Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

শাকিলা আজিজ্জাদা

ভাষান্তর: পৌষালী চক্রবর্তী

দূর থেকে দেখি

আবার আমি একা পড়ে গেছি
পেছনে কেউই দাঁড়িয়ে নেই
পায়ের তলার থেকে মাটি টেনে নিয়েছে
এমনকী সূর্যের কাঁধও আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে

আমার নাভিরজ্জু বাঁধা ছিল
চলে আসা রীতিনীতির আলখাল্লার গিঁটে
আমার কেশগুচ্ছ প্রথমেই কাটা পড়েছিল
লিপির অনুশাসনের বেসিনের উপর
আমার কানের কাছে প্রার্থনার মতো কেউ ফিসফিস করে
‘তোমার পিছনের ও পদতলের মাটি সারাজীবনের মতো নিঃস্ব হয়ে যাক’

সে যাক গে, একটুখানি উপরেই
একখণ্ড ভূমি থেকে যাবে
যে-পবিত্রতর অন্য কোনো ভূমির থেকে
শয়তান যা যাচ্ঞা করতে পারে আমার থেকে

সূর্য আমার কাঁধে হাত রাখলে
আমি বিচ্ছিন্ন করেছি আমার পদযুগল, সহস্র এক বার,
যা কিছু পিছনে ফেলে এসেছি, সেইসব কিছু, থেকে।

নির্জনতা

তোমার হাতের সব রেখার মধ্যে
তারা লিখে রেখেছে সূর্যের ভাগ্য

ওঠো,
তোমার হাতদুটো তোলো—

দীর্ঘ রাত্রি আমার দম বন্ধ করে দেয়

কাবুল
জুন, ১৯৯৪

আমার কণ্ঠস্বর

এক দূরের দেশ থেকে আমি এসেছিলাম
পিঠে এক ভিনদেশি ন্যাপস্যাক নিয়ে
ঠোঁটে নিয়ে নীরবতার গান

যখন আমি আমার জীবনের নদী বেয়ে ভ্রমণ করেছি
আমি দেখেছিলাম আমার কণ্ঠস্বর
(জোনার মতো)
গিলে নিয়েছিল একটি তিমি
মাছ

আর সেই থেকে আমার জীবনটা বেঁচে ছিল আমার স্বরে

কাবুল
ডিসেম্বর, ১৯৮৯

ইয়ালদা

আমার যন্ত্রণা হয়েছিল
যখন একবাটি মাখা ময়দার তালের মধ্যে
তোমার বাহুযুগল মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম

আর দেখছিলাম তুমি
একফালি লম্বা কাপড় ব্যবহার করছ
পাকা আঙুরের মতো তোমার স্তন বেঁধে নিতে

তোমাকে দেখেছি শিশুকে পরিত্যাগ করতে,
তোমার মুখের কোণ ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে
আমি যন্ত্রণা পেয়েছি।

তোমার ছায়ার দিকে ছুড়ে মারা একটি পাথরও
ঠোঁটে রক্ত বার করে আনার জন্য যথেষ্ট
যে পাথর ছুড়েছিল তার মুখে,
অবশিষ্ট লালা দিয়ে, আমি থুতু ছিটিয়েছি।

কথারা শুকিয়ে গেছে তোমার মুখের মধ্যে
ধীরে ধীরে বয়ে যেতে গিয়ে, বছর
হয়ে গেছে ধুলো আর ধোঁয়া

যাওয়ার সময় তারা পা টেনে টেনে হাঁটছিল
কিন্তু তোমার বাপের বাড়ির রাতগুলিকে
ঝুলন্তই ছেড়ে গিয়েছিল।

এপিটাফ

কার নিভে আসা শ্বাস
ঘুমোচ্ছে
তোমার ওই হ্যাজেল গাছের মতো চোখে?

কীরকমভাবে ছোট্ট শিশুর চাউনি
তোমার ট্রিগারের সামনে শূন্য হয়ে যায়?

কীভাবে তোমার হৃৎস্পন্দন চলে
যখন তরুণী মেয়ের হৃদয় তোমার তালুতে ধরা
আর পা-দুটো রক্তাক্ত?

পাহাড়ের মানুষ!
কোন পরিণতিতে তোমার পদতলের
খাড়াই পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে?

ধুলোয় ধূসর তোমার কোঁকড়ানো চুলের জন্য,
স্তনবৃন্ত পুড়ে গেলে
কীরকম লাগবে মেয়েদের,
কী ভাববে মা তার ছেলেকে?

বলো,
কার দু-চোখের গভীরে
তোমার নিভন্ত শ্বাস শান্তি খুঁজে পাবে?

ঈশ্বরের নিদর্শনসমূহ

একটি জানালার হৃদয়ে তুমি ফ্রেমের মতো বাঁধা পড়ে আছ

তার কাঁধের উষ্ণতা
তোমার আঙুলডগে জমাট বাঁধে

স্ট্রিটলাইটের নীচে
বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায় তার পদচিহ্নগুলি

তোমার নোটবই বন্ধ
কিন্তু তার চিন্তারাশি পিছলে গিয়ে
পুনরায় যোগ দেয় বিলীয়মান রাতের সঙ্গে।

আর সেখানেই, একটি রাতচরা বিড়ালের ছায়া, হারিয়ে যায়।

প্রথম শ্লোকের মতো কার্যকরী
হাফেজকে তুমি
রেখে দাও পিছনের জানালায়।

তোমার হাতকে দৌড় করাও
রেশমি রুমালের ওপর দিয়ে
কোণায় কোণায় গিঁট বেঁধে
মুড়ে নেওয়া হয় বইরূপ আদি জননীকে

একটি রুপোলি শালের নীচে
তোমার কাঁধ, পাঠ্যের নীরব
ছন্দ হেন, কেঁপে যায়।

প্রাচীন শ্লোকের যত মোড়কের নীচে
পচে ওঠে ঈশ্বরের চিহ্নগুলো।

কনের ঘোমটাটি

আমার বিয়ের সাজ আমি টাঙিয়ে রেখেছি
সাদা রঙের স্মৃতির এক হুকে
তার কাঁধের ওপর আমার রেশমতুল্য দৃষ্টিপাত

তার বুকের থেকে আমি ছিঁড়ে নিয়েছি আমার হৃদয়
সেখানে এখনও দুধের গন্ধ

সে হয়তো জেগে যেত
আমার গ্রীবায় তার স্পন্দমান আঙুলেরা
তার বাহুজুড়ে সেই পুরাতন লাস্যের কলকল।

আমার হৃদয় আমি উপড়ে এনেছি
কিন্তু আমার দু-চোখে শুধু সে
তার চওড়া ও উজ্জ্বল পশ্চাদ্দেশ
বরের শালে জড়ানো

আমি নিজেকে আর মনে করাতে চাই না
পরবর্তী শ্বাসেই
সে উড়িয়ে দেবে ঘোমটার আবরণ

আমি আর গুনব না
তার শ্বাসগুলি

ভূমা

পৃথিবী তার উষ্ণ বাহুদু-টি বাড়িয়ে দেয়
আমাকে জড়িয়ে নিতে
পৃথিবী আমার মা
তিনি আমার এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর
দুঃখ বোঝেন।

আমার এই বিচরণ
এক বুড়ো কাকের মতো
যে জয় করেছে
কম্পমান পপলার গাছের সুউচ্চ শাখা
একদিনে একহাজার বার

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে প্রতিদিন ঊষাকালে
নিজের কালো চঞ্চু ডুবিয়ে নেয়
সূর্যের পবিত্র কুয়োয়

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে উড়া দেয় শয়তানের ডানা নিয়ে

অথবা জীবন নিজেই এক শয়তান
ধূর্ত লোককে জাগায় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে

জীবন যেন-বা বিষাদগ্রস্ত পৃথিবীর মতো
যে তার রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে

আর তাই আমি ধন্যবাদ দিই
‘বিজয়’-এর প্রান্তসীমায়।

পেশোয়ার শহর
জুলাই, ২০০২

একটি পালক

সেপিদেহ্-র জন্য

যেভাবে আমার স্বপ্ন
তোমার পদক্ষেপের শব্দ শোনে
যখন তুমি প্রবেশ করো
ধীরে, ধীরে, আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে

পাতের তলায় তুমি হামাগুড়ি দাও
বিড়ালছানার মতো, তোমার দু-চোখ
আমাকে পান করে।

ঘুমন্ত বা জাগ্রত
আমার স্বপ্নের রেশম তুমি ভাঁজ করো।

যে-মুহূর্তে
তোমার হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরে
তুমি দ্রুত বালিশের ওপর ঘুমিয়ে পড়ো।

আর আমি, আধো ঘুমে, আধো জেগে থাকি
যে-মুহূর্তে স্বপ্ন নিঃশেষিত হয়
তুমি আমাকে ভরে তোলো, পুনরায়।

অপেক্ষায় থাকা বিড়ালটি

এই শব্দগুচ্ছ
তারা ভালোভাবে নেয়নি

দয়া করে বোলো না যে, স্বর্গের দরজা
আমার ওষ্ঠাধরের মাঝে খোলে।

আমার দুই বুকের মাঝের ফাটলে
ঈশ্বর স্বয়ং হালকা চালে হেঁটে যান

আমি আসব

এবং আবার
তোমার শ্বাস আমার মধ্যে শ্বাস নেবে
তোমার ফুসফুস ভরে উঠবে
আমার সুগন্ধে
তোমার জিভের থেকে
বৃষ্টি, বৃষ্টি, শুধু বৃষ্টি
আবার ঝরবে আমার গায়ে

আমি দিয়ে দেব

এবং এই সময়ে
যখন তুমি আসো, চকচকে চোখে
আর ঝুঁকে পড়ো, আমাকে দু-ফালা করে দিতে

সংশয়ের ছায়ামাত্র থাকবে না তোমার

সেই কালো বিড়ালের মতো, যে
লুকিয়ে থেকে লাফ দেয়
আর আমার পথ বরাবর চলে যায়
তোমার দুয়ারে এসে চড়াই শিকার করে
যতক্ষণ না সে
নিজেকে হতভম্ব আর ফাঁদে পড়া ভাবছে

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

কৌশিক মিত্র

ডাউনস্ট্রিম

ফরতাবাদের সুরমা অ্যাপার্টমেন্টের ১২ নং ফ্ল্যাটটা একটি আপাত কলহ অথবা কথা-কাটাকাটির পর স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক চিলতে বারান্দা থেকে সিগারেটের ধোঁয়া চারিয়ে যাচ্ছে সামনের রাস্তায়, রাস্তাটা নাকবরাবর গিয়ে মিশে যাবে গড়িয়া স্টেশন রোডে। বাঁ-দিকে এগিয়ে একটু গেলেই হরিমতী গার্লস। ধোঁয়াটা ততদূর যাবে না, যাওয়া সম্ভব নয় বলেই। কিন্তু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকল হরিমতী গার্লস স্কুল। সোনারপুর ব্লকের খাদ্য দপ্তরের পরিদর্শক অনিন্দ্য এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি মেয়ে সোনাইকে কোথায় ভর্তি করবে, কাছাকাছি হরিমতীর প্রাইমারি সেকশনে না কি আইসিএসই-র কোনো স্কুলে! চার বছর হয়ে গেল সোনাইয়ের। শিখার আপত্তি বোর্ড বা মিডিয়াম নিয়ে ততখানি নয়, যতটা অনিন্দ্যর গড়িমসি নিয়ে। অনিন্দ্য এই জায়গাটায় এসে বড়ো কনফিউজ্ড‌।ইংরেজি না বাংলা, আইসিএসই-তে না পড়লে কতখানি ক্ষতি হতে পারে সোনাইয়ের, সবাই কি হাসাহাসি করবে সোনাই বাংলা মিডিয়ামে পড়ছে বলে। মন বিদ্রোহ করে ওঠে মাঝে মাঝে! যদি পড়াতে নিজেকেই হয়, তাহলেও বছরে কম-সে-কম চল্লিশ থেকে ষাট হাজার টাকা স্কুলে দিতে হবে। কেন??? কেরোসিনের ডিলার হরি পালের মুখটা মনে পড়ে যায়, কী খুশিতেই না এসে মিষ্টি খাইয়েছিল নাতনিকে নামজাদা এক আইসিএসই বোর্ডের স্কুলে ঢুকিয়ে। এই সোশাল প্রেসার অনিন্দ্যকে গুটিয়ে রাখে। পাটুলির এক বিখ্যাত স্কুল থেকে ফর্মটা তুলে ফিল-আপ করে জমা দেবে কি দেবে না এটাই সে ভেবে যেতে থাকে। শিখার আপত্তি সংগত, এরপর দেরি করলে তো হরিমতীর শিশু শ্রেণিতে ঢোকাও মুশকিল হয়ে যাবে, ক্লাস ওয়ানে তো আবার লটারি।

অফিস থেকে অটোয় ফেরে অনিন্দ্য। অভ্যাসবশত, স্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে যায় বরদাপ্রসাদ হাই স্কুলের উলটো দিকের ইউনিক বুক স্টোর্স-এ। দোকানের মালিক নির্মলবাবুর ফেয়ার প্রাইস শপ আছে। দুই ছেলে এই দোকানটা দেখে, আবার ব্লকে খাতাপত্র সইয়ের জন্যও তারা প্রায়ই অনিন্দ্যর কাছে যায়। স্বভাবতই ছেলেদুটোর সঙ্গে অনিন্দ্যর সখ্যতা জমে যায়, নকাই তো অনিন্দ্যরই বয়সি ফিজিক্সে অনার্স, প্রচুর টিউশনও পড়ায়, মকাই একটু ছোটো। বেশিরভাগ সময়ে ইউনিকে মকাই-ই থাকে। খুব বেশিদিন অনিন্দ্য সোনারপুরে পোস্টিং পায়নি, সুতরাং আবাসনের বাইরে তার পরিচিতি কম, খুব একটা মিশুকে না হওয়ার কারণে সে এ-জায়গায় পিছিয়ে পড়ে, আবার ভেতরের আড্ডাবাজ মানুষটিকে সামলাতে না পারায় ইউনিক স্টোর্স তার গল্প করার একটা ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায়।

একটু আগেই ইউনিকে ঢুকেছে অনিন্দ্য। সন্ধ্যা নামছে। মেট্রোর গতিবিধিতে এই চত্বর এখন সর্বদাই সরগরম। কেন-না ঠিক পেছনেই কবি নজরুল। নির্মলবাবু মাঝে মাঝে দোকানে এসে বসেন। আগে কী ছিল, এখন কী হয়েছে এসব গল্প নির্মলবাবুর কাছ থেকে শুনতে ভালোবাসে অনিন্দ্য। আপাতত দোকানের সামনে ভিড় দেখে তার থমকে যাওয়া— হঠাৎ মকাই তাঁকে দেখতে পেয়ে যায়— ‘স্যার, এদিক দিয়ে আসুন।’ দোকানে ঢুকে একটা টুলে জমাট হয়ে যায় অনিন্দ্য।

এক সুবেশা চড়া মেক আপ নেওয়া ভদ্র মহিলার সঙ্গে মকাইয়ের তর্ক চলতে থাকে—

— ‘ম্যাডাম, আমি তো আগেই বলেছি অক্সফোর্ডের হার্ড বাইন্ড খাতা, একদিকে ছবি, রং পেনসিলের কাজ, অন্য দিকে টাইপড প্রিন্ট আউট নিয়ে সাঁটানো— পাঁচশোর এক পয়সা কমে দিতে পারব না।’

— ‘কিন্তু গাঙ্গুলীবাগানের মডার্ন সাড়ে তিনশো করে নিচ্ছে কী করে?’

— ‘ছবিটা তাহলে বাড়িতে এঁকে নিতে হবে ম্যাডাম।’

ভদ্রমহিলা ব্যাজার। ‘কত অ্যাডভান্স দিতে হবে?’

— ‘তিনশো।’— ভদ্রমহিলা তিনটে কড়কড়ে একশো টাকার নোট বার করেন।

বিলে লেখা শুর হয়।— দান্তে, মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো, মোৎজার্ট, নেপোলিয়ন, আমুন্ডসেন… মকাইয়ের বিড়বিড় অথচ নির্লিপ্ত উচ্চারণ চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ঠ।

‘অন্বেষা সেনগুপ্তের নামে বিলটা করুন। ক্লাস ফোর। হ্যাঁ, মোবাইল নাম্বার… না না, স্কুলের নাম লেখার দরকার নেই কিন্তু কবে দেবেন?’ হ্যাঁ, একটা কথা মনে রাখবেন, দু-শোর ওপর ওয়ার্ড যেন না হয়! ম্যাক্স দু-শো দশ। আমি কিন্তু দেখে নেব।

— ‘বেশ। আজ বুধবার! শনিবার বিকেলে পাবেন।’

ভদ্রমহিলা চলে গেছেন। মকাইয়ের সঙ্গে অনিন্দ্যর টুকটাক কথা শুরু হয়।

— ‘কী ব্যাপার মকাই? ফোরের একটা মেয়েকে দান্তের উপর দু-শো শব্দে রচনা লিখতে হবে?’ আহা! রবীন্দ্র সদনে লিট্ল‌ ম্যাগাজিন মেলা থেকে কেনা কমল মুখোপাধ্যায়ের শিলীন্ধ্র-র দান্তে সংখ্যাখানা অনিন্দ্যর মগজে ঝিলিক দিল। এখনও পুরোটা পড়ে ওঠা গেল না।

— ‘না, স্যার রচনা-টচনা নয়। সিম্পল প্রোজেক্ট!’

— ‘প্রোজেক্ট ব্যাপারটা আগেও শুনেছি। তা একটা ক্লাস ফোরের বাচ্চা দান্তের উপর প্রোজেক্ট করবে?’

— ‘স্যার, ওভাবে ভাবছেন কেন? এখন স্কুল, পেরেন্টস, টিচার সবাই চাচ্ছে ছেলে-মেয়ে অল স্কোয়ার হোক। দান্তে থেকে প্রোগামিং সবকিছুই মগজে লোড করে নিতে হবে’—

— ‘বুঝলুম। তা তোমার ভূমিকাটা কি এখানে, বাচ্চাদের বকলমে তুমি এসব তৈরি করো নাকি?’

— ‘না স্যার, আমার সময় কখন? সব লোক আছে। খাতা-পেনসিল তো পাইকেরি রেটে কেনা। একটা ছেলে আছে, ইরেজিতে এমএ করেছে বিদ্যাসাগর থেকে ডিসট্যান্সে, দু-চারটে সাইট ঘেঁটে এসব তৈরি করে একেবারে স্পেসিফিকেশন মতো টাইপ করে প্রিন্ট-আউট দিয়ে চলে যায়। এক দিদি আছেন, বাচ্চাদের পড়ান, ভালো ছবি আঁকেন তার কাজ খাতায় ছবি, লেখাগুলো পেস্ট করে, ছবির পাশে অলঙ্করণের কাজটা করা— ব্যস প্রোজেক্ট রেডি।’

অনিন্দ্য ফিরে গেল ছোটোবেলায়। সেটা সম্ভবত ১৯৮৮। সে ওয়ানে। মা তখনই বিএড করতে গিয়েছিল, শ্রীমন্ত কাকু মা বিএড-এর প্র্যাকটিস টিচিঙের প্র্যাকটিকাল খাতা অলঙ্করণ করছে। তখন বিএড-কে বিটি বলা হত। যতদূর মনে পড়ছে রুল টানা অংশে প্রথমে লেখা ছিল শিক্ষক ক্লাসে যে-পিসটি পড়াতে চলেছেন সেটি কীভাবে উপস্থাপনা করবেন তারই বিবরণ-নমুনা হিসেবে সম্ভবত: ‘ভোরাই’ কবিতাটা ছিল। হায়, সে-খাতাগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল!

