Categories
2021-Utsob-Krorpotro

সংগীতা এম. সাংমা

 

ওয়ানগালা একটি উৎসব

পাহাড়ের ঢালে ঝুম চাষ করে জীবনযাপন করা গারো জাতি বা সমতলের গারো, যারা কাঁদা-মাটিতে চাষ করে— তাদের উৎসবগুলো অনুষ্ঠিত হয় ফসলকে কেন্দ্র করে। ফসল রোপণ থেকে ঘরে তোলা অবধি বিভিন্ন উৎসব পালন করে গারো জনজাতি।

তার মধ্যে ‘ওয়ানগালা’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এটি বর্ষার শেষে এবং শীত শুরু হওয়ার মাঝামাঝি সময়, অর্থাৎ, সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবর মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয়। ‘ওয়ান’ শব্দের অর্থ হল নৈবেদ্য বা দেব-দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করার সামগ্রী এবং ‘গালা শব্দটির অর্থ হল উৎসর্গ করা।

‘সাংসারিক’ ধর্মে বিশ্বাসী এই জাতি দেব-দেবীর স্মরণে ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবার উদ্দেশ্যেই এই উৎসব ধুমধাম করে পালন করে। গারোরা এই প্রাচীন অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মকে সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য একদিনের জন্য হলেও ওয়ানগালা পালন করে থাকে। এই উৎসবের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি এবং লোকশ্রুতি।

মনে করা হয় প্রাচীনকালে মানুষ জীবন-ধারণের জন্য আলু, বনকচু, বিভিন্ন ধরনের মূল ইত্যাদিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। ধান, ভুট্টা, গম ও অন্যান্য শস্য তখন মানুষের কাছে অজানা ছিল। সেই যুগে পৃথিবীতে গিসিল বল গিত্তল রিকগে সামল জাফাং মনল (Gisil Bol Gitol Rikge Samol Japhang Monol) নামে এক বিশালাকায় গাছ ছিল। সেই গাছের চব্বিশটি শাখা ছিল। বারোটি শাখা পূর্ব দিকে এবং বাকি বারোটি ছিল পশ্চিম দিকে। প্রতিটি শাখা এক-একধরনের ফলে পরিপূর্ণ ছিল। এক শাখায় ছিল সর্বপ্রকারের মুল্যবান খনিজ যেমন- হিরে, সোনা, রুপো। অন্য শাখায় ছিল বিভিন্ন শস্যাদি যেমন– ধান, তুলো, রেশম-সহ আরও অনেক কিছু। সেই বৃক্ষের অন্য আর একটি শাখায় ছিল আশ্চর্যরকমের বিভিন্ন প্রজাতি আর রঙের ধান— নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি ইত্যাদি।

আ-জারেকছি জাপা নামের এক জায়গায় এইসব রঙিন ধানের একটি বাগান ছিল যার নাম Gliting Dinge Rane Dingje.

অবাক করার বিষয় হল এই শাখা থেকে কেউ ধান পেড়ে নিতে পারত না। একদিন বাতাসের দেবতা জারু মে-আ জাবাল ফান্তে অখখুয়াংসি জাফাত চংসি (Jaru Me.a Jabal Pante Okkhuangsi Japat-Chongsi) এবং ঝড় ও শিলার দেবতা মিখখা তেম্মা স্তিল রংপা (Mikka Temma Still Rongma) একসঙ্গে শক্তিশালী পায়ের ঝাঁকিতে সেই আশ্চর্য ধানের কিছু বীজ মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু গারোরা ব্যাপারটি খেয়াল করেনি। এদিকে নিউ নিকিসের দেবী, নামছিল আ-নিং নকসিক চিনিং নমিন্দিল আ-নিং ডিপারি চিনিং ডিপারা (Ah-ning Noksik Chining Nomindil Ah-ning Chining Dipera) মাটি থেকে সেই ধানের বীজ তুলে এ নিজের বাগানে রোপণ করে। পরবর্তীকালে মিসি সালজং তার কাছ থেকে বীজ ধার নিয়ে ধান চাষ করে।

ওয়ানগালা নৃত্যের একটি দৃশ্য, ছবি : গুগুল

একদিন মিসি সালজং হাটে যাওয়ার পথে দেখা হয় রাসং (আ-নি-আপিল ফাচিনি গালাফা) নামে এক লোকের সঙ্গে, তার হাতে ছিল একখানি নিড়ানি যা দিয়ে সে মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন আলু ও বন্যমূল সংগ্রহ করত। রাসং-কে বেঁচে থাকার জন্য নিত্য পরিশ্রম করতে হত। তার পরনে ছিল গাছের বল্কল। পোশাক ছিল খুবই জীর্ণ ও ধুলো মাটি দিয়ে ঢাকা। রাসং তাই মিসি সালজংকে দেখে লজ্জা পেয়ে পাশের একটা পাথরের পেছনে লুকিয়ে পরে। এরপর মিসি সালজং তাকে বেরিয়ে আসতে বলে। তার সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা দুজনে ‘দংক্রেং’ নামক গাছের নিচে দুপুরের খাবার খেতে বসে।

মিসি সালজং ভাত ও মাছ খেত কিন্তু রাসং এসব খাবার সম্পর্কে জানত না। সে শুধু বনের ফল-মূল, আলু এসবই খেত। তাকে দেখে মিসি সালজং খুব দুঃখ পেল এবং তাকে জিজ্ঞেস করল সে ঝুম চাষ করতে জানে কিনা। রাসং বলল বন পুড়িয়ে ঝুম চাষ জানে। ধানচাষ সম্পর্কে জানে না। মিসি সালজং দয়ার বশে বলে যে, তিনি তার জন্য ধানের বীজ পাঠাবে। রোপণ করে ফসল যখন পাবে তখন যেন প্রথম ফসলের কিছু অংশ ভোগ করার পূর্বে তার নামে উৎসর্গ করে। এমনটা যেন প্রতি বছর করা হয়।

মিসি সালজং বাড়ি ফিরে প্রতিশ্রুতিমতো তার চাকর নক খলজসিকসককে দিয়ে ধানের বীজ রাসং-এর জন্য পাঠাল। কিন্তু সেই চাকর হিংসা করে আধা শুকনো বীজ রাসং-কে এনে দিল। এদিকে রাসং খুব উৎসাহ ও আগ্রহের সঙ্গে বীজ রোপণ করে দেখা শুনা শুরু করল কিন্তু কিছুতেই বীজ অঙ্কুরিত হল না। রাসং রেগে গিয়ে মিসি সালজং-এর স্বর্গীয় বার্তাবাহী দূত দিমরে, চুন, বাং শেও বাং দিংকে নিজের কাছে বন্দি করে রাখল। এর পর মিসি সালজং তার দূতদের ছেড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করে এবং তার বদলে উত্তম বীজ দেবার প্রতিজ্ঞা করে।

এরপর রাসং আবার আগ্রহের সঙ্গে চাষ করা শুরু করে এবং দক্ষিণা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বৃষ্টিতে বীজ থেকে চারা গজিয়ে উঠল। এভাবে ধানগাছ যখন পরিপুষ্ট হয়ে উঠল, কিন্তু ধানকাটার সময় Mattengke Mesewal-এর এক শয়তান চাকর ধান চুরি করে কেটে মিসি সালজং-এর কাছে মিথ্যে অভিযোগ জানায়, যে, রাসং ফসল দেবতার জন্য কিছু তো রাখেইনি বরং লুকিয়ে ফসল তুলতে শুরু করেছে। মিসি সালজং এতে ভীষণ রেগে রাসং-সহ তার পুত্র এবং বার্তাবাহকদের বন্দি করল।

রাসং অনুনয় করে সব জানালো কীভাবে তাদের সম্পর্কে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছে এবং মুক্তি প্রার্থনা করলে। মিসি সালজংকে মুক্তি দিয়ে রাসং-এর সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক করল।

বাড়ি ফিরে রাসং ফসল তুলে কিছু অংশ ধূপ ও মদ সহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে মিসি সালজং-এর উদ্দেশে উৎসর্গ করল। এভাবেই রাসং তার আচিক আহ সংয়ের ভূমিতে জন্মানো ফসল উৎসর্গিত করে মিসি সালজংকে সন্তুষ্ট করল। মিসিসালজং আশীর্বাদ করে বলল—

“এইলোক এবং তার বংশধরদের ভূমিতে বেড়ে উঠুক এই শস্য, তার বংশ যেন চির আশীর্বাদ পেয়ে থাকে। প্রতিবছর পৃথিবীতে আমার আগমনের সময় হোক এ নৈবেদ্য উৎসর্গ”।

বর্তমান সময়ে গারোদের বেশিরভাগ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার দরুন নতুন ফসল যিশু খ্রিস্টের উদ্দেশে উৎসর্গ করে। বাইবেল অনুযায়ী, ঈশ্বর ভূমিজাত সবরকম শস্যের দশমাংশ ও অগ্রিমাংশ তাকে নিবেদন করবার কথা বলেছে। কারণ, তিনিই তাদের ফসল উৎপাদনের সামর্থ্য দেয়। তাই বাইবেল এবং পুরোনো ধর্মদুটোকে মিলিয়ে গারো সম্প্রদায় এই উৎসবটি পালন করে।

বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত এই উৎসব। যেমন— ওয়ানমা, রংচয়া, দ্রুয়া, ঘুরে ওয়াতা ইত্যাদি।

কৃষি নির্ভর গারো জাতি বারোমাসই কৃষিতে নিযুক্ত থাকে। শীত বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা চাষের স্থান নির্বাচন করে। তখন জুমাং সিআ অনুষ্ঠান পালিত হয়। এরপরে সর্ব প্রকার ফসলের দেবী কিরি রক্ষিমকে মর্ত্যে আসবার জন্য আহ্বান জানানো হয় আসিরকআ অথবা গিচ্ছিপং রকআ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তৃতীয় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে আগালমাকা যার মাধ্যমে গারোরা নকমা কর্তৃক ভাগে পাওয়া চাষের জমির ঝোপঝাড় আগাছা পরিষ্কার করে। চতুর্থ পর্যায়ে বেড়ে ওঠা সবুজ শস্য খেতে পালন করা হয় মি আমুয়া বা মেজাক সিমআ। এর পরে পালিত হয় রংচুগালা, এই অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র দেবী কিরি রক্ষিমকেই নয় মিসি সালজং-সহ অন্যান্য দেব-দেবীদেরকেও সন্মান জানায়। ষষ্ঠতম অনুষ্ঠান হল জামেগাপা বা মেদংরাউনা যা ওয়ানগালার প্রাক্কালে পালন করা হয়।

বছরের শেষ এবং প্রধান উৎসব হবার কারণে ওয়ানগালা প্রতি বছর সমষ্টিগতভাবে পালন করা হয়। গ্রামের সকলের খাদ্য শস্য ঘরে তোলা হয়ে গেলে নকমা (গ্রাম প্রধান) সবাইকে ডেকে ওয়ানগালার দিন তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। তারিখ ঘোষণার পর থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে ঘর বাড়ি গোছানো এবং মেরামত করা, অন্যান্য গ্রাম থেকে নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা— সবই জোরকদমে শুরু হয়ে যায়। যুবক-যুবতীরারা ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজিয়ে নাচ গানের মহরা দেয়। এই উৎসব মূলত তিনটে ধাপে সম্পন্ন হয়—

১. রুগালা— এই অনুষ্ঠানটি সাধারণত ১৫ই কার্তিকে পালন করা হয়। অর্থাৎ, ধান কাটবার পরে। এই দিন ভোরবেলায় নকমা ‘আসিরাক্কা’ বা জমি চাষের আগে পূজা করে মন্দ শক্তি দূর করবার স্থানে গিয়ে সালজং দেবতার পূজা করে। দুপুরে প্রথমেই ‘নক-গাত্তা’ বা ‘ঘরে তোলা’ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ধান বা ফসলাদি ঘরে তোলা হয়। এরপর গ্রামবাসী সকলে নকমা বা সমাজ/গ্রাম প্রধানের বাড়িতে সমবেত হয়। নকমা প্রথমে ভাণ্ডার দেবী রংদিক মিৎদে এবং গৃহ দেবতা নকনি মিৎদের পূজা করে এবং মিসি সালজং দেবতার উদ্দেশে নৈবেদ্য উৎসর্গ করে। এর পর একে একে গ্রামের সবার বাড়িতে পর্যায়ক্রমে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

২. সাসাৎ সওয়া— এই অনুষ্ঠানটি করবার একটি উদ্দেশ্য হল সালজং দেবতার প্রতি ধূপ প্রজ্বলন করা। এই দিন রাজকীয় বেশে নকমা এবং খামালেরা (পুরোহিত) প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে নৃত্য-গীতরত লোকেদের মাঝে কৃত্রিম ঘোড়ায় চড়ে নাচ করে। এটিকে ‘গুরে রদিলা’ বলা হয়। পুরোনো বিশ্বাস ‘সাসাৎ সওয়া’ বা ধূপ জ্বালানোর মাধ্যমে পরবর্তী বছর কেমন কাটবে সেটা গণনা করা হয়ে থাকে। যেমন— যখন ধূপ জালানো হয় তখন যদি ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠে তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে, এ-বছর ভালো কাটবে না। মনে করা হয় সামনে মহাবিপদ। ধূপ জ্বালানোর সময় যদি আগুন না জ্বলে শুধু ধোঁয়া নির্গত হয় তখন ধরে নেওয়া হয় যে, আগামী বাছর খুব ভালো কাটবে।

৩. দামা-গগাতা বা জল ওয়াতা বা রুস্রাতা— এটি অনুষ্ঠানের শেষ দিন এবং দেবতাদের বিদায় দেওয়া বা শেষবারের মতো নৈবেদ্য উৎসর্গ করার দিন। এই দিন সবার বাড়িতে সালজং দেবতা এবং রক্ষিম দেবীর উদ্দেশে মদিরা এবং ধূপ উৎসর্গ করে প্রার্থনা এবং তাঁদের বিদায় জানানো হয়। সন্ধ্যের আগেই যুবকেরা বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে নকমার বাড়িতে ফিরে আসে এবং নকমা ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে। নকমার ঘর থেকেই অনুষ্ঠানের সূচনা এবং সমাপ্তি দুটোই সম্পন্ন হয়।

গারোরা এই ওয়ানগালা আরও দুটো উদ্দেশ্যে পালন করে থাকে। প্রথমত, উৎপাদিত ফসল বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, পঙ্গপাল ইত্যাদির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেত। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ব্যাধি, মহামারি, রোগ-জীবাণুর হাত থেকে মুক্তি পেতে। গারোরা বিশ্বাস করে এই উৎসবকালে আসংততা নামে এক অদৃশ্য শক্তি উপস্থিত থাকে। সে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করে থাকে।

ওয়ানগালার নিয়ম রীতি, সমবেত ভোজন, নৃত্য-গীত এসব মনের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এবং বাহ্যিক বিষয়। দেবদেবীদের ভুলে না যাওয়া, তাদের স্মরণ করা, তাদের আশীর্বাদের প্রতিদানে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। তাদের মান্য করে জীবনযাপন করাই ওয়ানগালার নিগূঢ়তথ্য ও আসল বিষয়।

সহকারী লেখক: গৌতম সরকার

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

সুশীল রাভা

লোকধর্মের পিঠস্থান: আদি কামাখ্যাধাম

কথায় আছে “বিশ্বাসে মিলে বস্তু তর্কে বহুদূর”।লোকধর্মের মূল ভিত্তি হল অন্তর্নিহিত আত্মার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই জন্মায় ভয়, ভীতি ও ভক্তি। ভক্তি থেকে সৃষ্টি হয় নানাপ্রকার দেবদেবীর কল্পিত রূপ। সেই কল্পিত রূপই স্থান-কাল বিশেষে প্রতিষ্ঠা পায় থান, ধাম, মন্দির প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বস্তুত সেই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ লোকবিশ্বাসের অন্তরালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে লোকধর্মের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো সেইসবের পীঠস্থান অথবা লোকধর্মের মিলনক্ষেত্রে বলেও প্রচলিত। নবগঠিত আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রাম ব্লকের অন্তর্গত মধ্য কামাখ্যাগুড়ি গ্রামে অবস্থিত ‘আদি কামাখ্যাধাম’ তারই একটি নিদর্শন। শতাব্দী প্রাচীন এই ধামটি কে বা কারা, কবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র নেই। তবে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে ধামটি নাকি কোচবিহারের রাজবংশের কোনো এক রাজা শিকার করতে এসে ধামটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কোন রাজা বা কোন রাজ-আমলে ধামটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার কোনো লিখিত সূত্র নেই। বস্তুত সেইসময় লিখিত তথ্যের অভাবে কোচবিহার মহারাজগণের বহু ইতিহাস অজানাই থেকে গেছে। তথাকথিত গবেষকগণও বিষয়গুলি এড়িয়ে গেছেন।

এই জনশ্রুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। এলাকার জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানদের বক্তব্য থেকে জানা যায় আদি কামাখ্যধামটি নাকি বুড়া রাজার আমলে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু কে বুড়া রাজা, তার নামই-বা কী ছিল, তার কোনোটাই বলতে পারেননি। তবে প্রত্যেক বক্তাই রাজা বাদ্য-বাজনা সহকারে শিকারের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেই সূত্রে এটা অনুমান করা যায়, যে, খুব সম্ভবত মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলেই ধামটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কারণ, কোচবিহার মহারাজগণের শিকার কাহিনি পর্যালোচনা করে জানা যায় সেই সময়কালে একমাত্র মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই আধুনিক পদ্ধতিতে রুচিসম্মত সরঞ্জাম নিয়ে শিকার যাত্রায় যেতেন।

