Categories
অন্যান্য

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

সপ্তদশ অধ্যায়

এখান থেকে ভ্রমণ করো দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত ধরে। অতিক্রম করো আঠারো ইউ ইয়েন পথ। এসে পড়বে প্রসিদ্ধ সংকশা নগরীতে। বুদ্ধ তিন মাসাধিক কাল ত্রিয়াশত্রিনশাস স্বর্গে কাটিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর মায়ের মঙ্গলার্থে অনুশাসনগুলি প্রচার করেন। কথিত আছে স্বর্গ থেকে যখন তিনি পৃথিবীর পথে নেমে আসেন, প্রথম পা রাখেন এই সংকশা নগরীতে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে তিনি স্বর্গারোহণ করেন। আর শিষ্যগণের অগোচরেই রয়ে যায় সে-সব কাহিনি। স্বর্গবাসের মেয়াদ শেষ হবার সাতদিন আগে তিনি তাঁর অদৃশ্যমানতা ত্যাগ করেন।

বুদ্ধের আত্মীয় ভ্রাতা অনিরূদ্ধ ছিলেন প্রবুদ্ধ বা আলোকিত ব্যক্তি। তিনি জ্ঞানচক্ষু মেলে সুদূরে দেখতে পেলেন লোকমান, পরম পূজ্য তথাগতকে। প্রবীণ গুরু মৌদগল্যায়নকে অনিরূদ্ধ বললেন, ‘এবার তুমি যাও, তথাগতকে প্রণাম করো।’ মৌদগল্যায়ন এগিয়ে এসে বুদ্ধের চরণে নিজেকে প্রণত করলেন এবং একে-অপরকে অভিবাদন জানালেন। বুদ্ধ বললেন, ‘মৌদগল্যায়ন, আর সাতদিন পর পৃথিবীর পথে ফিরব আমি।’ এই কথা শুনে ফিরে গেলেন মৌদগল্যায়ন।

ইত্যবসরে আটটি সাম্রাজ্যের সম্রাট, তাদের মন্ত্রী, আমাত্য এবং প্রজাগণ, বুদ্ধের দীর্ঘ অদর্শনে হয়ে পড়ল ভারাক্রান্ত। এবার প্রিয় তথাগতের প্রত্যাবর্তনে সারা দেশজুড়ে সকলে মেঘরাশির মতো ঘনিয়ে এলেন। প্রত্যেকের বাসনা একটিই, পরম পূজ্যের দর্শন। একজন ভিক্ষুণী স্বগোতক্তির মতো হৃদয় নিংড়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আজ রাজা, মন্ত্রী, সাধারণ মানুষজন সকলেই গৃহের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন বুদ্ধের সন্দর্শনে। আমি একলা ভিক্ষুণী, কীভাবে দেখা পাই তাঁর?’ বুদ্ধ অন্তর্যামী। এই কাতর বাসনা জানতে পেরে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে এক মুহূর্তে সেই মহিলাকে চক্রবর্তী রাজার রূপ দিলেন। এবং তিনিই প্রথম অভিবাদন জানালেন প্রিয় বুদ্ধকে।

স্বর্গ থেকে অবতরণের সময় বুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল রত্নখচিত ধাপ-সহ তিনটি উড়ান। সপ্তরত্ন, সুবর্ণ, রৌপ্য, বৈদুর্য্য, স্ফটিক, মুক্তা, লোহিতক, মুসরগলভ দিয়ে তৈরি মধ্যবর্তী উড়ানে নেমে এলেন বুদ্ধ। ব্রহ্ম প্রস্তুত করলেন রূপার সিঁড়ি। চামরী গাইয়ের লেজ থেকে তৈরি শ্বেত মার্জনী হাতে তিনি এসে দাঁড়ালেন ডান দিকে। দৈব অধীশ্বর শিহ তৈরি করলেন রক্তবর্ণ সোনার সিঁড়ি। সপ্তরত্নে প্রস্তুত ছাতা হাতে এসে দাঁড়ালেন বাঁ-দিকে। অগণিত আমন্ত্রয়ী ঈশ্বরগণ বুদ্ধের অনুসারী হয়ে নেমে এলেন পৃথিবীতে। বুদ্ধ পৃথিবীর মাটিতে পা রাখতেই তিনটি উড়ানই ভূমিতে বিলীন হল। পড়ে রইল কেবল সপ্তসিঁড়ি।

পরবর্তীতে সম্রাট অশোক সেই সিঁড়ির অন্তঃসন্ধানে খননকার্য শুরু করলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে নরকের দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছোলেও কোনো তল পাওয়া গেল না সেই সপ্তসিঁড়ির। আর এর পর থেকেই সম্রাট হয়ে পড়লেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী। এই স্থানে নির্মাণ করলেন বৌদ্ধমঠ। মধ্য উড়ানে স্থাপিত হল ষোলো ফুট উচ্চতার বুদ্ধ মূর্তি। মূর্তির পিছনে নির্মিত হল ত্রিশ হাত উচ্চতার একখানি প্রস্তর স্তম্ভ। আর সেই স্তম্ভের শীর্ষে আসীন হল এক সিংহ মূর্তি। আর ভিতর দিকে স্তম্ভ গাত্রে চারপাশে উৎকীর্ণ বুদ্ধের মুখশ্রী। ভিতর-বাহিরে স্তম্ভটি কাচের মতো স্বচ্ছ।

কিছু বিরূদ্ধ মতের গুরু এই স্থান নিয়ে শ্রমণদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাদানুবাদ অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছোয় শ্রমণগণের গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতিতে, এ-স্থানে বসবাসের অধিকার যদি কেবল শ্রমণদের থাকে, তবে এখন তার প্রমাণসাপেক্ষে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটবে। তাঁদের এ-কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে, স্তম্ভ শীর্ষে বসে থাকা সিংহ গর্জন করে উঠল, তাঁদের অধিকারের সমর্থনে। এতে গুরুগণ নিদারুণ ভীত হয়ে পড়েন।

তিন মাসাধিক স্বর্গের ঐশ্বরিক আহার সেবন করে বুদ্ধের গা থেকে স্বর্গীয় সুগন্ধি বেরতে লাগল। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ স্নান করতে শুরু করলেন। যে-স্থানে এই ঘটনা ঘটে সেখানে পরবর্তীকালে একটি স্নানাগার তৈরি করা হয়। এই স্নানঘর আজও বর্তমান। যেখানে ভিক্ষুণী, সবার প্রথম বুদ্ধের অভিবাদন করেন, সেখানে একটি প্যাগোডা স্থাপিত হয়। বুদ্ধ যেখানে সর্বসমক্ষে চুল ও নখ কাটেন, সেখানেও তৈরি হয় প্যাগোডা। এ-সকল প্যাগোডা আজও বর্তমান। দৈব অধীশ্বর, শিহ আর ব্রহ্মার উপস্থিতিতে বুদ্ধ যে-স্থানে অবতীর্ণ হন, সেখানেও নির্মিত হয় একটি প্যাগোড। শ্রমণ এবং শ্রমণীগণ মিলে এই বিহারে সহস্রজনের বাস। কিছু জন আছেন মহাযান মতাবলম্বী আর কিছু হীনযান মতাবলম্বী। একটি সর্বজনীন তহবিল থেকে সকলেরই আহারের ব্যবস্থা হয়। এখানে রয়েছে একটি শ্বেত কর্ণ ড্রাগনের বাস। বিহারের শ্রমণগণের রক্ষক যেন সে-ড্রাগন। ভূমি আবাদ রাখে, নির্ধারিত ঋতুতে বৃষ্টি ঝরায়, সকল বিপর্যয় প্রতিহত করে। তাই তো শান্তির আবাস এই বিহার। শ্বেত ড্রাগনের এই সহৃদয়তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, স্রমণগণ ড্রাগনের একটি বিগ্রহ স্থাপন করলেন, আর তার শয়নের জন্য স্থান প্রস্তুত করলেন। বিশেষ নৈবেদ্য দেওয়া হয় ড্রাগনের উদ্দেশে। প্রতিদিন শ্রমণদের মধ্যে থেকে তিনজনকে পাঠানো হত ড্রাগনের বিগ্রহের কাছে। সেখানে তাঁরা আহার সম্পন্ন করতেন। প্রতি বছর বর্ষাশেষে ড্রাগন নিজ রূপ বদলে হয়ে যেত সাদা কান বিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকায় সাপ। সন্ন্যাসীরা যখন বিষয়টি জানতে পারলেন, ননীভরতি একটি তাম্র পাত্রে ড্রাগনটিকে রেখে দিলেন। প্রতি বছর একবার ঐ পাত্র থেকে বাইরে বেরিয়ে আসত ড্রাগনটি।

এই দেশ সুফলা। সাধারণ মানুষ সুখী-সমৃদ্ধ। তুলনারহিত এই দেশ। বিদেশ থেকে কেউ এলে তাঁরা অতিথি সেবায় মগ্ন থাকে অনিবার।

এই মঠ থেকে পঞ্চাশ ইউইয়েন দূরে আছে আর একখানি মঠ। হুও চিং সেই মঠের নাম। হুও চিং আসলে ছিল এক অশুভ আত্মা। বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে এই আত্মার রূপান্তর ঘটে। এই স্থানে পরবর্তীতে একটি বিগ্রহ তৈরি করা হয়। বুদ্ধের শিষ্য অরহত হাত ধোওয়ার জন্য একটু জল নিলেন, আর হাতের ফাঁক গলে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। জলের এই দাগ আজও দেখা যায় এখানে। সে-জলবিন্দু বয়ে যায়নি নিম্নে। এমনকী মুছেও ফেলা যায়নি। এই জায়গাতেই বুদ্ধের আর একটি প্যাগোডা আছে। এক শুভ আত্মা প্রত্যেকদিন জলসিঞ্চন করে পরিষ্কার রাখে এই প্যাগোডা। কোনো মনুষ্য সহায়তা দরকার নেই। গোটা জায়গাটাজুড়ে ‍রয়েছে শতেক ছোটো ছোটো প্যাগোডা। দিনভর ঘুরে গুনে শেষ হয় না এই প্যাগোডাগুলি। যদি গুনতেই চাও, তবে প্রতিটি প্যাগোডার পাশে দাঁড় করিয়ে দাও একজন করে মানুষ। তারপর গুনে নাও ঐ মানুষগুলিকে।

ছয় থেকে সাতশো জন শ্রমণ নিয়ে এখানেই রয়েছে আর একটি বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারের একটি স্থানে বুদ্ধ কিছু আহার গ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি নির্বাণ লাভ করেন। ঐ বিশেষ জায়গাটি গোরুর গাড়ির চাকার আকৃতির। বিহারের সর্বত্র রয়েছে সবুজ গাছপালা। কেবলমাত্র ঐ স্থানটিব্যতীত। বুদ্ধের পোশাক শুকাতে দেওয়া হত যেখানে সেই স্থানটিও সবুজহীন। সে-সব কাপড়ের দাগ এই স্থানে আজও অমলিন।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Categories
2021-December-Anubad

সিমাস হিনি

ভাষান্তর: অরূপরতন হালদার

 

বাসা বাঁধার জমি
[Nesting-Ground]

স্যান্ডমার্টিনদের বাসাগুলো ছিল নদীর পাড়ে অন্ধকারে
অসংখ্য ছিদ্রের মতো। সে কল্পনা করল বগল পর্যন্ত তার
হাত, হাতায় মোড়া, আর সোজা, কিন্তু একবার একটা মরা
রবিনের পায়ের ঠান্ডা নখ তার হাতে লেগেছিল, আর
পাখিটার যে-ছোট্ট ঠোঁট শুধু তার নজরে এসেছিল তার
ঘনত্ব তাকে অবাক করে দিয়েছিল।

সে দূর থেকে ভেসে আসা কিচিরমিচির শুনতে পাচ্ছিল,
কিন্তু লোকজন তাকে একবার খড়ের গাদার মাথার দিকে
একটা ইঁদুরের বাসা দেখিয়েছিল, বাসার ভেতরে তুষ আর
ভুট্টার ডালপালার গুঁড়ো লেগে থাকা গোলাপি, আর্দ্র গলা
আর পিঠের শব্দ শুনেছিল সে।

সে সান্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে রইল, একদৃষ্টে; অপেক্ষা করতে
করতে তার মনে হল যদি সে পরিত্যক্ত একটা গর্তে কান
লাগিয়ে মাটির নীচের নৈঃশব্দ্য শুনতে পেত।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘The Stations’, 1975]

জুলাই
[July]

হিম-পড়া সন্ধ্যার মধ্যে ড্রামের শব্দ বেজে উঠল, যেন
বাতাসের গম্বুজকে কেউ ডেকে উঠল মৃদুস্বরে। কিন্তু না।
ড্রামের অনেক নিচ থেকেই ড্রামের অস্ফুট স্বর যেন উঠে আসছিল।
অথচ ড্রামের শব্দ তেমন অস্ফুট নয়, বরং হাতুড়ির শব্দের
মতো জোরালো। শব্দ বিষয়ে অভিজ্ঞজনেরা ধীরে ধীরে
এর মধ্যে একটা ছন্দ খুঁজে পেলেন। পাহাড়ের মধ্যে
অনেক দূরে ঢালু অধিত্যকায় পিটিয়ে পাতলা করে ফেলা
হচ্ছিল সব পিপে আর ধাতব পাত।
পাহাড় যেন একটা পেটমোটা শব্দ উদ্গীরণ করা বাক্স,
অনুনাদী, দৈনন্দিন নির্ঘোষের বিপরীতে নীচু তারে বাঁধা,
একটা থেকে যাওয়া জোয়ারের ঢেউ যা যে-কোনো মুহূর্তে
ফেটে পড়তে পারে।
জুলাই মাসের রক্তিম সমুদ্রের ভেতর দিয়ে কমলা রঙের
ড্রামবাদকেরা তাদের স্বপ্নের মধ্যে পছন্দের মানুষটিকে
পায়। সব প্রসারণ, ফুলে ফেঁপে ওঠা যেন সংযোজিত স্বর;
সূর্যাস্তের মধ্যে কলার-শোভিত, লম্বা হাতাওলা সেইসব
মানুষ যারা নিয়তই পিছলে যায়, আর পুলিশের দল
তাদের ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল অব্যবহার্য পাথুরে কয়লার মতো
বাতাস অন্ধকার হয়ে এসেছিল, মেঘাচ্ছন্ন, আর কোনো
কসাইয়ের একটা অ্যাপ্রন। রাত স্তব্ধতায় ফিরে গিয়েছিল
যেন একটা শাদা রঙের মথের মধ্যে জলের প্রবাহ, যুদ্ধ
থেকে বহু মাইল দূরে, আর একটা রক্তের গ্রন্থি এখনও
নালার ভেতর অলস, নিস্তব্ধ

