ফুটেই চলেছে, ফুটেই চলেছে অনবরত! অতীতচারী রূপা মনে মনে সে-ছবি ফুটিয়ে তুলতে থাকে অভ্যস্ত ছন্দে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই। সে-বিগত ছায়া দেখতে চেয়েই সে যেন বাইরে উদাস চোখ মেলে ধরে। আর অমনি সাদা এক আম্বাসাডার গাড়ি এক প্রবল ধাক্কায় রূপাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে। সে-সাদা গাড়ি থেকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির কালো কুচকুচে লোকটা নেমে আসে। ওই নামাটুকু মাত্র— সঙ্গে সঙ্গেই পার্টি অফিসের মুখের জটলাটা ঝাঁক বাঁধে লোকটাকে ঘিরে। এক কমরেডের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে চলে লোকটা ধীর-নিক্তি মাপা পায়ে পার্টি অফিসের দিকে। প্রদীপ রায়— পার্টির জোনাল সেক্রেটারি। মেটিয়াবুরুজের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র! তার চিকন কালো হাতের ছোঁয়া কাঁধ দেওয়া কমরেডের মুখে কৃতার্থের ছবি এঁকে দেয় নিমেষে। মুহূর্তে সে-বিগলিত মায়া জাদু করে জোটবাঁধা বাকি কমরেডদের, কেন-না সবার মুখেই কৃতার্থের বিগলিত হাসি ঝুলে থাকে, যেন-বা লোল পড়-পড়! কেউ কেউ মনে মনে ইনকিলাব জিন্দাবাদ— এ-শ্লোগানও দিয়েছিল বোধহয়, নইলে চারতলা পার্টি অফিসের মাথায় টাঙানো ন্যাতানো লাল পতাকাটা হঠাত্‍ হাওয়ায় পত্‌-পত্‌ করে উড়বেই বা কেন ঠিক সে-সময়েই! যদিও কেউ দেখে না তা। শুধু রাস্তার উলটো দিকের দেওয়ালে আবছা হয়ে আসা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করুন— এ-বৈপ্লবিক শপথখানি তা দেখে এবং আরও একটু অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে পার্টির এ হেন প্রতাপে!

এ-দৃশ্যে দীর্ঘশ্বাস জমে রূপার মনে এবং তা তার বুক চিরে বেরিয়েও যায় সে-লহমাই, শুধু এক-একটুকরো ছবি ভাসিয়ে দিয়ে! তখন স্কুলবালিকা। তখন জরুরি অবস্থা পেরিয়ে গাই-বাছুরকে তাড়িয়ে কাস্তে-হাতুড়ির লালরাজ সবে মৌরসিপাট্টা কায়েম করেছে। তবুও গোরুর রাখাল সবুজ যুবাদের প্রতাপের রেশ সবটুকু মুছে যায়নি। ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড রোডের মথুর সিং তখনও তোলাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। এবং পুলিশের যোগ সাজসেই বোধহয় তার প্রতাপ ক্রমশ ক্রমবর্ধিত হতে থাকে, কেন-না মথুর সিং তখনও তো সবুজ রঙাই! এবং কাস্তে-হাতুড়ির লালরঙে তখনও আদর্শের মায়া। আবার যেহেতু ক্ষমতার ধর্মই হচ্ছে তার বিস্ফার, সে-কারণেও হয়তো সে, মথুর সিং ময়লা ডিপো, ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড, ফতেপুর ছাড়িয়ে তার রাজত্ব বিস্তার করে বাঁধা বটতলা, রূপশ্রী সিনেমা হল পর্যন্ত। মাঝে মাঝেই রাত-বিরেতে বোমার আওয়াজে কেঁপে ওঠে এ-তল্লাট। এবং তা অকারণেই কেন-না রাজ কায়েম করতে হলে অস্ত্রের, যা ক্ষমতার চিহ্ন, তার প্রদর্শন করতেই হয়।

আর তারপর সিনেমায় যেমন হয়, তেমনই হয়। উঠতি যুবা, কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি কৃষ্ণ, নেতৃত্ব যার সহজাত— সেই কৃষ্ণ মথুর সিং-এর দলবলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন মথুর সিং-এর দু-জন সাকরেদকে পাড়ায় দেখতে পেয়ে ক্লাবের ছেলেদের জুটিয়ে তাড়া করে। প্রথমটাই বাহুবলী দু-জন এমন অভাবিত ঘটনায় আশ্চর্যই হয় যেন। কেন-না নিরীহ ডরপুক বাঙ্গালি-আদমি তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে— এ তাদের ভাবনাতেই ছিল না। ফলে কোমরে গোঁজা অস্ত্র বার করতে গিয়ে জলদিতে হাত একটু কেঁপে যাওয়ায়, কিংবা দেশি ওয়ান শটার বেইমানি করেও হয়তো সে-ক্ষণে, তাই ছুটন্ত তাদের পিস্তল হাওয়াতেই গুলি উগড়ে দেয়। বা ইচ্ছে করেই হয়তো শূন্যে গুলি ছোড়ে নিতান্তই ভয় দেখাতে পেছনে ছুটে আসা ডরপুক নাদান বাঙ্গালি বাচ্চালোগোঁকে! কিন্তু অবাক তারা দেখে যে, বাঙালিবাচ্চারা ভয় না খেয়ে দৌড়েই আসে তাদের দিকে। আগুন উগড়ে সে-মুহূর্তে খালি ওয়ান শটার পিস্তল— তাতে গুলি ভরতে তো সময় লাগবে এবং গতিও শ্লথ করতে হবে। এরকম দোনামনা ভাবনাই হোক, বা পিস্তলে গুলি ভরতে চেয়েই হোক, তাদের গতি ক্ষণিকের জন্য শ্লথ হয়ই যেন। হয়তো-বা এমন অভাবনীয় কাণ্ড তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, তেমনটাও হতে পারে। মোদ্দাকথা তাদের গতি সে-ক্ষণে তেমন তীব্র ছিল না, বা আপেক্ষিকভাবে পেছনের ছুটন্ত জনতার গতির তীব্রতা বেশিই ছিল হয়তো! যাই-ইহোক, দড়াম করে একটা আধলা এসে আছড়ে পড়ে ছুটন্ত বাহুবলীর একজনের পায়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। অন্যজন সঙ্গীকে বাঁচাবে, না নিজে বাঁচবে আগে— এই দোটানায় ক্ষণিক থামেই যেন। ফলে কৃষ্ণর যাদব-বৃষ্ণী বাহিনী তাকেও পেড়ে ফেলে মুহূর্তে। আর জনতার মার দুনিয়ার বার— সেহেতু এক মস্তান নেতিয়ে পড়ে খাবি খেতে খেতে শেষ হাওয়া টানে বোধহয় সেখানেই। অন্য জনকে পুলিশ এসে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে ঘণ্টাদুয়েক পার হয়ে যায়। কেন-না রাস্তার পুবপাড় কলকাতা পুলিশের দখলে, আর পশ্চিমপাড় বেঙ্গল পুলিশের কব্জায়। ফলে কে হ্যাপা পোয়াবে এ-মীমাংসাতেই ওই ঘণ্টা দুয়েক সময় যায়। এবং ফিতে মেপে দেখা যায়, যে মারা গেছে সে কলকাতা পুলিশের আওতায়। আর যে তখনও মরেনি সে বেঙ্গল পুলিশের ছায়ায়। দু-পুলিশ দু-জনের দায়িত্ব নেয় আলাদা আলাদাভাবে। ফলে কেস দাঁড়ায় না। অশনাক্ত জনগণের নামে দু-থানায় দু-টি এফআইআর হয়। সময়ের সাথে ক্রমে সে-কেস ধামা চাপা পড়ে যায়।

এবং কেস ধামাচাপা পড়তে দেওয়া হয়, কেন-না লাল রাজত্বের বিপুল শুরুয়াতের দু-বছর পার হয়ে গেছে তখন, মরিচঝাঁপি নামক শাসকের সুশাসন কিংবা সন্ত্রাসও ঘটে গেছে ততদিনে, সেহেতু লাল রং একটু রংজ্বলা যেন-বা। আর সে জ্বলে যাওয়া লালে প্রতাপান্বিত প্রদীপ রায় স্বয়ং কৃষ্ণকে ছায়া দেয়। যে-খেলায় কৃষ্ণের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বিবেচ্য বিষয় হিসাবে থাকতে পারে না, যেহেতু ক্ষমতার রাজনীতি কথাটাই শেকড় গাড়ে! থকথকে কালো সে-ছায়ার মায়ায় অতি সাধারণ, আম-কৃষ্ণ লহমায় অসাধারণ হয়ে ওঠে যেন। ক্ষমতাভিষেক হয় তার পার্টির ছত্রছায়ায়। মথুরাপতি রাজা কৃষ্ণ যেন সে। কেন-না কালো সে-ছায়া মথুর সিংকে গিলে নেয়। এতদিনে পুলিশ খুঁজে পায় তাকে! ফলে এদিকে মুদিয়ালি থেকে ফতেপুর সেকেন্ড লেন, রূপশ্রী হল, বাঁধা বটতলা, তা ছাড়িয়ে ফতেপুর, ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড রোড, সিমেন্ট কল মোড় হয়ে রামনগর পর্যন্ত একছত্র রাজ যেন কৃষ্ণের। আর কে না জানে যে, ক্ষমতা মানুষের চেহারায় একধরনের জেল্লা আনে। লোকে কৃষ্ণের মাথার পেছনে বিভা দেখতে পায় যেন। সে-বিভা সমীহ আঁকে মানুষের মনে। যা অচেনার দূরত্ব তৈরি করে হয়তো। তবু সে হেঁটে গেলে মানুষ বিহ্বল কথা থামায় আচমকা, কেউ-বা গদগদে দেঁতো হাসি ঠোঁটে ঝোলায়। কৃষ্ণ উপভোগ করে তা। ক্ষমতা তাকে এটুকুও শেখায় যে দীর্ঘদিন রাজ করতে গেলে প্রজাপীড়ন অচল।মথুর সিং-এর পরিণতি কিংবা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অতীতই হয়তো তার মনে এ-বোধ আনে। না, এ-এলাকায় সে কোনোদিনই সাধারণ মানুষের ওপর কোনো জুলুম করেনি। আর সে থাকতে আর কারো সাহস হয়নি কোনোদিন কোনোরকম ফণা তোলার। আর তাই মানুষগুলো এখনও তার কথা বলে। রূপশ্রী হলের উলটো দিকের নামহীন কানা গলিটা, যেখানে তার ঠেক ছিল, তার নাম লোকের মুখে মুখে আজও কৃষ্ণের গলি নামেই পরিচিত। তার মৃত্যুর এতগুলো বছর পরেও!

আনমনা রূপার মন সহসাই আলো আঁকে তার মুখে। আবার ওপারের বাড়ি ডিঙিয়ে ফালি রোদ তার দোকানের দরজায় উঁকি মারে এই ক্ষণে, ফলে রূপার মুখে সে-আলো স্থায়িত্ব পায়। প্রদীপ রায়ের সঙ্গে সঙ্গে জটলাটা পার্টি অফিসে ঢুকে গেছে কখন, রূপার মন খেয়াল করে না তা। দোকানের হঠাত্‍ নির্জনতা তাকে বাস্তবে ফেরায়। কর্মব্যস্ততার অবসরে সে স্বস্তির শ্বাস ফেলার ফুরসত পায় যেন। কিন্তু কতক্ষণই তা! হঠাত্‍ এ-নির্জন অবসর আবারও অতীতকে আঁকে রূপার মনে, যা কৃষ্ণময়!

