Categories
2021-Utsob-Poem

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী

ডাক

দু-হাতে আঙুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে তোমার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে
অনেক দূরের কোনো বালিকার পড়ার টেবিলে।
রোগা বসতির মধ্যে যেখান দিয়ে চলে গেছে
একখানা একহারা স্টেশন—
চা-ওয়ালা ডেকে যাচ্ছে,
ঝালমুড়ির মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে নারকোলের প্রেম,
সাইকেল-কিশোরদু-টি অপেক্ষা করছে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার।
যে-কোনো দিকেই ট্রেন চলে যেতে পারে এক্ষুনি।
বালিকাটি মন দিয়ে এসবের মধ্যে দিয়ে লিখে যাচ্ছে
অজস্র অক্ষর, শব্দ, পিছুডাক।
স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেন অথবা আঙুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে তুমি
সেই ডাক শুনতে পাচ্ছ না।

আজকের বিশেষ বিশেষ

ঝরে পড়া সংক্রান্ত সমস্ত শব্দবন্ধরা
মেঘেদের মন ভেঙে দিয়ে সাদাকালো খবর হয়ে যাচ্ছে।
খবর হয়ে যাচ্ছিস তুই, আমি, আমরা আর
দুপুরজানলার ফাঁক দিয়ে ছিটকে আসা ফোঁটাদের কাটাকুটি খেলা।
যে-কোনো খেলাই তো শেষ হয়ে গেলে,
কাগজে— মগজে— শুধু ফলাফল হয়ে থেকে যায়।
রেফারির হুইস্‌ল থেকে শুরু করে ব্যাকপাস, ভলি থেকে ড্রিব্‌ল;
সমস্ত ঝাপসা রোমান্সের মতো ফোকাসের পিছনে মিলায়—
সেমিকোলনের মতো, স্তব্ধতা নেমে আসে রিমঝিম— মাঠের উপর।
বৃদ্ধ গ্রাউন্ড্‌সম্যান শিরা ওঠা হাত নিয়ে ঘাসের তবিয়ত দেখে রাখে,
আগামী খেলার কথা ভেবে।

অতিমারির গল্প

এখন তোমাদের মুখর কবিতাসন্ধ্যাগুলি ভেঙে যাচ্ছে বাইনারি ব্যথায়, কাগজ থেকে অক্ষর চুইয়ে পড়ছে দ্বিধাহীন এল.ই.ডি-র ঠোঁটে। বছরের পর বছর আলো ঝলমল করতে করতে ক্লান্ত ম্যয়খানাজুড়ে পড়ে আছে অনির্দিষ্ট ছুটির খেদ, থরে থরে সাজানো অব্যবহৃত তরল মৌতাত আর অজস্র বঙ্কিম সখ্য সম্ভাবনাগুলি; যেগুলি সপ্তাহান্তের পর আর রাস্তা পেরোতে পারেনি। ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে হাতগুলি যারা উল্লাস করেছিল, অফিসে অফিসে উদ্বিগ্ন মক্ষীসকল একাধিক চোখ জ্বেলে সন্দিহান ইতিউতি নজর ফিরিয়ে নিচ্ছে। ছোঁয়াছুয়ি খেলাগুলি স্তব্ধ হয়ে বসে পড়েছে নিরুপায়, আর সাইকেল চালিয়ে যে-কিশোরটি বারান্দায় একটি শ্যামল মুখ খুঁজে খুঁজে চলে যাচ্ছে একা ওকে তুমি রক্ষা কোরো ঠাকুর, ওদের বহুদিন কোনো স্কুলপালানো নেই আপাতত।

ব্যবধান

এই এত গুমোট দিনলিপি
পড়ানো গেল না বলে
ইদানীং দুঃখ হয় না।
অথচ দুঃখ হয় দোয়াতের, কালি-কলমের –
কলসির ভেতরে যেমন কিশোরী জিয়ল মাছ
অবিরাম ছটফট করে—
ঢাকা খুলে দিলে তার সামান্য-জীবন বেড়ে যায়।
আরও কী অজস্র স্তো‌‍‌কে ডোবানো বয়স আছে;
এ-হেন জীবন নিয়ে কোথা থুই কোথা রাখি
মাথায় আসে না।
অকথ্য সমস্ত ওই মেলামেশা-লিপি খুলে দেখি
স্পর্শ পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে যাবার আগে
সামান্য নখ রয়ে গেছে।

কথা ও কাহিনি

ঘেন্না আর প্রতিশোধস্পৃহাকে কাটিয়ে ড্রিব্‌ল করতে করতে
ওই যে পেনাল্টি বক্সের দিকে এগিয়ে যাওয়া মেয়েটি,
ওকে চিনে রাখো কথকঠাকুর।
ওর গল্প তোমাকে বলে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
ওর লাল রিব্‌ন তিন দশক পার করতে করতে এখন লাল পাড়,
সৈন্ধব লবণ আর কামরাঙা-দুপুরকে পেছনে ফেলে
সে একদিন হাঁটা লাগিয়েছিল হাইওয়ে ধরে।
হুহু ছুটে যাওয়া দৈত্য ট্রলারে ওর উড়তে থাকা ওড়নাসৌষ্ঠব
ছুলে গিয়ে রক্তপাত হয়েছিল বহুদিন,
বহুদিন রজঃস্বলা অবস্থায় ওর ব্যথার ভেতরে
গরম সীসার মতো প্রেম ঢেলে দিয়েছিল দোসর।
সঘন শ্রাবণে চুল এলো করে উইপিং উইলোর নীচে
দেহ মেলে ধরেছিল সে আদ্যন্ত বিস্বাদ ধুয়ে নিতে।
অথচ তার খাতার ভাঁজে অক্ষরজ্ঞান ছিল কবিতাপ্রতিম,
অথচ দু-চোখ তুলে চাইতে পারলে দেখতে পেত
গুটোনো ডানা মেলার মতো বিস্তর আকাশ আছে দিগন্তপ্রমাণ,
পুরোনো চিঠির মধ্যে এখনও ধক্‌ ধক্‌ করছে একখানা টাটকা হৃদয়।
সেখান থেকে এতদূর ঘেন্না, তাচ্ছিল্য আর প্রতিশোধস্পৃহাকে কাটিয়ে
ড্রিব্‌ল করতে করতে ওই যে পেনাল্টি বক্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি,
ওকে তুমি চিনে রাখো কথকঠাকুর।
ওর গল্প তোমাকে বলে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

Categories
2021-Utsob-Poem

রুহুল মাহফুজ জয়

গন্দমোদ্যান


বিলাই ভালো। বিলাইয়ের কামড় আরও ভালো। তারও চেয়ে ভালো বৃক্ষজীবন। ধীরে, অতি ধীরে, চুমুকে চুমুকে শিকড়-ডালপালাসমেত তৃষিতযাপন। বৃক্ষের ধী, বিড়ালের অস্থিরতা নিয়া নিম্ফেট ছোট্ট গর্তে ফুটছে অন্ধকার। অই ব্ল্যাকহোলে ঢুকে প্রথম আবিষ্কার। প্রিয়তমা নারীই যুদ্ধবিমান। বাজারের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে অচেনা বারান্দায় বাতাসশোষিত পেটিকোটের ভিতরে হারায়ে গিয়ে যুদ্ধের অই রেতঃপাতে আমি কী করে এলাম!