[কাব্যগ্রন্থ: ‘The Stations’, 1975]

পর্যটক
[The Wanderer]

একটা অর্ধবৃত্তের মধ্যে আমরা বুড়ো অঙুলের উপর ভর
দিয়ে অধিপতির টেবিল ঘিরে চকখড়ি দিয়ে যে-রেখা টানা
আছে তার উপর দাঁড়ালাম, আর দিনের ভেতর তখন সূর্য
দুধের উপরিতল গেঁজিয়ে দিচ্ছিল, একটা জ্যামের শিশির
এক ধার গরম হয়ে উঠছিল যার মধ্যে একটা গোটা বিনের
খোলা ফেটে গিয়েছিল। অধিপতি আমাকে সামনে
ডাকলেন, আমার হাতের উপর একটা রুপোর মুদ্রা রেখে
বললেন, ‘ছুটি শেষ হলে এই লোকটি ডেরির দিকে যাত্রা
করবে, তাই ওর জন্য এটা, এটা ওর পাওয়া জলপানি…
আমরা সবাই ওকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এবার যে যার
জায়গায় ফিরে যাও।’
আমি সেই মুদ্রা-প্রদায়ীর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি
আজ, আর এই পরিযায়ী নিঃসঙ্গতা থেকে ফিরে যাওয়ার
কোনো বাসনা নেই আমার। আমি দেখেছি জ্বলন্ত হলঘর,
ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা হৃদয়, ভরে ওঠা এবং পুনরায়
শূন্য হয়ে যাওয়া বেঞ্চগুলো, আসঙ্গের বৃত্তগুলোর ফিরে
আসা এবং ভেঙে যাওয়া। সেই সময় আমি ছিলাম
একজন ধনী যুবক, যে আজ তোমাকে বলবে অস্থিরতার
কথা, রাত-পাহারা, সব পতন, আর নারীদের কেঁদে-ওঠা
চোখগুলোর কথা।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Stations’, 1975]

নিভৃত
[Cloistered]

কলেজের ছোটো গীর্জাটির ঝুঁকে থাকা জানলার কাচে
আলো যেন কড়া পড়ে যাওয়া একটা অস্তিত্ব, উপাসনা-
স্থানের কৃত্রিম পাথরের চওড়া জায়গাটায় দীর্ঘ তেরচা
একটা দণ্ডের মতো জেগে আছে। কর্তব্যরত যাজক তাঁর
উচ্চারণগুলো প্রতিটা থাম আর প্লাস্টারের বিপরীতে
পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন, আর আমরা বেঞ্চির শক্ত প্রান্তে
আমাদের কনুইয়ের শক্তি মেপে নিচ্ছিলাম কিংবা সোনালি
রঙে মোড়া প্রার্থনা-পুস্তকের বেড় ছিঁড়ে ফেলছিলাম।

আমি ওই ছ-টা বছর নিয়ে একটা বেশ লম্বা একটা বই
লিখে ফেলতে পারতাম, আচার-অনুষ্ঠান আর অবসর
বিনোদন নিয়ে পাহাড়ের খাড়া দেওয়ালে একটা ফ্লেমিশ
ক্যালেন্ডার আটকানো। দেখ: আমাদের পেছনে পাহাড়-লাগোয়া
একটা সমাধিক্ষেত্র, আর নদীর ওপারে জমি চষা
চলছে, মাঝখানে একটা সুরক্ষিত শহর। এখানে এক
বিশ্বস্ত কেরানি বিশপের আংটি চুম্বন করছে, এখানে
মরশুমি ক্রীড়ার কারুকার্য, আর একজন অক্লান্ত উদ্ভাসক
এক কোণে তাঁর ডেস্কের উপর অবনত।

পড়ার হলঘরে আমার হাত শীতে কোনো লিপিকরের
হাতের মতো ঠান্ডা। অধীক্ষক পাশ দিয়ে হিসহিস শব্দের
মর্মর তুলে চলে গেলেন, স্তোস্ত্রগীতের বাষ্পের মধ্যে লীন,
তাঁর শক্ত জুতোর চাবুকের মতো ধ্বনি আলখাল্লার নীচে
আয়ত, মৃদু। এরপর আমি AB নামের সরলরেখাটিকে
দ্বিখণ্ডিত করি, আমার পা রাখার জায়গা খুঁজে পাই
লিভির প্রধান ক্রিয়াপদের মধ্যে। আমার কুড়েটা থেকে
আলো ফোটার পর আমি সপ্তর্ষিমণ্ডলকে ভালো করে
আরও একবার দেখি এবং সকালবেলায় একটা বেশ
প্রফুল্ল একটা আত্মজ্ঞান সহযোগে এনামেলের জলের
পাত্রে বরফের কুচি ভেঙে রাখি।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Stations’, 1975]

পশ্চিমের স্টেশনগুলো
[The Stations of the West]

গেইল্ট্যাষ্টের প্রথম রাতে সেই বৃদ্ধা রমণী আমার সঙ্গে
ইংরেজিতে কথা বলছিলেন: ‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি আবছায়া আলোয় একটা বিছানার পাশে বসে
দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে অনর্গল আইরিশ ভাষায় শুনতে
পাচ্ছিলাম কথাদের, একটা ভাষণ যা সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে
চেয়েছিলাম, তার জন্য দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে আমি
তখন ভীষণ কাতর।
আমি পশ্চিমে এসেছিলাম বিশুদ্ধ আবহাওয়া উপভোগ
করতে। স্বপ্নদর্শী যাঁরা, আমার মুখের উপর তাঁদের
শ্বাসবায়ু বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল রান্নাঘরের গন্ধ, তাঁরা
ক্রপীদের কবরের ধুলো মিশিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের
ধর্মের উপোসি লালাদের ভেতর, আর তা দিয়ে আমার
ঠোঁট লেপে দিয়েছিলেন। তাঁরা এফিটকে আহ্বান
করেছিলেন। আমি তখন আরক্তিম, আমার মুখে মাত্র
কয়েকটি কথা ফুটেছিল।
উপরের সেই ঘরটায় আমার সেইসব দিনগুলোয় যখন
চারপাশের সবকিছু মনে হচ্ছিল যেন দৈববাণীর অধীন,
আমার ভেতর সরস্বতীর কোনো বিভূতি ঝরে পড়েনি।
কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে পড়ছিল পশ্চিমের সেই স্টেশনের
কথা, শাদা বালি আর কঠিন শিলাস্তর, সেই আলোর কথা
যা তার নিজস্ব সংজ্ঞার মতো উঠে গিয়েছিল রানাফাস্ট
আর এরিগালের উপর দিয়ে, আনাঘ্রা আর কিনকাস্লাহর
উপর দিয়ে: এই নামগুলো ছিল বহনযোগ্য সেইসব
বেদীর পাথর, অবিমিশ্র প্রাকৃত উপাদান।

(ক্রপী: আইরিশ রিপাবলিকান বিদ্রোহী (সাধারণত অপভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।), এফিট: প্রাচীন এথেন্সের বিচারালয়ের সদস্য যাঁরা কিছু হত্যার মামলার বিচার করেছিলেন।)

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Stations’, 1975]

আশ্চর্য ফল
[Strange Fruit]

এই সেই কিশোরীর মাথা যেন কবর থেকে তুলে আনা লাউ।
ডিম্বাকৃতি, আলুবোখারার মতো গা, দাঁত যেন শুকনো খেজুর।
তারা তার চুল থেকে ভিজে ফার্নের পরত খুলে নিচ্ছিল
যেন সে-কেশরাশির জটা তারা উন্মুক্ত করে দেবে,
তার অটল সৌন্দর্যের মধ্যে বয়ে গিয়েছিল হাওয়া।
চর্বির মোহঘোর, নশ্বর ঐশ্বর্য:
তার ভাঙা নাক তৃণক্ষেত্রের একটা টুকরোর মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন,
তার চোখের গর্ত পুরোনো কারুকাজের মধ্যে শূন্য এক পুকুর,
ডাইওডেরাস সিকিউলাস স্বীকার করেছেন
নীচের এইসব ব্যাপারে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা:
নিহত, বিস্মৃত, নামহীন, ভয়াবহ
বালিকা যার মাথা কেটে ফেলা হয়েছে, অপ্রস্তুত করে দেওয়া কুঠার
আর স্বর্গসুখ, যা আপাতভাবে মনে হচ্ছিল ভক্তিশ্রদ্ধার ব্যাপার
তাকেও অপ্রস্তুত করে দিচ্ছিল।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘North’, 1975]

ঝিনুক
[Oysters]

আমাদের খোলাগুলো প্লেটের উপর খটখট শব্দ করছিল।
আমার জিভ যেন ভরে ওঠা মোহানা,
তারার আলোয় ভরা আমার তালু ঝুলন্ত, স্তব্ধ:
আর আমি লবণাক্ত কৃত্তিকার স্বাদ নিয়েছিলাম
কালপুরুষ জলে তার পা ডুবিয়ে দিয়েছিল।

জীবিত এবং অতিক্রান্ত
তারা তাদের বরফের বিছানায় শুয়ে থাকে
দ্বিকোষগুলি: ফেটে যাওয়া কন্দ
আর সমুদ্রের ছেনালিময় দীর্ঘশ্বাস।
অযুত তারা ছেঁড়া, খোসা ছাড়ানো, ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে।

আমরা সেই সৈকতের দিকে গাড়ি ছুটিয়েছিলাম
বেলেপাথর আর ফুলগুলোর মধ্যে দিয়ে
আমরা উদ্যাপন করছিলাম আমাদের বন্ধুতা,
একটা নিখুঁত স্মৃতি যেন নির্মিত হয়ে চলেছিল
খড়ের ছাউনি আর মাটির বাসনপত্রের ঠান্ডার মধ্যে।

আল্পসের উপর দিয়ে খড় আর তুষারের মধ্যে
বস্তাবন্দি অবস্থায় রোমানরা তাদের সব ঝিনুক
দক্ষিণ থেকে রোমের দিকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল:
আমি দেখেছিলাম স্যাঁৎসেঁতে সেইসব ঝুড়ি উগরে দিচ্ছিল
পাতার ঠোঁটঅলা, সমুদ্রের লবণে বিদ্ধ
বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সেইসব ভুরিভোজ

আর আমি ক্রমশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলাম এই ভেবে যে
সমুদ্র থেকে উঠে আসা কবিতা বা স্বাধীনতার মতো
উজ্জ্বল আলোয় আমার দেহ এলিয়ে দিতে পারছিলাম না।
আমি ইচ্ছে করেই আমার গোটা দিনটাকে খেয়ে ফেলেছিলাম
যাতে এর তীব্র, কটু স্বাদ আমাকে
আমার ক্রিয়া, বিশুদ্ধ ক্রিয়ার ভেতর দ্রুততর করে তোলে।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

টুম রোড
[The Toom Road]

একদিন বেশ সকালে আমি সাঁজোয়া গাড়িদের দেখলাম
কনভয়ের মধ্যে তারা শক্তপোক্ত টায়ারের উপর ভর করে
পাখিদের মতো কিচিরমিচির শব্দ করছিল,
সবার গায়ে ছিল ভুর্জের ডালপালা দিয়ে বানানো ছদ্মবেশ,
আর কানে হেডফোন গোঁজা সৈন্যরা গম্বুজের চূড়ায় দাঁড়িয়েছিল।
কতক্ষণ তারা আমার রাস্তা দিয়ে এভাবে যাওয়া-আসা করেছিল
যেন তারাই এ-রাস্তার মালিক? সারা দেশ ছিল ঘুমন্ত।
আমার ছিল আসা-যাওয়ার জন্য নিজস্ব রাস্তা,
শস্যখেত, আর গবাদি পশুরা,
ট্র‍্যাক্টরগুলো খড়-টানা মই নিয়ে খোলা ছাউনির নীচে
যেন ঝাঁকিয়ে উঠছিল,
শস্যের গুদাম, ঠান্ডা হয়ে থাকা গেটগুলো, ভিজে শ্লেটপাথর,
বাইরের ছাদে ছড়িয়ে থাকা সবুজ আর লাল লতাপাতা।
পেছনের দরজায় খিল দেওয়া বাড়িগুলোর মধ্যে
আমি কার কাছে ছুটে গিয়ে জানাব
দুঃসংবাদ যে বয়ে এনেছিল তার কথা, সেই ক্ষণকালের অভ্যাগত
যে ছিল প্রত্যাশিত, তাকে কি দূরে রাখা সম্ভব ছিল?
যারা বীজ বুনেছিল, যারা সমাধিফলকগুলো খাড়া করেছিল…
হে সারথি, তোমার ঘুমন্ত বন্দুকগুলোর উপরে
এখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে, যখন তুমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাও
স্পন্দমান দাঁড়ানো
সেই অদৃশ্য, দৃঢ় প্রস্তরফলক।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

জলপান
[A Drink of Water]

মেয়েটি রোজ সকালে জল নিতে আসত
যেন সেই পুরোনো বাদুড় মাঠের মাঝখানে বাতাসে টলায়মান:
পাম্পের তীব্র কাশির দমক, বালতির ঝনঝন শব্দ আর
ভরে উঠতে উঠতে সে-শব্দের ধীরে কমে আসা,
যেন তারই আগমনবার্তা। আমার মনে পড়ে
তার ধূসর রঙের অ্যাপ্রন, তার উছলে ওঠা বালতির
ক্ষতচিহ্নে ভরা সাদা এনামেল, আর উঁচু তারে বাঁধা
তার কণ্ঠস্বর যেন পাম্পের হাতলের শব্দ।
যখন পূর্ণিমার চাঁদ তার দেহের তীক্ষ্ণ কোণ পার করে
আকাশে উঠে আসে
তার জানালা দিয়ে রাত নীচে পড়ে যায়
শুয়ে থাকে টেবিলের উপর বয়ে চলা জলের ভেতর।
আমি যেখানে আরও একবার
জল পান করার জন্য মুখ নামিয়ে দিয়েছিলাম
আমি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছিলাম
তার কাপটির উপর লেখা সেই সাবধানবাণীর প্রতি
দাতাকে স্মরণে রেখো, যা তার ঠোঁট থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছিল

