লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কথাসাহত্যিক সুবোধ ঘোষকে নিয়ে অরিন্দম গোস্বামীর ধারাবাহিক প্রবন্ধ

দ্বিতীয় পর্ব

সুবোধ ঘোষের গল্প 

দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টা বাঙালির কাছে ছিল স্বপ্ন-বিদ্রোহ-স্বপ্নভঙ্গ-হতাশা আর বিপর্যয়ের চলচ্চিত্র। মানুষ তখন মানুষের ওপর হারিয়ে ফেলেছে বিশ্বাস, পুরোনো ঘরবাড়ির মতো ভেঙে পড়েছে আদর্শ আর মূল্যবোধের এতদিনকার লালিত সৌধ। ঐ সময়ের শেষ পরিণতিতে কলম ডুবিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা লগ্নে ছোটোগল্প রচনার সূচনা করলেন সুবোধ ঘোষ।
মধ্যবিত্ত মানুষের অবক্ষয় আর অভিশপ্ত অস্তিত্ব এক নতুন মাত্রা পেল সুবোধ ঘোষের লেখনিতে। এই সময়ের অন্যতম কথাকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে যদিও এই লেখার রূপ খানিকটা আলাদা।
বহুল প্রশংসিত ‘ফসিল’ গল্পের কথাই না হয় ধরা যাক। সামন্ত রাজার মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব মধ্যবিত্ত আদর্শবাদী মি. মুখার্জির। তার স্বপ্ন সে দেখিয়ে দেবে রাজ্যশাসন লাঠিবাজি নয়, এটা একটা আর্ট— সে দেখিয়ে দেবে। রাজ্যের কৃষির উন্নতির জন্যে সে পরিকল্পনা করে আড়াআড়ি দশ-বারোটা খাল কাটাতে। আর, রাজ্যের ঊষর জমি জিওলজিক্যাল সার্ভে করে খুঁজে বের করে কোয়ার্টজ আর গ্রানিট আর অ্যাসবেস্টসের বিপুল ভাণ্ডার। তারপর জমি জরিপ হয়, টেন্ডার ডাকা হয়। ইজারা নেয় বহুজাতিক বিভিন্ন সংস্থা।
এই সংস্থারা তৈরি করে খনি মালিকদের সিন্ডিকেট। রাজ্যের মজুরদের নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে তুলে আনে নিজেদের ধাওড়ায়। রাজ্যের নিজস্ব কাজের শ্রমিকের যোগানে পড়ে টান। পোলো খেলার সময় মুখার্জি দেখতে পায়, রাজার চোখে জল। শোনে, ব্যাঙের লাথি আর সহ্য হয় না মুখার্জি!
তারপর একদিন খনির ছাদ ধসে আটকে, চাপা পড়ে মারা যায় অনেক শ্রমিক। ঐ দিনেই ঘোড়ানিমের জঙ্গলে বনের পাহাড়ায় থাকা রক্ষীর মুঙ্গেরি গাদা বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দেয় আরও বেশ কয়েকজন প্রজা। মুখার্জি রাজাকে পরামর্শ দেয় দ্রুত প্রজাদের নেতা দুলাল মাহাতোকে আটক করার। শেষে ঐ খনি গহ্বরে ধসে চাপা পড়া শ্রমিক, গুলি খাওয়া প্রজার দেহের সঙ্গে স্হান হয় দুলালের-ও।
মধ্যবিত্ত এখানে নিজের থেকে হন্তারক নয়, কিন্তু মুখার্জির এই পরামর্শ ছাড়া কি এত দ্রুত মানুষগুলোকে ফসিল বানানো সম্ভব হতো? গিবসন যখন পিঠ চাপড়ে মুখার্জিকে বলেন, ওয়েল ডান, যখন উৎসাহ দিয়ে বলেন, তোমার জন্যেই অনেক ক্লামজি ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া গেল, তখন মধ্যবিত্তের প্রগতিশীল মানসিকতা সত্ত্বেও নিমকের দাম মেটাতে গিয়ে বৃহত্তর মানুষের লড়াইকে পিছিয়ে দেওয়ার যে কর্মকাণ্ড অনাবৃত হয়ে যায়, সেই কথাই শিল্প-সম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন এই কথাকার।