মনে হল, অন্যমনস্ক হাঁটতে-হাঁটতে একটা বেহেশতে পড়ে গেলাম। যদিও, বেহেশত একটা ধারণামাত্র। যে-ধারণার ভিতরে একটা প্রশান্ত নদী বেয়ে কাগজের নৌকা বয়ে যায়। নৌকার ভিতরে নাকফুলসজ্জিত বউ। ঘোমটা সরায়ে যে ইতিউতি তাকায়। আর পানির গুঞ্জন ছাড়া তাকে অন্য কিছুই বিষাদগ্রস্ত করে না।


অই যে, একদল লোক প্রাচীন সংগীতের স্বরলিপির ভঙ্গিমায় হেঁটে যায়। হাটুরে। নিজেরাই গপ্পের চরিত্র— তাদেরও একটা পিঁপড়াজীবন আছে। মাথায় সদাইয়ের ঝুঁড়িটা লন্ঠনছায়ায় ফারাও সম্রাটদের মুকুটের মতন দেখায়। হতে পারে, ওরাই তুতেনখামেন। মমির অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসে আজ সবজির কারবারি। আর অই যে, স্কুলে কান ধরে খাড়ায়ে থাকা ছেলেটা, যার মনোযোগের নিচেই ওড়ে যত উড়োজাহাজ— পাখিদের বিদ্যালয়ে ওর নামে রোলকল হয়। অই যে, মেয়েটা, সেলাইয়ে কারো নাম লিখতে গিয়ে সুইয়ে ফুটা করেছে আঙুল— ওর অন্যমনস্ক হাসির ভিতরে একটা জানালা ক্রমশ নদী পাড় হয়ে পাহাড়ের দিকে ঘন-অরণ্যে বেঁকে যাচ্ছে। কোনো একদিন ও-ই রূপকথার কাজলরেখা ছিল।


পায়ে যেন মোজা নয়— শৈশবের শালবন এঁটে ঘুমাতে যাই। ঘনছায়া, তেজ খুলে ঘাপটি মেরে বসো। লুকানো মুখের দীর্ঘ শরম তোমার সূর্য হয়। আমার পায়ের মোজায় রাত নেমে এসেছে। দ্যাখো। নিরাকারের মতন পাতাগুলা পতনোন্মুখ। পচনশীল। কে লিখবে সেই অ-প্রশ্রয় অশ্রুর গান?


খননের এই যে বিদীর্ণ চিৎকার— তার ভিতরে অঘোরে তবলা বাজাচ্ছে নীলজ এক লোক। মনমালী রয়ে গেছে ধাঁধা। পাতাসকল হলুদ হয়ে এলো। বুঝি, আবার বাতাসের ঘূর্ণনে আমাদের দেখা হবে। দেখা মানেই বিদায়— অথচ তোমার পায়ের শব্দে তা লেখা নাই।


একটা শিউলি ঝরে গ্যালো জীবনের কিনার ঘেঁষে— কোনো ফুলই ফুটল না আর।


কোথাও আমার আয়ু লাফাচ্ছিল খরগোশের মেজবানে। আর তুমি কেমন দূর্বাদলে বসে গুনছিলা খসে যাওয়া শীতের লোম। আর ভাবছিলা, প্রেমিকটা পুরুষ রয়ে গিয়ে কবি-বনে ফেলে গ্যাছে শব্দের যৌনজীবন। আর আমার আত্মা তোমার আয়ুর ভিতরে পলক ফেলছে— তুমি জন্মের মতন পুরানা সত্য হয়ে যাও।


সুন্দরী। মহিলা অন্যের বউ। মেয়েটা প্রেমিকা। আরেকজনের। উভয়ে উভচর। জাহাজডুবির পর নাভির দিকে তাকায়ে আছে, যেন দ্বীপ। সাঁতরাও, ক্যাপ্টেন!


শাড়ি। পরনে নতুন। কুহু ঘুমায়ে রয়, কুহু ঘোরের ঘুমে রয়। পরনে শাড়ি। নতুন। টুপটাপ। কাদা। পানিভরতি রাস্তা। রাস্তাভরতি নাগরিক অম্বল। কাদা লাগবে, ভিজবে শাড়ি। খিদা-ভয় নিয়া কুহু ঘুমায়ে রয়। পরনে নতুন, জারুলশাড়ি। নৌকা আঁকা— মাছেরা দেখিছে সাঁতার। তারও পরেও, কুহু ঘুমায়ে রয়, কুহু ঘরের ঘুমে রয়।

১০
কারে যেন ডাকছিলাম। কে যেন ডাক দিছিল আমারে। অপরিচয়ের এই ডাক প্যাঁচার দোসর। কেউ না জানি, ভৌতিক সেই শিহরণরিপু কোথা হতে আসে। এমন ডাক ডাকিলাম— কথার জন্ম না হতেই ভাষা মরে যায়। এই ডাক হতে পারত ছবির সামনে দাঁড়ানো আর্ট না বোঝা মুগ্ধ চোখ, সূরার অর্থ না জেনে কুরান মুখস্থ করা হাফেজের দৃঢ় স্বর, কিংবা অন্ধের অনুভূতি— যার স্পর্শের ধ্বনিময়তার নিকটে সকল ভাষা মিছা হয়ে যায়, আঙুলের চোখ দিয়ে যে দ্যাখে গন্দমোদ্যান।

Categories
2021-Utsob-Poem

সুজয় ঘোষ

কফিহাউসের প্রকাণ্ড ঘুলঘুলিগুলো খুব অবাক করত। মনে হত, দূরে কোথাও ঝাউবন। ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘলা। বৃষ্টি হচ্ছে। এখানে রোদ। ওখান থেকে দেখলে দেখবে আমরাও প্রকাণ্ড। তাঁরই মতো। মাটির কতগুলি মূর্তি। বনের প্রান্তে। একলা মন্দিরে। কান পেতে শুনি। কবিতার শব্দ। ওংকার। প্রসূতি। প্রসূন। হামাগুড়ি দিতে, উঠে দাঁড়াতে, মায়ের হাত দরকার, ঈশ্বরের হাত ছেড়ে। কবি উঠে দাঁড়ায়। বলি, তারপর! বলে, আরেকদিন হবে। আজ সন্ধ্যের আগে ঘরে না ফিরলে ফিনিশ! কী? আলো। মোমবাতি! লাইট!… এইভাবে গ্যেতেও চেয়েছিলেন, নাকি, মরার সময়… বড্ড লাউড! কফিহাউস তো! না, এই চিৎকার। কোথায় নেই! কবিতায়… শুনলেন না, টেবিলের নীচে বেড়াল বসে নিঃশব্দ! নাহ্‌, উঠি… ভালো লাগল, আপনার সাথে… আলাপ… প্রথম দিন তো। দ্বিতীয় দিন এলে লাগবে। লাগবেই বলছেন! আচ্ছা চলি… শোনালেন না তো! কী? কবিতা— বসে লিখছিলেন এখানে— আচ্ছা রাখুন… নতুন কবিতা!… উঁহু-হু— খুলবেন না— আমি যাই আগে… কবি ঘুলঘুলি দিয়ে চলে গেলেন। ঝাউবন মিলিয়ে গেল। আকাশের গায়ে এখন চিকচিকে জল। চিরকুট খুলে দেখি তাতে লেখা: কফির দামটা দিয়ে দেবেন, ধন্যবাদ!