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

ঈর্ষা-সম্বন্ধীয় একটা স্বপ্ন
[A Dream of Jealousy]

তুমি এবং আর একজন মহিলার সঙ্গে আমি হাঁটছিলাম
গাছপালায় ঘেরা একটা বাগানের মধ্যে, ঘাসের মর্মর
চিন্তামগ্ন আমাদের নৈঃশব্দ্যের ভেতর
তার আঙুল চালিয়ে দিয়েছিল
আর গাছগুলো খুলে গিয়েছিল একটা ছায়াচ্ছন্ন
আকস্মিক উজ্জ্বলতায় যার ভেতর আমরা বসে ছিলাম।
আমার মনে হল যেন আলোর সরলতায়
আমাদের মধ্যে ভয় জেগে উঠছিল
আমরা আমাদের বাসনার কথা বলেছিলাম আর
ঈর্ষা আমাদের ঘিরে ধরছিল,
আমাদের সংলাপ যেন একটা ঢোলা আলখাল্লা
অথবা চড়ুইভাতির জন্য পেতে রাখা একটা শাদা টেবিলক্লথ
যেন একটা আচরণবিধির বই নির্জন প্রান্তরে পড়ে আছে।
‘আমাকে দেখাও’ আমি বলে উঠলাম আমার সঙ্গীকে
‘আমি যা সবচেয়ে বেশি কামনা করেছি
তোমার স্তনের উপর এলিয়ে থাকা
সেই ফিকে লাল রঙের তারা’।
সে রাজি হয়েছিল। হায়, না এইসব কবিতা
না আমার আমার বিচক্ষণতা আর ভালোবাসা
তোমার বিক্ষত দৃষ্টিকে সারিয়ে তুলতে পারে।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

Categories
অন্যান্য

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

১০

সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু, কাছে পিঠে কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠেছিল। কেন-না এ-এলাকাটা নতুন গড়ে উঠেছে। মুদিয়ালির কিশলয় গলির পেছন থেকে নিয়ে পার্টি অফিসের পেছনের কয়েক ঘর বিহারীবস্তি ছুঁয়ে ওদিকে ফতেপুর সেকেন্ড লেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট যে-হোগলার জলাজঙ্গলটা বিরাজিত ছিল জলের মাঝে মাঝে কয়েকখানি শিমুল আর কদমের গাছ নিয়ে, এই তো সেদিনই যেন-বা, বিশাল বিপুল এক থম মারা নির্জনতা বুকে জাগিয়ে— যে-নির্জনতা ভর দুপুর বেলাতেও মাঝ-নিশার অন্ধকার ডেকে আনত, যেখানে দিনমানে কখনো কখনো বেওয়ারিশ লাশ ভেসে উঠত এই সেদিনও, সেই জলাটা একদিন রাতারাতি ভানুমতীর জাদুতে বা ময়দানবের ছোঁয়ায় বর্তমানে মধ্যবিত্ত মানুষের একতলা বা দোতলার জমাট বসতি, পুরোনো জাগানো দুয়েকটি শিমুল বা কদম গাছ সমেত, যেগুলো আপাতত আজও বেঁচে মানুষের লোভী শানিত নখর এড়িয়ে। এখন ময়দানব কৃষ্ণ হলেও আসল ভানুমতী-জাদুকাঠিটা ছিল আসল ভগবান প্রদীপ রায়ের হাতেই! লোকে বলে আধাআধি হিস্‌সা ছিল নাকি কৃষ্ণের আর প্রদীপের। লাল পার্টির যাই বদনাম থাকুক তারা কিন্তু দলের ওপর থেকে নিচু সবাইকে দিয়ে-থুয়েই খায়। যেমন দেখতে দেখতে উবে যায় ঘেঁষকালের মাঠ, শান্তিনগরের বিপুল সেই হোগলার বন— না, সেখানে ইদানীং আর লাশ ভেসে ওঠে না, কেন-না লাল জমানার মধ্যগগনে শান্তি হি শান্তি! এবং টাকা মাটি, মাটি টাকা— এ ঈশ্বরীয় বাণীটিও বাস্তব আদল পায়! সে-সব টাকাও সমান বখরায় ভাগ হয়েছিল কৃষ্ণ আর প্রদীপের মধ্যে। যেমন উবে যায় লালার মাঠ, পাল বাগানও। শুধু আজও রয়ে যায় বাঁধা বটতলার বাবুলের গলির পেছন থেকে নিয়ে রামদাসহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত হোগলার জলা-জঙ্গলটা, যেহেতু সেখানে মাঝে মাঝে জেগে থাকা দ্বীপে চোলাইয়ের চাষ হয়, এবং অবশ্যই পার্টি, পুলিশ, প্রশাসনের নজরের আড়ালেই, যেহেতু জলাটা কলকাতা কর্পোরেশন আর মহেশতলা গ্রামপঞ্চায়তের সীমানায়, ফলে দুই থানার মাঝখানে নিশ্চিন্তে বিরাজমান! হ্যাঁ, বর্তমানে মেটেবুরুজ যেমন উন্নয়নের প্রগাঢ় শরিক হয়ে মিউনিসিপালিটির ঊর্ধ্বে উঠে কলকাতা কর্পোরেশনের বর্ধিত এলাকা— ওয়ার্ড নং ১৩৩-১৪১, মহেশতলাও ক-বছর বাদে উন্নততর উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে পঞ্চায়েত থেকে মিউনিসিপালিটিতে উন্নীত হয়ে যাবে।

যে-কথা হচ্ছিল, সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু পুরোনো জাগানো শিমুল কিংবা কদম গাছে কোকিল ডেকেছিল, যা সেই দুপুরটাকে বিষণ্ণ ও ঘন করে তুলেছিল। আর সেই ঘন দুপুরখানি আরও ঘনান্ধ হয়ে উঠেছিল যখন কৃষ্ণ ঘরে এসেছিল, কেন-না তার শ্যাম মুখখানি ছিল কালো, থমথমে। ফলে সে-ক্ষণের ঘন আঁধার ভাঙতে সাহস হয়নি রূপার। বিস্মিত রূপা অপাঙ্গে তাকিয়েছিল কেবল, কেন-না কৃষ্ণের আজকের ফেরাটা সঠিক সময়ের ছিল। পরে স্নান করে, ভাত খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ফুকরে উঠেছিল কৃষ্ণ আপন মনে নিজেকে শোনাতেই যেন,— হেরে গেলাম। একটা বাচ্চা ছেলে হারিয়ে দিল! নাক-মুখ দিয়ে গলগলিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে সে, মনের চাপা হাহাকারটাকেই উগড়ে দেয় যেন।

ক-দিন ধরেই শেরু নামটা শুনছে রূপা। ধানখেতি বস্তির বছর সতেরোর কিশোর সে। কিশোরই তো, তবুও তার করিশ্মায় আব্বাস-বাদশার একচেটিয়া খানদান ভেঙে চৌচির যেন। কাচ্চিসড়ক, আয়রন গেট রোড, শাহী আস্তাবল লেন, ধানখেতি, বাত্তিকল কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সে ইদানীং! অথচ কেউ তাকে দেখেনি নাকি! ডকের চোর, ট্রান্সপোর্টার, লেবার কনট্রাক্টর— সবার কাছ থেকে তোলা তুলত তার দল। যারা এতদিন আব্বাসকে দিয়ে এসেছে, তারা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। ফলে দু-একটা লাশ পড়ে যায়, যে-খেলার যা নিয়ম তা মেনেই। ফলে টাকা আপনি পৌঁছে যেতে থাকে তার কাছে। সে-কিশোর, শেরু সব টাকা নাকি বিলিয়ে দেয় ধানখেতি-বাত্তিকলের গরিব সকল মানুষকে। পুলিশ অনেক বার রেড করেছে ধানখেতি বস্তি আচমকা, দিনে-রাতে। না, শেরুর টিকিটি খুঁজে পায়নি তারা। বোরখা পরা মহিলারা প্রত্যেকবারই পুলিশকে ঘিরে ধরে জানিয়েছে যে,— শেরু-এরু কিসিকো হমলোগ নাই জানিস। না, পুলিশরা বস্তির কোনো ছোকরাকেও ধরতে সক্ষম হয়নি। কেন-না সে মহিলাকুল সকল সময়েই তাদেরকে ঘিরে থেকেছে। পুলিশ জোরও করতে ভয় পেয়েছে— ডি॰সি॰ হত্যার কেসটা যে তখনও দগদগে। দ্বিতীয়ত এ-বস্তির গলির গলতা, তার ভুলভুলাইয়া! সরু সে-গলির দু-পাশে ঝুঁকে আছে বস্তির খাপরা-টালির চাল, মাথা ঠেকাঠেকি করে যেন, আবার হঠাৎ তুমি দেখলে সে-গলি শেষ হয়েছে কোনো বাড়ির উঠোনে, বেকুব তুমি জানো না যে, সে-বাড়ির লাগোয়া কাঁচা ড্রেনের পাশ দিয়ে আবার এক নতুন গলির শুরু। যদি-বা জেনে নিয়ে সে-পথ ধরে এঁকে বেঁকে এগোলে, আচমকা দেখলে তুমি সহসা হাজির একচিমটে এক খোলা প্রান্তরে, তাকে ঘিরে টালি-খাপরায় ছাওয়া দশ ঘর! ব্যস, ফেঁসে গেলে তুমি! যদি শত্রু হও, পিছন পানে ফিরতে চেয়ে দেখলে সে ড্রেন ঘেঁষা গলির আধা- অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে কয়েকটা শার্দূল চোখ সে-আঁধার চিরে! অগত্যা পুলিশকে ফিরে যেতে হয় বার বার মেন রাস্তায় খাড়া তাদের গাড়ির নিরাপদ ঘেরাটোপে। কিংবা এ এমনও চাল হতে পারে পুলিশ-প্রশাসনের আব্বাস-বাদশাকে সবক শেখানোর! হতে পারে বখরায় কম পড়ছে লালবাড়ির।

বাদশা নামটা ইদানীং শুনেছে রূপা। দেখেছেও একদিন এক ঝলক। হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল সে— ছ-ফুটের ওপর লম্বা, টকটকে গায়ের রং, সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো, এক কানে ঝিলিক দিচ্ছে সোনার হাত— পাঞ্জা। হ্যাঁ, বাদশার মতোই তার শান-সওকত। অল্প দিনেই আকাশ ছোঁয়া উত্থান। আব্বাসের হাত ওর মাথার ওপর, ও নাকি পরের ভোটে সবুজ দলের উমিদবার-প্রার্থী এবং জিতবেও, কেন-না আব্বাস ফ্যাক্টর। শোনা যায় সবুজ পার্টির শিয়ালদ-র ছোড়দার সঙ্গেও ওঠাবসা, বেরাদারি। তবে এটা সত্যি যে, কলকাতা-হলদিয়া ডকের অর্ধেক ট্রান্সপোর্ট, ট্রেলারের মালিক নাকি সে। আবার এদিকের জাহাজ কারখানা, রাজাবাজার ডক ইয়ার্ড, জি॰ই॰সি॰, ল্যাম্প ফ্যাক্টরি, সাবান কল— সবের লেবার কনট্র্যাক্টের অর্ধেক তার, বাকি অর্ধেক প্রদীপ রায়ের বকলমে কৃষ্ণের।

সহসা সে দুপুরের শব্দহীনতাকে চলকে দিয়ে, ফলত রূপার ভাবনাকেও, কৃষ্ণ বাঁহাতের তালুতে ডান হাতের ঘুসির আঘাত হেনে হিসহিসিয়ে উঠেছিল— গো হারান হেরে গেলাম! দাঁড় করিয়ে গোল দিয়ে চলে গেল বাচ্চা ছেলেটা! মুড়ি-মুড়কির মতো পেটো। সঙ্গে শূন্যে ফায়ার! আমরা পালটা দিলে পাড়ার সাধারণ মানুষের ক্ষতি হত। সেটা আমি থাকতে হার্গিস কোনোদিন হতে দেব না। অপেক্ষায় ছিলাম, যদি প্রদীপদার বাড়ি অ্যাটাক হত তখন তো…। আর প্রদীপদা বলে কিনা,— ‘আমরা কাপুরুষ! আমাদের নাকি ফালতু পুষছে!’ একটু থামে কৃষ্ণ, যেন-বা দম নেয় ক্ষণিক ভেতরের রাগটাকে পরিপূর্ণ ভাবে উগড়ে দেবে বলে।

— আমরা ফালতু! যে-যুদ্ধের যে-কৌশল— আমরা মোটে জনা দশেক আর ওরা পঞ্চাশ-ষাট জন। আগে কোনো খবর ছিল না, এমনই হঠাৎ চাল! তা তোর গোয়েন্দা-পুলিশ কি ঘাস ছিঁড়ছিল! শুধু আমরাই ফালতু! আমদের পোষে হারামিটা! কে কাকে পোষে! আমরা আছি বলেই তো তুই আছিস! শালা কালা নাগ!

ঘটনাটা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতোই, যেহেতু তা চিন্তারও অতীত ছিল, কেন-না প্রদীপ রায়ের আস্তানা ফতেপুর সেকেন্ড লেনের নোনাপুকুরে, খাঁটি হিন্দু বাঙালি পাড়া, তাছাড়া কৃষ্ণের খাস তালুক— সবচেয়ে বড়ো কথা প্রদীপ রায় নামের প্রতাপ, মাটির দুর্গের আসল নবাব যে, যতই ভোটে হারুক সে, বা মানুষ যতই অপছন্দ করুক না কেন! এ হেন প্রদীপ রায়ের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল একটা নাদান বাচ্চা ছেলে, নালায়কই যে! যা আব্বাস-বাদশারও স্বপ্নে হার্গিস আসবে না। তাও দু-আড়াই মাইল দূরের ধানখেতি থেকে উজিয়ে রামনগর লেন হয়ে, মিঠাতলাও, ব্রাহ্মসমাজ রোড, করমঞ্জিল, মুদিয়ালি ফার্স্ট লেন, মুদিয়ালি হরিসভা পার করে, ফতেপুর সেকেন্ড লেনের মতো হিন্দু পাড়ায় রঙবাজি, প্রদীপ রায়ের প্রতাপকে পায়ে দলে! এক ফুঁয়ে নিবিয়ে! বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো পেটো ফেটেছে। নাঃ, দম আছে ছেলেটার! সব্বাই একবাক্যে সেলাম ঠুকেছিল শেরুকে। এখন নেতার প্রতাপ পাংচার হলে নেতা তো সর্বহারা! সমান সত্য মস্তানের ক্ষেত্রেও। প্রতিটা মানুষ ঘরে লুকিয়ে ক্ষ্যা-ক্ষ্যা হেসেছিল, যদিও মনে মনে। ফলে গল্পের গোরু গাছ ছাড়িয়ে আকাশে ভেসেছিল।

— আবে, কালা নাগ, বাপকা আওলাদ হো বাহার নিকালিস!