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

Categories
2021-July-dharabahik

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

অষ্টম অধ্যায়
তীর্থযাত্রীদল নদী পার করে উং ছাং দেশে এসে পৌঁছোলেন। এই দেশটি ভারতের একেবারে উত্তর দিকে। মধ্যভারতীয় ভাষাই দেশজুড়ে সার্বিকভাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যভারত মূলত চীনের মতোই। এখানকার মানুষের পোশাক আর খাদ্যাভ্যাস চীনের মানুষের মতো। বুদ্ধের প্রচলিত ধর্ম এখানে বেশ ঋদ্ধ। সন্ন্যাসীগণ যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তার নাম সেংচিয়ালান। সর্বমোট পাঁচশত সন্ন্যাসী আছেন। সকলেই হীনযান মতাবলম্বী। ভবঘুরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদল এসে পড়লে, তিন দিনের জন্য তাদের আপ্যায়নের সমস্ত দ্বায়িত্ব তখন সন্ন্যাসীদের উপর। তিন দিন পর তাদের স্থান বদলের আহ্বান জানানো হয়। কথিত আছে বুদ্ধ যখন উত্তর ভারতে আসেন তখন এই দেশেও তিনি এসেছিলেন। বুদ্ধ এখানে একটি পদচিহ্ন রেখে যান, যেটি ব্যক্তিবিশেষের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ছোটো আর বড়ো হয়ে প্রতিভাত হয়। এখনও এই পায়ের ছাপটি বর্তমান। যে-পাথরের উপর তথাগত তাঁর কাপড় শুকাতে দিতেন, যে-স্থানে তিনি দুষ্ট ড্রাগনকে রূপান্তরিত করেছিলেন। সবই এখন দর্শনীয় স্থান। পাথরটি চৌদ্দো ফুট লম্বা আর কুড়ি ফুটের বেশি চওড়া, একটি দিক মসৃণ। বুদ্ধের ছায়া অনুসরণ করে হুই চিং, তাও চেং, হুই তা নগরাহরা দেশের দিকে এগিয়ে চললেন। ফা-হিয়েন এবং অন্যান্যরা এই উ ছাং দেশেই বর্ষাকালটি অতিবাহিত করলেন। বর্ষা অন্তে আবার পথ চলা, আবার এগিয়ে যাওয়া অবিরাম দক্ষিণ প্রান্ত ধরে, যতদিন না সু হো তো দেশে এসে পৌঁছোনো যায়।

নবম অধ্যায়
বৌদ্ধধর্ম এ-দেশে জনপ্রিয়। পুরাকালে পবিত্র ইন্দ্র শক্র বোধিসত্ত্ব পাবার আশায় নিজেকে পারাবত আর শঙ্খচিলে রূপান্তরিত করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব, পায়রাটির বন্দিমুক্তিপণ হিসাবে নিজের শরীর থেকে একখণ্ড মাংস কেটে দেন। এবং সেই স্থানেই তিনি বুদ্ধ হিসাবে জ্ঞানের সর্বশেষ স্তরটি সম্পূর্ণ করেন। পরে তিনি যখন তার শিষ্যদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা পরিভ্রমণ করছিলেন, তখন এই স্থানটিকে চিহ্নিত করেন তার বুদ্ধত্ব লাভের স্থান হিসাবে। এভাবেই এখানকার সাধারণ মানুষ জায়গাটির বিশেষত্বের কথা জানতে পারে এবং স্বর্ণ, রৌপ্যে মোড়া একটি প্যাগোডা নির্মাণ করে।

দশম অধ্যায়
এই অঞ্চল থেকে যাত্রীদল পাঁচ দিন ধরে পূর্ব দিক বরাবর ক্রমাগত হেঁটে পৌঁছোলেন চিয়েন টো উই দেশে। এ-দেশের রাজা, সম্রাট অশোকের পুত্র ফা ই। বুদ্ধ যখন বোধিসত্ত্ব লাভ করেন, তাঁর প্রতিরূপ অন্য আর একটি জীবের উদ্দেশে নিজের চোখদুটো উৎসর্গ করেন। সেই স্থানেও সোনা, রূপা খচিত একটি প্যাগোডা নির্মিত হয়। এই দেশবাসীরা মূলত হীনযান সম্প্রদায়ের।

একাদশ অধ্যায়
এই স্থান থেকে পূর্ব প্রান্ত ধরে আবার এগিয়ে চলা। সাত দিন অবিরাম চলা শেষে এসে পৌঁছানো গেল চু চা শি লো (তক্ষশিলা) নামের একটি দেশে। চীনা ভাষায় এর অর্থ ছিন্ন মস্তক। বোধিসত্ত্ব লাভের সময় বুদ্ধ তার সহ-জীবের জন্য নিজের শির উৎসর্গ করেন। এই হল এ-দেশের নাম মাহাত্ম্য। তীর্থযাত্রীদলের পথ চলা শুরু হল আবার। আরও আরও পূর্বে এগিয়ে চলা কেবল। এবার দু-দিনের সফর শেষে তারা এক আশ্চর্য দেশে এসে থামলেন। এখানে বুদ্ধ একটি ক্ষুধার্ত বাঘকে খাদ্যের যোগান দিতে নিজের দেহ দান করেন। এই দু-টি জায়গাতেও মূল্যবান পাথর খচিত প্যাগোডা রয়েছে। সন্নিহিত প্রদেশ থেকে আসা রাজা, মন্ত্রী, সাধারণ মানুষের মধ্যে, পূজার অর্ঘ্য দান, পুষ্প দান, প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যেন বিরামহীন এক প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যেত। এই সবকয়টি প্যাগোডা, একসঙ্গে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্যাগোডা চতুষ্টয় নামে পরিচিতি পায়।

দ্বাদশ অধ্যায়
চিয়েন তো উই প্রদেশ থেকে দক্ষিণ দিকে একটানা দুই দিন ভ্রমণ করে যাত্রীদল এসে থামল ফো লু শা (বৈশালী) প্রদেশে। পূর্বে বুদ্ধ তাঁর সকল অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করেন এই দেশ। ভ্রমণকালে আনন নামক শিষ্যকে বলেন, “আমার নির্বাণলাভের পর এ-দেশের এক রাজা কণিষ্ক এই স্থানে একটি প্যাগোডা নির্মাণ করবেন।” পরবর্তীকালে কণিষ্ক তাঁর শাসনকালে রাজ্য পরিদর্শনে এলেন। পবিত্র ঈশ্বর ইন্দ্র শক্র কণিষ্কের মস্তিষ্কে একটি ভাবনার বীজ বুনে দিতে চেয়ে নিজেকে মেষপালক বালকে রূপান্তরিত করলেন। পথমধ্যে গড়ে তুললেন একখানি প্যাগোডা। রাজা বালকের কাছে জানতে চাইলেন, “কী করছ হে বালক?” বালক উত্তর দিল, “বুদ্ধের জন্য প্যাগোডা তৈরি করছি।” রাজা বালকের কাজের প্রশংসা করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই চারশো ফুট উচ্চতার একখানি প্যাগোডা নির্মাণ করালেন। মূল্যবান পাথর খচিত তার সারা অঙ্গে। তীর্থযাত্রীরা এ-পর্যন্ত যত মন্দির, প্যাগোডা দর্শন করেছেন, দার্ঢ্য আর সৌন্দর্যে এর তুলনীয় কিছুই নেই। সুমেরু পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত বিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপজুড়ে এমন প্যাগোডা বোধ করি আর একটিও নেই। এটিই সর্বোচ্চ। রাজা এই প্যাগোডা নির্মাণ সম্পূর্ণ করলে দেখা গেল এর দক্ষিণ দিক দিয়ে তিন ফুট উচ্চতার কিছু ছোটো প্যাগোডা উদ্‌গত হয়েছে। বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্রটি এ-দেশে রয়ে যায়। পূর্বে উয়ে শি (পুরুষপুর এর রাজা কণিষ্কের পূর্ব পুরুষ হুভিষ্কা)-এর রাজা এ-দেশ আক্রমণের জন্য এক বিশাল সৈন্যদল জড়ো করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের সেই ভিক্ষাপাত্র অপহরণ করা। যুদ্ধে পদানত করলেন এই দেশের রাজাকে। এর পর বৌদ্ধধর্মের তীব্র পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কারণে পাত্রটি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তদনুযায়ী তিনটি সম্যক বোধের (বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘ) প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করলেন সর্বপ্রথম। তারপর একটি বিরাটকায়, সুসজ্জিত হাতির পিঠে পাত্রটি রাখা হল। এরপর হল কী! সহসা হাতিটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে এবং আর উঠে দাঁড়াবার সাধ্য রইল না তার। এবার চারটি চাকা বিশিষ্ট একটি গাড়ি প্রস্তুত করা হল। পাত্রটি রাখা হল গাড়ির উপর। গাড়ি টানার জন্য আটটি হাতি জুতে দেওয়া হল। পুনরায় হাতিগুলি অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা হারালো। রাজা অনুধাবন করলেন, এই রাজ্যে পাত্রটির কালাতিক্রম সম্পূর্ণ হয়নি, তাই এই বিপত্তি। গ্লানি, অনুতাপের সীমা রইল না রাজার। ফলস্বরূপ এই স্থানে রাজা একটি প্যাগোডা নির্মাণ করালেন। আর সেইসঙ্গে একটি মঠ। পাত্রটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি সৈন্যদল নিযুক্ত করলেন, আর সমস্তরকম পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করলেন।

সাত শতাধিক সন্ন্যাসী সমবেত হলেন। মধ্যাহ্নে তারা পাত্রটি বাইরে বের করলেন। এবার সকলে মিলে নানা উপচারে অর্ঘ্য সাজিয়ে নিবেদন করলেন। পূজা অন্তে মধ্যাহ্নভোজন সারলেন সকলে মিলে। এর পর আসন্ন সন্ধ্যাকালে যখন ধূপ ইত্যাদি জ্বালাবার কাল উপস্থিত হল, তারা আবার পাত্রটি বাইরে নিয়ে এলেন। দুই গ্যালনের অধিক তরল এই পাত্রে রাখা যায়। বিচিত্র রঙের সমাহার আছে এতে, যদিও মূল রং হল কালো। আদতে বুদ্ধের নির্দেশে চারটি পাত্রজুড়ে এই বৃহৎ পাত্রটি তৈরি হয়। আর এই চারটি জোড় সহজেই পৃথক করা যায়। এক ইঞ্চির এক পঞ্চমাংশের সমান পুরু এই পাত্রটি স্বচ্ছ আর উজ্জ্বল।

ধনীর দেওয়া বিপুল ফুলের ঐশ্বর্য, শত, সহস্র, দশ সহস্র শস্যের নৈবেদ্যেও অপূর্ণ রইল যা, দীনহীনের ছুড়ে দেওয়া একটি দু-টি পূজার ফুলে পূর্ণ হয়ে উঠল তথাগতর সেই ভিক্ষাপাত্র। পাও উন আর শেং চিন শুধুমাত্র পূজা দিয়ে ফিরে গেলেন। হুই চিং, হুই তা আর তাও চেং পূর্বেই না শিয়ে প্রদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সেখানে বুদ্ধের দন্ত, করোটি আর ছায়ার উপাসনা করলেন তাঁরা। সহসা অসুস্থ হয়ে পড়লেন হুই চিং আর তাঁর শুশ্রূষা করার জন্যে তাও শেং রয়ে গেলেন সেখানে। হুই তা একাকী ফিরে এলেন ফো লু শা প্রদেশে। সেখানে বাকিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তাঁর। এখান থেকেই হুই তা, পাও উন আর শেং চিং চীনে ফিরে গেলেন। ভিক্ষাপাত্রের মন্দিরে এসে হুই চিং-এর ভ্রমণ শেষ হল। মৃত্যু হল তার। আর এভাবেই ফা-হিয়েন এবার একাকী অগ্রসর হলেন পরবর্তী গন্তব্যে।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