একটা দুটো করে গাছ পুঁতে যায় অনেকে। ভিয়েতনামের গলিতে ধরে না। প্রেসিডেন্সির ছাদ থেকে দেখা যায়। স্থানাঙ্ক নির্মাণ। খালি হাতে আসে কবি হয়ে ফিরে যায়। ঝোলাব্যাগ চশমা কিনবে মায়ের কাছে বায়নায়। বাবার ছবি দেখিয়ে বলে, ঝুল ঝাড়েনি বাদল সরকার কটা পথনাটিকার পর! এবং ইন্দ্রজিৎ সময় করে পড়লে। বাবার চশমাটা হারিয়ে ফেলে! নাকি পকেটে করে পটলডাঙায় খুঁজতে যায় নকশাল স্পট। মেসের মাছের ঝোলের মতো দেয়ালে লেগে। ছিটকে গোপাল মল্লিক লেনে ঢুকল আলোবাবু। ধুতি হাঁটুতে তোলা, হাতে আঁকশি। অন্ধকারে সুইচ খোঁজে। খুঁটিতে গাঁথা পরপর কবিতার অন্ধকার। আলোবাবু আলো জ্বেলে দেয়। বিড়ির আলোয় দেখে একটা ঝাঁকড়া মাথা ছুটে পালাচ্ছে। একটা চারাগাছ, কয়েকটা পাতা। ঝিরঝিরে হাওয়া। আর জলপাই রঙের মুখ। প্রতিদিন লুকিয়ে চাঁদের জন্ম দেখে কবিতা লিখবে বলে। ইউনিভার্সিটির ছাদে কিংবা হাড়কাটার আকাশে।

কলেজ স্ট্রিটকে কলকাতা নাকছাবির মতো পরে থাকে। তার বিউটিগ্রাফ। কখনো কমে কখনো বাড়ে। কখনো লোক ডাকে কখনো ভড়কায় কখনো বিনা মৈথুনে কবজা করে কায়দায়। আঁচলে বেঁধে ফেলে। উঠতে বলে ওঠায় বসতে বলে বসায়। প্রয়োজনে দাড়ি সরিয়ে আঁচিল খুঁটে দেখে রক্তমাংসের মানুষ কিনা। গা শুঁকে বুঝে ফেলে জেলা: পশ্চিম দিনাজপুর, দুপুরে খায়নি, লোকসংস্কৃতি বইটার লেখককপি বেচেও গাড়িভাড়া ওঠেনি। অতএব রাত কাটানোর তদ্বির করতে যায় পুস্তনি রাখার গোডাউনের গলিতে। গাড়ির ভিড়ে ঢুকতে পায় না। পাঁচ টাকার মুড়ি একটা ফুলুরি কিনে কাজললঙ্কা চেয়ে তেলেভাজা দোকানির খিস্তি খায়। লঙ্কায় কামড় বসিয়ে সম্ভোগসুখ না পেয়ে ভেবে নিজের যৌনঅক্ষমতার ভূত দেখে মহাবোধির ছাদে একঝাঁক পায়রা উড়ে গেল। বেজে উঠল, ‘বুদ্ধং শরণং…’। আকাশে আলো ছড়িয়েছে। সন্ধ্যার বিউটি নামছে কলেজ স্কোয়ারের কালো জলে পা ডুবিয়ে।

পুঁটিরাম ল্যান্ডমার্ক করে অনেক দোকানিই করে খায়। বইয়ের দোকানদারও। এমনকী পাশের মিষ্টির দোকান মৌচাক কোথায় জানতে চাইলে, ও-ই তো পুঁটিরামের পরেই বললে লোকটি বুঝে চলে যায়। এই লাইনে পুঁটিরাম ল্যান্ডমার্ক করতে পারে এমন দোকান হয়নি। হত, বাঘা এক দু-জন প্রকাশক দোকান দিলে। কিন্তু এ-লাইনের দুর্ভাগ্য: অধিকাংশ নামি বইয়ের দোকান কলেজ স্কোয়ার টপকে। এ-লাইনে ছোটখাটো কয়েকটি প্রকাশনীর বিপণি। একসময় তো তাও ছিল না। আসলে বাঙলার সংস্কৃতি রোদ বাঁচিয়ে চলতে ভালোবাসত বোধহয়। এ-লাইনে বেলা অবধি রোদ থাকে। বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে দোকানে জল ঢুকে যায়। তাও নতুন কিছু গাছ গজিয়েছে। তারা রোদ-জল-ঝড়ে সমান লড়ে। তাদের মধ্যে হয়ে-ওঠা একটা ঝাঁকাল বটগাছ কে পুঁটিরাম কবে ল্যান্ডমার্ক করে দেখার।

ভাগাড়ে নতুন কী মড়া পড়ল যেমন আকাশে চক্কর দিতে দিতে চিল শুঁকে চলে যায়, তেমন কিছু লোক বই শুঁকতে আসে। তারা খরিদ্দার নয়, প্রকাশক নয়, সেলার নয়, লেখক। হয়তো পাঞ্জাবির বুকপকেটের কোণটা ছেঁড়া, কলমটা ঝুলতে ঝুলতেও আটকে আছে, পড়ছে না; কালি লিক করে বুকের কাছটা কালিময়। দাঁত দিয়ে মুড়ির ছিবড়ে খুঁটতে খুঁটতে ঘোলাটে চোখে বইয়ের মলাট উলটে দামটা দেখে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দেয়। পাশের পেয়ারায়ালার কাছে পাঁচ টাকা দরের পেয়ারা কেনে। পেয়ারার বিচি দাঁতের ফাঁকে ঢুকে যাওয়ার ভয়ে গায়ের সবুজ মাংসটুকু খেয়ে বাকিটা কলেজ স্ট্রিটের পায়রাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কলেজ স্কোয়ারে হাওয়া খেতে ঢোকে। রোদ থাকলে ডান দিকটায় বৃষ্টিতে বাম দিকে। অনেকসময় সন্ধ্যা-আরতি দেখে বিদ্যাসাগরের মূর্তির পাশে মন্দিরটায় কীর্তনের দলে ভিড়ে যায়। হেয়ারের সমাধির কাছটায় প্রেমিকপ্রেমিকা থাকে বলে যায় না। প্রেম দেখলে লেখকের অসুখ করে।

Categories
2021-Utsob-Poem

বেবী সাউ

চাও করুণানয়নে


অন্ধকার তোমাকে কাঁদায়?
তার দিকে মুখ করে বসে আছ, বিষাদের ধ্বনি!

তোমার প্রেমিকা রাধা, উজ্জ্বলতা বেশি
চোখের সাগরে ঝাঁপ দিই,
বার বার মরি

তীক্ষ্ণ ট্রেন আসে… কাঁপো…
খান খান ভেঙে পড়ে
হৃদয় তোমার

অন্ধকার উড়ে যায়…
যেতে যেতে অভিশাপ ছুড়ে দিয়ে বলে,

আলোতে অধিক জ্বালা
যাও, ভোগ করো…


চুপ করে বসে থাকো, আলো বিপরীতে…

হাওয়া-বাতাসের শব্দ ভাসে
তাকে লেখো

শূন্যতার সুর নিয়ে হেঁটে যায় নিশাচরী সেই
ধরে রাখো তাকে, প্রেমোদক

কেউ তো তোমার নয়
তুমিও কারো না এ-যাবৎকাল

নূপুরের ধ্বনি বাজে শুধু
শুধু বলে, আছি… আছি…

বাঁশিটি আড়াল হল শ্যাম
কুঞ্জবন ভাঙা পড়ে থাক…


প্রার্থনার মন্ত্র দিয়ে তাকে বেঁধে রাখো। বোঝে সেও?