— কিয়া বে শালা নাগ, চুহা বন গায়িস ক্যা!

একটা করে ডায়ালগ একটা করে পেটো।

— দেখলিস তো শেরুকা করিশ্মা!

— ইয়ে তো জাস্ট ট্রেলার থা বে নাগ কা আওলাদ। পিকচার অভি বাকি হ্যায়।

এমন বলেই নাকি ওরা ফিরে গিয়েছিল পেটোর বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে, সঙ্গে শূন্যে ফায়ার। এমনকী এ-গানও নাকি ভেসে উঠেছিল পেটো-পিস্তলের সংগতে— টিপ টিপ বরষে পানি, পানিমে আগ লাগে তো…! যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল, তেমনই ঝড়ের বেগে ফিরেও গিয়েছিল ওরা, যে-ঝড়ে প্রদীপ রায়ের সাজানো বাগান একটু হলেও তছনছ হয়েছিল বৈকি!

— আরে ওই ফর্সা পানা লম্বা ছেলেটাই শেরু।

— ধুস! শেরু তো কালো।

— যাইহোক, দেখিয়ে দিল বটে ছেলেটা। সত্যি দম আছে। নইলে বাঘের গুহায় এসে এমন রংবাজি!

কথারা আড়ালে আবডালে গড়ে ওঠে, হাওয়া পায়, ভেসে যায় দূরে রং পালটে পালটে।

হ্যাঁ, মুসলিম মহল্লায় চিকন কালো প্রদীপ রায় কালা নাগ বলেই প্রখ্যাত।

তবে নাগ তো! শীতঘুমে গেলেও যখন গর্ত থেকে বের হয়ে আসে শীত-অবসানে, তখন বিষথলি তার কানায় কানায় ভরা, টনটনায় তা যতক্ষণ না এক ছোবলে সবটুকু বিষ উগড়োতে পারে সে। এর পরের সময়টা, যা শীততুল্যই যেন প্রদীপ রায়ের সাপেক্ষে, কেন-না এই সময়টা সে নির্বিকার থাকে। আর এ-শীতলতার ঘেরাটোপে সে প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরে প্রভাব চালায় নীরবে, যেহেতু এটা প্রবাদ যে, আগুনের ফুলকির পিছনে হাওয়া থাকেই! সে-হাওয়ার উত্স খুঁজতে জানতে হয়। এবং ওপর তলার একটু তল্লাশিতেই খোঁজ মেলে এ-আগুনের পিছনে সেই শিয়ালদার ছোড়দা যোগ! অতএব গোপন রফা হয় রাজায় রাজায়। তবে সে-রফা অমূল্য আপোশের, নাকি মূল্যযুক্ত পাবলিক তা জানতে পারে না। শুধু ভাসা ভাসা এটুকুই জানতে পারে যে, সবুজ পার্টির নেতা সে-কিশোরকে নাকি ডেকে পাঠিয়েছিল এক ধোঁয়ামাখা সাঁঝে তাদের বাঙালিবাজার-বিচালিঘাটের দোতলা পার্টি অফিসে— হ্যাঁ, অতি অবশ্যই ইমানের শপথ চোয়ানো গোপনে।

কাচ্চি সড়ক, বাঙ্গালিবাজার থেকে শাহী ইমামবারা, থানা, লাল মসজিদ, শ্লটারহাউস রোড তক খানদানি মেটেবুরুজ সকালে শুনশান, বেলা যত বাড়ে, দিন ঢলে, আঁধার ঘনায় ততই সে জেগে ওঠে জুলুশে-জৌলুসে। সে-সাঁঝও ছিল তেমনই জৌলুসময়। একটি দোহারা কিশোর চোখের নির্লিপ্ত ইশারায় তার সঙ্গি চারজন সদ্য যুবাকে কাছে-দূরে লোকের ভিড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে তরতরিয়ে উঠে যায় পাঞ্জাছাপ পার্টি অফিসের দোতলায়। সঙ্গে সঙ্গে পানের গুমটিতে, সামনের ফুটপাথে ফলের দোকানে কয়েকজন ক্রেতার মধ্যে আলতো চোখাচোখি হলে কিছু বাদে লুঙ্গি-শার্ট পরা একজন উঠে যায় ওপরে নিঃশব্দে। কত লোকই তো এ-সময়ে পার্টি অফিসে যায় দরকারে-অদরকারে! ভেতরে লোক আছে দেখে যেন থমকায়, ইতস্তত করে, নাদান পাবলিক হেন। ততক্ষণে চোখে-চোখে যা কথা হওয়ার হয়ে গিয়েছে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে। কেন-না ঘরের ভেতর থেকে নেতাসাবের খাস চেলা খিঁচিয়ে উঠেছিল,— থোড়া ঠাহর যাও বাহার। অব জরুরি মিটিন চল রহা হ্যায়।

পিঠ ফেরানো কিশোরটির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছু সংকেত হানলেও হানতে পারে, যেহেতু সে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়েছিল এবং একজন এলেবেলে মানুষকেই শ্লথ পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল। কিন্তু ইমান শব্দটা, ও বাইরে তার অতি বিশ্বস্ত সঙ্গীদের উপস্থিতি তাকে নিশ্চিন্ততা দিয়েছিল। কিন্তু তার অজান্তেই লোকটি সিঁড়ির লান্ডিং-এ দাঁড়িয়েছিল দেওয়ালে পিঠ দিয়ে শিকারি শার্দূলহেন বিভঙ্গে। কিছু বাতচিত, কিছু চেতাবানি, কিছু লেনদেন ও উত্সাহব্যঞ্জক কথার শেষে কিশোরটি দরজা পার হয়ে সিঁড়ির মুখে ঘুরতেই শার্দূল হেন লোকটি চকিতে লুঙ্গির পেছন থেকে সাইলেনসার লাগানো পিস্তল বার করে নিঃশব্দে ছ-ছ-টা দানা গেঁথে দিয়েছিল কিশোর শেরুর শরীরে, নামে-কামে শেরই ছিল যে, সেহেতু ঘাতকজন পুলিশি শিষ্টাচারে দু-পা জোড়া লাগিয়ে স্যালুট ঠুকেছিল লুটিয়ে পড়া বীর শত্রুকে।

ততক্ষণে সিভিল ড্রেসের বাকি পুলিশরা পজিশন নিয়ে নিয়েছে পিস্তল উঁচিয়ে,— ভিড় হটাইয়ে সবলোক। জলদি। বিচালিঘাটের গলির ভেতর লুকিয়ে থাকা পুলিশ ভ্যান ত্বরিতে চলে আসে অকুস্থলে। পুলিশ দখল নিয়ে নেয় গোটা চত্বরের। ঝপাঝপ শাটার নামে দোকানে। ফুটপাথের হকারের মাল গড়াগড়ি যায়। যেমন সিনেমায় হয় তেমনই। শেরুর সঙ্গীরা বিপদের গন্ধ পেয়ে উদ্‌ভ্রান্ত মানুষের ভিড়ে বোধহয় নিঃশব্দে মিশে গিয়েছিল। ভ্যানে চেপে শেরু চলে যায় লালবাজারে। সবুজ নেতা চোখের আঁশু মুছে ধরা গলায় বলেছিল পরে সংবাদ মাধ্যমকে— কৌন থা হামকো কিয়া মালুম! উ তো উপর ভি নেহী উঠ সকা। হাম উসকা সুরত ভি নেহি দেখ সকা। সিঁড়িমেই তো পুলিশ উসকো মার দিয়া। পুলিশ কা ইয়ে গুণ্ডাগর্দিকো হমারা পার্টি অপোজ করতে হ্যাঁয়।

ততক্ষণে বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে এই খবর ঝলসে ওঠে যে— মেটিয়াবুরুজের শেরু নামক কুখ্যাত গুন্ডা পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত আজ সন্ধ্যায়।

সে-সাঁঝে বাত্তিকল-ধানখেতিজুড়ে শকুন সান্নাটা নেমেছিল, যা থকথকে কালো।

হঠাৎ শাঁখের আওয়াজে বাস্তবে ফেরে রূপা। সন্ধ্যের ধূপ-জল দিতে দোকানের বাইরে আসে সে। পাশের হলটা অভ্যাসবশত নজর টানে তার। আবছা অন্ধকার পোড়ো প্রাসাদের কঙ্কাল যেন তা। কে এক শামবাবু কিনে নিয়েছে হলটা— শামবাবুর আসল নাম রূপা জানে না, এটুকুই শুনেছে যে, সে নাকি বটতলার খুব বড়ো দর্জি ওস্তাগর— কাঁঠাল বেরিয়া রোডে হাভেলি তার। হয়তো বকলমে আব্বাসেরই লোক! ফতেপুরের অত বড়ো গ্যারেজটাও নাকি কিনে নিয়েছে, হাসপাতাল বানাবে। তার দোকানটাও কিনতে চায় সে। না, ন্যায্য দামই দেবে বলেছে, বরং বেশিই তা। বিক্রিই করে দেবে সে। কী হবে আর রেখে? নেহাত স্মৃতির অভ্যাস, তাই আসা! লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তিতে ধূপকাঠিটা গোঁজার আগে কৃষ্ণের ছবিতেও একবার ধূপ দেখায় সে।— বোকা, বড়ো বোকা ছিল লোকটা, শেরুর মতোই। রাজনীতির দাবার চালে সামান্য বোড়েই শুধু। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে জমাট বাঁধতে থাকে দোকানজুড়ে। সুইচ টিপে আলো জ্বালে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Categories
অন্যান্য

সোমা মুখোপাধ্যায়

তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়

সংস্কৃত তন্তু থেকে তাঁত শব্দের উৎপত্তি। বাংলার তাঁত এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প। একসময় মানুষ গাছের ছাল বাকল দিয়ে পোশাকের প্রয়োজন মেটাত। ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী বসতি ও গড়ে ওঠে। মানুষ নিজের ব্যবহারের জন্য বোনা শুরু করে। পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধরনের বোনার এই পদ্ধতি রয়েছে। এভাবে বাংলার তাঁতশিল্পের এক সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই তাঁতের কাজ হয়। এর মধ্যে হুগলি জেলার ধনিয়াখালি, রাজবলহাট, বেগমপুর এইসব অঞ্চলে তাঁতের সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। এই লেখায় রাজবলহাটের এক তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়ের সঙ্গে পরিচয় করাব।

বছর তিনেক আগে রাজবলহাটে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আলপনা ভড়ের সঙ্গে। রাজবলহাটের প্রসিদ্ধি দেবী রাজবল্লভীর জন্য। সকালে পৌঁছে মন্দিরে ঘুরে প্রসাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এই সময় পরিচয় হয় আলপনা ভড়ের স্বামী রবিন ভড়ের সঙ্গে। আমার গবেষণা বিষয়ে শুনে তিনি ওঁর বাড়ি নিয়ে যান। মন্দির থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক। শুনেছিলাম রাজবল্লভীর মন্দির ঘিরে আছে তাঁতিপাড়া। ঠকঠকি তাঁতের শব্দে মুখরিত থাকে এ-অঞ্চল।

গ্ৰামের পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেটাই নিজের কানে শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম সেই প্রচলিত কথা ‘চরকার ঘর্ঘর পড়শির ঘর ঘর’। এখানে সব বাড়ির সামনে রয়েছে কাঠে জড়ানো রঙিন সুতো। রোদে শুকিয়ে নেবার জন্য। বোনার‌ নানা রঙে সুতোকে রং করে নেওয়া হয়। আগে এখানকার মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো কালো রং করা। যদিও এর ভেতর অনেক পাকা বাড়িও আছে। আর আছে অনেক টেরাকোটার বর্ষপ্রাচীন মন্দির।

রবিন ভড়ের বাড়িতে ঢুকেই সামনের ঘরে তাঁত বুনতে দেখা গেল আলপনা ভড়কে। নদিয়ার নবদ্বীপে মহিলাদের তাঁত চালানোয় নিষেধ আছে বলে শুনেছি। চাক্ষুস এভাবে তাঁতবোনা দেখার অভিজ্ঞতা এর আগে ছিল না। এখানে সকলের হাত চালানো তাঁতটাই বেশি। ওঁরা স্বামী স্ত্রী দু-জনে আমাকে পরিচিত করান তাঁত যন্ত্রটির সঙ্গে।

আমরা টানাপোড়েন শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এখানে এসে তার আসল অর্থটা জানলাম।

তাঁতের মধ্যে কুণ্ডলী আকারে সুতো টানটান করে ঢোকানো থাকে। এখানে দু-ভাবে সুতো থাকে। লম্বালম্বিভাবে থাকা সুতাগুলিকে টানা এবং আড়াআড়িভাবে থাকা সুতাগুলিকে পোড়েন বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে বোনা হয়। তাঁত হচ্ছে কাঠের ফ্রেমের একটা যন্ত্র। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে।

“বাংলা তাঁতযন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু (spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল— শানা, দক্তি ও নরাজ। শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তার উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তার নাম মুঠ-কাঠ। শানা ধরে রাখার এই দু-খানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম দক্তি।

শানায় গাঁথা আবশ্যকমতো প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠের উপর জড়িয়ে রাখা হয়, একে বলে টানার নরাজ। আর তাঁতি যেখানে বসে তাঁত বোনে, সেখানে তার কোলেও একটি নরাজ থাকে— তার নাম কোল-নরাজ। টানার নরাজের কাজ হল টানার সুতাকে টেনে ধরে রাখা আর কোল-নরাজের কাজ হল কাপড় বোনার পর কাপড়কে গুটিয়ে রাখা।” (এই অংশটি উইকিপিডিয়া থেকে ব্যবহার করা হয়েছে)