Categories
2021-July-Essay

শুভদীপ ঘোষ

চার্লি ও চ্যাপলিনের কথা

চার্লির কথা ১: বাবা ছিল গায়ক ও অভিনেতা। ভালো গানের গলা ছিল, নামডাক ছিল। আমাদের এখানে বাণিজ্যিক রঙ্গমঞ্চ যেরকম ছিল কতকটা সেরকমই ছিল লন্ডনের মিউজিক হল বা আমেরিকার ভদেভিল। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের গ্রুপ থিয়েটারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের। সাধারণ মানুষের আনাগোনা লেগে থাকত, সারা শহর ঘুরে ঘুরে হত নাটক, গান, সার্কাস, মাইম, বক্তৃতা, জিমনাস্টিক এমনকী সন্মোহন জাতীয় ব্যাপার-স্যাপারও। ভীষণ জনপ্রিয় এই প্রদর্শনগুলিতে দর্শকরা নেমে এসে বিপুল উৎসাহে শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দিত, চলত দেদার মদ্যপান। বাবা ছিল এইরকমই ঘোর মদ্যপ। নাম চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন সিনিয়ার। চার্লির যখন বারো বছর বয়স তখন তার বাবা এই মদ্যপান জনিত অসুখের কারণে মারা যায়, মৃত্যুর সময় বাবার বয়স ছিল সাইত্রিশ। সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, বাবার সঙ্গে চার্লি ও তার দাদা সিডনির তা একেবারেই ছিল না। কয়েকবারের কিছু সাক্ষাৎ বাবার স্মৃতি হিসেবে থেকে গিয়েছিল তাদের মনে। তথাপি চ্যাপলিনের ছবিতে তার বাবার প্রভাব আছে নানাভাবে। মা ছিল বাবার মতোই ব্রিটিশ মিউজিক হলের গায়িকা ও অভিনেত্রী। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তার শিল্পীজীবন শুরু হয়। নাম হানা পেডলিংহাম চ্যাপলিন। বিজ্ঞাপনে বা হ্যান্ডবিলে ‘লিলি হার্লি’ নাম দেখা যেত। চ্যাপলিন সিনিয়ারের প্রেমে পড়ে ঐ কম বয়সেই। ১৮৮৩ নাগাদ সিডনি হক্‌স বলে একজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়, হক্‌স তাকে সোনার-খনিতে সমৃদ্ধ সাউথ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্ট্রান্ডে নিয়ে যায়। এখানে তাকে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়। এর অল্পকাল পড়েই হানা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পুনরায় ব্রিটেন ফিরে আসে। জন্ম হয় সিডনি হক্‌সের ছেলে সিডনি চ্যাপলিনের। উত্তর ফ্রান্সের লে হেভরের রয়াল মিউজিক হলে শুরু হয় পুনরায় গান গাওয়া। ব্রিস্টল, ডাবলিন, গ্লাসগো, বেলফাস্টে তার গান ও অভিনয় শুরু হয় সিনিয়ার চ্যাপলিনকে বিয়ে করার পর। ১৮৮৬ সালের ১৬ই এপ্রিল জন্ম হয় চার্লি চ্যাপলিনের (চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন জুনিয়ার)। মা বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল চার্লির সেটা বোঝার বয়স হওয়ার আগেই মা বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চার্লি ও সিডনি মায়ের সঙ্গে আলাদা থাকত লন্ডনের লাম্বেথ অঞ্চলে। হুইলার ডাইড্রেন নামে মায়ের আর এক ছেলের কথা তারা জানতে পারে অনেক পরে! এই গম্ভীর রোগা ডাইড্রেনকে চার্লির শেষের দিকের কিছু ছবিতে অভিনয়ও করতে দেখা গেছে। বাবার মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান, উত্তর আমেরিকা ভ্রমণের সময়কার অজানা কিছু ঘটনা, অন্য এই ছেলের রহস্য, না কি মায়ের কখনো ঠিক না হওয়া মানসিক অপ্রকৃতিস্থতা, প্রকৃত কারণ কী ছিল ছাড়াছাড়ির! চার্লিদের কাছে রহস্যই থেকে গেছে গোটা ব্যাপারটা। পরবর্তীকালের গবেষণা থেকে জানা যায় হানা চ্যাপলিন সম্ভবত সিফিলিস আক্রান্ত ছিল। অস্বাভাবিক মাথাব্যথা, মাঝে মাঝেই গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোনো বন্ধ হয়ে যাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক গৈরুষা, সার্বিক স্বাস্থের অবনতি-সহ শেষাবধি ডিমেন্সিয়া এই সিফিলিসের কারণেই হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়!

ছোটোবেলায় চার্লি

সুন্দরী কতটা ছিল তেমন জানা না গেলেও মায়ের রূপে-গুণে চার্লি ও সিডনি ছিল মুগ্ধ। অনেক রাত করে মা বাড়ি ফিরত, ফিরে দেখত ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, সকালে উঠে ছেলেরা দেখত মা ঘুমোচ্ছে, টেবিলে সাজিয়ে রাখা আছে তাদের খাবার। দাদু দিদারা এসে মাঝে সাঝে থাকত ওদের সাথে, হানার রোজগারে আধপেটা খেয়ে কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত। ছুটির দিনে কখনো লাম্বেথের ফুটপাথে কখনো কেনিংটন রোডের ধারে কখনো-বা ওয়েস্টমিনিস্টারের ব্রিজের ধারে, মায়ের সঙ্গে লাইলাক গাছের ডাল ধরে সুন্দর কেটে যেত তাদের বিকেলগুলি। গান গেয়ে, নেচে, কদাচিৎ আইসক্রিম কিনে দিয়ে অভাব অনটন কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত মা। কিন্তু এরই মধ্যে দুঃস্বপ্নের একটি রাত চার্লি কোনোদিন ভোলেনি।

প্রথম দৃশ্য— লাম্বেথে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মায়ের সাজপোশাকের প্রিয় পেটিটা খুলে বসেছে দুই ভাই, মা সাজগোজ করে বেরোবে, গন্তব্য অ্যালডারসটের ক্যান্টিন মিউজিক হল। চার্লির কথায়, “ভাড়া বাড়িতে একা রেখে যাওয়ার চাইতে মা সাধারনত আমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করত”।

দ্বিতীয় দৃশ্য— জমকালো পোশাকে মোহময়ী হানা গান ধরেছে। অ্যালডারসটের ক্যান্টিনে তুমুল হইচই হচ্ছে, দর্শক শ্রোতারা অধিকাংশই সৈনিক, তুমল বিশৃঙ্খলা, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে, শিস পড়ছে, উড়ে আসছে অশ্লীল শব্দ ও চুমু ‘চার্মিং লিট্‌ল চান্টার’ হানার প্রতি। দু-একজন মদ্যপ পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বদমায়েশি করে, গান গাইতে গাইতেই হানা হাত দিয়ে বাড়ি মেরে দূর করে দিচ্ছে তাদের। নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সব দেখছে শুনছে পাঁচ বছরের চার্লি।

তৃতীয় দৃশ্য— হঠাৎ গানের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, এদিকে মা প্রাণপণ চেষ্টা করছে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে! অর্কেস্ট্রা বন্ধ হয়ে গেছে। নাঃ! মা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে তড়িঘড়ি দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল আর কিছু বোঝার আগেই হিড়হিড় করে টেনে মঞ্চে তুলে দেওয়া হল পাঁচ বছরের চার্লিকে!

চতুর্থ দৃশ্য— চারপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া, তার মুখের উপর এসে পড়েছে স্পটলাইটের আলো। আবার শোনা যাচ্ছে যন্ত্রের আওয়াজ! অর্কেস্ট্রা বেজে উঠেছে, আর কিছু করার নেই, গান বেরিয়ে এল মানুষের গলা দিয়ে। স্বভাব কবিদের মতো স্বভাব অভিনেতা-গায়ক চার্লি গান ধরেছে, জ্যাক জোন্সের গান!

পঞ্চম দৃশ্য— শুরু হয়ে গেছে পয়সার বৃষ্টি, পুচকে চার্লি গান গাইতে গাইতে মায়ের ভাঙা গলা নকল করছে মাঝে মাঝে আর অদ্ভুত মুখভঙ্গি করতে করতে তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিচ্ছে পয়সাগুলো যাতে কতৃপক্ষ ঝেড়ে না দিতে পারে! এই কাণ্ড দেখে দর্শকরা হেসে কুটিপাটি।

ক্যানটারবেরি হল, লাম্বেথ

এই ছিল চার্লির প্রথম রঙ্গমঞ্চের অভিজ্ঞতা। কান্নাহাসির দোলদোলানো এই শৈশব, হাসির অন্তরালের বিষাদের উৎসভূমি ছিল। কৌতুক ও বিষাদের সমমিশ্রণ না ঘটলে মানুষ হাসে না ও হাসির শেষে মানুষের চোখে জল আসে না। এ-সব বোঝা হয়ে গিয়েছিল চার্লির অনেক ছোটোবেলায়। দারিদ্র্য দুর্দশা ঐটুকু ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছিল নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে। তাই প্রথম রঙ্গমঞ্চের কুড়িয়ে নেওয়া টাকার মতো চার্লি ঐশ্বর্যের শিখরে পৌঁছেও ছিল সমান হিসেবি।

শিল্পীজীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সুস্থতা মায়ের আর আসেনি। জামাকাপড় সেলাই করে মা কোনোরকমে সংসার চালাত। পাউনিল টেরাসের বস্তিতে উঠে আসে তারা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে। দুই ভায়েরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং শুরু হয় রোজগারের নানারকম চেষ্টা। বাড়ির সব জিনিস বেঁচে দিতে হয় একে একে, এমনকী তাদের সবচেয়ে প্রিয় মায়ের সাজগোজের পেটিটা পর্যন্ত! এরপর দেনার দায়ে সেলাইয়ের মেশিনটাও নিয়ে যায় পাওনাদার। লাম্বেথের ওয়ার্কহাউসে গরিব ও অনাথ বাচ্চাদের সাথে দুই ছেলেকে ভর্তি করে দেওয়া ছাড়া হানার আর কোনো উপায় থাকে না। রোজগারের বৈধ ও নিষিদ্ধ বিভিন্ন উপায়ে কাটতে থাকে হানার জীবন।

চ্যাপলিনের কথা ১: মানুষকে দেদার সাহায্য করার সময়ও আমরা আত্মসচেতন এক চ্যাপলিনকে দেখি তার ছোটো বড়ো সমস্ত ছবিতে। পয়সা রোজগার করার কত ফিকির আমরা দেখতে পাই তার ছবিতে। ধনসম্পদের বৈষম্যই যে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কায়েমি রাখার মূল চাবিকাঠি এই বোধ চ্যাপলিন যেরকম চার্লির জীবন থেকে পেয়েছিল সেইমতো তার প্যান্টোমাইম চলচ্চিত্র যাত্রার শুরুর চলচ্চিত্রটির নামও অদ্ভুতভাবে ‘মেকিং এ লিভিং’ (১৯১৪)। এই ‘মেকিং এ লিভিং’-এর চ্যাপলিন কিন্তু আমাদের চেনা ঢোলা প্যান্ট, ছোটো গোঁফ, ছড়ি টুপির ভবঘুরে আর্কিটাইপ চ্যাপলিন নয়। ঐ চরিত্রটিকে খুঁজে পেতে তাকে পরের ছবি ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’ (১৯১৪) অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরপর একে একে ‘হিজ নিউ প্রফেশান’ (১৯১৫), ‘হিজ নিউ জব’ (১৯১৫), ‘ওয়ার্ক’ (১৯১৫), ‘দি পন শপ’ (১৯১৬), ‘এ ডগ্‌স লাইফ’ (১৯১৮) জুড়ে শুধু ঢোলা প্যান্ট, ছেঁড়া টাইট কোট, ছড়ি, টুপি, ছোটো গোঁফ আর হাঁস জুতোটুকুও যাতে চলে না যায় সেই জন্য রোজগারের নানান ধান্দা। ‘এ ডগ্‌স লাইফ’-এ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে লোকভরতি বেঞ্চের একধারে বসে থাকা চ্যাপলিন মাটিতে পড়ে যায় যখন অন্য প্রান্তে একটি মোটা লোক এসে বসে। সমাজের বিস্মৃত মানুষের সর্বোত্তম প্রতিনিধি চ্যাপলিনকে এর পর বিশ্বাসযোগ্যভাবে অভিনয় করতে দেখি এমন এক প্রাহসনিক দৃশ্যে যেখানে বেঞ্চ থেকে উঠে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে জানালায় তার পৌঁছোনোর আগেই অন্য কেউ-না-কেউ পৌঁচ্ছে যাচ্ছে! সমাজের একেবারে নীচু তলার মানুষের অবস্থা নিয়ে এরকম শ্লেষাত্মক বিবৃতি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল!