কোচ রাজবংশের মহারাজদের মধ্যে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশিক্ষিত এবং আধুনিক রুচিশীল। তাঁর রাজত্বকালেই কোচবিহার রাজপ্রাসাদসহ রাজনগর আধুনিক শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে ঐতিহাসিক পণ্ডিতগণ মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণকে কোচবিহার রাজবংশের আধুনিক রূপকার বলে বর্ণনা করেন। জানা যায় মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ এক থেকে তিন সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে শিকার যাত্রায় বেরোতেন। শিকার করার আধুনিক সরঞ্জাম-সহ মনোরঞ্জনের গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্র সঙ্গে রাখতেন। বিশেষত সাময়িক অবকাশ যাপন ও অবসাদ কাটানোর জন্য গান-বাজনা এবং হাস্যকৌতুক ছিল মনোরঞ্জনের অন্যতম উপাদান। কোনো কোনো সময় ম্যাজিক শো-ও দেখানো হত। শিকার অভিযানে বেরিয়ে যেখানেই রাত্রিযাপন করত, সেখানেই গানবাজনা ও হাস্যরসে গমগম করত। ফলে স্থানটি এক জমকালো উৎসবে পরিণত হত।

কোচবিহার ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ১৮৬৩-১৯১১ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তার মধ্যে ১৮৭১ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর শিকার করার রেকর্ড রয়েছে। এই ৩৭ বছরে তিনি ৩৬৩টি বড়ো বাঘ, ৩১১টি চিতা বাঘ, ২০৭টি গণ্ডার, ৪৮টি বাইসন, ৫৩৩টি হরিণ, ৮১২টি অন্যান্য জীবজন্তু মেরেছিলেন।

মহারানি সুনীতি দেবীও একজন দক্ষ শিকারি ছিলেন।সেই সময় তিনি টাকোয়ামারী (বর্তমান-আটিয়ামোচড়) জঙ্গলে ১১টি বাঘ শিকার করেছিলেন। উল্লিখিত ধামটি ছিল টাকোয়ামারী বনাঞ্চলেরই অন্তর্গত। বস্তুত বনাঞ্চলটি অতীতে ভুটান-সহ অসমের মানস অভয়ারণ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সূত্রে এই অঞ্চলটি ছিল বন্য জীবজন্তুদের অবাধ বিচরণভূমি। ধাম অবস্থিত অঞ্চলটিও ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। ফলে কোচবিহারের শিকার বিলাসী মহারাজগণ প্রায়শই আসত শিকার করতে এই অঞ্চলে।

জনশ্রুতিতে রয়েছে একসময় রাজা শিকার করতে এসে, বর্তমান ধাম অবস্থিত নিকট স্থানে নল, খাগড়াবেষ্টিত একটি কর্দমাক্ত নালা (ডোবা) পার হতে গিয়ে রাজার হাতির চারটি পা কাদায় ডেবে যায়। মাহুত অনেক চেষ্টা করেও হাতিটিকে তুলতে পারেননি। ফলে সেইসময় রাজা অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিশেষত তাঁর এই প্রিয় হাতির করুণ দশা দেখে রাজা একপ্রকার ভেঙেই পড়েছিলেন। সেই সময়েই জঙ্গলের পাশেই বস্তিতে বসবাসকারী একজন বৃদ্ধ ‘কোচা-হুজি’, অর্থাৎ, কোচ (রাজ্য) জনগোষ্ঠীর গুণিন কবিরাজ, জঙ্গলে হাতির চিৎকার এবং মানুষের গুঞ্জন শুনে কৌতূহলবশত ধীরে ধীরে ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসেন। ‘হুজি’ দেখতে পান রাজার হাতি হাওদা সহ কাদায় ডেবে গেছে।

হাতির এই অবস্থা দেখে, হুজি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে রাজাকে বলেন— “মহারাজের অনুমতি হলে আমি একটা উপায় দেখতে পারি”।

বিচলিত রাজা হুজির কথা শুনে কিছু না ভেবেই একটু বিরক্তির সুরেই বলেন— “কী উপায় আছে তাড়াতাড়ি বলো”।

হুজি রাজার অনুমতি পেয়েই কাঠিতে গণনা করে বলে দেন, যে, এখানে কামাখ্যা মায়ের পুজো দিতে হবে। পুজো দিলেই হাতি উঠে দাঁড়াবে। বিচলিত ও উদ্বিগ্ন রাজা হুজির কথা শুনেই তৎক্ষণাৎ পূজার আয়োজন করার নির্দেশ দেন হুজিকেই। হুজি রাজার আদেশ পেয়ে আনুষঙ্গিক উপাচার জোগাড় করে তন্ত্রমতে ভক্তি ভরে কামাখ্যা মায়ের পুজো করেন। সেই সময় সূর্য প্রায় অস্তগত। অগত্যা রাজা পাশেই একটা উঁচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী শিবির তৈরি করে প্রিয় হাতির ওঠার অপেক্ষায় রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নিশিরাতে কিছু একটা শব্দে রাজার ঘুম ভেঙে যায়। সেইসময় রাজার একজন প্রহরী (সেপাই) ছুটে এসে খবর দেন মহারাজের হাতি কাদা থেকে উঠে গাছের পাতা খাচ্ছে। রাজা তাঁবু থেকে বেরিয়েই দেখেন, তাঁর প্রিয় হাতিটি সত্যি সত্যিই কাদা থেকে উঠে গাছের পাতা খাচ্ছে।

রাজা এইরূপ অলৌকিক ঘটনা দেখে দেবীর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে ভক্তিভরে প্রণাম করে ঘোষণা করেন— “এখন থেকে প্রতি বছর অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে এই স্থানে কামাখ্যা মায়ের পূজা করা হবে। আর এই পূজার খরচ কোচবিহার রাজকোষ থেকে পাঠানো হবে”।

বস্তুত তখন থেকেই অদ্যাবধি ধামের পূজা প্রচলিত নিয়মেই চলে আসছে। তবে কোচবিহার রাজকোষ থেকে কত দিন ধামের পূজার খরচ বহন করা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। মূলত এলাকার অধিবাসীরাই চাঁদা তুলে ধামের পূজা প্রচলন ধরে রেখেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদি কামাখ্যা ধাম অবস্থিত অঞ্চলটি অতীতে প্রাচীন কামরূপ (রত্নপীঠ) এর অন্তর্গত ছিল। এই প্রাচীন কামরূপ বা রত্নপীঠকে বলা হত তন্ত্র প্রধান দেশ। সেই দেশের অধিবাসীগণ ছিলেন মাতৃতান্ত্রিক এবং তন্ত্রে মন্ত্রে প্রসিদ্ধ। কামাখ্যা ছিল তাদের উপাস্য দেবী। সেই সূত্রে আদ্যাশক্তি কামাখ্যাদেবীর প্রভাব ছিল কামরূপের সর্বত্র বিরাজমান। উল্লিখিত ধামটি বলা চলে তারই একটি নিদর্শন। কোচ মহারাজাগণ ছিলেন আদ্যাশক্তি কামাখ্যা দেবীর উপাসক ও পরমভক্ত। সেই সূত্রে উল্লিখিত ধামটি কোচবিহার মহারাজগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

জনশ্রুতি রয়েছে কামাখ্যা দেবীর নামেই নাকি এই জনপদের নাম হয়েছে কামাখ্যাগুড়ি। ‘গুড়ি’ শব্দের অর্থ অবস্থান। কামাখ্যা এবং গুড়ি শব্দদু-টি মূলত মঙ্গোলীয় শব্দ বলে ভাষা তথা সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। এখানে কামাখ্যা দেবীর অবস্থান ঘটেছিল বলেই জায়গার নাম হয় কামাখ্যাগুড়ি।

এই স্থানের নাম সম্পর্কে ঐতিহাসিক কোনো তথ্যসূত্র না থাকলেও ইংরেজ গবেষক ডি. এইচ. ই. সন্ডার্স ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্সের প্রথম সেটেলমেন্ট জরিপের রিপোর্টে ধামটির কথা উল্লেখ করে গেছেন।

তিনি বলেছেন— “There was an idol, kamakhya thakur under a palash tree here. The taluk thus obtained its name- it is entirely under jungle”

এই শব্দগুলি তর্জমা করলে দাঁড়ায়— এখানে একটি পলাধঃ গাছের নীচে কামাখ্যা ঠাকুরের মূর্তি (থান) ছিল। তাই অঞ্চলটি এই নাম লাভ করে।

সন্ডার্সের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই প্রমান হয় স্থানটি অতি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী ধাম। ধামের প্রধান দেবী কামাখ্যা হলেও পাশাপাশি আরও আঠারোটি অনুসারী লৌকিক দেবদেবী রয়েছে। তাদের মধ্যে শীতলী, পাগলী, জোকা-জুকি, বাগসুর, কালসুর, বোকাসুর, লোহাসুর, মুড়িয়া মাশান, (বাগসুর, কালসুর, বোকাসুর, লোহাসুর এরা প্রত্যেকেই মাশান) রাখাল ঠাকুর, বুড়াঠাকুর, ভোটমুনি, সত্যপীর, বাসুকি, মনসা-সহ শিব, গঙ্গা ও লক্ষ্মী নারায়ণ আছে। উল্লিখিত দেব-দেবী তন্ত্রমতে এবং হুজি, অর্থাৎ, তান্ত্রিক দ্বারা পূজিত হন।

ধামের পূজা নাকি এক-দু-বছর বন্ধ ছিল। তার ফলে গ্রামে এক মহামারী কলেরার প্রকোপ শুরু হয়। জানা যায় সেই সময় গ্রামের বহু শিশু ও বৃদ্ধ মারা যান। সে-সময় গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়েছিল। এই মহামারি কলেরার হাত থেকে রক্ষা পেতেই গ্রামের অধিবাসীগণ তৎকালীন গাঁতবুড়া রাজবর রাতার নেতৃত্বে গ্রামের অশুভ শক্তিকে বিদায় করতে ‘হাংসবায়’, অর্থাৎ, গ্রাম পূজার আয়োজন করেন। সেই সময়ই গ্রামের প্রধান দেবী কামাখ্যা-সহ গ্রামের লৌকিক দেব-দেবী ও উপ-দেবতাগণের পূজা করে নদীতে ভেলা ভাসানো হয়। ভেলা ভাসানোর উদ্দেশ্য অশুভ শক্তিকে বিদায় করা। সমস্ত দেব-দেবীর পুজো করে অপশক্তি এবং কু-দৃষ্টির প্রকোপ থেকে বাঁচতেই, অর্থাৎ,ৈ সামগ্রিক মঙ্গলকামনার্থে মায়ের ভেলা ভাসানো হয়। ফলত তখন থেকেই রীতি মেনে অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে ১১ আষাঢ় প্রতি বছর এই ধামের পূজা হয়ে আসছে। লৌকিক নিয়মে অম্বুবাচি তিথিতে পূজা করা হয় বলেই এই পূজাকে আমোতি/আমতি পূজাও বলা হয়।

ধামের মহাপূজার ১৫-২০ দিন আগে থেকেই বিশেষ দিন দেখে লৌকিক নিয়মে প্রত্যেক দেবদেবীর নামে বাঁশ জাগানো হয়। বাঁশের বিশেষত্ব ১০-১৫ ফুট লম্বা চিকন (সরু) বাঁশ সুন্দর করে মাটিয়ে দেব-দেবীর চরিত্র অনুযায়ী লাল শালু ও সাদা শালু কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বাঁশের মাথায় ত্রিশূল বা চামর (চঙর) লাগানো হয়। যেমন প্রধান দেবী কামাখ্যার বাঁশ লাল-শালু কাপড় ও ত্রিশূলযুক্ত। দেবীরই বিকল্প রূপ-মা কালীর বাঁশ হয় অনুরূপ কাপড়ে মোড়ানো মাথায় কালো চঙর (চামর) লাগানো। অনুরূপভাবে আরও অন্যান্য দেব-দেবীগণের নামেও বাঁশ সাজানো হয়। এই বাঁশগুলো তন্ত্রমতে মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে শুদ্ধিকরণ করে জাগিয়ে তোলা হয়। বাঁশ জাগানোর বিশেষত্ব এই বাঁশ জাগানোর পরে কোনো তুলা রাশি ব্যক্তি হাতে নিলে, সেই ব্যক্তিটির ভর জাগে। এইরূপ অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য ধামের পুজোর দিন বহু মানুষের সমাগম ঘটে। বাঁশগুলো জাগানোর পর প্রত্যেক দেব-দেবীর থানে রেখে দেওয়া হয়। অম্বুবাচির আগেরদিন পর্যন্ত বাঁশগুলো নিয়ে গ্রামের আবালবৃদ্ধ মিলে ঢোল-করকা (বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে প্রতিদিন নগর পরিভ্রমণ করে মাগন তোলেন।

অনুরূপভাবে মা বোনেরাও প্রধান দেবী মা কামাখ্যার যোট নিয়ে নগর পরিভ্রমণ করে মাগন তোলেন। মায়ের যোট বহন করা হয় কোনো অকুমারী (?) মেয়ের দ্বারা। বিশেষত অকুমারী মেয়ের মাথায় যোটটি বসিয়ে নগর পরিভ্রমণ করেন এবং মাগন তোলেন। সেই মাগনের চাল বিক্রি করে মূল পূজার উপকরণ সামগ্রী ক্রয় করা হয়।

তেল, সিঁদুর, ধূপ-ধুনা, আতপচাল, কলার থাতি, ফুল, দূর্বা প্রভৃতি উপাচার সহ দেব-দেবীর চরিত্র অনুযায়ী হাঁস, মুরগি, কবুতর ও পাঁঠা বলি বা উৎসর্গ করে দেওয়া হয়। মহাপূজা হয় প্রতি বছর ১১ আষাঢ় অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে। সেইদিন বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের কাছে মানত করতে। বিশেষত কেউ আসেন সন্তান লাভের জন্য, কেউ-বা আসেন পারিবারিক শান্তি বা রোগমুক্তির দিশা নেওয়ার জন্য। বস্তুত মহাপুজোর দিন একাধিক ভত্তরীয়া ভর জাগেন। সেই ভত্তরীয়ার মাধ্যমে দেব-দেবীগণ ভক্তদের নানা সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেন। সেই দিন ভত্তরীয়াগণ এক অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেন। প্রত্যেকেই স্বাভাবিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এক অলৌকিক শক্তিতে ভর করেন। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য! ভত্তরীয়াগণ অলৌকিক শক্তিতে ভর করে পাঁঠা, কবুতরের মুণ্ড ছিঁড়ে তাজা রক্ত পান করে থাকেন। এইরূপ দৃশ্য দেখে মনে হয় ধামের দেব-দেবী আজও অতি সক্রিয় এবং জাগ্রত।

বিশেষত এই মহাপূজার মধ্য দিয়েই ভেলা ভাসিয়ে ধামের পুজোর সমাপ্তি ঘটানো হয়। ভেলা ভাসানোর উদ্দেশ্য সমস্ত আপদ-বিপদ ও অশুভ শক্তিকে বিদায় দেওয়া।

ভেলার বিশেষত্ব, পাঁচটি কলাগাছ একত্রিত করে গেঁথে ভেলা তৈরি করা হয়। ভেলার বৈশিষ্ট্য মাঝের কলা গাছটি বাড়তি রেখে দুই সাইডের দু-টি করে কলাগাছের মাথা তেড়া করে দিয়ে ভেলার মাথা চোখা করা হয়। ভেলার মাঝখানে নৌকো ঘরের ন্যায় ছই টাঙিয়ে ঘর বানানো হয়। সেখানেই অশুভ শক্তির বিনাশক মহাকালীর পুজো সাজানো থাকে। পূজা করা হয় সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে হুজি, অর্থাৎ, তন্ত্রসিদ্ধ পূজারী দ্বারা। এই পুজোয় পাঁঠা ও কবুতর উৎসর্গ করে বাদ্য বাজনাসহকারে ভেলাটি পালকির ন্যায় বহন করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে পুজোর পনেরো-কুড়িদিন আগে জাগানো বাঁশগুলোও বিসর্জন দেওয়া হয়। সেই রীতি আজকের দিনেও প্রচলিত রয়েছে।

ভেলা সাজান এবং তন্ত্রমতে পূজা

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে তৎকালীন মাড়েয়া (ধামের প্রধান) ভগলু রাভার নেতৃত্বে ধামে প্রথম মূর্তি পূজার শুরু হয়। এর পূর্বে শুধু থান বা ঢিবির উপরেই পূজা করা হত।

দেবী সিংহবাহনের উপর শায়িত শিবের নাভিপদ্ম থেকে প্রস্ফুটিত পদ্মে আসন করে বসা দেবীর ৬টি মাথা, ১২টি হাত, ২টি পা এবং দশ হাতে বিভিন্ন অস্ত্রে সুসজ্জিত। দেবীর দুই পাশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু দণ্ডায়মান। এইরূপ অদ্ভুত আকৃতির দেবীর পাশাপাশি আরও অনেক লৌকিক দেব-দেবী আছে। তার মধ্যে মুড়িয়া মাশান ও বাগসুর অন্যতম। এহেন লোকধর্মের ঐতিহ্যবাহী ধামের পুজোরীতি মেনে শতাধিক বৎসর ধরে চলে আসলেও সরকারিভাবে এখনও পর্যন্ত কোনোরকম দৃষ্টিপাত করা হয়নি। পায়নি কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা, পায়নি কোনো সরকারি-অনুদান অথচ এই ধাম বা মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারত পর্যটনকেন্দ্র বা সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন রইল।