সে কি মায়ার অধিক ছায়া, গান, শব্দ!
সে কি যাতনার কাল ছুঁয়ে বার বার কাঁদায় তোমায়!

বাসনার ঘরে এনে তাকেই বসাই
দু-হাতে জড়িয়ে দিই এয়োতির সাজ, ধানদুর্বো…

দিন কেটে যায়… ফিকে হয় মন, দেহ…

প্রেম, অভিযোগ শেষ হলে
গলা তুলে বলি, ‘সর্বনাশ, তুই মর মুখপুড়ি…!’


যা কিছু জমানো আমার, সঞ্চিত মায়া
দেহ দিই, স্নেহ দিই, দিই তাকে অধিক যাতনা

ধীরে ধীরে তার কাছে নিজেকে বসাই… ভাবি…
বিচ্ছেদ প্রবল জেনে লিখে রাখি পদাবলী, শ্লোক

দেখেও দেখে না কিছু
উপেক্ষায় রাত কেটে যায়…

সমস্ত শহর জানে নদীটির গায়ে কাল
ভেসে যাবে উলঙ্গিনী বধূ…


আকাঙ্ক্ষার হাড়গোড় নিয়ে বসে আছি, একা

পালিত যাপন এই, লোভানীয় হয়ে ওঠে আরও

ঝিঁঝি ডাকে
নিঝুম ডালের ফাঁকে দেখা দেয় রহস্যের চাঁদ

কেউ নেই
কেউ নেই

ধ্বনি নেই শব্দ নেই
অক্ষরের কাচ ভেঙে চলে গেছে নিঝুম শূন্যতা

পাশ ফিরে শুই
ভয়ে ভয়ে ডাক দিই… ‘আছ… জেগে আছ…!’

বাঁশি বেজে ওঠে…


কত রক্ত ক্ষয়ে গেল, প্রিয়,
কত মন ভেঙে ছারখার…

পাওয়ার নেশাই তবু বার বার বাঁচিয়ে তুলেছে…
আর্তনাদে ভরে গেছে শস্যের শরীর…

এ-ভাদর আসলে পোড়া…
এই দেহে ফসলের মায়া নেই কোনো

তাহাকেই কৃষিকাজ ভেবে
এ-জন্ম জাতিস্মর হল…


নিজেকেই খুঁড়ি

নিজের শরীরে খুঁজি ক্ষিতি, তেজ, বায়ু…

আকাশ এখানে মেশে
জল বয়ে যায়…

প্রতিটি ধ্বনির মাঝে তুমিও নিপুণ
সাবধানে রেখে দাও, ক্ষত, রক্তপাত

খুঁড়ি আর খুঁড়ি
আমার আহত দেহে তুমি জন্ম নাও…


গৈরিক বসনে সাজাই, আলুলায়িত কেশরাশি
জটা পড়ে…

পাগলিনী বেশ এই… কঠিন, কঠোর
শহরের পথে পথে ভেসে যায় পূর্ণতার ধ্বনি
গাছ কাঁদে, মাটি কাঁদে; আকাশের পাখি…

সাধনায় ভরে যায় নীপবীথি বন
নীলের আঁচল ওড়ে, শূন্য চারিদিক

পাথুরে শহর গলে, জল হয়ে যায়

মীরার ভজনগীত তোমাকেও জ্বালায়, পোড়ায়…


তোমাকে জীবন মানি
তোমাকে মরণ

আলেয়ার দিকে ছুটে ছুটে মরি
সরণের পথ নেই কোনো
ভাব নেই

ছেঁড়া বসনের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছি যে-কবিতা
কীর্তনের সুর দিই
বাঁশি দিই

মাদলের রব ঘন হলে
অভিসার, মৃদু ইশারায় চোখ মারে…
ডাকো?

১০
যে-পথ তোমাকে চায়, তার পরে কাত হয়ে শুয়ে থাকি আমি

পদধ্বনি বাজে

প্রতিটি ধুলোয় গায় বেজে ওঠে রাধা রাধা রব

নীচু মুখ, অভিমানী
সে-সব ধুলোর গায়, ধীরে ধীরে লিখি ‘অশ্রুপাত… তাহাকে কাঁদাও…’

Categories
2021-Utsob-Poem

রণজিৎ অধিকারী

সময়

সময়ের অস্তিত্ব নেই না?
দীর্ঘ নীরবতার পর সময় আড়মোড়া ভাঙে আর বৃষ্টিপাতের শব্দ এসে তোমার জানালায় ধাক্কা দেয়।
তুমি তো জানোই না, এই এখানে আসার পর, তুমি
ঠিক কোনখানটায় আছ, দেখানোর ভঙ্গিতে
তোমার আঙুল বের করে হাওয়ায় ঘুরিয়ে আবার অন্যমনস্কভাবে মুড়ে রাখো মুঠোয়।

লিফ্‌টের শব্দ, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে কিছু,
যেন সময়ের বিপরীতে নীচের রাস্তায় অত গাড়ির
জট পড়েছে,— কোথায় যাবে ওরা?
যা-ই দেখ তুমি জানালা দিয়েই দেখ, তোমার জন্য ছাঁচে কাটা জানালা, তুমি এখানে আসার অনেক আগে বানানো — মাঝে মাঝে তুমি ক্ষেপে ওঠো
এই ভেবে,
যেন কোনো কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই!

তবু শেষমেষ যা পাও— একটা পাতার খসে পড়া,
সমুদ্র থেকে পাঠানো একটা জাহাজের ডাক, কিংবা কোথাও ভারী কিছু ঘষটানোর শব্দে… তোমার
মনে হয়, এই সবই সময়ের খুব বাজে অনুবাদ!

বিছানা

দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে, যেন সবার অলক্ষ্যে
সেখানে একটা বিছানা পাতা, তারা প্রায়ই এসে
গড়াগড়ি খায় আর যখন তারা একে-অন্যের শরীরে
ঢুকে পড়ে তখনই বিশাল ঢেউগুলো এসে ঢেকে দেয়
তাদের সংগমস্থানটাকে।
দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে, সেখানে
মাঝে মাঝেই এক-একটা জাহাজ তলিয়ে যায়,
হয়তো নাবিক আবিষ্কার করে ফেলেছিল সেই বিছানা,
কিংবা উথাল-পাথাল সেই সংগমদৃশ্য!

