Categories
2021-Utsob-Poem

অনুপম মুখোপাধ্যায়

সেন্ট পিটার্সবার্গ

আমারই ভিতরে আছে সাবেক শহর
পুরাতন ইমারত প্রাচীন পাঁজর

ধাতুময় ইতিহাস এই শহরের
আমার সম্ভ্রম চায় অন্ধকার রাতে

এখানে কান্তার নেই মেয়েমানুষের
বুকের বোঁটায় নেই খয়েরি জোছনা

প্রেম আছে ঘৃণা আছে তার চেয়ে বেশি
প্রেম আর ঘৃণা নিয়ে অভিনয় আছে

ভাঙা উৎসবের দাঁত লেগেছে বাতাসে
কালো নদী বয়ে গেছে শহর দু-ভাগ

দস্তয়েভ্‌স্কির লেখা কাহিনি যেমন
এপারে দাঁড়িয়ে শুনি ওপারে চিৎকার

পাললিক

টেথিস সমুদ্রে তুমি ডুবে থেকেছিলে
অনুপম তুমিও তো পলির পাহাড়

বাতাস তোমার বুকে ডাকাতি করেছে
ছিঁড়ে রেখে গেছে সব জীবন কাহিনি

পাহাড়েরও সীমা থাকে উচ্চতাবিশেষ
কিছু পাখি উড়ে যায় পাহাড় পেরিয়ে

পর্বত হলে না কেন হতে পারলে না
হালকা হাতের চাপে গড়ে উঠেছিলে

টেবিলে কে রেখে গেছে দুধের গেলাস
খেয়ে নাও দিঘা যাও হাওয়া পালটাও

নিরো

অন্ধ লোক হেসে ওঠে তুষার পতনে
তুমি আরও দেওয়াল ঘেঁষে যাও

সরু গলি
পিঠে বোঝা
বৃদ্ধ ঘোড়া আসছে

শহরের যে-বাড়িতে আগুন লেগেছিল
তুমি আজও যাবে কি সেখানে

আধপোড়া পাণ্ডুলিপি
টিপে দেখবে কি

মনে কি পড়বে সেই ভুলে যাওয়া মুখ
মিশকালো বেহালার বাঁকে

জাহাজ ২

ভাঙা ১ জাহাজের অবয়ব থেকে সমুদ্রের ফেনা মুছে
নতুন জাহাজ আজ প্রকাশিত হল

ক্ষুধার্ত লোক কি বোঝে রেস্তোরাঁর ভিতরে বসা
অন্য ১ ক্ষুধার্তের জীবন কেমন

হাওয়া যত ছুটে যায় ধুলোভরা রাস্তা দিয়ে
অনেক দূরের কোনো কুটিরের দিকে
দুঃখ তত সোজা নয় বৃষ্টিতে ভাসিয়ে
পরিচ্ছন্ন বন্দরের অনুমতি পাবে

নতুন আষাঢ়ে মেঘ কোথায় গর্জন করে
কোথায় ভাসিয়ে দ্যায় নোঙরের ফুল

তার দেহ তার সে-শরীর আরও বহুকাল
তারই নিজের হাতে ব্যবহৃত হোক

Categories
2021-Utsob-Poem

অঞ্জলি দাশ

বোবা জল

মজা পুকুরের জলে ডুবে আছে অবুঝ বয়স,
চাঁদের ষোলোটি কলা কৌশলের জাল ফেলে
তীরে পাহারায়…
ঢিল ছুড়ছ,
আর বোবা পুকুরের বুক থেকে ব্যথার বুদ্‌বুদ উঠে
লুটিয়ে পড়ছে পায়ে।
ব্যথারা কি নীল?
নাকি স্পর্শভুক প্রেমের প্রান্ত ধরে বেড়ে ওঠা
জন্মান্ধের আলো?
ওইটুকু আলোর লোভেই অন্ধকারে বাঁধা পড়ে আছি।
বন্ধনের বিষ তুমি জানো,
জানো বন্ধনমুক্তির হাহাকার।
যে-সময় সমুদ্রে বাতাস ওঠে, বন্ধ পারাপার…
আমাদের দুঃখী পুকুরের বুক
জমানো কথার তোড়ে আছড়ে পড়ে ঘাটে।

বিবাহ বার্ষিকী

মুগ্ধ হাওয়া থেমেছে যেখানে, সেইখানে আমাদের মার্চ মাস। তার গায়ে টুকরো খিদে, আজও। বিমর্ষ ফুলের মতো ছোটো, তবুও বিশেষ।
যেন কোনো দীর্ঘ যাত্রা, ধীরগতি। সামনে কোথায় যেন সামান্যই আলো। জড়িয়ে আসা পথ, জুড়িয়ে আসা তাপ।
গতিবিলাসের মোহে স্বপ্ন ভুলেছে ঘুম। সে জানে না কোথায় কতটা রাত জাগা।
ট্রেনও বোঝেনি এখানে থামতে নেই। পথ নেই, তবু পলক নিবিয়ে দিয়ে উড়ে যেতে হয়।
কতদূর আর? কতটা পিছন দিকে মার্চ মাস আমাদের?
জলা পাহাড়ের পাশে চোরবাটো উঁকি মারে মাত্র একবার। সেইখানে শীত আর অন্ধকার পরস্পর আলিঙ্গনে।
ওই স্থিতি আমাদের নয়। আমাদের সূর্যোদয় অন্ধকারে সন্নিবিষ্ট। শুকনো পাতার গায়ে বাদামি রোদ্দুর লাগলে আমাদের ভাত ফোটে আজও।

বিষাদ প্রান্তর


সমস্ত মৃত্যুর স্বর একপাশে সরিয়ে রেখেছি।

আমার ভ্রমণ যত দূর, সেই অব্দি থেমে আছে পথ,
পাহাড় ততটা দূর অপেক্ষা করেছে।
তাহার ওপাশে কোনো দেশ নেই।
ধূ ধূ অবকাশে আছে হাওয়া… মানবিক গন্ধহীন,
নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কবিতারও মৃত্যু নিশ্চিত জেনে
ফিরে আসি।
সমস্ত ভ্রমণ শেষে বিন্দু বিন্দু আমি পড়ে থাকে পথে,
পাহাড়ের ভাঙা টুকরো তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখি,
জীবনের পাশে একটি কলম অপেক্ষায়।


খানিকটা অল্পবয়স রেখে আসি পথে,
ছাদহীন বৃষ্টি ও শিশির পান, ধীরে বাড়ে অবোধ ডালপালা,
বেড়ে ওঠে আর প্রতি রাতে শীত করে
ষোলো বছরের পর জ্বর আসে তার, আগুন শরীরে পথ পোড়ে।
এ-ঘর এখন রোদ্দুরবিহীন, ভুলে যাই ঘাসের বয়স।
ছাদের ছায়ায় বন্ধ চোখের পাতা ক্রমে ক্রমে অন্ধকার সহ্য করে,
স্মৃতিহীন, একা লাগে।


কিছু আগে কেউ যেন সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেছে
আকাশের দিকে, অনিচ্ছায়।
তার মনখারাপের ছায়া ভেঙে ভেঙে মেঘ খেলছে,
জানি বৃষ্টি হবে।
উঠোন পিছল হবে ফের, নীল হয়ে জেগে উঠবে ঘাসফুল
ওরা ব্যথা গিলে খায়।
আমাদের আনন্দ বিষাদ, প্রত্যেক পায়ের ছাপ,
লিখে রাখে জন্মকোষে।

বুঝি চুপ করে কান পেতে আছে দরজা জানালা
চিড় ধরা দেয়ালের তীক্ষ্ণ শিস, চিরে দিচ্ছে
গোপন অপেক্ষা
কার যেন খবর আসেনি কতদিন।

দীর্ঘ পথের হাহাকার,
চোখ থেকে মেঘ মুছে দেবে একদিন,
তার আগে ফিরিয়ে নেবেই কথা রাখবার দায়।


সব পথ মুছে গেলে পৌরাণিক শিকড়ের কাছে ফিরে আসি,
ভেঙে পড়া ঘর,
জং ধরা শিকলের গায়ে হাত বোলাতেই
নখের ডগায় সামান্য রক্ত জমে,
ওইখানে লেগে আছে প্রতিশোধপরায়ণ প্রেম।

তবু শেষমেষ উনুন জ্বলেছে রান্নাঘরে,
সাত সতেরোর ব্যথা দিয়ে ষোড়শ ব্যঞ্জন।
এ-ওষধি তোমাকে তো উপশম দেবে অগ্নি।
তার দিকে উড়ে যাবে মন পোড়ানোর ছাই
আসলে যে নিয়ম ভেঙেছে।