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

মনোরঞ্জন উরাও

ওঁরাওদের কয়েকটি উৎসব

কথায় আছে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’, ওঁরাওদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটে থাকে। ওঁরাও সমাজের মানুষেরা সাধারণত উৎসব প্রিয় হয়। অন্যান্য উপজাতিদের মতো এরাও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানান সংস্কার ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠান পালন করে। ওঁরাওদের কয়েকটি বিশেষ উৎসব হল— করম পূজা, আষাঢ়ী পূজা, বড়ভূত বা মান্‌খা পূজা, সহরাই বা গোয়াল পূজা, পুনামাণ্ডী, সারহুল, ভেলোয়া ফারী বা ডাণ্ডাকাট্টানা, খারিয়ানি ও ফাগুয়া পূজা প্রভৃতি। তবে ওঁরাও সমাজে সমস্ত পুজো পার্বণে ‘ভেলোয়া ফারী বা ডাণ্ডাকাট্টানা’ নামক অনুষ্ঠানটি পালন করে থাকে। পুজো পদ্ধতি এক এক জায়গায় এক এক রকম হয়ে থাকে। মূলত ওঁরাও সমাজের মানুষেরা প্রকৃতি পূজারি। প্রকৃতির মধ্যেই ঈশ্বরকে অনুভব করে। এই সমাজের নব্বই সতাংশই কৃষিজীবি। তাই তাদের বেশিরভাগ পুজো-পার্বণ হয় বৃক্ষ এবং ফসলকে কেন্দ্র করে।

করম বা কারাম উৎসব:

ওঁরাও সমাজে একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব হল ‘করম বা কারাম উৎসব’। ভাদ্রমাসের শুক্লাপক্ষের একাদশী তিথিতে এই উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। এটি মূলত প্রকৃতির পূজা তথা গাছের পূজা। করম পুজোর সাতদিন আগে থেকে ওঁরাও সমাজের কুমারী মেয়েরা দাতন ‘কাঠিগেঙে’ নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ বোনা ছোটো টুপা বা ডালা বালি দিয়ে ভরতি করে। তারপর গ্রামের প্রান্তে এক জায়গায় ডালাগুলিকে রেখে ‘জাওয়া’ গান গাইতে

করম পূজা, ছবি: গুগল

গাইতে তিন পাক ঘোরে। এর পর তেল ও হলুদ দিয়ে মোটর, মুগ, ছোলা, কুর্তী ও ভুট্টা বীজ মাখানো হয়। এসব কাজ কুমারী মেয়েরা করে থাকে। একে ‘জাওয়া মা’ বলে।

গ্রামের বয়স্কদের নির্দিষ্ট করা একটি জায়গায় দু-টি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয়। যা সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর বা ধরম ঠাকুর হিসাবে পূজিত হয়। করম পুজোর দিন করম গাছকে নতুন কাপড় পরিয়ে গাছকে আলিঙ্গন করে, ধূপ ও সিঁদুর দিয়ে পূজো করে ডাল কাটার অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়। তারপর নতুন কপড় পরে উপবাসী তিনজন যুবক তিনটি ডাল কেটে নিয়ে আসে। একই ভাবে নববস্ত্র পরিহিত তিন জন কুমারী মেয়ে যুবকদের কাছ থেকে ঐ ডাল উপাসনা দেবীর কাছে নিয়ে আসে। ওঁরাও সমাজের পুরোহিত তথা মাহাত সেগুলো নিয়ে পূজা অর্চনা শুরু করে।

কুমারী মেয়েরা করম পুজোর দিনে সারাদিন উপবাস করে সন্ধ্যার পর একটি থালায় ফুল ফল-সহ পুজোর নৈবেদ্য সাজিয়ে করম ডাল যেখানে আছে সেখানে গিয়ে পুজো দেন। ঐ সময় ওঁরাও রমণীরা গানের মাধ্যমে ধরিত্রী তথা বসুমাতা তথা ভূমিদেবীর কাছে প্রার্থনা জানায় যে, এ-বছর যেন ভালোভাবে বৃষ্টি হয়। ফসলে যেন পোকা না হয়। ফসল যেন ভালো হয়। এছাড়াও সকল পরিবারের সুখ সমৃদ্ধিও কমনা করে থাকে। পূজার মাহাত পূর্ব উল্লেখিত ধর্মা কর্মার গল্প সকলকে শুনিয়ে থাকে। সেইসঙ্গে সারারাত ধরে চলে নাচ গান।

পরের দিন সকালে মেয়েরা ‘জাওয়া’ থেকে অঙ্কুরিত বীজ গুলোকে তুলে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বাড়িতে নিয়ে এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম গাছটিকে জলে ভাসানো হয়ে থাকে। পুজোর পরে মেয়েরা পরস্পরকে করম ডোর বা রাখি পরিয়ে দেন।

আষাঢ়ী পুজো:

আষাঢ় মাসে জমিতে বীজ বপনের আগে এই উৎসব হয়। মূলত বৃষ্টির উদ্দেশে এই পূজা করা হয়। গ্রামের সকলে মিলে এই পুজো করে থাকে। আষাঢ় মাসে এই পুজো হয় বলে একে আষাঢ়ী পুজো বলে। ওঁরাও সমাজের বেশিরভাগ লোক কৃষিজীবি। তাই তারা জমিতে হালচাষের আগে ভূমিমাতাকে হিসাবে পুজো করে থাকে। ওঁরাও সমাজের কারো মতে মাটির নীচে থাকা অনেক ছোটো ছোটো জীব তাদের নাঙলের আঘাতে মারা যায়। তাই ধরিত্রী মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই পূজা। এই পুজোর উপকরণ হিসাবে থাকে কলা, বাতসা, আম, কাঁঠাল, জবাফুল, দুব্বা ঘাস, আতপচাল। পায়রা, ছাগল, পাঠাও বলি হয়। এই দিনে ঘর বাড়ি গোবর-মাটি দিয়ে মোছার পর একটি পুরোনো কুলোর মধ্যে ঝাটা, গোবরের তৈরি ঘুটোতে আগুন ধরিয়ে তাতে কয়েকটি শুকনো লঙ্কা ছিটিয়ে বড়োরা বাচ্চাদের গায়ে হালকা ধোঁয়া দেয়। তাদের বিশ্বাস এতে অশুভ শক্তির আক্রমণ থেকে বাচ্চারা রক্ষা পাবে।

পাড়ার মহিলারা (মা অথবা দিদা) সেই পুরোনো কুলোয় ঝাটা-সহ গোবরের ঘুটো রাখা কুলোটি বাড়ি থেকে দূরে ফেলে আসে। তারপর সকলে পুকুরে স্নান করে বাড়ি ফেরে।

সোহরাই বা গোয়াল পূজা:

ওঁরাওদের আর একটি উৎসব হল ‘সোহরাই পরব’ বা ‘গোয়াল পূজা’। সোহরাই পরবটি কার্তিক মাসের কালি পুজোর পরের দিন পালন করা হয়। বিশেষ করে সেই দিনে বাড়ির গৃহপালিত পশু,
দিন পালন করা হয়। বিশেষ করে সেই দিনে বাড়ির

সোহরাই বা গোয়াল পূজোর ছবি, ছবি : গুগল

গৃহপালিত পশু, অর্থাৎ, গোরু ছাগলদের পূজা দেওয়ার রীতিই হল সহরাই পরব। এই দিন সকাল থেকে এই পুজো শুরু হয়। সেই দিন ঘরবাড়ি গোবর দিয়ে মুছে গোয়াল ঘর থেকে বাইরের আঙিনা পর্যন্ত চালের গুড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। আলপনার মাঝে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। সেই দিন গোরু ছাগলদের পুকুরে স্নান করান হয়।

মোটর, ছোলা, মাসকলাই, এবং চাল-সহ সেদ্ধ করা হয়। যাকে ওঁরাওদের ভাষায় ‘দানাভাত’ বলে। পুজোর দিন সকালে গোরু ছাগলকে স্নান করিয়ে সর্ষের তেল মাথায় সিঁদুর দেওয়ার পর দানাভাতের সঙ্গে হাড়িয়ার জল পাত্রে নিয়ে প্রত্যেক গোরু ছাগলকে একটু একটু করে খাওয়ানো হয়। তারপর বাড়ির সকলে প্রসাদ হিসাবে দানাভাত মুখে দেয়।

একটি লাল মোরগ গোয়াল ঘরে বলি দেওয়া হয়। তারপর সেই মোরগের মাংস দিয়ে গোয়াল ঘরে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়। ওঁরাও সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এই খিচুড়ি বাড়ির সকলের না-খাওয়া পর্যন্ত কাউকেই বিতরণ করা যাবে না। পুজোর শেষে চলে বাড়ির বয়স্কদের হাড়িয়া খাওয়া। এভাবেই পূজা সম্পন্ন হয়।

ডাণ্ডা কাট্টানা বা ভেলোয়া ফারি উৎসব:

ডাণ্ডা কাট্টানা একপ্রকার শুদ্ধিকরণ উৎসব। ওঁরাও সমাজের সবক্ষেত্রেই সকল বিষয়েই পবিত্রতা রক্ষা করে চলা আবশ্যক। তাই প্রতিটি শুভ কাজে তারা ডাণ্ডাকাট্টানা পূজা করে থাকে। নতুন বাড়ি তৈরি থেকে শুরু করে গৃহপ্রবেশ বা যে-কোনো শুভ কাজের সূচনাতে যেমন নারায়ণ পূজা বা সত্যনারায়ণ পূজা করা হয় তেমনই ওঁরাওরা ‘ডাণ্ডা কাট্টানা’ অনুষ্ঠান করে থাকে।

এই অনুষ্ঠান যে-কোনো দিন সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে করা হয়। ওঁরাওরা তাদের যে-কোনো শুভ কাজের প্রারম্ভে, অর্থাৎ, বিবাহ অনুষ্ঠান, সদ্যজাত শিশুর আঁতুর, শ্রাদ্ধ, করম পার্বনের সমাপ্তিতে ভোর রাত্রে, শস্য ঝাড়াই-এর পর, বাঁধ নির্মান, পুকুর খনন, কুয়ো খনন, গৃহনির্মাণ, গৃহপ্রবেশ প্রভৃতি কাজের সূচনাতে এই শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান করে থাকে। ডাণ্ডা কাট্টানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ধার্মেস (ঈশ্বর), চালা আয়ো (ধরিত্রী মাতা), বিইড়ি বেলাস (সূর্যদেব), তাদের পূর্বপুরুষ ও অন্যান্য দেবদেবীর পুজো করে থাকে।

তাদের বিশ্বাস এই অনুষ্ঠান কেউ না করলে, সে অশুচি থেকে যায়। সমাজের কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বা কোনো প্রকার শুভ কাজে কিংবা কোনো পুজো পার্বনে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। সংসারের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রাপ্তির জন্য এবং গ্রহের প্রতিকূল প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য এই শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান করা উচিত বলে তারা মনে করে।

জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও অন্যান্য শুভকর্ম অনুযায়ী ডাণ্ডা কাট্টানার পদ্ধতি যেমন ভিন্ন তেমনই পুজোর সামগ্রী বিসর্জন দেওয়ার নিয়মও আলাদাভাবে পালিত হয়ে থাকে। এই পুজোর প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হল— একটি নতুন কুলা, আতপচাল, উনুনের পোড়া মাটি, একটি দেশি মুরগির ডিম, একটি মাটির প্রদীপ, কাঠকয়লার গুঁড়ো, কাঁঠাল পাতার তিনটি ঠোঙা, আতপ চালের গুড়ি, দেশি মদ বা হাড়িয়া, এক ঘটি জল ও ভেলোয়া কাঠি বা চিরচিটি গাছ (লঙ্কা গাছের মতো ছোটো গুল্মজাতীয় গাছ) ইত্যাদি।

বয়স্ক ব্যক্তিরাই এই পুজোতে অংশগ্রহণ করে থাকে। গোবর দিয়ে নিকানো পরিষ্কার জায়গায় ওঁরাও পুরোহিত পূর্ব দিক মুখ করে আসন পেতে বসে। তার পেছনে দুই দিকে বসে বয়স্ক ব্যক্তিরা। পুরোহিত নিজের কোলে একটি কুলো বসিয়ে তার মধ্যে আতপচাল ও ডিম রাখে। তার আগে লাল, সাদা, কালো রং ব্যবহার করে নিম্নের নকশা অনুযায়ী ডাণ্ডা কাট্টানার চিত্র আঁকা হয়। এই রং গুলোর এক একটি অর্থ আছে। একটি রং আরাধ্য দেব-দেবীর আহ্বান বা বিতাড়ন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ডাণ্ডা কাট্টানা চিত্রের মাঝখানে পূর্ব পশ্চিম লম্বা করে ভেলোয়া দণ্ড রাখা হয়। এই ভেলোয়া দণ্ডের মাঝখানে আতপ চাল গুড়োর ঠোঙাটি রাখা হয়। এর পর ওঁরাও পুরোহিত আতপালের মাঝখানে ডিমটি রেখে মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। পুজো শেষে আতপচাল গুড়ির সঙ্গে ডিম মিশিয়ে উনানের আঁচে সিদ্ধ করে প্রসাদ বানানো হয়। এই প্রসাদ সকলের মধ্যে বিতরণ করা হয় কিন্তু এই প্রসাদ মহিলাদের গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।

ডাংরী উৎসব:

ডাংরী পরবটি ফাল্গুন মাসে কেঁচো মাটি থেকে বের হওয়ার আগে করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বয়স্ক বুড়ি ছাগল বলি দেওয়া হয়। ওঁরাও সমাজে এই অনুষ্ঠানটি করে বাড়ির সকলে সুস্থ থাকার জন্য। ওঁরাওরা মনে করে ডাংরী পুজো করলে বাড়ির সকলে রোগ মুক্ত হয়। কালী মায়ের নামে ডাংরী পরবটি করা হয়। এই অনুষ্ঠানের দিন পুজোর সমস্ত উপকরণ একসঙ্গে একটি পাত্রে সাজিয়ে নিয়ে বাড়ির বাইরে খোলা মাঠে গিয়ে পূজা শুরু হয়। পুজোর পর বুড়ি ছাগলের মাংস খিঁচুড়ি বানানো হয়। তারপর খোলা মাঠে নিমন্ত্রিত সকলকে প্রসাদ হিসাবে খেতে দেওয়া হয়। সকলের খাওয়ার পর অবশিষ্ট খাওয়ার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ওঁরাও সমাজে। বয়স্ক পুরুষ ও মহিলারা খোলা মাঠে বসেই হাড়িয়া পান করে।

পুনামাণ্ডী পরব:

পুনামাণ্ডী পরবটি অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার আগে করা হয়। বয়স্ক পুরুষরা সকলে মিলে এই পরবের দিন ঠিক করে। পুজোর দিনে ঘরবাড়ি গোবর এবং মাটি দিয়ে মোছার পর আঙিনায় লালমাটি এবং চালের গুড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। এই পুজোতে মাটির তৈরি হাঁড়ি, কলসি, ছোটো হাঁড়ি, বাঁশের তৈরি কুলা এবং ঝাটার প্রয়োজন হয়। এই উপকরণগুলো আলপনা দেওয়া স্থানটিতে সাজিয়ে রাখা হয়। তারপর বাড়ির বড়োরা একটি থালায় কলা, বাতাসা, ধূপ, সিঁদুর এবং একটি ধান কাঁটা যন্ত্র নিয়ে নিজের জমিতে পুজো দিয়ে একগোছা ধান মাথায় করে নিয়ে পাট্টায় মারা হয়।

খারিয়ানি উৎসব:

একটি পারিবারিক উৎসব হল ‘খারিয়ানি উৎসব’। খারিয়ানি উৎসবটি মাঘ ফাল্গুন অথবা বৈশাখ মাসে পালন করা হয়। এই পরবে প্রধান উপকরণ হিসাবে একটি সাদা মোরগ এবং একটি কালো মোরগ প্রয়োজন। পুজোর দিন বাড়ির বড়োরা উপবাস করে। এটি পরিবারের নিজস্ব পুজো। ঘরের এককোণে মোরগদুটোকে পুজো করে বলি দেওয়া হয়। তারপর সেই বলি দেওয়া দুটো মোরগ দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে দুই জায়গায় খিঁচুড়ি বানানো হয়। কালো মোরগের মাংস দিয়ে বানানো খিঁচুড়ি পরিবারের সকলে খান এবং সাদা মোরগের মাংস দিয়ে বানানো খিঁচুড়ি পাড়ার সকলকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়।

দাসাই কারাম:

দাসাই কারাম উৎসবটি দুর্গাপূজার দশমীর দিনে করা হয়। চালের গুঁড়োর তৈরি তেলের পিঠে, হাড়িয়া, ধূপ, সিঁদুর ও তিনটি কলাপাতা ইত্যাদি সামগ্রী প্রয়োজন হয়। দাসাই কারাম পরবটি অনুষ্ঠিত হওয়ার এক মাস আগে থেকে গ্রামের নাচের আসরে ছোটো বড়ো সকলে সন্ধ্যায় খাওয়ার পর ঢোল মাদল নিয়ে নাচ গান করে। এইভাবে একমাস ধরে চলতে থাকে নাচ গান। পুজোর দিন সন্ধ্যা বেলা চালের গুঁড়োর তৈরি তেলের পিঠে প্রসাদ রূপে তিনটি কলাপাতায় করে পুজোর স্থানে রেখে ধূপ, সিদুর, ও হাড়িয়া দিয়ে বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিরা পূর্বপুরুষের নাম উচ্চারণ করে পুজো দেন। গ্রামের সকলে পুজো সেরে তেলপিঠে এবং বড়োরা হাড়িয়া খেয়ে নাচের আখড়ায় সমবেত হয়ে মাদল ও ঢোল বাজিয়ে নাচ গান করেন।