সেইসব জাহাজের আর্তচিৎকার অত জলের তলায়
চাপা পড়ে আছে বহুকাল ধরে;
দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে সেখানের আকাশে
ভারী ভারী মেঘগুলো এখনও দানবের মতো ঘুরে বেড়ায় আর গর্জন করে
কেবল সমুদ্রের শীৎকারধ্বনিকে চাপা দেওয়ার জন্য।

একটি সকাল

কিছুদিন রোগভোগ করে সকালের নরম রোদের সামনে এসে দুর্বল দাঁড়িয়ে বলি— ধন্যবাদ। যেন ফিরে এলাম আর সারা জগৎ দুশ্চিন্তা করেছে খুব
এ-ক-দিন, যেন আমি-হীন জগৎ সহ্য হবে না কারুর,

যেন কী কাঁপতে কাঁপতে এসে দুর্বলভাবে থেমে গেল
এবারের মতো…

এখন এই সপ্তাহপরের ভালোবাসার রোদ
পায়ের ওপর এবং আমি বলি— ধন্যবাদ।

আকাশে ভাঙা ভাঙা মেঘগুলো শ্রাবণের চিহ্ন বহন করছে না, জুলাইয়েরও না বরং ওরা এখন আমার
ভালো লাগার চিহ্ন গায়ে মেখে আছে। এবং
ওই সাদা শরীরের ইউক্যালিপটাস— যার মাথা থেকে
অনেকটা পৃথিবী দেখা যায়— ও আমাকে জানাল,
অনেক দূর দিয়ে চাকাগুলো খুব ধীরে আবার
গড়াতে শুরু করেছে…

আমি তক্ষুনি ওকে আর সেই দূর চাকাগুলোকে
ধন্যবাদ দিই

নির্ণয়

শেষে এমন হয় যে,
তুমি তিনটে দিন কোনোমতে পার করে দিতে চাইলে,
কিন্তু দুটো দিন পরই আটকে গেল,
একটা দিন দিগন্তের অনড় মেঘটার মতোই
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বুকের বাঁ-দিকে, কখনো

গলার একটু নীচে।
আসলে সবসময়ই জরুরি হল,
নিজের অবস্থানটাকে নির্ণয় করতে পারা।
তুমি কোথায় আর কখন সেটা ঘটছে।

যখনই খুঁজলে যেন দেখতে পাও, তুমি
এই বিশ্বের মাঝখানে, তোমাকেই ঘিরে এই
পাহাড় আর সমুদ্র, শব্দ আর নৈঃশব্দ্য,
তাপপ্রবাহ আর তুষারপাত…!

কিন্তু একদিন ঘড়ির কাঁটা কোনো একটা দিক
ইঙ্গিত করে থেমে যায়, তোমার গা থেকে রোদ
মুছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তুমি হয়তো টেরই পেলে না,
ওই ঘষটানো দাগটাই তোমার সীমা, হয়তো

উঁচু ওই পাহাড়ের ওপাশে আটকে পড়েছে
তোমার দিনগুলো, বরফে চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে
এবং তুমি এই বিশ্বের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন…

Categories
2021-Utsob-Poem

সেলিম মল্লিক

তোমার মানিব্যাগ খুলে

আমার পড়ার টেবিলে লাল রঙের পার্স ফেলে গেছ, তার ভেতর থেকে
কয়েকটি কাগজি মুদ্রা বার হয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে
বাইরে উড়ে গেল— বুঝলাম, তোমার সঙ্গে
টাকাপয়সার সম্পর্ক নয় আমার। ঘুমের সময়
তোমার ঠোঁটের বর্ণনাতীত গাঢ়তার দিকে
তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না, ভাবছিলাম
দুপুর গড়িয়ে গেছে, ঘুম ভাঙিয়ে
তোমাকে আরও রঙিন ফল খেতে দেব।

আর এখন, তোমার মানিব্যাগ খুলে
আনমনে খেয়ে ফেলেছি ঘন খয়েরি লিপস্টিকের শাঁস।

তারার চেয়ে দূরে

হোম কোয়ারান্টিনের সন্ধ্যে বেলা শিশি খুলে
তোমার নেলপালিশের গন্ধ শুঁকছি, এইরকম
তাজা গন্ধের হালকা পিঙ্ক গোলাপ-ফোটা সময়ে
তোমাকে হাওয়াদের সহচরী মনে হয়, যে কিনা
আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের কাছে এসে
খুব ঠান্ডা অতি সূক্ষ্ম পালক দিয়ে নাকের ডগা স্পর্শ করে।
আজ আমি পাকা ফল ভেবে
তোমার লিপস্টিকের মাংস খেয়ে ফেলেছি।

আবার জ্বর আসছে, চোখের পাতা ভরে
ঈষৎ উষ্ণ জল ছলছল করে।

পাশের ঘর তারার চেয়েও দূরে, তুমি
অনেক কিছু অনুমান করতে করতে
নিজের জন্য বিছানা প্রস্তুত করছ, নীল প্রেক্ষাপটে
পড়ে রয়েছে একটি অপ্রতিভ সাদা বালিশ।

একটা গ্রাম আছে

ধোঁয়া দিয়ে তৈরি অনেকগুলো পাহাড় পেরিয়ে
আমাদের একটা গ্রাম আছে— কোনোদিন
যাইনি, কেবল যাওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করি।
গোটা কয়েক গান তুলে রেখেছি, ওখানে গিয়ে
গাইব আর নীল জলে ভাসাব লাল ফুল।
নিশ্চয় বিসংবাদ হবে না, যা বহুবার
আমাদের কথোপকথনের ভেতরে ঘটে যেতে দেখেছি— গাঁয়ের লোকেরা
পোশাক ছাড়াই এগিয়ে আসছে আমাদের দেখে এবং
তাদের সঙ্গে আমরাও ন্যাংটো হয়ে চাঁদ লুটিয়ে পড়া
শস্যখেতের দিকে দৌড়ে চলেছি, পেছনে পেছনে
নিরীহ পশুরা ছুটছে উৎফুল্ল জ্যোৎস্না।

দেশের কথা

ঘুমের আগে আমার হাত
স্বাধীনভাবে ছুঁয়ে আছে তোমাকে, কিন্তু তোমার নিশ্বাস
নিরুত্তাপ ঠাকুমার গল্পের মতো— নিদ্রাকালেও
রাষ্ট্রহীন মানুষেরা মুঠো শক্ত করে ধরে রাখে! যদিও
অনেক আগেই তাদের খোয়াতে হয়েছে
ফুল-ফোটা রুমাল, কাকচক্ষু আয়না, পূর্বপুরুষের সইসাবুদ,
নাম-লেখা তৈজসপত্র, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের শিস।
শুঁড়-তোলা হাতির নকশা-করা কাঠের বাক্সটা
আমরা কোথায় রেখেছি? ওর মধ্যেই তো রয়েছে
কালো পোকা সাদা ফুলের অসংখ্য দাগযুক্ত আমাদের যৌবনের চিরকুট।

Categories
2021-Utsob-Poem

পার্থজিৎ চন্দ

রক্তমাখা, চোদ্দো লাইন-৪

শুয়ে আছে পিণ্ডবৎ, তাকে তুমি গর্ভ বলে মানো
ভাবো, এটুকু অর্জন নিয়তির কোটি সম্ভাবনা
ঘুরে ঘুরে ধাত্রে আসে, তারপর ধারকের রীতি
তাকে শস্য-স্পর্শ দেওয়া। অভ্রান্ত রাস্তার শেষে বাড়ি
দাঁড়িয়ে রয়েছে একা, ভাঙা সাইকেল টব ছুরি
নিপুণ সাজানো। তাকে রাখা আপেলের টুকরো;
যেহেতু সে-গর্ভ থেকে খিদে নিয়ে জন্মেছে সকালে
তার ক্ষুধিত লালার সামনে অসহায় খাদ্যরথ
দ্বিবিধ প্রকাশে ফোটে। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না
এবং সে গর্ভে ঢালে অনিবার্য টন টন খিদে
ফলত এ-গর্ভাশয় অযৌন জননের চিৎকার
বুকে নিয়ে বার বার অশ্রু ফেলবে, শিহরিত হবে
শুয়ে থাকবে পুত্ররূপে কন্যারূপে শূন্যতার হিম