চার পয়সা ধার দিয়ে ফাঁকতালে এক পয়সা নিজের জন্য সরিয়ে রাখে সে, কিংবা ‘সিটি লাইট’ (১৯৩১)-এ জলে ডুবন্ত সেই উন্মাদ ধনকুবেরকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে আগে জল থেকে ওঠার চেষ্টা করে! ‘Be brave! Face life!’, স্বগতোক্তির মতো শোনায়, বুক চাপড়ে এ-কথা বলতে গিয়ে চ্যাপলিনের আত্মপ্রবঞ্চনাময় কাশির দমক আমাদের হাসিতে ভরিয়ে দেয়। ‘Tomorrow the bird will sing’, আত্মহত্যা করতে যাওয়া যে-মানুষকে চ্যাপলিন এ-কথা বলছে সে একজন ধনকুবের! উদ্বৃত্ত অর্থের স্রোত, সমস্ত ভোগ করে ফেলার পর মানুষের বুঝি এই অবস্থা হয়! অথচ উলটোটাই তো কথা ছিল, কিন্তু ভবঘুরে আধপেটা খাওয়া চ্যাপলিন ভাবেনি সে-কথা, এখানেই ব্যক্তি চার্লির দুর্মর আশাবাদ চলচ্চিত্রের চ্যাপলিনের প্রতিভায় প্রকাশিত হয়েছে। এই ধনকুবের চরিত্রটির মধ্যে নিহিত আছে চার্লির বাবার ছায়া। মদ্যপ ধনকুবেরটি যেন চ্যাপলিনের বাবার ইগো আর নেশা ছুটে যাওয়া দাম্ভিক ধনকুবেরটি যেন তার বাবার অলটার ইগো।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অপ্রস্তুত চার্লিকে একদা ঘাড় ধরে তুলে দেওয়া হয়েছিল মঞ্চে, এই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন রূপ নিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে চ্যাপলিনের ছবিতে। ‘দি সার্কাস’ (১৯২৭) ছবিটিতে পুলিশের তাড়া খেয়ে চ্যাপলিনকে আমরা ঢুকে পড়তে দেখি সার্কাসের মঞ্চে, তারপর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে শুরু হয় ট্রাপিজের হাজার কসরত! ছবিতে সার্কাসের দর্শকরা সে-সব দেখে হেসে অস্থির তাদের কাছে প্রকৃত সত্য জানা নেই, আর আমরা ছবির দর্শকরাও হেসে অস্থির কিন্তু আমাদের অবস্থান চ্যাপলিনের সঙ্গে। ছবির এক জায়গায় সার্কাসের ম্যানেজারের মন্তব্য ভেসে উঠতে দেখি ইন্টারটাইটেলে, “He’s a sensation but he doesn’t know it…”। এতকাল বাদে এই স্বতঃস্ফুর্ত স্ল্যাপ্সটিকগুলির দিকে ফিরে তাকালে ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে এ-কথা কৌতুকপূর্ণভাবে সর্বৈব সত্য বলে মনে হয়। আবার প্রথম দিকের ‘এ নাইট ইন দ্য শো’ (১৯১৫)-তে আমরা দেখা পাই ব্রিটিশ মিউজিক হল বা আমেরিকার ভদেভিল জাতীয় রঙ্গমঞ্চের! ছবির এক জায়গায় মদের নেশায় চ্যাপলিন আচমকা গিয়ে রঙ্গমঞ্চের উপর উঠে পরে, তারপর শুরু হয় তার চিরাচরিত স্ল্যাপস্টিক মারপিট! অনেকে বলে থাকেন চ্যাপলিনের ছবি আসলে মানুষের আজীবন লালিত সুপ্ত শৈশবকে প্রাণিত করে তাই তার ছবির বয়সে ছোটো দর্শকের থেকে বয়সে বড়ো দর্শকের সংখ্যাই বেশি। মদ্যপ চ্যাপলিন আরও বেশি করে যেন ঐ শৈশবে প্রণত, তাই ভদেভিল রঙ্গমঞ্চে মদ্যপ চ্যাপলিন যেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে উঠে পড়ে, যেন এ তার অনেক ছোটোবেলার অভ্যাস! এখানে ছবির ভদেভিলের দর্শকদের থেকে ছবির দর্শক হিসেবে আমাদের অবস্থান অনেক বেশি ব্যক্তি-চ্যাপলিন নিষ্ঠ। ‘হিজ ফেভারিট পাস্টাইম’ (১৯১৪), ‘দ্য রাউন্ডার্স’ (১৯১৪) থেকে ‘সিটি লাইট’ মাতাল চ্যাপলিনের মগ্নচৈতন্যের শৈশবযাপন। যুক্তিবুদ্ধির ধারণা থেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে যা খুশি করা, কিছুক্ষণের জন্য শিশুসুলভ দুষ্টুমি করে চলা। স্ল্যাপস্টিক প্রদর্শনের এরকম সুযোগ চ্যাপলিন কখনো ছাড়েনি।

চিরাচরিত স্ল্যাপস্টিক, ‘এ নাইট ইন দ্য শো’ (১৯১৫)

চার্লির কথা ২: বন্দিত্ব ও একাকিত্ব বস্তিবাসীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। লাম্বেথের ওয়ার্কহাউসে একদিন তার মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হয়। জেরিমি বেন্থাম রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে বলেছিলেন প্যান-অপটিকনিয়ান। বলা নেই কওয়া নেই, সমাজসেবী পাদ্রির দল কোথা থেকে এসে নিয়ম নামক কবচ ঝুলিয়ে তার সাধের চুল কেটে দিয়ে চলে গেল! গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সমস্তরকম সমাজব্যবস্থায় মানুষ যে একটা সংখ্যার বেশি কিছু নয় চার্লি সেটা ঐ কম বয়সেই টের পেয়েছিল যখন সে দেখল আসলে নিজের শরীরটাও নিজের নয়। যে-শরীরকে সে চিরকাল ব্যবহার করেছে মানুষকে আনন্দ দিতে যে-শরীর তার শিল্পের যাপনভূমি সেইখানেই ঘটে গেল অতর্কিত হামলা। তার এই অভিজ্ঞতার কথা জানা থাকা দর্শক হিসেবে তার ছবি সমাদর করার প্রাক্-শর্ত।

মায়ের মধ্যে পাগলামির লক্ষণ দেখা দিলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। হানার পরিবারে মানসিক অসুস্থতার বেশ কিছু নজির আছে। হানার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া না কি সিফিলিস ঘটিত তা আজও পরিষ্কার নয়। মা হাসপাতালে চলে গেলে সরকারি নিয়মে চার্লি ও সিডনি কেনিংটনে তার বাবার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য গৃহকত্রী বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী লুইস ব্যপারটা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। খাদ্য জুটত কিন্তু তার থেকেও বেশি জুটত অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য। পরে মা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোলে তারা মায়ের সঙ্গে পাউনাল টেরাসের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। এখানে থাকা কালিন দারিদ্র্য চরমে পৌঁছোয়। আগের মতোই উপার্জনের নানা পন্থা এবং উপায় না থাকলে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়ানো এইভাবেই কাটত মায়ের নিত্যদিন। এই সময়েরই একটি ঘটনার কথা চার্লি অনেক জায়গায় বলে গেছে।

প্রথম দৃশ্য— মা বেরিয়েছে উপার্জনের জন্য। সিডনি কোথায় সে জানে না। ছাদের কড়িকাঠে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে, সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে চার্লির।

দ্বিতীয় দৃশ্য— বাইরে হঠাৎ হইচই-এর শব্দ। চার্লির তন্দ্রা ছুটে গেছে, সে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

তৃতীয় দৃশ্য— একটা আধপাগল ধরনের লোক মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে একটা ভেড়াকে তাড়া করে রাস্তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারের লোকজন বিশেষত চার্লির বয়সি ছোটোরা দারুণ উপভোগ করছে ব্যাপারটা আর হাততালি দিচ্ছে। চার্লিও দারুণ মজা পেয়েছে, সে অন্যদের সঙ্গে হাততালি দিতে দিতে দৌড়চ্ছে লোকটার পিছন পিছন।

দৃশ্য চার— রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁচ্ছে গেছে সবাই, লোকটা ভেড়াটাকে টেনে ঢুকিয়ে দিল একটা বাড়িতে। চার্লি চোখ তুলে দেখে সেটা একটা কসাইখানা! এই অনভিপ্রেত ঘটনার অভিঘাতে চার্লি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “ওরা একে মারতে নিয়ে যাচ্ছে!!”