এই সমগ্ৰ প্রক্রিয়াটি মূর্ত করে তুলেছিলেন আলপনা ভড়। আলপনা দেবীর বাবার বাড়ি রাজবলহাটেও। তাঁরাও তাঁতের কাজ করেন। কিন্তু আলপনা দেবী কখনো বিয়ের আগে তাঁত বুঝতেন না। বিয়ের পরেই এই কাজটা তিনি নিজের চেষ্টায় শেখেন। সাধারণত তাঁতি পরিবারের মেয়েরা চরকা দিয়ে সুতো কাটার কাজটাই করে থাকেন। তাঁত বোনার কাজ করেন খুব অল্প মেয়েরাই।

পাঠক ওপরে তাঁত বোনার বিষয়ে যে-লেখাটা রয়েছে তা পড়ে নিশ্চয় উপলব্ধি করবেন এই কাজটা অত্যন্ত জটিল। অনেকগুলো ধাপ আছে একটা শাড়ি বোনার। সেই কাজটিই নিজের আগ্ৰহে শিখেছেন আলপনা দেবী। আমরা নারী ক্ষমতায়ণ নিয়ে অনেক আলোচনা করি। কিন্তু একজন ক্ষমতাময়ী নারীকে নিজের সামনে দেখে সত্যি অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়। এই শিক্ষা তো আলপনা ভড়ের অর্জিত। কতটা আগ্ৰহ থাকলে একজন সংসারী মহিলা এটা রপ্ত করতে পারেন তা আর নতুন করে বলতে হয় না।

আলপনা দেবীদের দুই পুত্র। দু-জনেই অন্য পেশায় নিযুক্ত। এছাড়া পরিবারে আছেন রবিন ভড়ের মা ও বাবা। বাড়ির ভেতর আছে তাঁতের সুতো জড়ানোর ও সুতো কাটার যন্ত্র। আলপনা দেবীর বউমা এগুলোর কাজ কী করে করতে হয় তা দেখালেন। সঙ্গে ছিল চা জলখাবার-সহ উষ্ণ আপ্যায়ন।

রাজবলহাটের শাড়ি ও ধুতি ৮০/১০০ সুতোয় বোনা। একটু মোটা ধরনের হয় ফুলিয়া বা শান্তিপুরের তুলনায়। নকশার ক্ষেত্রেও সাবেকি নকশা অনুসরণ করা হয়। এই নকশা হল রঙ্গবতী, ডবিবুটি, দানিবুটি ইত্যাদি। সুতো মহাজনদের থেকে তাঁতিরা কেনেন। শাড়ি মোটামুটি ৪৫০ থেকে শুরু। নকশা অনুযায়ী দাম হয়। এই শাড়ি মহাজন বা হাটেই বেশি বিক্রি হয়। একটা শাড়ি দেড়দিন মতো লাগে বুনতে।

 

রাজবলহাটের তাঁতিদের আরাধ্যা রাজবল্লভী। এই দেবীর জন্য ১৪ হাত তাঁতের কাপড় লগে। যেটা এখানকার তাঁতিদের তৈরি। এই মন্দির চত্বরের দোকানে এই শাড়ি পাওয়া যায়। পুজোর জন্য এখানে সবাই শাড়ি কিনে পুজো দেয়।

Categories
2021-December-Prabandha

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

মন্টো: সাহিত্যের অন্তরালে সংগ্রাম

প্রাক্কথন: ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে অঙ্গারে এবং তৎকালীন প্রগতিশীল সাহিত্যের নানা কথা। কীভাবে আজ থেকে প্রায় একশো বছরের ওপারে চরম রক্ষণশীল সামাজিক পরিসরে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামির বৃত্তে আটকে থাকা সমাজের পশ্চাদগামী পারিপার্শ্বিকতার অন্ধকার পর্দাটিকে স্রেফ কলমের জোরে ছিন্নভিন্ন করে তৎকালীন সাহিত্যের ফেনিল আবেগসর্বস্বতার বাইরে বেরিয়ে ঘোর বাস্তবকে নিয়ে প্রগতিশীল লেখালেখির সূচনা হল, এবং তা উর্দুতে। আলিগড় হয়ে উঠেছিল এই নতুন পথের কেন্দ্রবিন্দু। সঙ্গে লাহোর, দিল্লি, বোম্বাই। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ লেখকের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে ভারতের প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন। তৈরি হয় প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘ। যাঁদের হাতে তৈরি হবে দেশভাগ-বিক্ষত, ভীত, ক্লিষ্ট এই উপমহাদেশের এক নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভাষ্য, এক শক্তিশালী আন্দোলন, যা পথ দেখিয়েছিল বামপন্থী প্রগতিশীলতার লড়াইকেও। আগের পর্বে লিখেছিলাম সাজ্জাদ জাহির, ডঃ রাশিদ জাহাঁদের কথা। অঙ্গারের কথা। যাকে হাতিয়ার করে ধর্মীয় ও সাম্রাজ্যবাদী সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের নতুন ধারার লেখকেরা। এই আখ্যানে সাহিত্য আঙ্গিক কিংবা ভাষারীতির বিশ্লেষণ বা তার গুণাগুণ বিচার এই কলমচির উদ্দেশ্য না, বরং সেই সময়কে ধরার চেষ্টা করা, আজকের সমকালীনতায় সেই ইতিহাসকে জানা-বোঝা, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাতকে আলোচনার পরিসরে তুলে আনার চেষ্টা মাত্র। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিপ্লবকে কীভাবে দেখব, তার একটা বাস্তব আখ্যান নির্মাণ করা। এই লেখকগোষ্ঠীর সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম, অবশ্যই সাদাত হোসেন মন্টো। এইবারের কিছু কথাবার্তা সাদাত হোসেন মন্টোকে নিয়ে।

মন্টো নিন্দিত, মন্টো অভিনন্দিতও। মন্টো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত। মন্টো উন্মাদ। মন্টো অস্বস্তিকর, বিপজ্জনক। বহুবার ফতোয়া এসেছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর বই, অশ্লীলতার জন্য মামলা হয়েছে ছ-বার, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, হতাশায় ভুগেছেন, কিন্তু তাঁর চারপাশে বয়ে চলা জীবনের প্রতি আকর্ষণ আর তাঁর কলম কেউ থামাতে পারেনি। রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল, সহযাত্রী সবাই একযোগে মন্টোকে খারিজ করে দিলেও তিনি বা তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনাকে থামানো যায়নি। নিজেই মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে লিখছেন— “এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মন্টো এবং তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য… মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে কে মহান গল্পকার, খোদা না সে।” মন্টো একদম এরকমই, গল্প লেখাটা যেন মন্টোর কাছে শুধু লেখা নয়, একটা চ্যালেঞ্জ, স্বয়ং খোদার সঙ্গে। মন্টোর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে গোপিনাথ নারাং লিখছেন, ”মন্টো একজন চিরবিদ্রোহী, দেশাচার আর মহিময়তার বিপ্রতীপে তাঁর অবস্থান, সে শিল্প-সাহিত্য, রীতি-নীতি কিংবা সামাজিক ধারণা, নৈতিকতা অথবা অন্য যা কিছু…।“ প্রেমচাঁদের হাত ধরে উর্দু সাহিত্যে সামাজিক বঞ্চনা আর সুখ-দুঃখের মানবিকতার যে-কর্কশ বাস্তবধর্মী আখ্যানরীতির সূত্রপাত ঘটেছিল, মন্টোর হাতে তা পূর্ণতা পায়। তিনি কলমের আঁচড়ে সমাজকে চিত্রায়িত করেছেন খোলাখুলিভাবে, মহিময়তার বিরুদ্ধে নিরন্তর কলম ধরেছেন, এতটাই তা তীব্র যে তৎকালীন সময় তাঁকে নিতে পারেনি। প্রহসনের ভারতভাগ, বিভাজন-বিদ্বেষ, দাঙ্গা, অনাচার, নির্যাতন, প্রেম-পরকীয়া, পানশালা থেকে বেশ্যাবাড়ি, মানুষের দোষ-গুণ, প্রতারণা থেকে যৌনতা… মন্টো স্পষ্ট, ঝরঝরে, বেপর্দা। এখানেই তিনি হয়তো ইসমত চুঘতাই, রাজিন্দর সিং বেদী বা কৃষন চন্দরের থেকে আলাদা হয়ে যান, তিনি লেখেন আর পুড়ে যান, পোড়ান… “স্বাভাবিকের থেকে এক ডিগ্রী উপরে থাকে আমার শরীরের তাপমাত্রা, আর তা থেকেই বুঝবেন আমার ভিতরে কী আগুন জ্বলছে।“

দেখছিলাম নন্দিতা দাশের ’মন্টো‘। একটি দৃশ্যে মন্টো মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসায় অ্যাসাইলামে ভর্তি হয়েছেন। সংশোধনাগারে উবু হয়ে বসে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছেন কিন্তু উন্মাদ মানুষগুলোর বিচিত্র আচরণ তাঁর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ সবাইকে সচকিত করে ছুটে এল মিলিটারি ট্রাক। এক লহমায় মন্টোকে ফেলে ছবি ঢুকে পড়ে মন্টোর গল্পের মধ্যে। ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের সেই দৃশ্য, যে-গল্প মন্টো বছর পাঁচেকের এই পরবাসে থাকাকালীন লিখেছিলেন… নন্দিতা দেখালেন একজন মানুষ এই ভারত-পাকিস্তান, পাকিস্তান-ভারত ডামাডোলে অস্থির হয়ে একটা গাছের ডালে চড়ে দেশভাগ নিয়ে ভাষণ শুরু করল। সে-গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষাণ সিং, রক্ষীদের অনুনয়-বিনয় বা ভয় দেখানোতে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই। সে নির্বিকার। মুখে রহস্যময় হিং-টিং-ছট, উপর দি গুড় গুড় দি অ্যানেক্স দি বেধ্য়ানা…। হিন্দুস্থান বা পাকিস্তান কোনো দেশই তার উদ্দিষ্ট নয়, পনেরো বছর ধরে সে খুঁজছে টোবা টেক সিং নামের তাঁর গ্রামটিকে। অনেকবার রক্ষীদের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টার পরে অবশেষে সে রাজি হয় কোনো এক দিকে যেতে। একসময় হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের মাঝখানে নো ম্যান্স্ ল্যান্ড-এ হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে সে। তার গলায় সেই বিখ্যাত ছড়াটি শুরু হয়, বদলে যায় তার কথাগুলো, উপ্পর দি গুড় গুড় দি অ্যানেক্স দি মুঙ্গ দি ডাল অব দি হিন্দুস্থান অউর পাকিস্তান। ক্যামেরা যুম আউট করতে থাকে, পর্দায় ভেসে ওঠে মন্টোর মুখ… ’আউর মন্টো‘।

নন্দিতা মন্টো ইয়াত-এর নতুন অর্থ তৈরি করেছেন তাঁর ছবিতে— সংবেদনশীল অথচ নিন্দিত এক শিল্পীর নিজস্ব মনোভূমি, যার কোনো স্থানিক পরিচয় নাই। এই প্রসঙ্গে আর একটি সিনেমার কথা মনে আসে, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ’মেঘে ঢাকা তারা‘। যেখানে নীলকন্ঠের আদলে ঋত্বিককে নির্মাণ করেছেন কমলেশ্বর। একইরকম আবেগতাড়িত, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা আর একজন, যাঁকে সমসাময়িক সময়, বন্ধু, রাজনীতি কেউ রেয়াত করেনি, তাঁকে নিয়ে নিরন্তর কাটাছেঁড়া করেছে, বিচার বসিয়েছে। মন্টোর মতোই তিনিও বলতে পেরেছিলেন, ”আমিও বেমালুম রিফিউজি হয়ে গেলাম…“। দেশভাগ আর সীমানা, কাঁটাতার একইভাবে দু-জনকেই ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল। দু-জনেই অক্লেশে বলতে পেরেছিলেন, “আমরা তো নো ম্যানসল্যান্ডে থাকি, আমাদের কোনো ঠিকানা নাই… দেশ নাই।” তাঁরা কেউই ভাবনার জগতে কোনো বেইমানি করেননি, শুধু নির্মমভাবে ছাল ছাড়িয়ে দেখেছেন, দেখিয়েছেন ভিতরের যন্ত্রণাগুলো। ঋত্বিক আশ্রয় নিয়েছেন চলচ্চিত্রের, মন্টো গদ্যের। মন্টোর গল্পের নির্মাণকৌশল, ভাষা-ব্যবহার আর শিল্পসুষমা তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে, অথচ তিনি অশ্লীল, উদ্ধত, বেহিসাবি। সারাজীবন বামপন্থী ভাবনার শরিক হয়েছেন, আবার আলি সর্দার জাফরির মতো বামপন্থী প্রগতিশীল লেখকেরা এক সময় তাঁকে বলেছেন প্রতিক্রিয়াশীল, দক্ষিণপন্থী। লিখেছেন, মন্টোর গল্প দূ্র্গন্ধে ভরা। ভারত বা পাকিস্থান দুই পারেই মন্টো বিপজ্জনক। আজও। অস্থির মন্টো পাকিস্তান থেকে প্রিয় বন্ধু ইসমত চুঘতাই-এর কাছে একটি চিঠিতে লিখছেন, “কোনও ভাবে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।” ভৌগোলিক অর্থে তো বটেই, দর্শনগতভাবেও শেষপর্যন্ত কাঁটাতার-ঘেরা এক না-দেশের অধিবাসী হয়ে ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকেন মন্টো।