প্রসববেদনা শেষে হাতে ধরো দ্বিগুণ অসীম

রক্তমাখা, চোদ্দো লাইন- ৫

আগে দাও পরিখার নির্ভরতা, মদ। তারপর রাত-পথিকের
মাথার ভেতর অচিরাৎ ঢুকে যাবে সেই সব মায়াবাদ্য, ট্রাম্পেট
এই যে স্লটার-হাউস মাৎসন্যায়ের, আরব্যরজনী ফুঁড়ে গল্প
ক্ষুধাতুর কামকলা অলীক কথন, সাজানো উপসংহার প্রায়।
ক্যাসেলে ঝিলিক দিয়ে ওঠা অস্ত্রশস্ত্র, আর গোপনীয় নয় রাত
বরং ভেলভেট কর্সেট প্রকাণ্ড হুক নিজে হাতে খুলে মাংস ধরবে
ক্রমতালিকার মৃত্যুধারা রক্তধারা নিয়ম মেনে সম্পন্ন হবে;
উদ্‌ভ্রান্ত তাতার দস্যুর হাতে জাদুপ্রদীপের অধিকার
আরও বেশি রাত্রের হিংস্র ছায়ামথ, উন্মুক্ত করেছে এতক্ষণে
ক্যাসেলের প্রকৃত দরজা, গুমঘর। দু-হাতে পরানো বাঘনখ
স্বয়ংক্রিয়, ইঙ্গিত একযোগে ফোটে স্থলে জলে অন্তরিক্ষে, দুর্গে
হতভম্ব আপেলের দিকে ছোটে সাপ। লিঙ্গ নিরপেক্ষ নীল ভ্রূণ
একমাত্র হিংসার। তার আশ্বাসে নিশ্চয় এতদূরে আমিও আসিনি

দেখো, তোমার পাঠানো জলৌকার ফেরা, পিঠে বস্তা… রক্তভেজা নুন

রক্তমাখা, চোদ্দো লাইন- ৬

লূতাতন্তু ছড়িয়েছে ব্যবস্থার দূরতম কোণে
প্রতিটি গল্পের শেষে ঢুকে গেছে চিতা খরগোশ
প্রথমে চিতার হাঁ-য়ে মিশে যায় খরগোশের মাথা
অজীর্ণ মাংস-হাড় জন্মান্ধ কথকের আইরিসে
ঢুকে আরেক কাহিনি, প্রতিনায়কের ঘামরক্ত—
মাখা, অস্বীকার করে চিতার ঘাতক দাঁত থাবা
গল্পের সাপেক্ষে গল্প এভাবে স্বাধীন ভূমি পেলে
সার্থকতা পায় চোখ। গল্পের থেকে মাইক্রোস্কোপ
তুলে ফেলে দর্শকের ভূমিকা বদলায় সংগোপনে
তখন সে খুঁজে ফেরে রহস্যজনক দূরবীন
চোখ রেখে দেখে ভ্রম, ইস্কাপন হরতন দেখে
দেখে রাজার ভূমিকা অকস্মাৎ বদলের বিবি
সেখানে মাকড়-রাত প্রশ্নাতুর, অনিবার্য কূট

যা ছিল স্পষ্ট অ্যালবার্ট, দূর থেকে মনরোর ছবি

রক্তমাখা, চোদ্দোলাইন- ৭

ভূর্জপত্র, খাগের কলম… সংঘর্ষ পরিস্থিতি
বলে একে মানা আবশ্যিক। কারণ এ-অবিরাম
ঘর্ষণের ফলে ফুঁসে উঠবে কুণ্ডলীকৃত অজগর
পাক দিয়ে ধরবে কুরুক্ষেত্র প্রতিটি রথের চাকা
রক্তস্রোত তির বৃংহণ, কে কাকে যে বিশ্বরূপ
দর্শন করাবে মৃত্যুতীরে… চাকা বসে যাওয়া রথ
নিকট বর্তমানের থেকে দূর বর্তমানে যায়
তথ্য, সংকেত। দূরগামী আলোর শরীর থেকে
তালা খোলা সে-সব সিন্দুক ঝরে পড়বে আমাদের
সমস্ত প্রলাপ লক্ষ করে। দাঁত-ভাঙা গজানন
তখনও লিখছে প্রতিটি শব্দ গুপ্ত-হত্যা গুপ্ত-প্রেম
সংঘর্ষ বিরতিবিহীন, ফুলকি উঠছে ঊর্ধ্বদিকে
উত্তাপে শিথিল হয়ে আসে মোমের কলম, গলে

আরও কত কুরুক্ষেত্র শ্যামবাষ্প ঢাকা যুদ্ধ অগণন

Categories
2021-Utsob-Poem

নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছায়ামানুষের খেলনাগাড়ি

১৮
ত্যক্ত কারখানার লাশ
পড়ে আছে জলে ও আগুনে

গা বেয়ে গড়িয়ে রক্ত মাটিতে জমাট

জানলা হাট করে খোলা; পাল্লা একদিকে কাত হয়ে
ভিতরে লোহার কান্না, স্প্রিঙের ফিসফিস

পাখি ঢুকে পড়ে রোজ
কেউ কেউ বেরিয়েও আসে

কখনো গভীর রাত্রে বেহেডউন্মাদভবঘুরে
অজ্ঞান মাংসের চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে খোলে

চরাচর ঢেকে যায় মরচেলাগা পালকে পালকে

১৯
ধ্বনিসমূহের মধ্যে কে যেন নীরবে ঢুকে গেছে

পাখির গলায় চোরাবালি

পায়ের তলার জমি ওলটপালট করে
আড় ভাঙছে মাটির ফোয়ারা

জল কেটে বসে যাচ্ছে মর্মরিত আলোর চাবুক

আকাশে বৃংহণ আর রক্তমাখা তুলোর গোঙানি

দৃশ্যের ভিতরপর্দা ছিন্ন করে উঠে আসছে
অদৃষ্টিমোহন সাঁকো—

পবিত্র, পিছল

২০
সকরুণ স্ট্রিটলাইট বুঁদ

তলায় পা ফাঁক করে শুয়ে আছে গলি

ঝাপসা হয়ে আসা নাম অক্ষর পারছে না কিছুতেই

ভিতরে শিসের শব্দ
বিস্মৃতমেরুন পর্দা গাঢ় হতে হতে হদ্দ খাঁ-খাঁ

লোক ঢুকছে, বেরোচ্ছে পালক

বিজন মাংসের ছাঁট মুখে নিয়ে নিবিষ্ট কুকুর

ঠিকানা হারানো শোক আয়নার বাজার পার করে
গলিটার সামনে এসে বাঁশি হয়ে যাচ্ছে একা একা

২১
ক্লান্ত পোড়োবাড়ি ধীরে গাছের মুঠোয় ঢুকে গেছে

কাজ বলতে তার শুধু দিনভর ঝিমোনো

স্বপ্ন বলতে ছায়া চেটে খাওয়া

ভিতরে বাতাস ঘোরে

দক্ষিণের জানলা থেকে ঝাঁপ দেয় যুবতীর হাসি

মেঝেয় লুটানো ম্লান জাফরিকাটা আলোর পাঁজরে
ঝুঁকে আসে পাথরের ফণা

নোনা ঝুলবারান্দা শুধু চুপিসাড়ে মুঠো থেকে খুলে
ভাঙতে ভাঙতে উড়ে যায় ক্যালাইডোস্কোপের ফুটো দিয়ে