একা আছে কেউ—
বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে অন্য কেউ মৃদুস্বরে ডেকে বলছে,
ওই যে অন্ধকার, ফাল্গুনের ছেঁড়া চিঠি আগলে বসে আছ,
ও-সব তো অন্য কারো জানি
তোমার কেবল ওই বিষণ্ণতাটুকু, তাকে রোদ দাও, বৃষ্টিস্নান দাও।

এ-যাপন অন্য পাণ্ডুলিপি,
আরও বেশি বেশি সাজিয়ে তোলে সে-পুরোনো অক্ষর
ভাঙাচোরা, তবু ছবি তৈরি হয়।
তবু অন্ধকারের শরীর জড়িয়ে
কোনো আশ্চর্য গানের পঙ্‌ক্তি বেজে বেজে
শূন্যতার আবাহন করে, বাঁশিটিও শ্বাস নিয়ে বাঁচে।
বন্ধ জানালার গায়ে নিশিডাক লাগে।


বোঝা যায় এইমাত্র ভেজা গাল মুছে এল।
অশ্রু অথবা প্রেম
যে-কোনো দাগের পাশে প্রশ্নচিহ্ন থাকে।
ঘাসমাটি ভেবে তুমি কেন অবুঝের মতো
তার সামনে হাত পেতে থাকো?
সে কিন্তু নিরুত্তরে শাদা পাতা হাতে নিয়ে
কিছু অক্ষর ছড়িয়ে রাখে নির্বিকার।

ভিন্ন বর্ণ, রাগে বা বিরাগে
আমরা যে কাহিনি বানাই, বার বার দৃশ্যপট পালটে ফেলি,
তার যাপনচিত্রটি নিয়ে অকারণে কাটাকুটি খেলি।
খেলা শেষ হলে দেখি, অন্তঃসারশূন্য আমরাই।


বিষাদ ধুতে ধুতে অন্ধকার জমে ওঠে বহমানতায়
আতঙ্কিত জলের জীবন… ঝিম ধরা, বিবমিষা,
আমরা আশ্রয় করি যাকে, সেই রাত পাথরের মতো,
জোনাকি অথবা চাঁদ সকলেই তার গায়ে মাথা কুটে অন্ধ হয়ে যায়।
আমাদেরও চোখ বুজে আসে,
দৃষ্টি বিভ্রমে প্রিয় মুখ ভেবে চাঁদকেই হাতের পাতায়
নিয়ে দেখি সেও ভয়ে গুটিসুটি মুখ গুঁজে আছে
জোনাকির বিপন্ন ডানার নীচে।


নদী আর মন দুইয়ের সীমান্তে এক তটরেখা,
নৌকো বাঁধা আছে
অথচ কোথাও কোনো নদী নেই।
তীররেখা ঢেউয়ের স্পর্শ চেয়ে কেবলই নিজেকে ভাঙে,

আমি তাকে জলস্রোত দিতে চেয়ে
অশ্রুগ্রন্থি ছিঁড়ি, ভেসে যাই নিজে।


অন্য জন্মে বিশ্বাস রাখিনি
চোখের আড়ালে কিছু রেখাচিত্র রং চায়, তাকে নাম দিই, স্মৃতি।
ঝাপসা দেয়ালে বিরহের চিত্রপট, তারই খুদকুঁড়ো সুখ জড়াই শরীরে।

পথ আজও নানাভাবে প্রলোভিত করে,
পরিব্রাজকের ঝুলি ছিঁড়ে ফেলে মাটিতেই শরীর গেঁথেছি।

বিরহ বেদনা ছাড়া অন্য নেশা ছোঁয়নি কখনো,
শুধু অক্ষর আশ্রয়।
প্রাণহীন রেখা বন্ধনের সঙ্গে ওঠা বসা হেতু ব্রাত্য।
ঘুমের মূল্য দিয়ে সামান্য যে-বোবাশব্দ
জড়ো করি ভেজা বালিশের পাশে,
তারা হাওয়ার শরীরে মেশে,
আমি একা বিরহবেদনা নিয়ে মাথুর রচনা করি।

১০
পূর্ণ আকাশ নেই, শুধু কিছু ছেঁড়া মেঘ পাশে,
তারা জানে ছাদ নিয়ে ভাবিনি কখনো।
মাটি খুঁড়ে নদীকে এনেছি দরজায়,
শরীরে জড়িয়ে গেছে জলের শিকল।

তৃষ্ণা লিখি জল দিয়ে, সুখ আঁকি জলে… মুছে যায়।
মুছে তো যাবেই, পণ্ডশ্রমের শাস্তি এই।

যদি চাও অশ্রুর সমস্ত উৎস ফিরিয়ে দিতেই পারি আজ।
দেয়ালে ফাটল, কষ্ট লুকোনোর কোনো অবকাশ নেই,
তবুও সে অবেলার রোদটুকু আত্মসাৎ করে।

Categories
2021-Utsob-Poem

সরদার ফারুক

বুনো চাঁদ

ইতস্তত পড়ে আছে শামুকের ভাঙা খোল
সাদা কড়ি, তারামাছ, ত্রিকোণ পাথর
বালির কাগজ জুড়ে কাটাকুটি খেলা
শেষ হতে বেশি দেরি নেই

ঝাউপাতা নাচে শুধু হাওয়ার উচ্ছ্বাসে
নারকেলসারি বলে ওঠে—
ওকে বিয়ে দিয়ে দাও!

তাঁবুর জীবন ভুলে, যাযাবর, শহরের দিকে হাঁটে
বুনো চাঁদ পিছু নেবে, কখনো ভেবেছ?
বাঁশের সেতুর কাছে বেদেনির চুড়ির দোকান

জ্বর

বিড়ালবিদ্বেষী কেউ বলেছিল প্রাণীটির রোমের নীচেই থাকে
জ্বরের জীবাণু। বাড়িতে বিড়াল নেই, তবু মাঝেমধ্যে জ্বর হয়
রক্ত পরীক্ষার কথা ভাবি
এমন সংক্রমণ খুব কম আছে— ত্বক থেকে স্নায়ু
এতটা নিবিড় করে আর কেউ জড়ায় আমাকে?

প্রবল দংশনে সব প্রতিরোধ ছেঁড়ে। যদি আজ সবাই ভুলেছে
তবে সে থাকুক— অন্তহীন এই নির্বাসনে, গোপন প্রেমিকা

কুশপুত্তলিকা

যেন তুমি অনেকটা মদ পান করে শুয়ে আছ মাঠে
মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় লাজুক তারার হাসি
যেন তুমি দিনমান অনাথের মতো পথে ঘুরে
দোকানির বয়সি মুখের রেখা দেখে যাও

এখন নীরব থাকা ভালো। আইনের বইয়ে বাসা বাঁধে
বোলতার পরিবার
প্রহরীর জুতোর ডগায় ঘাস লেগে আছে, বন্দুকের নলে
সাদা প্রজাপতি বসার আগেই উড়ে যায়
নীল ওড়নার নীচে মহাদেশ, অচেনা ভূগোল
কখনো দেখেছ তুমি মেরুর বরফ, প্রেইরির তৃণভূমি?

তোমার গোপন কথা সকলেই জানে
চৌরাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে রেখেছে কুশপুত্তলিকা
শীতের আগুনে সহসাই ছাই হয়ে যাবে

হাত

ছবিতে তোমার কাঁধে কার যেন হাত!
খোঁপায় গাঁদার ফুল, হাসি হাসি মুখ
জুলাইয়ের অসহ্য গরমে
মানচিত্র ফুটে আছে বাহুর সন্ধিতে

ফোটোগ্রাফারের ভুলে
ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর মাথা কাটা পড়ে গেছে
শুধু বনমানুষের মতো তার
রোমশ থাবাটি দেখা যায়

মৃদঙ্গ

সুডৌল মৃদঙ্গ দেখে থমকে দাঁড়াই
কী করে বাজাই
কীভাবে তুলব আমি রাধাকৃষ্ণ বোল?
ভাবতেই সাতটি সাগরে উতরোল
আড়-ঠেকা, সম-ফাঁক, নিগূঢ় তেহাই
হিসাব মিলাই

আসলে তো সুর-তাল সব মনে মনে
বিষাদমথিত আর তোলপাড় ক্ষণে
উঠে আসে হাতের আঙুলে
এক জীবনের না পাওয়ার কথা ভুলে

Categories
2021-Utsob-Poem

যশোধরা রায়চৌধুরী

প্রেম আর মৃত্যুকে নিয়ে কিছু কথা

মৃত্যুর সঙ্গে প্রেমের একটা কীরকম যেন সম্পর্ক আছে।

মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার অনুভূতি,
অনুক্ষণ শ্বাসরোধ হয়ে আসা আলোর কথা, ভাবতে ভাবতে
তলিয়ে যাওয়া প্রেমের মধ্যে
এই তো চেয়েছিল আরিস্তোত্‌ল থেকে অলোকরঞ্জন
অথবা রাসেল থেকে রবিশংকর…
বলো চায়নি?