— ‘রেট’ কীরকম দাও?

— ‘কম্পাইলেশন আর প্রিন্ট আঊট একশো পঁচিশ, ছবি আঁকা-সাঁটানো পঁচাত্তর।’

— ‘খাতা, মলাট স্টিকার নিয়ে তাহলে আড়াইশো। বাবা! তোমার তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফিট।’

— ‘খাতা পেন বই বেচে লাভ নেই স্যার। বই/খাতা এখন স্কুল থেকে নেওয়া মাস্ট। দোকান টিকিয়ে রেখেছে প্রোজেক্ট আর ইশকুল।’

— ‘বাঃ, এ তো দেখছি একেবারে ইন্ডাস্ট্রি!’

— ‘ঠিকই স্যার! কোর নয়, তবে ডাউনস্ট্রিম!’

ফিলড আপ ফর্ম নিয়ে আপাতত, সেই বিখ্যাত স্কুলের সামনে অপেক্ষমান অনিন্দ্য। গেটের অদূরে ভুট্টাওয়ালা, পাশে সুদৃশ্য চশমার দোকান। সে জানে, ফর্ম জমা দিলে সোনাইকে অ্যাডমিশন টেস্টে বসতে হবে। সিলেবাস দেওয়া আছে— ‘এ’ থেকে ‘জেড’ বড়ো ও ছোটো হরফে লেখা, ‘অ’ থেকে ‘ন’ পর্যন্ত লেখা এবং ‘ওয়ান’ থেকে ‘ফিফটি’ পর্যন্ত সনাক্ত করতে পারা— মোটের উপর এই হল সিলেবাস। এতে উতরোলে বাবা মা ক্যান্ডিডেট-সহ তিনজনকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হতে হবে। তাতে কর্তৃপক্ষ খুশি হলে তবে অ্যাডমিশনের পরোয়ানা।

অনিন্দ্য টাইম মেশিনে করে ফিরে যাচ্ছিল ব্লকের স্থায়ী সমিতির মিটিঙে। নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ স্থায়ী সমিতির তরফ থেকে বক্তব্য রাখছিলেন সিডিপিও শুভাশিস গোস্বামী— শুভাশিস অনিন্দ্যদেরই সমসাময়িক— ৩-৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য প্রথাগত শিক্ষা-প্রণালীকে এড়িয়ে ব্যবহারিক এবং বিনোদনমূলক শিক্ষাদান যে কত প্রয়োজনীয় সে-কথাটাই বোঝচ্ছিল শুভাশিস, ব্লকের (প্রোজেক্টের) ২০ খানা শিশুয়ালয়ে (মডেল আইসিডিএস সেন্টার) পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়ে গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ২৫টির কাজ শেষের মুখে, ওয়ার্কারদের সিনিতে (চাইল্ড ইন নিড ইনস্টিটিউট) অ্যাডভান্সড ট্রেনিং নেওয়ার পর্ব সমাধা। শুভাশিসের সঙ্গেই নিছক আগ্রহের বশেই হরিনাভীর কাছে একটা শিশুয়ালয়ে তার যাওয়া, বাচ্চাগুলোর জন্যে ট্রফি নিয়ে গিয়েছিল সে। সে এক আজব দেশ। সেই ফ্ল্যাশব্যাক এখন তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছিল।

সমস্যা হচ্ছে সোনাই পারছে না ঙ, ঞ লিখতে, এ-র মাত্রা কেন সে দেবে না এটা তার কাছে খুব দুর্বোধ্য, ওয়ান থেকে ফিফটি সিরিজে চিনলেও র‍্যান্ডম সিলেকশনে অসুবিধেয় পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কুঁচকে যাচ্ছে দিনদিন! কয়েকদিন আগেও অফিস থেকে ফিরে বাপ মেয়ের সঙ্গে টিনটিন নিয়ে বসত। রোজ তিন পাতা। টানটান হয়ে থাকত মেয়েটা! বাবা থার্কেটা দুষ্টু, কেন ও ক্যাপ্টেন আর টিনটিনকে ছেড়ে দিয়ে চলে এল। ‘তিব্বতে টিনটিন’— শেষের পাতা। চ্যাংকে নিয়ে ফেরার পথে টিনটিন, ক্যাপ্টেন আর কুট্টুস। সোনাইয়ের চোখে জল টলটল— ‘এ কী রে কাঁদছিস কেন’— মেয়ে ছুটে পাশের ঘরে চলে যায়। আবার ফেরে— ‘বাবা, ইয়েতিটা কী করবে এবার? ও যে একা হয়ে গেল!’

ইনস্পেকটর সাহেব অনিন্দ্য বসুরায়, এখন বড়ো একা, তার চোখের সামনে একের পর এক বিভীষিকা। হাতের ফাইলটা খুলে সে ফর্মটা একবার দেখে। সামনের পাতায় সোনাইয়ের পাসপোর্ট ছবিখানা বড়ো করুণ ঠেকে। অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল— ‘লা ভিতা নুওভা’— সে নিজেকে এখন দান্তে আলিগিয়েরির সঙ্গে তুলনা করল। আপাতত ইনফার্নোর সামনে। একজন ভার্জিলের বড়ো দরকার ছিল এ-মুহূর্তে। পথ প্রদর্শক! পাশের দোকান থেকে একটা ছোটো ফিল্টার উইলস নিয়ে ধরায় সে, হঠাৎই চমক— ‘স্যার কী ভাবছেন এত? মেয়েকে এখানে ভর্তি করবেন নাকি?’

কেরোসিনের এজেন্ট অমিত চক্রবর্তীর ছেলে বাপি।— ‘চলুন স্যার অফিসে দিয়ে আসি।’

— ‘আপনি এখানে?’

— ‘একটু ব্যাঙ্কের কাজে এসেছিলুম আর কী। আমার মেয়েও এখানেই পড়ে স্যার! এখন ক্লাস ফোর, নিশ্চিন্তে ভর্তি করে দিন— খুব ভালো জায়গা। খরচাপাতিও কম। আর কিছু না হোক মেয়ে অন্তত ইংরেজিটা ফড়ফড় করে বলতে শিখবে। ব্যস আর কী চাই?’

— ‘কীরকম খরচাপাতি?’

— ‘বছর দুই আগে একজনকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলুম, তখন ঐ অ্যাডমিশন চার্জ, টার্মিনাল ফীজ, টিউশন ফিজ, অ্যানুয়াল চার্জ, বইখাতা এসব নিয়ে হাজার বাহান্ন পড়েছিল, এখন আর কত হবে ষাট-পঁয়ষট্টি হবে বড়োজোর! ওসব নিয়ে টেনশন নেবেন না স্যার—ডিসকাউন্ট করিয়ে দোব।’

— ‘না মানে, কি জানেন তার আগে অ্যাডমিশন টেস্ট, ইন্টারভিউ এসব আছে তো, তাতে পাশ করা চাই।’

বাপি হো হো করে হাসতে শুরু করে— ‘স্যার টেনশন লেনে কা নেহি দেনে কা! আপনি আমাদের সাহেব— আর এই স্কুলের সামনে এসে আপনি টেনশন নেবেন, আর আমাকে দেখতে হবে! ম্যায় হুঁ না! ওসব টেনশন পাবলিকের জন্য। ছাড়ুন স্যার! আগে বলুন কী খাবেন লস্যি না স্প্রাইট!’

স্কুলের গেটের মধ্যে দিয়ে একঝলক তাকাল অনিন্দ্য! আলাদা করে একটা টেন্ট খাঁটানো হয়েছে, সামনে বড়ো করে সাইনবোর্ড টাঙানো আছে ‘অ্যাডমিশন কাউন্টার’।

অনিন্দ্য ধীরপায়ে গিলোটিনের দিকে এগিয়ে গেল।

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

শুভজিৎ ভাদুড়ী

ঈশ্বর আর মানুষেরা

এক
সবে মাত্র দু-বার গাড়ি চলেছে। দু-বার গাড়ি খালি করে এসে তিন নম্বর বার গাড়ি লোড করার কাজ চলছিল। অর্ধেক ভরা হয়েছে এমন সময় থানা থেকে বড়োবাবু এসে হাজির। আবুল দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। বড়োবাবুকে দেখে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। ‘কার গাড়ি?’ বড়োবাবু এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করলেন। এসব প্রশ্ন করার সময় বড়োবাবুর গলার স্বর অস্বাভাবিক রকমের আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আবুল খানিকটা দ্বিধা আর ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিল, “ছ্যার, আমার ছ্যার।”

“বালি তুলছিস কেন? বালি তোলা নিষেধ আছে জানিস না?”

আবুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই বড়োবাবুর সঙ্গে থাকা একজন কনস্টেবল বলল, “জানে না আবার! এরা সব জানে।”

বড়োবাবু চোখ নাচিয়ে আবুলের দিকে তাকালেন। যে তিনজন ঠিকা শ্রমিক গাড়িতে বালি ভরার কাজ করছিল তারা কাজ থামিয়ে বড়োবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাতে ধরা বেলচা। সেপ্টেম্বর মাস। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। বেলা বারোটার রোদ্দুরে সবারই গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বড়োবাবু ঠিক এখানে আসেননি। একটা কাজ সেরে এই পথেই ফিরছিলেন। পথে দূর থেকে বালির গাড়ি চোখে পড়াতে এখন এসে দাঁড়িয়েছেন। গোটা রাজ্যে এখন বালি মাফিয়া, বালি চোরে ভরে গিয়েছে। এই নিয়ে থেকে থেকে ওপর মহল থেকে চাপ আসে। খবরের কাগজে লেখালেখি হয়।

“এটা তো চরার বালু নয় ছ্যার।” আবুল বলল। সে-কথা অবশ্য ঠিকই। বড়োবাবু চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলেন। এখান থেকে বুড়িতোর্ষার সেতু দেখা যাচ্ছে বটে, তবে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর তো হবে। এসব জমি হয়তো নদীর চর নয়। চাষের জমি। ইতিমধ্যে পুলিশ দেখে এখানে অল্প ভিড় হতে শুরু করেছে। আশেপাশে খাটছিল এমন ছেলে ছোকরা, বৃদ্ধ এমনকী কোলে বাচ্চা নিয়ে শীর্ণ কায়া কয়েকটা মেয়ে বউও এসে হাজির। কোথায় যে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এরা, আসলে পুলিশের পোশাকটাই এরকম, বড়োবাবু ভাবলেন। এত চোখে পড়ে আর সবাইকে একেবারে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।

“চরের বালি না হোক, বালি তো! কার অনুমতি নিয়েছিস গাড়ি লাগানোর আগে? কাগজ দেখা।”

“কাগজ তো, আসলে…” আবুল আমতা আমতা করে,— “…ছ্যার, করা হয়নি ছ্যার।”

“তবে?” বড়োবাবু গলার জোর বাড়িয়ে বলেন, “নিয়ে যাব গাড়ি উঠিয়ে থানায়?”

গাড়ি থানায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ জানে আবুল। খানিক পয়সা খসবে আর দিনমান ভোগান্তি।

ইতিমধ্যে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে একজন যুবক। হাতে একটা কোদাল। বেশ আঁটসাঁট তামাদি চেহারা। একগাল দাড়ি। পরনে কেবল নীল চেকচেক লুঙ্গি। খালি গা। বুকে বড়ো বড়ো লোম। এখন ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। এ লালচান। বলল, “নিজের জমি থেকে বালা সরানোও দোষের?”

বড়োবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ভিড়ের মধ্যে থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ কানে এল তার, “নেতারা সব নদী থেকে বালা তুলে নিল, তাদের ধরতি পারেনা! হুজ্জুতি করার জন্যি এই গরিবগুলানকেই পায়।”

লালচান কিছু বলছে না। কেবল দেখছে বালি পড়ে সাদা হয়ে থাকা জমিতে মাঝখানে কেবল কিছুটা খাবলা। সবে মাত্র দুই ট্রলি বালি পার করা গিয়েছে। তার মধ্যেই এই বিপত্তি। এই বছর যেন বিপত্তির আর শেষ নেই। প্রথমে বন্যার জল ঢুকে ঘর বাড়ি সব ভাসিয়ে দিল। এত প্রবল বন্যা লালচান বহুদিন পর দেখল। রাজ্য সড়কের ওপর দিয়ে হুহু করে জল বইছে। জমি বাড়ি সব জলের তলায় পড়ে থাকল আধা মাস। সারা বচ্ছর বয়সের গাছপাথর না থাকা বুড়ি ঠাকুমার মতো রোগা হ্যাংলা শরীর যে, বুড়িতোর্ষা নদীর সে কিনা আঠারো বছরের সোমত্থ যুবতীর মতো ফুলে ফেঁপে উঠল। জল নামলে দেখা গেল জায়গায় জায়গায় চাষের জমিতে ঢের নদীর বালি এসে জমা হয়েছে। এখন এই বালি না সরালে চাষ হবে কী করে! আর চাষ না হলে খাবে কী?

লালচানের সম্পত্তি বলতে এই তিন বিঘা চাষের জমি। বছরে কখনো লোকের জমিতে শ্রম দিয়ে আর কখনো নিজের জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করে সংসার চলে। ঘর-ভরা সংসার। বাপ, মা, বউ, তিন-তিনটা ছেলেপুলে। সব মিলিয়ে মোট সাতটা উদগ্র হাঁ করে থাকা পেট। সেই পেট ভরার জন্য জমিতে ফসল হওয়াটা জরুরি। ফসল না হলে শুধুমাত্র লোকের জমিতে বাড়িতে গতর ঝড়িয়ে ওই পেট ভরা অসম্ভব। নিজের পেটে খিদের জ্বালা তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু যখন ওই একরত্তি বাচ্চাগুলা পেটের জ্বালায় হামলাবে তখন? চুপ করে বসে দেখবে এমন পাষাণ হৃদয় কার আছে!

লালচান তাই তেড়ে ফুঁড়ে এগিয়ে গেল, “এরা কী বলতেছে আবুল?”

আবুল হাত দেখিয়ে লালচানকে শান্ত হতে বলে। আবুল বলেছিল, নিজের থেকেই বলেছিল, যে ও বালুটা সরিয়ে দেবে। ওর নিজের ট্র্যাক্টর আছে। লাফাবাড়িতে একজনের নতুন ঘর উঠছে। ভিটে উঁচু করার জন্য বালু দরকার। আবুল লালচানের জমি থেকে বালু সরিয়ে ওখানে দেবে।

পয়সা যা পাবে সেটা ওর লাভ হবে, আর তাছাড়া লালচানেরও উপকার হবে। এখন এতে দোষের কী আছে সেটা লালচানের মাথায় ঢুকছে না। সে চিৎকার করে এইসব বলছে।

বড়োবাবু সামান্য হলেও দ্বিধাগ্রস্থ। চাইলে গাড়িটাকে তিনি থানায় তুলে নিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু বালি চুরি আটকানো তার একার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। জেলা স্তরের বিভিন্ন সরকারি মিটিং-এ তাকে এই নিয়ে কথা শুনতে হয় তাই তিনি গা ঘামিয়েছেন। তবে নদীর চর থেকে তুললে তিনি ধরতেন অবশ্যই। কিন্তু বন্যার জলের সঙ্গে আসা এবং চাষের জমিতে ফেলে যাওয়া বালুর ক্ষেত্রে নিয়মটা ঠিক কী এ-ব্যাপারে তার সঠিক ধারণা নেই। আবার এতটা সময় নষ্ট করে শুকনো হাতে ফিরে যাবেন এটা ভাবতেও তার ভালো লাগছে না।

দুই
সুরঞ্জন ভাবছিল এবার অফিস থেকে বেরোবে। বেলা দেড়টা বাজতে চলল। আজ সে অফিসে আসতই না। কিন্তু একটা জরুরি কাজ ছিল বলে আসতে হয়েছিল। কাজটা সেরে নিয়েই ফেরার কথা ছিল। আজ সকালের ট্রেনে ওর স্ত্রী এসেছে কলকাতা থেকে। সুরঞ্জন নিজেও কলকাতার ছেলে।

এতদিন চাকরিসূত্রেও কলকাতার আশেপাশেই ছিল, গতবছর বদলি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের একপ্রান্তে এই কোচবিহার জেলায় এসে পড়েছে। এখানেই এক ব্লকের ভূমিরাজস্ব আধিকারিক। ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। ফ্যামিলি আসেনি। আসবেই-বা কী করে! ওর বউ তো কলকাতায় চাকরি করে।

সামনের কম্পিউটার বন্ধ করে সবে চেয়ার ছেড়ে উঠেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল— ওসি।

“বলুন।”

“একবার সাউদের বস-এ আসতে পারবেন? বালির গাড়ি ধরেছি।”

অনিচ্ছে থাকলেও মুখের ওপর একেবারে না করতে পারল না সুরঞ্জন। পদাধিকার বলে সে ওসি-এর থেকে উচ্চ। কিন্তু থানার সঙ্গে তাদের একটা ভালো সম্পর্ক রেখেই চলতে হয়, কতরকম দরকার অদরকারে লাগে। সে বলল, “ক-টা গাড়ি?”

“একটাই।”

“আসছি। একটু থাকুন।”

বালি মাফিয়াদের নিয়ে সারা রাজ্যেই বেশ অস্থিরতা চলছে। উত্তরবঙ্গের এই জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় মাফিয়াদের দাপট এখানে অনেক কম। তবে যেদিকে চলেছে রাজ্য তাতে পরিবেশ অশান্ত হতে সময় লাগবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো শাসক দলের নানান মাপের নেতাদের যোগসাজশ পাওয়া যায়। আর এদিকে প্রশাসনিক সভায় নির্বিচারে ভূমিরাজস্ব দফতর চোর অপবাদে গালাগাল খেতে থাকে। তাদের অকর্মণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অথচ ব্লকের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা অফিসের নিজস্ব একখানা গাড়ি নেই। বাইরের লোকের মোটর সাইকেলই ভরসা।

সত্যি বলতে কী থেকে থেকে বেশ লজ্জা লাগে! সুরঞ্জন যেতে যেতে ভাবছিল। বুড়িতোর্ষার সেতুর ওপর থেকেই জটলাটা চোখে পড়ল। বাইক থেকে নেমে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জন জটলাটার কাছে এল। তারপর খানিক হই হট্টগোলের মাঝে সবটুকু শুনে বলল, “বালি বন্যার জলের সঙ্গেই আসুক আর যাই হোক বালি উঠানো বে-আইনি। বালি তোলার কোনও অনুমতি আমরা দেবনা। আর এগুলো জমির শ্রেণি কি? নদী বা সিকস্থি নয়তো?”