বেঁচে আছেন কি মন্টো? প্রশ্নটা খোঁচা মারতেই থাকে।উত্তরের জন্য মন্টোর বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে ঢুকে পড়তে হয়। বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। লিখে গেছেন প্রবল উদ্যমে— ২২টি ছোটোগল্পের সংকলন, ১টা উপন্যাস, রেডিয়ো নাটকের ৭টা সংগ্রহ, ৩টা প্রবন্ধ সংকলন আর দু-জন চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা, সব মিলিয়ে-মিশিয়ে তিনি আদতেই একজন সাদা-কালো চরিত্র। লেখকজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্রমশ বিপর্যস্ত মানুষটি দেশভাগকে পর্যবেক্ষণ করেছেন অন্য চশমায়, লিখেছেন সর্পিল সময়ের হিমশীতল, গা শিউরানো সব গল্পকথা। একসময় উর্দুতে ফেল করা একজন মানুষ হয়ে ওঠেন উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং আলোচিত লেখক, সাদাত হাসান মন্টো। পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে সমরালয়ে জন্ম ১৯১২ সালে। বাবা মৌলবি গুলাম হোসেন ছিলেন কঠোর ও বদমেজাজি। বাবার কাছ থেকে স্নেহ, ভালোবাসা একটুও পাননি, পরিবারেও উপেক্ষিত ছিলেন সবার কাছ থেকে। ভালোবাসা পেয়েছেন শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকেই, যিনি ছিলেন তাঁর আদরের ’বিবিজান‘। তারপর সারাজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন… পাঞ্জাব থেকে আলিগড়, আলিগড় থেকে বোম্বাই, দিল্লি, লাহোর… উর্দু সাহিত্যের পরিসরে তিনি প্রকৃতই একজন অভিবাসী, নোমাড, একজন জিপসিমানুষ। অসমাপ্ত পড়াশোনার পর অমৃতসরের রাস্তায় রাস্তায় বাউণ্ডুলে জীবনযাপন থেকে লেখক মন্টো হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ’তামাসা‘ গল্প দিয়ে, বারিসাহেবের সাপ্তাহিক ’খাল্ক্‘ পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন আলিগড়ে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আলী জাফরির, যাঁর প্ররোচনায় সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। যুক্ত হন ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনে। মন্টোর দ্বিতীয় ছোটোগল্প ’ইনকলাব পাসান্দ‘ আলিগড় পত্রিকায় ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্যের কারণে আলিগড়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ফিরে যান লাহোরে। তারপর বম্বে। ১৯৩৫ সালে বোম্বাইয়ের ’মুসসাবের‘ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। শুরু হয় মন্টোর সক্রিয় সাহিত্যজীবন। এখানেই বিবাহ ও প্রথম সন্তান আরিফের জন্ম। এরপর ১৯৪২ সালে চলে যান দিল্লিতে, অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র নাট্যকার হয়ে। শিশুপুত্র আরিফের আকস্মিক প্রয়াণে ব্যথিত মন্টো বছর দেড়েক পরেই আবার ফিরে আসেন বম্বেতে। ১৯৪৩ সালে বিখ্যাত ’ফিল্মিস্তান‘-এ গল্পলেখক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বম্বেতেই কাটান। লেখেন, অভিনয় করেন। এরপর দেশভাগের ছোবল। ভারত ছেড়ে চলে যান পাকিস্তানে, লাহোরে। সেটা ১৯৪৮। আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে। হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর কলম থামেনি, ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর ঠিক আগের দিনেও লেখেন ’কবুতর অউর কবুতরি‘ নামে একটি গল্প।

মন্টো নিজেই শুনিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার কাহিনি, ”ঠান্ডা গোস্তের মামলা প্রায় একবছর চলেছিল… এইসময় আমার মনের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কী করব ভেবে কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। লেখা ছেড়ে দিব কিনা ভাবছিলাম। সত্যি কথা বলতে মন এত তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে যে, ইচ্ছে হচ্ছে কোনো কিছুর একটা ব্যবস্থা হলেই লেখার চর্চাটা ছেড়ে দিয়ে কিছুকাল নিরিবিলি জীবন কাটাব। এরপর মনে কোনো লেখার ঝোঁক চাপলে তাকে ফাঁসি দেব… বাধ্য হয়ে নিজের গাঁটের থেকে নগদ টাকা সরকারের তহবিলে গচ্চা দিয়ে দরখাস্ত করলাম। বললাম আমি অমৃতসরের মোহাজির, বেকার, দয়া করে কোনো প্রেস বা সিনেমার কিয়দাংশ আমার নামে বিলিব্যবস্থা করা হোক… যখনই ইন্টারভিউ হল, আমি তাদের সাফ সাফ বললাম, আমার দরখাস্তে যা লেখা আছে তা সবই মিথ্যা, সত্য হল আমি ভারতে এমন কিছু সম্পত্তি রেখে আসিনি, শুধু একটা বাড়ি ছিল। আমি আপনাদের কাছ থেকে কোনো ভিক্ষা চাচ্ছি না, আমার মতে আমি একজন মস্ত বড়ো গল্প লেখক…

আমার কথায় তাদের সুমতি হল। কোনো একটা বরফের ফ্যাক্টরিতে অ্যালটমেন্ট পেয়েও যাচ্ছিলাম, এমন সময় একজন বলল— ’এ তোমরা কী করছ? এ লোকটি যার নাম সাদাত হাসান মন্টো, আদতে একজন বামপন্থী লোক।‘ অতএব আমার দরখাস্ত নাকচ করা হল। ওদিকে এ ব্যাপার হল, প্রগতিশীল লেখক বন্ধুরা আমাকে রক্ষণশীল বলে আমার অন্নজল সব বন্ধ করার ব্যবস্থা করল … অনেক ভেবে চিন্তে আবার কলম হাতে নিলাম…“ (’গঞ্জে ফেরেস্তা‘)

ওই বইটিতেই ’শ্যাম‘ সম্বন্ধে সংবাদপত্রে একটি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক নাইয়ার বানুর এক চিঠি পান। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ”অনেক সিনেমা দেখে মনে হয় যেন কারও নগ্ন অবস্থায় বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছি, আর এটা শালীনতা বিরুদ্ধ। ‘মুরলির ধ্বনি’ আবার একটু পড়ে বলুন তো এটা কোন ধরনের লেখা? একটা লোক যত বড় পাপীই হোক না কেন, এ লেখা ছেলেমেয়েদের মাঝে থেকে সে কী করে পড়বে? সে যত বড় মদ্যপায়ীই হোক বা বেশ্যা বাড়িতে পড়ে থাকুক বা হাজারও অনাচার করুক, সে যখন মনে করবে, ’মাগী কোথায়?’ এবং না পেলে বিছানা জ্বালিয়ে দেয়, তখন কেমন লাগে? এটা কোন ধরনের মনুষ্যত্ব?… সারা জগৎ তো পুরুষদের জন্যই বরাদ্দ নয়, যে যা-তা করে বেড়াবে। নিজেরা তো অধঃপাতে যাচ্ছেই সেই সঙ্গে শিশু সন্তানদেরও সেদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঘর ছেড়ে পালানোর দশা হয়েছে। এখন পুরুষদের হাতে সন্তানের ভার তুলে দেওয়া উচিত, তখন বুঝবে। বাপ ছেলেকে শেখাবে কি কিভাবে মদমত্ত হয়ে থাকতে হয়, শালী মাগী বলে মেয়েদের টেনে নিয়ে যেতে হয়? এইসব কথা খবরের কাগজে ছড়ানোর কি মানে আছে…“।

উত্তরে মন্টো লিখছেন, ”আমি যাই করি না কেন নাইয়ার বানুর প্রতি অবিচার করেছি। আমাকে এর প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত… আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে নাইয়ার বানু যে ধরনের মানসিক রোগগ্রস্ত তাদের প্রতি মানুষের করুণা করা উচিত। তার চিকিৎসা সম্বন্ধে মনে করি তার সামনে বোতলের মুখ খুলে মদের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে, মাথায় কাদা মেখে, মুখে গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে মাতলামি করতে হবে। এরপর শাম, বিশবী সদি, রুমান ইত্যাদি পত্রিকার লেখাগুলো বিজ্ঞাপন সমেত তাকে জোরে জোরে পড়ে শোনাতে হবে …না হলে সাদাত হোসেন মন্টোকে যেন বলা হয় নাইয়ার বানুর পুরোনো স্যান্ডেল এনে নিজের মাথায় মেরে নাইয়ার বানুর পূত-পবিত্রতাকে উদ্ধার কর…“ (’গঞ্জে ফেরেস্তা‘)

এভাবেই দেখেছেন মন্টো সময়কে। শ্লীল আর অশ্লীলতাকে। আপনি কি অশ্লীল? মন্টো লিখলেন, ”আমি জানি না আমাকে কেন বার বার যৌন সমস্যা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়? শিল্পে অশ্লীলতার সংজ্ঞা কি সত্যিই পাওয়া গিয়েছে? পুরুষেরা অশ্লীল কাজকর্ম করলে দোষ নেই, যত দোষ সেই কাজকর্মের বর্ণনা দিলে! লোকেরা আমাকে প্রগতিশীল বলে আখ্যায়িত করেছেন কারণ আমার কয়েকটি গল্প যৌন-সমস্যা নিয়ে লেখা… রুটি আর পেট, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক তো চিরন্তন ও চিরস্থায়ী। রুটি আর পেটের মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর নারী-পুরুষের মধ্যে প্রয়োজনীয়তা কার বেশি তা বলা মুশকিল। লেখক হিসাবে শুধু ঘৃণা আর বৈষম্যের বাস্তবতার সুত্রপাত কেন হয়, এবং কী পরিস্থিতিতে তার জবাব দেওয়া তা আমার গল্পে অবশ্যই পাবেন। যারা আমার গল্পে যৌন আনন্দ খুঁজতে যান, তারা হতাশ হবেন… আমার লেখনীতে যদি নারী-পুরুষের সম্পর্কের বাস্তবিক অবস্থা প্রাধান্য পায় তা অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক ভিত্তিতে যদি একটি দেশকে দ্বিখণ্ডিত করা যায়, ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে যদি এক-কে অন্য থেকে পৃথক করা যায়, একই আইনে যদি জমির মালিকানা হাতছাড়া হতে পারে, তবে কোনও রাজনীতি, আইন, বা বিশ্বাসের দ্বারা নারী-পুরুষকে আলাদা করা যায় না … যারা মনে করছেন সাহিত্য যৌনসমস্যা সৃষ্টি করছে, তারা ভুল করছে, আসলে যৌনসমস্যাই সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে।“

আপনার গল্পে পতিতাদের প্রসঙ্গ এত বেশি কেন?

”রেন্ডিদের কথা বলা যদি অশ্লীল হয়, তবে তাদের পেশাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। ওদের মুছে দিন, তাদের কথাও আসবে না… আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি তা হুবহু অন্যদের কাছে উত্থাপন করি। যদি এই দুনিয়ার সকল লেখক পাগল হন, তাহলে আমিও তাই।“ ’কালো শালোয়ার‘ গল্পের পটভূমি একটি পতিতার কুটির। মন্টোর সুলতানা এই কুটিরে বাস করে। সুলতানা একজন পতিতা, তার পেশা পতিতাবৃত্তি। সমস্ত শহরের পতিতালয়ের মেয়েদের মতোই সুলতানাও তার পেশা নিয়েই দিনযাপন করে। তার জন্য তার কোনো রাখঢাক নাই। অথচ সে নিন্দিত। মন্টো বলছেন, ”অনেকেই পানশালা থেকে ফিরে মন্দির ও মসজিদ-গামী হয়ে পড়েন, আমরা যদি আফিম, ভাং বা মদ্যশালার কথা উচ্চারিত করতে পারি, তাহলে ঐ সব পতিতা কুটিরের কথা কেন উল্লেখ করতে পারি না?“ মন্টো সুলতানাদের উপর কোনো মহত্ত্ব আরোপ করেন না, শুধু তাদের কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন।

মন্টোর গল্পের প্রায় সব চরিত্ররাই সুলতানার মতোই প্রান্তেবাসী। পরিত্যক্ত মানুষ, নারী-পুরুষ। সমাজের মূল স্রোত থেকে বিতাড়িত, তারা কেউ দেশচ্যুত, উদ্বাস্তু, পাগল কিংবা ভবঘুরে, নেশারু, অপরাধী, বেশ্যা কিংবা দালাল, নারী শরীরের ব্যাবসায়ী, ধর্ষক, ড্রাইভার, দোকানদার, অসংগঠিত শ্রমজীবী। মন্টো তাদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের কথা বলে গেছেন। পাশাপাশি খুলে দেখিয়েছেন ওপরতলার গ্লানি ও পাপ, হিংসা ও নিঃস্বার্থতার মিশ্র জীবনকে। প্রগতিশীল লেখক সংঘের সদস্য হয়েও ছকে-বাঁধা সাহিত্য, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি মন্টো। তাই মন্টো অনন্য।

আপনি লেখেন কেন?

”লেখকের অনুভুতি যখন আক্রান্ত হয়, তখনই সে কলম তুলে নেয়… ক্ষত থেকেই একটি গল্পের জন্ম। আজকের লেখক একজন তৃপ্তিহীন মানুষ, ঠিক যেমন একজন বেশ্যা, কিংবা ওই গাড়ির খালাসি, প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে যে আকন্ঠ নেশা করে থাকে। যে বেশ্যা সারারাত জেগে থাকার পর দিনের সময় ঘুমাতে ঘুমাতে গিয়ে স্বপ্ন দেখে, তার ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে চলেছে তারই বৃদ্ধ বয়স… সেই আমার গল্পের নায়িকা…।“ রবিশঙ্কর বল লিখেছেন— “মন্টো আসলে এক ক্ষত, দেশভাগ আর প্রান্তিক মানুষের জীবনের ক্ষত।” আর একটি লেখায় মন্টো এ-ও বলছেন, ”আমি কিছু বলতে চাই, তাই আমি লিখি। আমি কিছু রোজগারের জন্য লিখে থাকি এবং রোজগার করি তাই অনেক কথা বলতে পারি। রুটি ও শিল্পকলার যে সম্পর্ক তা আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো উপায় নেই, তা অনিবার্য।“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘)

আপনি কী লেখেন?

”যা কিছু আমাদের চোখের সামনে ঘটছে, সেই সবকিছুই লেখার বিষয় হবে।“ বার বার বলেছেন যে, যা কিছু আদি অকৃত্রিম ক্ষুধা তাই লেখার মূল উৎস, মানুষের জীবনে খাদ্য এবং যৌনতা এই দু-টি মৌলিক চাহিদাই তাঁর লেখার উপাদান… ”যেসব সামাজিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং যুদ্ধ সম্বন্ধীয় সমস্যা রয়েছে, সবকিছুর পেছনে ঐ ক্ষুধা, চাহিদা…“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘), এটাই আবার সাহিত্যের উপজীব্য। মন্টোর লেখারও। প্রতিদিনের জীবনের যা কিছু অংশ, যা যেমন তাঁকে যেভাবে স্পর্শ করেছে সেভাবেই লিখে গেছেন মন্টো।

আপনি কি প্রগতিশীল?