শিক্ষিত মানুষের আর যা যা চাওয়া থাকে
তার গভীরতা
শ্যাম্পুর পর মাথায় খুশকি আছে কিনা আঙুলে খুজলি করে
দেখে নেওয়ার মতো।

মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার ক্ষমতা
অশিক্ষিত মানুষের আছে
গাছ থেকে পিছলে পড়ে যাওয়ার সময়ে
রাতঘুমে বোবায় পাওয়ার সময়ে
হাঁচবার সময়ে।

হাঁচতে যে-সুখ
মুহূর্তের এক শতাংশের জন্য যে-মৃত্যু
হৃদযন্ত্রের বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে-মওকা
সর্ব অঙ্গের ক্রিয়াপ্রক্রিয়া থেমে যাওয়া সমেত

সেইসবের একশোগুণ বেদনা
প্রেমের ক্ষেত্রেও অর্জিত হলে
পৃথিবীর প্রতিটি প্রেমিক… চণ্ডীদাস থেকে জয়দেব
মিশেল ফুকো থেকে নীরদবরণ…
সবাই ধন্যি ধন্যি করত…।

বাকি যা কবিতা ও কথা ও দর্শন রচনা প্রেমকে নিয়ে, তা মিথ্যাচরণ।

তবে ৯৯% ক্ষেত্রে প্রেম থাকে না বলেই
এসব দরকার পড়ে আমাদের।


মৃত্যুর সঙ্গে প্রেমের একটা কীরকম সম্পর্ক আছে।
প্রেমের চূড়ান্ত অবস্থায় আমরা মরে যাওয়ার কথা বলি।
আমরা মরার মতো কষ্ট পাই, প্রেম চলে গেলেও, আবার।
তাহলে এই দু-রকম মরার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে।
তবে ভয়, যেটা প্রতিপদে আমাদের ভেতরে কাজ করছে,
নিজেকে সম্পূর্ণ হারানোর কষ্ট
আর সব হারিয়ে ফেলার দুঃখ আর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া,
আর শরতের মেঘের মতো উবে যেতে থাকার
বেদনা… সব মিলিয়ে,
আমার এখন মৃত্যুকেই বেশি বেশি প্রেমের মতো লাগছে।

কবিতার নাম শিল্প

আমি তো ভাষা পারি ভাষার আলো পারি আলোর চেয়ে পারি অন্ধকার
কিছু তো পাড়ি দেওয়া অথবা থেমে গিয়ে শ্রবণ সরু গান স্তব্ধতার

পাড়িতে আছে ভয় হয়তো পরাজয় হয়ত টানা গান ফুৎকারের
তবু তো চাক্ষুষ করেছি মন্দকে টেনেছি জিভখানি চিৎকারের

এখনও দম আছে এখনও ঘাম ঝরে তুমুল কষ্টেও হাসিই পায়
এখনও শ্রম করে অনুক্রম ধরে পেছনে চলে গেলে বাঁশি ফেরায়

ফের হে বালকেরা ফের হে বালিকারা হও হে কষ্টেই দৃষ্টিবান
যদি ভাষায় থাকো ভালোবাসায় থাকো নিজের শিল্পেতে দাও হে শান!

Categories
2021-Utsob-Poem

বিপ্লব চৌধুরী

টাকা মাটি মাটি টাকা

প্রেম একবারই এসেছিল। সরবে। রান্নাবাটি, কান্নাকাটি, ফাটাফাটি ঝগড়া আর তুমুল শরীরে। সন্দেহে ঝুঁকে পড়ে বার বার সে দেখত আমার মুখ। আমি তার ঘুমন্ত বুকে হাত রেখে জাগাতে চাইতাম। ভোরের আলো এসে পড়ত আমাদের কুঁচকানো বিছানায়। আমরা সিনেমায় যেতাম, নাটক দেখতাম, হেঁটে বেড়াতাম বইমেলার ভিড়ে। এইভাবে তিনটি শতাব্দী ধরে চলেছিল আমাদের দ্বিতীয় জীবন। তারপর কী যে হল। আমার প্রবাসী বন্ধু দীপেনের সাথে তার ভাব হয়ে গেল। আমার সঙ্গে আড়ি। আমি ভেঙে পড়লাম। গ্যালন গ্যালন মদ খেলাম আর ঘন ঘন গেলাম বেশ্যাপাড়ায়। প্রবাসে, দৈবের বশে যার সঙ্গে তোমার জমে উঠেছিল খেলা, একদিন ভেঙে গেল সেই খেলাঘর। তার অনেকদিন পরে টোকিয়ো নিবাসী দীপেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই উঁচু কলকাতায়, পার্ক স্ট্রিটের একটি অভিজাত বারে। তার মুখে, তোমার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হলাম। ‘হে ধরণী, দ্বিধা হও’ মনে হয়েছিল। সে নাকি তাকে বলেছিল যে, পীরিতি ভাঙনের খেসারত স্বরূপ আমি সেই ভদ্রমহিলার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়েছিলাম। শুনে প্রথমে বিদ্যুৎ চমকে উঠলেও তারপর হো-হো-হো হাসি পেয়েছিল। টাকা আমি জীবনে চাইনি, না তোমার কাছে, না আমার জীবনদেবতার নিকটে। আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। আমি চেয়েছি বাংলা মদ, বাঙালির প্রধান খাদ্য মাছ আর ভাত এবং বঙ্গভাষায় লিখিত কিছু উত্তম বইয়ের সম্ভার। টাকা আমি চাইনি কোনোদিন। আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম। সাপের মতন, সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছিলাম এই পৃথিবীর মাটি।

সূর্যকে বকতে যাচ্ছি

আমার এই হন হন করে হাঁটা দেখে বুঝছ না ব্রাদার, আমি চলেছি সূর্যকে প্রবল বকাবকি করতে, চলিত বাংলায় তিরস্কার বলা হয় যাকে, ঘনঘোর শীতকাল, ডিসেম্বর মাস, অথচ দশ দিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, জামাকাপড় বিছানাপত্তর বউদের গতর থেকে ভ্যাপসা ভাপসা গন্ধ ছাড়ছে, ক্রিসমাস উপলক্ষে যারা জলদাপাড়ায় বেড়াতে এসেছে, তারা কি ট্যুরিস্ট লজের ঘরে বসে সারাদিন আঙুল চুষবে, অথবা হুইস্কি আর পকোড়া পেঁদাবে, গন্ডারের খড়গের সঙ্গে সেলফি তোলার সৌভাগ্য কি হবে না তাদের, শিকেয় উঠবে নাকি পর্যটন শিল্প আমাদের, সমস্ত পৃথিবীতে যথাযথ আলোকসম্পাতের কাজ আমি একমাত্র ওকেই দিয়েছি, তবুও উত্তরবঙ্গের প্রতি সপ্তাহব্যাপী তার এই বঞ্চনার প্রকৃত কারণ কী, জানতে চাই আমি, সে কি বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা উগ্রপন্থীদের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তার উত্তরাপন যদি খুশি করতে পারে আমাকে, আজ না হোক অন্তত কাল থেকে সে আবার পূর্ববৎ রোদ্দুরের প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন আমি ওকে ক্ষমা করে দেব, জামার পকেটে দুটো পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলে আসব, চাঁদকে বলিস তোকে যে রামের বোতল আর দেশি মুরগির মাংস রেঁধে দেয়।