হাঁ হাঁ করে উঠল লালচান। তার সঙ্গে গলা মেলালো আরও অনেকে। সমবেত কণ্ঠস্বর জানান দিল জমি চাষেরই বটে। শ্রেণি ডাঙ্গা। সে খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “শোনো বালু তোলা যাবে না। কাজ বন্ধ। যেটুকু কাজ হয়েছে এর জন্য রয়্যালটি লাগবে। ফাইন হিসাবে দিতে হবে।”

লালচান বলল, “ছ্যার, বালি না সরান দিলে চাষ কীভাবে হবে? বিছন মাটি না পেলে ফসল হয়?”

কথাটা যে ন্যায্য তা সুরঞ্জনও জানে। কিন্তু সে কী করবে? তারও তো হাত পা বাঁধা। দিন সময় ভালো না। এখানকারই এক সাংবাদিক সারাক্ষণ খবরের জন্য ছোঁকছোঁক করে। তিলকে তাল বানিয়ে খবর ছাপায়। সে-সব খবর দেখিয়ে উপরমহল কৈফিয়ত চায়। কী দরকার অকারণ নিজের ওপর ঝামেলা ডেকে আনার। তাছাড়া একজনকে দয়া দেখালেই সব একেবারে পেয়ে বসবে। তবে এরা একেবারেই হদ্দ গরিব। কিন্তু এদের থেকে তো আর ফাইন নেবে না, ফাইন দেবে যে-ছেলেটা গাড়ি লাগিয়েছে সে। কী যেন নাম, আবুল শুনল বোধহয়। তবে সেও যে এই কাজটা করে বিশেষ কিছু পয়সা করবে তেমন নয়। নিজের সামান্য কিছু লাভ রেখে এ আসলে একধরনের সামাজিক উপকার। জমির উর্বরতা ফিরিয়ে দেওয়া। তাই এদের থেকে ফাইন নিতে যে ইচ্ছে করছে সেটাও নয়। কিন্তু এখন এই পুলিশের সামনে একেবারে কোনো ফাইন ছাড়া ছেড়ে দিলে ওরা হাসাহাসি করবে। পরে কোনো দরকারে ওদের ডাকলে খোঁটা দিয়ে কথা শোনাবে। তাই পুঞ্জীভূত অসন্তোষের মাঝে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন হাত তুলে বলল, “এই বালির গাড়ি রাস্তা দিয়ে গেলে কাগজে ছবি উঠবে। এলাকার লোকেরাই বালি চুরির অভিযোগ করবে। তখন আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি।

কোনো বালি কোথাও সরানো যাবে না। আর যেটুকু কাজ অন্যায়ভাবে হয়েছে তার জন্য ফাইন দিতেই হবে।”

সমবেত ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠলে সে আরও গলার জোর বাড়িয়ে বলল, “টাকা তো আর আমাকে দিচ্ছ না। সরকারি রসিদ পাবে। সরকারকে টাকা দিচ্ছ। আর না হলে থানার লোক আছে গাড়ি উঠিয়ে নিতে বলছি। যা হবে তা আইন মেনেই হবে।”

মুখে আইনের কথা বললেও সুরঞ্জন জানে এসব আসলে আইনের ফাঁক। আইনে ঠিক এরকম কথা বলা নেই। সরকার এক-একটা ভূমিরাজস্ব অফিসে রাজস্ব আদায়ের বড়ো বড়ো লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেয়। সেই ‘টার্গেট’ পূরণ করতে এইভাবে নরমে গরমে কিছু আদায় করতেই হয়।

যাদের মুখের জোর বেশি, যারা তুলনামূলক অসহিষ্ণু, যাদের নেতা ধরা আছে তাদের সামনে গুটিয়ে থাকে দফতর। কত কত বাংলা ইট ভাটা সরকারকে এক পয়সা রাজস্ব না দিয়ে মুনাফা করে চলে। কত ‘সেয়ম’ জমি ‘দুয়েম’ জমি পুকুর হয়ে যায় রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে। কত ‘পুকুর’ দিনের আলোয় ‘বাস্তু’ হয়ে যায় আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে।

শেষমেষ আরও কিছু কথা কাটাকাটির পর দু-হাজারে রফা হল। সুরঞ্জন রসিদ বই বার করে খসখস করে লিখে দিল ‘আনঅথরাইজড এক্সট্র্যাকসন অফ আর্থ’। হ্যাঁ, “আর্থ”। পাগল নাকি যে “স্যান্ড” লিখবে। অ্যামাউন্ট লেখার সময় থানার বড়োবাবু একটু নাক সিটকালো। নীচু গলায় বলল, “এত কমে ছেড়ে দিলেন! থানায় নিয়ে গেলে মিনিমাম দশ নিতাম।”

সুরঞ্জন অবশ্য সে-কথায় বিশেষ কান করেনি। কারণ, লালচান তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছে, “এবার তালে বালাটা পার করতে পারব?”

“একদম না। এটা অন্যায়ভাবে যে কাজটা হয়েছে তার জন্যে ফাইন। কাজ করার পারমিশন না। আর একবারও গাড়ি চলবে না।”

“পারমিশন কে দেবে তাইলে?”

“কেউ দেবে না।” ফাঁপা সরকারি দম্ভের বুটজুতো বালির ওপর মসমস করে সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন পেছন থেকে আবুলের গলা আলতোভাবে তার কানে এল, “বেকার বেকার খানিকটা টাকা খসল, তবে ভাবিয়েন না। ভোর রাতে গাড়ি লাগাব।”

তিন
প্রেম! কী গভীর প্রেম তার! কী গোপন সহবাস! এ-শরীর সে বানায়! এ-মাটি সে বানায়! তাঁর শরীরের ঘাম টুপটুপ করে গিয়ে পড়ে তৃষ্ণার্ত বুকে! ঘামে বুক না ভিজলে সঙ্গম হয় না। নরম হয়! নরম! নরম হতে হতে হাঁ করে থাকে বিছনের জন্য। তখন আর শুধু প্রেম থাকে না। থাকে পূজাও।

হাত জোর করা আকুল আকুতি। হে আমার ফসল ঘরে এসো। হে আমার ঈশ্বর ঘরে এসো। ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ। দাও। দাও। দাও।

একটানা শব্দটা সুরঞ্জনের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবু সে নিজেকে অটুট রেখেছে। আট বছর পেরিয়ে গিয়েছে বিয়ে হওয়া। বোধহয় কলকাতার কোনো গাইনি কোনো ফারটিলিটি ক্লিনিক আর বাকি নেই। সব দেখানো হয়ে গেছে। প্রায় তো মেনেই নিয়েছে ভাগ্য বলে। তবু আজও কেন যে এই প্রক্রিয়াটা দহন করে! কেন কেবল আনন্দ হয় না! আজ কি আরও বেশি করে যন্ত্রণা হচ্ছে? সংগম অসম্পূর্ণ রেখে নিজেকে স্ত্রীর শরীর থেকে পৃথক করল সুরঞ্জন। তারপর ওর পাশেই পা ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর মাথা নামিয়ে বসল। ওর পাশে এখন ওর স্ত্রীর নগ্ন নির্জন দেহস্তব্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। হঠাৎ মনে হল ওরা চলে আসার পর লালচান কি ওর জমির পাশে ঠিক এভাবেই বসে ছিল? ওকে কি তবে লালচানের মতো দেখাচ্ছে! ও নিজেই কি আসলে লালচান? না না, তা কী করে হয়! লালচানের জীবনে ওর ভূমিকাটা তো সেই অদৃশ্য অদেখা ঈশ্বরের মতো! যার অঙ্গুলি হেলনে উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়! অনন্ত সম্ভাবনার ওপর যে বালি ছড়িয়ে দেয়! তবে কি ও নিজেও ঈশ্বর! তাই-বা কীভাবে সম্ভব! ও নিজে তো এই বিরাট সমাজব্যবস্থা আইন ব্যবস্থার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটবৎ অংশ যে শিশুর মুখস্থ করা পড়া আওরানোর মতো সমাজের দুর্বোধ্য নিয়মগুলোর চর্বিতচর্বণ করে। ঈশ্বর তো সে যে অদেখা অলভ্য। যার কেবল আকাঙ্ক্ষা করা যায় ভ্রূণ রূপে, কুঁড়ি রূপে। মনে হতেই, সুরঞ্জন, আবার নেমে গেল স্ত্রীর শরীরে, যেভাবে কুমীর জলে নামে।

প্রেম! কি গভীর তার প্রেম! কি গোপন তার পুজা! যেন নিজের যৌনাঙ্গটাকে বেলচার মতো করে চালাচ্ছে সুরঞ্জন। প্রাণপণ। যেন নিজের সমগ্রটাকেই সে একটা বেলচার মতো করে চালাচ্ছে। সে একা নয়। তার সঙ্গে আরও অনেক স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ, বন্ধাত্ব বিশেষজ্ঞ। ফারটিলিটি ক্লিনিকের বড়ো বড়ো সাইন বোর্ডের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। মাটি খুঁজে বার করতে হবে। ফসল ঘরে এসো। এসো ঈশ্বর।

ক্লান্তি

ক্লান্তি

ক্লান্তি!

শরীরজুড়ে নেমে আসে ঘুম। বালির শরীর। বালির বিছানা। যখন দু-হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে একটা নিস্তব্ধ দেহ, বাইরে ভোর হচ্ছে।

লাফাবাড়িতে যাদের ভিটায় বালি দেওয়ার কথা ছিল তাদের দিয়েও এক গাড়ি বেঁচেছে বলে আবুল ওটা নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। ভোরের কাঁচা আলোয় দেখা গেল ওই যে গাড়িটা বুড়িতোর্ষার সেতু পেরিয়ে গেল।

জমির বুকে হাত রেখেছে লালচান। রং দেখছে। বুকের ওপর জন্মানো আগাছা দেখে ও মাটির মন বোঝে। তবে এখন তো সব খাঁ-খাঁ। যেন ওর সামনে নতজানু হয়ে বসেছে সেই অষ্টাদশী কিশোরী। জড়সড়। আগে আড় ভাঙতে হবে। মুখোমুখি বসেছে লালচান। দু-হাতে ঘাঁটছে। আবার প্রণামও করছে। ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এসো, এবার ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ…

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

গিনিপিগ

এই লোকটা, সেই লোকটাই— যাকে চিনতে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়েছে। তবে কি মানুষকেও গবেষণার জন্য গিনিপিগ করা যায়? তাহলে লোকটাকে একটা গিনিপিগই বলি। এই যে ‘বলি’— শব্দটায় একজন বক্তা আছেন। তিনিও লোকটার মতো একজন মানুষ। মানুষই মানুষকে বোঝে। অবিকল হাত পা, মাথা, পেট, বুক, জনন, প্রেম, চুম্বন সবই মানুষের আছে বলে, অন্য মানুষকে বোঝা সহজেই সম্ভব। কিন্তু গিনিপিগ? সে-তো খুদে একটি চঞ্চল প্রাণী! সারা শরীরময় ইট-সাদা, সাদা-কালো গোলাকার দাগ। ওগুলো এক-একটি পৃথিবী। ওইসব পৃথিবীতে বারংবার মহামারি গেছে, এসেছে। ওরা সবকিছুকেই ঝেঁটিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে আবারও গবেষণাগারের স্বেচ্ছাবন্দিত্ব মেনে নিয়েছে।

এইসবের কোনো বিচার নেই। গিনিপিগকে শুয়োরের বাচ্চা বললে ও কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। চুপচাপ গবেষণাগারের জেলখানার কয়েদি হয়ে মিটিমিটি হাসে। একজন মানুষ গিনিপিগকে বোঝে না বলে, আগের সেই ‘আমি-বক্তা’ এইবার গিনিপিগ হওয়ার চেষ্টা শুরু করল।

বউকে বলল— ও বউ, খেতে দাও। বউ ওমনি তাড়াতাড়ি পাকের ঘর থেকে এক থালা গরম ভাত আর কলমির গন্ধভরা জলের থেকে আবিষ্কৃত শাকের মৃতদেহ নিয়ে স্বামীর ভাতের থালার ওপরটা দেখতে দেখতে উঠোন পেরিয়ে দাওয়াতে উঠে গেল। সাদা ভাতের ওপর সবুজ কলমির শাক ততক্ষণে জলে ভাসা মৃতদেহ হয়ে গেছে। এক হাতে বউটার জলের ঘটি। ওই হাতের বগলে গোঁজা তালপাতার হাতপাখা। পাখার হাওয়ায় ভাত জুড়োবে। জুড়োবে বউয়ের মন।

আহা! স্বামী বলে কথা! জন্মজন্মান্তরের বোঝাপড়া! বউকে কখনো সখনো জড়িয়ে ধরলে লোকটার যৌবন ফিরে আসে।

যৌবন কি সত্যিই ফিরে আসে? এসবও গিনিপিগের মতোই গবেষণার বিষয়। তবে, মহাজনের কাছে হাওলাত বরাত বন্ধ হয়ে গেলে লোকটা বউকে পেটায়। মারতে মারতেই বনবন করে গাছের মগডালে উঠে যায়। আবারও সরসর করে নীচে নেমে আসতে গিয়ে পঞ্চায়েতি বিচারকদের দেখে পাতার আড়ালে চলে যায়। অর্থাৎ, লোকটা তখন একটা গিনিপিগ। ওকে আড়াল করতে সারা শরীরে পেটাইয়ের ব্যথা নিয়ে এবার ওর গিনিপিগ বউ দরজার খুঁটিতে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া আঁচলে মুখ চেপে বলে— তিনি বাড়ি নাই।

গিনিপিগ সন্ধ্যাকালে সরসর করে নীচে নেমে আসে। নিজের যৌবনকে আদর করে ডেকে নিজেকেই বলে— আয়…

রাত বাড়লে আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার ধবধবে সাদা চাঁদের কামিনী কাঞ্চন। গিনিপিগ তাঁর বউ গিনিপিগকে জড়িয়ে ধরে ফিরে যায় যৌবনের গবেষণা করতে। কেন, কেন তাদেরকে শিকার করে একদল মানুষ?

আবারও সকাল হয়। গতকালকের রাতের অভিজ্ঞতাকে নোটপ্যাডে মনে মনে লিখে রেখে গিনিপিগ জনমজুরি খাটতে যায়।

বউ চুলাতে রান্না বসায়। কাঁচা-পাকা পাতা পোড়ার গন্ধে বউয়ের হাতের কারসাজিতে জলে ভাসতে ভাসতে আসা রান্না করা ঢোলকলমির শাক করোনাতে মৃত্যু হওয়া লাশ হয়ে যায়।

এই লাশটাও কেউ ছিল। একদিন ওর ঘর ছিল। বউ ছিল। জলে ভাসা কলমির দামের মতো সংসার ছিল। বউ শাকভাত রান্না করে লোকটাকে খেতে দিত। রাত হলে আদর করত! আরও কত কিছু করত বউটা, ওই মৃতদেহর জন্য!

চিন্তায় ছেদ পড়ে। সারাদিন খেটেখুটে স্বামী স্ত্রী খেতে বসেছে। বেলাবেলি খেলে গরিবের একবেলার খাবারেই দু-বেলার স্বাদ মেটে। এসব সরকার জানে না। সরকারের ঘর থেকে আসা ফ্রী রেশনের চালের ওপর গিনিপিগেরা তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। আটা কিম্বা ফ্রি গম দশ টাকা কেজিতে বিক্রি করলে বিনা পুঁজির ব্যাবসাতে লক্ষ ঘরে আসে। বিদ্যুতের ব্যবহার শিখে গেছে ওরা। আর সেখানেও বিপিএল -দের টিকিয়ে রাখার ভোটব্যাংকের শুভকামনায় দুটো বাল্ব আর একটা পাখার মিটার রিডিঙের কাঁটা শূন্যতেই দাঁড়িয়ে থাকে। গিনিপিগদের বরাদ্দকৃত জমানো কেরোসিন তেল শহর থেকে আগত তেল ক্রেতাদের কুড়ি টাকা লিটারে বিক্রি করে দেয়। ওই তেল দিয়ে করোনাকালে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাস মালিকেরা মোবিলের সঙ্গে মিশিয়ে বাস চালায়। পরিবেশে দূষণ বাড়িয়ে তোলে সেই তেল পোড়া কার্বনমনোক্সাইড গ্যাস। গ্যাসের ধাক্কায় গিনিপিগের শরীরের গোল গোল চাকা চাকা সাদাকালো পৃথিবীতে ধস নামে।

তাতে কিছুই এসে যায় না গিনিপিগদের। বাঁচা মানে বর্তমান। কার কী ভবিষ্যৎ হবে, কে বলতে পারে?

বিনা পুঁজির ব্যাবসা সম্প্রসারণ করতে করতে এভাবেই চঞ্চল প্রাণীগুলো সামনের দিকে এগোয়।

এতক্ষণে বউ গিনিপিগ এঁটো থালাগুলো জড়ো করে বয়ে নিয়ে যায় সেই জলের কাছে। মাজাঘষা সারতে সারতে রাত বাড়ে। জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে সনাক্তকরণ হয়ে গেছে ততক্ষণে। এটা করোনা বডি। দৌড়ে এসে স্বামীকে জানায় সে। এতে স্বামী গিনিপিগের কোনো হেলদোল নেই। কেন-না, এই সময়টাতে সে নিশ্চিন্তমনে ভাবতে বসে। এঁটো হাত শুকিয়ে কাঠ! চোখে নেশা ধরানো জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে এখন চিতায় তোলা হবে। পাশাপাশি আরও চিতা। চিতাতে শায়িত প্রতিটি বডিই গিনিপিগের। গণচিতার আগুনের ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে গেছে।

এতক্ষণে গিনিপিগ বউ গিনিপিগকে বলল— জোরে নয়। এটা আমাদের দু-জনের মৃতদেহগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে শেষের কথা বলো— “বলো হরি, হরি বোল! রাম নাম সাথ হ্যায়…”

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

সুরঞ্জন প্রামাণিক

গল্প নেই শহরের মানুষ

ইদানীং সমীরণ যে-কোনো চরিত্রকে শর্ট-ফিল্মের ছোটো ছোটো ফ্রেমের মধ্যে ধরতে চাইছে বা বলা যায় চিত্রনাট্যের ফ্রেমে আটকে দেখতে চাইছে বা বলা ভালো দেখছে। যেমন এখন, ওই দেখুন তার দু-হাতে ফ্রেমমুদ্রা। আনুভূমিক বুড়ো আঙুলদু-টি পরস্পরের দিকে আস্তে আস্তে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। আর সমীরণের দৃষ্টি অনুসরণ করলে আপনি দেখতে পাবেন একজন বয়স্ক মানুষ মাথা নীচু করে ধীরে হাঁটছেন।

মানুষটা ফ্রেমের বাইরে চলে গেলে সমীরণ আপনাকে বা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, আমরা লোকটাকে দেখলাম কি না, ‘যেন কী এক ভার বইছেন, না?’