কাড়াভূত পূজা বা মানখা পূজা:

ওঁরাও সমাজের একটি শরীক বা বংশকেন্দ্রিক উৎসব হল ‘কাড়াভূত’ পূজা বা ‘মানখা পূজা’। এই পূজায় প্যারা বা মহিষ বলি দেওয়া হয়। ‘ওঁরাও’ ভাষায় মানখা শব্দের অর্থ মহিষ। এই পূজা সাধারণত এক যুগ, অর্থাৎ, বারো বছর পর একবার করা হয়। এই পূজা কোনো পরিবারে একবার করলে তিনপুরুষ করতে হয় না। এটি একটি শরীক বা বংশের পূজা। বংশ পরম্পরায় এই পুজো ওঁরাও সমাজে চলে আসছে। যে-কোনো মাসের অমাবস্যা রাতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সকলের সুখ, শান্তি, অসুখ এড়ানো, অভাব অনটন থেকে মুক্তি আশায় এই পূজা করা হয়। ওঁরাও মাহান এই পূজা করে থাকে। মাহান মহিষটিকে বস্ করে। ওঁরাও মাহান মহিষটিকে মন্ত্র করে মাঠে ছেড়ে দেয়। তারপর মহিষটি একাই পূজা স্থানে চলে যায়। এভাবেই এই উৎসবটি সম্পূর্ণ হয়। একে খুঁটি পূজাও বলে।

এছাড়াও ওঁরাও সমাজে জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু সংস্কারকে কেন্দ্র করে কিছু উৎসব পালন করা হয়। শ্রাদ্ধকর্মের সময় বাড়ির সকল পুরুষ, শিশুর মস্তক-মুণ্ডন করে টিকি রাখা ওঁরাও সমাজের রীতিতে আছে। কিন্তু বর্তমান কালে বয়স্ক পুরুষরাই ছোটো মাপের ঠিকি রাখে। মহিলাদের প্রসবের ষষ্ঠ দিনে বাচ্চাদর মাথার চুল নেড়া করে প্রসূতিকে স্নান করিয়ে সুদ্ধ করা হয়। কাটা চুল কলার ভেলায় রেখে গঙ্গা দেবীর নামে নদীতে, পুকুরে বা ডোবায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর নামকরণের বিচিত্র অনুষ্ঠান পালন করা হয। কলার ভেলায় রেখে জলে ভাসিয়ে মাতৃবংশ ও পিতৃবংশের নামে আতপচাল ফেলে ‘জোড়ালাগান’ খেলে শিশুর নাম রাখা হয়। ওঁরাও সমাজে শুভ ক্রিয়া-কর্মে ধাতুর পাত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ। অশুভ শক্তির নজর এড়াবার জন্য শিশুর কোমরে কালো সুতোর সঙ্গে চামড়া, লোহার পাত বা গাছের শেকড় বেঁধে দেওয়ার রীতি রয়েছে। একবছর বয়স হলে কন্যা সন্তানের কান ফুটো করা সামাজিক রীতি। পুত্র সন্তান বিবাহের উপযোগী হলে আগুয়া (ঘটক) মারফত ছেলের পিতা কন্যা বাড়িতে সংবাদ পাঠায়। কন্যার পিতা স্থান-দিন নির্ণয় করে আগুয়ার (ঘটক) মধ্য দিয়ে বিয়ের কথা চলতে থাকে। বিবাহের কথা চলাকালীন কন্যার গোত্র ও ছেলের গোত্র দু-পক্ষেরই জেনে নেওয়া খুব প্রয়োজন। একই গোত্রের বিবাহ নিষিদ্ধ। গোত্র এক হলে ধরে নেওয়া হয় যে, পূর্বে কোনো কালে তাদের পিতৃবংশ ও মাতৃবংশ একই পরিবারের একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান ছিল। কোনো এক কালে তাদের পূর্ব পিতৃবংশ ভাই-দাদা ছিল। গোত্র এক হলে ওঁরাও সমাজের বিশ্বাস নতুন যুবক-যুবতী একই মাতৃ গর্ভজাত সন্তান, অর্থাৎ, ভাই-বোন সম্পর্ক।

সাক্ষাৎকার

১. রবি এক্কা, বয়স ৫০, গ্রাম কাজীভাগ, তপন দঃ দিনাজপুর।

২. ঝারিয়া কুজুর, বয়স ৫৮, গ্রাম ফুলবাড়ি, গঙ্গারামপুর দঃ দিনাজপুর।

৩. অজিত লাকড়া, বয়স ৪৫, গ্রাম কাজীভাগ, তপন দঃ দিনাজপুর।

৪. বন্ধন লিণ্ডা, বয়স ৬২, বালুরঘাট, দঃ দিনাজপুর।

৫. মুংলী কুজুর, বয়স ৪৬, গ্রাম বুধইচ, তপন দঃ দিনাজপুর।

 

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

ভাস্বতী রায়

নন্দোৎসব: দধিকাদো ও পুরাতন রাজবংশী সংস্কৃতির অবক্ষেপ

করতোয়া নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা খ্রিস্টাব্দ পূর্বের প্রাচীন সাম্রাজ্য পৌণ্ড্রবর্ধন ও কামরূপের অন্যতম আদি বাসিন্দা হল রাজবংশী। সুপ্রাচীন ও কঠোর সামাজিক ব্যবস্থা্র নিগড়ে গড়া কৃষিজীবী এই সমাজে উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। ধর্মপ্রাণ রাজবংশী সমাজের সমস্ত উৎসবে অনুষ্ঠানে জড়িয়ে আছে বেদ পুরাণের আখ্যান কিংবা রাজবংশী লোকপুরাণের কোনো ‘কিচ্ছা’। সমস্ত উৎসব তাই ঈশ্বরকে স্মরণ রেখে। প্রবীণ মানুষদের কাছে শুনে সেইসব আখ্যান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করে চলেছে রাজবংশী সমাজ। দীর্ঘকাল ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই শ্রুতি কাহিনিগুলোর মাধ্যমে রাজবংশী সমাজে এই উৎসবগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়।

পাশাপাশি বসবাসকারী নানা উপজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে রাজবংশী সংস্কৃতির আদানপ্রদান ও সর্বোপরি বিশ্বায়নের (গ্লোবালাইজেশন) প্রভাবে উৎসব অনুষ্ঠানগুলো তাৎপর্য হারাচ্ছে। আবার কোথাও নবকলেবরে পালিত হচ্ছে কোনো উৎসব। কোথাও-বা বিকৃতি হচ্ছে। বস্তুত বর্তমান সময়ে উৎসবগুলোর অস্তিত্ব সংকটে। তেমনই এক উৎসব হল নন্দোৎসব। বৈষ্ণব মতবাদে দীক্ষিত রাজবংশী পরিবারে এই উৎসব পৃথক গুরুত্ব বহন করলেও সমগ্র রাজবংশী সমাজ এই উৎসবে মেতে ওঠে। এই উৎসবের আগাগোড়া বাৎসল্যভাবের প্রাধান্য দেখা যায়।

জন্মাষ্টমীর পরের দিনের অনুষ্ঠান, রাজবংশীরা যাকে বলে ‘দধিকাদো’। এই দুই দিনের অনুষ্ঠান একযোগে ‘নন্দোৎসব’ বলে অভিহিত হয়। রাজবংশী সমাজে বিশ্বাস, যে, পিতা ও পুত্রকে একযোগে এই উৎসব পালন করা উচিত। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে হয় জন্মাষ্টমী। এই দিন ‘বত্ত’ (ব্রত > বত্ত) থাকা হয়। দিনে উপবাসে থেকে পূজা অর্চনা শেষে নিশি যাপন পালন করা হয়। এইসময় কৃষ্ণের বাল্যলীলাকে সামনে রেখে নানান ভক্তিমূলক গান পরিবেশিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তরশতনাম, কৃষ্ণজন্মের নানান ‘কিচ্ছা’ (আখ্যান) বর্ণনা করা হয়। এর পরদিন, অর্থাৎ, নবমীর দিন আনন্দ উৎসব। এই দিন রাজবংশী সমাজে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বছরের অন্যতম আনন্দ উৎসব এই দিন। এই দিন পালনের ক্ষেত্রে রাজবংশী সমাজে বৈচিত্রের শেষ নেই। রাজবংশী সমাজে এই দিনটিকে বলা হয় ‘দধিকাদো’। এই দিনে দধি অর্থাৎ, দই বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমস্ত ক্ষেত্রে। সারাদিন নানান উৎসবে ও আনন্দে ভরে থাকে ছোটো থেকে বড়ো সকলে। কয়েকটি পর্যায়ে অনুষ্ঠানগুলি সমাপন হয়।

ধর্মীয় কারণবশত কিংবা রাজবংশী সমাজ কৃষিপ্রধান হওয়ার জন্য বিশেষত এই দিনে গোরু ও গোয়ালঘরের পরিচর্যা করা হয়। সকালে গোয়ালীঘর বা গোশালা পরিষ্কার করে ধুয়ে-মুছে গোরু বাছুরদের স্নান করিয়ে রাখা হয়। আবার এই ভাদ্র মাসটি রাজবংশী সমাজে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নানান সংস্কারে, প্রবাদে প্রবচনে ভাদ্র মাসের গুরুত্ব উঠে এসেছে। এইসময় সাধারণত কৃষি সংক্রান্ত কাজ বিশেষ থাকে না। সময়ের বেশ আগেই (ধান বোনা) ‘রোয়া গারা’ শেষ হয়ে যায়। পাট ছোলা, ধোওয়া ও শুকোনোর কাজও সমাপ্ত কিংবা একেবারে শেষের পর্যায়ে। তাই কৃষি যন্ত্রগুলো ধুয়ে শুকিয়ে তুলে রাখা হয়। রাজবংশী মতে এই সময় কৃষিকাজ বাদ দিতে হয়। রাজবংশী প্রবাদ অনুযায়ী ‘ভাদরের তের, হাল কিসসি ছাড়ো’।

ভাদ্র মাসে নববধূ যায় ‘নাইওর’-এ, অর্থাৎ, পিত্রালয়ে। এই যাওয়াকে বলে ‘ভাদরকাটানি’। আবার রাজবংশী লোকপুরাণ মতে ভাদ্র মাসে হয় ‘সিং-এর বিয়াও।’ ‘সিং’ বিয়ে করতে যায় দক্ষিণ দেশে। সিংয়ের সঙ্গে ‘বোঝা উভা’, অর্থাৎ, তল্পিবাহক হিসেবে যায় সমস্ত পক্ষীকুল। বিশেষত ‘ঢাডো সারো’ ও ‘ত্যাল সারো’ (দুই প্রজাতির শালিক পাখি)। আবার রাজবংশী বিশ্বাস মতে ‘ভাদই সাতাও’, অর্থাৎ, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে যে-বৃষ্টিপাত হয় তাতেই শীতকালের সূচনা। ফলে এই দিন গোরু বাছুরকে স্নান করানোর প্রথা বেশ পুরোনো।

এরপর হয় নন্দোৎসবের মূল অনুষ্ঠানের সূচনা।

সবার প্রথমে হয় স্নান উৎসব। বাড়িতে বাল গোপালের বিগ্রহে দধি দুগ্ধে স্নান করানো হয়। এরপর নানা উপচারে পূজা ও ভোগ হয়। নিরামিষ ভোগে থাকে বিশেষত ‘ঢ্যাপের চালের নাড়ু মলা’ (শাপলা ফুলের বীজ থেকে একপ্রকার চাল হয়) ‘বজ্রার নাড়ু’ (একধরনের বৃহৎ আকারের ভুট্টা) ও তালের রসের তৈরি নানা পদ। এর মধ্যে অন্যতম হল তালের নাড়ু, মালপোয়া, মণ্ডা, তালের পাতিজরা, তালের খিরসা আর সিন্নি। ভোগ নিবেদন হয়ে গেলে শুরু হয় ‘দধিকাদো’ খেলা।

মন্দির প্রাঙ্গনে এই খেলার সূচনা হয়। এই খেলার আসরের এককোণে একটি ছোটো মাটির ঢিপি স্থাপন করা হয়। কেউ কেউ এর ওপরে গোপালের বিগ্রহ স্থাপন করে। দুধ জল দিয়ে এই স্থানে ফল, দই, খই দিয়ে পূজা করা হয় তিনজোড়া ফল আর একজোড়া কড়িকে। তেল ও সিঁদুর দিয়ে মঙ্গল চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়। সেই স্থানে চতুষ্কোণ বা গোলাকার করে বিশাল এক অঞ্চলের মাটি কেটে নরম করে রাখা হয়। পুজো হয়ে গেলে ঐ নরম মাটিতে পঞ্চগব্য (দুধ, দধি, ঘৃত, গোময়, গোমূত্র) ঢেলে খানিকটা কাদা বানানো হয়। একে বলে ‘কাদো দেওয়া’। আগে থেকে এনে রাখা জল ঢেলে সম্পূর্ণ অংশটিকে কাদা করা হয়। ‘মারেয়া’ (সংকল্পকারী) বা গৃহকর্তা এর পর ‘খেলানটি’ বা ‘খেলাটু’, অর্থাৎ, খেলোয়াড়দের হাতে খেলার সামগ্রী ফলগুলো তুলে দেয়। এই অনুষ্ঠানকে বলে ‘কাদো ছাড়ি দেওয়া’। এরপর শুরু হয় নানান প্রকার খেলা। তবে শুরুটা হয় ‘নাইকোল খেলা’ দিয়ে।

উৎসর্গীকৃত নারকেল জোড়ার একটি নিয়ে প্রথম খেলা শুরু করতে হয়। কাদো খেলা বা নাইকোল খেলা দিয়ে কাদো খেলার প্রথম সূচনা হয়। খেলায় মেয়েরা সমস্ত জোগান দিলেও এই খেলা মূলত পুরুষ ও বালকেদের। একটি নারকেলকে ঘিরে শুরু হয় দুই পক্ষের মল্লযুদ্ধ। সঙ্গে শুরু হয় ঢাক ও ‘করকা’-র বাদ্য। একজন নারকেলটি চার হাতে পায়ে আঁকড়ে ধরে আর অপরজন সেটাকে তার হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে দর্শক যে-কোনো একটি পক্ষ নেয়। প্রয়োজনে জুটি বেঁধে খেলায় অবতীর্ণ হয়। সকলে প্রবল উৎসাহে এই খেলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে মেতে থাকে।

অপাদমস্তক কাদায় গড়াগড়ি করে খেলা হয়। ক্রমাগাত জল ঢেলে কাদার পিচ্ছিলতা বজায় রাখা হয়। মল্লযুদ্ধের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষ নিয়ে শুরু হয় বাজি ধরা। এইভাবে নারকেল, ‘জম্বুরা’ (বাতাবি লেবু), পানিকুমরা বা পুর (চালকুমড়ো) নিয়ে মল্লযুদ্ধ হয়। এরপরে হয় কড়ি খেলা। এক প্রতিযোগীর হাতের মুঠোতে ধরা থাকে দু-টি কড়ি। তার মুঠো থেকে সেটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে প্রতিপক্ষজন। এছাড়া ঐ কাঁদায় অনেকে লাউ বা কুমড়োর বীজ ছড়িয়ে দেয়। কে কতগুলো সংগ্রহ করতে পারে তারও প্রতিযোগিতা হয়।

দধিভাণ্ড একটি সমবেত খেলা। ‘নাইকোল খেলা’-র মতো প্রতিযোগিতা নেই এতে। খুব উঁচু দু-টি গাছের মাঝে একটি দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। সেই দড়ি থেকে ঝুলতে থাকে একটি ‘হাণ্ডি’ (হাড়ি)। সেই হাণ্ডিকে পেড়ে আনতে হয় বা ভাঙতে হয়। একের কাঁধে অপরজন দাঁড়িয়ে মনুষের পিরামিড বানিয়ে ঐ উচ্চতায় পৌঁছুতে হয়। এই পিরামিড বানিয়ে ওপরে ওঠার পদ্ধতিকে বলে ‘কলোর গছ’ (কলা গাছ)।

চিত্র ঋণ : গনেশ মান মুখিয়া

বাঁশের খেলায় একটি বাঁশের ‘ঝিক মাঠে’, অর্থাৎ, ডাল-পালা ভালোভাবে কেটে তাতে তেল জল দিয়ে পিচ্ছিল করা হয়। সেই বাসের মাথায় উঠে পেরে আনতে হয়ে ওপরে বাঁধা পুরস্কার।