সৌর

আজ রবিবার। চলে গেল আরও একটা শীতকাল। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম একটা আরামদায়ক কম্বলকে জড়িয়ে ধরে। নীল রঙের নরম কম্বলটিও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। অন্তত সকাল ন-টা দশটার আগে যে কোনোদিনই ছাড়তে চায়নি আমাকে। আমাদের মধ্যে কোনো কথা কখনো হয়নি। তবে পাশের বাড়ির থেকে টিভির শব্দ ভেসে এসেছিল। আজকে যেমন শোনা গেল কোকিলের, সবজি আর মাছওলার ডাক। এই শীতে বরাবরের মতোই আমি পান করলাম ওল্ড মংক রাম এবং পড়লাম কিছু বাংলা বই। তার মধ্যে দু-একটি কবিতার। শীতকালে আমি কোনো কবিতা লিখি না। মেঘলা দিনে কারো কথা আর মনে পড়ে না আমার। শীতকালে আমি কুয়াশা হয়ে কোনোমতে পড়ে থাকি পৃথিবীর কোণে। নেওয়া হয় না তোমার খবর। একটা নীল কম্বলের সঙ্গে শুয়ে থাকি আমি। শীত খুব শীত করে, তাই মোজাও খুলি না। দুঃস্বপ্নে দেখি বিপজ্জনক সব পথ আর অনেক পতন। ঢকঢক করে বোতলের জল খেয়ে দমদম বিড়ি ধরাই আমি। বসে থাকি। কাশি। ভাবি, শীতকাল কবে যাবে, কেটে গিয়ে, প্রথমে বসন্ত-পলাশ আর তারপর মহামান্য গ্রীষ্ম আসবে। আমিও যে সৌরজগতের মধ্যে আছি, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবে।

Categories
2021-Utsob-Story

রিপন হালদার

আশ্চর্য ভ্রমণ

এই মাঠটা মনে হয় কিছু মানুষের অন্তহীন পায়াখানার স্থান। এর আগে যে-কয়বার ও এখানে এসেছিল প্রত্যেকবারই কিছু মানুষকে দেখেছে তাদের দীর্ঘ কালো প্রস্রাবদণ্ড মাটিতে ঠেকিয়ে পায়খানায় রত। প্রত্যেকের সামনে একটা করে ঘটি। আড়চোখে গুনে দেখা গেল আটজন। এবং প্রত্যেকের মাথা মাটির দিকে নোয়ানো। এই লাইনের পর কিছুটা জায়গা ফাঁকা। তারপর আবার একটা লাইন। এখানে যারা বসে আছে তারা আবার পরনের লুঙ্গি বা ধুতির মতো পোশাকটা উলটিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। যেন এর ফলে পৃথিবীর আর কেউ তাদের গোপন অঙ্গ দেখতে পারবে না! অন্য দিকে তাকানোর ভান করে গুনে দেখা গেল ছয়জন। আগে যতবার এখানে এসেছিল এদের এভাবেই দেখা গিয়েছিল। আজও অমল দেখতে পেল মানুষগুলোকে একই কাজে ব্যস্ত। প্রত্যেকের বসার ধরন একরকম। মাথার আকৃতি দেহের বিশেষ করে হাত পায়ের গঠন একইরকম দেখতে। সামান্য দূরত্ব রেখে লাইন দিয়ে কী অদ্ভুতভাবে মানুষগুলো উবু হয়ে বসে আছে। এবং প্রত্যেকেরই গায়ের রং কালো। কিন্তু কোনোবারই কাউকে উঠে যেতে দেখা যায়নি। মানুষগুলোকে চিরস্থায়ী ভাস্কর্যের মতো দেখতে লাগছে। মাটির রাস্তাটা পেরোতে পেরোতে অমল মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে ওইদিকে। ব্যাপারটা এমন যে মনে হয় সেই প্রথমবার দেখা মানুষগুলোই এখনও সেখানে বসে আছে। আগেও অমল গুনে দেখেছে আট যোগ ছয়জন বসা ছিল।

বটগাছটা কাছে এসে পড়ায় এতক্ষণে মনে বেশ খুশি জেগে উঠল। ঘন ছায়ায় এবার ও যতক্ষণ ইচ্ছা বসে থাকতে পারবে। প্রতি শনিবার স্কুল চার পিরিয়ডে ছুটি হয়ে গেলে অমল এখানে এসে বসে থাকে। এই মাঠে ওই পায়খানার লোকগুলো ছাড়া অমল আর কাউকে কখনো দেখেনি। লোকালয়ের পিছন দিকে অবস্থিত বলে অথবা আশেপাশে পাকা রাস্তা না থাকার জন্য হয়তো এখানে কারো পা পড়ে না। এই কারণে ওর জন্য এখানে অপার স্বাধীনতা। যতক্ষণ ইচ্ছা থাকা যায়। কেউ বারণ করার নেই। কোনো মানুষই আসে না এখানে, কে বারণ করবে! বটগাছের কোটরের মধ্যে এভাবে বসে থেকে রোদে ছেয়ে থাকা মাঠের তিন দিকের সীমাহীন শূন্যতা দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে-হাহাকার মেশানো আনন্দ আছে তা অমল এই বয়সে সবটা বুঝতে না পারলেও হয়তো কিছুটা বুঝতে পারে। না হলে ও এখানে আসে কেন!

আজকের আবহাওয়া অন্যান্য দিনের মতো নয়। হঠাৎ আসা মেঘলা ধূসর আবহাওয়াটা মাঠের রূপ দিয়েছে পালটিয়ে। অথচ একটু আগেই রোদ ওর চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছিল। ঠান্ডা এক আমেজ প্রবাহিত হাওয়াকণার মধ্যে প্রবেশ করে ওর দেহের ত্বকে এখন মুগ্ধতা জাগাচ্ছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর অমলের ইচ্ছা করল মাঠটাকে একটু ঘুরে দেখার। অন্য দিন ও শুধু এখানে এসে বসে থাকত। যেহেতু অন্যান্য দিনের মতো আজ রোদের তেজ অত জোরালো নয়, তাই ভাবল ঘোরাই যায়! সারা মাঠের উপরে ধূসর কালো মেঘের ছায়া জমছে ধীরে ধীরে। এক সপ্তাহ পর অমল আজ এতটা খোলা জায়াগা দেখতে পাচ্ছে। ওর বাবার ওখানে এতই ঘিঞ্জি বাড়িঘর যে আকাশ দেখা যায় না।

কোন দিকে আগে যাবে বুঝতে না পেরে চোখ বরাবর হাঁটতে শুরু করে দিল। এদিকটা এবড়োখেবড়ো মাটি। উঁচুনীচু ঢিলে ভরতি। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর এবার অমল দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। এভাবে হাঁটার কোনো মানে হয়! অসাবধানে পা পড়লে মচকে যেতে পারে। কিন্তু মেঘলা আকাশের নীচে উদার মাঠের উপর দিয়ে একা একা এভাবে হাঁটার মধ্যে আনন্দও পাচ্ছে ও। মনের একাকিত্ব বাইরের একাকিত্বের সঙ্গে মিশে গিয়ে একধরনের বেদনা-মিশ্রিত আনন্দ তৈরি করছে।

বিরতির পর আবার শুরু করল হাঁটা। এবার বাঁ-দিক ধরল। যেদিকেই হাঁটে মাঠের অবস্থা একই। দিগন্ত অনেক দূরে! আবছা একটা দাগের মতো আকাশ আর মাটিকে কেটে রেখেছে।

এবার ডান দিকে ফিরল। এখানেও একরকম প্রকৃতি। যেদিকেই যাওয়া যায় কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু যেদিক থেকে ও এসেছিল সেই দিকটা বাদে। সেদিকে গাছপালার অস্পষ্ট কালো ছায়া প্রাচীরের মতো আকাশের দিকে কিছুটা উঁচু হয়ে আছে। অমল হাঁটতে থাকল এবার দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। আনন্দ যেন ওর হাত-পা হয়ে ছুটছে। কোথায় যাচ্ছে তার যদি কোনো গন্তব্য না থাকে তবে যেদিক খুশি চলা যায় এবং চলাটাই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। সেভাবে ক্লান্তিও যখন কাউকে আক্রান্ত করেনি তখন তো আর পিছু হটার কারণ নেই।

এইসময় বাঁ-হাতে ধরে থাকা বইখাতাগুলো নিয়ে অমল একটু অসুবিধায় পড়ল। তাছাড়া হাতের ঘাম লেগে লেগে ওগুলোর ধরে থাকার দিকটা নরম হয়ে যাচ্ছে। অমলের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। জামার নীচের দিকের দুটো বোতাম খুলে কোমরের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে নিল বেল্টের মতো করে। তারপর বুকের দিক থেকে বইখাতাগুলো একটা একটা করে সেখানে দিল চালান করে। এবার পেটের সামনে ভারী কিছু থাকার থলথলে অনুভূতি নিয়ে শুরু করল হাঁটা। পদ্ধতিটা তেমন স্বস্তির না হলেও হাতে ধরে রাখার চেয়ে সুবিধাজনক মনে হল।