আপনি ভাবতেই পারেন সমীরণ বুঝি তার দেখাটা আপনার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথবা আপনার সেরকম মনেও হতে পারে। আপনি সায় দিলেন।
এবার সমীরণ তার বসার ভঙ্গি বদলে আপনার মুখোমুখি, ‘আচ্ছা বলুন তো, এই মনে হওয়া কীভাবে ভিস্যুয়ালাইজ করা যায়!’ এটা সমীরণের গুণ। সে দর্শক-পাঠকের কাছ থেকে নিয়ে তাঁদেরই ফিরিয়ে দেয়। তার কথায় এ একধরনের ‘মাধুকরী’। সৃষ্টির জন্য। ভোগের জন্য নয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সমীরণ যত না শিল্পী তার চে’ অনেক বেশি দার্শনিক। আর এ-কারণে আমি তার ভক্ত। তাকে বোঝার চেষ্টা করি। তার সহযোগী হতে চাই।

ফ্রেমমুদ্রায় সমীরণ ও পাশে বসা তার বন্ধুকে দেখে এসব আমার মনে ঘটল এবং একটা গাধা ঢুকে বেরিয়ে গেল ওই ফ্রেম থেকে। আমার মনে হল সমীরণকে কিছু বলা দরকার।

তার আগে ফ্রেমবন্দি বয়স্ক মানুষটার গল্প বলে নিতে হবে। মানুষটার গল্প মানে আমাদেরও গল্প। মানুষটার নাম বিধু, বিধুভূষণ। একসময় বিধুদা আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এই চায়ের দোকানে বসেই তিনি আড্ডা দিতেন। বিধুদাকে গল্পবাজ বলা যাবে কিনা জানি না। তিনি অবশ্য গল্পের টানেই এখানে আসতেন। গল্পের ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়া ছিল তাঁর নেশা। নেশাটা কোথায় বলুন তো! গল্প আবিষ্কার করা। বুঝলেন না তো! মানে গল্পের মধ্যে নানা গল্প তিনি দেখতে পেতেন। আমরা চমৎকৃত হতাম। বিশেষ করে লেখক। একবার সমীরণই তিন-তিনটে নতুন গল্পের সম্ভাবনা দেখে ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল, কী এক আবেগে বিধুদাকে প্রণাম করে বসে। একবার হল-কী— কারো একটা গল্প পড়ার পর বিধুদার মুখ কেমন বে-বোধার মতো হয়ে গেল সেদিন। ম্যানুস্ক্রিপ্টে আরও একবার চোখ বুলিয়ে যেন নিজের মনেই নীচের ঠোঁট উলটে মাথা নাড়লেন। তাঁকে হতাশ দেখাচ্ছিল। বললেন, কথাটা এখনও মনে আছে, ‘খবরের কাগজের ঘটনা নিয়ে গল্প— ঘটনার বাইরে নতুন কোনো গল্প পাওয়া গেল না ভাই!’

তার পর অদ্ভুত সব বদলে যেতে থাকল। আমি গল্প লিখতে পারছিলাম না। সমীরণের গল্পেও বিধুদা আর নতুন গল্প পাচ্ছিলেন না। তাঁরও আসা কমে গেল। এর মধ্যে আমাদের অনেকেই কম্পুটারে লিখতে শুরু করেছি। মানে হাতে লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্টের দিন শেষ। এসব জেনে বুঝেই হয়তো তিনি আর আসেন না। জানি না তিনি ফেসবুক সাহিত্যের কথা জানেন কি না। মাঝে একদিন পথে দেখা। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ভালো নেই!’

‘কেন কী হয়েছে?’

আমার মুখের দিকে, বলা ভালো চোখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘গল্প লিখছ?’

আমি বললাম, ‘না।’

‘তুমি ভালো আছ?’

আমার কথা না শুনেই তিনি বললেন, ‘কী করে ভালো থাকবে! গল্প না থাকলে কি ভালো থাকা যায়? আচ্ছা ভাই আসি!’

সেদিন তাঁকে বেশ ঋজুই মনে হয়েছিল। এটা মনে হতেই সমীরণকে আর গাধার কথা না বলে বললাম, ‘তুই বরং বিধুদার সঙ্গে কথা বল! ক্যারেক্টারকে তো ভিতর থেকে জানতে হবে। সবচে’ বড়ো কথা, বিধুদাকে তুই প্রজেক্ট করতে চাইছিস কেন, এটা ভালো করে বুঝতে গেলে তো বিধুদাকে স্টাডি করা দরকার।’

সমীরণ কী ভেবে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, বিধুদা এই সমাজে বেঁচে থাকার বৈধতা হারাচ্ছেন!’

‘কেন, এরকম মনে হচ্ছে কেন তোর?’

‘একদিন বিধুদাকে বলতে শুনলাম, একদা ডাকসাইটে নেতাকে বলছেন, তোমরাই তো এই পরিবেশ তৈরি করেছ কমরেড! আর আমাকে কয়েকদিন আগে বললেন, শুনেছ আদালত চত্বরে এক পাগলিকে ধর্ষণ করা হয়েছে? এই ক-দিন আগে এক পাগলকে কী যেন বলে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ কপালে— খুন করা হয়েছে— এর মধ্যে কি কোনো গল্প আছে? দেখো তো লিখতে পারো কিনা! তিনি একটা ক্লু দিলেন— একটা মানুষ এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সে কিন্তু বলতে পারছে না— এই দুষ্কৃত নগর আমার দেশ না!’ এই ব্যাপার দুটো মিলে সমীরণের মনে হচ্ছে বিধুদার বেঁচে থাকার বৈধতা আর থাকছে না।

একটু ভেবে আমি বললাম, ‘মানে তুই আশংকা করছিস!’

‘আশংকার কথা ভাবিনি, তুই কী মনে করে বললি?’

‘কথাদুটো তো বিগত-বর্তমান উভয় সরকারের সমালোচনা হয়ে যাচ্ছে!’

‘ঠিক!’

‘আর সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহ— এক ওয়ান ফাইন মর্নিং আমরা শুনব, মাঝরাতে পুলিশ বিধুদাকে তুলে নিয়ে গেছে…’

সমীরণ অন্যমনস্ক। আমার মনে হল আমি তাঁকে ভাবাতে পেরেছি। সে কোনো নতুন দৃশ্য ভাবছে।
কথামতো বিধুদাকে চায়ের দোকানে ডেকে নিলাম। বললাম, ‘একটা অণুগল্প লিখেছি!’ বিধুদা কোনো উৎসাহ দেখালেন না। সমীরণ বলল, ‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে―’

‘বলো!’

‘আপনি কী এত চিন্তা নিয়ে হাঁটেন?’

‘কী দেখে তোমার মনে হল, আমি খুব চিন্তা নিয়ে হাঁটি!’

‘আপনার পথহাঁটা দেখে…’

বিধুদা একটু হাসলেন। তাচ্ছিল্যের না কি ব্যঙ্গের ঠিক বোঝা গেল না।

‘…যেন পৃথিবীর ভার আপনার কাঁধে, হারকিউলিস উপমা হয়ে আসে।’

নিজের মনেই আমি সমীরণকে তারিফ করলাম। গাধা নয়, হারকিউলিস তার মনে হওয়ার যথার্থ চিত্ররূপ।

‘আসলে হয়েছে কি, আমার চোখ ভালো নেই— সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হয় তাই মাথা নীচু করে পথ চলতে হয়—’ একটু দম নিয়ে বললেন, ‘তবে চিন্তা আছে, ছেলের চিন্তা ছেলে-বউয়ের চিন্তা— ঘরে নিত্য অভাব। খবরের কাগজের খারাপ খবর যেন ঘটে যাবে ওদের জীবনে— চিন্তা হয়, তোমাকে তো বলেছি… চিন্তা হয় কোথাও গল্প নেই দেখে।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘দাও দেখি গল্পটা!’

গল্পটা পড়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই লিখেছ, শহরের বিত্তবানের চিন্তায় আমরা ভাবনা প্র্যাকটিস করছি। ধরে নেওয়া গেল, একটিও ভালো মানুষ নেই আমাদের শহরে। ভালো মানুষ করোনা আক্রান্ত রোগীর মতো, সে-কারণে ভালো মানুষ সাসপেক্টে পুলিশ একজনকে তুলে নিয়ে গেছে যাতে অন্য মানুষ আক্রান্ত না হয়। ভালো! কিন্তু এসবই তো নেগেটিভ বাস্তবের প্রসারণ— ‘একটিও ভালো মানুষ নেই’ এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে কেউ গল্প ভাবতেই পারে, আমি ভাবতে পারছি না। আচ্ছা, ভালো মানুষের পক্ষে বাস্তব তৈরি হতে পারত নাকি?’ বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।

সমীরণের হাতে ফ্রেমমুদ্রা, সে পায়ের ছবি ধরতে চাইছে। বিধুদা ফিরে এলেন। আমাকে বললেন, ‘শহর হোক-কি গ্রাম— তুমি কি মনে করো গরিব মানুষেরা চিন্তা করতে পারেন না?’

উত্তরের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। তিনি চলে যাচ্ছেন। সমীরণের চোখ যেন দৃশ্যশূন্য। আর আমি উত্তর খুঁজছি…

Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

মার্সেল প্রুস্ত

স্মৃতি
[Memory]

ভাষান্তর: সঞ্চয়িতা পাল চক্রবর্তী

খয়েরি উর্দি ও সোনালি বোতামে সজ্জিত একজন চাকর বেশ শীঘ্রই দরজাটি খুলে দিল এবং আমাকে একটি ছোটো বসার ঘরের দিকে এগিয়ে দিল— যে-ঘরে ছিল পাইন কাঠের প্যানেলের কাজ, দেওয়ালে ঝোলানো ছিল ছাপা সুতির কাপড় এবং যে-ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যেত। আমি সেই ঘরে ঢুকতেই এক বেশ সুপুরুষ তরুণ উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে শীতলভাবে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আবার নিজের আরামকেদারায় বসে, ধূমপান করতে করতে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন। আমি একটু অস্বস্তির মধ্যে দাঁড়িয়েই রইলাম, বলা যায় আমি এখানে কী অভ্যর্থনা পেতে চলেছি সেটাই ভাবতে লাগলাম। এতগুলো বছর পরে, এই বাড়িতে এসে আমি কি ঠিক কাজ করলাম, যেখানে তাঁরা হয়তো অনেক আগেই আমাকে ভুলে গেছেন? এই আতিথ্যময় বাড়িটি যেখানে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের, গভীর, কোমল মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি?

বাড়ির চারপাশের যে-বাগানটি এবং একদিকে তৈরি হওয়া সেই অলিন্দটি, চিত্র-বিচিত্র চিনামাটির পাত্রে সজ্জিত ও খোদাই করা লাল ইটের দুই মুরুজ, লম্বা আয়তাকার জানালাগুলো যেখানে আমাদের বর্ষার দিনগুলি কাটিয়েছিলাম এবং এমনকী এই ছোট্ট বসার ঘরের সাজসজ্জাও— যেখানে আমাকে এখুনি নিয়ে আসা হল— কিছুই পালটায়নি। কতক্ষণ পরে এক সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক অবিন্যস্তভাবে ঢুকলেন। তিনি বেঁটে এবং কুঁজো। তাঁর অনিবিষ্ট দৃষ্টি তার মধ্যে এক নির্মোহ অভিব্যক্তি এনেছিল, আমি তখনই মসিয়ে দে এন-কে চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। আমি অনেকবার আমার নাম বললাম: কিন্তু তাঁর কোনো স্মৃতি উঠে এল না। আমার আরও বেশি অস্বস্তি হতে শুরু করল। আমাদের দৃষ্টি যেন আটকে গেল, আমরা কী বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি বৃথাই তাঁকে কিছু সূত্র দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম: তিনি আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন। আমি তাঁর কাছে একজন অচেনা মানুষ।যেই আমি চলে যাচ্ছিলাম, দরজাটি খুলে গেল: “আমার বোন ওডেট”, একটি দশ-বারো বছরের মিষ্টি মেয়ে তার নরম সুরেলা ভাষায় বলে উঠল, “আমার বোনের এক্ষুণি মনে পড়ল যে, আপনি এখানে ছিলেন। আপনি কি এখানে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান? তাতে তিনি খুব খুশি হবেন!” আমি ছোট্ট মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম এবং আমরা বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে আমি সত্যি ওডেটকে পেলাম। একটি বড়ো মোটা কম্বল ঢাকা দিয়ে একটি অনাচ্ছাদিত সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর এতই পরিবর্তন হয়েছে যে, আমি তাঁকে চেনা দুষ্কর হয়ে পড়ত! তাঁর মুখাবয়ব প্রলম্বিত হয়েছে এবং তাঁর অন্ধকার চোখ যেন তাঁর নিস্তেজ মুখকে বিদ্ধ করেছে। একসময় সে বেশ সুন্দরী ছিলেন এখন আর তা নয়। একটু যেন দ্বিধাগ্রস্তভাবেই তিনি আমাকে পাশে বসতে বললেন। আমরা একাই ছিলাম। “আমাকে এই অবস্থায় দেখে তুমি নিশ্চয়ই বেশ অবাক হয়েছ”, অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন। “আসলে আমার ভয়ংকর অসুস্থতার পর থেকে, এই যেমন তুমি দেখছ, এরকমভাবে কোনো ছটফট না করে শুয়ে থাকতে হয়। আমি অনুভূতি আর দুঃখ নিয়েই বেঁচে আছি। আমি গভীরভাবে ওই নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি, যে-সমুদ্রের এই অসীম শৌর্য আমার কাছে মনোমুগ্ধকর। এই ঢেউগুলো যেন আমার মনে আসা কত মন খারাপের চিন্তা, কত আশা যা আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি পড়ি, আসলে আমি অনেক পড়ি। কবিতার সুর আমার মধুর স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব সজীব হয়ে ওঠে। সত্যি তুমি কত ভালো যে, এত বছর পরেও আমাকে ভোলোনি এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ! আমার সত্যি খুব ভালো লাগছে! আমি আগের থেকে অনেক ভালো অনুভব করছি। আমি এটা বলতেই পারি— পারি না কি?— যখন আমরা এত ভালো বন্ধু ছিলাম, তোমার কি মনে পড়ে এই জায়গাতেই আমরা টেনিস খেলতাম? আমি তখন বেশ সমর্থ ছিলাম; আমি সুখী ছিলাম। আজ আমার সেই সামর্থ্যও নেই; আমি আর সুখীও হতে পারব না। আমি যখন দেখি ভাঁটার টানে সমুদ্র সরে সরে যায়, অনেক দূরে, আমার তখন ভাঁটার স্রোতে আমাদের একা হাঁটার কথা মনে পড়ে। আমি যদি খুব দুষ্ট, খুব স্বার্থপর না হতাম, তবে আমার সেই মুগ্ধ মুহূর্তগুলির স্মৃতি আমাকে সুখী রাখার জন্য যথেষ্ট হত। কিন্তু, তুমি জানো, আমি যেন নিজেকে ছাড়তেই পারি না, এবং কোনো কোনো সময় আমার নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও, আমার ভাগ্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠি। এই একাকিত্ব আমাকে উদাস করে তোলে, কারণ, সেই মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি একা। আর বাবা, আমার কথা ভাবার জন্য বাবা বড়োই বৃদ্ধ ও অসুস্থ। আমার ভাই এক নারীর কাছে ভয়ংকরভাবে প্রতারিত হয়ে চরম আঘাত পেয়েছিল। সেই থেকে সে একাই থাকে। কোনো কিছুই তাকে ভোলাতে ও সান্ত্বনা দিতে পারে না। আমার ছোটো বোনটি এতটাই তরুণ, তাছাড়া আমাদের তাকে নিজের মতো সুখে বাঁচতে দিতে হবে।”

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ উজ্বল হয়ে উঠল। তাঁর বিশীর্ণ পাণ্ডুবর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁর সেই বহুকাল পুরোনো মিষ্টি অভিব্যক্তি তিনি আবার ফিরে পেলেন। আবার তিনি সুন্দরী হয়ে উঠলেন। তিনি কী সুন্দরী ছিলেন! আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরতে চাইতাম: তাঁকে বলতে চাইতাম, আমি তাঁকে কতটা ভালোবাসি… আমরা অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম। সন্ধ্যার ঠান্ডা বাড়ছিল, তাই তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। এবার তাঁকে বিদায় জানাতেই হবে, চোখের জলে আমার গলা রুদ্ধ হয়ে এল। সেই লম্বা অলিন্দ দিয়ে আমি হেঁটে গেলাম। সেই সুন্দর বাগানের নুড়িপথ আর আমি পেরোব না। আমি সমুদ্রতীরে নেমে পড়লাম; সেখানে কেউ ছিল না। শান্ত, নির্মোহ ভাঁটার জলের ধারে বিষণ্ণ আমি বেড়াতে লাগলাম। সূর্য অদৃশ্য হয়েছে; কিন্তু তার বেগুনি আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

 

 

 

 

Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

চার্লস বুকাওস্কি

বারবিকিউ সস দিয়ে যিশু

ভাষান্তর: শুভঙ্কর দাশ

পেট্রল পাম্পের কাছেই হিচহাইকারটা দাঁড়িয়েছিল যখন ওরা তাকে গাড়িতে তুলে নিল। তাকে বসানো হল পিছনের সিটে ক্যারোলিনের সাথে।

গাড়ি চালাচ্ছিল মাররি। ফ্র্যাঙ্ক তার হাতটা সিটের পেছনে রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে হিচহাইকারের দিকে ফিরে তাকাল।

‘তুমি কি হিপি?’

‘আমি জানি না। কেন?’ জিজ্ঞেস করল অল্পবয়সি তরুণটি।

‘আসলে হিপিদের ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ। ওদের ব্যাপারে আমরা অভস্থ।’

‘তাহলে আমাদের আপনার অপছন্দ নয়?’

‘আরে না না, আমরা হিপিদের ভালোইবাসি! তা তোমার নাম কী?’

‘ব্রুস।’

‘ব্রুস। বাহ সুন্দর নাম। আমি ফ্র্যাঙ্ক। যে গাড়ি চালাচ্ছে ও হল মাররি। আর তোমার পাশের ওই সুন্দরী মাগিটার নাম ক্যারোলিন।‘

ব্রুস মাথা নাড়িয়ে হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কতদূর যাচ্ছেন?’

‘পুরোটাই যাব আমরা, তোমাকে নিয়ে পুরোটাই যাব আমরা বাচ্চে।’

মাররি হেসে উঠল হা হা করে।

ব্রুস জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি হঠাৎ হাসছেন কেন?’

‘মাররি ওরকম সবসময় ভুল সময়ে হাসে। কিন্তু ও আমাদের গাড়ির চালক। আর ও খুব ভালো চালক। ও আমাদের নিয়ে যায় উপকূলের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত। অ্যারিজোনা, টেক্সাস, লুসিয়ানার বুক চিরে। আর ও কখনোই ক্লান্ত হয় না। আর ও ঠিকই আছে তাই না সোনা?’ সে ক্যারোলিনকে জিজ্ঞাসা করে।

‘একদম তাই আর ব্রুসও বিন্দাস।’ সে ব্রুসের হাঁটুতে হাত রেখে অল্প চাপ দেয়। তারপর ঝুঁকে এসে তার গালে একটা চুমু খায়।

‘কিছু কী খেয়েছ তুমি বাচ্চে?’