১৯০১ সালে বাবা মারা যায়। দাদা সিডনি জাহাজে কাজ নিয়ে দূরে। চার্লি এই সময় মুদিদোকান থেকে মুচিগিরি সমস্তরকম কাজে নিজেকে যুক্ত করেছে, রঙ্গমঞ্চে গান অভিনয়ও চলেছে পাশাপাশি, বিদ্যালয়েও গেছে মাঝে মাঝে, আর শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছে উপলব্ধি করছে মানুষের স্বভাব ও মানুষের সমাজ। একদিন জানতে পারে মা সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে, তাকে আবার মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অসুখ তার আর কোনোদিনও সারেনি।

১৯১০ সাল নাগাদ চার্লি ব্রিটিশ মিউজিক হলের বিখ্যাত অভিনেতা ও স্ল্যাপস্টিক কৌতুকাভিনেতা ফ্রেড কার্নোর দলে যোগ দেয়। পরবর্তীকালে চ্যাপলিনের ছবিতে এর ওর মুখে বড়ো কেক বা পেস্ট্রি ছুড়ে মারার যে-দৃশ্যগুলি দেখতে পাওয়া যায় সেই স্ল্যাপস্টিক প্রকরণটি এই ফ্রেড কার্নোর মস্তিষ্কপ্রসূত, একে custard-pie-in-the-face gag বলে। ইনি ছিলেন স্ল্যাপস্টিক কমেডি এবং সাইলেন্ট কমেডির প্রবর্তকদের অন্যতম। এর হাত ধরেই চার্লির আমেরিকা যাত্রা ও ‘কমেডির রাজা’ ম্যাক সেনেটের ‘কিস্টোন স্টুডিয়ো’-তে যোগদান। এই বছরগুলিতেই স্ল্যাপস্টিক কমেডির উপযোগী শারীরিক দক্ষতা সে রপ্ত করে ফেলে, প্রায় স্প্রিঙের মতো বানিয়ে ফেলে শরীরটাকে। সঙ্গে লন্ডনের ‘ককনি’ বাচনভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে যা মার্কিন রঙ্গমঞ্চের জন্য একেবারেই উপযোগী ছিল না। পরে ‘এসানে স্টুডিয়ো’, ‘মিউচুয়াল ফিল্ম কর্পোরেশন’ হয়ে সব শেষে নিজে ‘ইউনাইটেড আর্টিস্ট’ তৈরি করে খ্যাতি ও সমৃদ্ধির শিখর ছোঁয়। মা তার সঙ্গেই ছিল আমেরিকাতে। ছেলের সাফল্য ও খ্যাতিতে যদিও সে নিস্তেজই থাকত। অবশেষে ১৯২৮ সালে তার মৃত্যু হয়।

চ্যাপলিনের কথা ২: বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের কাহিনি বলার কোনো দায় নেই বলেছিলেন বেলা বালাজ, জিভা ভের্তভের মতো চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকেরা। সেক্ষেত্রে মানতেই হবে চ্যাপলিনের সাইলেন্ট কমেডিগুলি বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের আদর্শ নিদর্শন। আর চ্যাপলিন সেখানে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকারী, একটা দাগ একটা ক্ষত। ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’-এর কথা ভাবুন, অভিজাতদের বাচ্চাদের গাড়ির রেসের ভিডিয়ো তোলা হচ্ছে সেখানে চ্যাপলিন ঢুকে পড়ছে বার বার! লাথি, গলা ধাক্কা যাই দেওয়া হোক সে নাছোড় বান্দা। একদম শেষে তাকে ভেংচি কাটতে দেখা যায় ক্যামেরার সামনে এসে। কতৃপক্ষ ও বড়োলোকেদের যাবতীয় ব্যাবস্থাকে সে যে সারাজীবন বুড়ো আঙুল দেখাবে এখানেই তার সূচনা হয়ে যায়। অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশের পর নানান অশান্তি করে ছবির মূল বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়া চ্যাপলিনের অনেক ছবিরই নিত্যদিনের ব্যাপার। এই ছবি থেকেই ভবঘুরে ঢোলা প্যান্ট টুপি ছড়ি ছোটো গোঁফের আর্কিটাইপ চ্যাপলিনের দেখা পাই আমরা। শোনা যায় ম্যাক সেনেটের নির্দেশে সে নিজেই তার এই রূপকল্প তৈরি করেছিল, অনেকে আবার বলে ঝড়জলের সন্ধ্যায় এইরকম দেখতে একটি মানুষের সন্ধান পেয়েছিল সে।

সেই বিখ্যাত ভেংচি, ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’ (১৯১৪)

‘ইজি স্ট্রিট’ (১৯১৭)-র একটি দৃশ্য আছে যেখানে চ্যাপলিন বাক্স থেকে খাবার বের করে বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে এমনভাবে যেন তারা মানবশিশু নয় তারা মুরগির ছানা! সের্গেই আইজেনস্টাইনকে এই দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে চার্লি বলেছিল, “জানেন তো— আমি এটা কেন করেছিলাম কেন-না শিশুদের আমি অপছন্দ করি। তাদের আমার ভালো লাগে না।” আপাত নির্মম এই কথার পিছনে লুকিয়ে আছে চার্লির বিপর্যস্ত শৈশব। প্রকৃতপক্ষে শিশু নয়, চার্লি অপছন্দ করত শৈশবকে। শিশুরা ছিল সেই অপছন্দের শৈশবের প্রতিমূর্তি।

‘শান্তি ও সমৃদ্ধির’ প্রতীক শ্বেত শুভ্র স্তম্ভের উদ্বোধন হবে। শহরের গণ্যমান্যরা উপস্থিত দলবল সমেত। পাইক-বরকন্দাজ পাদ্রি কেউ বাকি নেই। ঢাকা সরতেই দেখা যায় শ্বেত শুভ্র স্তম্ভের গায়ে কালো আঁচরের মতো কী একটা লেগে আছে যেন! ওহ্‌ ঐ শালা ভিখিরি ভবঘুরেটা! ঘুম ভেঙে উঠে হতভম্ভ চ্যাপলিন, তাকে যত নেমে আসার হুমকি দেওয়া হয় তত একবার তার প্যান্ট আটকে যায় মার্বেলের তলোয়ারে, একবার সে বসে পড়ে একটি মূর্তির মুখের উপর নিতম্ব রেখে! এদিকে বিউগল বেজে উঠতেই বাকিদের সঙ্গে সেও ঐ অবস্থাতেই স্যালুটের ভঙ্গি নেয়। বোঝা যায় ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত নয়। সমাজ যাদের ভুলে থাকতে চায় তাদের এরকম অবাঞ্ছিত উপস্থিতি দিয়েই শুরু হয় ‘সিটি লাইট’। ঝাঁ চকচকে শহরের অভ্যস্ত আলো নয়, যে-সব মানুষ বা যে-সব অঞ্চল ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রাত্যই থেকে গেছে, এই আলো সেই বাইরের নগরের। বস্তুত ‘সিটি লাইট’-এর সময় হলিউডে বাক্-চিত্র এসে গেছে। কিন্তু নৃত্যগীতবাদ্য মুখর কর্ণভেদী বাক্-চিত্রের বিপরীতে মাঝে মাঝে কিছু আওয়াজ ও নেপথ্যসংগীত ছাড়া ‘সিটি লাইট’-এর নির্বাক্‌ চলমান চিত্রমালায় এমন একটা সুখ ছিল যা এই ছবিটিকে শেষপর্যন্ত প্রায় মন্ত্রে-শান্তিতে উন্নীত করে দেয়!

সে এখানে স্বয়ং পাদ্রি এবং অবশ্যই অবধারিতভাবে জালি পাদ্রি, আদতে জেল পালানো আসামী। এদিকে শহরের শেরিফ চ্যাপলিন-আসামীকে চিনতে পারে ও তাকে বন্দি করে। কিন্তু তার উদারতায় ততক্ষণে সবাই মুগ্ধ তাই শেরিফ তাকে আমেরিকা থেকে পালিয়ে মেক্সিকোতে চলে যেতে সাহায্য করতে চায়। আমেরিকার সীমানায় নিয়ে গিয়ে যতবার তাকে মেক্সিকোতে পাঠানো হয় ততবার সে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে (নাকি বুঝতে না চেয়ে!) সীমানা টোপকে ফের আমেরিকা চলে আসে! শেষে বিরক্ত শেরিফ পশ্চাদদেশে লাথি মেরে তাকে মেক্সিকো পাঠিয়ে নিজে পালিয়ে চলে যায়। চ্যাপলিন তখন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়, এক পা আমেরিকার দিকে আর এক পা মেক্সিকোর দিকে দিয়ে লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে কী একটা গণ্ডগোল শুরু হয়েছে খুব গোলাগুলি চলছে। সে কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে ঐ লাইন ধরে দু-দিকে দুই পা রেখে দিগন্তের দিকে হাঁটা দেয় তার বিখ্যাত পাতিহাঁসের মতো হাঁটার ভঙ্গিতে! ‘দ্য পিলগ্রিম’ (১৯২৩) ছবির পরিসমাপ্তি ঘটে এখানেই। এই তার চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক ভাষা। প্রান্তবাসী অন্তেবাসী মানুষের প্রতিনিধি সে, তাই যেখানে দু-দেশের সীমারেখা সেখানেই তার বসবাস।

আমেরিকার স্টুডিয়ো সিস্টেম থুড়ি আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা তার এই ‘আঁতলামো’ ভালোভাবে নেয়নি। ‘মডার্ন টাইম্স’ (১৯৩৬) ছবিতে যন্ত্রপাতির ভিতরে ঘুরতে থাকা চ্যাপলিন তাই যতটা বোধ-বুদ্ধি রহিত প্রযুক্তির ব্যবহারকে ব্যঙ্গ করে ততটাই স্টার-ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের জাঁতাকলে তার কী অবস্থা হয়েছে সেটাও প্রকাশ করে। ব্যাপারটা ‘গোল্ড রাশ’ (১৯২৫)-এর সময় থেকেই শুরু হয়। চার্লির জবানবন্দি থেকে জানা যায় ক্লন্ডিক গোল্ড রাশের গল্পটা তার মাথায় আসে চিলকূট গিরি পথে যাবার সময়। নিজেকে নধর মুরগি হিসেবে ভাবার দৃশ্য পরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে আমেরিকার পথিকৃৎ একজনের নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ক্যানিবালিজ্‌ম-এর ঘটনা থেকে! চ্যাপলিন তাই মনে করত হাস্যরস আপাতবিরোধী কারণ তা উত্থিত হয় বিষাদ বা দুঃখ থেকে। উপহাসের ভিতর দিয়ে যে-হাস্যরস নির্গত হয় তা মানুষের অনেক অসহায়তাতে প্রলেপ দেয়, না হলে সে পাগল হয়ে যেত। নরভুকবৃত্তির এ হেন ব্যাঞ্জনা আমাদের হাসতে হাসতে স্তব্ধ করে দেয়। এই মুরগি অনুষঙ্গ রাষ্ট্রের চোখে আসলে ছিল প্রান্তিক মানুষের প্রতিমূর্তি!

নধর মুরগিরূপী চ্যাপলিন, ‘গোল্ড রাশ’ (১৯২৫)

এখান থেকে শুরু, ১৯৪০-এর ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ হাঁস জুতো টুপি ছড়ির ভবঘুরে চ্যাপলিন অন্তর্হিত, পড়ে আছে শুধু তার গোঁফটা! আসলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ চার্লির বন্ধু ভেনডারবিল্ট জার্মানি থেকে তাকে পাঠাতে থাকে কিছু পোস্টকার্ড। সেখানেই প্রথম চোখে পরে গোঁফ চুরির ব্যাপারটা! চার্লি লিখেছে সে-কথা, “ও আমার গোঁফ চুরি করেছে! ঐ গোঁফ আমি আবিষ্কার করেছিলাম! অবশ্য এই গোঁফ-সহ ওর মুখ আমার মুখের বাজে নকল— পুচকে ঠোঁট ও এলোমেলো চুল নিয়ে ঐ মুখে ফুটে উঠেছে অশ্লীল ভাঁড়ামো। হিটলারকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা আমি ভাবিওনি। কিন্তু যখন আইনস্টাইন ও টমাস মানকে জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে হল, তখন হিটলারের ঐ মুখ আর কমিক না থেকে হয়ে উঠল ভয়ংকর।” ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ শুরুর সময়ে খবর আসতে থাকে জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আমেরিকা-ইংল্যান্ড জল মাপতে শুরু করে, নাৎসি জার্মানিকে আপাতত চটানো যাবে না। ছবিটার বিরোধিতা শুরু হয়। বলা হয় ছবিটার মুক্তি এই দু-টি দেশে চিরকালের মতো নিষিদ্ধ করতে হবে। এদিকে ফ্রান্সের অঁদ্রে ম্যাজিনোর নামে নামাঙ্কিত ‘ম্যাজিনো লাইন’ নামক যুদ্ধের জন্য তৈরি দুর্গ ধূলিসাৎ হয়, ফ্রান্স অধীনস্থ হয় হিটলারের, অতঃপর ডানকার্কের দিকে এগিয়ে চলে রণতরী যুদ্ধ-বিমান। আমেরিকা প্রমাদ গোনে ও ডাক পড়ে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর! বলা হয় “তোমার ছবি তাড়াতাড়ি কর, সবাই অপেক্ষা করছে এটার জন্য।” কিন্তু ডিক্টেটর হ্যানকেল (হিটলারের নকল)-রূপী ইহুদি নাপিতের শেষ সম্ভাষণ মনঃপূত হয় না প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট-সহ গোটা মার্কিন সাংবাদিককুলের, বিশেষত, “in the name of the democracy— let us use that power— let us all unite…”। রাষ্ট্রশক্তি বুঝতে শুরু করে যা আগে কেবল সন্দেহ ছিল আজ তা প্রমাণিত হচ্ছে, এ-লোক খুবই বিপজ্জনক। ১৯৪৭-এ ‘মঁসিয়ে ভের্দু’ ঝড় বইয়ে দেয় আমেরিকা জুড়ে, বন্ধ করে দেওয়া হয় ছবির মুক্তি! নিজে বিবাহিত হয়েও, বড়োলোক মহিলাদের বিয়ে করা ও তারপর তাদের হত্যা করা এই এখন চ্যাপলিনের কাজ! সরাসরি পুঁজিরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ফতোয়া ম্যাকার্থি যুগে চ্যাপলিনকে দেগে দেয় আমেরিকাবিরোধী হিসেবে, দেশদ্রোহী হিসেবে, কমিউনিস্ট হিসেবে! যদিও তিনি এইচ. জি. ওয়েল্‌সকে বলেছিলেন, “আপনি যদি সমাজতন্ত্রী হন তাহলে বিশ্বাস করুন, পুঁজিবাদ বিনষ্ট, পৃথিবীর জন্য আর কী আশা থাকবে যদি রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র ব্যার্থ হয়?” ১৯৫২ সালে তাকে স্থায়ীভাবে মার্কিন দেশ ছাড়া করা হয়।