এই দিকে হাঁটতে গিয়ে অমল একটা বাড়তি সুবিধা পেল তা হল বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে মাঝারি গতির হাওয়া। ফলে দেহে আরামের সঞ্চার হচ্ছে। কতটা এসেছে কিছু বোঝা গেল না। দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে সোজাসুজি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মাঠের উপর ধূসর রঙের এবড়ো-খেবড়ো মাটির চাক ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে আসে বেশিক্ষণ তাকালে। তাও এই মুহূর্তে সামনে ক্ষীণ বৈচিত্র্যের আভাস দেখা যাচ্ছে মনে হল। কেমন যেন একটা অস্পষ্ট ধারণা হল অমলের, যে-জায়গাটায় ও এখন দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সোজাসুজি একটা উঁচু ঢিবির মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। যদিও খুবই আবছা দৃশ্যটা। ওর দৃষ্টিভ্রম কী! এই বৈচিত্র্যটুকুতে অবশ্য ওর মন সতেজ আর কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে উঠেছে। নতুন উদ্যমে আবার ধেয়ে চলল গন্তব্যের অভিমুখে। সমস্যা হল যতই ও এগোচ্ছে গন্তব্য আর আসে না। হতোদ্যম না হয়ে এগিয়ে যাওয়াই মনস্থির করল। অদ্ভুত তো! মনে হচ্ছে ওর এগোনোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গন্তব্যও দূরে সরে সরে যাচ্ছে। অমল এবার দাঁড়িয়ে পড়ল। ও কি ভুল পথে যাচ্ছে! কোনো ভুলভুলাইয়ায় আক্রান্ত হল! বেলা এখন কত! মনে হয় মধ্য দুপুর। স্কুলের টিফিনে খাওয়া পাউরুটির টুকরোটা হজম হয়ে গেছে আগেই। এই অবস্থায় আরও এগোনো কি ঠিক হবে! ফিরতে দেরি হলে নতুন মা নিশ্চয় রাগ করবে। সেদিন তো কড়াভাবে বারণ করে দিয়েছিল যে, স্কুলের ছুটির পর যেন অন্য কোথাও না গিয়ে সোজা বাড়ি চলে যায়।

এইসব এলেবেলে ভাবনাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে অমল এগিয়ে যাওয়াই সিদ্ধান্ত নিল। যেহেতু একটা গন্তব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে, এতদূর এসে ফেরা যায় না। তার উপর একধরনের অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ ওকে দখল করে ফেলেছে। দ্রুত পা চালাল। চেষ্টা করল দ্বিগুণ বেগে হাঁটতে। অনেকক্ষণ হাঁটল গন্তব্যকে সামনে রেখে। হাঁটতে হাঁটতে এইবার ক্লান্তি যখন ওকে প্রায় পেড়ে ফেলেছে, চোখের বায়বীয় ধোঁয়াশার পর্দাটা ঘিরে ফেলেছে ওর চারদিকটা। হাঁটা তবু থামাল না।

অবশেষে ঢিবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠল ওর চোখের পর্দায়। দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল কিছুক্ষণ। এবং শ্বাস-প্রশ্বাস যখন স্বাভাবিক পথে যাওয়া-আসা করছে হঠাৎ অনুভব করল পেটের ভারটা আর নেই। জামার গিঁট খোলা। এখন কী হবে! পিছনের দিকে মাথা ঘোরাল। পিছনে বিস্তৃত ধোঁয়া ধোঁয়া মাঠ। তারপর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফেলে আসা পথটাকে ফালা ফালা করে খুঁজতে থাকল বইগুলো। অবশেষে বুঝতে পারল একই জায়গাতেই ও ঘুরেফিরে চলে এসেছে। এবং শূন্য হাতে। ঢিবিটার দিকে আর এগোবে কিনা মনস্থির করতে পারছে না। ক্লান্তি আর হতাশায় বসে পড়ল মাঠের মধ্যে। কান্নার দমক ওঠা বুকটাকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কিন্তু অচেনা অজানার নিমন্ত্রণ কতক্ষণ সে উপেক্ষা করতে পারে, দেখাই যাক!

ততক্ষণে ওর পায়ের চঞ্চলতা মাঠে ঢলে পড়েছে। আবার শুরু করেছে হাঁটা। অবশ্যই সামনের দিকে। কিছুটা পথ এগিয়ে বোঝা গেল ঢিবি বলে এতক্ষণ যা ওর মনে হচ্ছিল আসলে তা বিরাট একটা টেবিলের মতো কিছু। মাটি বা পাথর দিয়ে তৈরি যে নয় তা অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। আরও এগোতে থাকল অমল আবিষ্কারের মোহে। গতি এবার আগের থেকে দ্রুত। প্রায় কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেল পদার্থটা স্বচ্ছমতো কিছু। ভালো করে তাকালে ভিতরের কিছুদূর পর্যন্ত যেন চোখ চলে যাবে। হয়তো চেষ্টা করলে ভিতরে কোনো মানুষও ঢুকে যেতে পারে। আজই ক্লাসে স্যার মালভূমি বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন। জায়গাটা একদম সেইরকমই দেখাচ্ছে। তবে এটা স্বচ্ছ পদার্থ দিয়ে তৈরি। বরফ, ধোঁয়া, জল বা মেঘের মতো কোনো কিছু দিয়ে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। ঠিক কী উপাদানে এটা তৈরি অমল বুঝে উঠতে পারছে না। ভয় মেশানো মুগ্ধভাব নিয়ে ও অনেকটা সময় ধরে ঐ দিকে তাকিয়ে আছে।

আর কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। আবার না গিয়েও পারা যাচ্ছে না। অন্য দিকে মনের মধ্যে বই হারানোর কষ্ট ওকে খুব বিব্রত করে রেখেছে। সত্যি বইগুলো কোথায় এমন উধাও হয়ে গেল! বইয়ের ভাবনা ভাবতে আর ওর ভালো লাগছে না। যা হবে দেখা যাবে। খুব ধীরে ধীরে ও এবার এগোচ্ছে এক পা দু-পা করে। ভয় ভয়ও করছে আবার বুকের মধ্যে। তবু সাহস আনার চেষ্টা করল। এভাবে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আর একটু। হাত বাড়ালেই দেয়াল বা পর্দাটা ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে এখন ও আছে।

অমলের চোখে এবার ভেসে উঠল চমৎকার একটা দৃশ্য। সেই স্বচ্ছতা ভেদ করে ফুটে উঠেছে একটা অবয়ব। সিনেমার পর্দায় ছবি ফুটে ওঠার মতো। ঠিক তাও না। কিছুটা আয়নার মতো। আবার অতি স্বচ্ছ আয়নাও না। আয়নায় জল লেগে থাকলে বা অল্প ধোঁয়াভরতি ঘরে দেয়ালজোড়া আয়না থাকলে যেমন দেখায় অনেকটা সেইরকম। অমল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ছবিটাকে। ছবির মধ্যে আবার মৃদু মৃদু ঢেউও খেলে যাচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো আরাম এখানে। কেউ যেন একটা বিরাট সমুদ্রকে চারকোনা করে কেটে বসিয়ে রেখেছে মাঠের মধ্যিখানে। ঠান্ডা একটা ভাব চারপাশটায় ছেয়ে আছে। যদিও কোনো শব্দ নেই এখানে। এতক্ষণ আসার সময় মাঠে যে-হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছিল তাও এখন বন্ধ। অমল তাকিয়েই আছে মুগ্ধতা নিয়ে। ওর অঙ্গভঙ্গি চেহারা অবিকল ফুটে উঠেছে সেই পর্দায়।

এভাবে কতক্ষণ ও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ও মনে করতে পারছে না। খুবই আরামদায়ক আবহাওয়া। অনন্তকাল এখানে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে অমলের। এখন ক-টা বাজে কাছে ঘড়ি না থাকার জন্য তা জানতেও পারছে না। বাড়ি ফেরার বাস কখন তাও ভুলে গেছে। স্বপ্নের কোনো দেশে হয়তো অমল চলে এসেছে। যেখানে বাস্তব জগতের কোনো স্মৃতিই আসে না।

ঠিক এইসময় অমল দেখল খুব ধীরে ধীরে একটা হাত বেরিয়ে এল সেই স্বচ্ছ আয়নার দেয়াল থেকে। অবিকল ওর হাতের মতো। রোগা শ্যামলা ধরনের। অবশ্যই হাতটা অমলেরই হওয়া উচিত। অমলও তাই ভাবছে। কিন্তু এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। সেই হাতে ধরা একগুচ্ছ বই। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে অমল বুঝতে পারল ওগুলো ওরই। রোবটের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অমল নিয়েও নিল হাত বাড়িয়ে। ভালোভাবে সেই অস্বচ্ছ আয়নার দিকে তাকিয়ে ও নিজের মুখের ছবি ছাড়া আর কিছুই যদিও দেখতে পেল না। কিন্তু যে-হাতটা বেরিয়ে এসে বইগুলো অমলকে দিল সেটা ওর নিজেরই হাত বলে এখন ও নিশ্চিত হতে পারছে না। আবার ওর এও মনে হল বইসমেত হাতটা যেন ওর পেটের নাড়িভুঁড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আবার ফিরে গেল সেখানেই। এমনভাবেই দৃশ্যটা সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছিল।