এছাড়াও আরও নানা ধরনের খেলা হয়।

এই অনুষ্ঠানে মাদক দ্রব্য সম্পূর্ণরূপে বর্জিত। বড়োদের খেলা শেষে ছোটো শিশুদের নামিয়ে দেওয়া হয় ঐ কাঁদায়। তারা আপন মনে কিছুক্ষণ কাঁদায় খেলে। মায়েরা দাঁড়িয়ে শিশুর খেলা দেখে। এরপর একের পর এক খেলা চলতে থাকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত। সমস্ত রাজবংশী পুরুষেরা এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে। অংশগ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। ‘বেলা’ (সূর্য অর্থে) যেতে শুরু করলে খেলা শেষ হয় ঐ তিনজোড়া ফল ‘গতান’ দেওয়ার মাধ্যমে, অর্থাৎ, ঐ তিন জোড়া ফল ও একজোড়া কড়ি ‘মারেয়া’-র হাতে ফেরত দিতে হয়। নারকেলগুলোকে প্রসাদ হিসেবে রাখা হয়। চালকুমড়ো গুলোকে প্রসাদ হিসেবে রান্না করা হয়। এরপর খেলোয়াড়রা সবাই স্নান করে এসে প্রথমে ঐ নারকেলের ‘পাকা প্রসাদ’ গ্রহণ করে। খেলোয়াড়দের প্রসাদ গ্রহণ হয়ে গেলে নিমন্ত্রিত ও প্রতিবেশী সকলে প্রসাদ গ্রহণ করে। সবশেষে গৃহকর্তা। পরদিন ‘শিতলি সেবা’ ও নিয়মভঙ্গ।

চিত্র ঋণ : সুমিত সা

নানা কারণে এই প্রাচীন ধর্মীয় উৎসবগুলো বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে। এর নানাবিধ কারণ আছে। বর্তমানে নিষ্ঠার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা, বাজি ধরা, আকর্ষণীয় পুরষ্কার এই উৎসবগুলোর অনেকটা অংশজুড়ে আছে। পুরোনো নিয়মগুলির বহু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তন কতটা ভালো, না, বিকৃত হচ্ছে— সে-প্রসঙ্গে বিতর্ক আছে। তবে এই পরিবর্তন বা সংকটের সম্ভাব্য কিছু কারণ আলোচনা করছি।

যেমন—

১) বিশ্বায়নের প্রভাবে ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে, বিশেষত টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভিন্ন ধারার সংস্কৃতির সংস্পর্শে রাজবংশী সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

২) কৃষিপ্রধাণ রাজবংশী সমাজ পূর্বে কৃষিকর্ম ও গো-পালন ছাড়া অন্য জীবিকার সাথে যুক্ত ছিল না। ফলে কৃষিকাজের দিনপঞ্জির সাথে উৎসবগুলোর যোগসূত্র ছিল গভীর। কিন্তু, বর্তমানে বিভিন্ন জীবিকা, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে একপ্রকার ছন্দপতন ঘটেছে।

৩) বর্তমান রাজবংশী সমাজের সেই পরম্পরাগত রীতিকে অনুসরণের জন্য সামাজিক নিয়ম ও কঠোরতা আর নেই। ফলে নন্দোৎসবের মতো উৎসব তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে তা স্বাভাবিক।

সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। প্রতিবেশীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান সজীব সংস্কৃতির লক্ষণ। রাজবংশী সংস্কৃতিও এই ধারা বজায় রেখেছে। রাজবংশী সমাজে বরাবর রক্ষণশীলতার পরিবর্তে আদানপ্রদানের মনোভাব স্পষ্ট। নন্দোৎসব তাই বিলুপ্ত নাও হতে পারে। কে জানে হয়তো নবকলেবরে আরও মুখর হয়ে উঠতে পারে।

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

সঞ্চিতা টোটো

টোটোদের ‘অউচু’

ভারতের আদিম লুপ্তপ্রায় ও উপজাতি টোটো। সম্ভবত খুব কম সংখ্যক জনসংখ্যার জনগোষ্ঠী। এয়ার মাদারীহাট বীরপাড়া ব্লকের টোটোপাড়া গ্রামে বসবাস করে। অন্যান্য উপজাতিদের মতোই টোটোদেরও নিজস্ব উৎসব-পার্বণ আছে। নিজেদের মতো পালন করে। আদিম. অর্থাৎ, প্রকৃতিকে এরা বিশ্বাস করে। এদের উৎসবগুলো হয় প্রকৃতিকেন্দ্রিক।

টোটোদের সবচেয়ে বড়ো পার্বণ হল ‘অউচু’। অউচু একটি উৎসবের ছাতার মতো। এর মধ্যে অনেকগুলো উৎসব পালিত হয়। কয়েকদিন ধরে এই উৎসব চলতে থাকে। ঠিক দুর্গা পূজার মতো। এক-একদিন এক-এক ধরনের উৎসব হয়। অনুষ্ঠানের ধরনও আলাদা আলাদা। উৎসবগুলোতে সবাই মিলিত হয়—

যেমন—

১) দিনাং-দি-ওয়াও

২) গোরো-য়া,

৩) মান্‌কা।

তবে শুরুটা হয় লাঠি-জাং-ওয়া দিয়ে। লা-জাং-ওয়া হল কোনো কিছু পার্বণ শুরু করার আগে সবাইকে নিয়ে ‘দেমসা’ (Gathering place for any religion/social event Or issue related to society) জড়ো হয়ে পার্বণের দিনকাল নির্ধারণ করার দিন। এইদিন কাইজিগন্নু-সহ গ্রামের সব গোত্রের লোকেদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ‘অউচু’-র দিনগুলো ঠিক করা হয়। অনুষ্ঠানে লাচিজাং-ওয়াক কে হবে সেটা সেই দিন গোত্রের লোকেদের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের জানানো হয়। এর পর শুরু হয় আসল অনুষ্ঠান।

গ্রামে বর্ষা আসার আগে থেকে সকলেই মাঠের কাজ প্রায় সেরে নেয়। যেমন— রান্নার খড়ি জোগাড় করা, সুপারি গাছ লাগানো, গাছে সার দেওয়া, ভুট্টা লাগানো, ফসল কাটা, মারুয়া বোনা ইত্যাদি।

বর্ষাকালে মনে হয় যেন আমাদের এই গ্রামে বৃষ্টি একটু বেশিই পড়ে। নদীনালা সবসময় ভরে থাকে। গ্রামের বাইরে বেরোনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় বললেই হয়। তখন টোটোদের দুর্দশার শেষ থাকে না।

আং রো

লাচিজাং-ওয়া-র সাত দিনের মধ্যেই দিনাং-দি-ওয়ার উৎসবের দিন ঠিক হয়। এইদিন সকালের দিকে নিজেরা বাড়ি থেকে দেমসার দিকে রওনা হয়। প্রত্যেকের হাতে থাকে কাস্তে। তারপর সকলের জমায়েত হলে পরিষ্কারের কাজগুলো শুরু হয়। আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে। অনেকে নিজেদের বাড়ির আশেপাশেও পরিষ্কার করে। এই কাজ সমবেতভাবে হয়। টোটোরা দলবদ্ধভাবে এরকম অনেক কাজ করতে থাকে নিজেদের হিতের জন্য।

এই দিন থেকে সাত অথবা নয় দিন পর ঠিক হয় ‘গোরো-য়া’ পূজার দিন। ‘গোরো-য়া’ পূজা খুব ধুমধাম করে বয়। এতে একটা মোরগ লাগে। সেই মোরগ বলি দিয়ে পূজা করা হয়।

এই পূজাতে পুরোহিত গোত্র অনুযায়ী মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। এবং একসঙ্গে প্রায় একগোত্রের অনেক বাড়ির পূজা করেন একের পর এক একইভাবে।

এইদিন ‘গোরো-য়া’ পূজার পাশাপাশি অন্য দেবতাদের নামেও পূজা হয়। যেমন— তাদেংতি (নদীর নাম), যইপতি (?) ইত্যাদি।

পুজো শেষ না হওয়া অবদি পুরোহিত খালি পেট থাকে। উপবাস করে। টোটোদের বিশ্বাস তাতে এই সমাজের ভালো হয়। এইসব পুজো করা হয় দেবতাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে। যাতে সেই দেবতার রাগ না হয়। কোনো পরিবারের উপর সেই রাগ অভিশাপ হয়ে না পড়ে এই বিশ্বাসে।

মুরগি-মোরগ বলি দেওয়া হয় দেবতার চাহিদা অনুযায়ী। সেটা পুরোহিতই বলে দেয় কোন দেবতার জন্য কোন ধরনের মুরগী বলি দেওয়া হবে। সে বলে দেওয়ার পর সেই মতো মুরগি দেওয়া হয়। মুরগি বলি দিয়ে সেটিকে রীতিমতো পরিষ্কার করে কয়লার আগুনে পোড়ানো হয়। দেবতার জন্য এই খাবার তৈরি করে কলাপাতা করে উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গকৃত সেই মাংস আমাদের কাছে পুজোর প্রসাদের মতো। একে বলা হয় নাং-সা (Nag-Sa)। এর পর সেই মাংস প্রসাদ হিসেবে টোটোরা গ্রহণ করে।

টোটোর প্রতি বছরের কোনো না কোনো সময়ে পারিবারিক পুজো করে থাকে। এই পূজাকে ‘গোরো-য়া’ বলে। গোরো-য়া পুজো খুব জাঁকজমক করে উদ্‌যাপন হয়। ‘অউচু’ উৎসবেরই একটা বিশেষ দিনে এই পূজা করা হয়। ‘গোরো-য়া’-কে অনুসরণ করে ঠিক তিন দিনের মাথায় পালন করা হয় ‘মানকা’ (Manka) উৎসব।

গারোয়া

‘মানকা’ পূজা করা হয় বিশেষ করে মেয়ের বাপের বাড়ির লোকেদের জন্য। এই দিন বিবাহিত মেয়েরা, তার বাবা আর দাদা-ভাইদের জন্য ভাত দিয়ে আসবে। বেশ আনন্দের সঙ্গে অনুষ্ঠান হয়। রান্না করা ভাত আর মাংসের টুকরো কলাপাতায় মুড়ে বাপ ও ভাইয়ের বাড়ি দিয়ে আসে। মানকা প্রতি বাড়িতেই হয়। এতে সবাই যোগ দেয়।

ভাত আর মাংসের টুকরো কলাপাতায় মোড়াকে বলে অঙ-রো (Ong-ro)। ‘অঙ-রো’-র সংখ্যা বাবা ও ভাইয়ের বাড়ির পুরুষের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। আসলে এই দিন মেয়েরা বাবা আর ভাইদের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করে ‘অঙ-রো’ দিয়ে আসার মাধ্যমে।

মায়েরা ভোরবেলাতে উঠেই ঘরে আলো জ্বালিয়ে রান্না শুরু করে। সকাল হতেই ‘অঙ-রো’ দিয়ে আসার পার্বণ চালু হয়ে যায়। মায়েরা বিশেষত ঘরে বসে অঙ-রোলং-ওয়ার বা কলাপাতায় ভাত মোড়ার কাজটা করে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সেগুলো নিয়ে মায়ের কথা মতো মামার বাড়িতে দিয়ে আসে কাপড়ে মুড়ে। টোটোদের কাছে এই দিনগুলো খুবই আনন্দের হয়।

তারা তাদের প্রতিদিনের কর্মরত জীবন থেকে একটু বিরতি পায় এবং আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বাড়িতে একসঙ্গে সময় কাটায়। উপভোগ করে। মান্‌কার আগে অনেক আয়োজন করতে হয়। যেমন— বড়ো উনুন তৈরি করা, হাঁড়ি জোগাড় করা, কলাপাতা কেটে নিয়ে আসা, পরিষ্কার করে উনুনের উপর রাখাই ত্যাদি।

অবশেষে এই দিনটিতে সেই কলাপাতায় কিছু সেদ্ধভাত আর কিছু রান্না মাংসের টুকরো মুড়ে দিয়ে আসতে হয়। সকালের মধ্যেই এই দেওয়া নেওয়া সমাপ্ত হয়ে যায়। কাজ গুটিয়ে নিয়ে। দুপুরটা বিশ্রাম নেয়। সন্ধ্যায় আবার দেমসায় জড়ো হতে হয়।

কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। নির্দিষ্ট গোত্রের লোকেদের দিয়ে। তারপর গান-নাচের পর্ব শুরু হয়। এইভাবে আমাদের আউচু শেষ হয়ে যায় সে-বছরের মতো।

পরের বছরের জন্য আবার অপেক্ষা করতে থাকি…

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

জয়দেব বাউরী

বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব

ছোটনাগপুর মালভুমির পালামৌ-হাজারীবাগ অঞ্চল থেকে মুণ্ডাড়ী জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পৃথক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দামোদর নদের দুই তীর বরাবর। ছড়িয়ে পড়েছিল কাঁসাই, শিলাই, দ্বারকেশ্বর— এদিকে দামোদর থেকে অজয়ের দুই তীরবর্তী অঞ্চলে। পশ্চিম রাঢ়ের একটা বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে ছিল মুণ্ডারী থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া এই জনগোষ্ঠীর পদচারণা। তখনও তারা ছিল পশুশিকারী, গাছের ফল ভক্ষণকারী। বকের মাছ শিকারকে অনুসরণ করে হয়ে উঠেছিল মৎস্যশিকারী। এই জনগোষ্ঠীই বাউড়ী জনগোষ্ঠী।

নৃতত্ত্বের এই সামান্য অনুষঙ্গের প্রয়োজন হল এ-জন্যই যে, মুণ্ডাড়ী জনগোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে বাউড়ী জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানের বেশ কিছু সাযুজ্য রয়েছে আজও। যেমন— বাঁধনা পরব, কাঠিনাচ, শালগাছের পুজো, মাদল বাজিয়ে নাচগানের অনুষ্ঠান, উলকি নেওয়া, শিকার যাত্রা প্রভৃতি। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠী তার জীবনযাত্রার সুদীর্ঘকালের ধারায় এসেছে বৌদ্ধসংস্কৃতির সংস্পর্শে, আরও পরবর্তীকালে এসেছে হিন্দুসংস্কৃতির সংস্পর্শে। আক্ষরিক অর্থে তারা পরিণত হয়েছে নিম্নবর্ণের হিন্দুতে। ফলত, তার আদিসত্তা, আদি আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব-সংস্কৃতিতে ঘটে গেছে নানান সংযোজন, সংমিশ্রণ ও বিয়োজন। তেমনি ঘটেছে প্রতি-সংযোজনও। কিন্তু, বিগত শতাব্দীর নব্বই পরবর্তী বিশ্বায়ন হাওয়ায় ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে তার সংস্কৃতির অবয়ব। তবে আদি উৎসবের একটি-দু-টি আজও কিন্তু টিকে আছে স্ব-মহিমায়। অন্যগুলি ক্রমে ক্রমে ম্রিয়মান কিছুটা।

আষাঢ়ী পরব

বাউরী জনজাতির মূল পরবগুলো কৃষি ও শস্যকেন্দ্রিক। আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহে বর্ষা আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ‘আষাঢ়ী পরব’। নতুন উদ্যোমে ধান রোপণের কাজ পুরোপুরি শুরু করার পূর্বে টানা দু-তিন দিন পরবে মাতে বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষ। হিন্দুধর্মে এই একই সময়ে পালিত হয় অম্বুবাচী। কিন্তু, বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এ যেন আকাশ ও ভূমির বন্দনা। বর্ষা আগমনের আনন্দ উদযাপন। কেন-না, মাটি-সংলগ্ন বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষদের কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা সেই কৃষি-সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই। এখনও প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এখন প্রায় সকলেই ভূমিহীন খেতমজুর, কেউ কেউ ভাগচাষি। তাই ‘আষাঢ়ী-পরব’ নিয়ে উন্মাদনা এতটুকুও কমেনি।

নতুন প্রজন্মের যে-সব ছেলেরা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ হয়ে বাইরে কাজ করতে যায়। তারাও ঘরে ফিরে আসে এই সময়। বাড়িতে আসে কুটুমজন, মেয়ে-জামাই। সাধ্যমতো নতুন জামা-কাপড় কেনার চেষ্টা করে সকলেই। কোথাও কোথাও কালকুদরা, বিসাঁই বা ভৈরবের থানে হয় শূকর বলি। ঘরে ঘরে ভাত পঁচিয়ে মদ রাখে মহিলারা। হাঁড়িয়া। বাখুলে বাখুলে সম্মিলিতভাবে কেনা হয় শূকর। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয় তার মাংস। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কাজ বন্ধ রাখে এ-সময়। কুটুমজন, প্রতিবেশীদের নিয়ে মাংস-মদ-গান-বাজনায় আষাঢ়ী-র আনন্দ উদ্‌যাপনে মেতে ওঠে বাউরী পাড়া। কোথাও কোথাও আষাঢ় মাসের সংক্রান্তির দিন পালিত হয় এই ‘আষাঢ়ী পরব’।

কিন্তু, বিগত দুই দশকে এই চিত্র বেশ কিছুটা বদলেছে। শতাংশের বিচারে অতি নগন্য হলেও শিক্ষার আলোয় আসতে পেরেছে নতুন প্রজন্মের একটা অংশ। অনেকেই সক্ষম হয়েছে মদের আকর্ষণ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে। শূকরের মাংসও অনেকে ঘৃণা ভরে অপছন্দ করে। ফলত পরবের উন্মাদনা একই থাকলেও রুচি ও খাদ্যাভ্যাসে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। আবার পরবতী প্রজন্মের যারা মদপ্রেমী তারা হাঁড়িতে রাখা নিজেদের তৈরি মদের প্রতি উদাসীন। তাদের পছন্দ ‘বোতল’। তাই আষাঢ়ী পরবকে কেন্দ্র করে ঘরের মহিলাদের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে যে একটা প্রস্তুতি চলত মদ রাখা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তা একেবারেই কমে এসেছে। চল্লিশের কম বয়সি মহিলারা এই শিল্পকর্মটিতে হয়ে পড়েছে একেবারেই অদক্ষ। অবশ্য প্রয়োজনও তো পড়ে না। নিকটবর্তী গঞ্জ থেকে ‘বোতল’ আসে। এখন বাখুলে বাখুলে মাদলও বাজে না আগেকার মতো। নিজেদের গান-বাজনার পরিবর্তে অনেক জায়গাতেই শব্দ-দূষণ ঘটিয়ে অ্যাম্পিলিফায়ারে বাজতে থাকে জনপ্রিয় বাংলা-হিন্দি সিনেমার গান। তবে পরব নিজে আছে পরবের মতো।