ডিক্টেটর হ্যানকেল (হিটলারের নকল), ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (১৯৪০)

প্রকৃতপক্ষে চলচ্চিত্রের আদি যুগে যে ক-জন বিরল প্রতিভাধর স্রষ্টার সৃষ্টি চলচ্চিত্রকে নাটক ও সাহিত্যের মধ্যবর্তী স্থানে উপনীত করেছিল চ্যাপলিন তাদের মধ্যে প্রধান বললেও অত্যুক্তি হয় না। ভঙ্গি, বেশভূষা, চরিত্রচিত্রণ সব কিছুর মধ্যে শুরু থেকেই তার স্রষ্টাসুলভ সাক্ষর বিদ্যমান, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বানিয়ে তোলা জিনিশ নয়, হয়ে ওঠা পদার্থ’। শিল্পের এই আদন্ত মৌলিক রূপ তার চলচ্চিত্রগুলিকে যেমন দিয়েছে বিশুদ্ধতার স্বীকৃতি তেমনই তার প্রতিভাকে করে তুলেছে শেক্সপিয়ারের সমতুল্য! কারণ, সেও শেক্সপিয়ারে মতোই বাণিজ্যের চলতি সবগুলি প্রথা মেনে নিয়েও স্তর-বহুল শিল্পী হতে পেরেছিল। অর্থাৎ, ভোক্তার তারতম্য অনুযায়ী তার আবেদনের স্তরও আলাদা-আলাদা, কিন্তু নিম্নতম স্তরেও বঞ্চিত হতে হয় না যেহেতু নিছক বিনোদন-উপভোগের সমান অংশীদার সবাই।

উপলব্ধি কী? চার্লির জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায়, “‘লাইম লাইট’ (১৯৫২)-এর ছবির চূড়ান্ত পর্যায়ে কমেডিয়ান ক্যালভেরোর উপলব্ধিই আমার উপলব্ধি: জীবন গতিশীল এবং তাই প্রগতি।” ‘লাইম লাইট’ ছবির শেষে পিয়ানো বাদকের ভুমিকায় যে-অভিনেতার দেখা পাই আমরা তার নাম ‘বাস্টার কিটন’। চ্যাপলিনের সমতুল্য প্রতিভার এই স্ল্যাপস্টিক কমেডিয়ানের সুদিন তখন পড়ে আসছে কিন্তু ক্যালভেরোর ভালোবাসা থেকে যায় তার প্রতি। চার্লি ও চ্যাপলিন সত্যিই কোনোদিন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। কি ‘মঁসিয়ে ভের্দু’-তে কি ‘সিটি লাইট’-এ, কি প্রতিবাদে কি প্রেমে, সদা প্রাণবন্ত এই ভাঁড় এই ভবঘুরে তাই আজও আমাদের এত প্রিয়। ক্যালভেরো মারা যায় টেরিকে প্রাদ প্রদীপের আলোর নীচে রেখে, কিন্তু আমরা জানি আর একজন চার্লি চ্যাপলিন (মৃত্যু— ২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৭৭) আর কোনোদিনও আসবে না এই পৃথিবীতে!

Categories
2021-July-Essay

মানস শেঠ

মিথ্রিডাটিয়ম: নীল রঙে মিশে গেছে ইতিহাস

“এ বিষের নাই রে শেষ!
শুরু শুধু আছে?—
কখনো থাকে এ বিষ দূরে
কখনো বা কাছে।”
— মাজু ইব্রাহিম

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে রাজার। খবরটা ছড়িয়ে পড়া মাত্রই রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে যায় চাপা গুঞ্জন— রানিই বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছেন রাজাকে। কারণ, অন্য কোথাও তো নয়, নিজের বিলাসবহুল ভোজনকক্ষেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে রাজাকে। রানি ছাড়া আর অন্য কারো পক্ষেই সেই ভোজনকক্ষে ঢোকা অসম্ভব। এমনই তর্ক বিতর্কতে উত্তাল রাজ্য। তবে রাজ্যের সবাই যে রানিকে খুনি ভাবছেন তা অবশ্য নয়। অনেকেই মনে করছেন, কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর কাজও হতে পারে এটা।

কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ তীর জুড়ে গড়ে উঠা পন্টাস রাজ্যের রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের মৃত্যু রহস্যকে কেন্দ্র করে দেশ তখন সরগরম। কে হত্যা করলেন রাজাকে— সেই প্রশ্নে বিভক্ত রাজ্যবাসী। সেই রহস্য উদ্‌ঘাটন না হওয়ায়, তখন থেকেই আজও দ্বিধাবিভক্ত ইতিহাস।

খ্রিস্টপূর্ব ১২০ অব্দে বিষক্রিয়ায় যখন মৃত্যু ঘটে রাজা পঞ্চম মিথ্রিডাটিসের, তাঁর দুই পুত্র তখন নিতান্তই নাবালক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরের বয়স তখন বারো। আর কনিষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ক্রেস্টাস্ তখন আরও ছোটো। রাজার মৃত্যুর পর, জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরকে সামনে রেখে রানি লেয়ডাইসই হয়ে উঠলেন সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী। রানি লেয়ডাইস ছিলেন অত্যন্ত চতুর। রাজ্যের শাসন ভার হাতে পাওয়ার পর রানি বুঝতে পারেন, কয়েক বছর বাদে বড়োছেলে মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরই এই সিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার হয়ে উঠে আসবে। রীতি মেনে, তাঁকে তখন ছাড়তে হবে এই গদি। প্রমাদ গুনলেন রানি। ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে গেলে কত কিছুই না করতে হয় মানুষকে! জ্যেষ্ঠ পুত্র মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটরকে হত্যার নকশা তৈরি করলেন রানি লেয়ডাইস। একদিন, কিশোর রাজকুমারের অজান্তে, পিছন থেকে বর্শা নিক্ষেপ করেন কেউ। বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সে-যাত্রায় বেঁচে যান কুমার। কিছু দিন পর, একপ্রকার জোর করেই, একটা পাগলা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে, যাতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু, সে-যাত্রায়ও বেঁচে যান তিনি। ঘোড়ার পিঠ থেকে তাঁকে পড়ে যেতে দেখেননি কেউই। তবে ঘোড়ার পিঠে চেপে সেই যে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন কুমার, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। এই সম্পর্কে দুটো মত পাওয়া যায়। প্রথম মতানুসারে, নিজের বিপদ বুঝে কুমার নিজেই রাজপ্রসাদ ত্যাগ করেন এবং আত্মগোপন করে থাকেন। দ্বিতীয় মত, জ্ঞাতি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে, কুমারকে অজ্ঞাতবাসে পাঠান স্বয়ং রানি।

“কতটা বিষ গিলেছ নিজে?
তারপর সব কিছু করলে বিষাক্ত।
কতটা বিষ ছড়িয়েছ সুখে?
তারপর করলে আমাকে এত ক্ষতবিক্ষত।।”
— দীপেশ সরকার

অগত্যাই ছোটোছেলে মিথ্রিডাটিস্‌ ক্রেস্টাস্‌কে সামনে রেখে রাজকার্য পরিচালনার যাবতীয় দায়ভার নিজ হাতে তুলে নেন রানি লেয়ডাইস। এদিকে সময়ের সাথে সাথে, অজ্ঞাত কোনো এক স্থানে বেড়ে উঠতে থাকেন কিশোর মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। তিনি বুঝতে পারেন তিনিই দেশের রাজা। রাজসিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার। সেই দাবির জন্য এবার নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন তিনি। তিনি নিজেই বিপদসংকুল ভবিষ্যতের কথা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। তিনি জানেন, কে বা কারা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছেন তাঁর বাবাকে। বিষক্রিয়ায় বাবার মৃত্যু ভাবিয়ে তোলে কুমারকে। অস্ত্র নিয়ে সামনাসামনি মোকাবিলায় ভীত নন তিনি। কারণ, এখন তিনি একজন বীর যোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত। তিনি চিন্তিত গুপ্তহত্যায়। কিশোর ইউপাটরের মনে সবচেয়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে— গুপ্তহত্যা তথা বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। সম্ভাব্য বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে সারাক্ষণই ভাবতে থাকেন তিনি। বিষ প্রতিরোধ করতে পারে এমন কিছুর খোঁজ করতে শুরু করলেন তিনি। এই অজ্ঞাতবাসের দিনগুলোতেই বিভিন্ন ভেষজবিদের সাহায্য নিয়ে বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হলেন ইউপাটর। বিভিন্ন গাছের ছাল, মূল, পাতা, ফল, ফুল প্রভৃতি সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। সেই সমস্ত ভেষজকে কখনো বেটে, কখনো শুকিয়ে, কখনো গরম জলে ফুটিয়ে নানান মিশ্রন প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। এই ধরনের নানান পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এক সময়ে প্রস্তুত করেই ফেললেন এক বিষ প্রতিষেধক। এবার নিয়মিত সেই বিষ প্রতিষেধক ব্যবহার করতে শুরু করলেন তিনি। এই সমস্ত বিষ গ্রহণের ফলে প্রথম প্রথম ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। কিন্তু স্বল্পমাত্রায় নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক নিতে নিতে ক্রমেই বিষ প্রতিরোধী হয়ে উঠেতে থাকেন। তিনি জানতে পারেন, তাঁর রাজ্যে ‘পন্টিক ডাক’ নামে এক ধরনের হাঁস আছে, যারা বুনো ও বিষাক্ত গাছপালা খেয়ে বেঁচে থাকে। বিষ প্রতিরোধের আশায় বিষাক্ত গাছপালার সাথে পন্টিক ডাকের রক্ত মিশিয়ে নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করেন মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। এছাড়াও এক জাতের বিষাক্ত মৌমাছির মধুও সেবন করতেন তিনি। এই সমস্ত বিষ গ্রহণ করে সর্ব অর্থেই বিষ প্রতিরোধী হয়ে উঠলেন তিনি।