ফেরার পথটা আর সেরকম কষ্টদায়ক লাগল না অমলের। বাসে উঠে জায়গাও পেয়ে গেল জানলার কাছটাতে। কিন্তু বসতে ইচ্ছা করল না। শুধু মনের মধ্যে একটা জটিল ধাঁধা আরামদায়ক কষ্টের মতো বাসা করে থাকল।

Categories
2021-Utsob-Poem

বিজয় দে

লোকারণ্য একাদশ

লোক ও পোক

“কবিতার ঘরে এখন লোক বসে রয়েছে”। এবং
“আপনি তো কবিতার লোকই নন”…

এই দু-টি বাক্য থেকে বাংলা সাহিত্যের একখণ্ড ইতিহাস
অন্তত পাঁচ-ছ-পৃষ্ঠা তো লাগবেই
বুঝতেই পারছেন, খরচা আছে, কেন-না এটা অনেক
ঝামেলাজনক কাজ

আর এটাও বুঝে নিন, খরচের হিসেব কিন্তু
কাউকে দিতে পারব না

খাকি রঙের অসুখ

“আগে লোক হও তারপর শ্লোক”…।

— তাহলে তো স্যার, আমি কিন্তু কিছুই হচ্ছি না

আগে তুমি বুড়ো আঙুলের টিপছাপ হও
তারপর পাপ ও পুণ্যের কথা ভাবা যাবে

তুমি কোথায় থাকো জানি না, কিন্তু তুমি কি জানো
প্রতিদিন একটু একটু করে কিছু কিছু নতুন পৃথিবী তৈরি হচ্ছে

বরং তুমি পুরোনো পৃথিবীর কোনো ভাঙাচোরা ডাকঘর
হয়ে যাও

— হ্যাঁ স্যার, তবে আমার কিন্তু খাকি রং নেই
আমার শুধু খাকি রঙের অসুখ আছে

চরিত্র

গাছের বর্ণনার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে লোকে ভুল বোঝে
ভাবে, এই লোকটার চরিত্রের কোনো মা-বাপ নেই

যেমন সকলে লেখে, তেমনই একদা আমি একটি গাছ লিখেছিলাম
এবার কী হল, গাছ কেটে লিখলাম ‘একটি লোক’

গাছের বর্ণনার দিকে তাকাতে তাকাতে
কখন যে বৃক্ষের শোকদিবস লিখেছিলাম, জানি না

তারপর থেকে চরিত্র নিয়ে আরও টানাটানি

আমি কিন্তু এটাও জানি, গাছও কখনো কখনো গোপনে
লোকারণ্যের শোকবার্তা লেখে

বাজার

একটি লেখা ঠিকমতো শেষ করতে পারলে
বাজারের ভিড় থেকে অনেকেই হৈহৈ করতে করতে
আমার ঘরে চলে আসে

কিন্তু আমার ঘরে আর কতটুকুই-বা জায়গা
তাই তাদের সদলবলে এক রহস্যময় গলির ভেতরে নিয়ে যাই
তারপর সেখানে, আলো ও ছায়া নামে দুই রহস্যময়ীকে
সাক্ষী রেখে যা যা বলি, প্রকৃতপক্ষে সেটা একটা
আলাদা হাসির গল্প; সেটা পরে বলা যাবে

গলির ভেতরে ঢুকে গেলে
আমার অবশ্য নিজের লেখালিখি কিছুই মনে পড়ে না

বরং বাজারের কথা বেশি শুনতে শুনতে ঘরে ফিরে আসি

লোকরহস্য

লোক এবং রহস্য; দু-টি শব্দ পাশাপাশি বসতেই
পুস্তকের ভেতরে দাউদাউ
প্রচুর আগুন লেগে গেল

এই আগুনের কথা রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন লিখেছিলেন কি?

এ-যাবৎ লিখিত আমাদের সমস্ত পুস্তক আদতে প্রস্তাবমাত্র
যা-কিছু লেখা হয়, সবই পুস্তক-প্রকাশের পর’

দূরে পুস্তক থাকুক, দূরে মস্তক; লোকের ভেতরে লেলিহান আগুন

আর আগুন লাগলে লাগুক
রহস্য ঢেলে ঢেলে, আশা রাখি, সব আগুন নিভিয়ে দেব

হে পত্রলেখক

“কবিতার উত্তর দিকে ঘর আর দক্ষিণ দিকে কবিতার দুয়ার
এসব দেখতে দেখতে জীবন প্রায় ফুরিয়ে এল”

চিঠির শেষটুকু ছিল ঠিক এরকম; তারপর
জানা যায়, পত্রলেখকের হাত হইতে সাধের কলমটি
খসিয়া পড়িল

ভুল। ভুল। এটা প্রমাণিত, কলম কারোর হাত থেকে খসে পড়ে না

কলম তো এতটা গাড়ল নয়, আসলে সে কখনো কখনো
লেখকের চোখের আড়ালে চলে যায়

হে পত্রলেখক, তুমি দীর্ঘদিন কবিতার উত্তর-দক্ষিণ লিখে যাচ্ছ
কিন্তু কখনো কোনোদিন কবিতার ভেতরের
নিভৃত কবুতর লিখতে পারোনি

অসহ্যলোক

অসহ্যলোক নামে আমাদের জীবনে নিশ্চই একটা কিছু আছে
তা নইলে আমি আর জানব কী করে

শোনা যায়, অসহ্যলোকে সবাই যার যার নিজের কাছ থেকে
অন্তত সাত হাত দূরে থাকতে চায়

এদিকে গা বাঁচিয়ে চলতে চলতে সারা গাঁ যে উজাড় হয়ে যাচ্ছে
সেটি যেন কেউ টের পাচ্ছে না

এখনও কেউ জানে না, বিগত যুদ্ধের সময় কেউ কেউ
নিজস্ব তিরগুলি নিজের দিকেই ছুড়ে দিয়ে
কোথায় উধাও হয়ে গেল

আরও শোনা যায়, অসহ্যলোকে পাপ ও পুণ্যের
কোনো সীমারেখা নেই

অসহ্যলোক; চেতনার সব শেষে দাঁড়িয়ে
সবার আগে সে যেন এক নিম চৈতন্য…

ভুল হলেও, ভাবতে ভালো লাগে, আমাদের লেখালিখি এখান থেকেই শুরু…

ভাঙা গন্ধ ভাঙা দেশ

ছাল ছাড়াতে ছাড়াতে সম্পূর্ণ স্বাধীন
একপাতা ইতিহাস একপাতা ভূগোল
কখনো এরকম একেকটি দিন
এলে ভালো হয়

তবু লোক আর স্বাধীন হয় না, হচ্ছে না। ফলে
নিজস্ব পতাকাটি নিজের গোপনেই মানুষ হতে থাকে

পতাকা ওড়ানোর সামর্থ্য নেই, তাই শুধু পতাকার ওপরে দুর্বলতা
সাহস লেখে সাহস লেখে

ছাল ছাড়ানোর সময় যে ভাঙা ভাঙা গন্ধ নাকে ভেসে আসে
তখন গন্ধে গন্ধে নিজের ভাঙা দেশের কথা মনে হয়

লক্ষ্মীর পা

এ-দেশে যত মেঘ আছে, সব একসঙ্গে জড়ো করলে
তোমার একটি মাত্র ডানা; এই টুকুই

আরেকটি ডানার খোঁজে এ-দেশের সব প্রেম আর প্রেম
আকাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে
বড়ো প্রেম ছোটো প্রেম, মেঘে মেঘে যেন
যুদ্ধকালীন তৎপরতা

কিন্তু যত প্রেম আছে আকাশে
সব জড়ো করলেও তোমার পায়ের একটি পাতাও হবে না

তবু এ-দেশে কেউ কেউ লক্ষ্মীর পা-কে প্রেমপত্র লেখে

ভোরবেলা সকালবেলা

“নমস্কার। শুভ সন্ধ্যা”

সামান্য উচ্চারণ কিন্তু অসামান্য আলো
যেন পুরোনো দিনের সকাল হচ্ছে

সকাল মানে, যখন কোনো কিছু আর লুকোনো যায় না
তখনই সকাল। তখন প্রত্যেকটি মুখ যেন একেকটি শুভেচ্ছা