‘না, আমার বেশ খিদে পেয়েছে।’

‘ঘাবড়ো না। আমরা শিগ্গির গাড়ি থামিয়ে কিছু খাব।’

ক্যারোলিন সমানে হেসে চলেছে ব্রুসের দিকে তাকিয়ে। ‘ও সত্যি খুব ভালো। খুব ভালো।’ ব্রুস টের পেল ক্যারোলিনের হাতটা আস্তে আস্তে তার পা বেয়ে নেমে আসছে তার লিঙ্গের দিকে। ফ্র্যাঙ্ক ব্যাপারটায় গা লাগাচ্ছে না আর মাররি গাড়ি চালিয়ে চলেছে। তারপর ক্যারোলিন ব্রুসের লিঙ্গ ঘঁষতে শুরু করল আর হাসতে লাগল।

‘গত রাতে কোথায় ঘুমিয়েছিলে তুমি বাচ্চা?’ ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করল।

‘গাছের নীচে। খুব ঠান্ডা ছিল। আর তাই মন ভালো হয়ে গেল যখন সূর্য উঠল।’

‘তুমি ভাগ্যবান। রাতে কোনো জন্তু তোমাকে গিলে ফেলেনি ভাগ্যিস।’

মাররি আবার হেসে উঠল।

‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’ বাচ্চাটা জিজ্ঞাসা করল।

‘আমি বলতে চাইছি তোমার ওই অত চুলের ভেতরে তোমাকে একটা সরস বাচ্চার মতো লাগছে।’

‘একদম তাই’ ক্যারোলিন জবাব দেয়। সে সমানে ব্রুসের লিঙ্গ ধরে উপর নিচ করতে থাকে। সেটা শক্ত হতে থাকে ক্রমে।

‘তোমার কত বয়স ব্রুস?’

‘১৯।’

‘তুমি গিন্সবার্গ, কেরুয়াক পড়েছ?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ওঁরা বিট জমানার। আমরা ভালোবাসি রক এবং লোকসংগীত, আমার জনি ক্যাশকেও ভালো লাগে। আর ববি ডিলান, অবশ্যই…’

ক্যারোলিন ব্রুসের জিপার খুলে ফেলে ওটা বার করে ফেলেছে। তারপর সে তার জিভ ছোঁয়ায়, আর জিভটা ওপর নিচ করে লিঙ্গ বরাবর। ফ্র্যাঙ্ক এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই ঘটছে না।

‘তুমি বার্কিলি অবধি এসেছ?’

‘এসেছি তো। বার্কিলি, ডেনভার, সান্টা বারবারা, ফ্রিস্কো…’

‘তুমি কি মনে করো একটা বিপ্লব ঘটবে?’

‘হ্যাঁ, হতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই আর। বুঝতে পারছেন…’

ক্যারোলিন ব্রুসের লিঙ্গটা তার মুখে পুরে নিয়েছে। বাচ্চাটা আর কোনো কথা বলতে পারে না।

মাররি অবশেষে পিছন ফিরে তাকায়, তারপর হা হা করে হেসে ওঠে। ফ্র্যাঙ্ক একটা সিগারেট ধরিয়ে দেখতে থাকে।

‘হে যিশু’, বাচ্চাটা বলে ওঠে, ‘হে ভগবান, যিশু!’

ক্যারোলিন ঝাঁকাচ্ছিল। তারপর সে পুরোটাই মুখের ভেতর পেল। শেষ হল ব্যাপারটা। ব্রুস সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। জিপারটা টেনে বন্ধ করেছে।

‘কীরকম লাগল, বাচ্চা?’

‘সত্যি বলতে, ভালোই লেগেছে।’

‘সবসময় এমন একটা গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা ঘটে না আর তাছাড়া ব্যাপারটা এখনও শেষ হয়নি। এটা স্রেফ একটা শুরু। দাঁড়াও এবার আমরা খাবার জন্য থামব।’

মাররি আবার হেসে উঠল।

‘ওনার ওভাবে হাসাটা আমার ভালো লাগছে না’, বলল ব্রুস।

‘সব কিছু তো আর ঠিকঠাক হয় না। এই তো সুন্দর একটা চোষণ পেলে।’

তারা আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে চলল।

‘খিদে পাচ্ছে মাররি?’

মাররি এই প্রথম কথা বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘বেশ বেশ, একটা ভালো জায়গা পেলেই আমরা গাড়ি থামাব।’

‘আশা করি দ্রুত ওটা পাওয়া যাবে’, বলল মাররি।

‘আমার মনে হয় ক্যারোলিনের খিদে পায়নি। ও তো সবে লাঞ্চ খেলো।’

‘আমি কিছুটা ডেসার্ট খেতে পারি যদিও’, ক্যারোলিন হেসে উঠল।

‘আমরা শেষ কখন খেয়েছি যেন?’ ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করে।

‘গত পরশু’, উত্তর দেয় ক্যারোলিন।

‘সে কী?’ জিজ্ঞাসা করে ব্রুস, ‘গত পরশু?’

‘হ্যাঁ, বাচ্চা, কিন্তু যখন আমরা খাই, সত্যি আমরা খাই— আরে এই তো। এই জায়গাটা তো ভালোই মনে হচ্ছে। প্রচুর গাছগাছালি, একদম ফাঁকা। গাড়িটা রাস্তা থেকে নীচে নামাও মাররি।’

মাররি রাস্তার ধারে গাড়িটা থামায় আর ওরা সবাই বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে, আড়মোড়া ভাঙে।

‘তোমার দাঁড়িটা খুব সুন্দর বাচ্চা। আর ওই একমাথা চুল। নাপিতেরা তোমার থেকে খুব বেশি কিছু নিতে পারেনি, তাই না?’

‘আমার মনে হয় কেউই পারেনি নিতে’।

‘কেয়াবাৎ বাচ্চে। বেশ, মাররি একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলো রোস্ট করার জন্য। একটা শিক তৈরি রাখো। দু-দিন কেটে গেছে এবার তো আমার পেটের অবস্থা করুণ’।

মাররি ট্রাঙ্কটা খোলে। ভেতরে ছিল একটা বেলচা। কাঠ এমনকী কয়লাও। সব কিছুই ছিল যা ওদের দরকার। ও সেগুলো বয়ে নিয়ে চলল গাছগাছালির ভেতর। অন্যান্যরা গাড়িতে গিয়ে উঠল। ফ্র্যাঙ্ক-এর দেওয়া জ্বলন্ত তামাক ঘুরতে লাগল হাতে হাতে আর একটা স্কচের বোতল। মদটা স্মুথ কিন্তু বাচ্চাটার বার দুয়েক জলের বোতলের প্রয়োজন হল।

‘আমার সত্যি ব্রুসকে পছন্দ’, বলল ক্যারোলিন।

‘আমারও ওকে পছন্দ’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘তাতে কী, আমরা কি ওকে ভাগ করে নিতে পারি না?’

‘নিশ্চয়ই’।

ওরা সবাই কথা না বলে মদ খেয়ে চলল। তারপর ফ্র্যাঙ্ক বলে উঠল, ‘চলো সব এতক্ষণে মাররি নির্ঘাত সব রেডি করে ফেলেছে।’

ওরা বাইরে বেরিয়ে ফ্র্যাঙ্কের পিছু পিছু চলল গাছগাছালির দিকে। ক্যারোলিন আর ব্রুস হাত ধরাধরি করে। ওরা যখন সেখানে পৌঁছোল দেখল মাররির কাজ প্রায় শেষ।

‘ওই জিনিসটা কী?’ বাচ্চাটা জিজ্ঞাসা করল।

‘ওটা একটা ক্রুশ। মাররি নিজে বানিয়েছে। দারুণ হয়েছে তাই না?’

‘মানে আমি বলতে চাইছি ওটা কী জন্য?’

‘মাররি বিশাস করে ধর্মীয় আচারপদ্ধতিতে। ও একটু ওরকম আমরা এটা মজা করে মেনে নি।’

‘শুনুন’, বাচ্চাটা বলে, ‘আমার খিদে পায়নি। আমার মনে হয় আমি রাস্তা ধরে কিছুটা এগোই হাঁটতে হাঁটতে’।

‘কিন্তু আমাদের খিদে পেয়েছে বাচ্চা’।

‘বেশ, কিন্তু আমার…’

ফ্র্যাঙ্ক বাচ্চাটার পেটে ঘুসি মারল একটা আর সে ঝুঁকে গেল সামনের দিকে, মাররি তার কানের পেছনে একটা গদা দিয়ে মারল। ক্যারোলিন পাতা দিয়ে একটা বালিশ বানাল আর বসে রইল আর তখন ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি বাচ্চাটাকে হেঁচড়ে নিয়ে চলল ক্রুশের দিকে। ফ্র্যাঙ্ক ব্রুসকে ক্রুশে ঠেসে ধরে রাখল আর মাররি বাচ্চাটার বাঁ-হাতের পাতায় একটা বড়ো পেরেক গেঁথে দিল। তারপর তারা তার ডান হাতের পাতায় গাঁথল।

‘তুমি কি পায়ের পাতায়ও পেরেক লাগাবে?’ জিজ্ঞাসা করল ফ্র্যাঙ্ক।

‘না, আমি ওতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বড্ড বেশি কাজ।’

ওরা বসে পড়ল ক্যারোলিনের পাশে আর মদের বোতল দেওয়া নেওয়া শুরু হল।

‘এখানে ওদের সূর্যাস্তটা বড়ো সুন্দর, তাই না?’ জিজ্ঞাসা করল ক্যারোলিন।

‘হ্যাঁ। ওদিকে তাকাও। গোলাপী আর আস্তে আস্তে যা লাল হচ্ছে। তোমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে মাররি’।

‘হ্যাঁ তো। আমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে। তোমার কী মনে হয়?’

‘আমি স্রেফ জিজ্ঞাসা করছিলাম। রাগ কোরো না আবার’।

‘তোমরা সারাক্ষণ আমাকে একটা বোকাগাধা বলে মনে করো। সত্যিই আমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে’।

‘বেশ। তর্ক করব না আমরা। বা হয়তো আমাদের তর্ক করার দরকার আছে। কারণ, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।’

‘তাই?’ বলল মাররি।

‘হ্যাঁ। আমি বারবিকিউ সস খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি ওই স্বাদে ক্লান্ত একেবারে। আর তাছাড়া কোথাও একটা পড়েছিলাম ওটা বেশি খেলে ক্যান্সার হতে পারে।’

‘কিন্তু কথা হল, আমার বারবিকিউ সস ভালো লাগে। আর আমি সারাক্ষণ গাড়ি চালাই, সমস্ত কাজ আমি করি, তাই আমাদের বারবিকিউ সস খাওয়া উচিত’।

‘তোমার কী মনে হয় ক্যারোলিন?’

‘আমার কিছু আসে যায় না, সস দিয়ে বা সস ছাড়া। এখন খাবার খেতে পেলেই হল’।

বাচ্চাটা ক্রুশে নড়াচড়া করা শুরু করেছে। সে পা ছড়ায় দাঁড়াবে বলে, সে উপর দিকে তাকায়। তারপর নিজের হাতটা দেখতে পায়।

‘হে ভগবান। এ আমার কী করেছেন?’

তারপর ব্রুস চিৎকার করে উঠল। সেটা ছিল একটা লম্বা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের কাকুতি। তারপর সে চুপ করে গেল।

‘মাথা ঠানৃডা রাখো বাচ্চা’, বলল ফ্র্যাঙ্ক।

‘হ্যাঁ ঠিক’, বলল মাররি।

‘মনে হয় না এখন ও আরেকটা চোষণ চাইবে, তাই না ক্যারোলিন?’

ক্যারোলিন হেসে উঠল।

‘শুনুন’, বাচ্চাটা বলল, ‘আমাকে দয়া করে ক্রুশ থেকে খুলে নামিয়ে দিন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এই যন্ত্রণা— খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি দুঃখিত যে, আমি চিৎকার করেছি। দয়া করে আমাকে নামান। দয়া করুন, দয়া করুন, হে পরমেশ্বর, আমাকে নামান!’

‘বেশ, মাররি ওকে নামাও।’

‘হে ঈশ্বর, ধন্যবাদ!’

মাররি ক্রুশের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর বাচ্চাটার মাথা ঠেলে দিলো পেছন দিকে তারপর তার ঘাড়ের শিরা একটা মাংস কাটার ছুরি দিয়ে কেটে দিল। তারপর সে একটা পেরেক-তোলা হাতুড়ি দিয়ে বাঁ-হাতের পাতার পেরেকটা ধরে টানতে লাগল। সে খিস্তি দিল বিড়বিড় করে।

‘এই অংশটা সবসময় খুব কঠিন।’

তারপর মাররি বাচ্চাটাকে নামিয়ে তার জামাকাপড় খুলছিল। সে জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে দিল একপাশে। তারপর ছুরি দিয়ে কাটতে লাগল বাচ্চাটাকে। পাঁজরের নিচ থেকে টেনে পেট বরাবর কেটে ফেলল।

‘চলে এসো’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘এই অংশটা আমি দেখতে পছন্দ করি না।’

ক্যারোলিন আর ফ্র্যাঙ্ক উঠে চলে গেল জঙ্গলের ভেতর। যখন ওরা ফিরে এল তখন মাররি বাচ্চাটাকে শিকে গেঁথে রোস্ট করছে।

‘শোনো মাররি।’

‘হ্যাঁ বলো।’

‘বারবিকিউ সস-এর কী হল?’

‘আমি ওটা দিতে যাচ্ছিলাম। ওটা দিতে হয় মাংস রাঁধার সময় যাতে করে সঠিক স্বাদটা পাওয়া যায়, তুমি তো সেটা জানো।’

‘একটা কথা বলি। এই ব্যাপারটা নিয়ে টস করা যাক। তুমি রাজি আছ মাররি?’

‘বেশ। ক্যারোলিন তুমি এদিকে এসো। তুমি মাংসটা উলটেপালটে রোস্ট কর, আমরা ততক্ষণ টস করে নি।’

‘ঠিক আছে।’

‘একবারই কল করবে’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘কল করবে যখন কয়েনটা বাতাসে ঘুরছে।’

ফ্র্যাঙ্ক কয়েনটাকে অনেক উঁচুতে টোকা মেরে পাঠাল।

‘হেডস!’ চেঁচিয়ে উঠল মাররি।

কয়েনটা এসে পড়ল। ওরা এগিয়ে গেল দেখতে।

হেডস ছিল।

‘ধোর বাঁড়া’, বলল ফ্র্যাঙ্ক।

‘তুমি যদি খেতে না চাও তাহলে খাবার দরকার নেই তোমার’, বলল মাররি।

‘আমি খাব,’ উত্তর দিল ফ্র্যাঙ্ক।

পরের দিন সকালে তারা চলেছে গাড়ি চালিয়ে। গাড়ির সামনে বসে আছে ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি, আর পেছনের সিটে ক্যারোলিন। সূর্য উঠে গেছে অনেকটা। ক্যারোলিন পেছনের সিটে বসে আছে একটা হাত নিয়ে। হাতের আঙুলের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

‘এই মেয়েছেলে খেতে পারে বটে, আমি এমন দেখিনি’, বলে ওঠে মাররি।

‘হ্যাঁ, আর প্রথম চাখাটা তো ওই চেখেছে। ছেলেটা গাড়িতে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে’।

ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি দু-জনেই হা হা করে হেসে ওঠে।

‘এইসব বাজে কথা কিন্তু, এক্কেবারে বাজে কথা!’

ক্যারোলিন গাড়ির কাচ নামিয়ে হাতটাকে বাইরে ছুড়ে ফেলে।

‘আমার পেটটা বড্ড ভরে গেছে’, মাররি বলে, ‘আমি আর একটাও হিপি দেখতে চাই না।’

‘তুমি একই কথা বলেছিলে ২ বা ৩ দিন আগে’ ফ্র্যাঙ্ক বলে ওঠে।

‘আমি জানি, আমি জানি…’

‘ওই দেখো! আস্তে চালাও! আমার মনে হয় আমি আর একজনকে দেখছি! হ্যাঁ, দেখো, দাঁড়ি, চটি, সাজগোজ’।

‘এটাকে বাদ দাও ফ্র্যাঙ্ক’।

হিপি তাদের দিকে বুড়ো আঙুল নাড়িয়ে লিফট চায়।

‘গাড়িটা থামাও মাররি। দেখা যাক না ও কতদূর যেতে চায়।’

ওরা গাড়ি থামায়।

‘কতদূর যাবে বাচ্চে?’

‘নিউ অরলিয়ন্স।’

‘নিউ অরলিয়ন্স? ওতে আমাদের কম করে যেতে ৩ বা ৪ দিন লেগে যাবে। বেশ উঠে পড়ো, বাচ্চা। যাও পিছনে গিয়ে বোসো আমাদের সুন্দরী ভদ্রমহিলার সাথে।’

হিপি গাড়িতে উঠে পড়ে আর মাররি গাড়ি চালাতে শুরু করে।

‘তোমার নাম কী, বাচ্চা?’

‘ডেভ।’

‘ডেভ। বাহ্‌ সুন্দর নাম। আমি ফ্র্যাঙ্ক। যে গাড়ি চালাচ্ছে ও হল মাররি। আর তোমার পাশের ওই সুন্দরী মাগিটার নাম ক্যারোলিন।’

‘আপনাদের সবার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে’, বলল ডেভ আর তারপর ক্যারোলিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

‘তোমার সাথে দেখা হয়ে আমরাও খুশি হয়েছি’, হাসল ক্যারোলিন।

মাররি ঢেকুর তুলল আর তখনই ক্যারোলিন তার হাতটা রাখল ডেভের হাঁটুর উপর।

[এই লেখাটা নিয়ে বলতে গিয়ে বুকাওস্কি বলেছিলেন, এই গল্পটার মূল ভিত্তি আমেরিকার টেক্সাসে ঘটা একটা ঘটনার নিউজ রিপোর্ট। পরে পুলিশ যখন ওদের ধরে তখনও মেয়েটার হাতে ছিল একটা মাংসের টুকরো। সে-মাংস কীসের তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না।]

Categories
2021-NOVEMBER-DHARABAHIK

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

নার্সিং হোমে কৃষ্ণ ঢুকতেই তার হাতে সদ্যজাতকে তুলে দিয়ে, যেমন দস্তুর নার্স বলেছিল— দাদা, মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। কৃষ্ণ লজ্জা মাখানো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে তার প্রথম সন্তানকে কোলে তুলে নিয়েছিল। দেখতে দেখতে সে-হাসি যেন গর্বিত পিতার হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল, কেন-না সদ্যজাত প্রাণটি সে-আশ্রয়ে বন্ধ চোখেই ঠোঁটে হাসি এঁকেছিল, অন্তত অবাক রূপার চোখে তেমনতরই প্রতিভাত হয়েছিল তা। নার্সের হাতে সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে পকেট থেকে এক খাবলা একশো টাকার নোট বার করে পাশে টতস্থ আয়ার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। নার্সটি আবারও ফুটে উঠেছিল— দাদার দিল্‌ই আলাদা! কম কথার মানুষ কৃষ্ণ হাতের ইশারা করেছিল, সে-ইঙ্গিতে নার্স ও আয়া তত্ক্ষণাৎ কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলে কৃষ্ণ রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল— কী, আমারই জিত হল তো! পরক্ষণেই শিশুটির বদ্ধমুঠিতে হাত রেখে স্বগতোক্তি করেছিল— আমার উদিতা, আমার দি-তা!