সুবোধ ঘোষের আর এক বিখ্যাত গল্প ‘গোত্রান্তর’-এও এইরকম কপটচারী মধ্যবিত্তের দেখা পাই। সংসারে সবকিছুই উপার্জনের নিরিখে বিচার্য হচ্ছে দেখে যে স্বেচ্ছায় গোত্রান্তরিত হতে চলে গিয়েছিল সুদূর উত্তরপ্রদেশের চিনিকলের কাজ নিয়ে। সেখানে শ্রমিক নেতা নেমিয়ার আর তার বোন রুক্মিনীর সান্নিধ্যে সে ভেবেছিল তার গোত্রান্তর সে ঘটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এমন সময়েই ঘটে যায় দুর্যোগ। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম পড়ে যাওয়ায় মিল মালিক শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। উত্তাল হয়ে ওঠে শ্রমিক আন্দোলন। নেমিয়ার মধ্যবিত্ত সঞ্জয়ের কাছে চাবি চেয়ে নেয়। চাবি দিয়েই সঞ্জয় বুঝতে পারে তার গুরুত্ব। রুক্মিনীর তখন প্রসবের সময় আসন্ন। সঞ্জয় রুক্মিনীর মৃত্যুর কথা ভাবে। একছুটে সে চলে যায় এই খবর নিয়ে মালিকের সহায়তায়। সেখানে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এলাকা ছাড়ে সে। পথে পড়ে এক নালা। সুবোধ ঘোষ দেখান ঐ নালায় জল মুখে দিতে আসা সঞ্জয়ের সঙ্গে পরপারের জল খেতে আসা এক জম্বুকের কোনো পার্থক্য নেই।
এমনি করেই ‘উচলে চড়িনু’ গল্পের দীনেশ ব্যবহার করে মজুরনী বিলাসীকে। কৈলাস ডাক্তারের ভদ্র ছেলে সুকুমারের কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়ে পশ্চিমা বেদিয়ার মেয়ে কূরূপা তুলসী। শেষপর্যন্ত অন্তঃসত্ত্বা তুলসীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে ঐ সুকুমার। যে সত্য ময়নাতদন্তের টেবিলে লাশ ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন কৈলাস ডাক্তার ‘সুন্দরম’ গল্পে।
‘তিন অধ্যায়’ গল্পের অহিভূষণের বন্ধুরা শুধুমাত্র অহমিকা দেখাতে গিয়ে বারবার ভেঙে দেয় বন্ধুর বিয়ে । জুতার দোকান করায় বন্দনার বাবাকে চামার বলতেও তাদের বাধে না। কিন্তু অবশেষে এই সমস্ত বাধা কাটিয়ে যখন অহিভূষণ-বন্দনা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় তখন সমাজের ধ্বজাধারী এই বন্ধুর এ প্রতিজ্ঞার সামনে পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
‘চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ’-এ এই মধ্যবিত্তের সন্তানরাই টুডু, খালকো, বেসরাদের চরমভাবে নিজেদের প্রয়োজনে ব‍্যবহার করে। ‘পরশুরামের কুঠার’ গল্পের ধনিয়া এইভাবেই সারাজীবন ভদ্রলোকের বাড়িতে শিশুদের প্রাণপীযূষ যুগিয়েও, শেষপর্যন্ত সমাজের বাইরে দেহপসারিনীর জীবিকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
‘বারবধূ’ গল্পের পঞ্চিবিবি তার আপ্রান চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয় নিজেকে গৃহবধূ লতা হিসেবে পরিচিত করতে। লতা এখানে তার পদচ‍্যুতির জন্য আভা ঠাকুরজির নাম নিলেও প্রসাদের প্রেমহীন কর্তব্যহীন ভূমিকা আমাদের বিমূঢ় করে। ‘কাঞ্চন সংসর্গাত’ গল্পের অটলনাথের নির্লজ্জতা আরও প্রকট। সে তার সহকারী কান্তিকুমারের প্রেমিকাকেই নিজের অঙ্কশায়িতা করে কান্তিকে দিয়ে নিজের জীবনী লেখাতে চায়— যে জীবনীতে সে উপাধি নিতে চায়: ‘বাণিজ্যঋষি’!
‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ গল্পের প্রফেসর বিমল বসু, ‘নির্বন্ধ’ গল্পের বিভূতি দারোগা, ‘কোটেশন’ গল্পের ভাস্কর বসু বা ‘হৃদঘনশ্যাম’ গল্পের গুলিখোর ভণ্ড শ্যামানন্দ— সবাই কম বেশি ছদ্মবেশে থাকা সুযোগসন্ধানী মধ্যবিত্তের সন্তান।
যে সমাজ-ব্যবস্থায় আর্থিক অনুগ্রহ দিয়ে মানুষকে কিনে নেওয়া যায়, সেই সমাজে মানুষ কতদূর অমানুষ হয়ে যেতে পারে, সুবোধ ঘোষ সেটা দেখিয়েছেন। আরও দেখিয়েছেন সুযোগসন্ধানী মধ্যবিত্ত বাঙালি এই ঘোলাজলে মাছ ধরতে কতটা সিদ্ধহস্ত। বিগত শতাব্দীর মধ্যবিত্তের মুখোশের পিছনে থাকা আসল চরিত্রের খোঁজে অনুসন্ধানী পাঠকদের তাই বারবার ওলটাতেই হবে সুবোধ ঘোষের ছোটোগল্পের পৃষ্ঠা।

Facebook Comments

পছন্দের বই