তুমি যদি মঞ্চ বা রোমাঞ্চ বলো, তাহলে সকাল
কিংবা তুমি যদি বলো, হে চঞ্চল পঞ্চায়েত
তাহলেও নিশ্চিত সকাল

শুধু এই, এইটুকু; এর জন্যে সমস্ত জপমালা
এবং অপমান পেরিয়ে আমি এখন
আমার দেশের সকল গোপন কথা…

আমি তো এতদিনে সব ভোরবেলা প্রস্তুত-প্রণালী
জেনে ফেলেছি। এখন ভোরবেলা ভোরবেলা
নাম ধরে ডাকলে মাঝরাত্তিরেও সকাল এসে হাজির হবে

কবিগর্জন কবিগুড়ি

কবিগর্জন নামে একটি স্টেশন।

কিংবা কবিগর্জন নামে একটি স্টেশনের ছবি
এ-দেশের বাতাসে উড়ছে। লাফ দিয়ে ছবিটা ধরতে চাইলেও
সেটি তখন এক অচেনা রঙিন ঘুড়ি… দাঁত বার করে হাসতে থাকে

সেখানে তোমার কি নাম লেখা আছে? লেখা থাকুক
সে তখন এক অলীক কবিগুড়ি স্টেশন হয়ে
তোমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছে

স্টেশনে একজন কবি আসন পেতে বসে আছেন; তাকে তুমি চেনো
তার কিন্তু কোথাও যাওয়া নেই শুধু আসা…
এদিকে স্টেশনের ভেতর থেকে অজস্র যাত্রীর ক্রমগুঞ্জন শোনা যায়
কিন্তু কাউকেই দ্যাখা যায় না

তো, আসন ছেড়ে সেই কবি যখন একবার উঠে দাঁড়ালেন,
তখন দ্যাখা গেল, কোনো ছবি নেই, ঘুড়িও নেই
একটি লেজঝোলা পাখি রেললাইন বরাবর উড়ে যাচ্ছে…

কবিগর্জন থেকে কবিগুড়ি… লিখে রাখো তুমি
এই হচ্ছে আমাদের অনন্ত ও একমাত্র ওড়াউড়ি

Categories
2021-Utsob-Poem

শ্যামলকান্তি দাশ

হরিণ

শহরের অলিগলি ভেঙে আমি যখন
প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছিলাম,
তখন কে আমাকে বলবে আমি একটা গাড়িচোর,
কে বলবে আমি সীমান্ত বাংলার ধর্ষক,
কে আমাকে বলবে মেদনিপুরের ভাড়াকরা গুন্ডা!
ছুটতে ছুটতে আমার রক্ত চলকে উঠছে,
জিভ বেরিয়ে আসছে,
তবু আমি তিরবেগে দৌড়চ্ছি।

একটা সময় আমি শহরের ভুলভুলাইয়া ছেড়ে
বেরিয়ে এলাম, বাইরে প্রচণ্ড শরৎকাল,
গাঢ় নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ,
আর বাইরে কী অসম্ভব জঙ্গল—
একদল হরিণ রাস্তা পেরোচ্ছে,
আমি হরিণের ভিড়ে মিশে গেলাম।
এবার আমাকে কে ধরবি ধর,
আমি এখন একটা চিত্রিত হরিণ ছাড়া আর কিছুই নই।
তিরবেগে দৌড়ে বেড়াচ্ছি।

নগ্নতার কাছে

ওগো নগ্নতা, ওগো নগ্নতা,
কেন তুমি আমার শাখাপ্রশাখায়
ওরকম ঘাসফুল ফোটালে
আমি দিশাহারা হয়ে গেলাম।

কত চখাচখি আমাকে দু-চোখ ভরে দেখে গেল
তৃপ্তির আনন্দে আমাকে নবদ্বীপে টেনে নিয়ে গেল
শান্তিপুরে টেনে নিয়ে গেল
তবু আমার কণ্ঠ ফুঁড়ে এক লাইন গান বেরোলো না

আমার সারা গায়ে কী অদ্ভুত, অবাক অবাক
আগুন জ্বলে উঠল, মুহূর্তে অঙ্গার হয়ে গেলাম
আমার শরীরে কী সব বজ্র লাফিয়ে উঠল একেকদিন
কী তাদের চকঝমক, কী তাদের রোশনাই

ওগো নগ্নতা, তুমি আমাকে কাঁদালে
অশ্রুর মতো
আমি কান্না ভালোবাসি বলে তুমি আমাকে কাঁদালে
কান্নার মতো
আমি একটা কালো হাঁসের গলা জড়িয়ে
সারারাত একা বসে রইলাম

গা ধুয়ে নেওয়ার মতো আমি কোনো সরোবর কিংবা
পদ্মপুকুর খুঁজে পেলাম না।

টিকটিকি

ভোরবেলা দেখলাম অতি ক্ষুদ্র একখানি
লেজ গজিয়েছে।
চুলবুল করছে পা— পেয়ে গেছি নখের সাক্ষাৎ।
আমার সাধনা শেষ।
হে মানুষ, দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখো—
জনারণ্যে আমি এক সংগোপন
টিকটিকি হলাম।

চুম্বন

ঠোঁট আঠালো হয়ে উঠেছে,
চুম্বনের সময় হয়ে এল।
কে কাকে আগে চুম্বন করবে
সেই নিয়ে চলছে দড়ি-টানাটানি।
এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে
ঘন হয়ে উঠছে ঝিঁঝির শব্দ,
মদির হয়ে উঠছে কদম ফুলের সুবাস।
আমাদের দ্বন্দ্ব তারিয়ে তারিয়ে
উপভোগ করে গেল একটা রাতচরা শেয়াল।

বর্ষার অপরিমাণ দু-জনে দু-জনকে
চুম্বন করতে ভুলে গেলাম।

পলাতক

গুপ্তচরবিদ্যায় হাত পাকিয়ে
সেই যে আমি ইন্ডিয়া থেকে
ইউএসএ পালিয়ে এলাম,
আর ফিরিনি।

বত্রিশ বছর ধরে এমন একটা
দুর্ভেদ্য দুর্গে লুকিয়ে আছি,
যেখানে একটা মশা মাছিও
গলতে পারে না।

ইতিমধ্যে নাম ভাঁড়িয়ে
কয়েকটা রিফিউজি ক্যাম্পে ঘুরে এসেছি।
দেদার ডলার পাউন্ড বিলিয়েছি।
একটু মানবতা না দেখালে
ইতিহাসে মহান হব কী করে!

শতাব্দী প্রাচীন একটা উড়োজাহাজ
হন্যে হয়ে চব্বিশ ঘণ্টা
আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

Categories
2021-Utsob-Story

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

মাদল

ছোটো ছোটো টিলা। শালের জঙ্গল। মাঝে মাঝে ফাঁকা মাঠ। জায়গাটা ভালো লেগে গেল গৌতমের। মুখে অবশ্য ও প্রকাশ করল না।

‘একেবারে অজ জঙ্গুলে অঞ্চল। হু! গাড়ি খারাপ হওয়ারও আর জায়গা পেল না।’

বিরক্তি প্রকাশ করলেন পাল সাহেব, ওর চামচিকে-বস্।

অন্য সময় হলে ও পাল সাহেবের কথায় সঙ্গে সঙ্গেই সায় দিত। ও তাই করে থাকে, একটু আগেও গাড়িতে তাই করেছে। কিন্তু এখন কেন যেন, এতদিনের অভ্যাসটাকে ও হঠাৎ কাটিয়ে উঠল। মনে মনে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইল একটা ঝাঁকড়া মতো গাছের দিকে। মউল গাছ। পাকা মউলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। আঃ! জোরে জোরে ফুসফুসভরতি করে হাওয়া টেনে নিল সে। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন পাল সাহেব। পরক্ষণেই হাতের ঘড়িটা দেখলেন। ‘দেরি হয়ে যাবে’— ব্যস্তভাবে পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— ‘দত্ত সাহেবের চিঠিটা সঙ্গে আছে তো?’