২২
দুপুরের রোদে বসে পাথরের ছায়া ভাঙে গান

তালে তালে সোমত্ত হাতুড়ি

ঘাম ঝরে

মুখে মুখে ফিরে আসা কলির শেষপ্রান্ত ধরে
দিন ক্রমে ঢলে পড়ে অনাবিল হাসির পারদে

একটু দূরে ত্রিপলের তাঁবু
হাওয়ার সংসার আগলে নিভু উনোনের পাশে শুয়ে

উঁচুনীচু রাস্তাগুলো খেলাচ্ছলে ডিঙোতে ডিঙোতে
রাতের খোরাকি নিয়ে উঠে আসে আলোর ঝরোকা

২৩
ঘোলাটে আকাশ ভেঙে গাছের গোড়ালি ডুবুডুবু

পাতায় পাতায় মিহি জলপিয়ানো
রিডের প্রলাপ

সামান্য উঁচুতে মাঠ দিগন্তে উপুড়

পিঠভরতি এলোমেলো চাবুকের ক্ষত চুয়ে চুয়ে
নরম মাংসের রেণু গুলে যায় জলে

ডুবে যাওয়া ইঁদুরের গর্ত থেকে উঠে আসে
ভাঙা দাঁত; বালকবেলার

ভেজা কাকতাড়ুয়া শুধু ফাঁকা মাঠে একপায়ে দাঁড়িয়ে
এ-পাশ ও-পাশ দোলে— যেন অনন্তের

পিয়ানোবাদক; যার হাতের আঙুলগুলো কাটা

২৪
ঝুরো পাথরের গান খরজে নেমেছে

আবছা আলো-অন্ধকারে ফণা তুলে দুলছে বুনোঘাস

বেলেপাথরের পিঠ, ছোপ ছোপ লোহার কালসিটে
শরীর বেঁকিয়ে যেন বহুকাল গুঁড়ি মেরে বসে

তলায় অনেক নীচে
দহে হাবুডুবু খাওয়া বাতাসের ছিন্নভিন্ন হাসি

আকাশ এলিয়ে আছে, শশীচুর ঝরে পড়ছে বনে

দস্তার নূপুর খুলে রেখে
বুকে হেঁটে উঠে আসছে কাটা জিভ; সুরসবিতার

Categories
2021-Utsob-Poem

হিন্দোল ভট্টাচার্য

মৃৎফলকে লেখা


বড়ো অন্ধকার, তবু দুঃখ থেকে একদেওয়াল দূরে
সুন্দর যেখানে ম্লান মুখ
নির্জন ঘরের মতো, জানলা খুলে রাখে শীতকালে।
তোমার হাসির শব্দে ভেঙে পড়ে
বরফের নদী।


তোমার শহর থেকে দূরে থাকি,— তোমার ভাষায়
কবেকার মরচে ধরা লোহার পেরেক বিঁধে আছে।

মানুষ দেবতা হলে, দেবতা শয়তান হয়ে যায়
ঘন ঘন রক্তবমি করে;

এত বিষ তুমি কেন ধারণ করেছ মহাদেব?

তাহলে সমুদ্র তোল, ধিকিধিকি প্রতিহিংসা
ভালো কথা নয়।

তোমার শহর থেকে দূরে থাকি,— সুন্দরের গায়ে
কবেকার পোড়া দাগ লেগে আছে জড়ুলের মতো


সেও তো আসলে মূর্তি,— যে কখনো নিজেকে ভাঙে না

খোলা চোখে পলক পড়ে না

তার চেয়ে মূর্তিকর হওয়া ভালো,— বার বার গড়ে
বার বার ভেঙে দেওয়া যায়

ব্যর্থ হলে মানে, তুমি বেঁচে আছ,—
রক্ত চলাচল হয়
দু-চোখে এখনও জল আসে…


ভালো, উদাসীন থাকা। এঁটো বাসনের স্তূপে
যেভাবে আহার লেগে থাকে

ইশকুলবাড়ির গায়ে বিকেলের আলো,—
তোমাকে ঈশ্বর ভাবি।

মাছি ও পিঁপড়ের সারি প্রাণকণা খুঁটে নিতে আসে…

ভালো, উদাসীন থাকা। আকাশ এবং শস্যখেত
মুখোমুখি শোয় যেরকম…

খেলা অসমাপ্ত রেখে পড়ুয়ারা ঘরে ফিরে যায়

পড়ে থাকে মাঠ যার সবুজের ফাঁকে ফাঁকে
জীবনের দুঃখ লেগে আছে


ঝরে যেতে পারি আমি, ঝরে যেতে পারো তো তুমিও
এ-পৃথিবী ঝরে যাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিরাতে—
আমাদের সকলের আয়ু আর মায়া ঝরে যায়।

যাওয়াটাই বড়ো কথা, থাকা তো কেবল
সমাধির কাজ। তুমি সমাধি হবে কি?
শিলালিপি থেকে তবু শুনেছ কি চোরা আর্তনাদ?

যুবতী যক্ষিনী জানে, তার স্তন বড়ো বেশি মৃত।
কামের আগুন নিভে গেছে তাই তাহাদের দেবী মনে হয়;
কোথাও সংগীত যেন শুধু প্রতিধ্বনি হয়ে আছে।

সংগীত ফুরিয়ে গেলে, তার পর শূন্যতাই জন্ম দেয় সুর…


আমাকে গোপনে রেখে ঈশ্বর বিদেশ চলে যান
হাওয়াবদলের রক্ত বেসামাল করে।
দেখি গুহামানবের চোখ দিয়ে, ভাবি জগন্নাথ
কীভাবে অন্ধের চোখে দেখা দেন এ-ঘন বরফে?
এখন আঁধারশীত। ঘনঘন ছোবল মেরেছে
পিশাচেরা যেরকম পাকে পাকে খায়।
আমি তো গোপনে দেখি ঈশ্বরের ছদ্মবেশে রন্ধ্রপথ দিয়ে
এসেছে কালাচ-বিষ। রয়েছে খোলস।
আমরা দু-জনে বসে আছি কবে ঈশ্বর ফিরবেন—


এই তো এলে, এর মধ্যে যাই যাই ভাব কেন, শোনো ওদিকে
কীর্তনের গান শুরু হল। রাতটা থেকেই যাও। না-হলে শ্বাসকষ্ট হবে,
ফিরে যাওয়ার পথ এত সহজ নয়।

কত চড়াই, ধ্বস, নালা, চোরাবালি, পাথর,— কোথাও কোথাও রাস্তাই নেই।
কোষবদ্ধ কিছু হাত বুনো লতাপাতা জড়িয়ে এ-পথে ধুলোয় মিশে আছে