মনসাপুজো

ধান রোপণের কাজ সম্পূর্ণ হবার পর কোথাও শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তি কোথাও আবার ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে মনসাপুজো হয়। শুধু বাংলা নয়, সর্পদেবীর পুজো বা আরাধনা নানা আঙ্গিকে ছড়িয়ে রয়েছে সারা দেশজুড়েই। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠীর মনসাপুজোয় বেশ কিছু স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। প্রতিটি গ্রামে রয়েছে মনসার থান। একমাত্র মনসারই মূর্তি পুজো করে বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাড়ায় পাড়ায় খড়মাটি অথবা কংক্রিটের ঠাকুর ঘর রয়েছে একমাত্র মনসারই। অন্য সব দেবতা বা ‘বুড়ি’-র অবস্থান গ্রামের আশেপাশে খোলা-আকশের নীচে, গাছের তলায় বা বনজঙ্গলের ধারে, ঝোপেঝাড়ে।

প্রায় মনসা থানের পাশেই থাকে ভৈরবের থান। মনসার পুজোয় বসার আগে ভৈরবের পুজো করা হয়। পুজোর আগের দিন হয় ‘বার’। হাঁড়ি-বাসন মেজে ‘বেরো’-র জন্য বারের ভাত রান্না করে মহিলারা। দুপুরে নখ, চুল-দাড়ি কেটে, স্নান করে বারের ভাত খায় ‘বেরো’। তারপর উপবাস। ভোরের বেলা সূর্য ওঠার আগে কেউ গুড়-চিড়া খায়। পুজোর দিন সারা বেলা উপবাস করার পর সন্ধ্যায় ঘট নিয়ে পুকুরে যায় ‘বারি’ আনতে। ঘাটপুজো করে জল নেয় ঘটে। সারিবদ্ধ ফিরে আসার সময়ই ভর আসে কোনো-না-কোনো ‘বেরো’-র। পথে না আসলেও থানে গিয়ে আসবেই। কারো উপর ‘ভর’ করে ভৈরবরাজ। কারো উপর ‘ভর’ করে স্বয়ং মনসা! তখন সবল পুরুষরা জড়িয়ে ধরে তাদের উন্মত্ততাকে সামাল দেবার চেষ্টা করে। অথবা থানজুড়ে আছাড়-পিছাড়ি দিয়ে উন্মত্ততা প্রকাশ করতে থাকে। দাঁত কিড়মিড় করে ঢাকিকে বলতে থাকে ‘বাজা’। ঢাকের বাজনা আর ‘ভরণমত্ত বেরো’-র উন্মাদনা! পাশে দাঁড়ানো লোকজন, অন্যান্য বেরোরা বলে ওঠে ‘খেলুক’। উন্মত্ততা থামিয়ে ভরমত্ত বেরো একসময় নিজেই বলতে থাকে নানা ক্ষোভের কথা। পুজো নিয়ে সন্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টির কথা, পাড়ার মঙ্গল অমঙ্গলের কথা। রাতভর তিনবার পুজো হয়। শেষ পুজো হয় ভোরের দিকে। অর্থাৎ, রাতজুড়ে জাগরণ। এই জাগরণের ঐতিহ্য রয়েছে বাউরী জনগোষ্ঠীর টুসু-ভাদু-মকর পরবেও।

বাউরী জনগোষ্ঠীর আদি ঐতিহ্যের ধারায় গানবাজনা সব পরবেরই অঙ্গ। মনসাপুজোতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকে শুরু হত ‘জাত’ গাওয়া। এখন কেবল বার, পুজো আর পান্নার দিন গাওয়া হয়। মনসা-কাহিনির বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে এই গান গাওয়া হলেও নিজেদের অভাব-দারিদ্র্যের কথাও উঠে আসে এবং তা আলাদাভাবে গীত হয় কখনো কখনো। পান্নার দিন ছাগবলি দিয়ে পুজো সম্পন্ন হয়। তারপর প্রসাদ গ্রহণ করে উপবাস ভাঙে সম্পূর্ণরূপে।

গোয়ালপুজো

ভাদ্র মাসে মনসাপুজোর পরদিনই হয় গোয়াল পুজো। পাঁকুড় গাছের ডাল কেটে খানিকটা কাঠের পুরোনো পুতুলের আঙ্গিকে বানানো হয় ঠাকুর। গোয়ালঘরে টাঙানো হয় শালুক ফুল। খই-মুড়কি-সিঁদুর-কাজল-হলুদ-তেল আর শালুকের উপচারে পুজো করে বাখুলেরই কোনো পুরুষ। ক-দশক আগেও মাদল বা ধামসা বাজিয়ে গাওয়া হত গান। এখন বিলুপ্ত সেইসব গান ও গানের মানুষেরা।

ভাদুপুজো

ভাদ্র মাসের সংক্রন্তির দিন হয় ভাদুপুজো। বাউরী সংস্কৃতির ধারায় অনেক পরের দিকে সংযোজন ঘটেছে ভাদুর। তার একটি জনশ্রুতিও প্রচলিত রয়েছে। দেবী নয় বরং বাড়ির কন্যারূপেই পূজিতা হয় ভাদু। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে কলঙ্গার মধ্যে গোবরের উপর ধান ছড়িয়ে, কোথাও কোথাও আবার একটি পাত্রের উপর ফুল রেখে এক মাস ধরে চলে ভাদুর আরাধনা। এটি ভাদুর বিমূর্ত এবং আদি রূপ। ভাদ্র-সংক্রান্তির এক সপ্তাহ আগে ভাদুর মূর্তি নিয়ে আসা হয় ঘরে। এই মূর্তি পূজার প্রচলন হয়েছে অনেক পরে। বাউরী জনগোষ্ঠীর পঞ্চকোটী, মানা এবং মূলা বাউরীদের মধ্যে ভাদুপুজো নিয়ে উন্মাদনা সবচেয়ে বেশি। কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা সংক্রান্তির রাতে ভাদুর জাগরণ করে। ভাদু গীত গায়। পরদিন সকালে দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে বিসর্জন দেয় পুকুরে বা নদীতে। এ-সময় এক ভাদুদল আর এক ভাদুদলের উদ্দেশে করে গান গায়। গানে গানে পাল্লা দেওয়া চলে।

ভাত বাড়ানো ও বাঁদনাপরব

এটি বাউরী জনগোষ্ঠীর একটি আচার। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু আচারের সঙ্গে সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অনুষ্ঠান, উৎসব। এই ‘ভাত বাড়ানো’ হয় কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায়। শক্তিদেবী কালিকার পুজোর দিন সকালের দিকে। মেয়েরা রান্নার হাঁড়িবাসন পুকুরে নিয়ে গিয়ে মাজে। স্নানটান করে এসে রান্না বসায়। বাড়ির বয়সে বড়ো কোনো পুরুষ স্নান সেরে এসে সেই রান্নার নানা পদ এক একটি পেনেটি পাতায় সাজায়। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নিবেদন করে সেইসব আহার্য্য। এই আচারটিই ‘ভাত বাড়ানো’। এ-দিনই সন্ধ্যাবেলায় হয় ‘ইঁজোপিঁজো’। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা পাটকাঠি জ্বালিয়ে, কুলো বাজিয়ে মশা তাড়ায়। পুড়ে যাওয়া পাটকাঠির অবশিষ্ট অংশ পুকুর বা ডোবার কাদায় পুঁতে দেয়।

কিন্তু এই আচারটিই অন্য এক মাত্রা পেয়ে যায় যখন পরদিনই জাঁকিয়ে বসে বাঁদনা পরব। অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠীর থেকে বাউরী জনগোষ্ঠীর বাঁদনা বেশ কিছুটা অন্যরকম। হয়তো-বা বৌদ্ধ-সংস্পর্শ পেরিয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুতে পরিণত হওয়ার জন্যই। গোয়ালের সবচেয়ে বয়স্ক গোরুটির শিঙে হলুদ-তেল মাখানো হয় প্রথমে। তারপর গোয়ালের অন্য গরুদের। সব গোরুগুলির সারা পিঠেই আলতার ছাপ মারা হয় বাটিতে কাপড় জড়িয়ে। দুয়ারে কাঁঠাল পাতা রেখে জ্বালানো হয় প্রদীপ। বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এটি গোরুর বিবাহ।

পুরুষরা মাদল বাজিয়ে কাঠি-নৃত্য করে। গান গায়। সেই গানে থাকে কৃষির অনুষঙ্গ এবং অন্য নানা প্রসঙ্গও। পাড়ার মনসাথানে নৃত্য-বন্দনা করে যায় গ্রামের ‘গোলাঘর’ তথা অন্যান্য উচ্চবর্গের বাড়িতে নাচ দেখাতে ও ‘আদায়’ করতে। সেই ‘আদায়’ সংগ্রহ করে পাড়ারই কারো উঠোনে পান-ভোজনে বসে আর প্রায় রাতব্যাপী গাইতে থাকে গান। কখনো ঝুমুর, কখনো ‘ডাঙাল্যা’।

চাঁওড়ি-বাঁওড়ি-মকর-এখ্যান-টুসু পরব

শস্য খামারে উঠে যাবার পর শুরু হয় বাউরী জনগোষ্ঠীর অন্যতম বড়ো পরব ‘চাঁওড়ি-বাঁউড়ী-মকর-এখ্যান-টুসু পরব’। বাংলা তো বটেই দেশের বিভিন্ন প্রদেশে হয় মকর সংক্রান্তি উদ্‌যাপন। বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব শুরু হয় ‘চাঁওড়ি’-র দিন থেকেই। এই দিন থেকে পরবের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে স্থানীয় হাট-বাজার থেকে। মহিলারা স্নান সেরে পিঠেপুলির জন্য ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে গুঁড়ো কোটে। অল্পবয়সি মেয়েরা এই দিন বা তার আগের কোনো হাটবারের দিন টুসুর চৌডল কিনে আনে। ছেলেরা অনেক আগে থেকেই ‘মকরকুঁড়ে’-র জন্য খেঁজুরপাতা কেটে মাঠে শুকোতে দিয়ে রাখে। পরব উদ্‌যাপনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির দিন হল এই ‘চাঁওড়ি’।

পরদিন ‘বাঁওড়ি’ থেকে শুরু আসল পরব। এদিন মহিলারা স্নান সেরে পিঠে তৈরি করে। পুরুষরা ‘বাঁওড়ি’ জাগানোর প্রস্তুতি নেয়। পাড়ার আশেপাশে ফাঁকা মাঠে শালাপাতা, শালডালে কুঁড়ে বানায় গানবাজনা আমোদ-স্ফূর্তির জন্য। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঢোল-ধামসা-মাদল নিয়ে পাড়ার ‘মরদ’-রা হাজির হয় সেখানে। চালা হয় বাড়িতে রাখা হাঁড়ির মদ। উনোন বানিয়ে বান্না হয় ‘চাট’। শুরু হয় ঝুমুর গান। একজনের একটা গান শেষ হয় তো অন্যজন আরেকটা শুরু করে। ধামসা-মাদলে মাতোয়ারা হয়ে এভাবেই রাতব্যাপী বাঁওড়ি জাগায় বাউরী-পুরুষরা। কিন্তু সংস্কৃতির বিশ্বায়নের হাওয়ায় ‘বাঁওড়ি’ জাগানোর এই চিত্রটিও অনেকটাই কমে এসেছে এখন।

টুসু ভাসান: গুগ্‌ল ইমেজ

বাঁওড়ির বিকেলে আশপাশের ফাঁকা মাঠে বা পুকুর পাড়ে শুকনো খেঁজুরপাতি-পোয়াল দিয়ে ‘মকরকুঁড়ে’ বানায় ছেলেরা; সংক্রান্তির সকালে স্নান সেরে আগুন পোহাবে বলে। এদিন কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এমনকী অন্যান্য জিনিস কারো বাড়িতে ফেলে রাখে না। অন্য কারো বাড়িতে থাকলে তা ঘরে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় ‘দেনি তোলা’ ধান আঁটি থেকে খড় নিয়ে ধান-চালের পুঁড়ো, মরাই, কৃষিযন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসের উপর চাপিয়ে রেখে ‘বাঁওড়ি বাঁধে’। বাড়িতে রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগেই এই বাঁওড়ি বাঁধার কাজটি সম্পন্ন করে নিতে হয়। সকালে মকর স্নানের সময় সেইসব বাঁওড়ি বাঁধা খড় ঘটির ভেতর ঢুকিয়ে পুকুরে জলে ভাসিয়ে আসে। স্নানের পর মকরকুঁড়ে জ্বালিয়ে আগুন পোহায়।

বাঁওড়ির রাত্রেই থাকে মেয়েদের টুসু বা তুষুর জাগরণ। পৌষ মাসের প্রথম দিনই টুসুপাতে অল্পবয়সি মেয়েরা। মাটির সরার উপর সারি দিয়ে বসানো প্রদীপ। মেয়েরা কুমোর ঘর থেকে কিনে আসে এই টুসু। এর পর এক মাসব্যাপী প্রতি সন্ধ্যায় টুসুর গান গেয়ে আরতি করে। অল্পবয়সিদের সঙ্গে যোগ দেয় বাড়ির ও বাখুলের বড়োরাও। বাঁওড়ির সন্ধ্যায় লুচি-সুজি-মিষ্টি-গুড়-চিড়া দিয়ে টুসুর ভোগ প্রস্তুত করে। সারারাত সমবেতভাবে গান গেয়ে টুসুর জাগরণ করে। ‘পহরে পহরে’ পুজো দেয়। কুয়াশা ছড়ছড় ভোর হতে না হতে টুসুকে মাথায় নিয়ে গান গাইতে গাইতে বাধ বা নদীর দিকে যায় ভাসাতে। এ-সময় একদল আর এক দলকে খানিকটা টিজিং করেই গান গায়। গানে গানে পাল্লা দেয় পরস্পর।

মকরের পরের দিনই এখ্যান। এই এখ্যান দিনেই বনবাদাড়, ঝোপঝাড়ে যে-সব দেবতা আছে তাদের সকলেরই পুজো হয়। মায়ুন্দাবুড়ি, বিসাঁই, কুদরা, বড়াম— এইসব দেবদেবীর থানে ষাঁড়া বলি হয়। মাটি খুঁড়ে পাথর দিয়ে উনোন বানিয়ে মাটির হাঁড়ি-সরায় রান্না হয় ভোগ। মোনোই খিঁচুড়ি। মুনিস-কামিন-মানদ্যার-ভাগীচাষিরা ‘গোলাঘর’ পরিবর্তন করে অন্য ‘গোলাঘরে’ কাজে যোগ দিতে পারে। পুরোনো গোলাঘরে মুজরি-টজুরি বাড়ানো নিয়েও কথা হতে পারে। বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এই ‘চাঁওড়ি-বাঁওড়ি-টুসু-মকর-এখ্যান’ পরব আসলে এক কৃষিবর্ষ বিদায় এবং আরেক কৃষিবর্ষকে বরণের উৎসব।

ছাতুবাড়ানো ও গাজন

চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে ছাতু বাড়ানো হয়। বাড়ির বয়সে বড়ো পুরুষরা-মহিলারা সকাল থেকে উপবাস করে। ঘর থেকে শাল বা পলাশ পাতায় ছাতু-গুড়-কাঁচা আম নিয়ে পুকুরে যায়। ডুব দেবার পর পেনেটি বা পদ্ম পাতায় সেই ছাতু-গুঁড়-কাঁচাআমের অংশ রেখে জলে ভাসিয়ে দেয়।

চৈত্র সংক্রান্তির শিবের গাজনে বাউরী জনগোষ্ঠীর পুরুষরা ভক্তা হয়। চড়কে ওঠে। বাণ ফোঁড়ানোর মতো নানা কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে দেবতাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে।

বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দু-টি প্রধান অক্ষ হল— ‘আষাঢ়ী’ ও ‘বাঁওড়ি’। প্রথমটি, সমস্ত সৃজনের উৎস, রাঢ়ের কৃষির সম্ভাবনার প্রধানতম আকর বর্ষাকে বরণ ও তার আগমনে আনন্দ উদ্‌যাপন। দ্বিতীয়টি হল শস্যের পূর্ণতা প্রাপ্তির পর খামারে ওঠা ও শস্যদেবী টুসু ঘিরে আনন্দ উদ্‌যাপন। অর্থাৎ, একটি কৃষি পর্যায়ের সূচনা এবং তার পরিসমাপ্তি এই দু-টি প্রধান বিন্দুতে স্থিত যেন বাউরী জনগোষ্ঠীর উৎসব। অন্যান্য পরবগুলি যেন আনুষঙ্গিক। নানাভাবে তা বাউরী জনগোষ্ঠীর জীবন ও চিত্তকে নান্দনিক উৎকর্ষতা দান করেছে।

ঋণ

১। রাঢ় সভ্যতা— সুনীল কুমার দাস।
২। রাঢ়ের জনজাতি ও লোকসংস্কৃতি— ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা।
৩। ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়— ড.অতুল সুর।