”না আমি প্রগতিশীল বা কমিউনিস্ট নই, অশ্লীল বা রক্ষণশীলও নই… আমি স্রেফ একজন মানুষ। কিন্তু প্রত্যেক মানুষকেই প্রগতিশীল হতে হয়। তাই আমি নিশ্চয় একজন প্রগতিশীল… আমি সমাজের বদলে বিশ্বাস করি, তাই আমি কমিউনিস্টও।“

এভাবেই মন্টোকে জানা হতে থাকে– তাঁর লেখা থেকে, জীবনচর্যা থেকে, সমস্ত কষ্ট-হতাশা থেকে। কোনো সন্দেহ নাই তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে দাঙ্গা আর দেশভাগ ব্যক্তি মন্টোকে দুঃখ দিয়েছে সবথেকে বেশি। লেখক মন্টোকেও। তিনি ভারত ভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে শুনিয়ে গেছেন রক্ত হিম করা গল্প। গল্পগুলো শোনাচ্ছেন সেই দেশগুলোতে, যেখানে ইতিহাস নির্মিত হয়, যে-দেশগুলোতে শাসকের ইচ্ছা অনুযায়ী অতীতও পাল যায়। এই ইতিহাস ক্রমাগত অস্বস্তিকর, অনিশ্চিত আর বিপজ্জনক বর্তমান তৈরি করে চলে। এর সামনে মান্টো একটা প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। মৃত্যুর পরেও সেই ঝাঁজ এতটুকুও কমেনি। বদলে যাওয়া ইতিহাসের আসল পাঠ নিতে গেলে মন্টোর তুলনা নেই; মন্টো নিজেও সে-কথা জানতেন। তিনি লিখে গেছেন সেইসব অমর আখ্যান। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় ভালবাসার কাঙাল সেই মানুষটিকে যিনি জাত-পাত-ভাষা-ধর্মের বা দেশকালের বিভেদ মানতেন না। তাঁর আত্মার সঙ্গী ’টোবা টেক সিং‘ নামের অলীক এক ঠিকানা খুঁজতে থাকা পাগল চরিত্রটি। সে ধর্মের ভিত্তিতে বুড়োখোকাদের ভারত-পাকিস্তান ভাগ করা মেনে নিতে না পেরে এক কাল্পনিক সীমান্তরেখার দু-পাশে হাত-পা ছড়িয়ে মরে যায়। দাঙ্গায় খুন ও লুটপাটে মেতে ওঠা ইশর সিং নিজের অজান্তে মৃতের সঙ্গে সংগম করে। নিজেও ’ঠান্ডা গোস্ত‘ হয়ে যায় পরে। ’খোল দো‘ গল্পে লাগাতার গণধর্ষিতা আধমরা কিশোরী, কোনো পুরুষ এমনকী ডাক্তার সামনে এলেও দম দেওয়া পুতুলের মতো হাতড়ে হাতড়ে সালোয়ারের গিঁট খুলতে চেষ্টা করে। ’শরিফন‘ গল্পের কাশেম তার কন্যা শরিফনকে নিহত দেখে অন্ধ প্রতিশোধস্পৃহায় এক হিন্দুকন্যা বিমলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশভাগ ও তাকে ঘিরে মানবিক প্রবৃত্তির এতো জ্বলন্ত দলিল আর কোনো লেখকের লেখা হয়ে উঠতে পারেনি। কোনো পক্ষাবলম্বন না করে মন্টো কেবল লিখে রেখে গেছেন। কোনো তত্ত্ব বিশ্লেষণ নেই, কোনো বেদনাবোধও নেই যেন। ১৯৪৭-এর ভারতভাগ আর দাঙ্গার চলমান ছবি মন্টো তুলে রেখেছেন কাগজে আর কলমে! পরোয়া করেননি, অতীত যখন পালটে যাওয়ার নিরন্তর হুমকির মুখে থাকে, তখন মন্টোর লেখা আয়না হয়ে হাজির হয়েছে। হচ্ছে।

মন্টোর অন্যরকম একটি বিখ্যাত গল্প, যার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, ’বু‘ (গন্ধ)। ১৯৪৪ সালে এই গল্প যখন ’আদব-এ-লতিফ‘ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল মহল গল্পটিকে “অশ্লীল” বলে দাগিয়ে দেয়। গল্পের মূল চরিত্র যুবক রণবীরের সঙ্গে একটি নিম্নবর্গ মেয়ের ঘটে যাওয়া সংগম মুহূর্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মেয়েটি এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় রণবীরের বাড়ির সামনে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল। পরনে ভিজা কাপড়। রণবীর তাকে নিজের ঘরে ডেকে নেয়, কাপড় বদলানোর সময় চোলি খুলতে না পেরে মেয়েটি তার সাহায্য চায়। মন্টো সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন, ”রণবীর ওর পাশে বসে চোলির গিঁট খোলার কাজে লেগে গেল। কিন্তু কিছুতেই যখন খুলছে না, বিরক্ত হয়ে একহাতে চোলির এক প্রান্ত ধরল, আর অন্যহাতে অপর প্রান্ত ধরে সজোরে টান মারল। গিঁট খুলে গেল। রণবীরের হাত দুইপাশে সরে গেল। চোলির তলা থেকে দুটি কম্পিত স্তন বেরিয়ে এল। রণবীর মুহূর্তের মধ্যে দেখল, তার হাত দুটি সেই ঘাটিন মেয়েটির দুই স্তনে— কুশলী কুম্ভকার যেমন নরম মাটির তাল দিয়ে পেয়ালা বানায়— সেভাবেই দুটি পেয়ালার আকার দিয়ে ফেলেছে সে… ধূসর রঙের সেই যুবতীর বুক সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক আর অদ্ভুত দ্যুতিময়। কালচে গম রঙের নীচে এক ধূসর বিভার পরত ছিল যা সেই অলৌকিক দ্যুতির জন্ম দিয়েছিল…

সারা রাত রণবীর ওর শরীর থেকে অদ্ভুত রকমের গন্ধ পাচ্ছিল। সেই গন্ধ একইসঙ্গে সুগন্ধ ও দুর্গন্ধ মনে হচ্ছিল। সারা রাত সে সেই গন্ধ পান করেছে। ওর বগল থেকে, ওর বুক থেকে, ওর চুল থেকে, পেট থেকে…। ওর সর্বাঙ্গে সেই গন্ধ, সে সারারাত ভেবে কূলকিনারা করতে পারেনি এই নীচবর্ণের মেয়েটি তার এত কাছে থেকেও এত ঘনিষ্ঠ হতে পারত না যদি ওর শরীর থেকে এই গন্ধ না পাওয়া যেত। এই গন্ধ তার মন ও মস্তিস্কের প্রত্যেক স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল…“

গল্পের শেষে মন্টো দেখিয়েছেন, রণবীরের নব বিবাহিতা স্ত্রী-র দুধসাদা গায়ে হেনার আতরের খুশবু। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও নিঃশেষ হয়ে আসা হেনার সুগন্ধের মধ্যে সেই গন্ধ রণবীর খুঁজে পেল না, যা সেদিন বৃষ্টিভেজা রাতে সেই ঘাটিন মেয়েটির ময়লা শরীরে সে পেয়েছিল। এভাবেই মন্টোর গল্পের আখ্যান এগিয়ে চলে এক অনায়াস, অকপট ভঙ্গিতে। পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে সামাজিক ট্যাবুকে টুকরো টুকরো ফেলার সাহস, যা কারোর পরোয়া করেনি। কোনো কোনো প্রগতিশীল লেখক ’গন্ধ‘-কে ’দুর্গন্ধ‘ বলেও অভিহিত করেন। অথচ একইসঙ্গে রূপকধর্মী এবং লিরিকাল, বস্তুবাদী এবং মানসিক জটিলতার বহুমাত্রিকতা মিশিয়ে এরকম গল্প এই উপমহাদেশে খুব কম লেখকই লিখেছেন। এখানেই তিনি অন্যরকম… ”যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি, তার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় না থাকে, আমার গল্পগুলো পড়ুন। আপনি যদি আমার গল্পকে সহ্য করতে না পারেন, তবে বুঝবেন, এই সময়টাই অসহনীয়।“

মন্টো শুধু বেপরোয়া নন, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী।— “মন্টো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী ছিলেন। সমাজের বিদ্রোহী, সাহিত্য ও আর্টের বিদ্রোহী, সমস্ত মহিময়তা অথাৎ Doxa-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহী”, লিখেছেন গোপিনাথ নারং। তিনি বারবার অচলায়তনের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছেন। লেখকের পেশাদারি মর্যাদা চেয়েছেন, লেখার উচিত মূল্যের কথা বলেছেন। পত্রিকা নামক ব্যাবসায় ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবি করেছেন। সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেছেন— ”আমি চাই বিদ্রোহ। সেই সকল লোকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যারা আমাদের পরিশ্রম করায়, কিন্তু পারিশ্রমিক আদায় করে না। আমি চাই বিদ্রোহ, সাংঘাতিক ধরনের বিদ্রোহ… আমি সেই আবরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চাই যা আমাদের পুঁজিপতিরা দীর্ঘদিন ধরে লেখকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, স্বার্থসাধনের জন্য। এই আবরণের জন্য যে চেতনা তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, আমার বিদ্রোহ সেই চেতনার বিরুদ্ধে, যা বলে লেখালেখি ব্যাপারটা নিছক একটা নেশা… আমাদের এক বিরাট যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এসো আমরা একটা সংঘ গড়ে তুলি। আমরা সকলে মিলে এক হয়ে যাই, যদি আমরা সকলে মিলে আমাদের কলমগুলি এক স্থানে রাখি, তাহলে একটা পাহাড় গড়ে তুলতে পারি…“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘)।

মন্টো যুক্ত হয়েছিলেন সাজ্জাদ জাহিরের উদ্যোগে গড়ে ওঠা নিখিল ভারত প্রগতিশীল লেখক সংঘে। সেখানে তিনি ও ইসমত চুঘতাই, কৃষন চন্দর বা সাহির লুধিয়ানভিদের মতো ভারতের প্রথমসারির যুক্তিবাদী প্রগতিশীল লেখক কবি নাট্যকারেরা সংগঠিত হচ্ছেন, রক্ষণশীল স্থবিরতার বিরুদ্ধে কলম শানাচ্ছেন। জীবনের বাস্তবতায় যা দেখছেন, তাকেই কথাশিল্পে উপস্থাপিত করছেন। মন্টোও তাই। বরং খানিকটা বেশিই ”এলাকায় পুরোদমে লুটতরাজ চলেছে। তারপরে যখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল, সব বিষম গরম হয়ে উঠল। ওরই মধ্যে একটা লোক কাঁধে একটা হারমোনিয়াম চাপিয়ে পরমানন্দে গান গাইতে গাইতে ছুটল … ’যব তুম হি গয়ে পরদেশ লাগকর তাইশ, ও প্রীতম পিয়ারে, দুনিয়া মেঁ কৌন হামারা…?” (’কালো সীমানা‘)। এরকমই মন্টো। দিশেহারা অক্ষরগুলোর মধ্যে মন্টো হেঁটে চলেন আগ্রহী চোখে। খুঁজতে থাকেন চরিত্র। জড়ো করেন শব্দ। পরে সেগুলোকে কাগজে সাজিয়ে নেন। যে-শব্দ, যে-কাগজ, সমস্ত লেখা মন্টোর মৃত্যুর পরেও তাকে মুছে যেতে দেয় না। হ্যাঁ, মন্টো বেঁচে থাকেন।

আপাতত শেষ করব মন্টোর একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে, ‘জবাই আর কোপ’…

“আমি লোকটার গলায় ছুরি ধরলাম, ধীরে ধীরে পোঁচ দিয়ে জবাই করলাম।”

“এ তুই কী করলি!”

“কেন?”

“জবাই করলি কেন?”

“এভাবেই তো মজা!”

“মজার বাচ্চা, তুই কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এইভাবে…”

আর জবাই করনেওয়ালার গলা এক কোপে আলাদা হয়ে গেল।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মন্টোকে ফিরে দেখা প্রয়োজন। সেই যে লাইনগুলোয় মন্টো লিখে রাখেন… ”যে নেতারা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে ঘৃণা জাগিয়ে তোলেন, তাদের আমি এই দাঙ্গার জন্য দায়ী মনে করি… ধর্মীয় অপপ্রচারের শয়তানিতে যারা মাতে, ভারতের স্বাধীনতার সৌধ তাদের হাতে গড়া হতে পারে না। তারা শুধু আমাদের স্বাধীনতার শত্রু নয়, মানবজাতির শত্রু।“ (’ভাগ‘)। এটাই তো আজকের কথা। আজকের বিভাজিত সময়ের কথা। এই জন্যই মন্টোকে বাঁচিয়ে রাখা বড়ো দরকার।

ফিরে আসি ’মন্টো‘-তে। ওই যে, এক লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন মন্টো। দৃষ্টি বিষণ্ণ। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে গানের সুর…

“বোল কে লব আজাদ হ্যাঁয় তেরে…”

ঋণ:
১. সাদাত হাসন মান্টো রচনা সংগ্রহ, রবিশঙ্কর বল।
২. ‘গঞ্জে ফেরেস্তা’, সাদাত হাসান মান্টো।
৩. মান্টোর প্রবন্ধ সংকলন, জাফর আলম।
৪. ‘ঠান্ডা গোস্ত’, সাদাত হোসাইন মান্টো, অনুবাদ: কাউসার মাহমুদ।
৫. ‘নেকেড ভয়েস’, ‘স্টোরিজ অ্যান্ড স্কেচেস বাই সাদাত হোসেন মান্টো’, আনন্দবাজার পত্রিকা।

Categories
2021-December-Kobita

নম্রতা সাঁতরা

নদ্যম্বু


আমি জেগে থাকতে চাই,
নুড়ির মতো কিছু ব্যথা নিয়ে
ধারালো আর প্রকট—
ভোঁতা, নরম হতে
তোমার বুকের মধ্যে কিছুদূর ঘুরপাক দরকার।


অনেকটা মরার মতো শুয়ে থাকি
পারের পলি হয়ে।
চাঞ্চল্যর জন্য দরকার
একটু জল,
বর্ষাকালে ফুলে উঠে
পাড় ভাঙবে যখন—
বন্যা হবে, সেই প্রথমবার পলি গুলে যাবে জলে।


এ নিরন্তর হাওয়ার খেলা।
তোমার থেকে আমার দিকে,
আমার থেকেও তোমার।
যে যত ঠান্ডা হয়
তার থেকে হাওয়া বয়।


তোমার সাথে আমার বার্ধ্যক্যদিন এগোচ্ছে,
অনুরাগীরা আসে যায়-
ডুব দেয়, তবু মনে মনে চায় ভেসে উঠতে।
সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায় শুধু কাদা।


যতই এগিয়ে চলো,
আঁচড় দাও,
হাঁটো হাজার মাইল।
সাগরের কাছে, রেখে যাওয়ার লোভ,
সাধারণ মজুরের মতো—
তোমাকেও হাত পাততে বাধ্য করে নুনের জন্য।


যারা থাকতে পারে তোমার উপর
তারা বেশির ভাগ আরোপিত,
অসম্মত বিবাহিতার মতো স্পষ্ট হয়ে যায়
মন ও বুকের ফারাক।
মনে ভাসে মাঝি— নৌকা,
বুকের মধ্যে জলাধার।

Categories
2021-December-Kobita

সৌরভ মাহান্তী

দেয়াল

শোক নাকি আনন্দ
কে যে কাকে গোপন করে?