ফিরে যাওয়ার পথ এত সহজ নয়।


যখন ঈশ্বর নেই, আমি খুব নিরাপদে থাকি!
এলোমেলো করে দেওয়া তার কাজ, আমি তো গুছোই
সে বলে, সঞ্চয়ী মন বড়ো;
বই গোছাই, ভালো করে পরিষ্কার করি ঘর, ফুল তুলে আনি…
মন্ত্রের বদলে কিছু অভিমান পড়ি।
তিনি পাথরের মতো তাকিয়ে থাকেন
ঈশ্বর এলেই শুধু
আচমকা হাওয়ায়, ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় খেত
ঘরের ভিতরে জমে ধুলো, মাটি, জল।
দেখি মৃত গাছের ডালেও
একটি আশ্চর্য সাদা ফুল ফুটে আছে।


কারা যেন আমাদের নিয়ে
অসমাপ্ত উপন্যাস লেখে।

এক-একটি অনুচ্ছেদে
এক-একটি চরিত্রে কথা বলি।

ক্রমশ লিখিত হই
তাঁর ইচ্ছেমতো।

তোমাকে হত্যার কথা ভাবি প্রতিদিন।
তোমাকে লেখার কথা ভাবি।

Categories
2021-Utsob-Poem

পঙ্কজ চক্রবর্তী

ধুলোর সংবাদ

আমি তো ভাবতেই পারি শোক নামমাত্র। চলে যেতে পারি আমোদিত ধুলোর অরণ্যে। তুমি জল দাও বারান্দায় প্রতিটি শিকড়ে। খুব যোগ্য মানুষ আমি নই। অবিবেচক। হলুদ পাতার দু-পাশে রান্নাঘর এঁকে বসে থাকি। ভাবি ভুল মানুষের বুকের আগুনে ফুটবে ডালভাত। দরজার ফাঁকে তদন্ত করবে তোমার পাঠানো লোক। ‘হাত পুড়িয়ে খায়’ এই মর্মে সংবাদ ছড়াবে বাজারে।

তোমার স্তন্যপানে প্রতি রাতে জেগে ওঠে হলুদ পাতার এক বাঁশি। আজ যদি তুমি না বলো, কেমন করে বুঝব মধ্যরাতে প্রতিটি গাছ একাই ঈশ্বর!

আবাসন

সূর্যাস্তের আলো গায়ে মেখে তুমি নেমে আসছ দশতলা বিল্ডিং থেকে। আজ তোমার ছেলের জন্মদিন। সকালে তার মুখ দেখা হয়নি। তবু মেঘের কানে কানে শুভেচ্ছা চেয়েছ এই জীবনের। এত উপর থেকে মনে হয় পিপাসা নিরর্থক। তবু শূন্য বুকে দম্পতি চায় ছোটোবাড়ি। সামান্য কয়েকটি ফুলগাছ। আর তখনই তোমার মনে পড়ে উটের সাম্রাজ্যে পোশাকের মূল্য নেই কোনো। তবু বাড়ি ওঠে মাঠের মাঝখানে। শূন্য হাওয়ায় ভেসে যায় তোমার সর্বস্ব। ঐ তো বাড়ি ফেরার পথ…

ঘরের জ্যামিতিটুকু নিঃসঙ্গ রান্নাঘরে একফালি আলো জ্বেলে রাখে…

গোধূলি

দীর্ঘস্থায়ী বাসনপত্রের ভিতর এখন তোমাকে দেখতে পাই। যেন পলাতক উড়োমেঘ, গাছের সংসার। তুমি দেবদূতহীন বেঁচেছিলে আরও পনেরো বছর। বাবার ফরিদপুরের কাঠের ছোটোবাক্সে জমিয়ে রাখতে দু-জন মানুষের অসংলগ্ন চিঠি। এখন আশ্বিন মাসের দুপুর। নিখিলেশ কাকুর আত্মমগ্ন প্রতারক ছায়া পড়ে আছে দক্ষিণের বারান্দায়। মানুষের রক্তমাংসে উপমার রাগ তেমন দীর্ঘস্থায়ী নয়। তোমাকে ডাকতে ডাকতে সুতো গুটোচ্ছি কেবল

এই তো সেদিন নিমগাছে এসে বসেছে নিজস্ব লাল ঘুড়ি। আমি তার পিছু পিছু অতর্কিতে পিছনের জানলা খুলেছি…

বাজার হাটের কড়চা

এই যে প্রতিদিন বাঁচি সে শুধু বাজার, ম্লান কিছু দোকানপাটের আলো। কয়েক টুকরো কাগজ আর ঘন ঘন প্লাস্টিকের বিবাহবন্ধনী। যদি সে আসে অলৌকিক হবে। মেঠোজল, বৃষ্টির দিন মনে হবে আঁধারের নৌকোবিলাস। নদীর ওপার থেকে এই তো সেদিন এল ঘন দুধ আর সুগন্ধি সাবান। খদ্দের দোকানীর লুকোচুরি খেলা কেমন স্বাস্থ্যবান শুয়ে আছে পথের ওপরে। কয়েকটি কুকুরের ছায়া আগন্তুক ঢুকে পড়ে জীবনীর প্রকাশ্য দরজায়।

আমরা নেই-মানুষের দল আজও দেখি দোকানপাট, রজকিনী ভাঙাচোরা আলো, ঢুকে পড়ছে অস্পষ্ট বুকের ভেতর। দু-একটি ধানখেত, নদী, সমুদ্র, নিকষিত হেম ছাড়াই দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকা গেল।

বাজারসমিতি

বাজারসমিতি, তুমি অনুরাধা পাড়োয়ালের শ্যামাসংগীতের মতো উদাসীন। খুব ভোরে মায়ের আঁচলে টের পাই উনোনের থাবা। ঐ তো এক হাজার চোখের সামনে তুমি কীভাবে খুলে ফেলো শাড়ি দূর থেকে দেখি। বেলা বাড়ে। চায়ের দোকানে ধারবাকি। সস্তার সিগারেট। তোমার স্তন, বাম বাহু উঁকি মারে বাজারের থলির ভিতর। শুধু সুখী মানুষের নিস্পৃহ চোখের মতো আরেকটা দিন চলে যায়।

তোমাকে এনেছি বিবাহ করে নগদ কুড়ি হাজার টাকা আর লাল সাইকেলের বিনিময়ে। এসো, বোসো, এমন এক বিকলাঙ্গ আখ্যানে। ঐদিকে শনিমন্দির, অলঙ্ঘ্য শ্যামাসংগীত— তার নীচে মাতৃআজ্ঞাবহ জল।

অবমানব

মেয়েলি কিশোর জানে নারীবাদ বলে কিছু নেই। শুধু তার চোখের চাহনি সন্দেহ করেছিল পুরুষের ছায়া। বাথরুমের দেওয়ালগুলি কবে থেকে ছন্নছাড়া প্রেমিকের চোখ? প্রতিদিন আয়নার ছবি জানে নির্জন বুকের রহস্য। প্রতারণা। লিঙ্গের পবিত্র আবহসংগীত। নারীর বুকের উপর, হে মায়াবী পুরুষ আমাকে চর্বচোষ্য খাও। ছুঁড়ে দাও রজঃস্বলা নদীর ওপারে। যদি পিতৃপুরুষ খোঁজ নেয় বলে দিয়ো নিজস্ব পাজামা আমি রেখে গেছি গাছের কোটরে।

নেই, নেই, কিছু নেই, সত্যি নেই, মেজদির দ্বিতীয় স্বামীর জীবনে। শুধু বাঁশবন থেকে একটু দূরে এখনও উড়ছে তার সন্ধ্যার রক্তমাখা প্রেমের অক্ষর।