Categories
2021-Utsob-Interview

সনাতন রুদ্র পাল

আলাপচারিতায় অরূপ চক্রবর্তী ও জাতিস্মর

[অবিভক্ত বঙ্গদেশে শারদীয় উৎসব বা দেবী দুর্গার আরাধনার প্রচলন হয়েছিল কয়েকশো বছর আগে। মূলত বিভিন্ন রাজপরিবার, জমিদার ও সমাজের ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতেই সেই সময়ে দেবী পূজিতা হতেন। কারো বাড়ির নাটমন্দিরে মূর্তি নির্মাণ ক’রে পুজো করা হত আবার কোথাও ঘটপুজো করা হত। বারোয়ারি পূজার প্রচলন শুরু এর আরও অনেক পরে। যদিও কবে কোথায় প্রথম দেবীবন্দন শুরু হয়েছিল তার ইতিহাস আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের আগ্রহ প্রতিমা নির্মাণশৈলীর ধারা নিয়ে। মনের গভীরে থাকা ভাবনাকে বাঁশ, খড়, কাদামাটির সমন্বয়ে একটা মূর্তিতে প্রকাশ। তাকে রং ও নানা ভূষণে অলংকৃত করে দেব-দেবীতে রূপদান যাঁরা করে থাকেন তেমন একজন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতা ও কিছুটা সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে আমরা টিম ‘তবুও প্রয়াস’-এর পক্ষ থেকে হাজির হয়েছিলাম এই সময়ের অন্যতম মৃৎশিল্পী জয়ন্তী আর্ট মিউজিয়ামের কর্ণধার সনাতন রুদ্র পালের স্টুডিয়োতে। বহু পুরস্কারে ভূষিত শিল্পী সাগ্রহে তাঁর কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও কিছুটা সময় বের করে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন।

সনাতনবাবুর শিল্পীজীবনের অভিজ্ঞতার কথা ও তাঁর স্টুডিয়োতে মূর্তি নির্মাণের কিছু ছবি নিয়ে এই উপস্থাপনা।]

মাতৃ অবয়ব সৃজনে মগ্ন শিল্পী

প্রতিমা নির্মাণশিল্পের সঙ্গে আপনাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে যা ছোটোবেলা থেকে দেখে আপনারা বেড়ে উঠেছেন। আপনাদের ক-পুরুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত?
আমার পূর্বপুরুষ (ঠাকুরদা) ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। ওনারা প্রতিমা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু সেই সময় বারোয়ারি দুর্গাপুজোর এত রমরমা ছিল না। তখন কিছু বর্ধিষ্ণু পরিবারে পুজো হত এবং দেখা যেত সারা গ্রামে হয়তো ওই একটি পরিবারেই পুজো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিমা তাঁদের বাড়িতে গিয়েও নির্মাণ করতে হত। কখনো কখনো আমাদের নিজস্ব শিল্পালয় থেকে তৈরি হয়ে প্রতিমা কারো কারো বাড়ি নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু সেইসময় পুজোর সংখ্যা এতটাই কম ছিল যে, এই জীবিকার উপরে নির্ভর করে সারা বছর সংসার প্রতিপালন করা কঠিন ছিল। সে-জন্য প্রতিমা নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈজসপত্র তৈরি করা হত। দেশবিভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কলকাতায় চলে আসেন এবং কুমোরটুলি অঞ্চলে তাঁদের স্থায়ী নিবাস হয়। সেইসময় রাখাল চন্দ্র পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স-এর সঙ্গেই আমার বাবা ও জ্যাঠামশাইরা একত্রে কাজ করতেন। পরবর্তীতে রাখাল চন্দ্র পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স থেকে বেরিয়ে এসে আমার বাবা বিখ্যাত মৃৎশিল্পী মোহনবাঁশি রুদ্র পাল একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই সময় থেকেই আমাদের বেড়ে ওঠা এবং এই শিল্পের সঙ্গে বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আমাদের মনের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছিল।

আপনি কবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন? এর জন্য কি আলাদা কোনো আবেগ বা মনের টান অনুভব করেছিলেন?
ঠিক কত বছর বয়স থেকে এই শিল্পের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন স্কুল-ফেরত প্রতিদিন আমাদের কর্মশালায় আসতাম এবং কিছু না কিছু কাজ সে মাটির হোক বা অন্য যাইহোক করতে হত। এইভাবেই ছোটো ছোটো কাজ শিখলাম। আমাদের বাবা জ্যাঠারা যখন দেখলেন আমরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছি এবং করতে পারছি তখন তাঁরাও আমাদের উপর আস্তে আস্তে ভরসা করতে শুরু করলেন এবং দায়িত্বও বাড়িয়ে দিলেন। এইভাবে ছোটো ছোটো দায়িত্বগুলো পালন করতে করতে একসময় নিজেকে এই শিল্পের সঙ্গে একাত্ম করে ফেললাম। একক প্রচেষ্টায় মূর্তি নির্মাণ শুরু করলাম।

যখন এই মৃৎশিল্পকে অন্যতম পেশা বলে গ্রহণ করলেন তখন নিজের সৃষ্টি কি পারিবারিক যে-শিল্পধারা রয়েছে সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিল না কি নিজের সৃষ্টিকে পরিবারের অন্যদের থেকে একটু আলাদা করার কথা চিন্তা করেছিলেন?
যখন আমার ৪২ বছর বয়স, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠান মোহনবাঁশি রুদ্র পালের থেকে আলাদা হয়ে এসে আমি সনাতন রুদ্র পাল নিজের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান ‘জয়ন্তী আর্ট মিউজিয়াম’ তৈরি করলাম। এবং ২৩ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান চলে আসছে। আমাদের বাবা জ্যাঠামশাইদের যে-নির্মাণশৈলী চলে আসছিল তারই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপ আমি আমার নিজের সৃষ্টির মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি এবং ভাবনার বিন্যাসে স্বতন্ত্র হবার চেষ্টা করেছি যা এখনও করে চলেছি।

কাঠামো- যার উপর ভিত্তি করে মূর্তি নির্মিত হয়

মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রেও কি অ্যানাটমি বা শরীরের গঠনগত বৈশিষ্ট্য কাজ করে?
অবশ্যই করে। এবং এটা নির্ভর করে প্রতিমার উচ্চতা অনুযায়ী। ধরুন ১৫ ফুট প্রতিমার ক্ষেত্রে গঠনগত পরিমাপ যা হবে ১০ ফুট বা ১২ ফুট প্রতিমার ক্ষেত্রে সেটা হবে না। এখানে প্রথমেই নীচের কাঠামো বা মূল বেদীর এবং সিংহের উচ্চতার উপরে দেবীর গঠনগত পরিমাপ নির্ভর করে এবং এটা আমাদের কোনো মাপজোক বা এঁকে করতে হয় না। এটা আমাদের এত বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে যাই যে, শরীরের কোন অংশের পরিমাপ কত হবে এবং এটার জন্য একটি সূক্ষ্ণ নিরীক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

বাঁশের কাঠামোর সঙ্গে খড় বেঁধে যে-প্রাথমিক অবয়ব তৈরি করা হয় সেই বাঁশ কি কোনো বিশেষ রকমের এবং কোথা থেকে আনা হয়?
মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে-বাঁশগুলো ব্যবহার করা হয় অন্যান্য বাঁশের থেকে তার কিছুটা তফাত অবশ্যই রয়েছে। মূলত এই ক্ষেত্রে ফাঁপা বাঁশ ব্যবহার করা হয় এবং যে-বাঁশের গাঁটগুলো ঘন থাকে সেই বাঁশই ব্যবহার করা হয়। তবে আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেক সময়ই বাঁশ পরিপক্ক হওয়ার আগেই যোগানদাররা সেগুলি বিক্রি করছেন এবং আমরাও বাধ্য হচ্ছি সেগুলি নিতে। আগে যেখানে একটি বাঁশেই কাঠামো সম্পূর্ণ হয়ে যেত এখন গুণগত মানের তফাতের কারণে একটা কাঠামো তৈরি করতে দুই বা ততোধিক বাঁশের প্রয়োজন হয়। এই বাঁশের যোগানের অধিকাংশই আসে মেদিনীপুরের ঘাটাল অঞ্চল থেকে। এছাড়া মুর্শিদাবাদ থেকেও কিছুটা আসে। এই ব্যাপারে যোগানদারেরা মূলত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বিভিন্ন মৃৎশিল্পীদের চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা একত্রে এই বাঁশের যোগান দেন যা আমরা বরানগর কিংবা কুমোরটুলি ঘাট থেকে আমরা সংগ্রহ করে নিই।

আজকাল নাকি অনেক শিল্পী বাঁশের বদলে মেটাল স্ট্রাকচারে কাজ করছেন। এই পদ্ধতিতে কাজ করলে কি বিশেষ কোনো সুবিধা হয় বলে আপনার মনে হয়?
আমরা যে-ধরনের কাজ করে থাকি তাতে মেটাল স্ট্রাকচারের প্রয়োজনীয়তা এখনও অনুভব করিনি। তবে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা কিছু শিল্পীরা যে-সমস্ত আর্টের প্রতিমা নির্মাণ করছেন সেগুলোতে মেটাল স্ট্রাকচার ব্যবহার করছেন এবং অনেকসময় দেখা যাচ্ছে সেই মেটাল স্ট্রাকচারই প্রতিমার চালচিত্র হিসাবেও কাজ করছে।

কর্মব্যস্ত স্টুডিও

এখনও কি মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে সনাতনী রীতিনীতি মেনে অর্থাৎ, কোনো বিশেষ দিনে কাঠামো তৈরি করে প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়? তাহলে যে-সব বিদেশে পাঠানো সেক্ষেত্রে এই রীতি কীভাবে মানা সম্ভব হয়?
বর্তমানে প্রতিযোগিতার যুগে যেখানে আমাদের অনেকগুলি মূর্তি নির্মাণ করতে হয় সেখানে এই তথাকথিত তিথি নক্ষত্র মেনে যেমন ১লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া বা রথযাত্রা ইত্যাদি দিনে কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না। আমরা পঞ্জিকা দেখে দেবীমূর্তি গঠনের কোনো বিশেষ দিনেই কাজ শুরু করে দিই এবং সেটা অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। বিদেশে মূর্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে তো এই রীতিনীতি একেবারেই মানা সম্ভব নয়।

বাজেট অনুযায়ী কি প্রতিমার গড়নে হেরফের ঘটে এবং সেটা কি নির্মাণগত তফাত নাকি বহিরঙ্গের সাজসজ্জার তফাত?
প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের একটি নির্দিষ্ট মান আছে যার সাথে আমরা আপোশ করি না। সেক্ষেত্রে বাজেট অনুযায়ী মূর্তির উচ্চতায় তারতম্য ঘটে। সাজসজ্জাতেও এটা প্রযোজ্য— যেমন কাপড়, গয়না, চালচিত্র ইত্যাদিতে কিছুটা তফাত হয়ে যায় এবং অনেকসময় দেখা যায় নিজেদের লোকসান হলেও আমরা নিজেদের কাজের মান বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকি।

প্রতিমা নির্মাণের সময় আপনারা কোন দিকটি বেশি গুরুত্ব দেন, দেবীর মাতৃরূপ নাকি রুদ্ররূপ?
এটি মূলত চাহিদা অনুযায়ী আমাদের রূপদান করতে হয়। তবে আমাদের এত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি রুদ্ররূপের তুলনায় দেবীর শান্ত সমাহিত মাতৃরূপের চাহিদা বেশি। হয়তো সকলের মঙ্গল কামনায় যেহেতু মাতৃ আরাধনা করা হয়ে থাকে তাই দেবী মূর্তিতেও মাতৃরূপের চাহিদা বেশি।

আপনাদের সৃষ্টিতে কী কী বৈশিষ্ট্য আছে যা একান্তই আপনার ঘরানার এবং যা দেখে মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে এ-সৃষ্টি আপনার?
ভালো প্রশ্ন করেছেন।

আমাদের সৃষ্ট দেব-দেবী মূর্তির চোখ, মুকুট, গয়না ও চালচিত্রের বৈচিত্র্য সবার থেকে আলাদা। এবং আমরা শুনেছি বিভিন্ন মণ্ডপে গিয়ে অনেক দর্শক মূর্তি দেখেই বলে দেন যে, এটি সনাতন রুদ্র পালের সৃষ্টি। তার জন্য আমাদের আলাদা করে কোনো নামফলক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। প্রতিনিয়ত এই ধারাকে ভাঙা গড়ার মাধ্যমে আমরা কাজকে আরো উন্নত ও আকর্ষণীয় করে তোলার কাজে ব্রতী থাকি।

প্রতিমার অঙ্গসজ্জার ভূষণ আপনাদের নিজস্ব স্টুডিয়োতে তৈরি করা হয় কি? মূলত কী ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়?
কিছু কাজ আমাদের নিজস্ব স্টুডিয়োতে অবশ্যই হয় বিশেষত চালচিত্রের। এছাড়া গয়নার বিশেষ ডিজাইন সৃষ্টি করে নিজস্ব কারিগরকে বুঝিয়ে দিই কী চাইছি। গয়না তৈরির ক্ষেত্রে শোলা, জরি, সলমা, চুমকি, মুক্তো, পুঁতি, আর্টিফিশিয়াল স্টোন ব্যবহার করি এবং এগুলো সব বড়োবাজার অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এবং একটি মূর্তির গয়না অন্যটির থেকে সামান্য হলেও তফাত রাখার চেষ্টা করি।

প্রতিমার রূপদানে যে-রং ব্যবহার করা হয় সেগুলো কি ভেষজ রং নাকি কেমিক্যাল?
এখন আর ভেষজ রঙের ব্যবহার হয় না। বিভিন্ন নামি দামি কোম্পানি আজকাল এত উন্নত মানের রং সৃষ্টি করছেন যে, মূর্তির রূপদান করার সময় রং নিয়ে বিশেষ চিন্তা করার দরকার পড়ে না। আর উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য আমাদের কোনো কৃত্রিম উপায় (বার্নিশ বা তেল) গ্রহণ করতে হয় না।

আপনার স্টুডিয়োতে যাঁরা কাজ করতে আসেন তাঁরা অধিকাংশই কি শিক্ষানবীশরূপে যোগদান করেন নাকি কাজের পূর্ব-অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন?
কিছু মানুষ আসেন একেবারেই শিক্ষানবীশ হিসাবে। এখানে স্টুডিয়োতে এসে ধীরে ধীরে কাঠামো গড়া, খড় বাঁধা, একমেটে, দো-মেটে ইত্যাদি কাজ কোনো অভিজ্ঞ কারিগরের তত্ত্বাবধানে থেকে ধীরে ধীরে শেখেন। এছাড়া আমাদের কাজের ধারা বোঝার জন্য পূর্ব-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষকেও অন্য কোনো কারিগরের তত্ত্বাবধানে কিছুদিন কাজ শিখতে হয়।

দেবীর মুখাবয়ব

প্রতিমার চক্ষুদান এবং অঙ্গের বিশেষ বিশেষ অংশ তৈরির জন্য কি আলাদা কারিগর রয়েছেন নাকি তাঁরা একাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে একটি কাজ করতে পারেন?
কিছু কিছু শিল্পী আছেন যিনি হাতের আঙুল নির্মাণ, চক্ষুদান বা অন্যান্য বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ। এবং দক্ষতা অনুযায়ী তেমন কাজই তাঁদের দেওয়া হয় এবং কেউ কেউ আছেন যাঁরা একাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারেন। তবে কাজের পুরোটাই আমার তত্ত্বাবধানে হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে আমি নির্দেশ দিয়ে থাকি।

আপনাদের ঘরানার দেবীমূর্তি এতটাই জনপ্রিয় যে, দেখা যায় অনেকেই আপনাদের এই সৃজনশীলতাকে অনুসরণ বা অনুকরণ করে মূর্তি নির্মাণ করছেন। এই ব্যাপারটা আপনারা কীভাবে দেখেন?
প্রথমেই বলি আমাদের নিজস্ব যে-সৃষ্টি তার কোনো পেটেন্ট নেই। কাজেই ভালো কাজের অনুকরণ বা অনুসরণ হবে এটাই স্বাভাবিক এবং আমরাও এই ব্যাপারে সচেতন থাকি। আমাদের যে-ডাইসগুলো থাকে তার উপরে আমরা নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাই। একটা জিনিস জানবেন যে, শিল্পী নিজেই নিজের কাজের সবথেকে বড়ো সমালোচক। আমরা একটা কাজ করার পরে ভাবি যে, হয়তো দেবীর গালটা একটু ভারী লাগছে, মুখটা একটু বেশি গোল লাগছে সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে আমরা এই জায়গাগুলোর দিকে নজর দিই। চোখ আঁকার ক্ষেত্রেও আমরা পরিবর্তন আনি আর যেটা বিশেষ করে আমরা করে থাকি সেটা হল গয়না, মুকুট এবং চালচিত্রের পরিবর্তন। নানারকম ডিজাইন আমরা নতুনভাবে তৈরি করে আগেরটাকে বাতিল করে দিই। কিন্তু যাঁরা আমাদের কাজের অনুকরণ করছেন তাঁরা কিন্তু সেই একই জায়গায় আটকে থাকেন। আমরা আমাদের নিজেদের কাজে প্রতিনিয়ত যে-সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারি অন্যেরা সেটা করে উঠতে পারেন না, যার জন্য তাঁদের কাজের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।