‘হ্যাঁ’— অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবাব দিল ও। বোধহয় এই প্রথম ও হ্যাঁ শব্দটার পরে ‘সাহেব’ কথাটা যোগ করল না। এরা সবসময় পরস্পর পরস্পরকে সাহেব বলে সম্বোধন করে কেন কে জানে? পরস্পরকে সম্মান দেখানোর জন্য? কই, সম্মান দেখানোর জন্য তো রবি ঠাকুরকে কেউ রবি সাহেব বলে না! চোখ ফেরাতেই দেখে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে…

পরক্ষণেই, ও দেখল, ঝরনার মতো কল কল করতে করতে বাঁ-দিকের শালের জঙ্গলটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে তিনটি সাঁওতাল ছেলেমেয়ে। দু-টি মেয়ে একটি ছেলে। যুবকটির গলায় একটা মাদল ঝুলছে। এলোপাথাড়ি তাল দিচ্ছে মাঝে মাঝে। ওর সঙ্গী মেয়েটির হাতে মস্ত বড়ো কাঁসার একটা খঞ্জনীর মতো ঝাঁই। বাজাচ্ছে ঝম ঝম করে। আর সব চাইতে ছোটো মেয়েটি— প্রায় তরুণীই বলা যায়— তার হাতে কিছু নেই। পায়ে মল ঝুম ঝুম করে বাজিয়ে কাছে এসেই হাসি হাসি মুখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল গৌতমের দিকে। মানুষটাকে ওর ভালো লেগেছে— এই সহজ কথাটা লুকোনোর কোনো চেষ্টাই নেই। হঠাৎ মেয়েটার খিল খিল হাসিতে গৌতমের চমক ভাঙল।

‘এ্যাই!’ পাল সাহের কর্কশ গলায় বললেন, ‘শহর এখান থেকে কত দূর?

যুবকটি সামনের দিকে আঙুল তুলে জবাব দিল, ‘হুঈ… দশ ক্রোশ হবেক।’

‘আর তোমাদের গ্রাম?’— দ্বিতীয় প্রশ্নটা গৌতমের। মেয়েটির উদ্দেশে।

‘উই তো বটে’ আবার খিল খিল করে হেসে মেয়েটি আঙুল দেখাল সামনের শালকুঞ্জের দিকে। কিন্তু কোনো গ্রাম নজরে পড়ল না গৌতমের।

‘আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?’, গৌতম জিজ্ঞাসা করে। অমনি খিল খিল করে হাসির ঝরনা গড়িয়ে গেল।

‘চল কেনে? যাবি?’— হেসে জবাব দিল ছেলেটি। তার কথায় স্পষ্ট আমন্ত্রণের সুর।

ঘর র র…

গাড়িটা স্টার্ট নিয়েছে আবার।
‘ঠিক হয়ে গেছে সাব’— ইঞ্জিনের ঢাকনাটা বন্ধ করে হাতের তেল কালি মুছতে মুছতে জানাল ড্রাইভার তেওয়ারি।

‘হয়ে গেছে! যাক।’— হাঁফ ছেড়ে পাল সাহেব বললেন, ‘নাও, চল চল গৌতম। উঠে পড়। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল গৌতম। দরজটা খুলে ওর কীটস ব্যাগটা নামিয়ে আনল। তারপর হেসে বলল, ‘না স্যার খুব একটা দেরি এখনও হয়নি। ভাগ্যকে ধন্যবাদ।’

‘এ কী, তুমি কোথায় চললে?’— পাল সাহেব এবার বুঝি রাগে ফেটে পড়বেন।

‘চললাম জীবনের খোঁজে’— ‘ননসেন্স! একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি, এ সময়ে…’

‘আমি তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি’— ওঁকে পাত্তা না দিয়ে বলে ওঠে গৌতম। ততক্ষণে রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমেছে সে।

‘তুমি কি পাগল হলে গৌতম!’— রমেশ পাল হাতাশ কণ্ঠে বললেন— ‘এর জন্যে তোমার চাকরি যাবে, তা জানো?’

‘জানি’— গৌতম হাসি হাসি মুখে ঘুরে দাঁড়াল। ‘চাকরিতে আমার আর প্রয়োজন নেই। ছেড়ে দিলাম।’

‘ছেড়ে দিলে!’— পাল সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন। ‘কিন্তু তোমার চাকরি ছাড়া…’

‘প্রয়োজন নেই। বাকি জীবনটা এদের সঙ্গেই কাটিয়ে দেব’—

পা বাড়ালো সে। জ্যোৎস্নার মাঠ পেরিয়ে মউলের ছায়া থেকে সাঁওতালী গাঁয়ের দিকে এগিয়ে গেল গৌতম। যেদিকে জীবন, যেদিকে মুক্তি…

পরদিন একটু বেলায় যখন ঘুম ভাঙল ওর, মাথার মধ্যে তখনও ভারী হয়ে আছে কাল রাতের মহুয়ার নেশার রেশটুকু।

স্নিগ্ধ নিঃশব্দ সকাল। আশে পাশে কেউ নেই। মেয়েটাকেও দেখতে পেলনা সে। বোধ হয় দল বেঁধে কাজে গেছে।

বুকের নীচে ছোট্ট একটা মোচড় অনুভব করল সে, কিন্তু সেটা সুখের না বেদনার তা ঠিক বুঝতে পারল না। মাটির ঘর। তকতকে নিকোনো মেঝে। একটা শেতলপাটির ওপর শুয়ে আছে ও। মাথার কাছে ছোট্ট জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। জানলার একপাশে জলের সরাই একটা—

ঘরে আর কিছু নেই।

যেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যেন আরও কিছু থাকলে ভাল হত। আরও কিছু প্রয়োজন ছিল ওর। মাথার নীচে কীটস ব্যাগটার ওপর সস্নেহে হাত বোলালো সে। তারপর হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে কবজির ঘড়িটা দেখল। বেলা আটটা দশ। পথ দশ ক্রোশ…

হাইওয়ে থেকে বাস ধরতে পারলে—

‘এখনো সময় আছে’— বিড় বিড় করে কথাগুলো উচ্চারণ করল সে।

তারপর উঠে দাঁড়াল তার কীটস ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে।

বার্নিশ করা একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘামছিল গৌতম। ধিতাং ধিতাং ধিনতা ধিতাং— ক্রমশই তার বুকের মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে কাল রাতের মাদলের শব্দটা। কাঁপা হাতে হাতলটা ঘুরিয়ে মাথাটা আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল সে। ধরা গলায় প্রশ্ন করল, ‘আসব স্যার?…’

Categories
2021-Utsob-Poem

অমিতাভ মৈত্র

সহ্যের সীমা

নৈতিকভাবেই একজন দাঁড় মাঝিকে টানতে টানতে
অনেক ভেতর পর্যন্ত নিয়ে যায়
আর সে চায় না এ-জন্য তাকে বিখ্যাত করে দেওয়া হোক

কিন্তু খাঁচার পাশে পেট্রোলভরতি টিন আনতে দেখে
যখন কান্না পায় সন্ধ্যেবেলার পাখিদের
ঈশ্বর জর্জরিত দাঁড় নিশপিশ করে ওঠে
তার বয়ান বদলানোর জন্য

কূটনীতি

বিকেল পর্যন্ত চুপচাপ শুয়ে থাকার পর,
একটা সাদা টিকটিকি কূটনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছে মরুভূমির কাছে
যেখানে, সে বিশ্বাস করে, কোনো রাস্তার দরকার হয় না
আর ঘুরে বেড়ানো যায় অবাধে।

ভর্ৎসনা

একশো শব্দের সংক্রমণ
যার মাঝখানে দুটো কুকুরের নীরবতা নেই।

সাদা ভর্ৎসনা করছে সাদাকে
আত্মহননের জায়গা খুঁজে না পাওয়ার জন্য।

দু-জন অন্ধ হাড় বেরোনো মৃতদেহ মুখোমুখি বসে
চোখ বুজে চা খাওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছে।

এবং ভর্ৎসনা করছে দু-জনকে
নেলকাটার ছাড়াই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার জন্য।

শক্তি

তার চারপাশে এমন অনেক কিছুই বিলিয়ার্ড বল দেখে
যা সে নিজে তৈরি করেনি
তবু তাদের শক্তিতেই সে গড়িয়ে চলে, থামে
বেদনা অনুভব করে

সেই তারাও আবার নিজের শক্তির কাছে
এক সূক্ষ্ম যন্ত্রব্যবস্থায় অসহায়ভাবে বাঁধা—
বিলিয়ার্ড বল গড়িয়ে দেওয়া বা থামানোর
বিন্দুমাত্র শক্তি তাদের নেই।

চাবি

বাবা মা বেরিয়ে যাবার পরে
ঘরের আনুপাতিক শূন্যতাকে
প্রতিদিনের মতো ধন্যবাদ জানায় শিশুটি
সে এখন এক পা দু-পা করে হাঁটতে শিখেছে

এবার পিঁপড়ে ডাকতে আসবে তাকে
একটি অন্ধ মেয়ের আঙুলের নখ
কাঠবাদাম গাছের পাতায় ঢেকে রাখার জন্য