হ্যাঁ, লোকটা পাগলের মতো মেয়ে চেয়েছিল প্রতিটা আদরের মুহূর্তে। ভাবে রূপা। আর, আর যেদিন ছোট্ট উদিতা দা-দা, ডা-ডা বলতে বলতে বা-বা বলে প্রথম যেদিন বুলি এঁকেছিল তার পাতলা নরম ঠোঁটে, লোকটা পাগল হয়ে উঠেছিল যেন। মেয়েকে নিয়ে এমন লোফালুফি করতে শুরু করে যে, রূপা ভয় পেয়ে ধমকেই উঠেছিল— থামো, পড়ে গেলে…! দেখছ না কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে!

— হাঃ হাঃ! আমার মেয়ে কিনা ভয় পাবে! কৃষ্ণের মেয়ে ভয় পাবে!

প্রথম থেকেই অল্প আওয়াজে বা জোরে দোলালেও ছোট্ট প্রাণটি ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। তখন তো কিছু বুঝতে পারেনি রূপা বা কৃষ্ণ কেউই…। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা, সে-টানেই যেন চেতনে ফেরে রূপা। খেয়াল করে কখন যেন সন্ধ্যের আঁধার গুঁড়ি মেরে ক্রমে গ্রাস করার তালে আছে তার দোকান ঘরটিকে। সে উঠে আলো জ্বালে সুইচ টিপে। কালিপরা টিউব লাইটটা বার কয়েক দপ দপ করে জ্বলে উঠলে, ম্লান আলো তবুও ঝলকে ওঠে কৃষ্ণের ফোটোর কাচে। সে-ঝলকানি তাকে ডাকলে, রূপা উঠে গিয়ে ফোটোটা আঁচল দিয়ে আলতো মুছে দেয়, মায়ামাখা হাতে। সে-মায়ায় কৃষ্ণের হাসি ফুটে উঠলে সে তার মুখের ছায়া ভেসে উঠতে দেখে যেন! নাঃ, সামনের অনেকগুলো চুলেই পাক ধরেছে যেন। পরক্ষণেই তার নিজের ছায়াকে মুছে সেখানে ফুটে ওঠে অন্য নবীনার মুখ— সুদীপ্তা, ছোটো মেয়ে তার।

— একটু কলপ তো করতে পার, নাকি? কী এমন বয়স হয়েছে তোমার? একটু থামে, তারপর আবার বলে ওঠে সুদীপ্তা, যা ইদানীংকার বাঁধা লব্জ তার— আমি তো আছি।

সবসময় শাসনে রাখে ছোটো মেয়েটি তাকে। পুরো বাপের স্বভাব পেয়েছে সে, অল্প কথা, কাটা কাটা, ওজনদার—তেমনই লম্বা দোহারা চেহারা। ছোটোমেয়েই তার ভরসা, আবার ভয়ও।

রূপা ফিরে নিজের জায়গায় আসতেই সামনের রাস্তা চোখ টেনে নেয় তার, যে-চোখে ভেসে ওঠে গোরার মুখ, আড়চোখে তার দোকানের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে হনহানিয়ে হেঁটে যায় সে। রূপার মুখে চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

— কাপুরুষ! কোন লজ্জায়ই-বা সে তার চোখে চোখ রাখে ?

ভাবে রূপা। আর অমনি দড়াম করে আছড়ে পড়ে কৃষ্ণের চেলা গোরার সে দিনের আধখানা বাক্য—বৌদি, দা-দা… । যা সে দিনের আঁধারকে চিরে আরো ঘনবদ্ধ করে তুলেছিল, যা আজকের ঘনায়মান অন্ধকারকে টলিয়ে ভাসিয়ে তুলেছিল আলো ঝলমল সে-আওয়াজ— দশ কা বিশ… দশ কা বিশ…!

কৃষ্ণর পর, বাবলু, তারপর গোরা… নাঃ, রূপশ্রী হলের দখলদারিত্ব ধরে রাখতে পারেনি সে। নির্লজ্জ, কাপুরুষ! যদিও কালের নিয়ম, ভিডিয়োর যুগ, হল্‌ চলছে না তেমন আর তবুও!

রূপা বাইরে এসে পাশের হল চত্বরের কালো অন্ধকারে চোখ চাড়ে, একবুক দীর্ঘশ্বাসকে চেপে ধরে।

— বৌদি, তিনটে চা।

সে-ডাকে রূপা দোকানে ফেরে, বর্তমানেও।

হ্যাঁ, কৃষ্ণের পর বাবলু, সে-ই কিছুদিন কৃষ্ণের তাজ ধরে রেখেছিল, দাপটে— তবে ওই কিছুদিনই। বাবলুর পর গোরা… গলির ছিঁচকে গুণ্ডা শুধুই, পাড়ার লোকের ওপর যত জুলুম! প্রদীপ রায়ের পা চাটা ভেড়ুয়া… ভোটের জন্য অমন কত কুত্তা, ভেড়ুয়া প্রদীপ রায় পোষে! কৃষ্ণের নাম ডুবিয়ে ছেড়েছে একেবারে! রোজ কৃষ্ণের গলিতে সন্ধ্যে লাগলেই মদ গেলা কতকগুলো চামচা জুটিয়ে আর মেয়ে দেখলেই টিটকারি দেওয়া। বিশ্বাসঘাতক, গদ্দার! অথচ সাবানকলে ওর চাকরি কৃষ্ণই করে দেয়! লোকে ঠিকই বলে— চুহা এক নম্বরের! কোর্টে গিয়ে বেমালুম বলে কিনা, ও কিছুই দেখেনি! বেশ করেছে আখতারের ছেলেরা কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে ওর! সে-দাগ আজও মোছেনি। তবুও দাগীবাজ হয়েও ছুটকো গুণ্ডামি গেল না! সবই ওই কালো লোকটার আশকারায়। ভোটে জেতে না, তবুও তাবড় নেতা নাকি প্রদীপ রায়, এলাকা ছাড়িয়ে গোটা কলকাতার জেলা কমিটির নেতা নাকি লোকটা! রাগে গনগনে হয়ে ওঠে রূপার মুখটা, গ্যাসের আগুনেরও উসকানি হয়তো কিছুটা, তবুও।

ভিডিয়োর যুগ এলেও তখনও সিনেমা হলের রমরমা ফিকে হয়নি। তবে রূপশ্রীতে আর বাংলা ছবি লাগে না। পরি হলে তো কবেই বাংলা বই দেখানো বন্ধ। পি-সন, কমল, খাতুনমহলে তো, যেহেতু খাস উর্দু এলাকার তাই বরাবরই হিন্দি ছবি। রূপশ্রীই একমাত্র বাঙালি হিন্দু পাড়ার হল। হিন্দি সিনেমার টানেই হোক, আর কৃষ্ণের পর তেমন দাপুটে নেতা না থাকার কারণেই হোক, বা পার্টির প্রশ্রয়েই হোক উর্দুভাষী মুসলমানদের ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমে, এ-তল্লাটে আখতারের ক্রমশ দখলদারি জারির শুরুয়াতই যেন তা। যা বাঙালি দর্শকদের হল থেকে দূরেই রাখে তখন। তেমনই এক সাঁঝকালে হলের তত্কালীন বকলমা মালিক গোরা কিছু উর্দুভাষীকে সবক শেখাতেই, যেহেতু তারা হলের গায়ে খৈনির পিক ফেলেছিল, যেন-বা বহুকাল আগের রিপিট শো— তবে এবার উলটপুরাণ, সবক শেখানেঅলা নিজেই সবক শিখে যায়! গোরা হাত তোলা মাত্র ত্বরিতে ওদের একজন লুঙ্গির গেঁজে লুকানো পিস্তলের বাঁট দিয়ে গোরার কপালে দাগা বুলিয়ে দেয়। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে—শুন বে! অবসে ই ইলাকা হামরিস। আখতার ভাই কা। ইয়ে ভাই কা সির্ফ ওয়ার্মিং সমঝিস। কাল সে ইধার তুঝকো দেখিস তো… । এই চেতাবনি দিয়ে গোরাকে এক ধাক্কা। যা ছিটকে ফেলে দেয় গোরাকে তার তাজ সমেত। কে যেন এক কলি গেয়ে ওঠে দেওয়ালে গুটখার পিক ফেলে—চুম্মা, চুম্মা ! দে দে মুঝে চুম্মা! গোরা ডানে, বাঁয়ে তাকায়, নিজের সঙ্গী কাউকে দেখতে পায় না। শুধু তার চারপাশে দুদ্দাড়িয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের ছুটে যাওয়া দেখে। দিবালোকে না হলেও, গোরার এ পতন প্রকাশ্যই, নিশালোকের মায়াবী আলোয় যা আরো পল্লবিত হয়। ফলে লজ্জায় বেশ কিছুদিন এ মুখো হয় না সে আর। শান গেলে যে কোনো ক্ষমতাবানই পঙ্গু। বস্তুত বাবুলের পরে কৃষ্ণের নারায়ণী সেনা যখন ছত্রকার!

রূপার মুখে আনমনে একটা মশা ঢুকেছে যেন। বাইরে এসে নীরবে থুথু ফেলে ড্রেনে– ওয়াক থু! সাঁঝ পেরোলে তার দোকান একটু জমজমাট থাকে সকালের মতোই, বুড়োদের কল্যাণে। ঘরে বসে কাঁহাতক সময় কাটে? তাই সকাল, সাঁঝে রূপার দোকানে তাদের আড্ডা। রূপার বেশ ভালোই লাগে। বাইরে মুসলিম ছেলেদের দঙ্গল—যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছেই।

— হবে নাই বা কেন? ওদের মহল্লায় সবই তো বোরখা ঢাকা! এক বুড়ো ক্ষ্যা-ক্ষ্যা করে হেসে কথাগুলো ছিটকে দেয়।

— হ্যাঁ, তবে থাকত যদি কৃষ্ণ আজ! আমাদের পাড়ার মেয়ে-বউদের তো…

তবে তার কথা মাঝখানেই আটকে যায়, যেহেতু বাইরে বাইকের আওয়াজ থামিয়ে বেজে ওঠে ভারিক্কি গলা—ভাবিজি, দো চায়ে।

আচ্ছা আখতারকে কী করে তোল্লাই দিচ্ছে প্রদীপ রায়, আব্বাসের জামাই জেনেও, যতই লাল পার্টির হোক না কেন আখতার? আর আব্বাসেরই বা কী চাল? মাটির দুর্গের উর্দু মহল্লায় তো আব্বাসের ইশারা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। রাজনীতির চাল বোঝে না রূপা। কৃষ্ণও কি বুঝতো?

দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাস দুটো এগিয়ে ধরে রূপা দুই খদ্দেরের দিকে।

৯ 

–নেতা! ঝাঁটের নেতা!

দুপুরবেলা ঘরে এসে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে কৃষ্ণ। গায়ের ভিজে জামাটা খাটের ওপর ছুঁড়ে দেয় সে। এ সময়ে রূপা চুপ করে থাকে। ওকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়। তবে আজ বড় রকমের কোনও গণ্ডগোল সেটা বুঝতে পারে রূপা, কেননা ঘরে কৃষ্ণ কখনো মুখ খারাপ করে না। আর আজ মানুষটা ঘরে আসতে স্বস্তিও পেয়েছে ও। নইলে সাত সকালেই ঘটনাটার খবর পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ এক রকম ছুটেই প্রায়। বাবলুই খবরটা নিয়ে এসেছিল। ফাতেপুর ভিলেজ রোডে দাঙ্গা লেগেছে নাকি! তারপর থেকে লোকের মুখে , টিভির খবর শুনে রূপার মনটা আনচান করছিল। ঘর-বার করছিল সে। পথঘাট নিমেষে শুনশান হয়ে পড়েছিল। দোকানে ঝটাপট শাটার নেমেছিল। হিন্দু পাড়ার ভিলেজ রোড যেখানে বাত্তিকল-ধানখেতির মুসলমান বস্তির ভুলভুলাইয়ায় গোত খেয়েছে, সেখানে নাকি ডি॰সি॰ পোর্টকে খুন করা হয়েছে। মনটা তাই অস্থিরই ছিল সকাল থেকে রূপার। এখন ঘরের মানুষ ঘরে ফেরায় আপাত স্বস্তি পায় সে। ঠান্ডা সরবতের গেলাস নিঃশব্দে বাড়িয়ে ধরে রূপা।

মেজাজ একটু ঠান্ডা হলে স্নান করে ভাত খেতে খেতে বৃত্তান্তে ফেরে কৃষ্ণ।

— জানো, খবর পেয়েই তো ছুটলাম প্রথমে পার্টি অফিসে। দলবল নিয়ে যেতে চাইলাম স্পটে। প্রদীপদা বলে কিনা যেতে হবে না, ওটা সেটিং কেস। শরিকি অন্য দলের মামলা! দাঙ্গার নাম করে সামান্য ডাবপাড়া নিয়ে ফালতু ঝগড়া বাঁধিয়ে একটা হিন্দুর ঝুপড়িতে আগুন ধারায় আনিস। ডকের ছিঁচকে চোর কাঁহিকা! সব সাজানো নাটক! খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে আসে—হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে কথা! ডি॰সি॰ পোর্টও ছুটে আসে। পুলিশও সে যোগসাজসে ছিল। বাত্তিকলের গলির ভুলভুলাইয়ায় ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশ ফোর্স পেছনে সরে আসে, ততক্ষণে ডি॰সি॰ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে একা, কেবলমাত্র বডিগার্ড সঙ্গী।

থামে কৃষ্ণ। এক গ্রাস ভাত ঢোকায় মুখে, কিছুটা চিবিয়ে, ঢোক গিলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,— ঢ্যামনা করিমের চাল সব। ডি॰সি॰টা সৎ ছিল কিনা! ডকের সব চুরি বন্ধ করে দিয়েছিল কড়া হাতে। তাই প্লান করে ডি॰সি॰কে ফাঁদে ফেলে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছে আনিসের দল, সঙ্গে নিরীহ বডিগার্ডকেও। শালা, করিম আবার মন্ত্রী! ওই তো একটা দু-গাছা লোকের দল! আমরা না জেতালে ভোটে জিতবার মুরোদও নেই! ডকের ডাকাত তো ও! সুভাষ বোসের নাম ডুবিয়ে ছাড়ল! ছিঃ! মাঝখান থেকে কয়েকটা নিরীহ হিন্দুর ঘর পুড়ল।

কৃষ্ণ জল খায়। ভাত মাখতে মাখতে বলে আবার,— তেমনি আমাদের প্রদীপদা! বললাম, আমাদের এলাকা। হিন্দুরা পড়ে পড়ে মার খাবে আর আমরা দেখব? তো, লোকটা বলে কিনা, ‘রাজনীতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। রাজনীতি অন্য জিনিস, সবাই পারে না’।

ভাত নাড়াচাড়া করে কৃষ্ণ। রূপা বোঝে, লোকটা মনে মনে আঘাত পেয়েছে খুব। নইলে কম কথার মানুষটাকে এত কথায় পায়!

— আমাদের ঘাড়ে চেপে উনি নেতাগিরি করবেন, আর আমরাই রাজনীতি জানি না!… মানুষের বিপদে যদি মানুষের পাশে না-ই দাঁড়াতে পারলাম, তবে কীসের…। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কৃষ্ণ। ফলে সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণি বাতাসটা আরও একটু লু টেনে আনে যেন বাইরে থেকে।

রূপা মৃদুস্বরে শুধু এটুকুই বলতে পারে,— ও কী? অর্ধেক ভাত যে পড়ে রইল!

— নাঃ, খিদে নেই আজ আর। বাথরুমে গিয়ে হাত ধোয়। ফিরে এসে খাটে হেলান দিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরায়।

— ওরা দু-জন ঘুমোচ্ছে নাকি? দিদি খেয়েছে?

— হ্যাঁ, দিদি ওদেরকে ওপরে নিয়ে শুয়েছে।

— তুমি খাবে কখন? বেলা তো হয়েছে।

— এবার খাব। একটু থামে রূপা, আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। তারপর রান্না ঘরে যেতে যেতে বলে,

— পুলিশের অত বড়ো অফিসারকে খুন করেছে… পুলিশ ছাড়বে না নিশ্চয়!

সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে কথা ক-টা উড়িয়ে দেয় কৃষ্ণ,— ধু-স-স! বললাম না মন্ত্রী লেভেলে সেটিং আছে। তাছাড়া এই ডি॰সি॰-র জন্য পুলিশেরও হিস্যায় টান পড়েছে কিনা!

সত্যিই তাই হয়, অর্থাৎ, কিছুই হয় না। যদিও সেদিন সন্ধ্যে থেকেই কার্ফু জারি হয়, লালবাজার পুরো উঠে আসে ভিলেজ রোড আর ধানখেতির বস্তিতে। আনিসকে ও তার দলবলকে গ্রেপ্তার করা হয়, মানে করানো হয় এবং আগে থেকে ছকা ছক অনুযায়ীই, নইলে ধানখেতি-বাত্তিকলের ভুলভুলাইয়া থেকে কাউকে বের করে আনা পুলিশের কম্ম নয়! যেমন ক-বছর পরে পারেনি শেরুকেও। বোকা আনিস রাজনীতির বোড়ে হয়ে গড়াগড়ি যায়, সেই সঙ্গে কিছু নিরীহ হিন্দু ছেলেও। না হলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে চক্রান্তটা সাজাবে কেমন করে মন্ত্রী-পুলিশের ঘোঁট!

আহা! কী অল্পবয়সি ডি॰সি॰র বউটা! আর বাচ্চাটাও কী ফুটফুটে! খবরের কাগজে ছবি দেখেছিল সে। দুপুরের খদ্দেরহীন দোকানে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পৌঢা রূপা। অভ্যাসবশে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। এইবার দোকান বন্ধ করবে সে। আর বেচারা আনিস! সে বোধহয় মুখ খুলেছিল নেতার গদ্দারি ধরতে পেরে। পুলিশ তার পেটে এমন লাথি কষায় যে পায়খানার দ্বার দিয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি নাকি বেরিয়ে গিয়েছিল! সে-মামলা আজও চলছে এত বছর পরও— সাক্ষী পাওয়া যায়নি নাকি কোনও! একটা করুণ হাসি আবছা ফুটে ওঠে রূপার ঠোঁটে। সেদিন রাত্রে মানুষটার গলায় আফসোস ঝরে পড়েছিল— আমাদের কাঁধে ভর দিয়েই নেতাগিরি… অথচ আমরাই রাজনীতির বোড়ে শুধু। মন্ত্রী-রাজারা দরকারে আমাদের খেয়ে নেয় আমাদের অজান্তেই! বেচারা আনিস… বোকা, বোকাচো-!

আচ্ছা কৃষ্ণের সঙ্গে প্রদীপ রায়ের কি কোনো দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল? নইলে…! সামান্য ঘরোয়া নারী জানেনি সে কিছুই! কেন-না কম কথা বলা লোকটা কখনো এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেনি। ঘর আর বার তার কাছে আলাদাই ছিল। কোনো হতাশায়, নিরুপায়তায় যেটুকু ধরা দিত স্বেচ্ছায় তার কাছে সেটুকুই কেবল!