দুর্গা, লক্ষ্মী, শ্যামা ও সরস্বতী মূর্তি ছাড়া আপনাদের স্টুডিয়োতে আর কী কী কাজ হয়?
দুর্গাপুজোর আগেই আসে গণেশ পুজো। বেশ কিছু গণেশের মূর্তি তৈরি হয় আমাদের এখানে। বিশ্বকর্মা মূর্তি আমরা সেভাবে করি না। এছাড়া শ্যামাপুজার পরে আসে জগদ্ধাত্রী পূজা এবং বছরের প্রায় শেষে আসে সরস্বতী ও বাসন্তী পূজা। তবে বাসন্তী দেবীমূর্তি চাহিদা তুলনায় অনেক কম থাকে। এই মধ্যবর্তী ফাঁকা সময়ে আমরা পরবর্তী বছরের পূজার মূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা এবং তার প্রাথমিক কাজ এগিয়ে রাখি।

মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে মাটি ছাড়া অন্য কোনো মিডিয়া (যেমন কাঠ, প্লাইউড, ফাইবার বা শোলা ইত্যাদি) ব্যবহার করেন?
না। আমরা মাটি ছাড়া শুধুমাত্র ফাইবার গ্লাসের কাজ করে থাকি। আসলে মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণের মধ্যে যে-আনন্দ পেয়ে থাকি সেই তৃপ্তি বা শান্তি অন্য কোনো মিডিয়াতে কাজ করে পাই না।

পূর্ণতা পাবার আগের পর্যায়

বিগত ২০২০ সাল থেকেই করোনা আবহে পুজোর জৌলুস অনেকটাই ম্লান। এর প্রভাব কি আপনাদের জীবিকার উপরে কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?
এই করোনা আবহে যদি কোনো শিল্প সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি হল মৃৎশিল্প। পুজোর সংখ্যা কম হবার সাথে সাথে পুজোর বাজেটও কমে যাওয়ায় আমাদের চাহিদামতো আমরা অর্ডার পাচ্ছি না এবং অর্ডার পেলেও সেখানে আমাদের কাজের নিজস্ব মান বজায় রাখার জন্য আমাদের লাভের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাচ্ছে। অন্যান্য সামগ্রীর থেকে আমাদের এই কাজটার এতটাই তফাত যে-কোনো একটা বিশেষ উৎসবের পরে অবিক্রিত মুর্তিগুলির কোনো চাহিদা বা মূল্য থাকে না। যেহেতু অনেকরকম কারিগর নিয়ে আমাদের একটা বৃহৎ পরিবার এবং প্রত্যেকেই এই উপার্জনের উপর নির্ভরশীল কাজেই আমাদের প্রত্যেকেরই পরিবার এই পরিস্থিতিতে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে বর্তমানে সরকার বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নানারকমভাবে সাহায্য করে থাকলেও মৃৎশিল্পীদের ব্যাপারে সেইভাবে এখন কোনো উদ্যোগ নেননি।

আপনাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি এই পেশায় আগ্রহী? যাঁরা এই পেশায় আসছেন তাঁরা কি সবাই নিজ আগ্রহে আসছেন নাকি জীবিকার তাগিদে?
আমাদের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের মৃৎশিল্পের প্রতি সেরকম আগ্রহ বা ভালোবাসা দেখছি না। বরং তাঁরা অন্য পেশায় নিজেদের নিযুক্ত করতে আগ্রহী। আবার বেশ কিছু তরুণ আসছে যারা কাজ শিখে ভালোবেসে এই পেশায় নিজেকে জড়াচ্ছেন যেমন বিভিন্ন কলাশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিখে তারা কাজ করছে। আমি অন্তত এই মুহূর্তে পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে হতাশ হওয়ার মতো কিছু দেখছি না। বরং আমার মনে হয় তারা অনেকাংশে আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান বিশেষত ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে।

প্রতিমা নির্মাণের সময় কি সনাতনী রূপ নাকি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী মূর্তিসৃজন— কোন ভাবনাকে আপনি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?
সনাতনী রূপ বলতে যেটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল একচালার মূর্তি। প্রতিমার মুখের আদল গোলাকৃতি। মুখের বর্ণ উজ্জ্বল হলুদ। টানা টানা চোখ ও সলমা জরির ডাকের সাজ। এক চালের মধ্যে সন্তান-সহ দেবী এটা কিন্তু যৌথ পরিবারের ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু কালের স্রোতে যৌথ পরিবারের ধারণা হারিয়ে গেছে। কিছু সর্বজনীন পূজা কমিটি তাদের পুজোয় সাবেকীয়ানা বজায় রাখলেও অধিকাংশ পুজোর উদ্যোক্তাদের চাহিদা প্রত্যেকটি মূর্তির পৃথক অবস্থান। আমরা সাধারণত চেষ্টা করি একই চালচিত্রের মাঝে আলাদাভাবে প্রতিটি মূর্তি সৃষ্টিতে। প্রয়োজনে পৃথক পৃথক চালচিত্রও করতে হয়। এছাড়াও আগে এক, তিন বা পাঁচ খন্তার মুকুটের যে-প্রচলন ছিল তাও এখন আর নেই পরিবর্তে মূর্তির গঠনবিন্যাস অনুযায়ী সামঞ্জস্য বজায় রেখে গয়না ও মুকুটের সৃষ্টি করতে হয়। সময়ের পরিবর্তন, রুচিবোধ ও চাহিদার কথা অবশ্যই মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রে আপোষ করা সম্ভব হয় না।

সারিবদ্ধ প্রতিমা

একটা প্রতিমা নির্মাণের পিছনে সৃজনশীলতা ও প্রাণের আবেগ মিশে থাকে। প্রতিটা সৃষ্টিই একজন শিল্পীর কাছে সন্তানসম। কিন্তু আপনারা এই সত্যিটাও জানেন মাত্র কয়েকদিন পরেই এই নির্মাণ জলে ভেসে যাবে। এই নির্মম সত্য একজন শিল্পী হিসেবে কীভাবে মেনে নেন?
প্রতিমার কাঠামো নির্মাণের দিন থেকেই প্রতিটা সৃষ্টির প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা বা সৃজনশীলতা মিশে যেতে থাকে এবং দিনে দিনে প্রতিমা যখন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায় ভালোবাসা বা আকর্ষণ সেই কাজের প্রতি তত বেড়ে যায়। আমাদের সবথেকে শূন্য বা ব্যথা লাগে যখন দেখি যে, আমাদের এই স্টুডিয়ো থেকে একে একে সমস্ত মূর্তি নিয়ে উদ্যোক্তারা তাঁদের নির্দিষ্ট পুজোমণ্ডপের দিকে রওনা দিচ্ছেন। এই কাঠ কাটার শব্দ, খড়ের স্তূপ, মাটির ও রঙের গন্ধ, বিভিন্ন অঙ্গসজ্জার উপকরণ মিলিয়ে আমাদের স্টুডিয়োতে এই যে মাসাধিককাল ধরে কর্মব্যস্ততা তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসে এবং পঞ্চমী থেকে স্টুডিয়োর ভিতরে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও শূন্যতা বিরাজ করে। তখন থেকে আমাদের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট, বিয়োগব্যথা জন্ম নেয়। সেই ক্ষণ থেকেই আমাদের মনে বিজয়া দশমীর বিষাদ জন্ম নেয়। কাজেই দশমী তিথিতে প্রতিমা নিরঞ্জন আর নতুন করে কোনো ব্যথা আনে না।

Categories
2021-Utsob-Poem

দেবোত্তম গায়েন

প্রলাপ এক মধুর স্বর…


মায়ের সমস্ত সুরের প্রলেপ প্রতিপালনের মধ্যে ঘুমিয়ে রইল। আগাছার জন্ম এ-বাড়ির মধ্যে হলে তা শাকপাতাসন্তান। অকুণ্ঠ চেয়ে চেয়ে শেষে লাল হয়ে এলে তার নাম জবা, জবা-ই। মাটিরূপ। ভাষা দাও। শরীরের কষ্ট। প্রমাদের মধ্যে জীবন। আমি বুঝতে পারছি তুমি উলঙ্গ, ভীষণ ঠান্ডা মস্তিষ্কজীবী এক পরাভূতা, জেগে আছে প্রচণ্ড বৈভবে ঘ্রাণের শিউলি, এ-দেহ না থাকলেও হত।


নিজের মধ্যে অন্ধ জেগে উঠলে পিঠ ভারি হয়ে আসে না-দেখার বোঝা নিয়ে। তাই সে নম্র হতে চেয়েও শত্রু সেজে বাড়ি ফেরে। তার ‘কে’ আলো চাইতে গিয়ে লতা হয়ে যায় পড়শির নরম জানালায়। এই শোভা থেকে আমাকে মুক্ত করে আপদকালীন স্বপ্ন। চেয়ে আর দেখার মধ্যে অনেকটা ফারাক, আমি বুঝতে পারি না। ডুব নিয়ে নেয় তারপর…


পতনের আশ্চর্য চিত্র তুমি বয়ে নিয়ে চলেছ নিরন্তর। মহিমার নীল চাঁদ ফুটে উঠলে অপরাজিত তুলতুলে শরীর চিরে বেরিয়ে আসে আরও একটা মানুষ। পৃথিবীর উপর এই অভিমান শ্বাপদের মানায় না তাই। ফুলের মর্ম মৃত্যু থেকে ছুটে আসা মৌমাছির মতো। ভিজে পদ্মের খসখসে ধ্বনি যে শীৎকার হয়ে ওঠে; এ তেমন বর্ষার গানও নয়।


হরিণ এক শাবক। ধোঁয়া ওঠা শরীরের কঠিন পর্যবেক্ষক। নিমজ্জিত অন্ধকার থেকে সরে এসে মানুষের বিশ্রাম পোষ মানিয়ে গেল শস্যের ফলন এবং যৌথ পরিকাঠামো। ছুঁয়ে দেখার প্রকৌশল এক আদ্যাপিঠের গুপ্ত মূর্তি। গোলা ভরা উলঙ্গ পোকা ফসল খেয়ে গেলে নিয়ম হয়ে উঠল পর্যবেক্ষক।


এ ভরা ডাকের মাঝে পড়ে আছে গাছের শুকনো আদল। বাদল ওহে বাদল। শরীর যে নগ্ন করি পরম বিশুদ্ধ সে-ধ্বনি; প্রবালের অনুভূতি। গভীরে কেউ, দেখে না সে মানুষের আঁচ পাওয়া ঢেউ। খেতে খেতে ভরে আছে সোনা ধানের আবেগ; সেরে যায় শরীর, ভিতর। নিজেকে যে নগ্ন করি পরম সত্যি এই। আবহ গান হয়, হয়ে ওঠে সত্তা এক প্রতিধ্বনি।

Categories
2021-Utsob-Poem

সেলিম মণ্ডল

আপেল ও সিঁড়িভাঙা অঙ্ক

সম্পর্ক, এক সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। বাবা চেয়েছিল— আমি অঙ্কে অনার্স করি। ফিজিক্স নিয়েছিলাম। নিউটনের মতো পড়ে থাকা লাল আপেল তুলে বুঝে নিতে চেয়েছিলাম মাধ্যাকর্ষণ বল। আপেল কুড়োতে গিয়ে দেখেছি— এখানেও সেই সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। যতই উপরে ওঠার চেষ্টা করি— ছাদ দেখতে পাই না। শূন্যতার আলো অথবা হতাশা আমায় না-শিখিয়েছে অঙ্ক, না শিখিয়েছে ফিজিক্স। দূর থেকে শুধু যারা এসেছিল বা দূরে চলে গিয়েও যারা কাছে থেকে গেছে তারা আসলেই আপেলের প্রেমে পড়েছিল। তারা বার বার ছুরির অভাবে, না কেটেই খেয়ে নিয়েছে গোটাটা।

ভালোমন্দ

প্রতিটা মানুষ স্বপ্ন দেখে। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখতে দেখতে বৃদ্ধ হয়ে যায়। তারপর মৃত্যুবরণ করে। আবার কেউ কেউ স্বপ্ন দেখতে দেখতে চুল-দাড়ি সাদা করে ফেললেও বৃদ্ধ হয় না। আপনি এই দু-ধরনের মধ্যে কেউ একজন হবেন। আপনার চুল পাকেনি। দাড়িতে গজায়নি মেঘ। কিন্তু আপনার রক্তের মধ্যে বসেছে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প। আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, রক্ত দেবেন কি, দেবেন না… আপনার মন চায় মানুষের জন্য কাঁদতে, আপনার প্রাণ চায়— রক্ত বেচে আপনি স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখবেন…
এভাবেই একদিন কবরের সামনে দাঁড়াবেন… কবর থেকে উঠে আসা আরেকটি স্বপ্ন দেখা মানুষ আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করবে… তার সঙ্গে গল্প করতে মন্দ লাগবে না…

লম্ফ

একবারই ঝড়ে তছনছ হয়েছি। একবারই। কতবার চেয়েছি— এবার উঠে দাঁড়াব। ঘুরে দাঁড়াব। মাঝে মাঝে এমন ঝড় আসে, মনে হয়— ঘুরে না দাঁড়ানোই ভালো। এই ঝড় আগলে রাখি। ভেঙে যাওয়া শিকড় থেকে ছোটো ছোটো ডালপালা গজাক। তবুও আঁচড় থাকুক। থাকুক এই অন্ধকার। পুরোনো স্থাপত্যের মতো ধ্বংসাবশেষ নিয়ে। লোকে ভিড় করুক। দেখুক— ঝড় আসলে ঝঞ্ঝাট নয়। ঝড় হল স্মৃতিমহল। ঝড় হল হারিয়ে যাওয়া মানুষের ফেলা যাওয়া পুরোনো লম্ফ…

আহ্বান

তুমি নেই অথবা তুমি আছ— এই বিশ্বাসের মধ্যে একটি গাছ বড়ো হয়ে ওঠে, মুনাই। বৃক্ষরোপণের সময় হাতে দেওয়া হয়েছিল একটি কুঠার। নিজ গলা কেটেছি, হাত কেটেছি, পা কেটেছি… গাছকে বলেছি: বড়ো হও, বড়ো হও। পাখি এসে বসবে ডালে। তার ঠোঁটে চুমু খাব।
গাছ কই? একটা আসবাব হয়ে ওঠা তক্তা নিজেকে সাজাতে পারবে সেই আনন্দে বীজের কাছে মিছে গর্ভ চাইছে। ফুলের কাছে কে আত্মহত্যা করবে? ফলের পাকা ত্বকে চুইয়ে পড়ছে সময়। ডালে ডালে পাতায় পাতায় শোনো কি সেই আহ্বান?

হাওয়া

রুটির দোকান থেকে ফিরে এসে দেখি— খাবারে, মাছিদের বমি! দ্রুত হাওয়া করি। মাছি কই? মাছি কই? হাওয়া লাগে নিজ গায়ে৷ বমির গন্ধ নেই। নিজের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে। খিদে আর পায় না। খালি রুটির দোকানের মেয়েটিকে মনে পড়ে… তার খাবারেও মাছি ছিল… তার খাবারেও হয়ত বমি ছিল… তবে হাওয়া করার কিচ্ছু ছিল না…

Categories
2021-Utsob-Poem

কুণাল বিশ্বাস

ঘুম

জলাশয় খুব ভালো, সকলের যোগাযোগ আছে
সহজে নিজের মুখ দেখে ফেলা যায়
মাছেদের খেলা ছাড়া পাতায় হলুদ এই ঘাট
গভীর গোপন হাওয়া ফাঁকতালে আসে
সমস্ত কেবলই ছবি— জল কমবেশি

শীতের সকালে চেনা দায়
মনে হয় শাদা ভূত শুয়েছিল সারারাত একা
এখনও কাটেনি তার ঘোর

আমিন

নীলগাই ছুটে আসে ঘরে
পিছু পিছু সব পোকা, জরিপের বন
আকাশের ভুল ধরে পাখিরা বিমুখ

মেঘ বিচারক…

ঢালো মদ… লেখো আমবাড়ি ফালাকাটা
টীকা লিখে যাও

খারিফ শস্য

আকাশের নীচে শুধু হাহুতাশ জারি
দুপুর অচল মনে হয়
কলতলা মেঝে
বাসনগুলি ধ্বনিপ্রবণ
গাছেরা গুটিয়ে আছে ভয়ে

বিবাদ এখন ভালো নয়
এই কথা বলে গেল পাখি

শিয়রে শ্রাবণ…

মাটি ও মেঘের কত যোগাযোগ রেখা
ভেঙে পড়ে বোরো ধান চাষের উপর

স্বপ্ন

সেই যে সেবার ঘন পুকুরের মেঘ
মহিষেরা ঘাড় গুঁজে জলে
মাঠের ছাউনি আর ঘাস কিছু দূর
বনপাউরুটি খেয়ে তোমাদের ঘুম ভেঙে গেল

অন্তিম

চোরাশিকারির বেশে রাত ঢুকে পড়ে
ভয়ে থম গাছের শাবক
ঘুরপথে বহুদূর হয়ে এখন পড়েছে মনে
তারাদের কথা

দেশের খবর শুনি ঠায়— দেশ মানে মহাকাল
সুদূর ফরিদকাঠি, পরগনা জেলা
দেওয়ালে গণেশ ঝোলা অনিতার রুটির দোকান
মাঝখানে পঞ্চায়েত বসে
ফেরে শীতকাল, রাঙা ডালিয়ার বন
পাখির ওড়ার পথ নীল

দেখি চাঁদ খুন করে ভোর
বড়ো হয় মেদিয়ায় আনাজের খেতে