খ্রিস্টপূর্ব ১১৩ অব্দ। সাত বছরের অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে অবশেষে প্রকাশ্যে আসেন মিথ্রিডাটিস্‌ ইউপাটর। সোজা হাজির হলেন রাজধানী সিনোপ শহরে। দখল করলেন সিংহাসন। সিংহাসনে বসলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌ হিসেবে। সিংহাসনে বসেই প্রতিশোধ নেন মায়ের উপর। বন্দি করেন রাজমাতা লেয়ডাইস এবং ভাই মিথ্রিডাটিস্ ক্রেস্টাস্‌কে। দেওয়া হয় কারাদণ্ড। হত্যা করতে থাকেন সিংহাসনের সম্ভাব্য সমস্ত দাবিদারদের। ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই কারাগারে মৃত্যু ঘটে মা ও ভাইয়ের। কথিত, রাজার নির্দেশেই হত্যা করা হয় তাঁর মা ও ভাইকে। নিজের বংশে সিংহাসনের আর কোনো দাবিদার না রাখার লক্ষ্যে, নিজের বোন লেয়ডাইসকে (মায়ের মতো একই নাম) বিবাহ করেন তিনি।

“উগ্র বিষ শরীরে প্রবেশ করিলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাহার চরম ফল ফলিয়া শেষ হইতে পারে, কিন্তু বিষ মনে প্রবেশ করিলে মৃত্যুযন্ত্রণা আনে— মৃত্যু আনে না।”
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এত কাণ্ডের পরও কিন্তু বিষ প্রয়োগে গুপ্তহত্যার ভয় থেকে নিষ্কৃতি পাননি রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের রান্নাঘরে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করেন তিনি। নিয়োগ করেন রয়্যাল টেস্টার। খাবার চেখে দেখার জন্য। তাছাড়া আগের মতোই এখনও নিয়মিত সেবন করে চলেছেন বিষ প্রতিষেধক। কিন্তু তাতেও যেন নিজেকে বিপন্মুক্ত ভাবতে পারছেন না তিনি। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করার পর, অবশেষে এক সর্ববিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করার কথা ভাবলেন তিনি। এই সর্ববিষ প্রতিষেধক হবে এমন এক মিশ্র ভেষজ, যা সমস্ত ধরনের বিষক্রিয়াকে প্রশম করতে সক্ষম হবে। সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক প্রস্তুত করার জন্য তলব করলেন রাজবৈদ্য ক্রেটুয়াসকে। ক্রেটুয়াসকে জানালেন, সর্ববিষ প্রতিষেধক তৈরি করতে চান তিনি, আর এই বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুতির দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে। রাজার ইচ্ছায়, সর্ববিষ প্রতিষেধক তৈরিতে ব্রতী হলেন ক্রেটুয়াস। ক্রেটুয়াস নিমগ্ন হলেন সর্ববিষ হরার প্রস্তুতিতে। নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে অবশেষে তিনি সক্ষমও হলেন এক সর্ববিষহরা প্রস্তুত করতে। অচিরেই সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক তুলে দিলেন তিনি রাজার হাতে। ক্রেটুয়াসের প্রস্তুত করা সেই সর্ববিষ প্রতিষেধক বা ইউনিভার্সাল অ্যান্টিডোট্‌স নিয়মিত গ্রহণ করতে শুরু করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।

এক পরাক্রমশালী রাজা হিসেবেই ইতিহাসে বিধৃত হয়েছেন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। যুদ্ধক্ষেত্রে ও রণকৌশলে রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্ ভয়ংকর ছিলেন। রাজ্যভার গ্রহণ করার পরই রাজ্য বিস্তারে বিশেষ মনোযোগী হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌। প্রথমে আক্রমণ শানাতে থাকেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমূহে। একে একে ছোটো বড়ো বিভিন্ন রাজ্য দখল করতে শুরু করেন তিনি। আনাতোলিয়া (তুরস্ক) অঞ্চলের রোমান মিত্র রাজ্যগুলো জয় করে ইজিয়ান সাগর তীরে রোমান রাজ্যের সীমানায় উপস্থিত হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্। এই সময়ে গোটা আনাতোলিয়া অঞ্চল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে ফেলেন তিনি। ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের হাতে রোমান মিত্রদের পরাজয় এবং পন্টাস রাজ্যের বিস্তারে চিন্তিত হয়ে পড়েন রোমানরা। ফলস্বরূপ খ্রিস্টপূর্ব ৮৯-৬৩ অব্দের মধ্যে তিনবার মিথ্রিডাটিসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন রোমান সেনাদল, ইতিহাসে যা ‘মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। রোম সাম্রাজ্যের সীমা থেকে মিথ্রিডাটিসকে হঠাতে রোমান সেনাধ্যক্ষ লুসাস কর্নিলিয়স সুলার নেতৃত্বে বিশাল এক বাহিনী হাজির হয় পন্টাস রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে। শুরু হয় ‘প্রথম মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৮৯-৮৫ অব্দ)। প্রাথমিকভাবে কিছুটা পিছু হঠেন মিথ্রিডাটিস্‌। পরে পালটা আঘাতও হানেন তিনি। ফলে, দীর্ঘস্থায়ী হল যুদ্ধ। বছর চারেক পর, খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ অব্দ নাগাদ রোমান রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সেনাধ্যক্ষ সুলার রোম অভিমুখে যাত্রা করেন। একই সময়ে মিথ্রিডাটিসের বিজিত রাজ্যেও শুরু হয় বিদ্রোহ। ফলে উভয়পক্ষই যুদ্ধ বিরতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরিণতিতে সমাপ্তি ঘটে প্রথম মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধের। ঘরোয়া অবস্থা কিছুটা সামলানোর অনতিকাল পরেই আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন দু-পক্ষ। শুরু হয় ‘দ্বিতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৮৩-৮২ অব্দ)। এই যুদ্ধে রোমানরা পিছু হঠতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের কাছে। এরপর বেশ কিছুটা সময় শান্তই ছিল উভয়পক্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ অব্দে, পার্শ্ববর্তী বেথিনিয়া রাজ্যে নিজেদের পছন্দের উত্তরাধিকারকে মসনদে বসাতে গিয়ে ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন এই দুই রাজ্য। শুরু হয় ‘তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ’ (খ্রিস্টপূর্ব ৭৩-৬৩ অব্দ)। দশ বছর ধরে চলল এই তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রোমান সেনাদের নেতৃত্ব দেন সেনাধ্যক্ষ নিয়াস পম্পিয়স ম্যাগনাস, যিনি ‘পম্পি’ নামে অধিক পরিচিত। দীর্ঘ দশ বছর ধরে যুদ্ধ করার পর, মিথ্রিডাটিসের রণক্লান্ত সেনাবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজ্যলাভের আশায়, পন্টাস রাজ্যের এই সেনা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মিথ্রিডাটিসেরই দুই পুত্র। মিথ্রিডাটিসের সেনারা আর যুদ্ধ করতে নারাজ। বরং এই যুদ্ধবাজ রাজার বিরুদ্ধে রোমানদের সাহায্য করতেই বেশি আগ্রহী তাঁরা। পরিণতিতে তৃতীয় মিথ্রিডাটীয় যুদ্ধে পরাজিত হন মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের স্ত্রী-কন্যা ও নিকটজনদের নিয়ে রাজধানী সিনোপ ত্যাগ করে কৃষ্ণসাগরের উত্তর দিকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্যান্টিকাপিয়ম শহরের দুর্গে আত্মগোপন করেন তিনি। এদিকে মিথ্রিডাটিসের পালানোর সংবাদ পেয়ে তাঁর সন্ধানে নেমে পড়েন রোমান বাহিনী। তাঁকে বন্দি করতে প্যান্টিকাপিয়মে সেনা পাঠান পম্পি। প্যান্টিকাপিয়ম অভিমুখে রোমান সেনা অভিযানের খবর জানতে পারেন মিথ্রিডাটিস্‌। কিন্তু না, রোমানদের হাতে কিছুতেই ধরা দেবেন না তিনি। রোমানদের গ্রেপ্তারি এড়াতে সপরিবারে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন মিথ্রিডাটিস্‌। নিজের সঙ্গে সবসময়েই কিছু পরিমাণে বিষ বহন করতেন মিথ্রিডাটিস্‌। সেই বিষ তিনি তুলে দিলেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হাতে। রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের দুই মেয়ে— মিথ্রিডাটিস্‌ (পিতার মতো একই নাম) ও নাইসা, বিষ পান করে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর স্ত্রীও বিষপান করা মাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অবশিষ্ট বিষের সবটাই পান করেন মিথ্রিডাটিস্‌ নিজে। সেই মারাত্মক বিষপান করেও মৃত্যু হল না তাঁর, দিব্যি বেঁচে রইলেন তিনি। নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক গ্রহণ করে, এখন তিনি নীলকণ্ঠ। কোনো বিষই আজ আর বিষ বলে প্রতীয়মান হয় না তাঁর কাছে। সকল প্রকার বিষের প্রতিরোধী হয়ে গেছেন তখন তিনি। তাই মারাত্মক এই বিষ সেবন করার পরও দিব্যি বেঁচে রইলেন মিথ্রিডাটিস্‌। তবে বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর শরীর তখন অবসন্ন, ক্লান্ত। দেহে আর শক্তি যেন নেই তাঁর। নির্জীব হয়ে নিজ শয়নকক্ষে পড়ে আছেন তিনি। কিন্তু বেঁচে আছেন। এদিকে রোমান সেনারাও শহরে ঢুকে পড়ল বলে। কিন্তু না, জীবন থাকতে রোমান সেনাদের হাতে ধরা দেবেন না তিনি। অগত্যাই তাঁর বিশ্বস্ত এক সেনাকে ডেকে মিথ্রিডাটিস্ নিজেকে হত্যা করার আদেশ দিলেন। অনুরোধেই হোক বা নির্দেশে, তাঁর অনুগত সেনার হাতেই শেষপর্যন্ত মৃত্যু বরণ করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।

ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পরই রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন রোমান সেনারা। রাজার ঘরে ঢুকে, মৃত রাজাকে উদ্ধার করেন তাঁরা। রাজার পাশে একটা পুঁথি উদ্ধার করেন রোমান সেনাদল, তাতে বেশ কয়েকটা বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুতির উপায় লিপিবদ্ধ করা ছিল। সেনাধ্যক্ষ পম্পির হাতে সেই পুঁথি তুলে দেন রোমান সেনারা। পুঁথির গুরুত্ব বুঝে তা সযত্নে রক্ষা করেন সেনাধ্যক্ষ পম্পি। কিছুকাল পরে, তাঁর উদ্যোগেই এই পুঁথির রোমান অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

“আমার ফণার মণি করিলাম উল্কাপিণ্ড তুলি
মহাকাল-করে জ্বালাময় বিষ-কেতন উঠিনু দুলি।
সেদিন আমারে প্রণতি জানাতে এলো কত নর-নারী,
বন্দিয়াছিল আমারে ভাবিয়া সাগ্নিক নভোচারি।”
— কাজী নজরুল ইসলাম

মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পর, সাময়িকভাবে ইতিহাসের অন্তরালে চলে যায় এই সর্ববিষ প্রতিষেধকের ঘটনাটা। মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পর রোমান মেডিক্যাল এনসাইক্লোপেডিয়ার রচয়িতা অলাস কর্নিলিয়স সেলসাস (খ্রিস্টপূর্ব ২৬-৫০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর বিখ্যাত ‘দি মেডিসিনা’ গ্রন্থে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্‌ ব্যবহৃত এই সর্ববিষহরার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এই গ্রন্থে এই সর্ববিষহরার উপকরণের বিশদ বিবরণও পেশ করেন তিনি। সেই সময়ে, মিথ্রিডাটিস্‌ ব্যবহৃত সর্ববিষহরার নাম হয়তো অনেকেই শুনেছিলেন, কিন্তু সেই বিষহরার উপাদান সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিলেন সবাই। সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই দ্রুত জনপ্রিয়তা তথা পরিচিতি লাভ করতে থাকে এই সর্ববিষহরা। অচিরেই, মিথ্রিডাটিসের নাম থেকেই এই সর্ববিষহরা ‘মিথ্রিডাটিয়ম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কোনো কোনো গ্রন্থকার আবার এই সর্ববিষহরাকে মিথ্রিডাটাম নামেও উল্লেখ করেছেন। মিথ্রিডাটিয়মে মোট ৩৬টা উপাদান আছে বলে উল্লেখ করেছেন সেলসাস। এই ৩৬টা উপাদানই ভেষজ তথা উদ্ভিজ। এর উপাদান হিসেবে এমন কিছু ভেষজের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, যা কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই পাওয়া যায়। সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই মিথ্রিডাটিয়ম নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে আমজনতার। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই ভাবতে থাকেন এই প্রতিষেধক সেবন করলে বুঝি সমস্তরকমের অসুখ থেকেও নিস্তার পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের আশায় রাজা প্রজা নির্বিশেষে এই মহৌষধ সেবনের আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু কে বানাবে সেই মিথ্রিডাটিয়ম? ক্রেটুয়াসের মতো সেই কুশলী ওষুধ নির্মাতা কোথায়? তবু হাল ছাড়তে নারাজ অনেকেই। ফলে নতুন করে প্রস্তুত হতে লাগল মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই সেই প্রস্তুত প্রণালিতে বড়োসড়ো পরিবর্তন আনলেন। বিষের তীব্রতা বাড়াতে অনেকেই আরও নতুন নতুন উপাদান যুক্ত করলেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই মিথ্রিডাটিয়মের ৫৪ খানা উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত রোমান ইতিহাসবিদ প্লিনি (২৩-৭৯ খ্রিঃ)। এই তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন বেশ কিছু মানুষ। তবে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে কেউ সফল হয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কারণ, শুধু উপাদানের বর্ণনা থেকে তো আর কোনো ওষুধ বা রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করা সম্ভব নয়। সেইসমস্ত ওষুধ বানাতে গেলে নির্দিষ্ট তাপ, চাপ, কতক্ষণ ধরে তা ফোটাতে হবে, কোনটা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে হবে, কোনটা গোটা ব্যবহার করতে হবে, সেইসমস্ত তথ্যও তো জানা প্রয়োজন। সব দিক বিবেচনা করে, আধুনিক মিথ্রিডাটিয়ম বিশেষজ্ঞরা তাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মিথ্রিডাটিয়ম বানানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মিথ্রিডাটিয়মের উপাদানগুলোর পরিমাপ লক্ষ করলে দেখা যাবে, কোনোটা ২৯ গ্রাম নেওয়া হয়েছে, তো কোনোটা ২৬.৬৬ গ্রাম, আবার কোনোটা ১.৬৬ গ্রাম নেওয়া হয়েছে। আজ থেকে অত হাজার বছর আগে, এত সূক্ষ্ম পরিমাপ করা যে, কীভাবে সম্ভব হল, তা অনুমান করা কিন্তু বেশ কষ্টকর।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক প্রাচীন এবং চিত্তাকর্ষক বিষয় বিষবিদ্যা বা টক্সিকোলজি। সাপের বিষ, মাকড়সার রস, আর্সেনিকাদি খনিজ বিষ, হেমলক জাতীয় ভেষজের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় মানুষের। ইতিহাস বলছে, মিথ্রিডাটিসের সমসময়ে রোম, গ্রিস, এশিয়া মাইনর অঞ্চলে বিষপ্রয়োগে গুপ্তহত্যা ছিল বহু রাজপরিবারের ইতিহাসের অঙ্গ। কোনো সন্দেহ নেই যে, সেইসমস্ত রোমহর্ষক মৃত্যুগুলোর সাথে একসঙ্গে ঠাঁই পাবে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুও। ইতিহাসের গর্ভে থেকে যায় কত বিষাক্ত ইতিহাস।

গ্রন্থঋণ:
1. ‘The Poison King: The Life and Legend of Mithradates, Rome’s Deadliest Enemy’, Adrienne Mayor, Princeton University Press, 27 March 2011.
2. ‘Mithridates the Great: Rome’s Indomitable Enemy’, Philip Matyszak, Pen & Sword Military, Reprint Edition, 1st March, 2016.

Categories
2021-July-Jenkobita

কোব্যায়শি ইশা

ভাষান্তর: রাজীব দত্ত

[কোব্যায়শি নব্যুয়কি থেকে কোব্যায়শি ইশা। ইশা মানে ‘এক কাপ চা’। এটা ছদ্মনাম। জাপানের অন্যতম যে-চারজন অন্যতম জেন কবি; ইশা তাদের একজন। বাকিরা হচ্ছেন বাশো, বুসোন এবং শিকি। ইশা কবিতা লেখা শুরু করেন শৈশবেই। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর লেখা কবিতার সংখ্যা বিশ হাজারেরও বেশি। তার মধ্যে অধিকাংশই প্রকৃতি নিয়ে। একটা মাছি, মথ, ফড়িং, ব্যাঙ, শামুক, মাকড়শা, প্রজাপতি, চড়ুইপাখি, কোকিল, কুকুর, চেরিফুল সকলেই ইশার বিষয়। তাদের সবার সাথেই মিলে মিশে নিজের মনুষ্য জীবনের দিকে যেন তাজ্জব তাকায় আছেন। বিহ্বলভাবে। পড়তে পড়তে সেই বিহ্বলতায় আমরাও সংক্রমিত হচ্ছি। কল থেকে পানি পড়ার শব্দ, পুরোনো দরজার আওয়াজ, মরচে পড়া তালা সব রকম প্রাত্যাহিকতার মাঝেই যেন ইশা। আর এটাই বোধহয় জেন; জেন কবিতা। সীমার মধ্যে অসীমের সন্ধান।

এইবার অনুবাদ প্রসঙ্গ। হাইকুর যে-শব্দবিন্যাস, তার যে-নিয়ম, তাকে এখানে মানা হয়নি। কারণ, আমার ধারণা, জাপানি ভাষা-শব্দের যে-বিন্যাস চাইলেও বাংলায় তা মানা সম্ভব না। দুইটা দুই ভাষা। ভাষা ভিন্ন হবার কারণে তার ব্যাকরণ-উচ্চারণ ইত্যাদি বিষয়াদিও ভিন্ন হতে বাধ্য। জাপানি বর্ণমালার হিসেবে বাংলাকে সাজালে তা কাঠখোট্টাও হয়ে উঠতে পারে। তাই, স্বাধীনতা নিয়েছি যথেষ্ট। কারণ তথাকথিত মূলানুগত থাকার দায়ে পাঠক যেন হোঁচট না খান। যেন মনে না করেন তিনি ভিন ভাষার সামনে। বলতে পারেন, পাঠকের অজুহাতে নিজের দায় নিজেই কমিয়ে নিলাম। উপায় ছিল না আর। এর আগে ইশার কবিতার আরেক কিস্তি অনুবাদ আরেক জায়গায় ছাপা হয়।

আরেকটা বিষয়, সবগুলো কবিতাই ইন্টারনেট থেকে নানা জায়গা ঘুরে সংগ্রহ করা এবং বেশিরভাগেরই ইংরেজি অনুবাদক রবার্ট হ্যাস। যেহেতু জাপানি থেকে ইংরেজি, তারপর ইংরেজি থেকে বাংলা; তাই নিশ্চিন্তেই বলা যায় দুধ তো নাই-ই, ঘোলও বাকি নাই। তাই ভালো হয় যদি আপনি ইংরেজিটাই পড়েন এবং আমার ভুলগুলা ধরায় দেন।]


ও টুনটুনি—
এই দিক ওই দিক তাকায়া
কী খুঁজো?


কোকিলটা কানতেছে;
যেন মাত্র দেখল
পর্বতটারে।


বরফ গলতেছে;
আর গ্রামটা ভরে গেল
বাচ্চাকাচ্চায়।


কাকটা
এমনভাবে হাঁটতেছে
যেন চাষবাস করতেছে


এই গরমকালের রাইতে
তারারাও
কানাকানি করতেছে।


একটা বাছুর
এই হেমন্তের বৃষ্টিতে
ঘুরতেছে।


নতুন বছর, নতুন সকাল
হাঁসেরা পুকুরে
প্যাকপ্যাক।


নয়া বছর
নয়া নয়া ফুল;
আর আমার যাচ্ছে আর কী!

১০
শুয়েছিলাম দুপুরে;
কৃষকদের গান শুনে
লজ্জা পাইলাম।

১১
পুরাদিন
ঘুমায় কাটাই দিলাম;
কেউ-ই কিছু কইল না।

১২
মাছিরা
আমি বাইরে যাইতেছি
তোমরা ধুমায়া প্রেম করো

১৩
ঘুম থেকে উঠে
হাই তুলতে তুলতে
বিলাইটা প্রেম করতে চলে গেল

১৪
ও চড়াইপাখি
রাস্তা ছাইড়া দাও;
ঘোড়া আসতেছে

১৫
এমনকী পোকাদের সাথেও—
কেউ গাইতে পারে
কেউ পারে না।

১৬
এই দুনিয়ায়
নরকের ছাদে হাঁটতে হাঁটতে
ফুল বাগান দেখতেছি

১৭
মাকড়শারা,
টেনশন নিয়ো না
ঘর এরকমই থাকবে।

১৮
মাছিদের মাইরো না
তারা হাত জোড় কইরা
মাফ চাইতেছে

১৯
পয়সাওয়ালাদের জন্য
বরফ পড়া নিয়া হাবিজাবি লিখতেছি,
আর্ট-টার্টনা।

২০
একটা বড়োসড়ো ব্যাঙ আর আমি;
একজন অপরের দিকে
অপলক তাকায় আছি।

২১
কী অদ্ভুত!
এই ফুলে ভরা চেরির নীচে
বাঁইচা থাকা

২২
বুদ্ধের ছবির নীচে
বসন্তের ফুলও কেমন জানি
ঝিমাইন্না ঝিমাইন্না।

২৩
এই বসন্তের বৃষ্টিতে
সুন্দর একটা মাইয়া,
হাই তুলতেছে।

২৪
ভাবতেছি,
বাপের মুখের উপর থেকে
মাছিগুলা তাড়ায় দিব।

২৫
ও ফড়িং,
তুমি কি আসছ আমাদের
পথ দেখাইতে?

২৬
দেখলাম
টেলিস্কোপ দিয়ে;
দশ পয়সার একটা ব্যাঙ

২৭
একটা কোকিল গান গাইতেছে;
আমারে শুনায়া,
পর্বতরেও শুনায়া।

২৮
পোকামাকড়ের কাছ থেকে ঘরটা
ধার নিয়া
ঘুমাইতে ছিলাম।

২৯
মানুষ কই?
সব মাছি আর
বুদ্ধ।

৩০
লোকটা মুলা তুলতে ছিল;
মুলা দিয়েই আমারে
রাস্তা দেখাইল।

৩১
হাঁস চরতেছে পুকুরে;
ওরাও কি আজকে
সুখ আাশা করতেছে?