একটু জোরেই যেন দোকানের দরজা বন্ধ করে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

Categories
2021-NOVEMBER-INTERVIEW

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

“রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলার মতো প্রজ্ঞা বা চর্চা বাঙালির কমে এসেছে।”

আলাপচারিতায় পার্থজিৎ চন্দ

দ্বিতীয় পর্ব

পার্থজিৎ: আপনি সংগীতের অন্দরমহলের মানুষ। সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ খুলে একটা গান (‘সন্ধ্যা হল মা গো’) পড়তে পড়তে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ ‘স্নেহ’-র আগে ‘অতল কালো’ ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ যে-কোনো ভাষার যে-কোনো সময়ের মহান কবিদের মধ্যে থাকবেন সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবনানন্দের পর রবীন্দ্রনাথের কাব্য-কবিতার বিষয়ে এক বড়ো অংশের শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে উদাসীনতা তৈরি হল… জীবনানন্দীয় আধুনিকতাকেই তারা একমাত্র আধুনিকতা বলে মনে করতে শুরু করল।
বিশ্বদেব: এ নিয়ে কী বলব আমি জানি না, তবে আধুনিক হওয়ার জন্য খুব বেশি চেষ্টা করার দরকার আছে কি? যে-কোনো বড়ো কবিই তাঁর সময়ে নতুন এবং সে-জন্যই আধুনিক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে আধুনিক ছিলেন, চণ্ডীদাসও তাই-ই ছিলেন।

পার্থজিৎ: আমি আরও স্পেসিফিক করে একটু আপনার থেকে জানতে চাই দু-একটি বিষয়… যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বাঙালির সমস্যা নেই, ছবি কতটা বাঙালি বোঝে জানি না, কিন্তু ছবি নিয়েও সমস্যা নেই… ছোটোগল্প থেকে শুরু করে প্রবন্ধ উপন্যাস ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা নেই; কিন্তু জীবনানন্দ-পরবর্তী সময়ে একদল গবেষক-পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয়ে একধরনের উদাসীনতা তৈরি করতে সমর্থ হলেন।
বিশ্বদেব: আমি তোমার প্রশ্নটি বুঝতে পারছি… তবে তুমি যে বলছ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বাঙালির কোনো সমস্যা নেই, আমার কিন্তু কারণ হিসাবে অন্য কথা মনে হয়… আসলে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলার মতো প্রজ্ঞা বা চর্চা বাঙালির কমে এসেছে। প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও তাই। আমার ব্যক্তিগত মত, একটা দুটো ব্যতিক্রম বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথের পর ওই উচ্চতার প্রবন্ধও আর লেখা হয়নি। যে-বাঙালি গান শোনেন তাঁদের মধ্যে ক-জন মন্তব্য করবার মতো স্তরে আছেন সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। এক সময়ে জীবনমুখী গান নামে একটা প্রবণতা শুরু হয়েছিল (শেষও হয়ে গেছে মনে হয়…), এমনকী ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কিছু মানুষ, যাঁদের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁরা গান বোঝেন, ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আন্ডারএস্টিমেট করতে শুরু করেন। অনেকের মতো আমিই বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথের মহত্তম সৃষ্টি হচ্ছে তাঁর গান… আরও একটা জায়গা… তাঁর নাটক।

পার্থজিৎ: হ্যাঁ, এগুলো তো আছেই, তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে সচেতন উদাসীনতা মাঝে মাঝে অবাক করে দেয়…
বিশ্বদেব: আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে-কাহিনিধর্মিতা তাকে এ সময়ের কবিতার ক্ষেত্রে একটা বড়ো ডিসকোয়ালিফিকেশন বলে ধরা হয়। কিন্তু আমি নিজেও বুঝতে পারি না মানুষ কেন এমন এক ভার্ডিক্ট বা ডিকটামকেই অ্যবসলিউট মনে করে! কাহিনি মানেই আর সব উপাদান ছেড়ে তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়, অথচ ‘কিনু গোয়ালার গলি’ তো এখনও আমার কাছে অদ্ভুত হৃদয়স্পর্শী কবিতা। কিন্তু ইউরোপ তো টেনিসন বা কোলরিজের কাহিনিধর্মী কবিতা সম্পর্কে এ-কথা বলে না… তারা জানে কবিতার বিবর্তনের ইতিহাসে ওই বিষয়টা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা আজকে যাকে আধুনিক কবিতা বলছি তার সেই ফর্মকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে হয়েছে। অথচ তুমি একবার ভাবো সেই যে কবিতা… রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘আজিকে হয়েছে শান্তি জীবনের ভুলভ্রান্তি…’ (‘মৃত্যুর পর’)… কল্পনা করা যায় এই লেখা! এ যেন হঠাৎ কোথা থেকে মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল, অথচ কী গভীর রহস্যময়… কী গভীর বেদনা। আসলে কি জানো, বীণা যে বাজবে তার আগে তাকে বেঁধে রাখতে হবে তো… রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেজে ওঠা কি সোজা কথা?

পার্থজিৎ: মানে পাঠককেও তৈরি হয়ে উঠতে হবে অবিরত…
বিশ্বদেব: হ্যাঁ, এটাই… এটাই। না বাঁধলে রেসোনেট করবে কী করে? এ-প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ল, আব্দুল করিম খাঁ সাহেবের কথা… কিরানার বাড়িতে রয়েছেন আব্দুল করিম খাঁ সাহেব। বাংলার একজন সংগীতসাধক গেছেন তাঁর কাছে গানের আরও পাঠ নিতে। তো হল কী বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেখলেন মাথায় পাগড়ি পরা একজন লোক গাছের নীচে বসে ‘সা…সা’ সেধে চলেছেন। সামনে একটা তানপুরা রাখা রয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সংগীতসাধক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্দুল করিম খাঁ সাহেবের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’ …যে-লোকটি গাছের নীচে বসে সুরসাধনা করছিলেন তিনি বললেন, ‘বোসো… আমিই আব্দুল করিম খাঁ…’। সংগীতসাধকের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা, তিনি কোনো রকমে বললেন, ‘আপনি যদি আমার গুস্তাকি মাফ করেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করব? এটা কী করছিলেন আপনি? আপনার মতো একজন শিল্পী এতক্ষণ ধরে ‘সা…সা’ করে চলেছেন…!’ আব্দুল করিম বললেন, ‘আমি সুরচর্চা করছি, সা-কে খুঁজছি… এই দেখ…’। বাংলা থেকে করিম সাহবের খোঁজে যাওয়া সংগীতসাধক দেখলেন, তানপুরার উপর ছোট্ট একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখলেন আব্দুল করিম খাঁ… তারপর ‘সা…’ ধরলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তানপুরার তার থেকে লাফিয়ে পড়ে গেল কাগজটা। এই হচ্ছে পারফেকশন, এই হচ্ছে আব্দুল করিম খাঁ-র সঙ্গে বেজে ওঠা… কিন্তু তার জন্য তো বাঁধতে হয়েছে তানপুরার তার। যে-বাঙালির বাংলার সংস্কৃতির প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই সে রবীন্দ্রনাথকে বুঝবে কী করে? একটু অন্যরকমভাবে বললে বলতে হয়, আমাদের বোধের টেস্টবাড্‌সগুলিই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নিজে খুব সামান্য লেখক, কিন্তু সারাজীবন এর বাইরে যেতে পারলাম না; যাবার প্রয়োজনই হয়নি আমার। আমি বাংলার যে-কোনো প্রান্তে বসে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রান্তসীমা পর্যন্ত দেখতে পাই। আমার বাংলা এত সুন্দর, এত মহৎ। বাংলার প্রতি এই ভালোবাসা কোথায় এখন? রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে যে-অপূর্ব লালিত্য রয়েছে, তার সুরের মধ্যে যে-বিস্তার রয়েছে তাকে ঠিকঠাক আবিষ্কার করতে না-পারলে ওই জীবনমুখী গানই হবে। আবার শুনলাম কোনো এক শাস্ত্রীয় সংগীতের পণ্ডিত নাকি মন্তব্য করেছেন, ওঁর সবই ভালো, শুধু সুরগুলি ভালো নয়। তাঁর এতই স্পর্ধা যে, রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বদলে তিনি গাইতে চেষ্টা করবেন।

পার্থজিৎ: এই মূঢ়তার দিকে তাকিয়ে শুধু ক্ষমা করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার আছে বলে তো মনে হয় না…
বিশ্বদেব: একজন মানুষ তার অস্তিত্বের বিন্দুটিকে অস্বীকার করে কবি কেন, কিচ্ছু হতে পারেন না। আমার সমস্ত শরীরের ভেতর দিয়ে এই বাংলার অনুভবই তো বয়ে চলেছে। ধরো একটা কোকিল যেভাবে গায় একটা কাক সেভাবে গাইতে চেষ্টা করলে কিছুতেই পারবে না। কিন্তু এটিই কি একমাত্র সত্যি? একটা কোকিলও কি কাকের মতো গাইতে পারবে? যে-মানুষ প্রকৃত সৌন্দর্যপিপাসু সে জানে কাকের ডাকও কত মধুর।

পার্থজিৎ: আপনার ‘গাছের মতো গল্প’ বইটি পড়তে গিয়ে বার বার দেখছিলাম, আমি নরনারীর প্রেমের কথাই বলছি, টলটলে এক প্রেম… সে-প্রেম ছায়া ফেলে যাচ্ছে আপনার জীবনে… কিন্তু সেখানে যৌনতার প্রকাশ্য উদ্‌যাপন উল্লেখ্যভাবে কম। আপনার কবিতায় যৌনতা এসেছে জলের ভেতর মিশে থাকা জলরং আলোর মতো। এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা হচ্ছিল, তিনি প্রেম ও পূজার মধ্যে অভিন্নতা দেখতে পেয়েছিলেন… আপনিও কি প্রেম ও পূজার মধ্যে এই অভিন্নতা দেখতে পেয়েছিলেন?
বিশ্বদেব: একদম… শুধু একটা কথা বলি, আমার মনে হয় যা সত্য সে-সম্পর্কে লজ্জিত হবার কিছু নেই। কারণ, কোনো সত্যই আমি ঘটাইনি। দ্বিতীয়ত, যা গভীর শ্রদ্ধার ও আনন্দের তা নিশ্চিতভাবে ঐশ্বরিক। অনাদি অনন্ত সৃষ্টির যে-রহস্য… এই সৃষ্টিকে যে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে… সে-যৌনতা কখনো নিন্দনীয় হতে পারে? আমি নিন্দনীয় হতে পারি… আমার মনকে নিন্দনীয় করে তুলতে পারি; কিন্তু ওই সত্য কখনো নিন্দনীয় হতে পারে না।

পার্থজিৎ: এর মধ্যে পাখোয়াজ ও সেতার বেজে যাবার আনন্দ রয়েছে তাহলে…
বিশ্বদেব: একদম, বললেন যখন একটা কথা বলি… ধরুন বেহাগ… তার মধ্যে কি শুধু অন্য রসগুলিই এল? শৃঙ্গার এল না? আমাদের শাস্ত্রে যে-নবরসের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রস-শ্রেষ্ঠ হল শৃঙ্গার… ফলত আমি নিজে একে অপবিত্র মনে করি না। বসন্তে যখন সারা প্রকৃতি নেচে ওঠে, মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, কোকিলের কুহুতান শুনি তখন কি তার মধ্যে শৃঙ্গার রস থাকে না? শৃঙ্গার বাদ দিয়ে একে কল্পনা করলে তো তা অপূর্ণ হতে বাধ্য। আমি নিজে কখনো এর থেকে দূরে থাকতে চাইনি; আবার এর মধ্যে মানুষের আরোপিত যা কিছু কদর্যতা তার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। সত্যি কথা বলতে, আমার ভাবনাতেও এই কদর্যতা আসে না। এটা যে আমি খুব মহৎ মানুষ বলে হয়ে থাকে তা নয়; আসলে আমি জানি যে একবার ওই কদর্যতা প্রবেশ করলে আনন্দটা হারিয়ে যাবে। বেহাগ আমার প্রিয়তম রাগ; কিন্তু বেহাগের মধ্যে তো কোনো কদর্যতা নেই। আমি আরও বলতে চাই, প্রশ্ন করতে চাই, যে-কোনো নারীর নগ্ন মূর্তি কি কদর্য? সে-সৌন্দর্য ঐশ্বরিক। শৃঙ্গারকে যারা নিন্দনীয় বলে মনে করেন তারাই একে কদর্য করে তোলেন।

পার্থজিৎ: শাস্ত্রীয় সংগীতে আপনার সুগভীর দখল, আপনি কি কোনো গুরুর কাছে শিষ্যত্ব নিয়ে সংগীতশিক্ষা করেছিলেন?
বিশ্বদেব: সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য, আমি কলেজ থেকে পাস করে বেরোবার ঠিক আগে অল্প সময়ের জন্য শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলাম পণ্ডিত সুভাষ রায়চৌধুরীর কাছে। তিনি আগ্রা ঘরাণার ওস্তাদ আতা হোসেন খাঁ-র শিষ্য ছিলেন। যদিও আমি তার আগে থেকেই রাগ ইত্যাদি চিনতে পারতাম।

পার্থজিৎ: অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না যে, আপনি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌহিত্র। শৈশব যৌবনের অনেকটা সময় তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আপনার কেটেছে। যে-গুটিকয়েক বাঙালি লেখক চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাঙালির অন্দরমহল পর্যন্ত প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তার মধ্যে তারাশঙ্কর অন্যতম। তাঁর লেখার গান ও সুরের ব্যবহার উল্লেখ্য। আপনার কি কোথাও মনে হয় যে, এটা আপনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক উৎসাহ ও ভিত তৈরি করতে সাহায্য করেছে?
বিশ্বদেব: আমার গানের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় রবীন্দ্রসংগীত, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর মাধ্যমে… তারপর ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি-র গান… রাধিকামোহন মৈত্রর সরোদে মজে ছিলাম খুব। তারাশঙ্করের যে-গান, সে-সম্পর্কে আমার একটু অন্য ধরনের অনুভূতি আছে। ওঁর লিরিক্স অসামান্য, ওই জীবন যে উঁনি শুধু দেখেছেন তাই নয়, সমস্ত রস গ্রহণ করেছেন। ওই গানটির কথা বার বার মনে পড়ে, রবীন মজুমদারের গাওয়া ‘তোমার আয়না বসান চুড়িতে…’।

পার্থজিৎ: এই গান তো বাংলার কোণে কোণে বাজত রেডিয়োতে। মানুষ কান পেতে থাকত…
বিশ্বদেব: আর একটা গান… ‘ভালোবেসে মিটিল না সাধ… জীবন এত ছোট ক্যানে…’।

পার্থজিৎ: আমি বহু বহু মানুষকে এর উৎস না-জেনে ব্যবহার করতে শুনেছি… এটা একটা লবজ হয়ে গেছে বাংলায়…
বিশ্বদেব: মানুষের জীবনে এর থেকে বড়ো প্রশ্ন আর কী আছে! এবং দেখ কী সরলভাবে বললেন… আমি তারাশঙ্করের ক্ষেত্রে বলব, কী জটিল বিষয় নিয়ে তিনি লিখলেন, কিন্তু প্রকাশের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই।

পার্থজিৎ: সেই সুদূর বীরভূমের গ্রাম থেকে উঠে এসে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠা… এই জার্নি তো আপনি দেখেছিলেন…
বিশ্বদেব: আমি খুব কাছ থেকে দাদুকে দেখেছি। আমরা কাছেই থাকতাম, পাইকপাড়া আর টালার দূরত্ব। তারপর বাষট্টি সালে আমার বাবা মারা যেতে আমরা দাদুর টালার বাড়িতে এসে উঠলাম। আমি জীবনে খুব বেশি বড়ো সাহিত্যিককে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাইনি; কিন্তু এই একটি মানুষকে কাছ থেকে দেখে বুঝেছিলাম একজন সাহিত্যিকের সব থেকে বড়ো মূলধন হল তার বিশ্বাসের ভূমি। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তাঁর সততার লক্ষণ। তারাশঙ্কর অনেক কিছুই জানতেন না; হ্যাঁ, জানতেন না… বিজ্ঞানে তাঁর সামান্য ধারণা ছিল, বিশ্বের বড়ো বড়ো সাহিত্যিকদের বই পড়ে ফেলবার মতো পণ্ডিতি তাঁর ছিল না… তা হলে তিনি কীসের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন? একটা মাত্র গ্রন্থ যার থেকে সমস্ত জ্ঞান গ্রহণ করতে হয়— সে-গ্রন্থের নাম জীবন। তারাশঙ্কর ঠিক ওই গ্রন্থ থেকেই তাঁর পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। আমার সামনেও একটি মাত্র গ্রন্থই খোলা থাকে— সেটি জীবন। আমি নিজেও বহু গ্রন্থ পাঠ করি এমন নয়, ভাবি বেশি। তার অনুষঙ্গে কিছু বই পড়ি। তাতে আমার অভিযাত্রা অনেক বেশি আনন্দের হয়।

পার্থজিৎ: সৃষ্টির সময়ে, মানে ধরুন একটা লেখার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন বা ভয়ংকর রকম ডুবে রয়েছেন… সে-সময়ে ঠিক কেমন দেখেছেন তারাশঙ্করকে?
বিশ্বদেব: আমরা তখন খুব ছোটো, আমরা বাগবাজারের একের এক আনন্দ চ্যাটার্জ্জী লেনের ভাড়াবাড়িতে… মানে দাদুর ভাড়াবাড়ি… দাদুর বাড়ি তৈরি হচ্ছে টালায়… আমার মনে আছে বাগবাজারের ভাড়াবাড়ির দোতলায়, একটা সাবেককালের ডেস্ক নিয়ে এক চিলতে বারান্দায় লিখে চলেছেন তারাশঙ্কর। আমি, আমার দিদি শকুন্তলা ও আমার এক মামাতো ভাই— তিনজনে লাফালাফি তুলকালাম কাণ্ড করছি। কোনো দিনের জন্য সেই ঋষি বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়েছেন বলে আমার মনে পড়ে না। সাবেককালের খাটের বাজু ধরে ঝুলোঝুলি করছি আর সেই খাটে বসেই উঁনি লিখছেন; বিরক্ত হতে দেখিনি। বাংলা সাহিত্যের মণিমুক্ত তখন সেখানে তৈরি হচ্ছে। পরে যখন ওঁর আরও নামডাক হল, মনে পড়ে সকালবেলা একটু লেবু-চা-বিস্কুট খেয়ে বসতেন। একটা বাঘছাল ছিল দাদুর, সম্ভবত তাঁকে ওটি দিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনারায়ন রায়… সে-সময়ে দেখতাম তাঁর চোখে এক অদ্ভুত উদাস দৃষ্টি। বেসিক্যালি গ্রামের মানুষ, ফলে লোকদেখানো ভড়ং ছিল না।