বাইরের যাবতীয় আঘাত, রাখি সযত্নে…

জানালা

খাঁচার ভিতরে ঢুকে থাকিস

সুদিন এলে,
বুকের পাঁজরে সোনা বাঁধিয়ে দেব

ছাদ

মধ্যবিত্ত ফুটপাতের তলায়
জোৎস্না ঝরে পড়ে

যেন না-ছুঁতে পারা বাবার যন্ত্রণা…

উঠোন

তোমাকে মাড়িয়ে যাব এমন সাধ্য কই?

আলপনাতে পা দিতেই
পদবি বানাই লক্ষ্মীছাড়া

মেঝে

বিষ পেতে দিই বুকে

এক্ষুণি তো অবাধ্য শিশুর গ্রাস,
ছিনিয়ে নেবে বেহায়া লোকটি…

তুলসিতলা

নিভে যাওয়াতেই আপত্তি
দিন দিন ভরাট হয়ে উঠুক সংসার

ভুলেও ঠান্ডা করিসনে প্রদীপ

 

 

Categories
2021-December-Kobita

ইন্দ্রজিৎ নন্দী

বাদুড়কলোনি


বাদুড়ের ভালোবাসা সহজেই অনুভব করা যায়
কেন-না, শহরতলির শেষে নগ্ন মৃতপ্রায়
তাদের চিন্তাহীন ঝুলে থাকা!

সম্পর্কের ভিতরে বাড়ে তুমুল সম্পর্কতাপ।
তুমি টের পাও ঢের জীবন বেঁচে থেকে
আর বাদুড়েরা টের পায় কয়েক মুহূর্তে!
যখন অপরপ্রান্ত ভালোবাসায় ধাক্কা লেগে ফেরে আল্ট্রাসোনিক,
তাদের এই ঝুলে থাকা সম্পর্ক শান্তির কিংবা প্রেমের সমধিক।


তোমাকে আমি প্রেমিকা হিসেবে অল্পই চিনি।
যখন যখন রোদ পড়ে আসে প্রেমিক দারুচিনির,
হেমন্ত আঁকা গাছটার নিচে আমাদের দেখা হয়,
সময়টা বোধ’য় খারিফ শস্য কাটার সময়…

মাঠে ধান নেই, ইঁদুরেরা কেটে নিয়ে গেছে ঘরে
ওদিকে ঠোঁটখড় বয়ে ফেরে শালিখ শহরের
মাঠের একপাশে দারুচিনি, অন্য পাশে পিপুলের শান্ত কলোনি।
বাদুড়-মেঘের উলটো দিকে ঝুলে থাকা ন্যাসপাতি ফল যেমন
সেভাবেই আমরা ভালোবাসাটুকু চিনে নিই।


ছিল না শিমুল কাঠের ছলনা;
পর্যটক পাতা সাজিয়ে রাখে অর্জুন সামিয়ানা!
পাতার নীচে ঘুরতে আসে ট্যুরিস্টব্যাগ— অ্যাটাচিকেস,
সম্পর্কের মতো শিমুল, হাওয়া লেগে চিপকে একশেষ
পর্যটক মাথায় লাগে, গায়ে লাগে, ওড়ে
উড়তে উড়তে সারারাত জাগে, সমস্ত রাত জাগে

জাগতে জাগতে বাদুড় হয়ে যায় বাদুড়ের পড়শী পাতাটিও
যা কিছু ওড়ে তাদের বাদুড়বশে পালক ভেবে নিয়ো!


বৃষ্টি পড়লে এক ফুলের হৃদয় পুকুর হয়ে যায়
চুলের খোঁপা থেকে বয়ে চলে গন্ধরাজ নদী;
নদীর জন্য এক পৃথিবী ভালোবাসা রেখে
ঝরে যায় শালবন পাতা।
পাতা বয়ে গেলে নাম জানা হয় না খরস্রোতার।

নদীর মতো করে একবার সে-পাতার শরীর তুলে ধরো,
পারো! সংসারের ভিত নাড়িয়ে চলে যেতে তুমি পারো।

নড়বড়ে ভিত শিকড়ের উপর তীব্র মেঘের সংসার বানাব
আমরা দু-জন, দূর থেকে মনে হবে পাখি!
দিনশেষে আমরা আসলে ঘোরতর স্তন্যপায়ী।


একটা প্রেমের প্রতি আমরা বরাবরই উদার
যে-প্রেমে চুলে পাক ধরে জারুলপাতার
কিংবা বুড়ো পাতা পড়ে ভরে ওঠে শিউলি সরোবর;
পড়ে যায়, ডুবে যায় বুক অবধি ভিজে শাড়ির মতো,
এ-সব অনেক পুরোনো পদ্ধতি— ইতিহাস লিখিত

এক শরীরের ইতিহাস লিখতে গিয়ে
প্রায়শই নিমগাছ কিংবা নিয়ামক সানন্দার তীরে
ঝুঁকে পড়া মেধা নিয়ে— জলের উপর জেলেপাড়ার নিম
বাদুড় শরীরের মতো তার ছায়া গভীর— অসীম।

অসীমের উপরে জল, নীচেও স্মৃতির মতো কালো নিমরাজি জল,
মাঝখানে তিতো অস্তিত্বের মতো সোহাগ কিংবা গাঢ়তর নিমফল।

Categories
2021-December-Kobita

প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী

লুব্ধক

জলে স্পর্শ করে গেছি, একটি নক্ষত্র রাতে নেমে এল বলে
বহুদিন পরে এল, বহু সন্ধ্যা পার করে, দৃষ্টি বিহ্বল

এল এই, নিমেষেই জ্বেলে দিল অপ্রতিম আলো
সে-আলো শরীরে মেখে, অন্ধকার হয়ে গেছে স্ফটিক স্ফটিক!

ঘনভার রাত্রি নামে, আদিগন্ত ভেসে যায় শূন্যের গহ্বরে
আমি সে-আলোর আভা মুঠো ভরে রেখে দিই শ্লোকের মতন

দ্বন্দ্ব

আমার সমস্ত দিন যদি-বা জোনাকি আলো খোঁজে
সন্ধ্যে নামে যত্র তত্র, ফিরে যায় শালিকের দল
ক্যাকোফোনি পৃথিবীর তারই মধ্যে আকাঙ্ক্ষা নিষ্ফল
তারই মধ্যে মৃদুস্বর কখনো শ্রুতিতে বেজে ওঠে
বাদামি খামের পিঠে টুকরো অক্ষর লেখা হলে,
বোধহয় সে-অক্ষরই দীর্ঘ কবিতার কোনো পাতা
কবে সে কবিতা শুরু, কবে তার বেড়েছে আকার
জানে না এখনও কেউ বন্ধ থাকা দেরাজের তাকে
তরঙ্গ বাহিত হয়ে চলে আসে আলো হাওয়া তার
এমনও মুহূর্ত আসে সমস্ত ক্লান্তিই নির্ভার
হতে চায় তার কাছে, আবার দ্বিধায় করে ভর
ভেঙে ফেলে সকালেই রাতের বানিয়ে তোলা ঘর

জন্মান্তর

তুমি ভাবো হাল ছেড়ে চলেই এসেছি
চলে তো এসেছি বহুদিনই
তবুও প্রতীক্ষমাণ জীবন আমার
ঘাসের সবুজে আর নরম হৃদয়ে
পা ফেলেছি অতি সাবধানী

যে-সময় চলে যায়, দ্রুতগামী যে-সময়
পারিনি রাখতে ধরে শিখিনি কৌশল
প্রতীক্ষা শিখেছি শুধু, সামান্য সম্বল

ঘাসের সবুজে আর নরম হৃদয়ে শুনি
‘এ-জন্মে ঘেঁটে গেছে সব’
শাখা প্রশাখায় তবু পরিযায়ী থেকে যাই
যে-থাকা দুরূহ সম্ভব!

অপারগতা

আবাহন নেই মানে বিসর্জন নয়
তুমি তা বোঝো না, জানি। তুমি তা জানো না
ঘুমের ভিতর থেকে যে-সব অক্ষর
ম্লান হয়ে পড়ে থাকে ঘরের কোণায়
সঙ্গহীনতার কথা তারা কিছু জানে
বাকিটুকু মিশে যায়, হাওয়ায় হাওয়ায়

সমস্ত জীবন ধরে অপেক্ষা করেছি
ধীর এলে দ্রুতপাখি বড়ো অসময়ে
ভ্রমণ পিপাসু তবু বুঝতে পারো না?
পাহাড়ের বিপরীত সমুদ্র নয়!

একটি সরল বাক্য

অনন্ত ফসল খেত পারাপার করে
পৌঁছেছি তোমার কাছে, নিষ্ফল দিন!
গতিহীন এই পথে ক্ষতের উপর
বিছিয়েছি রোগশয্যা, নিরাময়হীন

আরও কি আঘাত বাকি? বাকি আছে আরও?
প্রস্তুতিও সেইমতো শুরু হোক আবারও… আবারও…

একটি সরল বাক্য বুঝে গেছি শেষে
সরল হয় না পথ।
হয় জটিল, নয় জটিলতর…

 

Categories
2021-December-Kobita

সুমন সাধু

ইনসমনিয়া

একটা বিছানা
সরু হয়ে শুয়ে আছে ঘুম
কে গান শোনাবে, কে গল্প করবে
আমি হাই তোলা সহযোগে
ফেলে রাখছি ওষুধ
এদিকে একটা শালিখ
শরীর থেকে কিছুতেই উড়তে চাইছে না

গুহার মতো অন্ধকার

ঘুম থেকে তুলে নিয়ো এক-একটি নাম
বাসন মাজার মতো বারকতক ঘষেমেজে যখন
সোনাটি খেলে যাবে নামে নামে
তখন নামের গায়ে জুড়ে বসবে পেখম
ডানা চাইলে সমুদ্র দেখিয়ো
দেখিয়ো রাষ্ট্র, উত্তাপ, দেশদ্রোহী, সমকামী জাতীয়
শব্দ বিশেষ
ঘুম থেকে উঠে তাদের নামের গায়ে লিখে দিয়ো
সমস্ত খুন আসলে গুহার মতো অন্ধকার

ঢেউয়ের প্রতি


একটা বিশাল গর্জনের লোভে বেরিয়ে পড়েছিলাম প্রিয় আলোকচিত্রীটির সঙ্গে। অযথা ফালতু সময় দু-জনকে খেয়ে ফেলছিল। সমুদ্রে ফাটল ধরলে বন্ধু ব্যাগ থেকে বের করে আনত ক্যামেরা। আমি আরামকেদারায় তাস খেলা সহযোগে মিলিয়ে নিতাম হরতন ইশকাপন। দু-জনের বন্ধুত্ব হত বেশ। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে আলোকচিত্রী ফ্রেম খুঁজে নিত। রাজার পাশে নিত আমাকেও। সেই আমাদের প্রথম হাত ধরা। প্রথম শরীর স্থাপন।


তারপর একটা ফ্রেম এল। যেখানে ব্লার করা থাকবে সমুদ্র, গর্জন। কয়েকশো মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আলোকচিত্রী। এই লং ডিসটেন্সের স্বভাবে জুড়ে বসবে পাখি। শহরের সমস্ত অবিবাহিতরা মুছে দেবে প্রথা। সেই ভাঙন থেকেই একটা লেখা লিখতে চাই।


একমাত্র সমুদ্র জানল। বাকিটা জুড়ে পড়ে থাকল গর্জন। গর্জনের কথা কেউ শুনতে পায়নি।

একার মতন একা

একা থাকার নেশা লেগে গেছে একরত্তি শরীরে
একার এই সফরে কিছু মানুষ থেকে যান তুমুল
আসেন, আর হুব্বার মতো এতিম করে দেন
ভাবি, গায়ে গতরের জোর
বন্ধুহীন এই পৃথিবীতে বন্ধুদের তরজা
জীবনানন্দীয়, নাগরিক ক্লান্তি মুছে
আমার হাত ধরে নিয়ে যায় মিছিল
ভিড়ের শহরে, একাদের খারাপ থাকতে নেই

আবার ঘুম

বাড়ির বাইরে একটা দুনিয়া যখন মজা দেখায়, তখন তোমার শয়নকক্ষে হাজির হয় ঘুম। যাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না।

আয়ুরচিত

বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগলে তোমার কথা ভাবি। আমাদের একসঙ্গে পাহাড়কোলে উদ্দাম বৃষ্টিতে ভেজার কথা ছিল। তারপর অবাধ্য সর্দির জল, হাঁচি, কাশি, প্যারাসিটামল। আমাদের প্রেমের আয়ু সামান্য। যদিও শরীর এখনও তাজা আছে। তার আয়ু কি শতাধিক?