পার্থজিৎ: এটিই কি তাঁর সব থেকে বড়ো কবজকুণ্ডল হয়ে উঠল? এই নাগরিক ভড়ং থেকে দূরে থাকার ফলে অক্ষরের মাধ্যমে তাঁর প্রকাশ আরও যথাযথ হল এবং মানুষ তাঁকে গ্রহণ করল দু-হাত ভরে?
বিশ্বদেব: একজন নাগরিক মানুষও বড়ো সাহিত্যিক হতে পারেন অবশ্যই; আমার মনে হয় একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত-না স্বাধীন হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজের কাজের প্রতি অনুরক্ত থাকতে পারেন না। সাধনার শেষতম কথা আপন মনে থাকা। এই আপন মনে কেউ থাকে না, সব পরের মনে থাকে।

পার্থজিৎ: উনিশশো অষ্টআশি সালের সতেরোই মে— এটি আপনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। সেদিন আপনার চেতনার অনন্ত বসন্তোৎসব শুরু হয়ে গেল। তার কিছু আগে স্বামী ধ্রুবানন্দজির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ, আজ কি কোথাও মনে হয় যে, এগুলি সবই পূর্ব-নির্ধারিত?
বিশ্বদেব: আসলে পূর্ব-নির্ধারিত কথাটির মানে আমার কাছে আজও পরিষ্কার হল না। ধরুন আপনি হেঁটে যাচ্ছেন, যেতে যেতে একটা জায়গায় দেখলেন একটি থাম রয়েছে। আপনি কি থামটিকে পূর্ব-নির্ধারিত বলবেন? আপনি যদি ওই জায়গাটি দিয়ে অতিক্রম না-করতেন তা হলে থামটিকে দেখতেই পেতেন না। এমনভাবে ভেবে দেখি, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতীত থেকে অনাদি অনন্ত ভবিষ্যৎ— সবই চিরন্তন। এর পরিবর্তন নেই, ফলে নির্ধারণেরও কোনো প্রশ্ন নেই। ঈশ্বরই সব করেন, তাঁর পূর্ব-পর বলে কিছু নেই… তিনি তো আর সময়ের অধীন নন। আমি শুধু বলতে পারি, এই জীবনকে আমি দেখলাম, বুঝলাম… বুঝলাম, দেহের ভেতর যে আছে বাইরেও সে আছে। আসলে বাইরে-ভেতর বলেও কিছু নেই… জগতে কিছু হয়নি, কিছু হবেও না… অনাদিকাল থেকে জগতের একটি স্থির ছবি আছে। সেই স্থির ছবির আভাস আমরা থিয়োরি অফ রিলেটিভিটিতে পাই।

পার্থজিৎ: আপনার সঙ্গে কথা শুরু করলে অসংখ্য জিজ্ঞাসা মনে আসে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ঠিক এখন যেমন মনে হচ্ছে, মৃত্যুবোধ বা মৃত্যুচেতনা যে-কোনো শিল্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। হয়তো সব শিল্পের শুরুও এখান থেকে। আপনি মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে কখনো দেখেছেন?
বিশ্বদেব: আসলে মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে মৃত্যু যে কত কাছে আছে এটা সে বুঝতে পারে না। আমার নিজের জীবনে সাংঘাতিক বিপদ ঘটেছে বেশ কয়েকবার, মোটর-অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে দু-বার, তাছাড়া ক্যানসার পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু এই কোভিড অতিমারির সময়ে আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। সেটা মনে হয় সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়; যদিও একটা কথা প্রচলিত হয়ে আছে খুব গূঢ় অনুভবের কথা মানুষকে বলতে নেই। তা হলে কি আমি মানুষের সঙ্গে শুধু অগভীর অনুভব ভাগ-বাটোয়ারা করব? আমি মৃত্যুকে দর্শন করলাম কিছুদিন আগে… আমি কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলাম, দীর্ঘদিন খুব কষ্টের ভেতর ছিলাম। আমি এ-বাড়ির একদম শেষ ঘরে শুতাম, আমার স্ত্রী দূরত্ব বজায় রেখেও যথাসম্ভব দেখাশোনা করতেন পরম যত্নে। একদিন রাত্রে আমি ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাচ্ছি; হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, অসম্ভব আঘাত অনুভব করলাম। সব অন্ধকার হয়ে গেল; পরক্ষণে বুঝলাম আমার স্ত্রী খুব কাছে থেকে বার বার বলছেন, ‘তুমি পড়ে গেছ… তুমি পড়ে গেছ’। আমি দেখছি আমার দেহ-টা পড়ে আছে ওই জায়গায় আর আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি… আমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি… আমার থেকে পাঁচ-সাত হাত দূরে বড়ো প্রদীপের শিখা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রদীপ নেই; শুধু শিখা। অদ্ভুত সোনালি-লাল এক আলোর আভা আর অন্ধকার। আমি তাকে অনুসরণ করছি, করিডোর যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে দেওয়াল ভেদ করে বাঁ-দিকে চলে গেলাম; অনুভব করলাম এক আশ্চর্য ঠান্ডা ও শান্ত প্রকৃতির মধ্যে এসে পড়েছি। ওপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ; ডান দিকে একটি পাহাড়। কিছু কালো কালো মানুষ মাথায় ভাঁড়ের মতো জিনিস নিয়ে অন্ধকারে হেঁটে চলেছে। তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম ডান দিকের পাহাড়ের গা-বেয়ে নেমে আসছেন শ্রীকৃষ্ণ। নীলাভ গাত্রবর্ণ, হাতে বাঁশি… আমি কৃষ্ণকে চিনি। আমার দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল, আমার চশমাটা পাচ্ছিলাম না। চশমা হারিয়ে গেছে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কৃষ্ণ নামছেন আর তাঁর চোখে আমার সোনালি চশমা। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘প্রভু, এই জিনিস কি তোমাকে মানায়?’
তিনি বললেন, ‘তুমি যে বললে তোমার চশমা হারিয়ে গেছে? তাই আনলাম… এই নাও। কিন্তু তুমি এখানে কেন? ফিরে যাও…’
তাঁর কথা কোনো অনুরোধ নয়, স্টেটমেন্ট নয়… এক সত্য রয়েছে তার ভেতর। অনুভব করলাম ঘুরে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছি, দেহের ভেতর ঢুকে গেলাম আবার।
এখন এটা শুনে একজন আমায় বলেছিলেন, ‘এটা আপনার মনে হয়েছে…’। তিনি সব থেকে সত্যি কথাটাই বলেছেন; কারণ, আমি এমন কিছু বলিনি যা আমার মনে হয়নি। যা মনে হয়নি তা বলাটাই মিথ্যাভাষণ। কিন্তু অনেকে যে-অর্থে এটাকে ‘বাস্তব নয়’ বলেন আমি জানি না এর থেকে বেশি বাস্তব আর কী। বাস্তবকে চিনতে গেলে তো তাকে মনে হতেই হবে। আমি নেই অথচ জগৎ আছে এটা ভাবা যায় না; জগৎ ও আমি একসঙ্গে আছি এটাই চিরন্তন অনুভূতি।

পার্থজিৎ: একদম শেষে এসে আপনি আর একটি মারাত্মক প্রসঙ্গের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, ‘মনে হওয়া’ ও ‘ফলসহুড’কে এক করে দেখার যে-চেষ্টা তার দিকে আমাদের অন্যভাবে তাকাতে বাধ্য করলেন…
বিশ্বদেব: এই অবিশ্বাসের যুগে বিশ্বাসকেই অনুসরণ করেছি সারাজীবন। জ্ঞানের প্রধান তিনটি লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়— বিশ্বাস, বিশ্বাসের কারণ ও তার বাস্তবিক সত্যতা। এই তিনটিকে পৃথক করে দেখা হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে অবজেক্টিভ কন্ডিশন, এই সাবজেক্টিভ কন্ডিশনকে অবজেক্টিভ কন্ডিশন থেকে আলাদা করে দেখার প্রবণতা এখন সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে, সন্দেহের চেহারা নিয়েছে। এটা কোনো দার্শনিক-সন্দেহ নয়, হিংসা থেকে উৎপন্ন হওয়া সন্দেহ।

পার্থজিৎ: আপনি যে-অনন্ত আনন্দ ও আলোকিত জগতের মধ্যে রয়েছেন, যার স্পর্শ আমরা পাচ্ছি তা আরও অনেক অনেক দিন ধরে যেন পাই— এই চাওয়া। আপনার সঙ্গে কথা ফুরায় না…
বিশ্বদেব: ‘আমি যদি না থাকি’— এ-বেদনার কোনো অর্থ হয় না; এই আনন্দের ভেতর আমি খুব সুন্দর বেঁচে আছি। জীবনের অপূর্ণতা যা মনে হত একদিন, এখন আর তা মনে হয় না… জীবন খুব পূর্ণ।

প্রথম পর্ব

Categories
2021-NOVEMBER-PROSE

সম্প্রীতি চক্রবর্তী

ভূত কৌতুক: সাহিত্যে ও চলচিত্রে বাঙালি ভূতের চরিত্রায়ন

একটা বাংলা horror film-এর কথা ভাবুন। হিন্দি মূলস্রোতের মতো সাদা শাড়ি, বিরহ গান আর পাঁচটা অন্তরঙ্গ দৃশ্য মনে পড়ছে কি? একাকিনী বিধবা প্রলোভন দেখায় অমাবস্যার রাতে? নাকি বাংলা ভূত বলতে শ্যাওড়া গাছের মগডালে বসা চিতল মাছের পেটি হাতে শাকচুন্নি? ঘাড় মটকাবে, যদি না সে মাছ পায়, নিদেনপক্ষে একটা মোয়া বা নাড়ু তো লাগবেই! আসলে বাঙালি ভূতের পরতে পরতে একটা ব্যঙ্গকৌতুক রয়েছে, বাংলা সিনেমা বা সাহিত্যে তারই খানিক নাগাল পাওয়ার চেষ্টা এই প্রবন্ধে।

আজকের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ বা ‘গয়নার বাক্স’ যেখানে ভূতে মোহর জোগায় পরিচালক কে, বা যক্ষের ধনের সন্ধান দেয় আটপৌরে তোতলা গৃহ স্ত্রীকে, তার পূর্বসূরি খুঁজলে পেয়ে যেতে পারেন যমালয় জীবন্ত মানুষ বা চার মূর্তি। মানলাম সেটা যমপুরি, ঠাকুর দেবতাদের সঙ্গে খানিক রঙ্গরসিকতা কিন্তু এখানেও যে পরলোক আর হাস্যরস মিলে মিশে আছে। চার মূর্তিতে আপাতদৃষ্টিতে ভূত নেই, সে যতই টেনিদা বাংলোর কেয়ারটেকারকে দেখে ভিরমি খাক, তবু ভৌতিক আবহাওয়া তৈরি হয় স্বামী ঘুটঘুটানন্দের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টায়। চারমূর্তি জঙ্গলঘেরা বাসায় অনেকটাই ভীত সন্ত্রস্ত। তবে ক্লাসিক ছবি অবশ্যই ‘ভূতের রাজা’, যার হাসি চিরমলিন। তিনটি গুপি বাঘা ছবিতেই ভূতের রাজাকে হাসি ছাড়া কল্পনা করতে পারেন? ভূতের নাচ একবারেই ভয়াবহ নয়, পেট মোটা পাদ্রী ভূত যখন নাচে তখন পেছনের আবহসংগীত লক্ষ করেছেন? চমক রয়েছে, সঙ্গে অভিনবত্ব, তবে নেই কোনো শীতল শিহরণ। এইসব ভূতই অতি সজ্জন ও পরোপকারী। বাংলা ধারাবাহিকেও তার প্রভাব এসে পড়ল। দু-টি পপুলার বাংলা বিনোদনের চ্যানেলে ‘ভূত ঠাকুমা’ আর ‘ভূত দাদু’ পেশ করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তারা পুরোনো আমলের পোশাক পরে ধারাবাহিকের মূল চরিত্রকে সাহায্য করে, কখনো হাসির উদ্রেক ঘটায়, কখনো প্রেমে পড়ে, হুকো সেবন, প্রাতঃভ্রমণ কিছুই বাদ নেই। ‘ভূতের ভবিষ্যত’-এ তো অশরীরীর মজলিস, তাও প্রত্যেক সংলাপে হাসি পায়, ক্ষুরধার হিউমার যাকে বলে। ‘গয়নার বাক্স’-তে মৃত পিসিশাশুড়ি নাতবউমাকে আপন করে নেয়। কিছুদিন আগে কৌশিক গাঙ্গুলি ‘খাদ’ নামক একটি সিনেমা বানান, তাতেও আদপে ভূতেদের আনাগোনা, (যদিও মৃত্যু রহস্য উন্মোচন সিনেমার একেবারে শেষে) কিন্তু ভয়ের বদলে সেখানে আলাদা আলাদা জীবন-ছবি অঙ্কিত হয়েছে।

কোথাও গিয়ে বলাই যায়, বাঙালি ভূত আর যা-ই পারুক ভয় দেখাতে পারে না। কারণ, তারা হাসি ফোটায় দর্শকের মুখে, কখনো বুদ্ধিমত্তার জোরে, কখনো নিজেই সং সেজে। সিনেমা থেকে সরে গিয়ে ছোটোবেলার উপকথা হাতরালেও মামদো, ব্রহ্মদৈত্যর কথা মনে পড়ে, যাদের উপস্থিতি রক্তপিপাসু নরখাদক এর চেয়ে ক্ষুধার্ত চেহারার জানান দেয় বেশি। গোপাল ভাঁড়ের গল্প বা অন্য রূপকথায় ভূতের প্রসঙ্গ এসেছে বার বার, কিন্তু ঘাড় মটকাবার বদলে তারা বেছে নিয়েছে বিয়েবাড়ির মিষ্টি চুরির মতো কাজ, বা কোনো বাচ্চার নিত্যসঙ্গী হয়েছে চুপিচুপি। ঠিক এই কারণেই ছেলেবেলায় ভয় বলতে কখনো বাঙালি ভূত মাথায় আসেনি।

ভূত আর হাস্যরসের মধ্যে আদপে সম্পর্কটা কী? সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি, বাংলা সাহিত্য কি বলছে?

সেখানেও কিন্তু অলৌকিকতা আর হাসি এক ভাবে মিলে মিশে আছে। তিন জনের লেখা উল্লেখ করি, troilokyanatherডমরু চরিত, সুকুমার রায়ের ভুতুড়ে খেলা এবং আরও অনেক পরের হলেও শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগান’।

ত্রৈলোক্যনাথের ডমরু ধর এক আশ্চর্য চরিত্র। অবাস্তব ঘটনা তার নিত্য সঙ্গী, যার জেরে সে এক সামান্য দর্জি থেকে জমিদার হয়ে উঠতে পেরেছে, বিবিধ অলৌকিক, বিদঘুটে কাহিনী সে শোনায় তার বন্ধু মহলে, সকলে তাঁকে সমিহ করে এবং আমরা পাঠকরাও সেই গল্পে মজি বার বার। ‘ডমরু চরিত’-এর একটি গল্পের শিরোনাম ‘ছোটখাটো ভালো মানুষ ভূত’, এই পর্বে ডমরুর সাক্ষাৎ হয় এক ভীতু ভূতের সঙ্গে। সে আশেপাশে কোনো মানুষ হাচলে কাশলে ভয় পায়, কুকুর ডাকলে পলায়ন করে, ডমরুর হাতে ভেটকি মাছ দেখেও সম্ভ্রমে তা চাইতে পারে না। ইংরেজিতে একটা বিখ্যাত সিনেমা ছিল, ‘ক্যাস্পার’, এক ছোটো সাদা ভূতের গল্প। ত্রৈলোক্যনাথের ছোটো ভূত তাকে মনে করিয়ে দেয়। ডমরুর ভীতু ভূত তারই সঙ্গে গ্রামের পথে হাঁটা চলা করে, রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি মারে আর ঘুলঘুলি দিয়ে হাত বাড়িয়ে মাছ ভাঁজা নেয়, তবে যদি রাঁধুনে নিজে থেকে হাতে তুলে দেয়। ভদ্র, শিষ্ঠ ভূত, নিজে কাড়াকাড়ি করতে পছন্দ করে না। এবারে চলে আসুন মা ভূত আর ছানা ভূতের গপ্পে। সুকুমার রায়ের ভূতুড়ে খেলায়, পান্ত ভূতের ছানা তার মায়ের কোলে খেলা করে। মা তাঁকে কত নামে ডাকে, ‘নোংরা মুখো সুটকো’, ‘বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বৃষ্টি ‘গণেশ ঠাকুর ময়দা ঠাসা নাদুস’’। ভূত তো কী হয়েছে, সেও গরমিকালে বৃষ্টির স্বস্তি বোঝে, গণেশ ঠাকুরের মতো নাদুসনুদুস বাচ্চার স্বপ্ন দেখে আবার ময়দার কোমল ডেলা ভেবে শিশুকে কোলে তোলে যত্নে। দেবতার মানবায়ন বলে একটি কথা আছে, বাংলা হিন্দু পৌরাণিক গল্পে তার নজির মেলে বার বার। এখানে শিবদুর্গা যেন আর পাঁচটা দম্পতির মতো নিত্য কলহে জড়ায়, রাধাকৃষ্ণের প্রেম হয়ে ওঠে অতি মানবিক। আমার তো মনে হয় এই বাংলায় ভূতেদের ও মানবায়ন ঘটেছে। এর সব থেকে উৎকৃষ্ট নজির কিন্তু শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগান’।

বুরুন অঙ্কে তেরো পেয়ে ফেল করেছে, বাড়িতে সে এক ঘরে, কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। মনের দুঃখে গোঁসাই ডাকাতের বাগানে গিয়ে তার সাক্ষাৎ হয় নিধিরাম ভূতের সঙ্গে। নিধিরাম দু-শো বছর ধরে সেই জঙ্গলে রয়েছে, হাত পা ইয়া লম্বা করে, অদৃশ্য হয়ে, একেবারে ছোট্ট হয়ে হোমিওপ্যাথির শিশির মধ্যে ঢুকেও সে বুরুনকে ভয় দেখাতে ব্যর্থ হয়। হতাশ হয়ে ভূত বাবাজি তার অসীম সাহসী বন্ধুকে সাহায্য করতে উদ্যত এবার। করালি স্যারের টিউশনে ভূত বুরুনের হয়ে অঙ্ক কষে দেয়, স্কুলে ক্রিকেটে বুরুনের হাতে ব্যাট দিয়ে অদৃশ্য ছক্কা মারে, এমনকী তার বাড়িঘর ঝাড়পোঁছ পর্যন্ত করে দেয়।

এইসব বাঙালি ভূতের গল্পে কেউ স্নেহশীলা মা, কেউ-বা পরোপকারি বন্ধু আবার কেউ ভূতের একমাত্র স্বধর্ম বর্জন করে নিজেই ভয় পেয়ে বসে আছে। কেউ কেউ আবার মানুষের আদলে তৈরি ম্যাজিক জানা এক প্রজাতি, সিনেমা হোক বা গল্প এই ধারা চলছে শতকের পর শতক।

বাংলার ভয়, অশ্রু, কষ্ট মিলে মিশে যায় রঙ্গব্যঙ্গে, কৌতুকে। আমরা হাসি খিলখিলিয়ে, ভূত চতুর্দশী হোক বা নিশিদিন কোনো অমাবস্যা।